বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৮

প্রচ্ছদ।। কুয়াশা ।। জানুয়ারি সংখ্যা ।। ২০১৮ইং ।। ২য় বর্ষ ।। ৯ম সংখ্যা।।



সম্পাদকীয়।। জানুয়ারি সংখ্যা।। ২০১৮ ইং।

সম্পাদকীয়ঃ কুয়াশা ।।  জানুয়ারি সংখ্যা। ২০১৮ইং। 

দেখতে দেখতে একটি বৎসর পার করলো "কুয়াশা"। খুব সফলতার সাথে এবং পাঠকপ্রিয়তার দাবি রেখে ২০১৭ইং সাল পার করা হলো আটটি সংখ্যা প্রকাশনার মাধ্যমে। 
খুব ভালো এবং কিছুটা তিক্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এইতো এতো দূর আসা। কেউ কেউ লেখা দেননি - অনেকবার চেয়েও। এমন অভিজ্ঞতাও তৈরী হয়েছে। তবে আশা রাখছি অল্প কিছুদিনের মধ্যে লেখকরাই লেখা দেবার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বেন এমন প্লান নিয়ে সামনে এগোচ্ছি। তবে এ কথা নিশ্চিত যে " কুয়াশা " একটা পাঠক সমাজ তৈরী করে নিয়েছে। একটা সম্ভাবনাময় স্থানে অাসতে পেরেছে। এর জন্য আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেক সময় ব্যায় করতে হয়েছে। অর্থও ফুরাতে হয়েছে । এ জন্য নিজেকে সম্পাদক এবং প্রকাশক হিসেবে গর্ববোধ করি।


নতুন বছরের নতুন ভাবে সবকিছুর আবির্ভাব হয়।  কিন্ত "কুয়াশা " আগের মতোই আছে। থাকবে। এখানে সব লেখকের গুরুত্ব সমান। লেখার মানের নিকট কুয়াশা কখনো আপোস করেনি। করবেওনা। তবে আশার কথা এই যে দিন দিন" কুয়াশা "জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আশান্বিতভাবে। "কুয়াশা " যদিও অনলাইন ভিত্তিক একটি ম্যাগাজিন- তবু এর মান মর্যাদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পাঠক ও ভিউওয়ার মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়ছে। অনলাইন এক্টিভিষ্টদের নিকট কুয়াশা একটা প্লাটফর্ম তৈরী করতে বদ্ধপরিকর।


যারা নিয়মিত " কুয়াশা " তে লিখছেন এবং পড়ছেন।  এখানে অলরেডি একটা "কুয়াশা " পরিবার তৈরি হয়ে গেছে। সেজন্য সকলের ভূমিকা রয়েছে। এখানে লিখতে থাকেন। আরো লেখক ও পাঠক বৃদ্ধির জন্য আপনারাও সহযোগীতা করেন। নিজের লেখাতো পড়বেনই। আরেকজনকে পড়ার সযোগ করে দিন। এজন্য আপনার প্রকাশিত লেখার পেজটা বিভিন্ন সাইটে শেয়ার করার নীতিগত দায়িত্ব আপনার। ভবিষ্যতে লেখক সম্মানীর ব্যবস্থা করারও পরিকল্পনা হাতে রেখেছি। নিজের মতো করে দাবি রাখতে পারার একটা অধিকার তৈরী করে নিন। এ জন্য এই সাইটে মাঝে মধ্যে এসে ঢু মেরে যান। অন্যদের লেখাও পড়ুন, শেয়ার করুন। তাতে "কুয়াশা" র নিকট প্রিয় হতে পারবেন। "কুয়াশা " আপনাকে নিয়ে গর্ববোধ করবে।

সাথে থাকুন - এই আশা করে এখানেই রাখলাম।


----------------
দ্বীপ সরকার

সম্পাদক
মাসিক কুয়াশা ওয়েবজিন। 

সূচিপত্রঃ কুয়াশা ।। জানুয়ারি সংখ্যা ।। ২০১৮ইং ।।

সূচীপত্রঃ কুয়াশা।। জানুয়ারি সংখ্যা ২০১৮ইং।। 

অনুবাদ গল্পঃ 
রহমান হেনরী

প্রবন্ধঃ 
জালাল উদ্দিন ইমন

অনুবাদ কবিতাঃ 
আবুল কাইয়ুম

কবিতাঃ
নির্মলেন্দু গুণ, শক্তি চট্টপাধ্যায়, সৌমিত্র চক্রবর্তী, অর্পিতা আচর্য, কল্যাণী তালুকদার, এ বি এম সোহেল রশিদ, সাইদুর রহমান, সিদ্দিক প্রামাণিক, শামীম আহমেদ, আহমেদ মুনীর, কাজী জুবেরি মোস্তাক ।। 

গল্পঃ 
দ্বীপ সরকার, এস আই জীবন,  রায়ান নুর, অনির্বাণ চক্রবর্তী ।।

কবিতাঃ
রোহিনী কান্ত রায়, কবির হুমায়ুন, এ কে এম আব্দুল্লাহ, অনুপম দত্ত, চঞ্চল দেবনাথ, সুনীতি দেবনাথ, এলিজা আজাদ, নাসির ওয়াদেন, জীবননেসা হেলেন, আনজানা ডালিয়া ।। 

অণুগল্পঃ
সিলভিয়া ঘোষ, গোলাম রব্বানী টুপুল,

কবিতাঃ
সুশান্ত হালদার, রিদওয়ান নোমানী, অরণ্য আপন, বশিরুজ্জামান, রুমাদাশ পড়শি, রতন রায়, এম এ হান্নান, ফাইয়জ ইসলাম ফাহিম, রুপক চৌধুরী, রাহুল রায়, 

ছড়াঃ
স্বপন শর্মা, পলক রায়,  আহমেদ ফারুক মীর, , সালমা আজাদ, নাসির ফরহাদ

অনুবাদ গল্পঃ স্কুল।। ডোনাল্ড বার্থালমি ।। ভাষান্তর।। রহমান হেনরী





স্কুল 



মূলঃ ডোনাল্ড বার্থালমি 
ভাষান্তর: রহমান হেনরী
ভালো কথা, দেখুন, চারা রোপনের জন্য এই  ত্রিশজন ছেলেমেয়ে ছিলো আমাদের, কেননা আমরা শনাক্ত করেছিলাম সেটা... তা ছিলো ওদের শিক্ষার অংশ, আপনারা জানেন, এটা দেখার জন্য যে উদ্ভিদের মূলতন্ত্র কিভাবে কাজ করে... আর দায়িত্ববোধের ব্যাপারটাও, কোনকিছুর যত্ন নেওয়া, স্বতন্ত্রভাবে দায়িত্ব নেওয়া। কী বোঝাতে চাইছি আপনারা জানেন। আর সবগুলো চারা মরে গিয়েছিলো। ওগুলো ছিলো কমলালেবুর চারা। জানিনা, কেন মরলো, শুধু বলতে পারি মরে গিয়েছিলো। হয়তো মাটিরই কোনও সমস্যা কিংবা বীজতলা থেকে যে চারাগুলো আমরা পেয়েছিলাম সেগুলো উৎকৃষ্ট প্রকৃতির ছিলো না। এ ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছিলাম। তো আমরা ত্রিশজন ছেলেমেয়ে পেলাম, প্রত্যেক ছেলে বা মেয়ের জন্য নির্ধারিত একটা করে ছোট্ট গাছ রইলো আর আমরা পেলাম ত্রিশটি মৃত চারা। ছেলেমেয়েরা ওইসব ছোট্ট বাদামি কাঠিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো, সেটা ছিলো খুব হতাশাজনক ব্যাপার।

ওটা খুব খারাপ ব্যাপার ছিলো না যে চারাগুলো নিয়ে এসব ঘটার মাত্র দু সপ্তাহ আগে, সবগুলো সাপ মরে গিয়েছিলো। কিন্তু আমার মনে হয় সাপগুলো— আচ্ছা, সেটার কারণ সাপগুলো লাত্থিয়ে বিদেয় করা হয়েছিলো...  সেটা আপনাদের স্মরণে থাকতে পারে, হরতালের কারণে চারদিন বয়লার বন্ধ ছিলো, সেটা ব্যাখ্যাযোগ্য ঘটনা। এ ব্যাপারে আপনি বাচ্চাকাচ্চাদের বোঝাতে পারবেন যে হরতালের জন্য এমনটি ঘটেছে। বলতে চাইছি, ছেলেমেয়েগুলোর কারুরই মা-বাবা তাদের তর্কসীমা অতিক্রম করতে দিতো না আর তারা জানতো একটা ধর্মঘট কর্মসূচি চলমান আছে এবং সে কথার অর্থ কী। কাজেই, ধর্মঘটের পর যখন সব কাজ চালু হলো আর আমরা দেখলাম সাপগুলো মরে গেছে, ওরা খুব একটা বিচলিত হয়নি।

ঔষধি বাগানের ক্ষেত্রে এটা হয়তো অতিজল ঢালার ঘটনা ছিলো, আর এখন ওরা অন্তত বুঝলো বেশি জল ঢালা চলবে না। ছেলেমেয়েরা ঔষধি বাগানের ব্যাপারে অতিসচেতন ও দায়িত্ববান ছিলো আর তাদেরই কেউ কেউ... আপনারা জানেন, যখন তাদের দিকে অতটা নজর দেয়া হয়নি, সম্ভবত অতিরিক্ত জল ঢেলে ফেলেছিলো। কিংবা হতে পারে... আচ্ছা ঠিক আছে, সাবটেজ তথা অন্তর্ঘাতের কথাটা আমি ভাবতে চাই না, যদিও এসব আমাদের সাথে ঘটতো। বোঝাতে চাইছি, এটা এমন এক ঘটনা যা আমাদের মনে তার্কিক ভাবনা জাগিয়ে তুললো। আমরা এভাবে ভাবছিলাম তার কারণ সম্ভবত এই যে, এর আগে মরু ইঁদুর, শাদা ইঁদুর আর সালসান্ডারগুলোও মরে গিয়েছিলে... যা হোক, বাচ্চারা এখন জেনে গেছে প্লাস্টিকের ব্যাগে করে ওগুলো আনা-নেওয়া যাবে না।

অবশ্যই আমরা স্বীকার করি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ মরে যাবে, এটা কোনও আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। সংখ্যাগুলো খেয়াল করুন, ওরা পেট ভেল্টিয়ে চিত হয়ে জলের উপরিতলে ভাসতে থাকে। কিন্তু শিক্ষণ পরিকল্পনা করা হয়েছিলো ওইসব মাছের ওপর, এ ব্যাপারে, আমাদের কিছুই করার ছিলো না, প্রতিবছরই এটা ঘটছে, আপনাদের উচিত এ ব্যাপারটাকে দ্রুত অতীতের দিকে ঠেলে দেয়া।

আমাদের কাছে এমনকি কুকুর ছানাও ছিলো না।

আমাদের কাছে এমনকি একটাও ছিলো না, সেটা ছিলো নিতান্তই একটা কুকুরছানা, একদিন কানাডিয়ান বংশোদ্ভূত মেয়েটি ওকে একটা মালবোঝাই ট্রাকের নিচে দেখতে পেয়েছিলো আর সে ভয় পেয়েছিলো যে মাল সরবরাহ শেষ হলে চালক হয়তো ওর ওপর দিয়েই ট্রাকটা চালিয়ে দেবে, কাজেই সে ছানাটাকে তুলে তার ব্যাগে পুরে স্কুলে নিয়ে এলো। তো, আমরা সেই কুকুরছানাটা পেলাম। দেখামাত্রই ভাবলাম, হায় খ্রিষ্ট, বাজি ধরে বলতে পারি এ ছানাটা হয়তো সপ্তাহ দুয়েক বাঁচবে আর তারপর... এবং সে ওরকমটিই করেছিলো। শ্রেণিকক্ষের ভেতরে আদৌ এটার থাকার কথা নয়, শ্রেণিকক্ষের বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে, কিন্তু আপনি তাদের বলতে পারেন না যে শ্রেণিকক্ষে তারা কুকুরছানা আনতে পারবে না, যখন ইতোমধ্যেই ওটা ওখানে আছে, ওদের সামনেই মেঝেতে ছোটাছুটি করছে আর জিহ্বা বের করে কুটুকুটু করে বেড়াচ্ছে। ওরা ছানাটার নাম দিলো এডগার— তার মানে, ওরা আমার নামেই নাম দিলো কুকুরছানাটার। ওর পিছনে ছুটে টেংলাতে খুব ভালো লাগছিলো ছেলেমেয়েগুলোর। ‘‘এদিকে, এদিকে, এডগার; খুব সুন্দর, খুব সুন্দর, এডগার।’’ হেসে কুটিকুটি বাচ্চারা শ্রেণিকক্ষটাকে নরক বানিয়ে ছাড়লো। ওরা এই দ্ব্যর্থকতার আস্বাদন পেয়ে গেল। আমি নিজেও উপভোগ করতে লাগলাম। বাচ্চামি স্বভাবে মনঃক্ষুণ্ণ হলাম না। ছানাটার জন্য শিক্ষা-উপকরণ সরবরাহ কক্ষের পাশে ওরা একটা ঘরও বানালো আর চলতে থাকলো এসব। ওটা কেন মরলো জানি না। আমার ধারণা, মেজাজ বিগড়িয়ে। খেলার মত কিছু হয়তো ছিলো না ছানাটার। প্রতিদিন আমি উপকরণকক্ষ ও তার আপপাশটা পর্যবেক্ষণ করতাম। বাচ্চারা স্কুলে আসার আগেই ওটাকে বের করে আনতাম। আমি ওর রক্ষক হয়ে উঠেছিলাম।

আর তারপর এলো কোরিয়ান এতিম শিশুটির ব্যাপার যাকে শিশুকর্মসূচির আওতায় আমরা পালক দিয়েছিলাম, এর আওতায় ছেলেমেয়েদের প্রত্যেকেই এক মাসের জন্য ওদের কোয়ার্টারে বাস করবে, এটাই ছিলো পরিকল্পনা। সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক হয়েছিলো, বাচ্চাটার নাম কিম আর হয়তো তাকে বেশ দেরিতে পালক দেয়া হয়েছিলো বা ওরকমই কিছু একটা। যে চিঠি আমরা পেলাম তাতে মৃত্যুর কারণ লেখা ছিলো না, আমাদেরকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো কিমের বদলে অন্য আরেকটা বাচ্চা আমরা যেন ওদেরকে দত্তক দিই, ওরা খুব আকর্ষণীয় সমীক্ষা প্রতিবেদন দেবে আমাদেরকে, কিন্তু আমাদের হৃৎপিণ্ডে আর সাহস ছিলো না। ছাত্রছাত্রিরা এ ঘটনাকে খুব কঠিনভাবে নিয়েছিলো ( যতদূর মনে পড়ে, সরাসরি কেউ আমাকে কিছু বলেনি) এ অনুভবে যে হয়তো বিদ্যালয়টারই কোনও ত্রুটি আছে। কিন্তু আমার মনে হয় না স্কুলের কোনও বাজে ব্যাপার আছে, বিশেষত, আমি এখনকার সবচে ভালো ও খারাপ দিনগুলো দেখেছি। এটা কেবলই একটা দুর্ভাগ্য। চোখের পলকে আমাদের অস্বাভাবিক সংখ্যক ছেলেমেয়ের পিতামাতা বিগত হলো, এসবের মধ্যে আমার মনে পড়ে দু দুটো হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া আর দুটো আত্মহত্যা, একটা জলে ডুবে মরা আর সড়ক দুর্ঘটনায় একসাথে চারজনের মৃত্যু। আরেকটা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। আর আমাদের দাদা-দাদি নানা-নানিদের স্বাভাবিক মৃত্যুহারও বেশি, কিংবা হতে পারে এবছর মৃত্যুহার আরও বেশি, সেরকমই মনে হয়। আর শেষকথা হলো এটা মর্মান্তিক।

মর্মন্তুদ ঘটনা তখনই ঘটলো যখন ম্যাথু ওয়েন ও টনি ম্যাভরোগর্দো ওখানে খেলতে লাগলো যেখানে নতুন ফেডারেল ভবনের নির্মাণসামগ্রি স্তূপ করে রাখা। ওখানে কাঠের বিশাল বিশাল বাটাম সাজিয়ে রাখা ছিলো, আপনারা জানেন, নির্মাণসামগ্রির গাদাগুলোর সামনে। ওখান থেকেই একটা মামলার উদ্ভব হলো, অভিবাবকগণ অভিযোগ তুললেন বাটামগুলো ঠিকঠাক সাজানো ছিলো না। জানি না কোনটা সত্য কোনটা নয়। এটা এক অদ্ভূত বছরে পরিণত হলো।

বিলি ব্যান্ডের বাবার কথা উল্লেখ করতে ভুলে গেছি যাকে মুখোশধারি এক অবৈধ অনুপ্রবেশকারি তার বাড়িতে এসে চাকু মেরেছিলো।

