বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

প্রচ্ছদঃ কুয়াশা ।। ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ।। ২০১৮ইং ।।


সম্পাদকীয়ঃ ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ।। ২০১৮ইং ।। সংখ্যা ১০।।

সম্পাদকীয়ঃ ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ।।  ২০১৮ইং ।। 



ফেব্রুয়ারি মাস মানেই ভাষার মাস। ভাষা আন্দোলনের মাস। মায়ের মুখের শিখানো ভাষাকে স্বাধীন মুখের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবার মাস। ভাষার দাবীর জন্য যে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে হয়েছে, নিরলস আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে সেই ভাষাটাই আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষা। যে ভাষার জন্য এদেশে ভাষা সংগ্রামী নামে একটি সমাজ চিন্তাশীল মানুষ গড়ে উঠেছিলো এবং ভাষা সৈনিক নামে এদেশে বহুল পরিচিত ও সমাদৃত সুশীল সমাজ আছে - এটাই আমাদের বাংলা ভাষার গৌরব এবং ঐতিহ্য। এতদভিন্ন পৃথিবীতে অন্য ভাষার জন্য এমন কোন ইতিহাস নেই, নজির নেই। নেই ভাষা শহীদ, নেই ভাষা সৈনিক। নেই রক্তের দাবি। কিন্ত আমাদের বাঙালীর সেটা আছে। রক্তের বদৌলতে জায়েজ করে নেয়া হয়েছে এই ভাষাকে -এটাই বড় আদালত। এটাই বড় রায়। তাই আর কোন হারাবার ভয় নেই। যা হারিয়েছি সেটা ভাষা শহীদদের রক্ত এবং গুটিকয়েক মানব সম্পদ। 

 সশ্রদ্ধভালোবাসা জানাই সেই সমস্ত ভাষা শহীদদের প্রতি, ভাষ সৈনিকদের প্রতি। যাঁদের কল্যাণে আমার মুখের ভাষাকে মায়ের ভাষা বলতে পারছি এবং মানতে পারছি। সালাম বরকত রফিক এদের আত্নার মাগফিরাত কামনা করছি। তাদের শরীর থেকে ঝরে যাওয়া রক্ত বৃথা যায়নি। রক্তের মূল্য  শুধু এই প্রাপ্তিতে মিশিয়ে দিলে তাদের অবমূল্যায়ন করা হবে। বরং এমন স্বীকৃতি দেয়া হোক যে, তাদেরকে বাংলাদেশ যতদিন বেঁচে থাকবে, বাংলা ভাষা যতদিন মানুষের মুখে মুখে ফুটবে ততদিনই আমরা তাদের কাছে ঋণী হয়ে থাকবো। কারন এর মূল্য হয়না। এর অবদান, উপকার গ্রাহ্যতা মাপা যায়না। চির ঋণী হয়ে থাকতেই আমাদের প্রাণের তৃপ্তি যেনো। শোধ হয়ে গেলে যেমন তার টানপেড়েন থাকেনা। তাই আমরা তাদের অবদানের বিষয়টা শোধ দিতে চাইনা - আমরা তাদের নিকট ঋনী হয়ে থাকি - এটাই আমাদের পরিতৃপ্তি। 


ঠিক এই মাসে আয়োজনটাও বরাবরের মতোই রাষ্ট্রীয়ভাবে বেশ জোরেসরে করা হয়ে থাকে। বাংলা একাডেমী কতৃক আয়োজন করা হয় বই মেলা। বই মেলার তাৎপর্য মূলত একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস ঐতিহ্যকে মানুষের মধ্যে জাগ্রত করা। ভাষার অহংকারকে তুলে ধরা, ভাষাকে পাবার জন্য তীতিক্ষার কথা মনে করিয়ে দেবার জন্যই বারবার বৎসর ঘুড়িয়ে ফেব্রুয়ারি আসে, একুশ তারিখ আসে।

বই মেলা এ মাসের গভীর ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। লেখক প্রকাশকদের মেলনমেলায় পরিনত হয়। আশা উদ্দীপনা এবং সৃজনশীলতার আবেগ আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে দেয়।  এদেশে একারনেই কবি লেখক তৈরী হচ্ছে আশাব্যঞ্জকহারে। এটা বাঙালী জাতির বড় দায়বদ্ধতার দিক।

এরই সামান্যতম আয়োজন আমাদের "কুয়াশা"।
চলতে চলতে দশম সংখ্যা পার হলো। মানে দশ মাস পেরিয়ে বৎসর পাই পাই এরকম একটা সময় পার হয়ে গেছে। এখানে সকলের অধিকার সমান। সবাই লেখা দিতে পারে। তবে প্রকাশণার ক্ষেত্রে বাচ বিচারের তো কথা থাকেই। সে জন্য কিছু জনের মন খারাপ হতে পারে।  তবে লেখা মানসই হলে অবশ্যই যাবে একসময়।
সকলকে ধন্যবাদ....


দ্বীপ সরকার

সম্পাদক

সূচিপত্র ।। কুয়াশা ।। ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ।। ২০১৮ইং ।।

সূচিপত্রঃ কুয়াশা ।। ফেব্রুয়ারি সংখ্যা।। ২০১৮ইং।। 


প্রবন্ধঃ 
মতিন বৈরাগী, রহিমা আক্তার মৌ

কবিতাঃ

শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায়, রহমান হেনরী, মোহাম্মদ ইকবাল, রুপা সাধুখা, ভাস্কর চৌধুরী, নাসির ওয়াদেন, সীমান্ত হেলাল, সুনীতি দেবনাথ,ইউসুফ তাপস, দ্বীপ সরকার, রেবেকা রহমান, আসমা মতিন।

অনুবাদ কবিতাঃ
অরণ্য আপন।

বই আলোচনাঃ
পার্থ মল্লিক।

গল্পঃ
সাইদুর রহমান

কবিতাঃ
এ কে এম আব্দুল্লাহ, লায়লা আঞ্জুমান ঊর্মি, আবু আশফাক্ব চৌধুরী, শামীম আহমেদ, মোহিত অনু, অভিলাষ মাহমুদ।

অণুগল্পঃ
সৌমিত্র চক্রবর্তী, সিলভিয়া ঘোষ, প্রিতম গোর্কী। 

কবিতাঃ
শ্রীলেখা চ্যাটার্জী, সুশান্ত হালদার, কবির হুমায়ন, শিশির রায়,মোঃ নুরুল গনী,সজল মালাকার, ফাইয়াজ ইসলাম ফাহিম, আনজালা ডালিয়া, ইয়াসমিন আক্তার মণি, রুপক চৌধুরী।

ছড়াঃ
মজনু মিয়া
বিচিত্র কুমার 

প্রবন্ধঃ মানুষ বনাম শূন্যতা ।। মতিন বৈরাগী

প্রবন্ধঃ  মানুষ বনাম শূন্যতা

মতিন বৈরাগী
শূন্যতা এক বাস্তবতা মানুষের জীবনের। মানুষ বহুতে যেমন যুক্ত, তেমনি এককে এক শূন্যতা তার সমস্ত অস্তিত্ব বেষ্টন করে রাখে। এই শূন্যতা মূলত অস্তিত্ব সংকট। আবার বৃহতে ছড়িয়ে সামগ্রিক হয়। শূন্যতা অর্থহীন নয়, আবার ক্ষণিকেরও না। প্রতিমুহুর্তে মানুষ তার নিজের দিকে ফিরাতে চায় অর্থবোধকতা তার অস্তিত্বের, আর সেই উদ্যম থেকে জন্ম লয় স্বার্থ। এই স্বার্থ কখনও ব্যক্তিকে আগ্রাসী করে তোলে, কখনও জীবনে বিরাজমান এই শূন্যতা ব্যক্তিকে অস্তিত্বহীনতার দিকে ধাবিত করে এবং এক অসহায়ত্বের বলয় সৃষ্টি করে। কখনও ব্যক্তির শূন্যতা এবং সমাজকাঠামোয় ব্যক্তির অবস্থান, বিরাজমান শূন্যতা ব্যক্তিতে ব্যাক্তিতে মিলে সমাজপ্রকৃতি হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে তার কোনো অর্জন শূন্যতাকে পরিপূর্ণ করতে পারে না। সে এক শূন্যতার ক্ষুদ্রতা থেকে ক্রমাগত বৃহতে নিপতিত হয় এবং উপলব্ধিহীন পরিস্থিতির মধ্যে নিজকে খোঁজে তার তৃপ্তির অনুষঙ্গ। সে যেমন শূন্যতার মধ্যে এসেছে তা একটা আকস্মিকতা তেমনি সে সেই আকস্মিকতাকে বিস্তার দিতে চায় নিজের দিকে সব কিছু টেনে। এর মধ্যে তার অসাহয়ত্বের একটা সহায় বা অবলম্বন সে খুঁজে নেয়। এর কোন বিরাম বা ক্লান্তি নেই।কারণ মনোজগতে শূন্যতারও কোনো স্থবিরতাও নেই। জাগতিক আর্জনে তার কোনো অনীহা নেই কারণ এক শূন্যতা তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে। তবু বাস্তবের অভিঘাতে মানুষ এই শূন্যতাকে খুব একটা আমলে নিতে পারে না কারণ সে ইতোমধ্যে একটা সমাজ গড়ে তুলেছে, যার মধ্যে তার অধিষ্ঠান এবং সেখানে আধিপত্য করার অন্যকে অধীন করার সুযোগ রয়েছে, [এর মধ্যে শূন্যতা পুরণ প্রয়াস] এই সুয়োগ শূন্যতা থেকেই উদ্ভুত। মানুষ এবং মানুষ তা কতগুলো কার্যকরণের ফলশ্রুতি, শারিরীক রাসায়নিক ক্রিয়ার একটা গঠন বা বিস্তার থেকে প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের উদ্ভব, যা স্ব-নিয়ন্ত্রিত স্ব-বিস্তৃত এবং স্ব-বুদ্ধির বৃত্তান্ত। তবে তার বিকাশ উন্নয়ণে মানুষ স্বভাবগত ভাবে ও জীবন আচরণের পদ্ধতির মধ্য থেকে বুদ্ধিবিকাশের ধারায নিজেকে যুক্ত করছে প্রতিমুহূর্তের চলমানতায় যা আপাতত তার শূন্যতাকে স্পর্শ থেকে অনুভুতির দরজাথেকে দূরে রাখছে। অর্থাৎ মৌলিক শূন্যতা মানুষের মধ্যে চির বিরাজমান থাকলেও চলমানতায় সে আর তার অবস্থানকে নির্ণয় করতে পারছে না, বা করে না। কিন্তু একটা সময় যখন জাগতিক সকল বিষয়-আশয় থেকে তার অনুপস্থিতি শুরু হয়, [ দৈহিক অক্ষমতা থেকে] অর্থাৎ রিলের কাঠিটি অন্যের হস্তগত হয়, তখন সে আস্তে আস্তে এক শূন্যতার স্পর্শ অনুভব করে। তখন তার মধ্যে জাগতিক অস্তিত্বের চেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরাজাগতিক অনুভব কল্পনায় নির্মাণ করে সামাজিক সূত্রগুলো থেকে। এই খানে তার নিস্পৃহতা, নিসঙ্গতা ধীরলয়ে মহাশূন্যের অস্তিত্বকে প্রকট করলেও সে সব বিষয় নিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারে না, সামাজিক অবস্থানের কারণে।
সমাজের চলমান লোভ, আধিপত্য, নিজ শ্রেষ্ঠত্ব, বা টিকে থাকবার, বেঁচে যাবার চলমান চিন্তাগুলো তাকে চাগিয়ে রাখে এবং একসময় তার অস্তিত্বহীনতার সংকটকে অনেকাংশে নিস্পৃহ করে তোলে। তখন তার মধ্যে জাগে এক অপেক্ষা, মৃত্যুর অপেক্ষা। এ মৃত্যু যেন তার প্রার্থিত, তার সাধনার। অর্থাৎ এখানে আর তার কোনো কাজ নেই, এখানে আর তার কোনো ভোগ নেই, যা আছে তা এখন ওই খানে।ওই খানটাও সে কল্পনা করে নেয়, কেমন থাকবে কীকী পাবে বা পাবেনা, পেতে হলে কী ধরণের সংকটা মোকাবেলা করতে হবে,কী প্রশ্ন হতে পারে, কী জবাব সে দেবে আর দেয়ার তরিকাগুলো কী ভাবে ধর্মীয় নিয়মাবলীতে বিধিবদ্ধ তাই নিয়ে ভাবে। এ ভাবে মানুষ ওইখানের অস্তিত্বকে প্রলম্বিত করে এবং মৃত্যুকে নিজের জন্য গ্রহণ করে।শূন্য থেকে মহাশূন্যে প্রস্থানের একটা চিত্র দাঁড় করায়। আসলে মানুষ শুন্যতাকে অগ্রাহ্য করতে পারেনা,সে মেনে নিতে পারেনা তার অস্তিত্বহীনতা।
দার্শনিকরা এই শূন্যতাকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করে তার বিপরীতে অস্তিত্বকে স্থির প্রজ্ঞা হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। বহুতর নান্দনিক ভাষ্য ও ব্যাখ্যাবলী রচিত হয়েছে, লেখক কবি শিল্পী ও দার্শনিকের ভাষ্যে। অনস্তিত্বের বিপরীতে অস্তিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস রয়েছে এবং এভাবে দার্শনিক চিন্তার অস্তিত্বের অনর্থতাকে ভরাট করে মানব মনে, মানবজ্ঞানে প্রথিত করার চেষ্টা করছে, করেছে। কিন্তু তবু মানুষ শূন্যের হাত থেকে তার ছোবল থেকে নিজেকে পরিপূর্ণ উদ্ধার করতে পারেনা। তাদের এই সব ব্যাখ্যাবলী প্রমাণ করতে চাইছে, শূন্যতার আস্তিত্ব মানুষের নিজের মধ্যে যাকে ভরিয়ে তোলা হয় আস্তিত্ব চিন্তাদ্বারা। আর অস্তিত্ব চিন্তা মানুষের মনের অর্থহীনতাকে প্রশমিত করে। ‘আমি বেঁচে আছি কারণ আমি চিন্তা করতে পারি’। এই বেঁচে আছি চিন্তা তাকে শূন্যতা থেকে নিরাপত্তা দেয়। আবার ধর্মীয় বিবৃতিগুলো শূন্যতাকে ভরাট করে মানুষ তার অস্তিত্ব ঈশ্বরের সংগে যুক্ত করে নেয়। ঈশ্বর বৃহত অংকে মহাশূন্য, তার রূপ নেই, ব্রহ্মাণ্ড অস্তিত্বের চাইতেও বিশাল সে কল্পনায়, আবার অনস্তিত্বও সে কারণ কেউ তাকে দেখেনি। তার উপস্থিতি মহাশূন্যের দিকে, মানে ঈশ্বরই শূন্য অস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বমান, এবং মানুষ ক্ষুদ্র অস্তিত্ব থেকে ঈশ্বর অস্তিত্বে লীন হলে শূন্যতা সক্রিয় এমন এক শূন্যতা যার কোনো পরিমাপ থাকে না, আপনা আপনি সক্রিয় এবং নিস্ক্রিয়তায় রূপবান হয়।
এই শূন্যতা মানবজীবনে অস্তিত্বের সন্ধানে অমৃতের মতো কাজ করে, তাই সে সমাজবদ্ধ। অসায়ত্ব থেকে সহায়ের চিন্তা রাষ্ট্র, সমাজ, ক্ষমতা, অন্যকে ক্ষমতাহীন করার পায়তারা সবই সে করে। বলা যেতে পারে শূন্যতা মানব জীবনের ভোগের পূর্ণতা প্রদানের উদ্দীপনা। শূন্যতা থেকেই মানুষ ভরাতে চায় নিজেকে পূর্ণ করে নিতে চায় সকল ভাঁড়ার। কারণ শূন্যতাকে কোনো সীমায় অস্তিত্বহীন করতে পারে না। নাই এই চিন্তা থেকে আছের চিন্তা, পুরাতনকে ভাঙা, নতুনের আরো অনুসন্ধান এবং বিষয়কে সহজে নিজের দিকে অস্তিত্বমান করার ভাবনা মানুষের শূন্যতার বোধ থেকেই আরম্ভ।

গোষ্ঠিবদ্ধতা ব্যক্তির শূন্যতারই ভরাট আকাঙ্ক্ষা। আর গোষ্ঠি থেকে অন্যগোষ্ঠিকে দখলে নেয়া তাদের নিজস্বতার বিলোপ করে দেয়া শক্তিমানদের শূন্যতা ভরাটেরই প্রয়াস। আর এ ভাবে বহু বহু কাল থেকে যুদ্ধ-বিগ্রহ-ধংস-নির্মাণ হত্যা-লুট মানব সমাজকে এতোদূর এনেছে। ইতিহাসের ধারায় লক্ষ করলে দেখা যায়, দরকার নেই তবু তার চাই, ভোগে, বিলাসে, উশৃঙ্খল জীবন আচরনে, আনন্দে, তার তৃপ্তি নেই, আরো প্রয়োজন। কখনও কখনও ব্যক্তির এই অর্থহীনতা গোষ্টি বা ব্যস্টিকেও মোহান্ধ করে।কারণ তাদেরও শূন্যতা। ফলে এক ধারা থেকে অন্য ধারার অধীনতা প্রকৃত পক্ষেই শূন্যতা ভরাটের কোনো উপশম দেয় না, আপাতত তার অতৃপ্তি আস্তিত্ব সংকট এই ঘটমান ঘটনাবলী নিস্তার দিলেও সে তার শূন্যতাকে ভরাট করতে পারে না। ফলে সংকট তীব্র হয়, এবং নানা ভাবে তার বিস্তার ঘটে। যদিও এই শূন্যতা দৃশ্যমান নয়, [আবার অস্তিত্বহীনও নয়] তবু তার উপস্থিতি রয়েছে মানুষের মনোজগতে। এই জগতে আলো পড়লেই সে তার হীনতা ক্ষীণতা অসায়ত্ব সবই উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু উপযুক্ত মনোউণ্নয়ন ব্যবস্থার অভাবে এই অনর্থকে অর্থরূপে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে না। ক্ষমতা দখল ভোগ, সম্পদ কুক্ষিগতকরণ, যথেচ্ছচারীতা সবই মানসিক শূন্যতার ফলাফল, কারণ এর মধ্যে পিছনে তাড়া করে ফেরা অনর্থ আড়াল হয়। আবার যারা হতাশাক্রান্ত হয়, তাও এক শূন্যতা আর তা অপসারণের শক্তিহীনতায় সে অধীন হয় এবং শূন্যতা থেকেই তার পরিণতিকে মহাশূন্যতায় যুক্ত করে ভাগ্য বলে মেনে নেয়।
শূন্যতা যেমন একদিকে নিস্পৃহতার দিক নির্দেশ করে অন্যদিকে ব্যক্তিকে গোষ্ঠিকে, এমনকী গোটা একটা সমাজকেও তা পূরণে উৎসাহিত করে। এরই পথ ধরে আমরা লক্ষ করি সভ্যতার অগ্রযাত্রা। যদিও চুড়ান্ত অবস্থায় ব্যক্তি শূন্যতা থেকে সামগ্রিক অস্তিত্বকে নিরঙ্কুশ করতে পারে না, কেবল মাত্র সমাজে কর্মচাঞ্চল্য দ্বারা তা ভরাট করে রাখা যায়। সে কারণে সমাজ-রাষ্ট্র কাঠামোতে যা কিছু কল্যাণকর তা সবই শূন্যতাকে ভরাট করে। আবার যা কিছু রযে গেছে এখনও দিকপাতের বাইরে তাই রয়েছে শূন্যতা তীব্রতার পক্ষে। ফলে আমরা পাহাড়ি, আদিগোষ্ঠি, সমতলি, উন্নত অনুন্নত ইত্যাদি পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত হয়ে মানব মিলনের পথকে দুর্গম দুঃসহ করে রাখছি। এর মধ্যে আরো বহুতর অনুষঙ্গ রয়েছে। ক্ষুদ্র মানব সত্তা বৃহতে সামাজিক সত্তা বর্ণে গোত্রে ভাগ হয়ে গেছে। প্রত্যেক মানুষই আদিমানুষের কোনো না কোনো শাখার বিবর্ততিত রূপ। কোনো মানব সত্তাও আজ আর তার অতীতের উপরে দাঁড়িয়ে নেই। আদি গোষ্ঠিগুলোও কেবলমাত্র আদিরূপেই দাঁড়িয়ে আছে তাও সত্য নয়, তাদের অগ্রগতি বৃহতের অগ্রগতির সংগে সংযুক্ত হয়নি তাদের গোষ্ঠিবদ্ধ অস্তিত্বহীন প্রবণতার কারণে, তারা এই ভাবনাকে গ্রহণ করতে পারেনি যে অন্তর সত্তায় সে এবং বৃহত একই বস্তু-বিশ্লিষ্ট রূপ।[ যা তাকে করতেও দেয়া হয় না] তার অভ্যেস রুচি ভাষাকে বদলাবার ক্রিয়ায় যে সুযোগগুলো আজ আশু প্রয়োজন সমতলিরা শূন্যবৃত্তির তাড়ণায় তাকে তামাশা করে রেখেছে।তাদেরকে করে রেখেছে জীবন্ত এন্টিকস। এখানেই তৈরি হয়েছে তার অস্তিত্বহীনতা। তার স্বাধীনতা হীনতা। আর তা’ নিয়ে পরিকল্পিত কর্মপন্থার পরিবর্তে তাকে আদিগোষ্ঠিরূপে চিরকালের প্রদর্শনী করার মধ্যে অন্যের যে বানিজ্য আছে তাকেও চিনতে পারা দরকার। তাকে বৃহতের সংগে মিলিয়ে বৃহত মানবগোষ্ঠির মধ্যে আত্মিকরণ করার কাজটি আজ বড় জরুরী।
সংগত কারণে মানব জনম যে শূন্যতাকে বহন করছে যা সামাজিক সৃষ্টি তাকে পরিপূর্ণ করা যায় মানব কল্যাণবুদ্ধির ধারে কিন্তু বৃহত তা করে না, আর ক্ষুদ্ররা বিশ্বাসও করতে পারে না পরিপূর্ণ আস্থায় নিজেদেরকে স্থানান্তরীত করে। মানুষ অস্তিত্ব হীন হতে চায় না তার শরীরকাঠামো তাকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত।[ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটে] আর তাই সে তার অস্তিত্বকে জাগিয়ে রাখতে চায় তার সামাজিক ইচ্ছার মধ্যে। এতে বহু মানুষের যুক্ততা পাওয়া যায় আবার চক্রান্ত রয়েছে বৃহতের এবং বহুর ইচ্ছার মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ ধংস রিরংসা চালিয়ে নেয়ার। পাবো না এই বৃত্তান্ত থেকে যেমন চুরি করা, পাবো এই প্রত্যাশা থেকে নির্মাণ করা। শূন্যতা থেকে মানুষের মুক্তি নেই/[আছে], সত্য হয়ে থাকবে ততক্ষণ যতক্ষণ না মানুষ কর্মের মধ্যে তাকে অপসারণ করবে ব্যক্তি নয় গোষ্ঠি নয় সামগ্রিক মানবিক কল্যাণ বোধ। সীমাবদ্ধ মানুষ অসীম হয়েছে এই শূন্যতা অনেকাংশে বিদুরিত করতে পারার করণে। ক্ষুদ্র জাতি সত্তাগুলোর মঙ্গল বৃহতে, বৃহতের মঙ্গল নতুনে এবং শূন্যতা পরিহার করে মননে সেই তেজ ও দীপ্তি আনা যে বৃহত হয়ে সে বৃহতকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তার অসায়ত্ব ভাঙণের ক্রিয়ায়। এখানেই শূন্যতার উপশম।

