প্রবন্ধঃসুররিয়ালিজমের প্রাসঙ্গিকতা ও অপ্রাসঙ্গিকতা ।। কবির মুকুল প্রদীপ

সুররিয়ালিজমের প্রাসঙ্গিকতা ও অপ্রাসঙ্গিকতা
------
------
ডাডাবাদী আন্দোলনের অন্তিমলগ্নে এই পাশ্চাত্য শিল্প আন্দোলনের সূচনা হয় যার মেন্যুফেস্টো লিখেছিলেন আঁদ্রে ব্রেঁত ।তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী,সে কারণেই ফ্রয়েডিও মনোবিকলন তত্ত্বকে শিল্পে যুক্ত করে জন্মদিলেন এই অভিনব শিল্প-আন্দোলনের।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শিল্প-বিবর্তনের মূল ভিত্তি এবং বুর্জোয়া বাস্তবতা বিরোধী ডাডাবাদ আন্দোলন যখন কিছুটা থিতু হয়ে আসে,তখনই পরাবাস্তববাদের উত্থান।এই আন্দোলন ইয়োরোপের বুর্জোয়াদের দ্বারা ধিকৃত হয় নি,কারণ ডাডাবাদের দার্শনিক ভিত্তি ছিলো বল্গাহীন ভাঙচুর ও সমস্তরকমের যুদ্ধবিরোধ এবং পুঁজিবাদী বাস্তবতাকে নস্যাৎ করে এক উদ্ভট কল্পনাজাত।ও ডাডাবাদীরের আচরণও ছিলো ততটাই উদ্ভট।কিন্তু পরাবাস্তববাদ তেমনটা নয়,ব্রেঁত নির্ধারিত পরাবাস্তবাদের মূল ভিত্তি ছিলো এরকম,-

এ-মতবাদের মূলকথা অবচেতন মনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা। এ আন্দোলনের মূল উদ্গাতা ফরাসি পুরুষ কবি-সমালোচক আঁদ্রে ব্রেঁত। ডাডাবাদীরা যেখানে চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী করতে যার মাধ্যমে সে ভেদ করতে পারবে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল, পৌঁছাতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে; সেখানে পরাবাস্তববাদ আরো একধাপ এগিয়ে বলল, প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে। পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে গভীর থেকে তুলে আনা।পরাবাস্তববাদ বিকশিত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ডাডাবাদী কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে। এ-আন্দোলনের সূচনা ফ্রান্সের প্যারিস থেকে, ১৯২০-এর দিকে। তখন থেকেই এটি ধারাবাহিকভাবে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন দেশ ও ভাষার Visual arts, Literature, Film এবং Music-এ। শুধু তাই নয়, এটি রাজনৈতিক চিন্তা (রাষ্ট্রচিন্তা) ও চর্চা, দর্শন এবং সামাজিক তত্ত্বেও (সমাজতত্ত্ব) স্থান পায়।(তথ্যসূত্র পরাবাস্তব উইকিপিডিয়া)

বাংলা শিল্প-সাহিত্যে পাশ্চাত্য শিল্পের আমদানি আমারা জানি মাইকেল মধুসূধনের হাত ধরে সূচনা হয়,তিনিই প্রথম প্রথাগত ছন্দের জড়ত্ব ভেঙে খুলে দেন এক আলাদীনের আশ্চর্য জগত।পরে রবীন্দ্রনাথের হাতে তা আরও প্রসারিত হয়,এবং পঞ্চপাণ্ডদের লেখায় আমরা সুররিয়ালিজমের মতো মতবাদের প্রয়োগ প্রবল ভাবে লক্ষ করি।অনেকেই মনে করেন ভিনদেশের মতবাদ বাংলা সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর,কিন্তু না ,এটা কিছুতেই মেনে নেয়া অসম্ভব এখন।তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে হতে হবে সচেতন। যেটা জীবনানন্দ দাস তথা তাঁর পর্বরতী অনেকেই প্রমাণ করে গেছেন যে, বৈশিক মতবাদ কীভাবে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে।আর এখন বৈশিক সাহিত্য বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে ভাবাও অসম্ভব।
আর সুররিয়ালিজমকে বাদ দিয়ে তো কবিরা ভাবতেই পারে না,কারণ কবিতায় চিত্রিত হয় কবির কল্পনাজাত সংঘাত।

তারমানে এই নয় যে কল্পনা মানেই বাস্তব বর্হিভূত কিছু বরং বলা যায় মানুষ যতটা কল্পনা করতে পারে ততটাই বাস্তব।যাঁরা বর্তমানে সুররিয়ালিজমের বিপক্ষে তাঁরা নিশ্চয়ই এই যুক্তি মেনে নেবেন না।তাঁরা বলবেন যে এসব উদ্ভট,অলৌকিক চিত্রকল্প সমৃদ্ধ কবিতা পাঠকের কোন কাজে আসে না, এই অস্থির সময়ে ও যান্ত্রিক জীবনের জটিলতায়।আরও বলবেন পরাবাস্তব দুর্বোধ্যতার কারণেই কবিতার পাঠকসল্পতা।এর ভোক্তা একধরণের অলস প্রজাতির বুর্জোয়া পাঠক যাঁদের কাজকর্ম নেই তাঁরাই এই শিল্পের জাবর কাটেন।এই দর্শনকেও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না,আধুনিক কবিতাকে ছেনে দেখলে নিশ্চয়ই এর বিহিত খুঁজে পাওয়াও সম্ভব;কিন্তু নিশ্চয়ই তা পরাবাস্তববাদের জন্য না,এর পেছনে লুকিয়ে আছে কবির সমাজবিচ্ছিন্নতা,ও ভীতি এবং প্রয়োগকৌশলগত ত্রুটি।
উদাহরণের মাধ্যমে একটু আলোচনাকে স্বচ্ছ করতে চেষ্টা করা যেতে পারে যেমন,

পল এলুয়ার-এর কবিতা
আমি তোমাকেই শুধু ভালবাসতে চাই
আমি তোমাকেই শুধু ভালবাসতে চাই
ঝড় ওঠে উপত্যকায়
মাছের নদী
আমি তোমায় আমার একাকীত্বের সঙ্গে একাত্ম করে তুলেছি
জগতজুড়ে লুকোনো
বুঝতে পারার মতন দিন ও রাত্রি
তোমায় আমি যা মনে করি
তার চেয়ে বড় বিম্ব নই আমি
তারা তোমার প্রতিমার সারা জগতজুড়ে
আর তোমার চেখের পাতায় শাসিত দিন ও রাত্রি

(মলয় রায় চৌধুরীর অনুবাদ দেয়াল থেকে)

এই কবিতাকে বিশ্লেষণের কোনো অভিপ্রায় নেই এখানে,শুধু বুঝে নিতে চেষ্টা করবো ফ্রয়েডিও মনস্তত্ত্বের আলোকে ব্রেঁত-এর ভাষ্য, ‘সত্তা হোলো যাবতীয় স্বপ্ন,সৃষ্টি,সম্ভাবনার স্বপ্নময় অন্ধকার,যেখানে মানুষের চিরন্তন রূপকল্প,মিথ এবং তার মৌল প্রতীক অতি নিঃশব্দে কাজ করে’।এবারে জীবনানন্দ দাসের কবিতা থেকে উদাহরণ দেখি,-

আমরা যাইনি মরে আজো—তবু কেবলি মনে হয়;
মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;
প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর পরে।

‘ঘোড়া’ জীবনানন্দ দাস

একজন কবি আধুনিক যুগে বসে লিখছেন, ‘প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে’ এই চিত্রকল্পকে খুব সহজ করে পরাবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না।বিশেষত যখন ‘লোভ’ এবং প্রাগৈতিহাসিক যুগের ‘ঘোড়া’র মতো শব্দের ব্যবহার উৎপ্রেক্ষা অলংকার বিমূর্ত করে তোলে।যাইহোক বাস্তবাদীদের সংজ্ঞা ধরে বললে বলতে হয় বাস্তব কি?উত্তর নিশ্চয়ই এমন হবে যে সমকালীন মানব জীবনের জৈব জটিলতা।কিন্তু তাহলে তো কাল এর ভিত্তি উল্টে যাবে!যেতেই হবে,কারণ জীবন কেবল একতরফা জটিলতায় আটকে থাকে না,সে বয় প্রবহমান।আর বাস্তববের সংঘাতে মানব মনের স্বপ্ন কিংবা কল্পনা অথবা মগ্নচৈতন্যের যে বোঝাপড়া তা কিন্তু চলতেই থাকবে;আর এই দর্শনই কালোত্তীর্ণ শিল্প-সৃষ্টি করতে পারে,যেটা প্রস্তর যুগের ঘোড়ার ঘাস খাওয়ার মতো আজও প্রাসঙ্গিক ।তারমানে এই নয় যে বাস্তবতার যে সংজ্ঞা তা অপ্রাসংগিক ? সাহিত্যের বাস্তবতাও যদি চিরকালীন দ্বন্দ্ব তৈরিতে সক্ষম হয় তাহলে সেটা অস্বীকার করার কোনো প্রশ্নই নেই।এবং এমন নজিরও কম নেই বাংলা কবিতা তথা সাহিত্যে।সময়োপয়োগী না হলে কোনো দর্শনই টেকে না শিল্পে এটাই যথার্থ মনে করি।আর এটাও মনে করি তুচ্ছকে অর্থবহ করে উপস্থাপন করাও কবির কাজ,শুধু এটা ওটা নস্যাৎ করা নয়।

Post a Comment

Thanks

নবীনতর পূর্বতন