পৃষ্ঠাসমূহ

পুরনো সংখ্যা

বৃহস্পতিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৮

গল্পঃ সম্মান ।। জুঁই জেসমিন


সম্মান


তাজমিন শহর থেকে বাড়ি ফিরার পথে চান্নু চোরের সাথে দেখা, তাজমিনের নিজ এলাকার মানুষের সাথে দেখা হওয়ায়, তার প্রাণ খুশিতে নেচে উঠে, যেন সারা পাড়া ও মানুষজনকে মমতায়, বুকে আঁকড়ে ধরতে মন চায় তার- চান্নুকে হাসি মুখে সালাম করে বলে, " চান্নু ভাই আসলামু আলাইকুম, কেমন আছিস ভাই, ভাল? চান্নু বড় অবাক হয়, জীবনো কেউ তাকে সালাম করেনি, আজ তাজমিন তাকে সালাম করছে, যেন অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ভেবে, খুশিতে তার বড় বড়, যুগল চোখে- চৈত্র দুপুরে বর্ষার ঢল নামে।
তাজমিন জিজ্ঞেস করে, কি ভাই, তোর কি শরীল ভালানা? কান্দেছিস নাকি,---?
চান্নু- না বহিন কান্দিম ক্যানহা? কতদিন পর তোক দেখিনু, মোর বেটি আর তুই তো এক সমবয়সী। তোক দেখে হামার পারুলের কথা মনে পড়িল। তুই তো পড়ালেখা করেছিস, আর হামার মাই, সংসারত বাচ্চা কাচ্চা লে আসান নাই। "
চান্নু চোর কথা টা ঘুরিয়ে, তার মেয়েকে নিয়েই বিড়বিড় করে বলতে থাকে।
তাজমিন সব শুনার পর কিছুটা বিস্মিত কন্ঠে আহারে বাছা! এই বলে, বিদায় নেয়।
চান্নু জনশূন্য মাঠে কাঁঠাল গাছ আঁকড়ে চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদে। সংসারের অভাবে সে চুরি করতে বাধ্য হয়েছে, কচি কচি সাত সাতটা ছেলে মেয়ের মুখে আহার দিতে, দিন মজুর করেও হয়না। বাধ্য হয়ে রাতের বেলায়, যার তার ঘরের মুরগী, হাঁস, পাতিল কড়াই এসব চুরি করে - দূর গ্রামে তা বিক্রি করে চাল ডাল বস্ত্র -স্ত্রী সন্তানদের জন্য, কিনে নিয়ে আসতো।
চান্নুর ছেলে মেয়ে আজ অনেক বড়, ছয় ছেলেই বিয়ে করে ঘর সংসার করছে, ছেলেরা যখন থেকেই ইনকাম করতে শিখেছে এবং মোটামুটি জ্ঞান হয়েছে তাদের, সেই থেকেই বাবাকে চুরি করতে নিষেধ করে।
ছয় ছেলেই রিকশা চালিয়ে সুন্দর ভাবে জীবন সংসার চালায়, তারা এক মাস করে ভাগ করে নেয়,বাবা মাকে খাওয়াপরা ব্যাপারে। বড় ছেলে বলে, বাবা মাক হামা আলাদা থাকিবা খাওয়াবা দিমোনাই, হামরা ছয় ভাই, প্রত্যেকেই এক মাস করে বাবা মাক খাওয়াবো। সুবিধা অসুবিধা দেখিমো চিকিৎসাপাতি করিমো। "
চান্নু ভাবে, "বেটালার সংসারেত দুজন স্বামী স্ত্রী খাচ্ছি পরছি। " চান্নু, তাজমিনের একদিনের প্রথম সালামে জীবনের সংজ্ঞা খুঁজে, খুঁজে জীবনের অর্থ আর দশ জন মানুষের মতো যশ সুনাম, সম্মান -!
বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, অথচ আজ পর্যন্ত কারো কাছে সম্মান পেলোনা, সালাম পেলোনা! চান্নু চোর নামেই যতটুকু সমাজে পাওনা, পরিচিতি।
চান্নুর বুক হাহাকার করে, হঠাৎ সালাম ও সম্মান পেতে- তাজমিনের ব্যবহার দেখে।
সে আযানের সুরে সুরে বিধাতার কাছে হাত তোলে - সম্মান পেতে!
ক্রমশ আযান শুনতে শুনতে তার আযান মুখস্থ হয়ে যায়, সু মধুর কন্ঠে আযান দিতে পারে নিজে নিজে। মসজিদে গিয়ে পড়ে থাকা শুরু হয়, তার আর এক জীবন। এক সময় মসজিদে যিনি আযান দেন তিনি হঠাৎ দেশের বাড়ি চলে যান, মসজিদে কে আযান দেবেন সময় মতো, সহী শুদ্ধ ভাবে? এমন মানুষ,,,,
হঠাৎ গ্রামের কয়েকজন ছেলে মজলিসে বলেন, অপরাধ মাফ করবেন, চান্নু ভাই আযান দিলে কেমন হয়,? তাঁর সবাই আমরা আযান শুনেছি, অনেক সু মধুর। "
তাছাড়া চান্নু ভাই তো বেশির ভাগ সময় তো মসজিদতেই পড়ে থাকে,নামাজ কালাম পড়ে।, "
চান্নু- এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব শুনে ভয়ে কাঁপতে থাকে- না জানি কেউ এই বলে উঠবে- চান্নু তো চোর, চোর হয়ে আযান দেবে? এই ডা কেউ মাইনবোনা।"
কিছু মানুষ ব্যাপারটা আপত্তি করলেও শেষমেশ চান্নুর ওপর দায়িত্ব পড়ে আযান দেওয়ার। চান্নু ডুকরে কেঁদে ওঠে---,
অনেকজনে তার মনে সাহস জোটায় পিঠ চাপড়ে। চান্নু ভাই চিন্তা করিস না, তুই পাড়িবো, হামরা তো আছি!"
চান্নু খুশির হাওয়ায় বাড়ি ফেরে-
সে তার বউকে ভীষণ ভালবাসে, একসাথে খাওয়া, ঘুমানো, তাদের মহব্বত এতো টাই লোভনীয়,, অনেকেই তাদের দেখে বলে শালিক পাখির জোড়া। বউকে জড়িয়ে খুশির খবর টা সে দেয়।
" সাদিকা সাদিকা মুই আজ থেকে মসজিদে আযান দিমু, কপালে চুমু খেয়ে বলে "ও বউ তুই খুশিতো? জানিস, মোর জীবনো মুই এমন খুশি পাওনিরে,,,সাদিকা!"
বউ বলে গলা জড়িয়ে" মুইও খুব খুব খুশি খোদা যাতে হামার সব গুনহা মাফ করে দেয় গো।"
চান্নু বলে, " আমিন।"
পরদিন হতে চান্নু আযান দেওয়া শুরু করে ফজর হতে এশা-
গ্রামের সব ছেলে মেয়ে মুরুব্বী, চান্নুকে সালাম করে এখন রোজ, সম্মান করে, ভাল ভাবে কথা বলে। চান্নুর এই যেন জীবনের বিরাট পাওয়া। সে এখন মুয়াজ্জিন নামেই পরিচিত। চান্নু তার অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের জন্য তাজমিনকে ভুলতে পারেনি, আর পারবেওনা কখনো কোনদিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন