গুচ্ছকবিতা
জিয়াউদ্দিন লিটনএক অসমাপ্ত প্রেমের প্রত্যাবর্তন
(দ্বৈত কণ্ঠে আবৃত্তিযোগ্য আখ্যানমূলক সংলাপ কবিতা)
কবি: — তুমি! হঠাৎ এভাবে সামনে!
কবিতা: — হ্যাঁ, আমি-ই… যেন হারানো ঋতু ফিরে এলো।
কবি: — বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, এতোদিন পরে…
কবিতা: — তবু দেখো, মুহূর্তেই সব দূরত্ব মুছে গেল।
কবি: — মনে আছে? আমাদের প্রথম পরিচয়—
ফেসবুকের নীল পর্দায় একটুখানি শুভেচ্ছা,
যেন শুকনো ডালে প্রথম কুঁড়ির উঁকি।
কবিতা: — হ্যাঁ, সেই শুভেচ্ছাই তো নিঃশব্দে
জড়িয়ে ফেলেছিল আমাদের অজানা ভুবনে।
কবি: — কত রাত আমরা লিখেছি,
শব্দে শব্দে জ্বালিয়েছি নিভু প্রদীপ।
কবিতা: — তোমার প্রতিটি বাক্য ছিলো কবিতার মতো,
আমার হৃদয় তখন পাঠক, উন্মুখ, অস্থির।
কবি: — শব্দগুলোই তখন ছিল আমাদের দেখা,
তুমি ছিলে অক্ষরের মাঝে ঝলমল হাসি।
কবিতা: — মনে আছে? তুমি লিখেছিলে—
“কবিতার চোখে যদি প্রেম ঝরে,
তাহলে আমি সেখানেই জন্ম নেবো।”
কবি: — অথচ দেখো, সময় কেমন নিষ্ঠুর!
দিন, মাস, বছর গড়াল;
আমাদের দেখা হলো না, তবু অপেক্ষা রইলো।
কবিতা: — ক্যালেন্ডারের প্রতিটি পাতায় আমি লিখতাম—
“আজও তুমি আসোনি।”
কবি: — কত উৎসব এলো, গেলো—
আমাদের অনুপস্থিতিতে!
কবিতা: — কিন্তু অদৃশ্য এক সুতোয় বাঁধা রইলাম আমরা,
মনের অন্দরে গোপন প্রতিজ্ঞার মতো।
কবি: — আজ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে,
বুকের ভেতর লুকানো বসন্ত হঠাৎ ফুঁটে উঠেছে।
কবিতা: — আমারও তাই, চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে
যেন সমুদ্র তার হারানো তট ফিরে পেয়েছে।
কবি: — চারপাশে আলো, সংগীত, মানুষ—
তবু আমার চোখে কেবল তুমি।
কবিতা: — এই মঞ্চ, এই সন্ধ্যা—সব যেন নাটক,
আর আমরা দু’জন চরিত্র—অভিনয়হীন সত্যের।
কবি: — তুমি কি জানো, আমি কখনোই ভুলিনি তোমাকে।
কবিতা: — ভুলে থাকা যায় নাকি!
হৃদয়ের যে নদী, তার স্রোত গোপনে বয়ে চলে—
অবশেষে এসে মিশে যায় পরিচিত সাগরে।
কবি: — মাঝেমাঝে মনে হতো, তোমাকে হারিয়েছি।
কবিতা: — কিন্তু হারানো মানেই তো ফুরিয়ে যাওয়া নয়,
কখনো কখনো তা ফিরে আসার প্রস্তুতি মাত্র।
কবি: — সত্যিই, আজ বুঝতে পারছি—
ভালোবাসা সময়ের নয়, অনুভবের।
কবি: — আজ কি তবে আমরা নতুন করে শুরু করবো?
কবিতা: — কেন নতুন? এ তো একই যাত্রার বিরত অধ্যায়
মাত্র।
কবি: — ঠিক বলেছো, তবু এই দেখা যেন
আবার প্রথম দিনের মতোই আবেশ জাগাচ্ছে।
কবিতা: — তবে আজ থেকে লিখি—
একই পাতায়, একই কালি দিয়ে।
কবি: — আজ থেকে আর কোনো অন্তরাল নয়।
কবিতা: — প্রতিশ্রুতি?
কবি: — প্রতিশ্রুতি, আকাশের মতোই অটল।
কবিতা: — তবে আজ থেকেই লিখি—
“তুমি আমার কবিতার নাম, আমি তোমার কণ্ঠের সুর।”
কবি: — চারপাশে অনেক চোখ, তবু আমি চাই
পৃথিবী শুনুক আমাদের এই ঘোষণা।
কবিতা: — হ্যাঁ, ইতিহাসের পাতায় যদি কিছু লেখা যায়,
তাহলে লিখুক—
দুই হারানো প্রাণ হঠাৎ একত্রে
একই সুরে গাইতে শুরু করলো।
কবি: — আর যদি কোনো পাঠক আমাদের গল্প পড়ে,
সে যেন বিশ্বাস করে—
প্রেমের মৃত্যু হয় না,
শুধু বিরতিতে বদলে যায় তার ছন্দ।
কবিতা: — আর আমরা?
কবি: — আমরা চিরকাল থাকবো—
কবি ও কবিতা হয়ে,
সময়ের অক্ষরে লেখা এক অনন্ত প্রেমগাঁথা হয়ে।
কবি ও কবিতা ( দৈতকন্ঠে)— এক অনন্ত মিলনের প্রতিধ্বনি,
যেন নক্ষত্রের নীরব আলাপ আকাশের বুক জুড়ে,
যেখানে প্রতিটি শব্দই একটি চুম্বন,
আর প্রতিটি নীরবতাই এক দীর্ঘ আলিঙ্গন।
অন্তর্লোকের প্রতিধ্বনি
প্রতিদিন ভোরে আয়নার ভেতর থেকে
এক অপরিচিত মুখ এসে বলে —
আজও বেঁচে আছো?
আমি তাকাই—
সে আমার মতো, অথচ আমিই নয়।
দুপুরে সে বসে থাকে আমার লেখার টেবিলে,
কলম ছুঁয়ে দেয়, কিন্তু লিখে না কিছু।
আমার ভাবনাগুলো চুরি করে
নিজের নামের নিচে রাখে।
কখনো দেখি —
আমি হাসলে সে থম মেরে যায়,
আমি কাঁদলে তার চোখে বৃষ্টির বদলে ধোঁয়া ওঠে।
রাতের নীরবতায় সে হাঁটে জানালার ধারে,
আকাশে তারাদের গোনে —
যেন প্রতিটি তারা আমার পাপের সাক্ষী।
যখন আমি ঘুমিয়ে পড়ি
সে চুপিচুপি ঢুকে পড়ে স্বপ্নের পেছনের ঘরে,
আমারই শরীর পরে নেয়,
আর আমি হয়ে যাই এক ছায়া—
নিজের ছায়ার ছায়া।
ভোর হলে দেখি—
বালিশে দুটি নিঃশ্বাস পড়ে আছে,
একটি আমার,
অন্যটি... কে জানে কার।
নিরবতার বর্ণমালা
একদিন শব্দগুলো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল,
আমি তখন নীরবতার কণ্ঠ শুনেছি—
সেখানে তোমার না-বলা কথার প্রতিধ্বনি ছিল,
যেন বাতাসে ভেসে থাকা নামহীন কোনো সুর।
চাঁদের গায়ে কালো বিন্দুর মতো
আমারও আছে এক অপূর্ণ উজ্জ্বলতা—
সব আলো নিভে গেলে তবেই বোঝা যায়
অন্ধকারেরও একধরনের দীপ্তি আছে।
রাস্তায় দেখি ছড়ানো মুখোশ,
আমি ভাবি—আমার মুখ কোথায়?
পরিচয় যেন নদীর ঢেউ,
যা একবার ছুঁয়ে যায়, তারপর হারিয়ে যায় কুয়াশায়।
বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি,
আমি জানালা পেরিয়ে দেখেছি শুধু আলো;
তুমি ভিজছিলে, আমি শুকনো ছিলাম—
তবু দুজনের ভেতরই ছিল একরকম শূন্যতা।
এখন রাত হলে আমি গুনি
ফোঁটা নয়, তোমার অনুপস্থিতি গুনি—
আর ভাবি, নীরবতাও একধরনের বর্ণমালা,
যা কেবল হারানো ভালোবাসাই পড়তে জানে
তুমি কিছুই বলো না
নামহীন ঝড়
তবু তোমার ঠোঁটের কোণে কাঁপে এক অনুচ্চারিত শব্দ,
যেন বাতাসে আটকে থাকা কোনো নরম নৌকা,
যা বারবার ঘাটে এসে দাঁড়ায়— কিন্তু ভিড়ে না।
আমি জানি—
তুমি বলতে চাও কিছু, খুব ছোট্ট, খুব গভীর কিছু,
কিন্তু ভয় পাও, হয়তো ভেঙে যাবে নীরবতার পাথর।
তবু শোনো, আমি তৈরি—
তোমার অর্ধেক বাক্যও যদি আসে, আমি তাকে পূর্ণ করব নিঃশব্দে।
তোমার চোখে কখনও কখনও দেখি আলো—
একটা নামহীন ঝড় ঘুরে বেড়ায় সেখানে।
তুমি যদি একবার বলো— "হ্যাঁ, আমি ভাবি তোমায়,"
তবে এই অনিশ্চিত পৃথিবীও পেয়ে যাবে তার ঠিকানা।
রাতে আমি ভাবি—
ভালোবাসা কি শুধু লুকিয়ে রাখার ব্যাপার?
নাকি বলার মধ্যেই তার মুক্তি?
তুমি তো জানো, নীরব নদীরও একদিন মুখ খোঁজে সাগর।
তুমি পাশে থেকেও কত দূরে—
আমি চিঠি পাঠাই বাতাসে, ডাকে তোমার নাম।
তোমার না-বলা কথাগুলো আমার কানে বাজে—
একটি অসমাপ্ত গানের মতো।
বলো না, এবার বলো—
ভয় কিসের?
তোমার বুকের ভেতর যে ঢেউ জেগে আছে,
তাকে নাম দাও— আমি শুনব,
যেভাবে নদী শোনে তার প্রথম বর্ষার শব্দ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks