মাস্টার
মুন্না জানে এই সকাল সকাল সমস্ত ঝাড় পোছ না দিলে মালিকের মুখ শুনতে হবে নয়তো মাইনে থেকে টাকা কাটার হুমকি আসতে পারে। এই কটা টাকাই তো পায় সে, তার থেকে যদি আবার কেটে নেয়...
নাহ্ আর বেশী কিছু ভাবতে পারছে না সে। টাকা কটা কাটা গেলে যে কি হবে, অসুস্থ মা আর তিন তিনটে বোনের সব দায়িত্ব যে তার।
শীতের এই তিন-চারটে মাসেই তো কাজের চাপ তাদের। তাও আগের মতোন দিন নেই... সেই দর্শকের চাহিদাও নেই... নেই পশুপাখির খাঁচা পরিষ্কার সহ ওদের নানান ধরনের খেলা । আজ বছর দশেক হলো, এই ব্যাবসা পুরো ডাউনের দিকে । নানা ধরণের আইন কানুনে আবদ্ধ হয়ে, বাঘ, সিংহ তো আগেই ছাড়া পেয়েছিলো এখন হাতি, ঘোরা, টিয়া, ময়না, কাকাতুয়া সবই প্রায় নেই বললেই চলে। থাকার মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরণের কুকুর, আর কয়েকটা বিড়াল। থাকার মধ্যে শুধু আছে জিমন্যাস্টিকের দল, আর পিঙ্কি, সাইনাদের লোহার খাঁচায় মোটোর বাইকের রেসিং আর আর মাঝে মধ্যে আছে মুন্না - বিট্টুদের একটু আধটু কমেডি । যাই হোক করে চলে যাচ্ছে ওদের মতোন করে। মালিক গতবার থেকেই জানান দিচ্ছে আর বেশী দিন রাখবে না এই দল। এই দল না থাকলে কি করবে মুন্না? কোথায় যাবে? এই বুড়ো বয়সে নতুন কী কাজ করতে পারবে সে! আর একটা সময় তার টিমেই ছিলো, লোলিত, আনোয়ার, সলমন, গুড্ডু, করিম, শচীন...আজ সাত আট বছর ওরা নিজেরা অন্য কাজে যুক্ত হয়ে দল ছেড়ে চলে গেছে। মুন্নাকেও বারে বারে বলেছিলো। কিন্তু মুন্না কোথাও যেতে পারেনি।ঐ যে মা একদম ছোটবেলায় বলে দিয়েছিলো, 'এই দলের মাটি সারাজীবন আঁকড়ে থাকবি মুন্না, এখানেই তোর জন্ম এখানেই তোর মৃত্যু। হাজার কষ্ট হলেও এখানকার মাটি ছেড়ে কোথাও যাবি না।'
মনে মনে ভাবে মুন্না ঃ
মাও যে এক সময় দলের সাইকেল জিমন্যাস্টিকে ট্রেনার ছিলো। তারও আগে নিজেও ভালো জিমন্যাস্টি করতো। বাবার সাথে মায়ের আলাপ এই দলেই। 'বাবা'এই নামটা বলতেই মুন্নার চোখের সামনে ভেসে ওঠে নানান দৃশ্য আর তার সাথে কান মাথা গরম হয়ে ওঠে ওর। থাক আর কোন পুরোন কথা মনে করবেনা ও। মায়ের বয়স হয়েছে ,এক সময়ের অনিয়মের ফল এখন শরীর জানান দিচ্ছে। তাই ছেঁড়া লিগামেন্টের যন্ত্রণা, কোমরের হাড় ক্ষয়ে যাবার ব্যথায় জর্জরিত সে বিছানায় শয্যাশায়ী। মালিকের সব কাজ সেরে ঘরের(হা হা হা করে হাসে মনে মনে মুন্না, সারাটা জীবন তাবুকেই ঘর বানালো তারা) দুটো সিদ্ধ ভাত রেঁধে মা বেটায় খেয়ে নেবে। তারপর আবার সান্ধ্যকালীন একটু ডিমের ঝোল ভাত বানিয়ে শো তে নামবে।
সন্ধ্যের কথা মনে পড়তেই মুন্নার একটা কথা মনে হলো। সীমান্তবর্তী এই এলাকায় আজ মাস খানেক হলো তাবু পেতেছে তারা। এখনও এদিককার মানুষজন এসবে উৎসাহ পায়। অনেক সময় ওপার থেকেও চুপিসারে লোক আসে তাদের শো দেখতে। তাই বিশাল এলাকা না হলেও মোটামুটি মুখ গুলো চেনা হয়ে গেছে মুন্নার । তারা তাবু পাতার সাত অাট দিন পর থেকেই মুন্না লক্ষ্য করেছে তাবুর বাইরে বিকেল থেকে ছেঁড়া , তালিমারা কোট প্যান্ট পরে একটা বয়স্ক লোক, একমুখ দাঁড়ি, সাদা চুল আর অস্বাভাবিক হাবভাব নিয়ে একটা বছর পনেরোর মেয়ের সাথে রোজ আসে। মেয়েটাকে যেন আঙুল দেখিয়ে কি যেন বলে! দু একদিন মুন্না ভেবেছে কাছে গিয়ে শুনবে কি বলে লোকটা, কিন্তু মুন্নার তখন এতো তাড়া থাকে আর শোনা হয় না। আজ এখানে একটা রাজনৈতিক খুন হয়েছে। তাই সব আমোদ প্রমোদ বন্ধ মানে বন্ধের জন্য।
হঠাৎ বাইরে একটা উত্তেজনাময় চিৎকার গণ্ডোগোলের আওয়াজে বাইরে এসে মুন্না দেখে
ঐ লোকটি এসেছে কিভাবে যেন। আজ সে একা। লোকটা কে দেখতে গেলো মুন্না। মুন্না কে সামনে দেখে লোকটির চেহারা বদলে গেলো।
বাঘের খাঁচা থেকে বাঘ কে বের করে , সিংহের খাঁচা থেকে সিংহ কে এনে ট্রেনিং দেওয়া, কুকুর দেরও ট্রেনিং দেওয়া ছিল মাস্টারের কাজ।
কত বছর আগে মনেহয় বছর পঁচিশেক হবে! যেদিন, সিংহটা এক কামড়ে উঠিয়ে নিয়েছিলো মাস্টারের ঘাড়ের মাংস, সেদিন রাতে সিংহের মাংস খেতেও দেখেছিল মাস্টার কে মুন্না। তারপর মায়ের সাথে দিনের পর দিন অশান্তি থেকে মুক্তি পেয়েছিলো মুন্না। কারণ লোকটা কে আর খুঁজে পাই নি কেউ কোনদিন। বরং মাস্টার কে খোঁজ করেনি কেউ আর। মুন্না আজ যে লোকটাকে দেখছে ,সে যে মাস্টারই তা জানতে বা বুঝতে এতটুকু দেরী হয়নি মুন্না। শুধু একটাই কথা ভাবছে সে, তাহলে সেদিন রাতে কাকে নান চাকুদিয়ে কাতিল করেছিলো সে!!
--------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন