বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১৮

প্রচ্ছদ।। মাসিক কুয়াশা ।। ঈদ সংখ্যা ।। জুন ২০১৮ইং।।


সম্পাদকীয়।। মাসিক কুয়াশা।। ঈদ সংখ্যা ।। জুন ২০১৮ইং।






সম্পাদকীয়।। মাসিক কুয়াশা।। ঈদ সংখ্যা ।। জুন ২০১৮ইং। 


কুয়াশা বরবারই চেষ্টা করে সার্বজনীন হতে। সব বিতর্কের উর্দ্ধে। স্বতন্ত্র চিন্তা চেতনা নিয়ে কুয়াশার পথ চলা। তবে সমালোচনা হতে পারে যুক্তির সাথে। সেটা পত্রিকা, ম্যাগাজিনের জন্য পাথেয়। 
চারপাশে ঈদ ঈদ রব রব। মুসলমানদের পবিত্র এবং আনন্দের একটা দিন। এই দিনকে ঘিরে পৃথিবীর সকল দেশে মুসলমানদের আনন্দের জোয়ার বয়। ব্যবসায়ীরা তাদের তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনা দিয়ে ব্যবসা সাজায়। সাহিত্য পণ্যের সঙ্গার চাইতে একটু ভিন্ন স্বাদের হলেও এই মাসকে ঘিরে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা পাঠকদের জন্য বিশেষ সংখ্যা তৈরি করে থাকে। ভালো ভালো লেখক কবিদের নিয়ে কভারেজ করা হয়। পাঠককূলও মুখিয়ে থাকে এই ঈদ সংখ্যার জন্য। এটা একটা বিশেষ আনন্দের নাম। 
আমরা কুয়াশাকে এই প্রখমবার ঈদ সংখ্যার চাদরে সাজানোর চেষ্টা করছি। জানিনা পাঠকের নিকট কতোটা প্রাপ্তি রেখে যাবে।

এ সংখ্যায়  তুলনামুলকভাবে সিনিয়রদের স্থান দেবার চেষ্টা করা হয়েছে । ছড়া বিভাগ রাখা হয়নি বলে দুঃখ প্রকাশ করছি। এমনকি অনেক নিয়মিত লেখককেও বাদ দিতে হয়েছে সিনিয়রদের স্বার্থে। তবে নিয়মিত সংখ্যায় সকলকে আবার নিয়ে আসবো। সকলেই সাথে থাকবেন - এই কামনায়।

সম্পাদক 

সূচিপত্রঃ মাসিক কুয়াশা।। ঈদ সংখ্যা।। জুন ২০১৮ইং।।

সূচিপত্রঃ মাসিক কুয়াশা।। ঈদ সংখ্যা।। জুন ২০১৮ইং।। 

প্রবন্ধ
মতিন বৈরাগী,কবির মুকুল প্রদীপ,  মাসুদ চয়ন।

অনুবাদ কবিতা
আবুল কাইয়ুম, অরণ্য আপন।

কবিতা
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, তৈমুর খান, হরিৎ বন্দোপাধ্যায়, নাসির ওয়াদেন, মুস্তফা হাবিব, সুদীপ্ত বিশ্বাস, আলম দীন,  অপাংশু দেবনাথ, শিশির রায়, মনোজ জানা, সবর্না চট্রোপাধ্যায়, শ্রদ্ধা চক্রবর্ত্তী, স্বপন শর্মা, রুমকি আনোয়ার, সুমন আহমেদ, মোঃ নুরুল গণি, মীম মিজান, মুহাম্মদ জসিম।

গল্প
রওশন রুবী, রুদ্র সুশান্ত, আফসানা খানম অথৈ, সজল মালাকার, নুশরাত রুমু

অণুগল্প
দীলতাজ রহমান, দ্বীপ সরকার



মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১৮

সৃজনশীল কাজে তরুণদের শনাক্ত করা দরকার ।। মতিন বৈরাগী

সৃজনশীল কাজে তরুণদের শনাক্ত করা দরকার

মতিন বৈরাগী

প্রতিভা ও মেধা দু’টি শব্দ প্রায় সম-অর্থবোধক মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে প্রতিভা কেবল মাত্র মেধা নয়।মেধাও হুবহু প্রতিভা নয় । অনেক খানি সম্পৃক্ততা খানিকটা ভিন্নতা রয়েছে। অনেকেই বলেন পৃথিবীতে প্রতিভা নিয়ে সমভাবে সকলে জন্মগ্রহণ করেনা। কেউ কেউ বলেন প্রতিভা সৃজনশীল কাজের সংগে যুক্ত এবং বিশেষ ক্ষেত্রে এই প্রতিভা ব্যক্তিকে বিশেষ কাজে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করে, দূর দেখতে সফলতা দেয়। দৃশ্যমানত সকলে রবীন্দ্রনাথ, গ্যোটে, কিংবা হেমিঙওয়ে, আইনেস্টাইন বা হকিংস প্রমুখ নন । কেউ কেউ আবার মেধা যা শ্রম-উৎকর্ষতায় যোগ্য করে তোলে তা কমবেশী প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকে, এবং মানুষ তার কর্মের ঐকান্তিকতা, পুন পুন চেষ্টায় তার বলবৃদ্ধি ঘটাতে পারে। প্রতিভাবানের পরবর্তি প্রজন্ম প্রতিভাবান হবে এমন কোনো কথা নেই, মেধাবী মা বাবার সন্তানরা কখনও কখনও মেধার স্বত্ব উত্তরাধিকারে লাভ করে থাকে। কিন্তু সত্য নয় যে তা লাভ করবেই, অনেক মেধাবীর পরবর্তি প্রজন্ম মেধাশূন্য এমন দৃশ্যমানতা রয়েছে। জীবনানন্দ বলেছেন ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি,’ সম্ভবত সে কথা তিনি প্রতিভাবান কবির দিকে দৃষ্টি রেখেই বলেছিলেন। সন্দেহ নেই যে প্রতিভাবান ব্যতিরেকে সৃজনশীল কাজ যেমন সাহিত্য, চিত্র, ভাস্কর্য্য, নৃত্য ও সংগীত এসবে এমন একটা কিছুর প্রয়োজন পড়ে যা সৃজনে নতুনত্ব আনে এবং ব্যক্তি উপলব্ধিকে বিশ্ব-উপলব্ধির সাথে যুক্ত করে। মেধা দরকার হয় সময়কে বুঝতে, সমকালকে উপলব্ধি করতে, নির্মাণকে নির্মোহ করতে এবং কৃতকৌশলগুলোকে বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকে সিদ্ধ করতে।
সকলেই বিশ্বশ্রুত ও নন্দিত মানুষ হয়ে পৃথিবীতে কাল কাটাতে আসেনা। তবে নিচে পড়ে যে থাকে সেও অপাঙক্তেয় নয়। সমাজে তার শ্রম বিনিয়োগে প্রতিভাদীপ্ততা না থাকলেও সামাজিক নিয়মাচারে সে বড় হয় বিষয় প্রসংগে অবগত হয়, জীবিকায় অর্জিত অভিজ্ঞতার প্রয়োগ হয় এবং এই ভাবে জাতীয় উৎপাদনে তার ভূমিকা যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করে উদ্বৃত্তমূল্য। যদিও সে আলোচ্য কোনো কালে নয়, কোনো অংশে তার কর্ম গুরুতর প্রয়োজনীয় বলে কেউ স্বীকারও করেনা, যুদ্ধে বীরের ইতিহাস হয় অথচ যুদ্ধটি করে সাধারণ সৈনিক, মরেও সে লড়েও সে। তবু একজন প্রতিভাবান জেনারেল তার প্রতিভাগত যৌদ্ধকৌশল কে ধ্রুপদী স্টাইলে পরিচালিত করে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে, একজন সাধারণ যোদ্ধার অনিবার্য জীবনদানকে রক্ষাও করতে পারে। এখানে দুটো জিনিস লক্ষণীয় এক প্রতিবাদীপ্ত জেনারেল তার প্রতিভাবলে যুদ্ধকে ছন্দবদ্ধ করে হিসেব নিকেশকে প্রায় নিখুঁত করতে পারে, এবং একজন সাধারণ সৈনিক তার স্বল্পমেধারও প্রয়োগীক শৃংখলায় আরো বেশি নিপুণ করতে পারে। এভাবে প্রতিভাবান অনেক কাজকে সৃজনশীল পর্যায় উন্নীত করে তার শিল্প সত্তা তৈরি করে নিতে পারে এবং অন্যের জন্য উদহরণ হতে পারে। তেমনি সৃজনশীল কাজে প্রতিভাবানই কেবল জরুরী অন্যেরা বা কম প্রতিভা বা মেধার মানুষের কোনো প্রয়োজন নেই, তারা কেবল তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ব্যাপার তাও সত্য নয়।
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে সৃজনশীল সকল কাজে প্রতিভাবান যতখানি উৎকর্ষতার আয়োজনটি তার নির্মাণে যুক্ত করতে পারেন, একজন মেধাবী ঠিক ততটা নির্মাণ শৈলীতে সেই অসমাপ্ত আলোটুকু দিতে পারেন না, যা মানব মনোজগতে এমন এক আলোড়ন তোলে-যা প্রকাশহীন এবং অভিব্যক্তিহীন কেবল স্তব্ধতা। যেমন প্রত্যেক সংগীত শিল্পী তার গানের বা সুরের সঠিক মাত্রাকে মেনেই গান পরিবেশন করেন এবং এতে কোনো ভুল নেই, কিন্তু একজন প্রতিভাবান শিল্পী এমন কিছু সেই সুরের মাত্রায় গেঁথে দেন যা ভিন্ন হয়ে ওঠে। যদিও এই সব বিশ্বাস ব্যাপক ভাবেই প্রগতিবিরোধিরা ব্যবহার করে নিজ অহংকে চূড়ান্ত মাত্রা দিতে চায় এবং অন্যকে অস্বীকার করে।তারা বলে শিল্প শিল্পের জন্য। ইতর প্রকৃতির দরকার পানি কচু, শিল্প কেন? তারা জানতে চায়না যে সামগ্রিকতা বলে একটা কথা আছে, ভিন্নতাও আছে। যেমন সমাজে সকলেই সামগ্রিক, কিন্তু তার ভেতরও কোনো কোনো ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতা থাকলেও সে সামগ্রিকতারই অংশ মাত্র। তার স্বাতন্ত্র্যতা বা প্রতিভার ভিন্নতা কেবল মাত্র সমাজের ওই মাত্রাটুকুকেই চিহ্নিত করে যে সে অন্যথেকে ভিন্নতর গুণসমৃদ্ধ রূপদক্ষ। কিন্তু প্রতিভাবান যদি সমাজ সত্তাকে না জানতে চায়, আপন অহংয়ে নিজ শ্রেষ্ঠত্ব দাবীই করতে থাকে তা হলে তার ভাগ্যটি হয় ‘ওয়েলস’ এর মতোই। এই প্রতিভা কোনো কাজেই লাগেনি, রাসেল কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৎসাহস দেখাতে পেরেছেন, আর ওয়েলস হয়ে রয়েছেন সময়ের ভাঁড়।
এখন আমরা আসতে পারি মূল বক্তব্যেঃ তরুণদের বেশি সাহায্য করতে হবে কেন? এর অর্থইবা কি, তরুণরা কি সোনার স্বর্গ এনে দেবেন? না , স্বাভাবিক বিবেচনা থেকে বলা যায় যে তা’ তারা এই মুহুর্তে পারবেন না। দু’একজন প্রতিভাবান তরুণ থাকলেও সমাজ ও রাষ্ট্রিক পর্যায়ে যে ভাঙচূর চলছে তাতে ওই সব প্রতিভার শনাক্তকরণ পৃষ্ঠপোষকতা কেউ দেবেনা, দেবে লুটে, দেবে সাহিত্য মাফিয়াদের। এই সমাজ এই রাষ্ট্র তাই করবে তার স্বার্থে । কারণ অসুস্থ অন্যের সেবা দেবে কি করে। নইলে দীর্ঘ সময় ধরে একটি জাতি নেশার ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হয়ে অধঃপতিত হয়েছে, তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য আশা গেছে, পরিবার অর্থসংকটে পড়েছে, নিরাশায় হারিয়ে গেছে পিতামাতা, খুন হয়েছে, নানা উপসর্গে পড়ে ধর্ষক হয়েছে, ছিনতাইকারী হয়েছে, তার উচ্ছেদে এত কাল পরে উদ্যোগ হয়েছে, তবুও ভালো দেরিতে হলেও হয়েছে, নাকি বাহানায় শেষ হবে সব অভিযান? অদ্ভুত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের মতো। এমন অনেক সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? কোনো ঘাগু বৃদ্ধ, সে কি আশা হতে পারে? না কি আগামীর প্রজন্ম যারা যুদ্ধ করতে পারে, লড়তে পারে, মরতে পারে তারাই আশা। যদিও কেউ কেউ বলেন সে গুড়ে বালি। প্রত্যেক সমাজ তার প্রয়োজনে তার প্রয়োজনীয় মানুষ তৈরি করে, যেমন স্বদেশ তৈরি করেছিল। লক্ষ করলে দেখা যাবে সামাজিক চাহিদা না হলে নতুন কিছুর সৃষ্টি হয় না। নতুন প্রতিভাও আসেনা। প্রত্যেকটি প্রতিভাবানের উপস্থিতির সময় কাল যদি লক্ষ করা যায় দেখা যাবে কোনো না কোনো সামাজিক চাহিদার কারণেই একজন সেক্সপিয়র, গ্যোটে, রবীন্দ্রনাথ, পুশকিন, টলেস্টয়, তুর্গেনেভ, দস্তয়ভস্কি,সলোখভ একজন মার্কেজ এসেছেন। সমাজ আগবাড়িয়ে তাদেরকে স্বাগতও জানিয়েছে। তবে তার জন্য প্রস্তুতি চাই। তরুণদের সৃষ্টিকে মনোযোগে নেয়া চাই, সম্ভাব্য আলোচনা চাই, ত্রুটি বিশোধনে সক্রিয় সহযোগীতা চাই। তা হলে প্রতিভাবান অনেক না হোক কিছু মেধার চাষ হতে পারে। তারাই হয়ত পারবে প্রকৃত উন্নয়নটা ঘটাতে।

উত্তরাধুনিকতাবাদ (পোস্টমডার্নিজম) ধোঁয়াশা ।। কবির মুকুল প্রদীপ


উত্তরাধুনিকতাবাদ(পোস্টমডার্নিজম) ধোঁয়াশা

কবির মুকুল প্রদীপ

রাজনৈতিক মানদণ্ডে উত্তরাধুনিকতাবাদ মূলত মার্কসবাদী দর্শনকে অস্বীকার করে এমনটা ধারণা করা হয়।সাহিত্যেও উত্তরাধুনিকতাবাদকে চিহ্নিত করার বহু কসরত দেখেছি কিন্তু কোন দার্শনিক, সমালোচক স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারছেন না;সে অক্ষমতা স্বীকারও করেন তাঁরা ।অবশ্য যাঁরা নিজেদের উত্তরাধুনিক কবি-সাহিত্যিক দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন,তাঁরাও নাকি এই বিষয়ে তেমন কোন যুক্তি-তত্ত্ব খাড়া করতে পারছেন না।বিষয়টা কী আসলেই ফাফা?নাকি রোমান্টিসিজম খুব সহজে আধুনিকতাবাদকে স্বীকার করেছে?কিংবা কোন মতবাদকে খুব সহজে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে?এসব প্রশ্নের উত্তর জানার দরকার নেই,শুধু একটু ভাবনার মধ্য রেখে আমি বলতে চাচ্ছি যে সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে এখন উত্তরাধুনিকতার সংজ্ঞা নির্ণয় করা জরুরী বোধ করি।আর সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই আমি এই প্রবন্ধ লেখার উৎসাহ অনুভব করছিলাম ঠিক তখনই গুগোল উত্তরাধুনিক উইকিপিডিয়া জানালো এই তথ্য। যা নিচে উদ্ধৃতি হিসেবে পেশ করা হলো দেখুন,-
দুবাংলায় উত্তর আধুনিকরা ‘উত্তর’ ও Post-এর পার্থক্য হাজির করে বলছেন, উত্তর আধুনিকতা ও Postmodernism এক কথা নয়। ‘আধুনিকতা’র আগে ‘উত্তর’ প্রয়োগ দ্বারা তারা ‘আধুনিকতা-উত্তীর্ণ’ হওয়াকে বোঝাচ্ছেন। পাশ্চাত্যে কিন্তু Postmodernism দ্বারা তা বোঝানো হয়নি। তারা Modernism-এর আগে Post ব্যবহার করে কালগতভাবে Modernism-এর পরবর্তী ধাপকে বুঝিয়েছে। যাই হোক, উত্তর আধুনিকতা বলতে বুঝায় সেই অবক্ষয় বা স্বেচ্চাচারিতা থেকে উত্তরণের প্রয়াসকে, যে অবক্ষয় বা স্বেচ্ছাচারিতা দোর্দণ্ড প্রতাপবান আধুনিকতার আস্তাকুঁড়ে জন্ম লাভ করেছে। উত্তর আধুনিকদের মতে, আমরা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি আধুনিকতার কারণে। অবশ্য কোনো কোনো মহল, যেমন দৃষ্টান্তবাদীরা, এমন কিছু মনে করেন না। তাদের মতে, অবক্ষয় বিভিন্ন কারণে আসতে পারে, কিন্তু এর জন্য কেবল আধুনিকতাকে দোষারোপ করা যায় না। যদি করা হয়, তবে পরোক্ষভাবে যুক্তিবাদিতা, ধর্মনিরপ্রেক্ষতা ইত্যাদির মতোন আধুনিক আলোককে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেলা হয়। উত্তর আধুনিকরা আধুনিক-পূর্ব সময়ের মিথ, উপকথা, লোকবিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস, কৃষ্ণ, হাছন, লালন ইত্যাদিকে সামনে রেখে পুনর্চর্চায় ব্রতী হতে সবাইকে আহ্বান করে।
আচ্ছা বেশ সেতো হতেই পারে কিন্তু তাতে কি আবার ফিরে আসবে পুরাতন ঐতিহ্য?যা গেছে তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, বা সে চেষ্টা করাও বৃথা।তবে ওসবের পুনর্বির্ণিমান হতেই পারে এবং সে হচ্ছেও সাহিত্যে।যাইহোক তর্ক নয়;ওসবে আগ্রহও নেই।তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে উত্তরাধুনিকরা আধুনিকতাবাদকে অস্বীকার বা আক্রমণ করেই নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।কিন্তু কীভাবে?সেটা বুঝতে আধুনিকতাবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক তাই আগে সংক্ষিপ্তভাবে একটু আধুনিকতাবাদ নিয়ে দুচার কথা বলে নেয়া ভালো।কিন্তু আধুনিকতাবাদেরও খুব সহজ সংজ্ঞা হয় না,তবুও চেষ্টা করা দেখা যাক।
আধুনিকতা একটি দার্শনিক আন্দোলন যা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা সমাজে সুদূর প্রসারী ও ব্যাপক রূপান্তরের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রবণতা ও পরিবর্তনের সাথে সাথে উত্থান লাভ করে। যেসব ফ্যাক্টর আধুনিকতাবাদকে বর্তমান রূপ দান করে তার মধ্যে শিল্পভিত্তিক সমাজ গঠন, নগরের দ্রুত বিকাশ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। আধুনিকতাবাদ আলোকায়নের চিন্তাধারার অভ্রান্ততাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং অনেক আধুনিকবাদী ধর্মীয় বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করেন।
সাধারণভাবে আধুনিকতাবাদের অন্তর্ভুক্ত সেইসব লোকেদের কাজ ও সৃষ্টিকর্ম যারা অনুভব করেন ঐতিহ্যবাহী শিল্প, স্থাপত্য, সাহিত্য, ধর্মীয় বিশ্বাস, দর্শন, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, দৈনন্দিন কাজকর্ম এমনকি বিজ্ঞানও পুরোপুরি শিল্পায়িত সমাজের উত্থানের ফলে নতুন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও সেকেলে হয়ে পড়েছিল। কবি এজরা পাউন্ডের ১৯৩৪ সালের "এটি নতুন করে করুন" এর ডাক আন্দোলনটির যাকে তারা পুরনো দিনের সংস্কৃতি হিসাবে দেখত তার প্রতি অগ্রসর হওয়ার একটি স্পর্শপাথর ছিল। এর আলোকে এর নানা উদ্ভাবন যেমন চেতনা-প্রবাহের উপন্যাস, প্রায়শ্চিত্তমূলক ও বার সুরের সংগীত, ডিভিশনিস্ট ছবি ও বিমূর্ত চিত্রকলা সবই ঊনিশ শতকের অগ্রদূত ছিল।
আধুনিকবাদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল আত্মসচেতনতা এবং সামাজিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্য নিয়ে বিদ্রুপ, যা প্রায়ই কাঠামো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে নিয়ে যেত ও ছবি, কবিতা ও দালান ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা পদ্ধতি ও উপকরণ প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট করত। আধুনিকতা স্পষ্টতই বাস্তবতাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে এবং অতীতের কাজগুলোকে নতুন করে দেখা, লেখা, বিবেচনা ও বিদ্রুপ করে।
কিছু ভাষ্যকাররা আধুনিকতাকে চিন্তার একটি ধারা হিসাবে ব্যাখ্যা করেন- এক বা একাধিক দার্শনিকভাবেসংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্যগুলি, যেমন আত্নসচেতনতা বা আত্মোল্লেখ, যা সমস্ত নৃতাত্ত্বিক ও শিল্পকর্মের মধ্যে চলছে। বিশেষ করে পশ্চিমা জনগণ, যারা একে সমাজে চিন্তার প্রগতিশীল ভাবধারা বলে মনে করে, যা মানুষকে ব্যবহারিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা প্রযুক্তির সাহায্যে তাদের পরিবেশ সৃষ্টি, উন্নয়ন ও পুনঃনির্মাণ করার ক্ষমতাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এদিক থেকে আধুনিকতাবাদ যা অগ্রগতিকে আটকে রাখছিল তা খুঁজে বের করার লক্ষ্যে বাণিজ্য থেকে দর্শন পর্যন্ত অস্তিত্বের প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিবেচনাকে এবং একই প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য নতুন উপায়ে তা প্রতিস্থাপন করার লক্ষ্যে উত্সাহ দেয়। অন্যরা নান্দনিক আত্মঃদর্শন হিসাবে আধুনিকতার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া এবং ফ্রেডরিখ নিৎশে (১৮৪৪-১৯০০খ্রি.) থেকে শুরু করেন স্যামুয়েল বেকেট (১৯০৬-১৯৮৯ খ্রি.) পর্যন্ত বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও শিল্পীদের প্রযুক্তিবিরোধী ও নাস্তিবাদী দিকগুলো বিবেচনা করা হয়।(তথ্য সূত্র/আধুনিকতাবাদ উইকিপিডিয়া)
মূলত উত্তরাধুনিকদের বক্তব্য এই যে আধুনিকতার প্রভাবে বর্তমান সমাজ-রাষ্ট্রে জন্ম নিয়েছে যাকিছু অকল্যাণকর অশুভ তাকে আরও নিবিড়ভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে।কিন্তু উত্তারাধুনিকবাদীরা সঙ্ঘবদ্ধ নয় এর চর্চা এতোটাই বিক্ষিপ্তভাবে হচ্ছে যে একে এক সূত্রে বাঁধা শুধু কঠিন নয় অসম্ভবও কারণ প্রত্যেক কবি-সাহিত্যিক জানেন তাকে নতুনভাবে উপস্থিত হতে হবে পাঠক মহলে।তারপরেও সাহিত্য সমালোচক ,দার্শনিকরা এর ভিন্নতা চিহ্নিত করতে আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যসমূহের সাথে উত্তরাধুনিক সাহিত্যের ভিন্নতা বোঝাতে যে মানদণ্ড হাজির করেছেন আসুন সেসব দেখে নিই।
১।আধুনিকতা –রোমান্টিসিজম/প্রতীকধর্মিতা।উত্তরাধুনিকতা –প্যাটাফিজিক্স/ডাডাইজম।
২। আধুনিকতা- ফর্ম(কাঠামোর চক্রাবদ্ধতা)।উত্তরাধুনিকতা –এ্যান্টিফর্ম(চক্রহীনতা,উন্মুক্তি)।
৩। আধুনিকতা- উদ্দেশ্য নির্ভরতা।উত্তরাধুনিকতা- ক্রীরাময়তা।
৪। আধুনিকতা- শ্রেণিলগ্নতা। উত্তরাধুনিকতা- নৈরাজ্য।
৫। আধুনিকতা- যুক্তির শাসন। উত্তরাধুনিকতা- নিস্পন্দন,নীরবতা।
৬। আধুনিকতা- ফলাফলপ্রধান,শিল্পসৃষ্টি। উত্তরাধুনিকতা- প্রক্রিয়াপ্রধান।
৭। আধুনিকতা- দূরত্ব। উত্তরাধুনিকতা- অংশগ্রহণ।
৮। আধুনিকতা- সৃজন,সমগ্রায়ন। উত্তরাধুনিকতা- অবনির্মাণ,বিনির্মাণ।
৯। আধুনিকতা- সমন্বয়। উত্তরাধুনিকতা- বিরোধাভাস।
১০। আধুনিকতা- উপস্থিতি। উত্তরাধুনিকতা- অনুপস্থিতি।
১১। আধুনিকতা- প্রকরন,সীমা। উত্তরাধুনিকতা- বয়ান।
১২। আধুনিকতা- নির্বাচন। উত্তরাধুনিকতা- একত্রায়ন।
১৩। আধুনিকতা- ব্যাখ্যা/পাঠ। উত্তরাধুনিকতা- অ-ব্যাখ্যা/ভুল পাঠ।
১৪। আধুনিকতা- দ্যোতিত। উত্তরাধুনিকতা- দ্যোতক।
১৫। আধুনিকতা- লক্ষণ। উত্তরাধুনিকতা- বাসনা।
১৬। আধুনিকতা- প্যারানইয়া। উত্তরাধুনিকতা- সিজোফ্রেনিয়া।
১৭। আধুনিকতা- পিতা, ঈশ্বর। উত্তরাধুনিকতা- পবিত্র ভূত (পবিত্র আত্মা)।
১৮। আধুনিকতা- অধিবিদ্যা। উত্তরাধুনিকতা- আয়রনি।
১৯। আধুনিকতা- সিদ্ধান্ত, মীমাংসা। উত্তরাধুনিকতা- অমীমাংসা।
এই হচ্ছে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এমনটাই ধারণা করেন তাত্ত্বিকেরা।যদিও বিভিন্ন গুণী একে বিভিন্নভাবে ধরতে চেয়েছেন;যদিও বিষয়বস্তু এক শুধু বলার ধরন আলাদা যেমন,-
উত্তরাধুনিক কবিতা প্রসঙ্গে অনুবাদক ও সমালোচক আবুল কাইয়ুম পোস্টমডার্ন মতবাদের বৈশিষ্টগুলো এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন - রীতি বা প্রথাবিরুদ্ধতা, ব্যাখ্যা বা যুক্তির অতীত সৌন্দর্য, আঙ্গিকের রীতিসিদ্ধ বাধ্যবাধকতা না থাকা, অসংলগ্নতা ও দুর্বোধ্যতা/ অবোধ্যতা, ছাড়া-ছাড়া ও ছেঁড়া-ছেঁড়া চিত্রকল্প, জাদুময়তা বা মায়াজাল সৃষ্টি, বাক্যের অর্থময়তার চেয়ে শব্দের ব্যঞ্জনা ও শক্তির প্রতি গুরুত্বারোপ, জীবন-উপলব্ধিজনিত জটিলতা, জৈবিক কথকতা ইত্যাদি।রেফারেন্স(ছন্দ ও ছন্দাতীত)আবুল কাইয়ুম।
তবে সামগ্রিক বিবেচনায় উত্তরাধুনিকতাবাদকে বাঁধা না গেলেও একেবারে ফাফা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না;কিছু কিছু ক্ষেত্র উত্তরাধুনিকতাবাদ প্রসংগিক হয়ে উঠতে চায় যথা- মার্কসবাদী দার্শনিকদের মতে সমাজকে তারা গোষ্ঠীগতভাবে চিহ্নিত করে সুতরাং ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়।এক্ষেত্রে উত্তরাধুনিকরা বলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের কথা,জোর দেন প্রতিটি ব্যক্তির আলাদা আলাদা বিশ্লেষণে।বলেন যে ব্যক্তি পারিবারিকভাবে কর্তা সেই আবার কর্মক্ষেত্রে শোষিত শ্রমিক অর্থাৎ সকলেই কোন না কোন ভাবে নিপীড়িত।তাই এখানে গোষ্ঠীবদ্ধ সংগ্রাম নয় বরং জোর দিতে হবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ওপরে।অন্যদিকে মার্কসবাদ পুঁজিবাদকে আক্রমণ করেন এবং তার বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রামের আহ্বান করেন,কিন্তু উত্তরাধুনিকরা পুঁজিবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে বলেন পুঁজিবাদী অসঙ্গতিগুলোকে সমালোচনা করতে।
এতো চিরকালীন দ্বন্দ্ব ,নতুনকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে পুরাতনকে করতে হয় অস্বীকার।তবে উত্তরাধুনিকতাবাদ কিন্তু আধুনিকতাবাদকে অস্বীকার করে না বরং তারা গুরুত্ব দেয় বিনির্মাণে।তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি যে ,এখন আর কোন পুরাতন তত্ত্বই বর্তমান সাহিত্য তথা সমাজতন্ত্র কিংবা রাজনীতিসমূহের সমালোচনার ক্ষেত্রে যথার্থ নয়।সমসাময়িক সাহিত্যের কথাই যদি বলি তাহলে বলতে হয় সংকরত্বের অথবা বিচূর্ণতার কথা কারণ সাহিত্য এখন আর সমষ্টিগতভাবে চর্চিত হচ্ছে না বরং দেখা যাচ্ছে ধ্রুপদীবাদে মিশেছে রোমান্টিকতা ,রোমান্টিকতায় মিশেছে আধুনিকতা,আধুনিকতায় উত্তরাধুনিকতা ইত্যাদি ইত্যাদি।তাই তত্ত্ব কেন্দ্রিকভাবে সাহিত্যকে না দেখে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে আত্মকেন্দ্রিক লক্ষণসমূহের ভেতর দিয়ে আর তার মধ্য থেকেই উদ্ধার করতে হবে সমসাময়িক বেক্তিকেন্দ্রিক জটিলতাসমূহ যা মূলত কলগতভাবে চিহ্নিত করবে পুঁজিবাদ-ধর্ম-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সমাজ-শক্তির চক্রব্যূহে থৈ হারানো মানুষের দৈনন্দিন বাস্তবতা ।যার থেকেই সহজ হতে পারে রাষ্ট্রীয় সমস্যাবলীর সুষ্ঠ সমালোচনা,শিল্পেরও।




