পৃষ্ঠাসমূহ

পুরনো সংখ্যা

সোমবার, ১৪ মে, ২০১৮

ভালোবাসা সমাচার ।। রুদ্র সুশান্ত


ভালোবাসা সমাচার

রিপন সাহেব গত দুমাস আগে বিয়ে করেছেন। চাকরীর বয়স দেড় বছরের একমাস কম অর্থাৎ সতেরো মাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখা পড়া শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করতেন। সেটা ছেড়ে দিয়ে এটাতে এসেছেন। এটা অবশ্য সরকারী চাকরী। তাও আবার ব্যাংকে। আজকাল সরকারী ব্যাংকেও মোটা মানের স্যালারী পাওয়া যায়। প্রবাদ আছে-"চাকরী করুন হয় ব্যাংকে না হয় রেংকে
তিনি আবার এ চাকরীটাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছেন। মাস শেষে মোটা অঙ্কের মাইনে পেলে সবাই যেকোন চাকরীকে ভালোবাসবে, এটাই স্বাভাবিক। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবে সেটা কোন কারণ নয়।
.
সদ্য বিবাহিত বৌটাও খুব আদরের। নিশান নাম। রিপন সাহেব আদর করে নিজপত্নীকে নিশু ডাকেন। গোলাগাল চেহারার টানা টানা চোখে প্রতিমার মতো সুন্দর একজন মেয়ে। দেখলেই প্রোজ্জ্বলিত মোমবাতির মতো যেকোন পুরুষের হৃদয়ে ভালোবাসর উষ্ণ ক্ষরণ হতেই পারে। তবে এতে দোষের কিছুই নেই। বিধাতার বরাবরই নারীপক্ষে জোরালো অবস্থান। তিনি বারবার পক্ষপাতিত্ব করেছেন, নারীকে তিনি বানায়াছেন মোহনীয় করে আর পুরুষকে করেছেন কর্কশ। নারীকে দিয়েছেন অসহনীয় সহ্য ক্ষমতা পক্ষান্তরে পুরুষকে দিয়েছেন লোভ।
নারীর তুলতুলে গালে পৃথিবীর সমগ্র সুখ একসাথে উদ্দোম মনে খেলা করে। নারী হলো পৃথিবীর ফুল আর পুরুষ হলো আগাছা। পুরুষ কখনো নারীর মন বুঝেনি, দেহ বুঝেছে ।
.
রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পূর্বে রিপন সাহেব নিশানকে নিজের বুকে সেফটি পিন দিয়ে টাই আটকে রাখার মতোন করে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে লেপ্টে রাখেন। এতে নাকি রিপন সাহেবের সারারাতের ঘুমের পূর্ণতা পায়। এমন অবলীলায় বুকে নিয়ে রিপন সাহেব মাঝে মাঝে ডাকেন -"নিশু?"
মা মুরগীটার পাখা থেকে সদ্য ডিম ফোটে বের হওয়া ছানার মতোন রিপন সাহেবের বুকে থেকে মাথা তুলে নিশান বলেন-"হু"
তারপর দুজন আবার চুপচাপ।
.
রিপন সাহেব ভোর-সকালে বিছানায় চোখ খোলার আগে হাত বুলায়ে দেখে নেন নিশান আছেন কিনা? তারপর যথারীতি প্রতিদিন একই কম্ম।
নিশান সাজুগুজু খুব প্রছন্দ করেন।
শ্রাবণ এসে গেছে। আজকাল নিয়ম করেই বৃষ্টি হচ্ছে। রাত-বিরাতে। সকাল-বিকাল।
এর মধ্যে নিশান একদিন বলে বসলেন- " চলো, কাল আমরা বাইরে ডিনার করি।"
রিপন সাহেবও বলে দিলেন-"হু, চলো।"
সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে তিনি অফিস চলে এলেন। অফিস এসে দেখেন মোবাইলে চার্জ প্রায় শেষ, অফিসে যে চার্জার আছে গতো ক'দিন ধরে সেটাও নষ্ট। প্রায় বারোটার দিকে তিনি স্ত্রীকে একটা ম্যাসেজ করলেন। তাদের পারসোনাল কথা-বার্তা। মেয়েরা আবার এসব কিছু খুব প্রছন্দ করেন। যেমন- তার বর অফিস টাইমে তাকে ফোন দিক্, ম্যাসেজ করুক, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাক, রাতে বাসায় ফিরার সময় প্রায়ই এটা ওটা নিয়ে আসুক, তার স্পেশাল ডে গুলো মনে রাখুক, পালন করুক.... ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েরা মেয়েরা গল্প করার সময় এইসব গলাধঃকরণ বিদ্যা আবার উগরে দিয়ে অট্টহাসি হেসে বলবে--"এই জানিস, আমার ও না, এমন-তেমন, আমার জন্য পাগল।"