একদিন শ্রেণিকক্ষে আমাদের আলোচনা বসলো। ওরা জানতে চাইলো, ওগুলো কোথায় গেল?  গাছের চারাগুলো, সালাম্যান্ডার, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ, এডগার, বাবাগুলো, মাগুলো, ম্যাথু আর টনি, ওরাসব কোথায় গেল? আর আমি বললাম, জানি না, আমি জানি না। আর ওরা বললো, কে জানে? এবং আমি বললাম, না, সেটাই জীবন যেটা বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করে। তখন তারা বললো, মৃত্যু কি মৌলিক উপাত্ত হিসেবে গণ্য নয়, এটার অর্থ হলো— মৃত্যুর মাধ্যমে দৈনন্দিনতা থেকে ভিন্নদিকে যাত্রাকে অবশ্যম্ভাবি করা হয়—
আমি বললাম, হ্যাঁ, হয়তো।
তারা বললো, সেটা আমাদের পছন্দ নয়।
আমি বললাম, শুনতে ভালো লাগছে।
তারা বললো, এটা ন্যাক্কারজনক।
আমি বললাম, তাই।
তারা বললো, তুমি কি এখন হেলেনের সাথে দৈহিক মিলন ঘটাবে( হেলেন আমার পাঠদান সহায়িকা) যাতে করে আমরা দেখতে পারি কীভাবে এসব হয়? আমরা জানি হেলেনকে তুমি পছন্দ করো।
হেলেনকে নিশ্চয় পছন্দ করি কিন্তু বললাম সেটা আমি করবো না।
আমরা এসবের কথা অনেক শুনেছি, তারা বললো, কিন্তু কীভাবে ঘটে তা আমরা দেখিনি।
আমি বললাম আমাকে গুলি করা হোক আর তবুও ওটা আমি করবো না, কখনই না, একদম না, প্রদর্শনী করবো না। হেলেন জানাপথে বাইরে তাকিয়ে থাকলো।
তারা বললো, প্লিজ, দয়া করে করো হেলেনের সাথে, মূল্যবোধের একটা তাত্ত্বিক ধারণা আমাদের দরকার, আমরা শংকিত।

আমি বললাম যে তাদের শংকিত হওয়া উচিত নয় (যদিও আমি প্রায়শই শংকাবোধ করি) আর বললাম সর্বত্রই মূল্যবোধ বিরাজমান। হেলেন এগিয়ে এলো আর আলিঙ্গন করলো আমাকে। আমি ওর চোখের পাতায় চুমু খেলাম কিছুক্ষণ। পরস্পরকে জাপটে ধরে থাকলাম। ছেলেমেয়েরা প্লুত বোধ করলো। তখন দরোজায় এক ধরণের টোকা পড়লো, দরোজা খুললাম আর নতুন একটা মরু ইঁদুর ঢুকে পড়লো শ্রেণিকক্ষে। দুর্দান্ত উল্লাসে ফেটে পড়লো বাচ্চাকাচ্চারা। 


প্রবন্ধঃ স্বপ্ন উড়ে আকাশে ।। জালাল উদ্দিন ইমন


স্বপ্ন উড়ে আকাশে

প্রতিটা মানুষের জীবনে সহস্র স্বপ্ন বুকে বাসা বেধে বসবাস করে কোনো একদিন এই স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পাবে বলে আমরা স্বপ্ন দেখেই যাই। পুর্ণ হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে অগ্রসর হয় প্রতিটা মানুষ, মাঝেমাঝে আমরা এমনই কিছু স্বপ্ন দেখি যেটা পূর্ণতা লাভের কোনো যোগ্যতা বা অধিকার মানুষের নেই তবুও প্রতিটা মানুষ তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষে সর্বদা সচেষ্ট দায়বদ্ধ। সেই স্বপ্ন গুলো ঘুমের ঘরে হোক কিংবা জীবনের কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষে জেগে উঠার যুদ্ধজয় করে বেছে থাকা। যেমন স্বপ্ন দেখে বিখ্যাত ব্যক্তিগণ তাদের জীবনপথ সুষ্ঠু পথে পরিচালিত করেছেন আর বিশিষ্ট মানুষদের কাতারে দাঁড়াতে পেরেছেন।
আগে শুনতাম বড় বড় বিখ্যাত ব্যক্তিরা ও বলে গেছেন স্বপ্ন দেখতে কিছুই লাগেনা শুধু দৃড় বিশ্বাসের সাথে স্বপ্নের পথে চললেই নিজের স্বপ পূর্ণ হয়ে যাবে।
আপনি নিজেই অনুমান করতে পারছেন বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে আপনি আমি আমরা কেউই একমত নই, আজকালের স্বপ্ন গুলো দেখে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়।
স্বপ্ন দেখতে টাকারপাহাড় লাগে, যদি আপনার এই জিনিষটা থাকে তবে স্বপ্ন কিন্তু আপনাকে দেখবে আপনার টাকাই দেখাবে যোগ্য কিংবা অযোগ্য প্রাইমারী পাশ করলে ও যদি ঐ পাহাড়তলি থাকে তাহলে স্বপ্ন আপনার পিছনে ছুটবে।

কত মানুষের কত স্বপ্ন এমনি কিছু যে স্বপ্ন আমাদের ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাতারে দাড় করাবে। চাই অনেক বড় কিছু হতে চাই সবার সামনে মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে তেমন কিছু লক্ষে আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টান্তর করি। কিন্তু আমরা যেভাবে স্বপ্নকে দেখি স্বপ্ন কী আমাদের সেই দেখে হয়তো, যদি সব স্বপ্নই আমাদের দেখার মত করে আমাদের দেখত তাহলে আর স্বপ্ন দেখার রুচিই থাকতোনা। স্বপ্ন দেখা কতটা কষ্ট কিংবা সুখ আমরা তা কখনো উপলব্ধি করতে পারতাম না যদি আমাদের ছোটবেলা থেকে দেখে আসা স্বপ্ন গুলো পূর্ণতা পেত। তবে স্বপ্ন কী জিনিষ কাকে বলে কত প্রকার কিছু বুঝতেই পারতাম না।
শুধু নিজের স্বপ্ন নয় মাঝেমাঝে পরিবারে দেখা কিছু স্বপ্ন ও বাস্তবায়নের লক্ষে সহস্র কষ্টভোগে  সাধনা করতে হয়। শিশু বয়সে মা বাবার স্বপ্ন থাকে তার সন্তান লেখাপড়া করবে বড় হয়ে একটা ভালো কিছু করে পিতামাতার মুখ উজ্জ্বল করবে। মনে হয় এ ছাড়া আর কিছু পাওয়ার থাকেনা, কিন্তু পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া স্বপ্ন গুলোতে শতকরা আশি জনই ব্যর্থ হই। কারণ ঐ স্বপ্নে নিজের আশা আকাঙ্ক্ষা থাকেনা তার দৃড় প্রত্যয় ও নেই আমরা ভাবি, কী একটা মা বাবা আমার ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এত কষ্টের জিনিষ তারা অবশ্যই জানতো তবুও আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছে কেনো। মাঝেমাঝে আমাদের অনেক রাগ হয় মা বাবার উপর কিন্তু ভাবিনা, এই কাজ করলে লাভজনক কে হচ্ছে আমি, না মা বাবা তাই তাদের দেখা স্বপ্নে আমরা তেমন আগ্রহশীল মনস্থির করিনা।
যদি তাদের স্বপ্নে বাস্তবায়ন করি তাহলে পৃথিবীতে মনে হয় আরাম-আয়েশ ঘুরাঘুরি মজার খেলা আড্ডা আমার জন্য সৃষ্টিকর্তা পাঠায়নি। আবার কিছু মা বাবা তাদের এমনো কিছু স্বপ্ন আমাদের উপর চাপিয়ে দেয় যা আমরা করতে পারিনা জানিনা আমাদের দ্বারা সম্ভব ও নয়। চেষ্টা করি হাজারো বার কিন্তু বারবার ব্যর্থ, এই রকম কিছু ব্যর্থতা আমাদের মানুষিক ভাবে জীবনপথ অচল করে দেয়, বা পাগলের মত কিছু পাগলের স্বপ্নের কথা শুনলে আমার চোখেরজল এসে যায় টলমলিয়ে অনবরত রক্তলাল থেকে কষ্টে সাদারঙ হয়ে যাওয়া ফোঁটাযুক্ত। হাজারো মানুষিকভাবে অসুস্থ মেধাবী শিক্ষার্থী লক্ষ করেছি তার মধ্যে ২ শতাধিক শিক্ষার্থীর মা বাবার দেওয়া স্বপ্নের পিছনে ছুটতে গিয়ে পাগলাগারদে অসহায় হয়ে পড়ে আছে।
আমাদের মা বাবারা মনে করেন শিক্ষায় তার সন্তানকে আলোকিত মানুষ গড়বে,আমি মানি, অবশ্যই মানুষের মত মানুষ হবে আলোকিত মানুষ হবে।

কিন্তু মা বাবা আপনারা শুধু শিক্ষার কথা ভাবলেন একটু নিজের সন্তানের উপর এত বড় চাপ প্রয়োগটা সে নিতে পারছে কী পারছেনা তা আপনার মাথায় রাখা দরকার,
কিন্তু যদি স্বপ্নটা নিজের দেখা কোনো স্বপ্ন হয় সেটাই ভালো, মনের কঠিন জোর দৃঢ়বন্ধনে আবদ্ধ নিজের লক্ষ হাসিলের উপর সর্বদা দায়বদ্ধ আর সেই স্বপ্ন গুলোই বেশি সত্যি হয়।
হোক না  তবে সেটা খেলা কিংবা অন্যান্য কোনো বিনোদন,বা খেলাই শুধু কী লেখাপড়া করে বিখ্যাত ব্যক্তি আছে  খেলা বিনোদন সংগীত সাহিত্যের মাধ্যমে ও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি আছে  যা আপনাদের মাথায় থাকেনা ।

পরিশেষে
স্বপ্ন মানুষকে বাছতে শিখাই আশা দিয়ে ধৈর্যধারণ করতে শিখাই। জীবন সাজানোর প্রেরণা যোগায় বারবার ভেঙে যাক তবুও বাছার আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা দেখেই চলি, স্বপ্ন আমাদের দেখছে কিনা তা ভাববার বিষয় নয়।  

অনুবাদ কবিতাঃ শৈল মন্দির ।। হিল্ডা ডুলিটেল (HD)।। ভাষান্তর ।। আবুল কাইয়ুম












শৈল মন্দির
----------------------------------------
মূলঃ হিল্ডা ডুলিটেল ( HD)

ভাষান্তরঃ আবুল কাইয়ুম
১.
প্রকাণ্ড, উজ্জ্বল দরোজা,
শৈল চত্বর,
দীর্ঘ স্তবকে স্তবকে সাজানো শিলা,
কৃষ্ণ পাথর, রুপোলি গ্রানাইট
এবং আলোকিত শৈল বিন্যাস-
স্বচ্ছ, সুগঠিত সফেদ নির্মাণ।
অনেক উষ্ণতা, কোনো পাহাড়ি ছাগল
এখানে চারণ করে না, কোনো পাহাড়ি হরিণ
তোমার সুন্দর ঘাসে পা রাখেনি;
পৃথিবীর শেষ প্রান্ত যেন তুমি,
আকাশ-খিলানের দিকে স্তম্ভ তুলে ধরে আছো।
পৃথিবী যেন উত্তোলিত হয়েছে-
আমরা আকাশের কাছাকাছি,
আমাদের ঊর্ধ্বে সামুদ্রিক বাজপাখির চিৎকার,
নাগালের বাইরে গাংচিলের দ্রুত পলায়ন, 
শৈলদেহে আছড়ে পড়া প্রচণ্ড সামুদ্রিক ঢেউ
ভয়ার্ত, নীরব এখানে।
আমাদের নিচে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে,
যেখানে পৃথিবী পড়েছে ধরা
এবড়ো-খেবড়ো শৈল ফাটলে
সেখানে মৃদু ঝড়ের ঝাপটে বেঁকে গেছে
একটি ছোটো গাছ, শুভ্র ফলগুলো তার
এই উচ্চ শিখরেও গন্ধ ছড়ায়।
এবং আরো নিচে
বাতাস গর্জে ওঠে আরো,
শিস দেয়, বজ্রনাদে মাতে
ক্রোধে গোঁ গোঁ করে ওঠে,
শক্ত পায়ে মাড়িয়ে যায় ঘাস।
২.
বললাম : আমি কি এইভাবে
চিরদিন অনবরত
এইসব পাথরের মধ্য দিয়ে
তোমাকে অনুসরণ করে যাবো?
আমি তোমাকে ধরতে চেষ্টা করি-
কিন্তু টলতে টলতে সরে গেলে;
তুমি আমার হাতের থাবার চেয়েও দ্রুতগতি।
এ কি বিস্ময় তুমি ! 
আমি চিৎকার করলাম-
হে প্রিয়- হে রহস্যময়- হে সুন্দর-
হে শ্বেতগুল্মের মাংস।
কিন্তু আমি খণ্ডিত হলাম, ছিন্ন হলাম।
আমার এই পায়ের চেয়েও পাহাড়ি পথ
দ্রুত ঊর্ধ্বারোহী।
যদি কোনো অপদেবতা এই্ আঘাতের
প্রতিশোধ নিতে পারে, আমি চিৎকার করে বলবো,
যদি কোনো ভুত পারে-
আমি চিৎকার করে বলবো, হে দুষ্ট
তুমি এই ঈশ্বরকে ধাওয়া করো, 
কুকর্ম ও পাপের জন্য তাকে বিদ্রুপ করো।
৩.
আমি কি এই দুর্দশা থেকে নিজেকে
নিক্ষেপ করতে পারবো , আমি কি
লাফ দিতে সক্ষম হবো এবং তোমার নিকটে যাবো?
নাকি হে প্রিয়, গোড়ালিতে গোড়ালি জড়িয়ে
পতিত হবো নিচে?
তুমি কি আমাকে করুণা করবে হে সফেদ ম্তন,
আমি যদি জাগ্রত হই, তুমি কি আমাকে
করুণা করবে, চোখে চোখ রাখবে?
তুমি কি শুনছো
তুমি কি জানো কীভাবে আমি এই পর্বত
আরোহন করেছি?
আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিলো, পা টলমল করছিলো,
অনেক হোঁচট খেয়েছিলাম গুল্মের মাঝে।
তুমি কি জানো শৈল শিখরে উপবিষ্ট হে ঈশ্বর,
তোমার গৃহের চত্বরে পৌঁছতে
আমাকে কতোদূর হাঁটতে হয়েছে?
৪.
আমার ঊর্ধ্বে বাতাস ঘূর্ণিত হচ্ছে।
আমি তোমার দরোজায় এসে দাঁড়িয়েছি
এবং আমি জানি-
তুমি দূরে, অনেক দূরে,
এমনকি আর একটি উঁচু পাহাড়ের চেয়েও।

নেই কেন সেই পাখি ।। নির্মলেন্দু গুণ










নেই কেন সেই পাখি


দুঃখ সে নয় শুধুই আমার একার,
তোমারও কিছু অংশ আছে তাতে ।
নিবিড়ঘন ব্যথার পাশাপাশি,
তুমিও মিশে আছো আমার সাথে ।
দুঃখ সেও নেশার মতো লাগে
যদি ওটা তোমার দেওয়া হয়,
অন্য যতো দুখের কথা জানি
তার কিছুই চাওয়ার মত নয় ।
তুমি আমার ভিতর বাড়ি চেনো
তাই সহজে প্রবেশ করো মূলে,
যারা আসে সুখের স্মৃতি হতে;
হারায় তারা পথের হুলুস্হুলে।

একটি মানুষ ।। শক্তি চট্টপাধ্যায়























একটি মানুষ 

একটি মানুষ দেখেছিলাম, দাঁড়িয়েছিলেন একা 
হঠাৎ পথে দেখা আমার, হঠাৎ পথে দেখা 
সবাই তাঁকে দেখতে পায় না 
সবাই তাঁকে দেখতে পায় না 
কিন্তু, তিনি দেখেন– 
কোথায় তোমার দুঃখ কষ্ট, কোথায় তোমার জ্বালা 
আমায় বলো, আমারই ডালপালা 
তোমার এবং তোমার, তুমি যেমন ভাবেই কাটো 
আমি একটু বৃহৎ, তুমি ছোট্ট করেই ছাঁটো 
লাগবে না লাগবে না 
আমি কি আর পাথর, আমায় লাগবে একটুতে? 
মানুষ আমি, কী মনে হয়? মানুষ সহ্য করে।

সৌমিত্র চক্রবর্তীর তিন কবিতা










সৌমিত্র চক্রবর্তীর তিন কবিতা

যাচ্ছেতাই


অসহ্য টুকিটাকি ব্যাথার সন্ধিছায়ায়
তিন দুগুণে ছয়, ছয় দুগুণে...
কতদূর পৌঁছলে খেই হাতের নাগালে?
এককাপ ব্ল্যাককফি, একটা সিগারেট
কখনো এইই যথোচিত
কখনো আঁতেল সিনেমার টুকরো।
এরচেয়ে ভোরবেলা শুরু হোক
শুদ্ধ বাংলা মালেই,
অন্তত তাহলে ফেরেব্বাজীর মুখোশ
ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া যায়;
অন্তত কেউ তো বলবে না
আয় তোকে মুরগি করি!


রক্তছাপ

কথা ছিল সাবান আর জল
দিয়ে দিনের প্রত্যেক সেকেন্ডের গায়ে
লেগে থাকা আঁশগন্ধা রক্তচিহ্ন
তুলব অসময়ে।
বলনি তো, নিজেই
রক্তের পান্ডুলিপি হয়ে
আবিস্কৃত হবে চানঘরের অন্ধ ছায়ায়?
এত হাসি, এত কথা
ছৌনাচের পুরাইতিহাস
কিম্বা রাজপুরুষের পদস্খলনের
মজারু বৃত্তান্ত সাবলীল ব্যাটে
ছক্কায় মাঠের ওপারে উপগ্রহ হতো,
কোনো অসতর্ক পিছলানো
নো বলের ভুলেও বলনি তো
নগরীতে সিজোফ্রেনিয়া
গোকুলে বেড়েই চলেছে!
আজ ঘন্টাটা ছিঁড়ে পড়তেই
ভয়ংকর আওয়াজেরা মিলখা সিং হয়ে
ছুটে গেল ভয়ের বরফ স্রোতে।
শোকোত্তর হুল্লোড় ডেসিবেলের লাল
দাগ থেকে দূরে চলে গেলে
দেখলাম, সম্পর্কের সুতোগুলো
ছেঁড়া কুটিপাটি নেতিয়ে পড়ে আছে
শুকিয়ে যাওয়া রক্তের কালো ছাপে।


মৃত্যুকালীন 


এক একটা সময় আসে মৃত্যুকেই চাই
অভিমানের ক্ষুরধারে পা দোলাই বসে।

ক্যালেন্ডারের পাতা ওড়ে, ডায়েরি বিবর্ণ, 
হঠাৎ হাওয়ার ঝোঁকে মনের নোংরা ভাসে।

একশো বছর বেঁচেও নিজেকে চেনা যায়?
একলাইনের আত্মজীবনী আঁকে সম্পূর্ণ মানুষ?

শুধু মুখোসের ছদ্মআবরণে ঢাকা কালো বলিরেখা,
শুধু দিন কাটে, রাত কাটে নিজেরই ঢক্কানিনাদে।

সময়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সব ফানুস ফেটে গেলে
শুধু মৃত্যুকেই বন্ধু মনে হয়।

সোমনামবিউলিসম ।। অর্পিতা আচর্য

















সোমনামবিউলিসম 

ভুলে যেতে চেয়েছি সব স্বপ্ন-বিকৃতি 
চারপাশে ঝুলে থাকা সরব চাদরে 
লুকিয়ে ক্লান্ত মুখ, 

তবু রাতের বাইপাসে -
এখনো অলীক সব যাত্রীবাস যায় 
কুয়াশা কুয়াশা গন্ধ জানালার কাচে 

মাঝরাতে  ঘুম ভাঙলে বেড়ালের পায়ে 
হাঁটি ছাদ, সিঁড়ি, বারান্দা ও গেট 
মাধবী লতার ঝাড়, দুলে দুলে, আটকায় পথ 
দিকভ্রান্ত নিশিডাক, যেন এক হ্যালুসিনেশন
ছায়ার মতন কারা উঁকি দিয়ে চলে গেছে 
স্বপ্নে এসে - অই সব চওড়া চওড়া পথে 
বাতাসের মত যেন ছুটছে কারা যাত্রী বাসে বাসে 
হলুদ চাদর মুড়ি,  পাথরের মত সব সার সার মুখ 
জানালায়  বসে আছে নিস্কম্প, উদাস, নিষ্ঠুর-
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে ওরা সব কতকাল ধরে 

যাওয়ার রাস্তায় শুধু হাতছানি 
দিয়ে গেছে স্বপ্নে, আমাকে !

মন ।। কল্যাণী তালুকদার






















মন


ক'দিন ধরে তুমি খুব অসুস্থ.....
হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি,
তোমার শরীরটা যেন
একটা আধপুড়া রুটি....
ঘুন খাওয়া কাষ্ঠ খন্ড... 
তাতে একটা পিন ফুটেছে...!
যেদিন দেখে এসেছিলে
নিঃসন্তান সেই বিধবাকে...
ওর ভীষন কষ্ট.....
অর্ধাঙ্গ অবশ....!
ঠেলাঠেলি পরিজনদের
ওর সেবা নিয়ে....!
শুধু তাই নয়
দেখছি,তুমি প্রায়শই
অসুস্থ হও নানাবিধ কারনে।
ঠিক অনুভূত হয়না...
কোথায় চিনচিনে ব্যথাটা....
অহর্নিশ কষ্ট দেয়!
বড় অসহায় তুমি....
হস্তপদ হীন
অসমর্থ.....!
তোমার অদৃশ্য হৃৎপিন্ড
দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত
অনবরত রক্তক্ষরণ চলে....!
তুমি তো নির্বাক
বাকশক্তি হীন...!
কিন্তু, তোমার হাজার কোটি চোখ
সে চোখ গুলো
পুরো পৃথিবীটাকে
এক নিমেষে দেখে নেয়....!
সাবলীল দৃশ্য গুলো তোমাকে
পাগলের মত হাসায়!
নির্মমতা গুলো অগুনতি
শানিত অস্ত্র হানে উপর্যুপরি
ভারসাম্য হারাও অবশেষে...
কি? ঠিক বললাম তো?

দেশপ্রেমের উষ্ণতা ।। এ বি এম সোহেল রশিদ










দেশপ্রেমের উষ্ণতা


সাইবেরিয়ার তুষার ঝড়ে পালিয়ে আসা 
পরিযায়ী পাখির ডানায় আনা বরফস্তুপ 
নিযুত চেষ্টায়ও শীতল করতে পারেনি
দেশপ্রেমের উষ্ণতা

চোলিস্তান ও থর মরুভূমির শিকারি বাজপাখিও
ছেড়ে দেয় হিংস্রতা মুক্তিকামীদের বজ্রকঠিন দৃঢ়তায়।
আমার এই নরম মৃত্তিকায় মুখরিত হিন্দোলে
বিসর্জন-নদীর বুকে অশ্রুরঙ মেখে ফোটে রক্তশাপলা

সবুজফসলের ক্ষেতে উঁকি দেয়া লাল অর্ক
কখন যে হয়ে গেছে লালসবুজ পতাকা
সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে নয় মাসে
নদীর আঁচলে বাঁধা ভূখণ্ডটিও হয়ে গেছে
একটি সার্বভৌম মানচিত্র।
গভীর দুর্যোগেও লাঙলের চুম্বনে দ্বিগুণ ফসলে
ভরে উঠে আমার গোলা; ভারে উঠে জলাশয়
মাছে মাছে। শিশির পাখা মেলে বসে দূর্বাঘাসে
আগামীর সূর্য কিরণে হাসবে সে সবুজের বুকে

স্বাধীন দেশের স্বাধীন শিশু, পা রাখে পৃথিবীর পথে
হাজার বছরকে সঙ্গী করে সে ভবিষ্যৎ যাত্রায়
গাইছে গান; প্রাণ খুলে বাতাসের কানে কানে
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি

একাকার ।। সাইদুর রহমান










একাকার


কেউ কি ভাবে অবনী পরে
থাকবে না সে চিরকাল;
কেউ তো জানে না চুপিসারে
অপেক্ষায় ঐ মহাকাল।

শুনিয়ে গেলে তুমি যত গান
বাতাসে বাজে সর্বক্ষণ;
ঢেলে গেলে প্রেম অভিমান
হাসায় কাঁদায় ভুবন।

যে ফুল ফুটলো আজ কাননে
দুলে দ্যাখো কি উচ্ছ্বাসে;
কোমলতায়, তার রূপে গুণে
মোহিত সবাই সুবাসে।

এক দিন তারও তিরোধান
জন্ম পুন নূতন প্রাণ;
মন ব্যাকুল, করে আনচান
বারে বারে স্মৃতি স্নান।

পালাবদল যেন এ পৃথিবীতে
আমার, কাল তা তোমার;
যায় মিশে, পরিশেষে ধুলোতে
সব নিশ্চিহ্ন একাকার।

তিন অণুকবিতা ।। সিদ্দিক প্রামাণিক

















বুদ্ধ পাহাড়

এভিলেটর এক্সক্যালিটরের জিহ্বা
বুদ্ধ পাহাড় থেকে অহিংস কেটে 
শহর বানায়।

তারপর মৌসুমী বৃষ্টির ঢলে
হিংসার বুটের নিচে চাপা পড়ে
নিরিহ পিঁপড়ে, সামান্য আরশোলা 


ইঁদুর

সুরঙ্গ বেয়ে চলে গেল গনিকা বাড়ি
তারপর গোপন গহ্বরে
রেখে এলে কৃষকের লবনাক্ত ঘাম
 

জেলে বু'

বালুর কাফনে নদী মরে গেলে
জালের মধ্যে বাস করে শুধুই অবসর।
তখন জেলে বৌয়ের ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক,
সস্তা পাউডারে লেপ্টানো মুখে-
মাছিদের ভিড়

সন্ধ্যার পাড়ায় জেলে বু'দের খুব নামডাক শুনি

দেহের ভাঁজে হয় সাধুত্ব বিলিন ।। শামীম আহমেদ

















দেহের ভাঁজে হয় সাধুত্ব বিলিন 

মহাকালের কলেবরে দেখি বিষন্ন মানবতার মুখ,
পোড়া চোখ বারবার ব্রোথেলের দরজায় কড়ানাড়ে,
পুড়ে দগ্ধ হয়,আবার পুড়ে নগ্নতার সুন্দরর্যে;
সামাজিক গণ্ডীর ওপাশে আরেক সমাজ
সেখানেও সামাজিক জীবনের উচ্ছ্বাস,দেহের
প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে হয় সাধুত্ব বিলিন 
বীর্যহীন নিরবতার মৌন প্রহর শেষে ।

তারপরও পূজা আর্চনা অমরত্বের বিলাপ 
সেখানেও পূজা মণ্ডপ,সেখানেও হয় আরাধনা 
স্বর্গের আকাঙ্ক্ষা ধর্মের গণ্ডী হয়তো পেরোতে
পারেনা তবুও মনের গহিনে সত্য দানাবাঁধে ;
স্বর্গে যেতে কে না চায়,কেউ কেউ অন্তহীন পরকালের 
বিশ্বাসী আমার মতো ;
তারপর হিসাব কষে দেখি নরকের দরজায় আমি ;

আসল সত্যটা দূরে বসে কটাক্ষ করে হাসে ।


আমি তখনও লাশ হয়ে থাকবো ।। আহমেদ মুনীর









আমি তখনও লাশ হয়ে থাকবো 

তুমি ভালোবাসো পদ্মাপারে যমুনার বুনোজলে
বসুন্ধরা বাউনিয়ার গৃহকোণে সামীর জামিউল যুবকের
আকাশ কাঁধ কপোল চিবুক নাঙ্গা অধর
আর আমার নিষ্প্রাণ লাশ ।।

পড়ার টেবিলে নির্ঘুমে জড়াও তাকে যদি বলো ‘ভালোবাসি
আমিতো আছি প্রত্যহ তোমারই’
ক্লাশের ক্লান্তির একঘেয়ে অবসরে
ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত ঘর্মাক্ত উৎসুকে তার হাতে চাপ দিয়ে
নিশ্চিত করো তোমার ভালোবাসা
সিনেপ্লেক্সের কর্ণারে কিংবা মধ্যরাতে
পাশাপাশি শুয়ে আধোঘুমে বুকে চেপে ধরে
প্রমাণ করো নিশ্ছিদ্র ভালোবাসা 
দুজনে একত্রে পার্কের রাস্তায় হেঁটে কিংবা দূর্বাঘাসে বসে
তার কাঁধে হাত রেখে বলো ‘সখে, তোমাকেই ভালোবাসি’  
প্রত্যুষে খুব ভোরে দিবসে প্রথম আলো আঁধারে
তার কপোলে গালে হাত বুলিয়ে বুকে বুক মুখে মুখ রেখে
একটু বেঁকে ভালোবাসার কবিতাসমগ্র আবৃত্তি করো ।।

কখনও অসুস্থ হলে জ্বরে শরীর কপাল পুড়লে
মাথায় পানি দিতে দিতে তার মুখের দিকে ঝুঁকে
তোমার গরম শ্বাস তার শ্বাসে বয়ে দিয়ে দাও
আর বলো ‘ভালোবাসি ভালোবাসি আর চাই শুধু তোমাকেই’
এমনকি প্রচণ্ড যুদ্বের দামামায় পাগলিনীর বেশে উদ্বিগ্ন হয়ে
তাকেই ভালোবাসার আশ্বাসে নির্ভার করো
পোখারার সাত তারকা ফুলবারীতে তার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে
সুটকেস ফেলে রেখে বড়ো আদরে তাকে বুঝিয়ে দাও
অথবা সরাসরি সোজাসুজি তাকে সঠিক উচ্চারণে বলো
তোমার অনুরাগ ভালোবাসার কথা ।।
প্রচণ্ড ঝড়ে যখন ওড়ে যায় আশ্রয় ঘরবাড়ি
তার বুকে মাথা রেখে মাথা ছুয়ে বলো ‘ভালোবাসি’,
সবশেষে যখন চিরনিদ্রায় মাটির ঘরে হবে তার শেষ বিছানা
সেখানেও যেভাবেই পারো চিৎকার করে ধ্বনিত করো
‘ভালোবাসি ভালবাসি, ভালবাসি’ -
আমি লাশ হয়েও তোমার সেই কণ্ঠস্বর শুনবো, বুঝবো
তুমি ভালো আছো
তাকে ভালোবেসে কোন কষ্ট নেই তোমার এখন আর
আমি তখনও লাশ হয়ে থাকবো নিশ্চল নিশ্চুপ নিরাকার ।।

মুক্তি চাইছি ।। কাজী জুবেরি মোস্তাক









মুক্তি চাইছি 

স্বাধীনতার উল্লাস আজ মনে হয় ফিকে
যখন দেখি মানবতাটা মরছে ধুঁকে ধুঁকে ,
স্বাধীনতা অাজ পরে আছে আস্তাকুঁড়ে
আর পরাধীনতা দেখি বুক উঁচিয়ে চলে ৷

ভাষার স্বাধীনতাতো পেয়েছি বায়ান্নতে
তবুও বলার স্বাধীনতাটাও চাইতে হচ্ছে ,
গণতন্ত্র নামক বিজয় পেয়েছি একাত্তরে
গণতন্ত্রেরও স্বাধীনতা দরকার আজকে ৷

বলতে গেলেই যদি গলাটা দাবিয়ে ধরো
তবে বায়ান্নয় এ জাতি কি পেলো বলো ? 
চুপ করে থাকাই যদি হয় বাকস্বাধীনতা 
তবে আমি চাইনা তেমন বাকস্বাধীনতা ৷

যে গণতন্ত্রটা এসেছিলো বিজয়ীর বেশে
সে গণতন্ত্র আজ মুখ থুবড়ে পরে আছে ,
আর পরিবারতন্ত্র বিজয়ীর বেশে ঘুরছে
নির্বোধ বাঙালী তাতেই হাততালি দিচ্ছে  ৷

আর না অনেক হয়েছে অনেক দেখেছি
বায়ান্নয় পাওয়া বাকস্বাধীনতাটা চাইছি ,
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের গণতন্ত্র খুঁজছি
চাইছি শকুনের ছায়া পরা পতাকার মুক্তি ৷

গল্পঃ পিছুটান ।। দ্বীপ সরকার


পিছুটান

মাজেদার বয়স ১৮ কিংবা ১৯ এর মধ্যেই হবে। বাবা ময়েন উদ্দিন লাঠি ধরে ধরে হাঁটার বয়সে পা দিয়েছে। পঁচাশি তো হবেই। সন্তান হয়না হয়না করে শেষ বয়সে এই মাজেদা সংসারে আসে। মা,টা তাকে কোনমতে দুধপান করাতে পেরেছে। তারপর স্তন ক্যান্সারে তার মা ছকিনা বিবিও পরলোক গমন করেন। ছকিনার মৃত্যুর সময় মাজেদার বয়স হয়েছিলো তিন বছর।

ময়েন উদ্দিন এখন সংসারে কলার গাছের মতো। এমনি দাঁড়িয়ে আছেন মাত্র। কুঁজো হয়ে লাঠি ধরে হাঁটেন। কোন মতে খাবারের সময় হলে একটু খান। গোসল টোসল ঠিকঠাকমতো করতে পারেননা। মাজেদা তির তির করে বড় হয়ে উঠলো। লেখা পড়া পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত করতে পেরেছে। এর পর টাকা পয়সার অভাবে স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেনি। একবেলা খেলে আরেক বেলার জন্য চিন্তা করতে হয়। তাই মাজেদা চিন্তা করলো তাকে একটা কিছু করতেই হবে। অন্তত বৃদ্ধ বাবার মুখে দু - মুঠো ভাত তুলে দিতে পারলেই হলো।পাশেই বড় চাতাল। বড় রাইসমিল।  যেখানে প্রতিদিন শত শত মন ধান ভাঙ্গা হয়। মাজেদা প্রায়শঃই দেখেন চাতালে আট দশজন মহিলা প্রতিদিন কাজ করে। পুরুষও আছে অনেক।


সেদিন শনিবার। মাজেদা সকালেই চাতালে গেলো। চাতালের একপাশে অফিস। মাজেদা একজন মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো,
ঃ মালিক কোথায় আছেন?
অফিসের দিকে ঈশারা করে মহিলা বললেন,
ঃ ওই যে, ওই দিকে যান। ওহানেই উনি আছেন।

মাজেদা তাই করলো। সাহস করে চাতালের মালিকের অফিসে গিয়ে ঢুকলো। 
ঃ স্যার, একটা কথা কবার চাচিলাম।
ঃ কি কথা। বলুন। 
ঃ হামার মা নাই, বাপটা মরে মরে অবস্থা।
সংসারে এখন হামি ছাড়া কেউ নাই। তাই হামাক একটা কাজ দেন।
চাতালের মালিক একটু গম্ভীর স্বরে বললেন,
ঃ তা দেবো। তো, বাড়ি কই তোমার? 
ঃ হামার বাড়ি স্যার এহানেই। এই গ্রামেই।
ঃ কার মেয়ে?
ঃ ময়েন উদ্দিনের। 
ঃ ও। এর আগে মনে হয় তোমাকে দেখিনি।
ঃ আমি বাড়ির বাইর হইনা। কিন্ত এখন.....
কথাটা বলে মাজেদার চোকে সামান্য পানি আসলো। চাতালের মালিক স্বপন চৌধুরি মানুষ হিসেবে ভালো তবে ভেতরে ভেতরে চিজ একটা। স্বপন সাহেব বললেন,
ঃ টেনশন করোনা। কাল থেকে এসো। 
কথাটা বলে মাজেদার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। মাজেদা লজ্জা পেয়ে সালাম দিয়ে উঠে চলে গেলো।

একমাসের মত হচ্ছে মাজেদা চাতালে কাজ করে। এখানে যারা কাজ করে  সেসব মহিলার থেকে মাজেদা বয়সে অল্প। অবিবাহিতা। রুপ লাবণ্যের ছোপ শরীরে বেশ লাগিয়ে আছে। ফর্সা নয়। তবে শ্যামলার চেয়ে আরো একটু উজ্জল। যেটা মাজেদার জন্যই হয়তো মানায়।
মুখয়বের একটা আর্ট আছে। গায়ের জামা কাপড় দামী নয় তবে পরিষ্কার পরিপাটিতে মাজেদা এক ও অদ্বিতীয়। চাতালের মালিক স্বপন চৌধুরী যখনি অফিসে এসে বসেন তখনি মাজেদাকে ডেকে পাঠায়। মাজেদাও প্রতিদিনের মতো এক গ্লাস পানি হাতে চলে যান অফিসে। আজকেও সেরকম ঘটলো। স্বপন সাহেব চাতালে আসলেন। 
ঃ এই, মাজেকে ডাকতোরে
ওখানে আরেক মহিলা কর্মি  মাজেদাকে বললো,
ঃ ওই ছুঁরি, তোক ডাকে যা..
মাজেদা অফিসে গেলো। স্বপন সাহেব বললেন,
ঃতোমাকে এই মাহিলাদের টিম লিডার বানাতে চাই। তোমার মত কি?
ঃ হামি যে নতুন। আর ওরা তো হামাক হিংসা করে খুব।
ঃকেনো হিংসা করে?
ঃ এই যে, কাউকে না ডেকে হামাক ডাকলেন ।
ঃ ও।  সমস্যা নাই। ওরা তোমার কিছু করতে পারবেনা। আরেকটা সুসংবাদ আছে।
ঃকি?
ঃ এই মাস থেকে তোমার বেতন হবে তিনশ টাকা দিন হাজুরা। অর্থাৎ নয় হাজার টাকা মাস।
কথাটা বলে স্বপন সাহেব মাজেদার ডান হাতটা ধরতে চাইলে মাজেদা দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।
মাজেদা সব বুঝে। জ্ঞান বুদ্ধিতে পাকা একটা। মালিক মশাই কি বলতে চায় সেটা মাজেদা ঠিকই বোঝে। অার আর মহিলারাও তাতে একটু মাইন্ড করে বসে। সেটাও মাজেদা বোঝে। সেকারনেই ওরা হিংসা করে। কিন্তু মাজেদার অার্থিক সাপোর্টটা বড় ব্যাপার এখন। তাই মাজেদা চুপচাপ ভাবছে একাকি। সেদিন সন্ধ্যার আগেই মাজেদার কাজ শেষ হলে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো। চাতাল থেকে বাড়ি পায়ে হাঁটলে ছয় / সাত মিনিটের পথ। মাজেদা সময় কম তাই জোরেই হাঁটছে। পিছন থেকে এক যুবক ঢন ঢন করে সাইকেলে বেল দিতে দিতেই মাজেদার গায়ের সাথে বেজে গেলো। ছেলেটি পাশে পড়ে গেলো। তাতে ছেলেটির হাত পা অাঘাতে ছিলে গেলো। মাজেদা হতভম্ব হয়ে গেলো। মাজেদা ছেলেটিকে মাটি থেকে তুলতে চাইলে ছেলেটি বাধা দিয়ে বললো।
ঃ সাইকেলের বেল শোনেননা?  কান কি ঠসা?মাজেদা একবার শুধু "সরি,, বলে  চলে গেলো।

পরের দিন সকালে মাজেদা তার কর্মস্থলে আসার জন্য সড়ক দিয়ে হাঁটা শুরু করেছে। আবারও ওই ছেলেটি সাইকেল নিয়ে বেল দিচ্ছেন আর হাঁকিয়ে পেডেল মারছেন। মাজেদাকে দেখে চিনতে পেয়ে ছেলেটি সাইকেল থেকে নেমে মাজেদার সাথে হাঁটা শুরু করলো। 
ঃ আপনার নাম কি?
মাজেদা মুচকি হেঁসে বললো
ঃ নাম শুনে কাম কি?
ছেলেটি তার হাতের ক্ষতদাগ দেখিয়ে বললো
ঃ দেখেছেন, কি হচে হামার?
মাজেদা নিজেকে অপরাধী মনে করে। তাই একটু সহানুভূতি দেখানো দরকার। একটু ভেবে আস্তে বললো
ঃ নাম হামার মাজেদা। মাইনসে মাজে করে কয়।
ঃ নামটাও সুন্দর। আপনিও সুন্দর। রাতে ঘুম হয়নি। বড় জ্বালা করেছে হাতে।
মাজেদা লজ্জা পেলো।
ঃ সরি। আর বলেননা।
বলে মাজেদা সটকে পড়লো চাতালের দিকে। ছেলেটি সাইকেলে চেপে ঢন ঢন করে বেল দিতে দিতে চলে গেলো।

চাতালে এসে মাজেদার মনটা কেমন করছে। এদিকে সব মহিলাদের লিডারশীপ। মাজেদা সবাইকে ধানে পা দিতে বলে এক ঢোক পানি মুখে দিলো। রোদ পড়েছে খুব। অনেক ধান। একশ মনের বেশিই হবে হয়তো। বিকেলে আবার ধান মেশিনে ঢুকবে। তাই মাজেদা হিসেব করে নেতৃত্ব দিচ্ছে। চাতালের মালিক এসে বললো। 
ঃ এই মাজে, সকালে ভাত খেয়েছো?
ঃ হ। 
ঃ বুড়ো বাপরে খাওয়াইছো?
ঃ হ। 
এতটুকু খোঁজ নিয়ে স্বপন সাহেব শহরে চলে গেলো আর বললো। "ভালো করে সকলে কাজ করো,,।

দূপুরে খেয়ে দেয়ে সবাই ছায়ায় বসে আছে। মাজেদা বয়সে সবার ছোট। তবে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া থাকায় পড়তে ও লিখতে পারে সুরুতহালেই । মাজেদা আরেকজন সহকর্মীকে নিয়ে রাস্তার উত্তরপাশে হাঁটতে যায়। এক মাসের বেশি হয়ে গেলো এদিকে আসেনি। মাজেদা ডান দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে গেলো সেই ছেলেটি আরেক চাতালে কাজ করছে। ছেলেটিও দেখছে মাজেদাকে। দুই জন চোখে চোখ রাখলো সামান্যক্ষণের জন্য। অতঃপর মাজেদা তার সহকর্মীকে সাথে নিয়ে নিজ চাতালে আসলো। তার সহকর্মী হাজেরা কিছুই টের পেলেননা। 

ছেলেটির নাম নয়ন শেখ। ডাক নাম নয়ন। গত দুদিন হলে কেমন যেনো আনমনা। মাজেদার প্রতি একটা গোপন টান। কিছুক্ষণ পর নয়ন কাজের ফাঁকে একটু "গাও জুড়ায়ে আসি " বলে সরদারকে সিগনাল দিয়ে এ দিকে আসলো। আসার সময় পাশের মুদি দোকান থেকে দশটি চকলেট নিয়ে আসলো। এসে দেখে নয়নের পরিচিত দুইজন পুরুষ এখানে কাজ করে।
ঃ এ, নছের ভাই, আাপনি এটি কদ্দিন হলে?
ঃ হয়েই তো গেলো ছয় সাত মাস।
ঃ ও। ভালোই তো।
কথাটা বলে নয়ন তার পকেট থেকে চকলেট বের করে সবাইকে একটি করে দিলো। কিন্ত মাজেদার এখানে  এসে ওকে দিলো দুটি । যদিও সবগুলি দেয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্ত পরিবেশ সেরকম ছিলোনা। তাতেই মাজেদা মনে মনে খুব খুশি হলো। মাজেদা চকলেট নিয়ে ওর দিকে চেয়ে একবার ছোট্র করে মুচকি হাঁসলো। নয়ন দ্রুত তার নিজ কর্মস্থলে চলে গেলো।

এরি মধ্যে চাতালের মালিক স্বপন চৌধুরি এসে উপস্থিত হলো। এসে মাজেদার খোঁজ আগে।
ঃ কি খবর মাজে?  কাজ কর্ম কেমন হচ্ছে?
ঃ ভালো। আজকে তো এখনো রোদের চিকাস বারাইনি। এতগুলো ধান।
ঃ খুব শীত পড়েছে। রোদের চিকাস বের হয়তো ।
স্বপন সাহেব এতটুকু বলে অফিসে ঢুকলো সাথে মাজেদাকেও আসতে বললো।
মাজেদা  নিয়মমত এক গ্লাস পানি নিয়ে অফিসে ঢুকলো। স্বপন সাহেব একটু দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ চিত্তে বললো।
ঃ তোমাকে একটা কথা বলবো
ঃ কি কথা।
স্বপন সাহেব ইতস্তত স্বরে আস্তে বললো।
ঃ ইয়ে মানে। তোমাকে বি, বিয়ে করতে চাই। তুমি কি তাতে রাজি?
মাজেদার চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। লজ্জা এবং ভয়। সব মিলিয়ে মাজেদা চিন্তায় পড়ে গেলো । স্বরটা এলোমেলো হয়ে গেলো তার।
ঃ আপনার না বউ ছোল আছে?
ঃ ধুত্তুরি। না থাকে। তোমার জন্য আলাদা বাড়ি করে দেবো।
মাজেদা এতটুকু বলে মুখে চাদর গুঁজে চলে যেতে লাগলে স্বপন সাহেব তার হাত ধরে ফেলে। হাত ধরে নিচের চেয়ারের পাশে বসালো এবং কপালে ছোট্র করে কিস দিলো। মাজেদা নির্বিকার। এখানে তার করার কিছুই নাই। গরীবের খুব বেশি ইচ্ছা থাকতে নেই। কোটিপতি লাখোপতিদের এগুলো ব্যাপার নয়। তারা জানেই গরীবরা পেটের দায়ে মুখে কূলুপ দেয়। মাজেদা ভয়ে লাল হয়ে গেলো। বললো।
ঃ হামাক যেতে দিন। মানসে দেখলে ক্যালেঙ্কারি বের করবি। 
স্বপন বললো।
ঃ ও সব চিন্তা করোনা। আমি তো বিয়েই করবো।
মাজেদা কান্না স্বরে বললো।
ঃ হামি আজ কাজ করমোনা । হামাক ছুটি দিন,  বাড়ি যামো।
ঃ ঠিক আছে যাও। কাল সকালে এসো। আর সন্ধ্যায় তোমার বাড়িতে যেতে পারি।
ঃ না। বাড়িতে যাবেনা।
এই কথা বলে মাজেদা কোথাও না থেমে সোজা বাড়িতে চলে গেলো। চাতালের সবাই তার যাওয়া দেখলো। "ইদানিং স্যারের সাথে খুব ভাব দেখতাছি " হাজেরা মন্তব্য করলো। মেরিনা বললো " কি যে হচ্ছে আল্লা মাবুত জানে "।


মাজেদা বাড়ি গিয়ে বৃদ্ধ বাবার সাথেও কথা না বলে গায়ে লেপ দিয়ে  শুয়ে পড়লো। শরীরের ভেতর ভয়। টেনশন। জীবনে এই প্রথম একজন তাকে ছুঁয়েছে। ছোঁয়ার অনুভূতিটা উপলব্ধি করছে। তারা বড়লোক। কোটিপতি। বউ আছে ছোল আছে। এদিকে নয়ন তার মন কেড়ে বসে আছে গোপনে। কিন্ত তার পক্ষে স্বপনকে বিয়ে করার যুক্তিও অনেক। গরীবের জন্য সতীন বড় বিষয় নয়। বিষয় তার ভবিষ্যৎ অঢেল সম্পত্তি। তাই মাজেদা হাজারো কথা ভাবছে আর ভাবছে। চোখে ঘুম নেই।
সন্ধ্যার সময় স্বপন সাহেব মোটর সাইকেল নিয়ে হু হু করে মাজেদার বাড়িতে এসে হাজির । মাজেদা নিষেধ করেছিলো। তবু আসলো। 
ঃ মাজে কই তুমি?  
মাজেদা ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। তাকে বসার জন্য ভাঙ্গা চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বললো।
ঃ হামি না আপনারে নিষেধ করছিনু। 
স্বপন সাহেব বসতে বসতে বললো
ঃ একটা জরুরি কথা।
ঃ কি আবার জরুরি কথা?
ঃ শোনো, সময় নাই। আগামী কালকেই বিয়ে এবং রেষ্ট্রি।
মাজেদা হতভম্ব। 
ঃ কি কন আপনি?  হামার বাপরে ছাড়া হামি...
ঃ সমস্য নেই। ওনাকে আমি বলছি।
এই বলে স্বপন সাহেব ঘরের ভেতর গিয়ে মাজেদার বৃদ্ধ বাবাকে বিয়ের কথা জানালো। তিনি ঠিকমত শুনতে পান না। তবু যতটুকু বুঝলেন হাত নেড়ে সম্মতি জানালেন। 
এবার মাজেদার হাত ধরে স্বপন সাহেব বললো।
ঃ কালকে তুমি বউ হচ্চো। তোমার আর কজ করা লাগবেনা। তোমার এই কুঁড়ে বাড়িতেই বিয়ে হবে।  

স্বপন সাহেব এই বলে  চলে গেলো। তখন সন্ধ্যা পার। মাজেদা রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ালো। একটা গাছের আড়ালে। কিছুক্ষণের মধ্যে নয়ন সাইকেলের ঢন ঢন বেল দিতে দিতে আসলো। মাজেদা তাকে সাইকেল থেকে নামতে বলবে। কিন্ত কি যেনো বাধা দিচ্ছে। আর বলতে পারলোনা। গাছের আড়ালে হওয়ায় নয়ন তাকে দেখতে পায়নি। মাজেদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়িতে ফিরে আসলো। চোখের ধারে সামান্য পানি আসলেও সেটা অগোচরে মুছে ফেললো। নয়নকে মনে প্রানে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্ত নিজের চাতালের মালিক। মানুষে তাকে লুচ্চা বলে ডাকে।  না বলার জো নাই। না বললেও জোর করে বিয়ে করতে চাবে। তখন আরো বেশি বিপদ।

পরের দিন বিকেল হতে না হতেই স্বপন সাহেব মাইক্রো নিয়ে উপস্থিত। সাথে লোক বেশি নয়। এই দশ বারো জন। এক মাইক্রোতে যা ধরে। 
সন্ধ্যার আগেই বিয়ের কাজ শেষ হলো। একলক্ষ টাকা মোহরানা। নগদ একভরি গহনা। মাজেদা চোখ মুছতে মুছতে মাইক্রোতে উঠলো। একাই উঠে বসে পড়লো স্বপন সাহেবের পাশের সিটে। জানালাটা খুলে রাখলো যদি নয়নকে দেখা যায় এই ভেবে। কিছুক্ষণের মধ্যই বর কনে বিদায় আদায় নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলো। গ্রাম থেকে চাতাল পর্যন্ত মাটির রাস্তা। তাই আস্তে আস্তে গাড়ি চলতে লাগলো। ততক্ষনাৎ নয়নও সাইকেল নিয়ে গাড়ির সামনে। কিন্ত নয়নের সাইকেলটা পাঞ্চার হয়ে যাওয়ায় টানতে পারলোনা। সাইকেল থেকে নামতে হলো।এদিকে মাইক্রো সাইড দেয়ার জন্য বার বার হর্ণ দিয়ে যাচ্ছে। মাজেদা যে পাশে বসে আছে নয়ন ঠিক ওই পাশ দিয়েই ক্রোস হয়ে গেলো। নয়নকে দেখে মাজেদার মনের ভেতর পৃথিবী সমান কান্না নেমে আসলো। মাজেদা ঘুঙুরের ভেতর খুব কাঁদছে। সাইকেলের চাকায় হাওয়া না থাকায় নয়ন হেঁটে হেঁটে কাঁচা রাস্তার এক পাশ দিয়ে যাচ্ছে। সামনে পরিচিত রুস্তুমের সাথে দেখা।
ঃ ক্যারে রুস্তম, কার বিয়ে হলোরে?
ঃ ক্যা জানিসনে?  ওই চাতালের মালিক স্বপন চদরী (চৌধুরী) মাজে,ক বিয়া কইরা নিয়া গেলো। লুচ্চাটা এই সহজ সরল মাইডারেও জীবন নিয়া ছিনিমিনি খেলবো 
নয়ন থমকে দাঁড়ালো।
ঃ কি কও রুস্তম ভাই। মাজে,র বিয়া হ,লো।
রুস্তমের কি যেনো তাড়া আছে তাই চলে গেলো।
নয়ন ওখানে সাইকেল রেখে অনেকক্ষণ বসে বসে মাটিকে কি কি সব আঁকছে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। 

লেখাঃ ৬/১/১৮ইং