ডোম সিরিজ ও কবি গিরিশ গৈরিক গৈরিক ।। মাসুদ চয়ন

ডোম সিরিজ ও কবি গিরিশ গৈরিক গৈরিক

যে লোকটির চোখে আগুন ছিল ।। কাজুকো শিরৈশী ।। অনুবাদঃ আবুল কাইয়ুম


কাজুকো শিরৈশীঃ জাপানী কবি

যে লোকটির চোখে আগুন ছিল

মূলঃ কাজুকো শিরৈশি

অনুবাদঃ আবুল কাইয়ুম











আগুন আছে তার চোখে
যখন সে আমার দিকে তন্ময় দৃষ্টিতে তাকায় আমি উষ্ণ হয়ে যাই
একটি শীতল হৃদয় এবং একটি হিমেল পাকস্থলি
উষ্ণ হয়ে যায়
তার চোখে আছে আফ্রিকান সূর্য
সে এমন মানুষ যার রয়েছে জুলু রাজ-পরিবারের গৌরব
দুটো বিপ্লবের মধ‌্যখানে থেকে 
সে আমার জন‌্য মাংস ঝলসালো তার হেঁসেলে,
বেশ সুস্বাদু
বসার ঘরে তার এক বছর বয়সী যমজ সন্তান রা এবং রি
পালাক্রমে কেঁদে চলছিল
তার আগুনের চোখ নম্রভাবে শিশুদের শান্ত করার জন‌্য
গাইলো ঘুমপাড়ানি গান
তখন এমন এক মুহূর্ত ঈষদুষ্ণ পৃথিবী পুরোপুরি উষ্ণ হয়ে গেল 
 এবং আগুনে চোখের মানুষটির বসার ঘর সুখী হয়ে গেল।


কবি-পরিচিতি : কাজুকো শিরৈশি (জন্ম ১৯৩১-) কানাডা প্রবাসী জাপানী কবি। বাংলাদেশের সাহিত‌্য-অঙ্গনে তিনি পরিচিত মুখ। তাঁর অনেকগুলো কবিতা অনুবাদ করে কবি আমিনুর রহমান ২০০৩ সালে ”কাজুকো শিরৈশির কবিতা” নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। একবার বাংলাদেশ ঘুরেও গেছেন এই জাপানী কবি। বিশ্বব‌্যাপী অসংখ‌্য সাহিত‌্য সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন তিনি। জাপানের তিনটি সেরা সাহিত‌্য পুরস্কার লাভ করা ছাড়াও তিনি বিশ্বের নানা স্থান থেকে পেয়েছেন অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার। ইংরেজি ভাষায় অনূদিত তাঁর কাব‌্যগুলোর মধ‌্যে Seasons of Sacred Lust (1978) এবং Let Those Who Appear (2002) উল্লেখযোগ‌্য। তিনি আধুনিক জাপানী সাহিত‌্যের সেরা জীবিত কবিদের একজন।

রিতা এবং রাইফেল ।। মাহমুদ দারবিশ ।। অনুবাদঃ অরণ্য আপন


মাহমুদ দারবিশ
রিতা এবং রাইফেল

মূলঃ মাহমুদ দারবিশ ( ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি) 


 অনুবাদঃ অরণ্য আপন


রিতা এবং আমার দুচোখের মাঝখানে একটা রাইফেল 
এবং কে আর জানে রিতাকে যে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করে স্বর্গ রঙের চোখের অমরত্ব করতে?
আমি রিতাকে চুমু খেয়েছি যখন সে যুবতী ছিল 
আমার মনে আছে যে সে কীভাবে আমার কাছে আসত এবং 
কীভাবে তার খোঁপার চুল আমার বাহুতে এসে এলিয়ে পড়ত
এবং আমি রিতাকে মনে করি যেভাবে চড়ুই বাতাসের প্রবাহকে মনে রাখে
আহ রিতা! আমাদের মাঝে এক মিলিয়ন চড়ুই উড়াউড়ি করে
আমাদের অসংখ্য মিলনের স্থান রাইফেলের দ্বারা গেছে পুড়ে।
রিতার নাম আমার মুখে ভোজের মতো
রিতার শরীর আমার রক্তে উৎসবের মতো
আমি নিজেকে হারিয়েছিলাম রিতার মধ্যে দুবছর ধরে আর 
রিতা আমার কাঁধে ঘুমিয়েছিল দুবছর ধরে। আমরা প্রতিজ্ঞা 
করেছি নিজেদের ঘরে চুমুর ওপর ভরসা করে। আমরা পুড়েছি 
ঠোঁটের ওয়াইনে এবং আমরা জন্মেছি হাজারবার আমাদের মনে।
আহ রিতা! রাইফেলের সামনে তোমার থেকে চোখ সরে নিত 
এই নীলাভ মেঘগুচ্ছ
ওহ! এক সময় আবছা ভোরের অন্ধকারে আমার চাঁদ হয়ে গেছিল তার চোখ
সমস্ত শহর গানে ভেসে গেল
তখন রিতা এবং আমার চোখের মাঝে একটা রাইফেল ছিল।।

সোমবার, ১১ জুন, ২০১৮

ভালোবাসি ভালোবাসি ।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 

















ভালবাসি, ভালবাসি

ধরো কাল তোমার পরীক্ষা,রাত
জেগে পড়ার
টেবিলে বসে আছ,
ঘুম আসছে না তোমার
হঠাত করে ভয়ার্ত কন্ঠে উঠে আমি
বললাম-
ভালবাস? তুমি কি রাগ করবে?
নাকি উঠে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে,
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো ক্লান্ত তুমি, অফিস থেকে সবে
ফিরেছ,
ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত পীড়িত..
খাওয়ার টেবিলে কিছুই তৈরি নেই,
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ঘর্মাক্ত আমি
তোমার
হাত ধরে যদি বলি- ভালবাস?
তুমি কি বিরক্ত হবে?
নাকি আমার হাতে আরেকটু
চাপ দিয়ে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো দুজনে শুয়ে আছি পাশাপাশি,
সবেমাত্র ঘুমিয়েছ তুমি
দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম
শশব্যস্ত
হয়ে তোমাকে ডাক দিয়ে যদি বলি-
ভালবাস?
তুমি কি পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে?
নাকি হেসে উঠে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি
দুজনে,মাথার
উপর
তপ্ত রোদ,বাহন
পাওয়া যাচ্ছেনা এমন সময় হঠাত
দাঁড়িয়ে পথ
রোধ করে যদি বলি-ভালবাস?
তুমি কি হাত সরিয়ে দেবে?
নাকি রাস্তার সবার
দিকে তাকিয়ে কাঁধে হাত
দিয়ে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো শেভ করছ তুমি,গাল কেটে রক্ত
পড়ছে,এমন সময়
তোমার এক ফোঁটা রক্ত
হাতে নিয়ে যদি বলি-
ভালবাস?
তুমি কি বকা দেবে?
নাকি জড়িয়ে তোমার গালের রক্ত
আমার
গালে লাগিয়ে দিয়ে খুশিয়াল গলায়
বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো খুব অসুস্থ তুমি,জ্বরে কপাল পুড়েযায়,
মুখে নেই রুচি, নেই কথা বলার অনুভুতি,
এমন সময় মাথায় পানি দিতে দিতে
তোমার
মুখের
দিকে তাকিয়ে যদি বলি-ভালবাস?
তুমি কি চুপ করে থাকবে?নাকি
তোমার গরম শ্বাস আমার
শ্বাসে বইয়ে দিয়ে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো যুদ্ধের দামামা বাজছে ঘরে
ঘরে,
প্রচন্ড যুদ্ধে তুমিও অঃশীদার,
শত্রুবাহিনী ঘিরে ফেলেছে ঘর
এমন সময় পাশে বসে পাগলিনী আমি
তোমায়
জিজ্ঞেস করলাম-
ভালবাস? ক্রুদ্ধস্বরে তুমি কি বলবে যাও?
নাকি চিন্তিত আমায় আশ্বাস
দেবে,বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো দূরে কোথাও যাচ্ছ তুমি,
দেরি হয়ে যাচ্ছে,বেরুতে যাবে,
হঠাত বাধা দিয়ে বললাম-
ভালবাস? কটাক্ষ করবে?
নাকি সুটকেস ফেলে চুলে হাত
বুলাতে বুলাতে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো প্রচন্ড ঝড়,উড়ে গেছে ঘরবাড়ি,আশ্রয়
নেই
বিধাতার দান এই
পৃথিবীতে,বাস করছি দুজনে চিন্তিত
তুমি এমন সময় তোমার
বুকে মাথা রেখে যদি বলি ভালবাস?
তুমি কি সরিয়ে দেবে?
নাকি আমার মাথায় হাত রেখে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো সব ছেড়ে চলে গেছ কত দুরে,
আড়াই হাত মাটির নিচে শুয়ে আছ
হতভম্ব আমি যদি চিতকার করে বলি-
ভালবাস?
চুপ করে থাকবে?
নাকি সেখান থেকেই আমাকে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
যেখানেই যাও,যেভাবেই থাক,না
থাকলেও
দূর থেকে ধ্বনি তুলো
ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি..
দূর থেকে শুনব তোমার কন্ঠস্বর,বুঝব
তুমি আছ,তুমি আছ
ভালবাসি, ভালবাসি........

আমার জলেই টলমল করে আঁখি ।। নির্মলেন্দু গুণ








আমার জলেই টলমল করে আঁখি


নিজের জলেই টলমল করে আঁখি,
তাই নিয়ে খুব বিব্রত হয়ে থাকি।
চেষ্টা করেও রাখতে পারি না ধরে-
ভয় হয় আহা, এই বুঝি যায় পড়ে।
এমনিই আছি নদীমাতৃক দেশে,
অশ্রুনদীর সংখ্যা বাড়াবো শেষে?
আমার গঙ্গা আমার চোখেই থাক্
আসুক গ্রীষ্ম মাটি-ফাটা বৈশাখ।
দোষ নেই যদি তখন যায় সে ঝরে,
ততদিন তাকে রাখতেই হবে ধরে।
সেই লক্ষেই প্রস্তুতি করে সারা,
লুকিয়েছিলাম গোপন অশ্রুধারা।
কিন্তু কবির বিধি যদি হন বাম,
কিছুতে পূর্ণ হয় না মনস্কাম।
মানুষ তো নয় চির-সংযমে সাধা,
তাই তো চোখের অশ্রু মানে না বাঁধা।
আমার জলেই টলমল করে আঁখি,
তোমার চোখের অশ্রু কোথায় রাখি।

আমি পাথর সরাতে পারি ।। মহাদেব সাহা

















আমি পাথর সরাতে পারি

পাথর কতোটা ভারী, তার চে'ও ভারী 
তোমার নির্দয় প্রত্যাখান, 
আমি পাথর সরাতে পারি, উপেক্ষা পারি না ; 
তোমার উপেক্ষা আর অবহেলাগুলি 
পাথরের চে'ও অধিক পাথর হয়ে আছে, 
এই বুকে হয়ে আছে অনন্ত অনন্ত হিমযুগ ; 
কতো সহস্র আলোকবর্ষ ব্যাপী আমি 
এই উপেক্ষা ধারণ করে আছি । 
পাথর কতোটা ভারী, তার চে'ও 
হাজার হাজার গুণ ভারী 
তোমার শীতল দৃষ্টি, 
তোমার ফিরিয়ে নেয়া মুখ 
তোমার নিঃশব্দে চলে যাওয়া ; 
আমি পাথর সরাতে পারি, উপেক্ষা পারি না ।

তৈমুর খানের দুটি কবিতা



তৈমুর খান




আত্মরক্ষা
           
নৌকা ভেসে গেছে
বন্যা আসক্ত নদীও
প্রেমের বৈঠারা কে কোথায় ?

হাসিকান্নার জলে বিস্ময় তরঙ্গ তট ভাঙে
সততার বিকল্প ছিল না যদিও
এসময় ভেসে গেছে সেও

নিজের ছায়ার কল্পনায়
এখনও ভেসে আছি
এই তীব্র প্রবাহে যতক্ষণ ভেসে থাকা যায়



নীলবর্ণা
               
কোনও নীলবর্ণার কাছে
আমার সাহসী বিশ্বাস রোজ যায়

কী কথা বলতে চায়  ?
বলা হয় না কথা তার
প্রপীড়িত উল্লাস নীরব দহনের গান গায়

নীলবর্ণা নিসর্গ হয়
শস্যক্ষেত হয়
নীলবর্ণা তবু এক পাখি
আমার অনন্তলোকে তার ডাক শুনতে থাকি

মঞ্চে দাঁড়িয়ে ।। হরিৎ বন্দোপাধ্যায়













মঞ্চে দাঁড়িয়ে


সভার মঞ্চে উঠলেই মনে হয়
সবাইকে সবকিছু বলে দিই
তারপর ভাবি কী আর বলবো
সেই তো এক অভাব, কোথাও কিচ্ছু হচ্ছে না,
যে যা পাচ্ছে যা খুশি নিয়ে নিচ্ছে

আমি না বললেও কেউ কেউ তো বলেছে
কী বদলটা হয়েছে তাদের ?
সেই তো অভাবের এক ডাল থেকে আর এক ডালে

আজকেও অনেক কিছু বলবো ভেবেছিলাম
শেষমেষ একটা কবিতা বলে নেমে এলাম ।



বেড়াজাল ।। নাসির ওয়াদেন












বেড়াজাল

         

কেটে বেড়িয়ে যাই

কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ে মায়ার জালে
নেতিয়ে পড়া পুঁই শাকও একটু হলেও
মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় --

চারিদিকে ষ্পর্ধার ঝড়ো হাওয়া বইছে
কবিকে কবি নয়
সত্যিকে মিথ্যে বলে
কত আদিখ্যেতা দেখি টিভির সাক্ষাৎকারে
নির্জলা  মিথ্যের চাতুরী --

প্রতিনিয়ত বেড়াজালে আটকে যাচ্ছি
সূর্যও আটকে থাকে মেঘের জালে
বৃষ্টিও পাথর হয়ে ঝরে
তবুও, সৌজন্যতা নিজেকে ফিকে করে
ভালবাসা ভাঙে শত গঞ্জনার মায়ার বেড়াজাল 

চন্দ্র বালিকা ।। মুস্তফা হাবিব

















চন্দ্র বালিকা


মানুষ মানুষের মধ্যে বৈষম্য বাড়াতে রোজ 
প্রাণপণ প্রতিযোগিতায় মাঠে নামে মানুষ,
জলে ডুব দেয়,ছল চাতুরিতে উচাটন মন,
   সবাই সকাল সন্ধ্যায় উড়ায়  ডাঙার ধুলো।


অবিশ্রাম দ্বন্দ্ব সংঘাতে রোজ দেয় হামাগুড়ি
কেউ কারো কল্যাণে উড়ায় না ভেষজ সুখ,
হিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে নি:শেষ একাকার ;
  মরীচিকার পিছনে ছুটে ভুলে যায় নিজকে।

তবু এসব কিছুকে উপেক্ষা করে
সবার জীবনে একটি দিন আসে সাজসাজ রবে
প্রজাপতির রঙিন ডানায় অপার স্নিগ্ধতা নিয়ে!
  রূপালি চাঁদের জরি মাখা সেই দিনের শরীর।

সেদিন আমার দুচোখে চন্দ্র বালিকা হাসে
তারা হাসে, জোনাকিরা নাচে দাদরা তালে,
লাল শাড়িতে বধু নাইওর যায় স্বজনের বাড়ি
   ভুলে যায় পরস্পর বিদ্বেষপূর্ণ সমস্ত আঁধার।

সেই দিনটি পেতে আমিও যেনো মাছরাঙা পাখি,
সুদুরে মেলে দেই বিজনে স্বপময় উদাসি আঁখি।
...................

কালবেলা ।। সুদীপ্ত বিশ্বাস





















কালবেলা



মুখোশের মাঝে মুখটা হারিয়ে গেলে
মানুষে-মানুষে যবনিকা নেমে আসে,
উজানের স্রোতে অনেক সাঁতারু ছিল
অকুল পাথারে একজনও নেই পাশে।


বন্ধুর বুকে বন্ধু বসালে ছুরি,
ভাইয়ের রক্তে দুহাত রাঙালে ভাই;
মনের আগুনে প্রতিদিন পুড়ে-পুড়ে
চিতার জন্য পড়ে থাকে শুধু ছাই।


ধর্মের নামে অন্ধেরা উন্মাদ
রক্তে-রক্তে রাঙিয়ে নিচ্ছে হাত;
মৃতের মিছিলে কত অসহায় মুখ
প্রশ্ন করছে,মৃত্যুর আছে জাত?


খুনের মিছিলে এ কেমন সভ্যতা?
প্রতিবাদ? তুমি প্রতিবাদী ভাষা শেখো;
ধর্মের-কল আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে
মানুষে-মানুষে ভালবাসা লিখে রেখো।

বাংশগাড়ি ।। আলম দীন













বাঁশগাড়ি

আমার সামান্য জমি,এরই পরে বাঁশগাড়ি প্রচণ্ড প্রতাপ,
কুলাবো কেমন করে নমনীয় দেহে এই বংশদণ্ড ঠাপ !
এবার রেহাই দাও,
ধরছি তোমার পাও
অন্তত থাকুক এই মুখে,নির্যাতনে শিউরে ওঠা ব্যগ্র প্রলাপ ।
কতো যে যুদ্ধ হলো ন্যায় আর অন্যায়ের,সমূহ-সমূহে বিপরীত
কে তবে বিজয়ী হলো আজতক,কোনো প্রমাণ বুঝিনি কিঞ্চিৎ;
রাজাই রাজত্ব করে,
অন্য রাজা অস্ত্র ধরে
এসবই তো চেষ্টামাত্র করে নিতে কুক্ষিগত ক্ষমতার ভিত ।
প্রতাপে প্রতুল ন্যায়,তাকে বাধ্য হয়ে ডেকে ফেলি বাপ,
আমি যে নিঃস্ব হয়ে জন্মিয়াছি,এ আমার জন্মগত পাপ;
আমি অসহায়
ক্ষমা করা যায় ?
অধিকার চাবো না কখনো আর,ক্ষমতা আমার অভিশাপ

বিবর্ণ সুতো ।। রওশন রুবী




বিবর্ণ সুতো 



               হন্তদন্ত হয়ে ব্যাংকে ঢুকলেন দোলন। সামনে পেছনে আশেপাশে কে কোথায় আছে ওদিকে লক্ষ্য করার এক মুহূর্ত সময় নেই। চেক লিখে কাঁচের ছোট ছিদ্র দিয়ে অফিসারকে দেবার জন্য বাড়িয়ে রাখলেন। পাশাপাশি দুজন অফিসার বসেন এখানে। একজন একাউন্ট চেক করেন; অন্যজন ক্যাশিয়ার। চেকের সর্বডানের অংশ ছিঁড়ে; সেই টোকেনটি হাতে কম পক্ষে ত্রিশজন মানুষ গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে। দোলনের ডান পাশের অংশটি বাম হাতে। তিনি অফিসারের হাতের দিকে তাকালেন। তার হাতে দশবারোটা চেক এখনও। অগত্যা চেকটি ধরে নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে রইলেন। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তিনজন এসে তার হাতে চেক ধরিয়ে দিল। সে নিয়ে অপেক্ষাকৃত বয়স্কজনের চেকটি উপরে রাখলেন। লাইনে লোকজনের সমাগম বাড়ছে। কাউন্টার থেকে ছয় সারি হয়ে গেল ইতিমধ্যে। ছয় সারিতে কম করে হলেও পঞ্চাশ জন মানুষ হবে। হাতেগোণা কয়জন ছাড়া প্রত্যেকে কথার থলিটা ফুটো করে দিয়েছে। দুকান ভোঁ ভোঁ করছে। এরা যেন রাজ্যের কথা বলতে এখানে এসেছে। এদের মূর্খামি কখনও সুধরাতে পারবে না কেউ। এবার দোলনের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। তিনি হাতের চায়না পাখাটি দিয়ে বাতাস করছেন। এসব বাতাস থোড়াই কেয়ার করে গরম। মানুষে মানুষের গরমটাই মারাত্মক। মানুষ দাঁড়াতে দাঁড়াতে অস্থির হয়ে উঠে গরমে না যতটা; কথায় তার তিনগুণ। এর মধ্যে কথায় অতিষ্ঠ হয়ে অনেকেই অনেককে ধমক দিলেন। আরে চুপ করেন না! কী শুরু করেছেন? সামান্য সময় চুপ হয়। পরেই আবার তেতে ওঠে পরিবেশ। স্কুলের বাচ্চারা এদের থেকে শতগুণ ভালো। চুপ থাকতে বললে অন্তত পনেরো মিনিট হলেও চুপ থাকতে পারে। এরা যা করে তা ছোট বাচ্চাদেরও হারমানায়। একেক জনের ভাব দেখে পিত্তি জ্বলে যায় দোলনের। মনে হয় কত বিশেষজ্ঞ। একে তো ভ্যাপসা গরম তার উপর কাউন্টারে ভিড়। দুহাত ব্যবধানে দুটি পিলারে বাক্সবন্দি দুটি ফ্যান বাতাস দিতে দিতে নাভিশ্বাস তুলছে। পিলার থেকে পিলারের দূরত্ব প্রায় পাঁচ হাত। ওসব ফ্যানের বাতাস নস্যি যেন। এতক্ষণে অফিসারের হাতের চেকগুলো শেষ হলো। তিনি দোলনের হাতের চেকগুলো নিলেন। দোলন সেই কাউন্টারের পাশের কাউন্টারের সামনে আড়াআড়ি দাঁড়ালেন। ঘামে ভিজে উঠেছে শরীর। ব্যাগে ভেজা টিস্যু থাকলেও ব্যাগ খুলে নেবার ঝক্কিতে গেলেন না। একটু নড়া চড়া করলেই শরীরে শরীর লেপ্টে যায় যেখানে। সেখানে ব্যাগ খোলার মতো বোকামি করা যায় না। এক্ষেত্রে ছেলেরা ভীষণ নড়ছে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ সবসময় সুবিধাবাদী। গাড়িতে বসলেও তাদের হাত পা ছড়িয়ে বসার কাঙ্গালপনা থাকেই। যা গা গুলিয়ে উঠে দোলনের। সে প্রায়ই এমন লোকের পাল্লায় পড়লে নির্দিষ্টস্থানে না গিয়ে পথে নেমে অন্য গাড়িতে উঠেন। ড্রাইভারেরা কখনও কখনও বুঝে কিছু বলে না। অর্ধেক পথের ভাড়াই নেয়। কোল কোন ড্রাইভার ঐলোকগুলোর মতো চরিত্রহীন লাফাঙ্গা। ওরা নামাতে চায় না। নামানেও ডাবল ভাড়া নেয়। এক রুটে তেরো বছর চাকরী করে দোলন। নতুন দু‘একজন ড্রাইভার পড়ে যায়। এসব সামলেই চলতে হয় পথে নামলে; জানে দোলন। এখন এখানেও সুবিধাবাদী লোকগুলো নড়াচড়া করছে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। অকারণে এদিকে ওদিকে যাচ্ছে। ফলে গায়ে গা চেপে জায়গা দিতে হচ্ছে। কেউ কেউ হাত তুলে কাউন্টারের গ্লাস বা পাশের দেয়াল ধরছে। অমনি বেরিয়ে পড়ছে বগলের জমে থাকা ঘামের গন্ধ। দেখা যায় ঐ হাতের নিচে কয়জন ক্যাশিয়ার সাহেবের ডাকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সেই গন্ধে মেয়েরা মুখ বিকৃত করছে। ছেলেরা বলেই বসে, ভাই হাতটা নামিয়ে নিন। দোলন কখনও কখনও টাকা তুলতে আসা এই সব শিক্ষিত লোকদের অবাক হয়ে দেখেন। সে বুঝতে পারে না এদের স্বভাব এতো কঞ্জুসের মত কেন? 
ছেলেদের কাউন্টার, মেয়েদের কাউন্টার পৃথক হলে বেশি ভালো হতো। অথবা দুজন ক্যাশিয়ার টাকা প্রদান করলে।কতৃপক্ষ যদি এইসব ব্যপারের নজরদারি না করেন; তবে সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি হবে না কখনই। কেন তারা এই বিষয়টায় নির্লিপ্ত কে জানে। যিনি টাকা প্রদান করেন তিনি ভীষণ ধীর। ধীর হবেন নাই বা কেন? একটা ভুলের জন্য তাকে কি কম খেসারত দিতে হয়? ভুলের মাসুল গুনতে গুনতে ধীর হয়েছেন তিনি। তার আঙুল গুলোও সতর্ক হয়েছে। তিনি দুতিনবার টাকা নিয়ে হাতে গুনবেন। তারপর টাকাকে সামনে পেছনে উপর নিচ ঝাঁকি দিবেন। ঝাঁকা ঝাঁকি শেষে টাকা গণনাকারী মিশিনে দিবেন। মিশিন থেকে প্রথমবার বের করে আবার ঝাঁকিয়ে মিশেনে ঢোকাবেন। এইবার নিশ্চিত হয়ে কাউন্টারের ছিদ্র দিয়ে বাড়ানো হাতের টোকেনটি নিয়ে চেকের সাথে নম্বর মিলিয়ে টাকা হস্তান্তর করবেন। একজন টাকা পেতে হলে ক্যাশিয়ার সাহেবের হাতে চেক ওঠার পরেও দশ বারো মিনিট সময় লাগে। এরমধ্যে অন্যরকম সুবিধাভোগীরা কাউন্টারের ভেতর দিয়ে লেনদেন করছে। বাদ নেই অফিস স্টাফ এবং পরিচিতরাও। আশ্চার্য! অফিস স্টাফরা পরেওতো নিতে পারে! জনগনকে ভোগান্তি দিতে সত্যি সবারই আরাম আরাম লাগে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক ধরে বাহিরে অপেক্ষা রত মানুষগুলো অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। গুঞ্জনে গুঞ্জনে বিরক্ত লাগছে দোলনের। দূরে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু একবার কারো নাম ডাকলে সে সাড়া না দিলে পরবর্তী নাম ডাকবেন। বাদ পড়া নামগুলো সব চেকের নিচে চালান হবে। তখন মাথা কুঁটেও লাভ হবে না; সবার পরে নিতে হবে টাকা। তাই দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল দোলন। কতক্ষণ লাগবে কে জানে। দোলন গলা বাড়িয়ে টুপি মাথার লোকটিকে দেখল। এতক্ষণ চোখে চোখে রেখেছে লোকটাকে। হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছিল। আসলে সামনে তিনজন তার থেকে লম্বা লোক দাঁড়িয়েছে বলে ওনাকে দেখা যায় নি। ঐ লোকটির পরেই দোলনের ডাক পড়বে। সে চেক জমা দেবার সময় তার চেকটি উপরে দিয়েছিল। তাই ভিড়ে ক্যাশিয়ার সাহেবের কন্ঠস্বর কানে আসুক বা না আসুক। ওনাকে লক্ষ্য রাখলেই ফল পাবে দোলন। সোনালী ব্যাংকে সব সময় এমন ভিড় থাকে কিনা জানে না দোলন। সে মাসের ছয় কি সাত তারিখে টাকা তুলতে আসে। এই টাকা উপর তার বাসা ভাড়া, লোন, বাকি দোকানের টাকা, সংসার খরচ, ছেলের খরচ, অফিসে যাবার ভাড়া সব নির্ভর করে। চাকরির স্থলে কাজের পর বড় অফিসারদের মুখ ঝামটা। সেসব পার করে মাস শেষে যে টাকা ব্যাংকে আসে তা তুলতেও নাভিশ্বাস। ছেলে এই বিষয়ে সহযোগিতা করতে পারত তাকে। কিন্তু করে না। কেউ নিজের থেকে মায়া না করলে মায়া তো সৃষ্টি করা যায় না। এই টাকা তোলার পর চাল, ডাল, কাঁচা বাজার; মাছ মুরগি, বিস্কিট, ডিম, তেল ইত্যাদি কিনে বাড়ি যেতে হবে। যাবার পথে বাকি দোকানে টাকা পরিশোধ করে যাবেন। বাড়ি গিয়ে হাত মুখ ধুতে না ধুতে প্রাইভেট পড়তে চলে আসবে ছেলেমেয়েরা। সে সময় ক্লান্তিতে শরীরটা ঝিমোয়। ইচ্ছে করে দুদণ্ড শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। সেই রাত সাড়ে চারটায় ঘুম ভাঙা চোখ, যেন তাকিয়ে থাকতে চায় না। কিন্তু দোলের ছেলেটা বড় হয়েও বড় হয়ে উঠে না। সে দরজা খুলে মোবাইল নিয়ে বসে থাকবে। বলতে বলতে হয়ত আধঘন্টা পর এক কাপ চা করে দিবে। অথবা দোলন ঘরে ঢুকলে সে বেরিয়ে যাবে বা বাহিরেই থাকে। দোলন তো ছেলের কাছে বেশি কিছু চায় না। সে এলে না বলতে একমগ ঠান্ডা পানি যদি এগিয়ে দেয়। যদি এক মগ চা করে দেয়। যদি হাট-বাজারগুলো করে আনে। যদি বেতনটা তুলে আনে। এই জীবনে দোলনকে বুঝলো না কেউ। বুঝলো না নিজের সন্তানও। তার থেকে সবাই চায় আর চায়। কিন্তু তাকে কেউ বিন্দু পরিমান দিতে চায় না। বিষিয়ে উঠছে তাই দোলনের জীবনটা। হতাশা গ্রাস করছে তাকে। দিনে দিনে গুটিয়ে যাচ্ছে শামুকের মতো। অথচ সে ছিল উদ্ধমি একজন মানুষ। সবকিছুতে সতেজ থাকতে তার ভালো লাগতো। তাকে পৃথিবীর মানুষগুলো কোনঠাঁসা করে দিচ্ছে। সে কি কিছু চায় তাদের কাছে? না; চায় না কিছুই। যেই জন্মদাতা-দাত্রী তার কথা ভাবেনি। সে মানুষের কথা কেউ ভাববে এমন বোকার মতো চিন্তাও করে না দোলন। সে শুধু বাঁচতে চায়। টিকে থাকতে চায় পৃথিবীর আলো বাতাসে। কারো উপরে বোঝা হয়ে নয়। কাউকে পাওনাদার রেখে নয়। তবু কেন তারা তাকে নিয়েই খেলে? সেই ক্লাস সিক্সে প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পর বাবা মা তাকে বিয়ে দিল তিন সন্তানের এক জনকের কাছে। ভালোবাসা কি জিনিস সে কখনও তা টের পায়নি। ভদ্রলোক টাকার কুমির ছিলেন। কিন্তু ভালোবেসে তিনি কখনও দুটো কথা বলেনি। এক বিছানায় থাকেনি দোলনের সাথে। তবে? তবে কেন বিয়ে করল? বিয়ে করল তার ছেলে মেয়ের জন্য একজন দাসির দরকার ছিল বলে। তার ঘর পাহারা দেবার লোক দরকার ছিল বলে। তিনি দাসির প্রতি যথেষ্টই সহায় ছিলেন। কখনও খেলো কিনা সে খোঁজটুকু নিয়ে, খবরদারি করেননি দাসির উপর। 
দোলনকে ভালোবেসে ছিল তার গ্রামেরই এক ছেলে। জলের ধর্ম শূন্যস্থান ভরিয়ে দেয়। দোলনের শূন্য পারাবারও ভরে উঠেছিল সেই অঢেল জলে জলে। তাঁর মনে প্রবাহিত হতো সুর, ছন্দ, গান। গুনগুন করত অসংখ্য মৌমাছি। তার উড়তে ইচ্ছে করত। তাদের দেখা সাক্ষাত কোন দিন হত না। শুধু চিঠি লেন-দেন হতো। একেকটা চিঠি আসতে আসতে প্রায় পনেরো দিন পেরিয়ে যেত। তবু সেই অপেক্ষার মধুরতা তাকে সব কষ্ট থেকে পৃথক করে ফেলে। সে নিজের মধ্যে একটা জগত তৈরি করে বাঁচে। দিনে দিনে তার উপর প্রভুত্বের প্রখরতা বাড়তে থাকে। অধৈর্য, অসহিষ্ণু দোলন কোন আশ্রয় পায় না। সে ডাল-পালা ভাঙাচোরা একটি পতিত ভূমির বৃক্ষ যেন। মেয়েরা বড় হতে থাকলে প্রভুর চিন্তা শুরু হয়। ঘরে মা না থাকলে বিয়ে দিবেন কি করে? তাই তিনি একটু আধটু ভালোবাসা খরচ করতে চায় দোলনের জন্য। ততদিনে অত্যাচারিত অবহেলায় দোলন তো মরে গেছে ভেতরে ভেতর। তার যে দেহ আছে দৃশ্যত। ও দেহের বোধ নেই। সে শুধু ঘৃণা করে প্রভুকে তখন ভীষণ, ভীষণ। স্বার্থের জন্য যে ভালোবাসা সে তো ঘৃণা পাবারই যোগ্য। যে মেয়ে স্বার্থ ত্যাগের জন্য জন্মেছে; হয়ত তার ঘৃণা করা বেমানান। কিন্তু শরীরের ভেতর রক্ত মাংসগুলো তাকে কেমন জানি করে ফেলে। ভেতরে ভেতরে একটি হাই স্কুলের কেরানির সাথে যোগাযোগ করে ভর্তি বিষয়ে। তিনি প্রধান শিক্ষক এবং অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করে দোলনকে ভর্তি করেন। ভর্তির সময় দোলন তার সমস্যা বলেছিল। তাই তারা তাকে দয়া করে। সেই দয়া অনুসারে সে শুধু পরীক্ষাগুলোতে অংশ নিত। এইভাবে নবম শ্রেণিতে উঠে তার পড়া বন্ধ হয়ে যায়, ভর্তি টাকা ছিল না বলে। সে ঐ পাষাণকে বললে, টাকার বদলে তিরস্কারই পেত; জানে বলেই, বলেনি। পড়ার তৃষ্ণা তাকে আহত করত। সে দিনরাত শুধু চিন্তা করত কি করা যায়? এই চিন্তার মধ্যে একদিন তার ভালোবাসার মানুষের চিঠি আসে। সেই চিঠি প্রভুর হাতে পড়ে। ফলে নিপীড়ন চরমে উঠে। নিত্য নিপীড়নে ও শ্বাস কষ্টে আক্রান্ত হয়। সেই রোগ সারাতে দিনের পরদিন ডাক্তারেরা ঘুমের ঔষধ খেতে দেয়। ঔষধ আর মনের অশান্তিতে দোলন মাটির পুতুলে পরিণত হয়। চেয়ে থেকেও সে কিছু বুঝে না; দেখে না; জানে না; শুনে না। ঘুমের পর ঘুম; ঘুমের পর ঘুম, দোলনকে জগতের মায়া থেকে দূরে ঠেলে দেয়। প্রায় বছর দেড়েক পর, ধীরে ধীরে দোলন সুস্থ হতে থাকে। কিছুটা সুস্থ হলে সে কেমন অনুভব করে। ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার চেকাপ করে বলে আনন্দের খবর! আপনি ছেলের মা হচ্ছেনে। এখন পাঁচ মাস চলছে। আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট তাই বলছে। অবিশ্বাস্য চোখে ডাক্তারের দিকে তাকায় দোলন। সে ডাক্তারকে বলতে থাকে, এটা সম্ভব নয়! কিছুতেই সম্ভব নয়! ডাক্তার বলে, সম্ভব অবশ্যই! আপনি একজন বিবাহিত মেয়ে। দোলন ফের প্রতিবাদ করতে চায়। বলতে চায়, আমার স্বামীর সাথে তো আমার সম্পর্ক নেই। কিন্তু ভাবে, এ কি হলো! কি করে হলো! কিছুই বলে না ডাক্তারকে। প্রশ্নটা তাকে যন্ত্রণা দিতে থাকে; দিতে থাকে। অবশেষে সে বুঝতে পারে প্রভুই তাকে রেপ করেছে। সে ধর্ষিতা। ঘৃণার মাত্রা বাড়ে যখন তার মুখে শুনে, “খুব তো উড়ে ছিলে। কেমন ডানা কেটে দিলাম?” যে মানুষ জ্ঞানহীন মানুষকে ধর্ষণ করে তাকে ঘৃণাই করে দোলন। 
ছেলে সন্তান জন্ম নিল একদিন। দিনে দিনে সে বড় হতে থাকলো। দোলনকে যে ছেলে ভালোবাসে; সে কেমন করে যেন খোঁজ নিয়ে নিয়ে দোলনকে নিতে আসে। দোলন তাকে ফিরিয়ে দেয় সন্তানের কথা ভেবে। বলে, সর্বহারাকে নিয়ে ভাববেন না। সে খড়কুটোর মতো বেঁচে থাকবে। ঐ সন্তানের কথা ভাবুন। পরিচয়হীনার পরিচয় না থাকে থাকুক; ওর একটা বাবার পরিচয় তো থাকলো। ভাঙা মনে ছেলেটি চলে যায়। খাঁ খাঁ শূন্যতা নিয়ে সর্বহারা দোলন বেঁচে থাকে। তার ছেলে নিলয় স্কুলে ভর্তি হয়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার একটা সুযোগ আসে। ওকে আনা নেয়ার প্রেক্ষিতে। তাই সে খোঁজ নিয়ে ওপন ইউনিভার্সিটির এসএসসি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়। ক্লাস বা পরীক্ষা শুক্রবার করে হওয়ার, ছেলের নোট করতে যাচ্ছে বলে বেরিয়ে মাঝে মধ্যে ক্লাস করে আসে। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দেয়। একই ভাবে এইচএসসি শুরু করে। শেষ সেমিস্টার ঘনিয়ে আসে। প্রভুর মেয়েদের ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায়। তারা অতি সুখে দিন যাপন করে। ওদের চিন্তা আসে তাদের ভাইয়ের সমান সম্পদ দোলনের ছেলে পাবে। এইটুকু তারা মানতে পারে না। তাই তিনজনে মিলে কৌশলে দোলনকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। দোলন জানে এতে তার প্রভুরও সায় আছে। নয়তো তিনি অন্তত অত্যাচারে অতিষ্ঠ দোলনকে ঠাঁই দিতেন। একদিন দোলন নিজের কথা ভেবে চলে যেতে চেয়েছে। আজ সে ছেলের কথা ভেবে থেকে যেতে চায়। কিন্তু পাষাণদের কুটকৌশলের কাছে হেরে যায় সরল মনা দোলন। তার এইচএসসি ফাইলান পরীক্ষা নিকটবর্তী ছিল তাও দিতে পারে না। একদিন যে বাবা মা তাকে জবাই করেছিল। সবশেষে তাদের কাছে চলে আসে নিপীড়িত দোলন। তাকে বাড়ির কেউ, পাড়ার কেউ চিনতে পারে না। সবাই বলে কী মেয়ে, কী হয়ে গেল! অবশ্য সে ফিরে আসার বছর তিনেক আগে তার বাবা মারা যায়। আর এক বছর আগে মারা যায় মা। তাই তাকে কোন অপরাধে এমন শাস্তিময় আজাবের জীবনে পতিত করল তারা; জানা হয় না। তাকে যে ভালোবেসে ছিল। সে এখন কলেজ শিক্ষক। শেষবার দোলনের কাছ থেকে ফিরে এসে সে বিয়ে করে। তার এক মেয়ে এবং এক ছেলে নিয়ে সংসার। সুখে থাকুক আর দুঃখে। তারা টিকে আছে। তার বিয়ের কথা শুনে দোলন কষ্ট পেয়েছিন। আর সে কষ্টকে শ্রাবণের বর্ষণে ভিজিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। ছোট বোনের জামাই অনেক চেষ্টা তদবীর করে পরিবার পরিকল্পনা অফিসে তার চাকরির ব্যবস্থা করে। চকরির ফাঁকে ফাঁকে পুনরায় সে পড়াশোনা শুরু করে। বিএসএস পাশ করে আর এগুতে পারেনি পড়া দোলন। দোলন সুলতানা! দোলন সুলতানা আছেন? কে দোলন সুলতানা? দোলন তাকিয়ে দেখে সবাই খোঁজা খুঁজি করছে দোলন সুলতানাকে। আর ক্যাশিয়ার সাহেব চোখের সামনে হালকা হলুদ রঙের চেকের পাতাটি ধরে। তার মোটা ফ্রেমের ভেতরে চোখগুলো কেমন ভয়ঙ্কর ফ্যাকাসে দেখায়। দোলন কাঁচের ছিদ্র দিয়ে টোকেনটি ঢুকিয়ে দেয়। দেরির কারণে ক্যাশিয়ার সাহেবের ভয়ঙ্কর ফ্যাকাসে চোখগুলো দপ্ করে জ্বলে উঠে নিভে যায়। টাকা নিয়ে দোলন ভালো করে এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে দেখে গুণে নেয়। আরো একবার এক হাজার টাকার একটা ছেঁড়া টেপ লাগানো নোট পড়েছিল বলে সর্তক হয়েছে সে। টাকা নিয়ে ভিড় থেকে বেরিয়ে ঘড়ি দেখে চারটা বেজে গেছে। সেই দুটো বিশ থেকে চারটে। টানা এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট। এখনও যতগুলো মানুষ আছে, ঘন্টা খানেকের আগে ক্লিয়ার করতে পারবে বলে তো মনে হয় না। এর মধ্যে ক্যাশিয়ার সাহেব উঠে গেলেন চা সিগারেট খেতে। সবাই হতাস হয়ে তার প্রস্থান পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।কলাপসিবল গেইট বন্ধ করে দিচ্ছে দারোয়ান। আর কাউকে ঢুকতে দিবেন না। যারা ভেতরে আছে তারা টাকা নিয়ে যাবেন। দোলনকে একটু ফাঁকা করে দিল কলাপসিবল গেইট।গেইট দিয়ে বেরুতে গিয়ে বাধা পায়। কেউ তার ব্যাগ ধরে টান দিল। দোলন টলকে উঠে। ব্যাংকের ভেতর ভিন্ন কিছু হবে না ভেবেও ব্যাগটি শক্ত করে ধরে গ্রীবা বাকিয়ে দেখে বিউটি। ও তার বাল্যশিক্ষা থেকে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত সহপাঠি ছিল। বড় হওয়ার পর আর দেখা হয়নি। তবু বন্ধুকে চিনতে এতটুকু দেরি হল না দোলনের। এর একটা কারণ অবশ্যই আছে। সেটা হলো ওর গালে টোল পড়ে। টোল পড়া মানুষ যেমন কম দেখা যায়; তেমনি তাদের চিনতেও বেগ পেতে হয় না। তারা হাসলে বা কথা বললে মুখে যে মায়া দেখা যায়, সে কারো সাথে মিলে না। বিউটি বলে,
- অনেক সময় ধরে তোকে দেখছি আর দেখছি। ভাবছি তুই কিনা! নাকি অন্য কেউ! বারংবার ডাকতে চেয়েও থেমে গেছি। তুই বরগুনা থেকে কবে এলি? ছেলে মেয়ে ক‘জন? শুনেছি তোর সৎ ছেলেমেয়েরা তোকে মাথায় করে রাখে। তোর বরও নাকি তোকে চোখে হারায়?
দোলন ভাবে বিউটি তার সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। তাই তাকে তেমন কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। দেখা হয়েছে হাই, হ্যালো করে দিলেই হলো।
- কিরে বিরক্ত হলি? কিছু বলছিস না যে?
- ওদের কথা থাক বিউটি। আমার এক ছেলে। একটা চাকরি হওয়ার কারণে এখন এখানে থাকছি।
- ওমা তুই চাকরি করছিস্! খুব ভালো কথা। তোর ছেলেটার বয়স কত?
- ও এইচএসসি ফাস্ট ইয়ারে পড়ে ।তোর কি খবর? ছেলে মেয়ে?
- খুব ভালো আছিরে! আগের বরটা অশিক্ষিত ছিল, জ্বালাত খুব। এখন ভালো আছি।
- আবার বিয়ে করেছিস্!
- আরে আমাদের সময়ের সব মেয়েরা কি বিয়ে করতে পার তো! হাজারে দুচারজন পার তো। আমাদেরকে অভিভাবক বিয়ে দিত। আমাকেও দু‘দুবার ওরাই বিয়ে দিয়েছে। বাবা মায়ের দায়দায়িত্ব আছে না? জন্ম দিলেই তো দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আগের ঘরের একটা মেয়ে; এঘরের এক মেয়ে একছেলে নিয়ে খুব ভালো আছি। দোলন মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শোনে। কি ভীষণ অকপটে সব কথা বলে দিতে পারে বিউটি। সত্যি, কেউ ভালো আছে জানলে দোলনের ভালো লাগে। এ সময় বিউটির ডাক পড়ে। সে টাকা নিতে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
- অনেক কথা আছে। একটু দাঁড়া প্লিজ। আমি আসছি।
দোলন দাঁড়িয়ে নয় একটি খালি চেয়ার পেয়ে বসে পড়ে। চাকরির পর এই তেরো বছর দোলন বাসা ভাড়া করে থাকছে।
আজকাল দোলনের শুধু চিন্তা হয়; শেষ বয়সে কে তাকে দেখবে? একে একে সবাই তার কাছ থেকে সরে যায়। সে না চাইলেও সরে যায়। তার কপালটা এমন কেন? ঝগড়া করে না, কাউকে অবহেলা করে না; মানুষকে তার যথাযথ সম্মান দেয়। তবুও তাকে কেউ ভালোবাসে না। কেউ তাকে আগলে রাখে না। ছেলে কাছ থেকে চলে গেলে আরো একা হয়ে যাবে। কে তার খোঁজ রাখবে? নিজের অপরাধে নিজের জীবন যদি এমন হতাসাগ্রস্থ হত; তবে দোলন মেনে নিত। কিন্তু তার তো কোন অপরাধ নেই! আজকাল সে চায় কেউ তাকে ভালোবাসুক, আগলে রাখুক। কিন্তু সেই মানুষ পায় না সে। পাবে কী করে? কাউকে তো দোলন বা তার পরিবারের কেউ বলে না, তার স্বামী নেই। সবাই জানে স্বামী আছে। স্বামী থাকা একটা মানুষকে কেউ বিয়ে করতে আসবে না। প্রেম করা হয়ে উঠে না দোলনের। সে ভাবে এমন যদি কেউ আসে যার ভালোবাসার প্রয়োজন তাকে ভালোবাসা দিবে; সংসার দিবে; আগলে নিবে। যে ভালোবাসা নিয়ে হারিয়ে যাবে এমন মানুষকে সে চায় না। চাইলেই মিলে না। মিলে না বলেই দোলনের হা হুতাশ নেই। সে ভাবে অনেক ভাবনা। যদি এমন হয় সেই মানুষ ছেলেকে মেনে না নিল? যদি তাকে ছেলে মেনে না নিল? সেতো কাউকেই হারাতে পারবে না। আবার যদি এমন হয়, ছেলের লেখা পাড়ার উপর প্রভাব পড়ে? তবে তাও মেনে নিতে পারবে না সে। ছেলেকে সে যত কষ্টই হোক উচ্চ শিক্ষিত করবে। তবেই না একদিন যে সংসার তার পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিয়েছে ; সেই সংসারের মানুষগুলোর উপর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। ছেলেই তার সব কিছু। সে জানে তার ছেলে একদিন অনেক বড় হবে; অনেক বড়। সেইদিন দোলন তাকে বুকে জড়িয়ে নেবার জন্য হয়ত থাকবে না। তবু তৃপ্তি পাবে। চল চল দোলন! বিউটির তাড়া পেয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং ব্যাংকের সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসে। বিউটি বলে,
- চল একটু চা খেয়ে নেই। হোটেলে চা খেতে তোর আপত্তি নেই তো!
- আপত্তি থাকবে কেন?
ওরা ব্যাংকের নিচে নূর হোটেলে ঢুকে একটি টেবিলে বসে। দোলন দুকাপ চা ও দুটো পরোটার অর্ডার দেয়। হাই স্কুলের পাশে ছিল হোটেল। স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন তারা সেখানে ঢুকে চা ও পরোটা খেত। কখনো দোলনেরটা শেষ হলে বিউটির থেকে একটু নিয়ে খেত। কখনো বিউটির শেষ হলে দোলন থেকে নিয়ে খেত। দোলন দেখে বিউটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে। সে অবাক হয়ে বলে,
- মনে রেখেছিস!
- কেন নয়! আর কেউ আসেনি। তাই ভিড়ও ছিল না যে।
বিউটি দোলনের হাহাকার ধরতে পারে না। সে উৎফুল্ল গলায় নানান কথা বলে। দোলনও বলে। বিউটি যত কথাই বলুক ঘুরে ফিরে চলে আসে স্বামীর কথায়। তার যেন কোথাও যাবার আর পথ নেই। ভালোবাসা পেয়ে মেয়েটা অস্থির হয়ে উঠছে। কি সৌভাগ্যবতী সে। দোলনের ভালো লাগে। 
চা শেষ হলে দোলন দেখে পোনে পাঁচটা বাজে। সে উসখুস করে। বাচ্চারা পড়তে এসে যাবে। ছেলে ঘরে না থাকলে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবে কিছুক্ষণ। তারপর চলে যাবে। বাসায় পৌঁছানোর সাথে সাথে অভিভাবকদের ফোন শুরু হবে। কৈফিয়ত দিতে হবে। এই বিষয়টি বিরক্ত লাগে দোলনের। সে ব্যাগ খুলে টাকা ওয়েটারকে দিতে গেলে বিউটি বলে,
- প্লিজ! আর কিছুক্ষণ থাক না! কত বছর পর দেখা। আরেক কাপ চা খাই চল। 
ওয়েটারকে আরেক কাপ চা আনতে বলে বিউটি। ওয়েটার চলে যায় বিউটি তাঁর সুখের কাসুন্দি ঘাটছে। দোলন বার কয়েক ছেলেকে ফোন করে। সে ফোন ধরে না। দোলনের টেনশান বেড়ে যায়। তবু সে হাসি মুখে চা‘য়ে চুমুক দেয়। টুকটাক প্রশ্নের উত্তর দেয় বিউটির। আবার ফোন করে নিলয়কে। এবার ফোন ধরে ও। দোলন বলে
- বাসায় থাকিস।
- কেন?
- আমার ফিরতে দেরি হবে। কাজ আছে।
- আমি বাহিরে।
- কতদূরে?
- বাসার কাছেই।
- তাড়াতাড়ি যা।
- ঠিক আছে।
ফোনটা রেখে বিউটির দিকে তাকিয়ে হাসে দোলন। আর বলে, এবার বল। তারা আরো কিছুক্ষণ কথা বলে বেরিয়ে আসে। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। লোকজন তাই আশ্রয় নিয়েছে হোটেল ব্যাংক এবং অন্যান্য দোকানের সামনে। বিউটি তার বরের অপেক্ষায় হোটেলের বাম পাশে ঔষধের দোকানে দাঁড়ায়।দোকান থেকে হাইওয়ে হাত তিনেক দূরে। ছাতা খুলে দোলন একের পর এক আটোরিকসায় উঠবার চেষ্টা করে।এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াচ্ছে না ওগুলোর ড্রাইভার। কোন রিকশাও চোখে পড়ছে না। বাড়ি যাওয়া জরুরি। নিলয়ের ধৈর্য খুবই কম। সে বাচ্চা গুলোকে থামিয়ে রাখতে রাখতে সহজেই অধৈর্য হয়ে উঠবে। আরেকটা অটোরিকসা আসায় জিজ্ঞেস করল যাবে কিনা। সে যাবে না বলে। দোকান থেকে বিউটি তাকে ডাকে। সে ফিরে তাকিয়ে দেখে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার ভালোবাসার মানুষটি। বিউটি আবার ডাকে এদিকে আয়! এদিকে আয়! আয় না! পরিচিত হয়ে যা! আয়!  দোলনের চোখ ঘোলা হয়ে উঠে। সে ওদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে সামনে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে চা খেতে খেতে বলা বিউটির কথাগুলো কানে বাজে ঢোলকের সুতীব্র শব্দের মত। পৃথিবীর উপর প্রচন্ড অভিমান হয়। দোলন যেন পুরোন কাঁথা। ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায় যার সব সূতো। ঢের বিবর্ণ সূতোর ভেতর থেকে সে মুখ ঘুরিয়ে ফের ওদের দিকে তাকায়। ঘূর্ণিঝড়ে তছনছ করে অলেখিত বন্ধন। সেই ধ্বংস যজ্ঞ থেকে সামনে ফিরতেই একটি গাড়ি এসে ধাক্কা দেয়। পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়াতে চায়। আরেকটা গাড়ি পলকে এসে ওকে ফেলে দেয় রাস্তায়। দুমড়ান শরীর থেকে দোলন হাত বাড়িয়ে কিছু আঁকড়ে ধরতে চায়।

আমার কিছু বলা হলোনা ।। রুদ্র সুশান্ত


আমার কিছু বলা হলো না


দুই জনের হাতে দু'কাপ সস্তা চা, রঙ চা বা লাল চা, যে যেটা বলেন। অনেকদিন পর দেখা হলো, সেই ২৮ তারিখ অর্থাৎ বইমেলার শেষক্ষণে দেখা হয়েছিলো, কথা হয়েছিলো। বইমেলার একদম শেষ পর্যন্ত ছিলাম আমরা, বইমেলায় রাত ন'টায় লাইট অফ হয়ে যাবার পরও আমরা 
অ-নে-ক ক্ষণ ছিলাম। সেইদিন অন্ধকারে চলে আসার পর আজও অব্দি আর ওই উদ্যানে যায়নি, বইমেলা ছাড়া ওটাকে আমার ন্যাংটা  ন্যাংটা মনে হয়।




শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করলাম, কতোগুলো মেয়ে আসলো, সবার হাতে প্লেকার্ড। ওখানে বিভিন্ন লেখা। "শক্তি" নামে একটা সংগঠন  ধর্ষণ বিরোধী মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। আমরা দু'জন ওখানে দাঁড়িয়ে সাম্প্রতিককালে মহামারী আকারে বেড়ে যাওয়া ধর্ষণ নিয়ে কথা বলছি, ঘুরে ফিরে আমি কবিতায় চলে আসলাম।



সাম্প্রতিক সময়ে কবিতায় বাঙলাদেশের অবস্থান নিয়ে কথা বলছি।  কথা বলতে বলতে গণগ্রন্থাগারের ভিতরে ঢুকে পড়লাম, হাঁটতে হাঁটতে শওকত ওসমান মিলনায়তনের সামনে চলে গেলাম, এখানে প্রায় দিনই কোন না কোন প্রোগ্রাম লেগে থাক, আজ দরোজা বন্ধ।  মানে কোন প্রোগ্রাম নেই।



দেয়ালে হেলান দিয়ে কথা বলছি। আশেপাশে আরো অনেক লোক, সবাই আড্ডায় ব্যস্ত।  পাশে কারা যেনো ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছে। একটা ছেলে বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে।  ওদিকটায় আমার তেমন নজর নেই, কারণ এখানে পবিত্র কবিতার কথা চলছে।
কবিতায় ডুবে আছি আমরা দু'জন।


মুহূর্তকালেই আকাশ কালো হয়ে এলো। খর-রৌদ্রের বৈশাখ হলেও গত ক'দিন ধরে ঢাকায় টানা
ঝড়-বাতাস ও বৃষ্টি চলছে। বলতে না বলতেই ধূলাবালি উড়িয়ে গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাতাস এসে গেলো আমাদের চোখেমুখে।



সবার মতো দৌঁড়ায় গিয়ে  আমরা দু'জন শওকত ওসমানের ছবির কাছে অবস্থান নিলাম।  জোরেশোরে বৃষ্টি এসে গেলো, বৃষ্টির ফোটা বড়ো থেকে আরো বড়োতর হচ্ছে। আমি বৃষ্টির ভিতর খুব ছন্দ খুঁজে পাচ্ছি, মন ভরে বৃষ্টি দেখছি। আশেপাশে সব লোকে লোকারণ্য।  আমার পিছনে হলুদ জামা পড়া একজন মেয়ে খোলা চুলে দাঁড়িয় আছে, কখন থেকে সে মেয়ে আমার পিছনে আছে আমি দেখিওনি, খেয়ালও করিনি। যখন চোখ পড়লো, আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। মেয়েদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা ব্যাপক, ঈশ্বর প্রদত্ত। আমি না তাকাতে চাইলেও মনের অবাধ্য নয়নদ্বয় বারবার কিশোরীর দিকে চলে যাচ্ছে।



হলুদ জামা আর খোলা চুলে কিশোরীকে মনে হচ্ছে আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে কোন মেঘপরী আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে বৃষ্টিযুক্ত বাতাস এসে আমার শার্ট ভিজে গেছে। চোখ শুধু কিশোরীর দিকে যেতে চায়। লক্ষ্য করলাম  কিশোরীও আমার দিকে তাকাচ্ছে। কথার ফাঁকে আমার মন কিশোরী বন্দনাগীত গাইছে। গলে যাওয়া বরফের মতো মনটাও ক্ষণেক্ষণে গলে যেতে চাইছে।



ল্যাম্পপোস্টের আলো ছুঁয়ে পড়া বৃষ্টির ফোটাগুলো আমায় পলকেই স্বর্গে নিয়ে যেতে চাইছে। মুগ্ধ হয়ে  আমি বৃষ্টি, বৃষ্টির বিশেষ গুণ হলো বালিকাদের মতো এটাও আমাকে খুব করতে পারে। ঠিক চাঁদের আলোর মতো। আমি কোন লেখায় জানি লিখেছিলাম- "চাঁদের আলো এবং বালিকা দু'টোই আফিম, মাঝরাতে খুব নেশা ধরে।" 
আজকে মনে হলো সেই নেশার মাঝে বৃষ্টিও যোগ হলো। ষোড়সী রুপবতী বালিকার নূপুরধ্বনির ন্যায় বৃষ্টি আমাকে হৃদয়ে লাগছে, হৃদয়ের অন্তস্থলে প্রেমিকার চুমোর মতো ছুঁয়ে যাচ্ছে।


বালিকাদের গায়ে যে সুগন্ধি আছে, পৃথিবীর কোন সুগন্ধি উৎপাদন কোম্পানি আজো অব্দি এমন হৃদয়ভরা সুগন্ধি তৈরী করতে পারেনি।  এটা তাদের ব্যর্থতা নয় বরং বালিকাদের ঈশ্বর প্রদত্ত মোহমায়া, যেটা বালিকাদের করেছে পৃথিবীর সবচে' মারাত্মক আবেদনময়ী। এ গন্ধ মস্তিষ্কে ধারণ করেই যুদ্ধজয়ী সেনাপতি তাঁর প্রেমিকার কাছে ফিরে আসে। এ গন্ধ বুকে ধরে রাখতেই প্রেমিকজন সারা মাস কষ্ট করে টিউশনের ইনকাম দিয়ে পেটভরে কিচ্ছু না খেয়ে তার প্রেমিকার কাছে গিয়ে গাছের আবডালে চুমো খায়। এই চুমো স্বাস্থ্যবান না হলে মনোবান। একটা লিপস্টিক কিনে দেয়, এক ঝুড়ি লাল চুড়ি কিনে দেয়, বাদাম কিনে রাস্তার ধারে আড্ডা মারে-এই আড্ডার কোন বিষয়বস্তু থাকেনা, থাকে নিরাপদ চাহনি, মনোমুগ্ধকর কথার ডালা, ভালোবাসার কীর্তন,  দু'জনে উদাস হবার মনোবাসনা। 



বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। কোথা থেকে আগন্তুকের মতো একটা প্রাইভেট গাড়ি এসে থামলো, সেটাতে হেলান দিয়ে আমি মনের মতো বৃষ্টি দেখছি। আমার পাশে থাকা মানুষটা মনে হয় আরো বেশি আবেগী। হলুদ জামা পরা বালিকা আমার খুব কাছে না হলেও কাছেই। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় কিন্তু না, বালিকাদের হাত দিয়ে নয় মন দিয়ে ছুঁতে হয়। মন দিয়ে একবার ছুঁতে পারলে তাদের মনে        মহাবিশ্ব   পরিমাণ জায়গা করে নেয়া যায়, বালিকারা একবার যাকে মন দিয়েছে তাকে সব দিয়েছে। বালিকাদের মন জয়ের জন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ করা লাগলেও মন জয়ের পরে আর কোন শান্তিযজ্ঞ করা লাগেনা।   একথা উপলব্ধি করে হয়তো নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন--
"হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোরে
মন বাড়িয়ে ছু্ই।"
বালিকারা কাঁচের চেয়েও বেশি ভঙ্গুর, এরা যে কি আঘাতে ভেঙে যায় আর কিসে আনন্দ পায় সেসবের তালিকা হয়তো স্বয়ং ঈশ্বরও নির্ণয় করতে পারেননি। 
হলুদ জামা পরা বালিকাটার নয়ন দেখতে মায়াবী,  বিড়ালের চোখের মতো। আমি বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে সেই মায়াবী নয়নদ্বয় দেখছি। চোখাচোখি হলেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিই। বালিকাদের ঠোঁটের চেয়ে নয়ন  বেশি সংবাদ বহন করে।




বিকেল বয়ে গেলো, সন্ধ্যা। অন্ধকার।
ল্যাম্পপোস্টের আলোকে দূরের কোন আলোকবর্তিকা মনে হচ্ছে। পাশে থাকা হলুদ জামা পরা মেয়ে আমার আরো কাছে চলে আসলো, আমি ঘুরে জোরে নিশ্বাস ছাড়লে বালিকার খোলা চুলে গিয়ে পড়বে।
পাশে একটা কুকুর,  বৃষ্টির ফোটা কুকুরের গায়ে লাগছে তাই সেটা বারবার পায়ের খুব কাছে চলে আসতে চাচ্ছে  আর বালিকা এতে ভয় পাচ্ছে। জাস্ট আমার পিছনে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার, চেয়ারটা ফাঁকা পড়ে আছে অথচ কেউ ওটাতে বসছে না। সবাই হয়তো মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি মানুষের বেদনা সংবরণ করেছে। বৃষ্টি দেখে মানুষ বেদনা লুকায়, বৃষ্টি দেখে মানুষ প্রেমে পড়ে আবার বৃষ্টি দেখে মানুষ অসহ্য হয়।




বৃষ্টি থামার কোন আভাস পাচ্ছি না, একেই কি মুসলধারে বৃষ্টি বলে? হয়তো তাই। মুখ তুলে সোজা উপরে তাকালাম, পাকা ছাদ ছাড়া আর কিছু দেখলাম না। কিশোরী আমার নয়ন ফাঁকি দিতে পারেনি, রেখেছি তারে নয়নে নয়নে। একে একে লোক কমতে শুরু করলো। সর্বসাকুল্যে আট-দশজন আছি আমরা, একজন ছাতা নিয়ে এসে আরো একজনকে নিয়ে গেলো। কয়েকজন ছেলে বুকের বাটন খুলে দিয়ে ভিজতে ভিজতে চলে গেলো। বাকি আছি আমরা তিনজন, কিশোরী মোবাইল হাতে নিয়ে কারসাথে কথা বললো। একটুপর একজন রিক্সা নিয়ে এলো, আমি সবকিছু ভালোভাবে লক্ষ্য করছি। রিক্সা থেকে মধ্য বয়সী একজন লোক নামলো, কিশোরী পা বাড়ালো, চলে যাচ্ছে আমার পাশ দিয়ে। আমাকে ক্রস করে একটু সামনে গিয়ে ডানপায়ে ভর দিয়ে ঘুরে এদিকে তাকালো। চোখ দু'টো মিটমিট করে পৃথিবীর সব সংবাদ বহন করে চলছে, আমাকে চোখ চোখ পড়তেই মনে হলো তার চোখ থেকে অগ্নি বেরিয়ে এলো। পরক্ষণে অস্তনিমিত সূর্যের মতো চোখ নামিয়ে নিলো। এর মধ্যে আমার মনে দু'দফা ভূমিকম্প হয়ে গেলো। নিজেকে গাঁধা গাঁধা লাগছে। ধুর! আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। নাহ্। কিচ্ছু হবেনা। চোখ নামিয়ে চলে যাবার সময় কিশোরী বলে গেলো-"কেউ কিছু বলতে চাইলে বলতে পারে।" এই কথা শোনার পরে এমন অনুভূত হলো আমার হৃদয়ে যা পূর্বে আর কখনো হয়নি। রিক্সা চলে যেতে লাগলো, রিক্সার দূরত্ব যতো বাড়ছে আমি ততো নির্বাক হচ্ছি। এই মেয়েগুলো অদ্ভূদ হয়, একমিনিট আগে বললেই পারতো, রিক্সাটা অন্ধকারে ঢুকে গেলো, আর দেখা যাচ্ছে না। অদ্ভূদ স্বভাবের কিশোরীটা আমায় এক গামলা হতাশা দিয়ে পইপই করে চলে গেলো। কেউ একদিন তাকে কিছু বলে দিবে ঠিক আমার "কিছু" আর বলা হবে না। আমার কিছু বলাটা মাটি চাপা পড়ে গেলো রিক্সা বিলীন হবার সাথে সাথে। কিছু বলতে পারিনি, আমার কিছু বলা হয়নি। হয়তো তাকে কোনদিন কিছু বলা হবেনা। এই মনোহারিণী কিশোরী গুলো আলোড়িত হোক পৃথিবীর বাতাসে আর মুগ্ধ হোক প্রেমিকের ঠোঁটে। কিশোরীরা মুখে ফসকে বলে ফেলুক কাউকে "কিছু"। কিছ না বলা কথা ভালোবাসাময় হয়ে থাকুক পৃথিবীজুড়ে।
--------------