.
রিপন সাহেবের ম্যাসেজ দেখে নিশানও খুব খুশি হয়েছেন। আজ তারা বাইরে ডিনারে যাবার কথা। ব্যাংকের চাকরীতে কখনো কখনো একগলা কাজ হয়ে যায়, তখন আর চাকুরীজীবীদের ডান বাম মনে থাকে না। রিপন সাহেবেরও আজ তা-ই হলো।
.
তিনি মনেপ্রাণে কাজের ভিতর ডুবে গেলেন।
লাঞ্চ করলেন চারটারও পরে। চোখেমুখে প্রায় ঝাপসা দেখছেন। ব্যাংকে চাকুরীজীবীদের মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয়- কয়টা একশো টাকার নোটে পাঁচশো টাকা হয় সেটও ক্যালকুলেটরে হিসাব করা লাগে।
রিপন সাহেবের এমন অবস্থা হয় যে তিনি বাজার করে বাকি টাকা হিসাব করে ফেরত নিতে পারেন না, কারণ সারাদিন কাজ করে বাজরের হিসাব ভুলই হয়।
.
রিপন সাহেব বাসায় ফিরলেন রাত দশটার কিছুক্ষণ পর, ওদিকে নিশান রিপন সাহেবের মোবাইলে কল ট্রাই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। রিপন সাহেব বাসায় ফিরার পর নিশান চুপচাপ। রিপব সাহেবের ডিনার এসব কিছুই মনে নেই। তিনি বাসায় এসে যথারীতি নর্মাল প্রতিদিনের মতোই আচরণ করছেন কিন্তু নিশান রাগে ফুলে আছেন, মনে হচ্ছে আমাবস্যায় সাগরের জল ঠাঁই দাঁড়ায়ে আছে।
তিনি স্ত্রীকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলেন।
নিশান নিরুত্তর।
সে এমনভাবে রাগ করেছেন যেনো মনে হচ্ছে ঘন্টাখানেক আগে এই বাসার উপর দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে কোনো জলোচ্ছ্বাস বয়ে গেছে।
মেয়েরা জন্মগতভাবে খুবই সহজসরল হন, তাদের মনে মায়া মায়া ভাব থাকে। আবার যখন বেঁকে যায় তখন মনে হয় বিধাতা এর চেয়ে অদ্ভূদ আর কোন পদার্থ পৃথিবীতে সৃষ্টি করেননি। কারা যেনো ধর্মের দোহায় দিয়ে বলেছে- নারীদের পাঁজরের বাঁ' পাশের হাড় একটা নাকি বাঁকা, তাই তারা সহজে বশে আসে না। আর তারা যখন রাগ করে মুখ ঘুমোট করেন তখন মনে হয়, একটা কেনো? বিধাতা প্রদত্ত ২০৬ টি হাড়-ই বাঁকা। মাঝে মাঝে নারীদের অভিমান এমন পর্যায়ে চলে আসে- যদি আপনি তাঁকে বলেন, এই মুহূর্তে অভিমান না ভাঙলে প্রলয় ধ্বংস হয়ে যাবে। তাও তারা অভিমান ভাঙবেন না। আর সে অভিমান যদি প্রিয়জনের সাথে হয় -তাহলে তো হইছে, আজকে মহাকাব্য রচনা হবে।
.
রিপন সাহেবও আজকে সেই মহামাত্রর অভিমানে পতিত হলেন। করার কিছুই নাই। বিধি বাম। মেনে নেয়া আর সরি বলা ছাড়া আর কোন কথা বললে সংসারে আজই লঙ্কাকান্ড বেঁধে যাবে। হয়তো মহাপবিত্র নিকম্ভূলা যজ্ঞও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, নারীর চরম রোষানলে পড়ে।
আবার একজন মেয়ে যদি কোনো কারণে একজন পুরুষের উপর বিমোহিত বা মুগ্ধ হয় তবে সে মেয়ে কারণে-অকারণে সে পুরুষের উপর বারবার বিমোহিত হতে থাকবে।
.
রিপন সাহের ঘটনা আঁচ করলেন এবং তার মনেও পড়লো।
সো সরি বলা ছাড়া অন্য কোন ওয়ে নেই।
স্ত্রীর সামনে দাঁড়ায়ে আপাদমস্তক একজন খুনীর অপরাধীর মতো তিনি বললেন- "সরি, জান। আমার মনে ছিলো না, কাল নিশ্চয় যাবো। তাছাড়া অফিসে অনেক কাজ ছিলো।"
নিশানের কোন রিয়েক্ট নাই। চুপচাপ।
অন্যদিন ডিনারের জন্য নিশান তাকে ডাকেন। আজ তিনি স্ত্রীকে বহুবার ডেকেছেন। নিশান আসেনি।
--"নিশু,নিশু, নিশু।"
নিশান আর কিছু শুনে না।
বাচ্চা ছেলের মতোন রিপন সাহেব একাএকা খেয়ে নিলেন। খিদেও ছিলো খুউব।
তারপর নিশু নিশু ডাকতে ডাকতে তিনি কখন ঘুমায়ে পড়লেন।
.
.
প্রতিদিনের মতো রিপন সাহেবে আজও সকালে বিছানায় হাত বাড়ালেন। কিন্তু কি রে, পাশে নিশান নাই। হুট করে তিনি চোখ খুললেন, দেখলেন স্ত্রী বিছানায় নাই। দফ করে তিনি বিছানায় উঠে বসলেন।
নিশু নিশু বলে এঘর-ওঘর খুঁজলেন।
নিশান কোথাও নেই।
প্রায় পাগলের মতো হয়ে তাড়িঘড়ি করে নিজের মোবাইলটা নিয়ে নিশানকে ফোন দিলেন, বিছানার পাশে মোবাইল রিংটোন বাজছে। ওদিকে আবার ঘরের দরোজাও খোলা। মহা দুঃচিন্তার কথা। রিপন সাহেব শ্বশুর বাড়ী, নিজের বাড়ী, আরো আত্মীয় স্বজন অনেক জায়গায় খোঁজ নিলেন। কোথায় কোন খোঁজখরব পেলেন না।
নিজে উচ্চস্বরে কয়েক বার নিশু নিশু বলে ডাকলেন। কিন্তু কোন প্রতিউত্তর আসলো না। তিনি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন। কাল রাত মেয়েটা অভিমান করলো, আজ সকাল হতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েরা অভিমান করলে এমন অবস্থা হয় সমগ্র পৃথিবীর দুঃখ যেনো তাদের অন্তরে এসে জমা হয়। তাদের অভিমান ভাঙাতে হয় পরম মমতায়, চরম আদরে। আদরে মেয়েরা মহাসমুদ্রের জলের মতো মিলায়ে যায়। তখন তাদের আর দুঃখ থাকে না।
কিন্তু নিশান কই?
বাইরে ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরের মেইন দরোজা ধরে রিপন সাহের সিঁড়ি বেঁয়ে সোজা ছাদে উঠে আসলেন। তিনি দেখে অবাক হলেন যে - নিশান একাএকা বৃষ্টির জলে ভিজছেন। এরকম চরম মুহূর্ত বিয়ের পরে তিনি কখনো একা উপভোগ করেননি।
সিঁড়িঘরের গোঁড়ায় দাঁড়ায়ে তিনি ডাকলেন- "নিশু, নিশু, অ্যাই নিশু।"
শুনেও নিশান কোন কথা বললেন না, দুহাত দু'দিকে প্রসারিত করে সে ভিজেতেই আছে।
রিপন সাহের শব্দ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
আর বললেন-নিশু, তুমি একা....
সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন রিপন সাহেব। নিশান হয়তো কাঁদছেন। বৃষ্টির জলে চোখের জল বুঝার উপায় নেই। তবে চোখেমুখে একগাল হতাশা প্রদীপ্তমান।
.
রিপন সাহেব আরো কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাকে কাছে টানলেন। প্রতিমার মতো মেয়েটা কোন কথা বললো না, নিঃশব্দে জড়ায়ে গেলো স্বামীর বক্ষে।
প্রতি সকালের মিলন মেলা থেকে আজকের মিলনমেলা আলাদা। আলাদা পরিবেশ, আলাদা ভঙ্গি, আলাদা স্থান।
সব আলাদা হলোও দুজনই এক।
এবার বৃষ্টি হোক, শ্রাবন এভাবে কাঁদতে থাকুক। আর প্রকৃতি দেখুক তাদের সাথে দু'জন কেমনে একাকার হয়ে গেলো।
আজ তলায়ে যাক, আজো অজোর বর্ষণ হোক।
আজ হোক মহানন্দের মহামিলন।
আজ হোক...।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন