সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৭

সম্পাদকীয়ঃ কুয়াশা ওয়েবজিন। নভেম্বর সংখ্যা।২০১৭।


সম্পাদকীয়ঃ কুয়াশা ওয়েবজিন। নভেম্বর সংখ্যা।২০১৭।

প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করছি যে আমি সঠিক সময়ে কাজ সম্পাদন করতে না পারার জন্য। প্রতি মাসের পনেরো তারিখের আগেই কুয়াশা ওয়েবজিন প্রকাশ হয়ে থাকে। কিন্ত এবারের সংখ্যায় তার ব্যত্যয় ঘটলো। পারিবারিক কিছু সমস্যার কারনেই সঠিক সময়ে কাজ করতে পারিনি এবং কাঙ্খিত পরিমাণ লেখাও স্থান দিতে পারিনি। নিজের কর্ম ব্যস্ততাও সময়ক্ষেপণেরর জন্য দায়ী। 

দেশের সার্বিক  পরিস্থিতিতে সাহিত্য করা খুব মুশকিল। তারপরেও নিজের দায়বদ্ধতার কাছে তো আর হার মানা যায়না। মেধা হচ্ছে গোপন ক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ। মেধা ও মননকে কখনো দাবিয়ে রাখা যায়না।সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সকল পরিস্থিতি উপেক্ষা করে আমাদিগকেই এগোতে হবে। কলম ধরতে হবে। ডায়েরীতে, খাতায় লিখে রাখতে হবে - যখন যা ঘটবে। যখন মনের দ্বারে দায়িত্ব এসে উঁকি দেবে। আমরা সকল বাধা,সকল অন্যায় উপেক্ষা করে দায়িত্বশীল হতে চাই। দায়িত্ব নিয়ে কলম ধরতে চাই। রোহিঙ্গা নাম নিয়ে গ্লোবাল পলিটিক্সে যে ধূম্রজাল তৈরী হয়েছে সেটাকে পরিস্কার করার দায়িত্ব আমাদের। সহিত্যকে সঠিক জায়গায় নিতে হবে। কোন প্রকার কলুষতা সাহিত্যকে আঁচড়াতে পারবেনা। 

হে যুবক,হে কলম সৈনিক !  কেউ কি বেঁধে রাখতে পেরেছে মানুষকে - মানুষের জালে! অথচ আমরা কিছুটা হলেও আটকা পড়ে আছি। এটা পরিস্কার যে মানবতাকে ভূ- লুন্ঠিত করেছে সূচি নামক নরখাদক। এটা আমাদের সভ্যতাকে আঘাত করেছে। আমাদের ইগোতে আঘাত করেছে। এটাই সঠিক সময়, জাগবার এবং জাগাবার। এটাই সঠিক সময় চোখ মেলে তাকাবার। জাহেলিয়াত বলে যে সভ্যতাকে মানুষ চেনে সেই সভ্যতাকেও টপকে চলে গেছে এই মায়ানমার। ৫০০ হিজরীতে যা - না ঘটেছে এই মায়ানমার তা ঘটিয়েছে। সভ্যতার চরম মৃত্যু ঘটিয়েছে। প্রত্যেক সমাজের দাবি,প্রত্যেক মানুষের দাবি রক্তের প্রতিশোধ নেয়া উচিত। 

আমরা ধন্য যে এমন কুসভ্যতাকে নিয়ে বহু সাহিত্য হয়েছে,কবিতা হয়েছে, গল্প হয়েছে। মিডিয়ারাও সোচ্ছার ছিলো - দেশি বিদেশী গবেষক,কবি, সাহিত্যিকদের লেখা সঠিক সময়ে তারা পত্রিকায় ছেপেছেন। আমার " কুয়াশা ওয়েবজিন,, তারই বহিঃপ্রকাশ স্বরুপ। সাহিত্যের প্রথম কথাই হলো মানুষ, মানবতা,সভ্যতা - যা কিনা মানু্ষের কল্যাণে।

সূচিপত্রঃ কুয়াশা ওয়েবজিন। নভেম্বর সংখ্যা।২০১৭।

সূচিপত্রঃ কুয়াশা ওয়েবজিন। নভেম্বর সংখ্যা।২০১৭।

উপন্যাসঃ
স্বপ্ন ও শেষ অধ্যায় ।। তৈমুর মল্লিক

কবিতাঃ
২০ শে নভেম্বর, সন্ধ্যা ।। জয় গোস্বামী
মেঘের নদী ।। মহাদেব সাহা
পিপাসার্ত ঢেউ ।। মুহাম্মদ নূরুল হুদা
পথ ।। নভেরা হোসেন

গল্পঃ
প্রকৃতজন ।। রওশন রুবি
আমাদের সাদা ঘোড়া ।। নীলিমা নিগার

কবিতাঃ
কবির প্রতি ।। আহমেদ মুনীর
হারিয়ে গেলো ।। শ্রীলেখা চ্যাটার্জি
আবার ঘরে দাঁড়াবো ।। দ্বীপ সরকার
চেষ্টা করব ।। হরিৎ বন্দোপাধ্যায়
চৈতি হাওয়ার চোখ ।। নাসির ওয়াদেন
অবিশ্বাসীর নিভৃতে ।। মায়িশা তাসনিম ইসলাম

অণুগল্পঃ
বর্ষীতে মাছ ধরার ইচ্ছেও ফুরিয়ে গেছে ।। শিহাব আহমাদ
সরি ।। এলিজা আজাদ

কবিতাঃ
১২ বছর আগে ।। আদিত্য পিয়াস
চিঠি- ৩ ।। শামশাম তাজিল
মেঘালো চোখ ।। শামীমা সিমা
যুদ্ধবাজ ।। সুনীতি দেবনাথ
আবিস্কার ।। সিদ্দিক প্রামাণিক
সেই বেলা ।। রায়ান নুর
মহোৎসব ।। কৃপা আচার্য
মৃণ্ময়ী ।। ইয়ার ইগনিয়াস
কে যায় গাঁয়ের পথ বেয়ে ।। আব্দুল্লাহ আল মারুফ
সূর্যোদয়ের পূর্বের শীতের সকাল ।। কে এম বায়েজিদ
সার্থক ভালোবাসা টক ঝাল মিষ্টি ।। বাদল মেহেদী

ছড়াঃ
মা ।। হামিদ হোসাইন মাহদী
কোন্দল ।। বিচিত্র কুমার

স্বপ্ন ও শেষ অধ্যায় ।। তৈমুর মল্লিক

স্বপ্ন ও শেষ অধ্যায় 
                     (খণ্ড ৪) 
 
তোমরা সবাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করো। অথচ তোমাদের দেখলে একরাশ নিরাশা ভর করে । তোমাদের মধ্যে মায়া মমতা মানবতা ভালবাসা এতটাই কম যে ধীরে ধীরে সমাজ ব্যাবস্থা কোথায় চলেছে সেটা অনুমান করলেই ভয় লাগে । শালীনতা, ভদ্রতা, নম্রতা , ত্যাগের সংকল্প কেমন যেন ফিকে হতে চলেছে । তোমরা কেন আজ একে অপরের কাছ থেকে এত দূরে চলে যাচ্ছ? 
তোমাদেরকে ক্যাম্পাসে চলাচল করতে দেখলে মনে হয় আমরা সেই যুগে চলে গেছি, যেই যুগে ছোট ছোট গোত্রে বিভক্ত ছিল সম্পুর্ন সমাজ ব্যাবস্থা। 
সভ্যতার কল্যাণে বিজ্ঞানের কল্যাণে একটা সময় আমরা এক হয়েছি। কিন্তু আজ অতি আধুনিক সমাজ ব্যাবস্থা আমাদেরকে সেই গোত্রে বিভক্ত করে ফেলছে । কিন্তু কেন? 
বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি পরিচিত এবং সকলের প্রিয় রফিক স্যার কথা গুলি অতি উৎকণ্ঠা নিয়ে ছাত্র ছাত্রিদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন।
আসতে পারি স্যার?
এসো। তোমরা এত দেরি করলে কেন? 
দুঃখিত স্যার। 
এর চেয়ে বেশি কিছু না বলে রুমি, রিনি আর বিথি যার যার স্থানে বসে পড়লো।
হাঁ যা বলছিলাম। রফিক স্যার আবার বলতে শুরু করলেন। 
রফিক স্যার পড়াচ্ছেন ঠিক কিন্তু তার চোখ খুঁজে ফিরছে একজনকে । ভালো করে এদিক ওদিক দৃষ্টি দিয়েও সে তাকে খুঁজে পায়না । ছাত্রটির নাম সাগর । রফিক স্যারের খুব প্রিয় একজন ছাত্র । স্যরা কাউকে বুঝতে না দিয়ে তার পাঠদান চালিয়ে যেতে থাকেন । 
কতটা নির্লজ্জ আমারা হয়েগেছি যে -
ভুলে গেছি আমরা কে কোথা থেকে এসেছি। আমরা ভুলে গেছি, আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব একটা সত্ত্বা আছে। আমরা ভুলে গেছি আমাদের প্রত্যেকের বাবা-মা আছে। আমরা ভুলে গেছি আমরা একটা সামাজিক বলয়ের মধ্যে বাস করি। ভুলে গেছি আমাদের যে কোন ভাল কাজের জন্য আমরা নিজেরা যতটা খুশি হয়ে থাকি, তার চেয়ে অনেক বেশি সম্মানিত হন আমাদের বাবা মা। ঠিক একি ভাবে মন্দ কাজের জন্য বাবা-মা হন যার পরনেই অসম্মানিত। যাদের বাবা মা নেই তারা যে আমাদের কর্মের ফল কবরে গিয়ে পেয়ে থাকে, মুসলমান হিসাবে আমাদের সেটা বিশ্বাস করতে হবে। রফিক স্যার ক্লাসে সবার উদ্দেশ্যে এই কথাগুলো বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। 
এভাবেই চলতে থাকে পাঠদান । 

২০ শে নভেম্বর, সন্ধ্যা ।। জয় গোস্বামী















২০শে নভেম্বর, সন্ধ্যা

তোমার সঙ্গে ঘুমোবো আজ
মাটিতে হোক, আগুনে হোক, জলে
যেখানে বলো ঘুমোবো আজ
যেখানি পারি জায়গা করে নেবো
এখন আমার হুঁশ নেই আর
কোন কালীর দিব্যি
ভালো মন্দ চুলোয় যাক গে
মোদ্দা কথা শোনো---
তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না

মেঘের নদী ।। মহাদেব সাহা

















মেঘের নদী

আকাশে ওই
মেঘের ভরা নদী---
নীল সরোবর
বইছে নিরবদি;
আকাশে মেঘ
স্নিগ্ধ জলাশয়
আজ জীবনে
কেবল দুঃসময়;

আকাশে ওই
স্বর্ণচাঁপার বন,
দূর পাহাড়ে
মেঘের সিংহাসন;

নদীর তলায়
চাদের বাড়িঘর
একলা কাদে
বিরহী অন্তর।

আকাশে ওই
পাখির ডাকঘর
ভালোবাসায়
জড়ায় পরস্পর;

জলের বুকে
চাঁদের ছায়া পড়ে
ডাক শুনি কার
বাহিরে অন্তরে;

আকাশে মেঘ
অথই জলাশয়
এবার গেলে
ফিরব না নিশ্চয়।

পিপাসার্ত ঢেউ ।। মুহাম্মদ নূরুল হুদা

















পিপাসার্ত ঢেউ

দূরের দুয়ারে জেগে একাকী দুজন
বাহুতে রেখেছি বাহু, বাহুর কুজন।
যত তুমি দূরে যাও, তত কাছে আসো
ধরার অধরা হয়ে মন টিপে হাসো।
যুক্ত হই মুক্ত হই আপনা কয়েদি,
অর্ধ-মিল সিদ্ধ যদি হে দিলদরদী।
কানুর বাঁশিতে ঝরে বেদনার হীরে,
মুখোমুখি দুই দুখী যমুনার তীরে।
বেহুলার হাতে কাঁদে বেহাল বেহালা;
জাগে না লখাই আর, দেহে তার তালা।
আমার ভেতরে তবু তোমার শানাই,
আমাকে বানাই তাই তোমার কানাই।
পাশাপাশি বয়ে যাই, কারো নই কেউ;
আমরা তৃষ্ণার জল, পিপাসার্ত ঢেউ।

পথ ।। নভেরা হোসেন








পথ

একটা আঁকা-বাঁকা পথ 
দূরে নির্জন বনভূমি 
সভত্যা এখানে নিশ্চুপ
সারা রাত মহুয়ার গন্ধ 
সারি সারি বৃক্ষ অপেক্ষায় দিন গোনে 
আচমকা চমকে ওঠে কুড়ালের শব্দে
বড় বড় যন্ত্র আসে 
বৃক্ষের বুক বিদীর্ণ করে বানাতে বসতভূমি 
লোকালয় ক্রমশ খাড়া হয়ে ঢোকে বনভূমে
বনও সরে যেতে যেতে নদীতে এসে মাথা ঠুকে 
আর কত সংকুচিত হবে সে 
আর কত বলি দেবে সবুজ বৃক্ষ 
এর পর শুধু পুস্তকে লেখা থাকবে 
এখানে একজন বন শায়িত আছেন 
তার কবরে ফুল দেয়ার জন্য 
কোনো মানুষও জীবিত নেই আর

গল্পঃ প্রকৃতজন ।। রওশন রুবি

প্রকৃতজন


জানালা দিয়ে বিকেলের শীতল আলো আসছে । আজ অনেক মন খারাপ আসাদের। মামা মোশাররফ খসরু তাকে দেখে অবাক হয়নি। যেন জানতো সে আসবে। এমন পরিস্থিতিতে আসাদ অস্বস্তিতে ভোগে। তিনি জেগে ওঠায় সালাম দিয়ে কেমন আছেন জানতে চাইলে সেই উত্তর না দিয়ে বললো
-  খেয়েছো? তোমার চাকরি কেমন লাগছে? অন্য কোথাও চেষ্টা করা ছেড়ে দিয়েছো নাকি? 
-  জ্বি খেয়েছি। কলেজের জন্য নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়েছি।
রেজাল্ট বেরুনোর অপেক্ষায়। 
-  গুড। চেষ্টা করে যাও। প্রায়োজন হলে বলবে।অবশ্য প্রাইমারি স্কুলের প্রতি সরকারের এখন নেকনজর পড়েছে। বেতন স্কেলও ভালো দিচ্ছে। কোথাও চাকরি না পেলে পড়ে থাক। তোমার বড় আব্বার সাথে জমিজমা ঝামেলা মিটমাট হয়েছে?
-  না। এখনও কোন সুরাহা হয়নি। 
-  কি বলতে চাইছেন তিনি?
-   তিনি বলছেন ঘরের ভিটে আর বাগানগুলো মা তার কাছে বিক্রি করে টাকা নিয়েছে। তখন তিনি রেজিষ্ট্রি করে নেননি পরে নিবে বলেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে মা তাকে আর পাত্তা দেন নাই। এখন আমাকে সব লিখে দিতে হবে। এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে মামলা করবে।
-   গাছে আর মাছে মিথ্যে কথা। তোমার মা তাদের থেকে কোন সহানুভূতিই পায় নাই। উপযুক্ত প্রমাণ না দেখাতে পারলে এই মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। রায়ে তুমিই জয়ী হবে। আর জমিগুলো তো সব তোমার মায়ের নামে নয়। তোমার বাবারও আছে। তোমার বাবারগুলো কি তোমার মা বিক্রি করতে পারতো? তাদের কথা অনুযায়ী তোমার বাবার গুলোও তোমার মায়ের। এরা মিত্থুক। তোমারে একা পেয়ে জুলুম করছে সব চুষে নেবার জন্য। তোমার বাবার অনেক জমিজমা ছিলো। সেগুলোর কি করেছে না করেছে আল্লাহ্ জানে। তিনি তো বলবার সময় ও পায়নি কোথায় কি আছে না আছে। তার নিরুদ্দেশ যাত্রা শেষ হতে না হতেই তিনি চলে গেলেন। কে জানতো নিরুদ্দেশ থেকে ফিরে এলেন একেবারে চলে যাবার জন্য। তোমার ফুফুদের সাথে যোগাযোগ রেখো। একবার ভূমি অফিসে গিয়ে খোঁজ নিও। টাকা পয়সা খরচ হলেও দলিল পত্রগুলো তুলে নিও। বাড়ির পূবঘরের তোমার আমানত দাদার থেকে সঠিক তথ্য পাবে। লোকটার মধ্যে জালিয়াতি নেই। তার থেকে কিছু জেনে নিতে চেষ্টা করিও।
-  এখন আমার কি করা উচিত মামলার বিষয়ে মামা?
-  সে বিষয়ে অবশ্যই  চুপচাপ থাকা উচিত। যদি তারা আইনি ব্যবস্থা নেয় তখন মনোবল না হারিয়ে পদক্ষেপ নিবে। আর যদি জোর জবরদস্তি করে নেয়  তখনও লড়তে হবে। দেশের প্রচলিত আইন ন্যায়ের পক্ষে থাকবে। সেরকম কিছু হলে তুমি পূরবীর সাথে যোগাযোগ করবে সে সিভিলের ল'ইয়ার। হাই কোর্টে আছে জানো তো?
-  জ্বি মামা।
পূরবী আসাদের বড় মামার বড় মেয়ে। ছ'বছরেরর বড় আসাদ থেকে। প্রতি শীতে স্কুল ছুটিতে মামা ওদের নিয়ে গ্রামে বেড়াতে আসতো। নিজের বাড়ি, বোনদের বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন তিনি ছেলে মেয়েদের নিয়ে। বড় মুরগি, রাজহাঁসটি, পুকুরের রোয়া উঠা রুই, শোল, কাতলা মাছ তোলা হতো এবং রাতে রান্না করে রাখলে সকালে সর পড়া মাছ তরকারি দিয়ে ধোঁয়া উঠা গরম ভাত খেয়ে  মোশাররফ খসরু পরিতৃপ্তিতে ঢেকুর তুলতেন আর ডান হাত দিয়ে ভরা পেটে হাত বুলাতেন যা দেখলে রাঁধুনির চোখ জুড়িয়ে যেত। তারা বেণুকা খালার বাসায় এলেই দেখা হতো ওদের সাথে। আসাদের বাবা নিরুদ্দেশের পর, যখন কাকারা আসাদের মা ও আসাদকে বের করে দিলো। তখন কেউ নয় আসাদের বেণুকা খালাই তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলো। বড় মামী এবং মামাতো ভাই বোনেরা  ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। ওরা আসাদকে খুব ভালোবাসতো। আসাদ ও তার মাকে ওদের বাসায় যেতে অনুরোধ করতো। আসাদের জন্য খেলার অনেক কিছু ও নতুন জামাকাপড় নিয়ে আসতো। মামা আসাদকে নিজের কাছে বসিয়ে নলা তুলে খাওয়াতো।  সব সময় পূরবী আপা ও নীলা আপা আসাদের জন্য হরেক রকমের চকলেট আনতো। সানি ও সকিল ভাই টেনিস বল, ক্রিকেট বল, ব্যাডমিন্টন , অনেক গল্পের বই নিয়ে আসতো। বলতো স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তোমার জন্য কিনেছি। ওরা সবাইকে তুমি করেই ডাকে আসাদকেও তুমি করে ডাকতো। অনেকবার আসাদ ওদের বাসায় গিয়েছে। ওর মায়ের সাথে কখনও, কখনও বড় মামার সাথে। যে কয়দিন শহরে থাকতো বড় মামী কত রকমারি মুখরোচক খাবার রান্না করতো। বেণুকা খালার সাথে কিছু মিলতো কিছু মিলতো না। পাঁচ খালা ও দুই মামার মধ্যে আসাদের কাছে বেণুকা খালা, তার মা ও বড় মামাকে একই ছাঁচে তৈরি মনে হয়। অন্যরা ভীষণ আল্লাহ্ ভক্ত হলেও। অথচ গরিব আত্মীয়কে গরীব বলে দূরে ঠেলে রাখতেও কুন্ঠা বোধ করে না বরং আনন্দিত হয় একবার বেণুকা খালার দাওয়াতে সব বোন এবং ভাইয়েরা এলো। মেঝখালা আসার সময় সবার জন্য আলাদা ভাবে প্রবাস থেকে পাঠানো শ্যাম্পু, সাবান, কফিগুড়ো আনলো। সবাইকে ভাগ করেও দিলো কিন্তু কিছুই আসাদকে দেবার কথা ভাবলো না। আসাদের মায়ের সামনে পড়ে যাওয়ায় বললো
- আপনাদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আপা। পরে কিছু পাঠিয়ে দিবো। সেই পর আর কখনও হয়নি। মায়ের চোখ ছিল সেদিন নির্লিপ্ত। ঠোঁটে ছিল স্মিত হাসি। যা দেখে তার বেদনা ছুঁতে পারেনি তার পাষাণ বোন। কিন্তু রাতে যখন ছেলের ঘুমন্ত মাথা বুকে জড়িয়ে ডুকরে উঠেছিলেন ঘুম ভাঙা ছেলেটি ঠিক মায়ের সে ব্যথা বুঝতে পেরেছিলো। যা আজও দুখিনী মায়ের মুখের দিকে তাকালে বা দূরে থাকলে সেই শ্রেষ্ঠ মুখ মনে পড়লে ব্যথায় মুচড়ে উঠে বুক। 
    
       খসরু মামা কথা বলতে বলতে সেই যে ঘুমিয়েছেন আর উঠেন নি। এখন সন্ধ্যে ছ'টা পঁচিশ। সুশ্রী একজন নার্স এলেন । খুব মোলায়েম তার চলা। যেন মোমের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মোমের পুতুল। ওর চামড়া উপর দিয়ে ভেতরের রন্ধ্রের মধ্যে রক্ত চলাচলও দেখা যায় । আসাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সেই বিকেল বেলায় হাসান মামা আবার আসবো বলে চলে গেছে আর আসেনি। হাসান মামা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আসাদের মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধু । আসাদের একটু বাইরে যাবার ছিলো তবুও যেতে পারেনি। খসরু মামাকে একা ফেলে যায় কি করে? হাসান আলীই একদিন আসাদের বাবাকে খুঁজে পেয়ে নিয়ে এসেছিলো। তিনি সিলেট গিয়েছিলেন ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত দেখতে মাধবকুন্ডে গিয়েছিলেন। সেখানে একজন লোকের ধাক্কায় পড়ে গেলেন স্রোতের মধ্যে। নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটির দিকে রাগাম্বিত চোখে তাকিয়েই রাগ পড়ে গেল। কারণ লোকটি একজন পাগল। হাসান আলীকে ফেলে দিতে পেরে হলুদ দুখানি দাঁতে কালো হয়ে যাওয়া উপরের পাটির সামনের চারটি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে হি হি করে হাসছে আর বলছে 
-  হি হি হি! ফাইলে দেইলুম। ফাইলে দেইলুম। আমাকে যে ফাইলে দেইলু। মর! মর! মর ! হি হি হি ...... হাসান আলী স্রোত থেকে উঠে আর পাগলকে দেখতে পেলেন না। তিনি ভেজা কাপড় নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে চলে আসবার জন্য সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে প্রবেশ মুখর কাছে এলে দেখলেন পাগল এক পানদোকানের নিচ থেকে পানের বোঁটা, পরিত্যক্ত কাগজ ইত্যাদি তুলে তার ব্যাগে রাখছে। দু'জন লোক পান কিনতে এলে একজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলা আবার হি হি হি করে হাসছে আর ঐ বাক্যগুলো বলছে। দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি যা যা, দূরহ্! দূরহ্! পাগল বলে পাগলকে তাড়িয়ে দিলে পাগল তার ধূলোবালি জমে থাকা নোংরা মোটা কালো দুটি বুড়ো আঙ্গুল তুলে বলে -  কেইচু কেইচু কইরতে পেরবি আনেস। কি মেইজা! কি মেইজে! তুই মর মর মর আনেস। হি হি হি .... নামটা খুব পরিচিত এবং পাগলের মুখে নামটি শুনে ওদের রেখে কিছু সামনে এগিয়ে আসা হাসান আলী ফিরে ভালো ভাবে মুখটি দেখে। নোংরা কালো মুখটি তার তখন চেনা লাগে। সে সেখানের প্রশাসনিক সহায়তা নিয়ে পাগলকে পাবনা পাগলা গারদে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সেখানে দীর্ঘ সময় চিকিৎসার ফলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। এবং একদিন হাসান আলী তাকে মোশাররফ খসরুসহ আসাদের বেণুকা খালার বাড়ি নিয়ে আসেন। আসাদের বাবার আগমনে প্রতিটি মানুষ খুশি হলেও আসাদের বড় আব্বা খুশি হয়নি। মৃত্যুর আগে আসাদ ও তার মাকে বলে গেছেন আসাদের বাবা -  ও আইমারি লোইকজেন দেইয়ে মাইরে পাড়োর নেইচে ফাইলে দেইছে। 
আসাদের বড় আব্বা এইসব কথা পাগলের প্রলাপ বলে উড়ি দিয়েছে। আসাদরা আর্থিক ও সামাজিক দূর্বলতার কারণেই বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে পারেনি। নার্স তার কর্তব্য পালন করতে করতে ডাক্তার বিমল সাহা এলেন। বহুবছর আগে মামার বাসায় তাকে দেখেছিল আসাদ। তখন থেকে এখন অনেক বদলেছে। তখন ছিল সদ্য পাশ করা ডাক্তার। দৃষ্টি ও স্মরণ শক্তি  তীক্ষ্মতা দেখে অবাক আসাদ। তাকে দেখেই চিনতে পারে এবং জানতে চায়
-  কি মোবারক কেমন আছো? অনেক বড় হয়ে গেছো? আসাদের অন্য নাম মোবারক হোসেন। ঠিক মনে রেখেছেন তা। 
-  জ্বি, ভালো মামা। আপনি?
-  আর আমাদের থাকা.....
খসরু মামা এর মধ্যে উঠে পড়েছেন। হাসান আলীও এলেন তিন বন্ধুকে রেখে আসাদ ব্যলকনিতে দাঁড়ালো।

তিন বন্ধুর গল্পের ভেতর পূরবী আপা, সানি ও সাকিল ভাই এলো। রাত বাড়তেই একে একে সবাই চলে গেছে আসাদ ও মোশাররফ খসরুকে রেখে। ওদের যাবার ভঙি এরকম ছিল " আচ্ছা  থাক। আমরা কাল আসবো।" আসাদ আশ্চার্য হয়েছে। ওদের বাবা; ওরা এভাবে আসাদের ভরসায় ফেলে চলে গেলো? যদি আসাদ না আসতো তবে কে থাকতো মামার কাছে? শহরে থাকতে থাকতে মানুষগুলো কেমন যান্ত্রিক ও বোধহীন হয়ে পড়ে। খুব অবাক হয় আসাদ। গ্রাম্য জীবনে সম্পর্কের প্রতি সম্পর্কের যে সম্মান বোধের শীতলতা তা আসাদকে গভীর ভাবে নাড়া দেয়। সে রুমের পাশে ছোট ব্যালকনিতে গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। আকাশ দেখা যায় না অসংখ্য হলুদ লাইটের তীব্র ছটায় । যেখানে আকাশ দেখা যায় না, ঘাস, মাটি স্পর্শ পায়না মানুষ। পাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙে না। পাখিদের ঘরে ফেরা ডানার মিহি শব্দ গাঁথেনা প্রাণে। ভাটিয়ালি, রাখালিয়া যান্ত্রিক বাক্সে বেজে চলেছে সেখানকার মানুষদের দিনে দিনে ক্ষয়িষ্ণু হয় বোধ। মায়ামমতা এরা কিনে নেয় টাকার বদলে। হায়রে দুনিয়া ! হলুদ লাইট জুড়ে উড়ছে অজস্র পোকা। লাইটগুলোকে আকাশের অনুজ্জ্বল তারা মনে হয়। যেন নেমে এসেছে দলবেঁধে তারারা এই শহরে। দীপাবলির আলো যেমন দোলায় রাতের উর্ধ্ব আবরণ। মনে হয় এই আলো রাতের অন্ধকারকে ছিন্ন ভিন্ন করে তেমনি দীপাবলীর আনন্দে স্বেচ্ছায় জেগে থাকা কিশোর কিশোরীদের পরিতৃপ্ত আত্মার অবিকল নৃত্য করে। সেই নৃত্যের রেশ লেগে থাকে চোখে ও মনে। প্রায় অবলুপ্ত  মাটির গন্ধ শুঁকে শুঁকে তবু যেন কতো কতো লোক ছুটে যায় মধ্যবিত্তের আঙ্গিনার দিকে । কতো কতো লোক ছোটে নিন্ম আয়ে জোড়া সংসারের দিকে। খুব কম সংখ্যকই খুঁজে পায় অট্টালিকার উদ্ভিদের মাটি ছাড়া মাটির গন্ধ। সেখানেও আজকাল মিশে যাচ্ছে অজৈব উপাদান। বেঁচে থাকার তাগিদে তবু যে যেখানে, যে যেমন তেমনি বেঁচে থাকা শিখে যায়। প্রথম খাদ্য গ্রহণ কেউ যেমন শেখায়না। শিশু অনুসন্ধান করে নিকটজন সহৌযোগিতা করে তেমনি বেঁচে থাকাও যার যার তার তার।  কার্তিকের শুরু থেকে যে-বোষ্টমীপরিবার করতাল বাজিয়ে ঘুম ভাসিয়ে নিয়ে যেতো কাকভোরে 
ভুলতে পারেনি তাদের আসাদ । আজও তাই নিদ্রাহীন রাতের কোলে শুয়ে ওদের কথা কেন যেন খুব মনে পড়ে। অনিতা বোষ্টমির গলাটা ঘুমের গহ্বর থেকে তুলে আনতো চৈতন্যকে। জেগে উঠতো আসাদ। জানালা খুলে কার্তিকের ঘুমভাঙা প্রকৃতিকে দেখে মুগ্ধ হতো
যাপিত স্বপ্নে সমারোহে বিভোর হয়ে থাকা ছাড়া আর কিইবা করার আছে। গ্রামে বা শহরে কোথাও বোষ্টমিদের এখন সাক্ষাত পাওয়া যায় না তেমন। ব্যস্ত জীবনের চোরা স্রোতে অজান্তেই ভেসে যায় কতো জীবনতরী। তারাও হয়তো তাদের মতো শিখে গেছে বেঁচে থাকা। 

মাথার কাছে রাখা মোবাইল ফোনের কাঁপুনিতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখলো রাত দেড়টা বাজে। ঘুম জড়ানো গলায়
-   হ্যালো! বলতে বলতে ব্যালকনিতে চলে গেলো আসাদ। আড় চোখে দেখে নিলো মামা টের পেয়েছে কিনা। না তিনি ঘুমচ্ছেন। 
-  আমি  আরিফ রেহমান। ঘুমিয়ে পড়েছিস না? ভেবেছিলাম লিখছিস। তাই ফোন কলাম। দোস্ত জরুরী কথা আছে তুই আমার সাথে একটু কথা বলতে পারবি? 
-  পারবো। চাইলে দেখাও করতে পারি। 
-  মানে কি দাঁড়ায়! তুই এখন এই শহরে?
-  হুম। গতকাল থেকে । বড় মামা স্টোক করেছে।  
- থাকবি ক'দিন।
-  কাল পর্যন্ত।
-  দেখা না করে চলে যাবি না।
-   016189510.. এই নাম্বারে ফোন করিস। যেটায় কথা বলছি ওটা দিনে বন্ধ থাকে।
- ওকে। 
-  মামা এখন কেমন আছে?
-   ভালো।
-   তাকে দেখতে যাবো। তবে বলতে পারছিনা কখন। অফিসে গেলে বুঝবো। তোর সাথে দেখা ওখানেও হয়ে যেত পারে।
-   ঠিক আছে। ফোন দিস্।
-  তবে এখন রাখ। মামা জেগে উঠতে পারে। কাল সব ঠিক করে নিবো। গুড নাইট।
-  ভালো থাকিস। গুড নাইট।
রাতেই আরেক জন ফোন দিয়ে জানালো তিনি জ্বীন জাতি। ঘুমের ঘোরে শুয়ে শুয়ে নিচু স্বরে আসাদ বললো "হু" তারপর বিভিন্ন হেদায়েত দেয়ার চেষ্টা করলো। ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জদের নামাজ পড়তে বললো। খুব সরুগলায় দু'চারটা প্রশ্ন করলো আসাদ তাকে। উত্তর দিতে পারলোনা। অপ্রয়োজনীয় ফোনে ঘুম ভেঙে গেলো। আর ঘুম এলো না। খুব ভোরে কাকের ডাকাডাকি তে বুঝলো গভীর রাতের শান্ত ঢাকা শহর জেগে উঠেছে। আসাদ বিছানা ছেড়ে ভোরের হাওয়া মেখে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো। কী শীতল শান্ত লাগছে সব কিছু। আশ্চার্য আধাঘন্টা পেরুতে না পেরুতে চোখের সামনের দৃশ্যগুলো বদলে গেলো। আসাদ প্রাত কাজ শেষ করে এক গ্লাস পানি খেলো। সকালে খালি পেটে পানি খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। ছোট থেকেই আসাদের মা অভ্যাসটা করিয়েছে। সকালে নার্স এসে মামার প্রাতঔষধের নিয়মাবলী সারলে মামাকে কিছুক্ষণ একা রেখে আসাদ নিচে নামলেন। নাস্তা করে উপরে উঠে দেখলেন নীলা আপা এসেছে। তিনি মোশাররফ খসরুকে খাওয়াচ্ছেন। আসাদকে দেখে বললেন 
-   কেমন আছো?
-  জ্বি ভালো। আপনি?
-  বাবা অসুস্থ থাকলে মেয়েরা যেমন থাকে তেমন।
- ওখানে তোমার নাস্তা আছে খেয়ে নাও।
-  আমি খেয়েছি।
-  শুনো আসাদ বাবাকে ওভাবে একা ফেলে নিচে যাবে না। আমার বাসায় থাকার প্রবলেম। খুব ছোট ছোট তিনটে রুমে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকছি তাই বাসা বদল করার আগে আমার কাছে রাখতে পারবো না বাবাকে। বড় আপার শশুর শাশুড়ি দুজনে তাদের কাছে থাকে এবং দুজনেই খুব অসুস্থ তার উপর ওর বড় ছেলেটা অটিস্টিক। নিজে নিজে খেতে পর্যন্ত পারে না। ছোট মেয়েটার বয়স তিন বছর। ধরতে গেলে চারজনই শিশু। এ অবস্থায় বাবাকে সেও টেককেয়ার করতে পারবে বলে মনে হয়না। বাবার যে কন্ডিশন তাতে ওনাকে একা ও রাখা ঠিক নয়। উভয় সঙ্কটে পড়েছি। তুমি কি কিছু দিন বাবার কাছে থাকতে পারবে? 
আসাদ বুঝতে পারে না নীলা আপার মাথায় গন্ডগোল আছে কিনা। যদি গন্ডোগোল না থাকে তবে কি করে একজন অসুস্থ মানুষের সামনে এই সব কথাবার্তা বলে মানুষটার মন ভেঙে দিচ্ছে? যেখানে তাকে টেনশান মুক্ত রাখা জরুরী। সেখানে আরো টেনশান চাপিয়ে দেয়ার মতো নিঠুরতা? তাছাড়া আসাদ একজন সরকারি চাকরিজীবী। তার তিনদিন ছুটি শেষে সে ওপেনিং ডে তে তো কর্মস্থলে থাকতে হবে। তারপর হয়তো তিনদিনের ছুটি নিয়ে আবার আসতে পারে। কিন্তু এরা তো পুরোই আসাদের উপর ঢিল ছুঁড়ে বসে আছে। এরা তো মনুষত্ব হারাতে হারাতে এমন হয়েছে যে অন্যের সমস্যা থাকতে পারে তা ভাবতেই পারেনা। এই এদের সাথে শৈশবে দেখা এদের কোন মিল নেই। কেন এতোটা দ্রুত মানুষ বদলে যায়?
পনেরো মিনিট আরো থেকে তিনি চলে গেলেন। সেই থেকে ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে অাসাদ।
আরিফ রেহমানের ফোন আসার কথা। এলো না। তাই টেনশান হচ্ছে আসাদের। কি বলতে চাইলো? কি জরুরী কথা ছিলো? ওর অফিসে যেতে হবে, নাকি যেতে হবে না ? ও কি আদো আসবে? ভাবতে ভাবতেই ফোন তুলে নিলো আসাদ।

গল্পঃ আমাদের সাদা ঘোড়া ।। নীলিমা নিগার






আমাদের সাদা ঘোড়া



সকাল বেলা থেকেই নীলের মা ভীষন ব্যস্ত।নাস্তা তৈরি করছে অনেক কিছু।সুজির হালুয়া,পরোটা,ডিমপোচ, আলু ভাজি,নিরামিশ,চালের রুটি,সেমাই,গরুর মাংস ভূনা, মুরগীর ঝোল এইসব।এক হাতেই তার সব করতে হয়।বেগম নামে একটি মেয়ে আছে,সেও তাকে সাহায্য করে সকল কাজে।এদিকে অনেক আয়োজন।তার মামা শ্বশুর এসেছে গতকাল বাড়িতে।প্রায় একমাস অবধী থাকবেন।তিনি অচল মানুষ।ছোটবেলায় তার জ্বর হয়েছিল,সেই থেকে তার দুটো পা অবশ হয়ে গেছে। সেই থেকে আর চলাফেরা করতে পারেনা।কোন রকম লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটে।অনেক চিকিৎসা করা হইছে,কিন্তু লাভ হয়নি।এদিকে সংসারের সকল দায় দায়িত্ব তার বধূই পালন করে থাকে।তার পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে।অনেক বড় সংসার।এরপর থেকে তিনি চলাফেরা করার জন্য ঘোড়া কিনে নিলেন।সাথে সহিস সবসময় থাকত।হাটে যেতেন,এইপাড়া,ওইপাড়ায় যেতেন ঘোড়ায় চড়েই।ঘরে বসে তিনি গড়গড়া টানেন।পিতলের লম্বা কলসীর মতো, তার সাথে
লম্বা পাইপযুক্ত।
মতিদাদু বাসায় বেশির ভাগ সময় বসে বসেই জাল বুনতেন,আর পান খেতেন।তিনি বিশাল জমিজমার মালিক।সারাদিন অনেক বর্গাদার আসেন,তাদের সাথে জমিজমার খোঁজ খবর
নেন আর পান খান।মনের আনন্দে খোঁশ গল্প
করতে থাকেন।তার টাকা পয়সার অভাব নেই।
ছোট ছেলে সুলতান সবসময় বাবার কাছে কাছে
থাকে।ওকে তিনি খুব ভালোবাসেন,যেখানেই
যান,সুলতানকে সাথে করে নিয়ে যান।
মাঝে মাঝে তার আবার শহরতলীতে তার বড় ভাগিনা আব্দুল লতিফের বাসায় বেড়াতে আসেন।মতিদাদুরা একভাই একবোন।তার
বোনের নাম শাবান।দেখতে অসম্ভব সুন্দরী।শাবানের চাঁদে হয়েছেন,তাই বাবা / মা
এই নাম রাখেন।দুই ভাইবোনের আবার খুব মিল মহব্বত। একজন আর একজনকে না দেখে থাকতে পারেন না।তাই মাঝে মাঝে একে অপরের বাড়িতে ঘুরে আসেন।সারাদিন দুইভাইবোন গল্পগুজব করেন,আর নামাজকালাম,দোয়াদরুদ পড়েন।
নীলের এই দাদুভাইটার নাম মতি।
গ্রামের লোকজন সবসুদ্ধ তাকে ডাকে লেংড়ামতি।তিনি আবার অনেক ধনবান।নিজ বাড়িতে একটা মসজিদও করেছেন।
ঈমাম সাহেব বাড়িতেই থাকেন।কাচারিঘরে সবসময় মেহমান,অতিথি লেগেই থাকত।বাড়ি ভর্তি কামলা আর জায়গির বসবাস। সবসময় ব্যস্ততা।একের পর এক ফসল আসতেই থাকে।কখনও ধান,কখনও গম,কখনও আখ,সরিষা,তিল এইসব।বাড়িতে হাঁস,মমুরগী,কবুতর,ছাগল,গরুর অভাব নেই।এছাড়া পাড়ার মাতব্বর ও তিনি ছিলেন।সকল সমস্যা,বিপদআপদে সবাই তার কাছেই ছুটে আসে।তিনি বিচক্ষন ভাবে সবসময় তাহা সমাধা করেন।সকলেই তার রায় একবাক্যে মেনে নেন,আর কোন দ্বিমত পোষন করেন না।যেহেতু সে চলাফেরা করতে পারেনা,তাই সব সময় ঘোড়াও সহিস তার সাথেই থাকে।
সকাল বেলা থেকেই নীল আর তার বড়আপুর লেখাপড়ায় মন নেই।কখন ঘোড়াটাকে নিয়ে পাড়ায় বেড়াতে যাবে,এই বাহানা খুঁজতে থাকে।কিন্তু তার মা আবার খুব কড়া।কিছুতেই তিনি রাজি হবেন না। সামনেতাদের বার্ষিক পরিক্ষা।মা,লেখাপড়ায় খুব সিরিয়াস। এখানে কোন ওজর আপত্তি চলবেনা। সাদা ঘোড়াটা দেখতে খুব সুন্দর।লেজের আগায় একগুছো চুল।মনে হয় বেণি করে দেই।ওকে নিয়ে বের হলে আজকেতো পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা ওদের পিছন পিছন ঘুরঘুর করবে। মাতিয়ে উঠবে পুরোটা শহর। নীল মনে মনে ভাবতে লাগল,আজ খুবই মজা হবে।কিন্তু মাকে কিভাবে পটাবে চিন্তা করছে, মা,কেমনে যেন সব বুঝে যায়,মায়ের নাকি চারটে চোখ আছে,দুটি চোখ সামনে,আর দুটি চোখ পিছনে।সব অপকর্ম ফাস হয়ে যায়। ওদিকে স্কুলেরও সময় হয়ে গেল। দাদু বিছানায় ঘুমাতে পারেনা,নামাওঠা করা তার জন্য জুলুম,কষ্টকর।তাই তিনি আসলে সবসময় নীচে বিছানা করে দেয়া হয়,দাদু সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে,আর নাতনীদের সাথে গল্পগুজব করে সময় কাটিয়ে দেয়।মজার মজার সব রূপকথার গল্প তার জানা আছে।ঠাকুরমার ঝুলি সব তার মুখস্হ।এতো মজা ককরে বলে সেগুলি শুনতেও বেশ আনন্দ লাগে।পড়াশোনা তখন একেবারেই হয় না,এই নিয়ে নীলের মা আবার বেশ চিন্তিত।সামনে
মেয়েদের পরিক্ষা।কি হবে ককে জানে!!! এরা
দুইবোনতো সারাদিন দাদুর ঘরেই আছে,পড়ার টেবিলের ধারে কাছেও নেই।দাদু আবার চুপিচুপি ওদের টাকাও দেয়,টিফিন আর এটা সেটা খাবার জন্য,এজন্য দাদুভাইটা আসলে তখন ঈদ ঈদ মনে হয়,মাও অনেক মজার মজার রান্নাবাড়া করেন।পড়াশোনা ফাঁকি দেয়া যায় অতি সহজেই।নীল বসে বসে ১৬ ঘরের নামতা মুখস্হ করছিল।এই একটা জ্বালা হয়েছে।তার মা সব নামতা মুখস্হ করিয়ে তবেই ছাড়বে।সেদিন পিতাপুত্র অংকটা ভুল করে এসেছে,এতে মা খুব রাগ হয়েছে।আজকে পাঁচ প্রশ্নমালার সব অংক করতে বলছে,কিন্তু নীলের এসব কিছুই ভালো লাগছে না। নীলেরএদিকে পড়ায় একদমই মন নেই।সে
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সাদাঘোড়াটা দেখল।ইসসস!!! কখন ঘোড়া
নিয়ে বাইরে যাবে তবেই তার শান্তি।মা,এসব
কিছুই বোঝে না,শুধু শুধু গাদাগাদা পড়া দিয়ে রাখে।নীলের এখন ইচ্ছে করছে ঘোড়ায় চড়ে
সারাটা পাড়া টহল দিতে,সে উপায় কি আর আছে?ঘোড়ার পিঠে উঠে যখন পাড়াটার মধ্য ঘুরতে থাকে তখন কেমন একটা রাজকীয় ভাব চলে আসে।সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে।তখন বেশ হাসি পায়,আবার মজাও লাগে।সবাই সারি বেঁধে ঘোড়ায় চড়ার জন্য আবদার করতে থাকে।
এটাও বেশ উপভোগ্য।বাবা দেখলে বকা দেয়,এই
শিগগির নাম!!! পড়ে যাবে এখনি, পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙবে এইসব।একটা ম্যাসাকার হবে।
সামনে তোমার পরিক্ষা।
সহিস ছেলেটাও কম বয়সের।সে একের পর
এক সবাইকে নিয়ে ঘুরিয়ে আনে,এতে তার
কোন ক্লান্তি নেই।সেও উপভোগ করে বিষয়টি।
নীল তাকিয়ে দেখল ঘোড়াটা ছোলা,ভূসি খাচ্ছে
মহাসুখে,নীল ঘোড়াটাকে একটু আদর করে দিল।আর কানে কানে বলল,এই শোন!!!
আজ সারাদিন তুই আমার বুঝলি,তোকে নিয়ে
আজ অনেক ঘুরে বেড়াব।আমার সব সখিদের
সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।তুই কিন্তু ওদেরকে
পিঠ থেকে ফেলে দিস না আবার!!!
নীল রান্নাঘরে গেল, 
-----ওমা কি করছ?
----কাজ করছি দেখছনা,
----মা!!! শোন আমি আজকে স্কুলে যাবনা,
কেন?খুব পেট ব্যথা করছে,
----শুধু শুধু পেটব্যথা কেন করবে?
---আমি তার কি জানি,কিন্তু করছেতো?
----সত্যিই করছে নাকি?
-----হা,একদম সত্যি কথা,খুব ব্যথা করছে মা।
----কেন? হঠাৎ করেই খুব ব্যথা করছে,
----আজ আর স্কুলে যাবনা কিন্তু,
----আচ্ছা যেও না,এখন যাও দাদুভাইকে নাস্তাটা দিয়ে আস।কাছে বসিয়ে খাওয়াবে,খেলায় রেখ কোন অসুবিধা যেন না হয়।তারপরঃ ঔষধ খেয়ে
শুয়ে থাক।একদম বাইরে খেলতে যাবেনা
বলছি।
নীল তখন বেশ খুশিমনে দাদুর নাস্তাটা নিয়ে তার ঘরে গেল।আজ সারাদিন ঘোড়াটা তার।আপুও নিতে পারবেনা।কারন আপুর স্কুল আছে।আপু তার তিন বছরের বড়।দুজনের বেশ ভাব।কিন্তু সেই সবসময় ঘোড়াটা কাছে রাখে,তার ইচ্ছেমতোই চলে সব কিছু।সহিস বেটাও তার কথাই বেশি শুনে।নীল একদৌড়ে গিয়ে দেখে আসল ঘোড়াটা কি খাচ্ছে?
খা!! বেটা খা!!! বেশি করে খা!!!
আজ অনেক খাটুনি হবে তোর।
সহিস ছেলেটা তখন ঘোড়াকে বেশ আয়েশ করে গোছল করাচ্ছে,বেশ আয়োজন করে নিয়েছে।নীলের খুব ইচ্ছে করছিল সেও ঘোড়াকে গোছল করায় তার সাথে।কিন্তু মায়ের ভয়।মা খুব রাগ হবে।এসব মা এএকদমই পছন্দ করেন না।তাছাড়া আপাতত তাকে মা
চুপ করে শুয়ে থাকতে বলেছে।নীল যে স্কুল
ফাঁকি দিয়েছে সেটা মার বুঝতে অনেক দেড়ি
হয়ে গেল।
এই আপু আমি কিন্তু আজ আর স্কুলে যাবনা,
----কেন যাবিনা?
---আমার আজ খুব পেটে ব্যথা,
--- ওমা!কি বলিস,
----তাহলে তুই আজকে আর ঘোড়ায় চড়তে পারবিনা,তাইনা!!!
----কে বলেছে পারবনা,অবশ্যই পারব,
যাহ,ততক্ষণ কি আর থাকবে,ঔষধ খেয়েছি,মা বলেছে ভালো হয়ে যাব,আর ব্যথাতো বেশি না,অল্প অল্প।
---আমারও আজ মাথা ব্যথা করছে বুঝলি,
---হমমম
----ভাবছি আমিও আজ স্কুলে যাবনা,
----সত্যি বলছিস
----হা,সত্যি
---মা বকেনি,
----নাহ,খুব ব্যস্ত ছিল,রান্নাবাড়া করছে,
----ও,আচ্ছা!!! তাহলে মা কে বলে আয়,
----বলেছি,মা বলেছে চুপচাপ শুয়ে থাকতে,তাই
শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছি,এখন তবে
চল আমরা দাদুভাইয়ার কাছে গিয়ে শুয়ে
থাকি,আর রূপকথার সব গল্প শুনি।
নীলের মায়ের বুঝতে আর বাকি থাকল না,এরা
দুইবোন স্কুল ফাঁকি দদিয়েছে।কাওকে ঘরে পাওয়া গেলনা।এরা একজনের মাথা ব্যথা আর একজনের পেটের ব্যথা কোথায় চলে গেল।তারা
এখন পুরোপুরিভাবে সুস্হ হয়ে গেছে।
মা ডাকতে থাকল নীল!!! এই নীল!!!
কই গেলি?
কোন সাড়াশব্দ নেই!!!
সহিস ছেলেটারও কোন খবর নেই,ওকে একটু
বাজারে পাঠাতে চেয়েছিল।মেয়ে দুটোরও হদিস
নেই।কারণ নীলরা দুইবোন
তখন সাদা ঘোড়া নিয়ে সারাটা পাড়া ঘুরতে গেছে,আজ তাদের মহা আনন্দের দিন।

কবির প্রতি ।। আহমেদ মুনীর



















কবির প্রতি            

তোমার কাছে অনেক কিছু চাই কবি 
কবিতাভালবাসাজোছনার কোমল হাত 
রৌদ্রের আলোক খরতাপ জীবনের নিবিড়তা 
মেঘ বৃষ্টি জল বনভূমি 
পাহাড় পর্বতের সবুজ বৃক্ষলতা 
রাত্রির একাগ্র সুখ জন্ম মৃত্যু হিসাব 
সব কিছুইতো আছে তোমাদের কাছে 
তোমাদের ক্যানভাসে আকাশে দিগন্তে 
নক্ষত্রলোক কৃষ্ঞগহ্বর ছায়াপথে 
ব্যথা বিরহ বেদনা যাতনা আনন্দ 
বিনোদন সুখ ভালবাসা 
আমাজান আর আফ্রিকার রেইন ফরেষ্ট 
তুষারে ঢাকা হিম শীতল মেরু 
মরুদ্যান পান্থপাদপের নির্মল জল 
মরুভূমিতে ঈপ্সিত বৃষ্টিপাত চাষাবাদ 
তোমাদের কাছে আছে জিম্মী আমাদে 
স্বাধীনতা স্বাধিকার বজ্রধ্বনি 
বিশুদ্ব বাতাস অম্লজান 
বায়ুমন্ডল বায়ুপ্রবাহ 
জীবন  যৌবনের গান 
মানুষের গান সভ্যতার গান ।। 
আমি এখনও আছি এই বাংলায় পথে প্রান্তরে 
এখনও জীবিত সদর্পে মিছিলের অগ্রভাগে 
বর্গী আর হানাদারদের তাড়াই প্রত্যুষে দিবাভাতা।