১০.০৬.১৭.

প্রবন্ধঃভাষা নিয়ে বিশিষ্ট্য জনদের ভাবনা ।। রহিমা আক্তার মৌ

ভাষা নিয়ে বিশিষ্ট্য জনদের ভাবনা




রহিমা আক্তার মৌ
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে বাংলাসহ আরো ৪টি প্রদেশের মুসলমানেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মুসলমান প্রধান রাষ্ট্র সমূহ গঠন করা হবে। আর এ রাষ্ট্র সমূহের অন্তর্ভূক্ত ইউনিটগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত এবং সার্বভৌম। কিন্তু ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে অধিবেশন বসলে সব উলোট পালট হয়। বলা হয় শব্দটি স্টেটস হবে না, হবে ষ্টেট। ভুল করে টাইপ করার সময় একটা এস এসে বসে গেছে। তার মানে ভারতের মু্ষলিম প্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে হবে মাত্র একটি রাষ্ট যার নাম পাকিস্তান। হিন্দু-মুসলমানদের ভৌগোলিক অবস্থানগত জন সরকার নিরিখে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয় দুটি অংশে ভারত ও পাকিস্তান। আর পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আগেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা প্রসঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়।

উর্দুর পক্ষে উসকানি মুলক বক্তব্য দিয়ে বাঙ্গালীর ভাষা সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটান আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়া উদ্দিন আহমদ। তার বক্তব্যের লিখিত প্রতিবাদ জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। বাঙ্গালি জাতির এক অসাম্প্রদায়িক সহিষ্ণু চেতনার পথে লড়াই শুরু হয় এখান থেকেই। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা ‘বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তমদ্দুন মজলিস।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গনপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম অধিবেশনেই প্রস্তাব করেন। পরিষদের কার্যক্রম ইংরেজি ও উর্দু ভাষার সাথে বাংলা ভাষাতেও পরিচালিত হোক, তাঁকে সমর্থন করেছিলেন সদস্য রাজকুমার চক্রবর্তী।

১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। যুক্তি আর বাস্তবতাকে মূল্যায়ন না করে মগজে শুধু স্লোগান রাখলেন, ২১ মার্চ রেসকোর্স মাঠে ইংরেজিতে বক্তৃতা করে বলেছিলেন, “তোমাদের পরিস্কার বলে দিচ্ছি পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু আর অন্য কোন ভাষা নয়। কেউ যদি এর বিরোধিতা করে মনে করতে হবে যে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু। ২৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে ও তিনি একই প্রস্তাব করেন। সেদিন-ই জিন্নার প্রস্তাবের বিপক্ষ নেয় এবং না সুচক শব্দ বের হয়। 

মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদা দেয়ার জন্য অনেক আন্দোলন হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি হরতাল হয়েছে। মার্চ মাসের ১৩,১৪ তারিখেও ছিল হরতাল। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারিতে ধর্মঘট ডাক দেওয়া হয়। ৩১ জানুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সর্বদলীয় সমাবেশ হয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের হরতাল হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদের রাজেট অধিবেশন, তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি পেশ করার দিন ধার্য হয়। কিন্তু নূরুল আমিন সরকার ২০ তারিখেই ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে দিল। 

 ২১ তারিখে দলে দলে ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে উপস্থিত। ১৪৪ ধারা অমান্য হবে কিনা এ নিয়ে আগের দিন অনেক জটলা হয়। ১১ জন ছিল আইন অমান্য না করার পক্ষে আর ৩ জন ছিল অমান্য করার পক্ষে। কিন্তু ২১ তারিখের বেলতলার ছাত্র সভায় সাধারণ ছাত্ররা সম্মিলত ভাবে ১৪৪ ধারা অমান্য করে পথে বের হবার পক্ষে রায় দিল। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার কারণে পুলিশের কাদাঁনে গ্যাস আর বুলেটের সামনে পড়ে ছাত্র জনতা। ঘটনাস্থলে শহীদ হন আব্দুল জব্বার ও রফিক উদ্দীন আহমেদ। আহত হন আরো ১৭ জন। এর পর পরই শহীদ হন আবুল বরকত। ২২ তারিখ গায়েবানা নামাজ শেষে প্রতিবাদ মিছিল বের হলে সেখানেও পুলিশের গুলি চলে সেখানে শহীদ হন শফিউর রহমান।

 ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রনীত হয়। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি লাভ করে। স্বীকৃতি পাওয়া বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের বিশিষ্ট্য জনেরা বিভিন্ন ভাবে মত প্রকাশ করেছে,,,,,,,“রাষ্টভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, মুলতঃ শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এই দিনই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষেদের অধিবেশনে উর্দুকে পাকিস্তানের এক মাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এক মাত্র কুমিল্লার শ্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্তই উদুর্কে একমাত্র রাষ্ট ভাষা করার প্রতিবাদ করেন এবং উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি জানান। কোন বাঙ্গালি মুসলমান প্রতিবাদ করেনি। এটা লজ্জা জনক ইতিহাস। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোল শুধুমাত্র ভাষার আন্দোলন ছিল না। বাঙ্গালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন এর সাথে জড়িত ছিল।” কথা গুলো বলেছেন বঙ্গ বন্ধুশেখ মুজিবুর রহমান। 

তিনি আরো বলেন,,,,,
“ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষনা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহনের দিন থেকেই সকল সরকারী অফিস, আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করবোনা। কারন তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না। এ অবস্থায় হয়তো কিছু কিছু ভুল হবে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসেনা। এ ভাবেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে।” (১৯৭১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আজাদ, সংগ্রাম, ইত্তেফাক সুত্রে)।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাতৃভাষা চর্চার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বলেছেন,,,,,,,
“আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি এই যে, আমরা সবচেয়ে কাছের মানুষটিকেই সবচেয়ে কম জানি। আমরা ইংরেজদের কৃপায় ইংরাজি, গ্রিক ভাষা জানি, ইতিহাস জানি, তাদের সভ্যতার খবর নিই, কিন্তু আমারই গায়ে লাগিয়ে সে প্রতিবেশীর ঘর তারই কোন খবর রাখিনে বা রাখার চেষ্টা করিনে। বরং ঐ না জানার গর্ব করি বুক ফুলিয়ে। কোন মুসলমান যদি তার সভ্যতা ইতিহাস ধর্ম শাস্ত্র কোন কিছু জানতে চায় তাহলে তাকে আরবি ফার্সি বা উর্দুর দেয়াল টপকাবার জন্য আগে ভাল করে কসরৎ শিখতে হবে। ইংরেজী ভাষায় ইসলামের ফিরিঙ্গ রূপ দেখতে হবে। কিন্তু সাধারন মুসলমান ভাল করে বাংলা ভাষাও শেখে না, তার আবার আরবি ফার্সি। কাজেই ৯-মন তেল ও আসে না, রাধাও নাচেনা। আর যাঁরা ও ভাষা শেখেন তাঁদের অবস্থা “পড়ে ফার্সি বেচে তেল” আর তাদের অনেকেই শেখেনও সেরেফ হালুয়া রুটির জন্য।

 কয়জন মৌলানা আমাদের মাতৃভাষার পাত্রে আরবি ফার্সির সমু্দ্র মন্থর  করে অহত অমৃত এনে দিয়েছেন জানিনা। সে অহত তারা একা পান কোরেই ‘খোদার খাসি ’ হয়েছেন। কিন্তু এ যোদার যামি দিয়ে আর কতদিন চলবে ? তাই আপনাদের অনুরোধ করতে এসেছি এবং আপনাদের মারফতে বাংলার সকল চিন্তাশীল মুসলমানদেরও অনুরোধ করছি, আপনাদের শক্তি আছে, অর্থ আছে যদি পারেন মাতৃভাষায় আপনাদের সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস সভ্যতার অনুবাদ ও অনুশীলনের কেন্দ্রভুমি যেখানে হোক প্রতিষ্ঠা করুন। (“মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা” শীর্ষক অভিভাষন-সুত্রে)

আমাদের ভাষা সমস্যা শিরোনামে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন,,,,,


 “আমরা বঙ্গ দেশবাসী” আমাদের কথা বার্তার, ভয়-ভালোবাসার চিন্তা কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। দুঃখের বিষয়, জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধের ন্যায় এই সোজা কথাটিকেও আমাদের মধ্যে এক সম্প্রদায়কে বুঝাইয়া দিলেও তাঁহারা জোর করিয়া বুঝিতে চাহেন না। তাই মাঝে মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা কি কিংবা কি হইবে তাহার আলোচনা সামরিক পত্রিকা দিতে দেখিতে পাওয়া যায়। মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষা কানের ভিতর দিয়া মরাম পশিয়া পরান আকুল করে? মাতৃভাষা ছাড়া আর কোন ভাষার ধ্বনির জন্য প্রবাসীর কান পিয়াসী থাকে ? মাতৃভাসা ছাড়া আর কোন ভাষায় কল্পনা, সুন্দরী তাহার মনমজান ভাবের ছবি আঁকে ? কাহার হৃদয় এত পাষান যে মাতৃভাষার অনুরাগ তাহাতে জাগে না? পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করিয়া দেখ, মাতৃ ভাষার উন্নতি ব্যতীত কোনও জাতি কখনও কি বড় হইতে পারিয়াছে ? আরব পারস্যকে জয় করিয়াছিল। পারস্য আরব ধর্মের কাছে মাথা নিচু করিয়াছিল। কিন্তু আরবের ভাষা লয় নাই শুধু লইয়াছিল তাহার ধর্মভাবে আর কতকগুলি শব্দ।” 

তিনি আরো বলেছেন,,,,,
“সেদিন অতি নিকটে যেদিন বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভাষার স্থান অধিকার করবে। বিদেশীর ভাষার সাহায্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চ্চার মতন সৃষ্টি ছাড়া প্রথা কখনও টিকিতে পারে না। যতদিন পর্যন্ত তাহা না হইতেছে, ততদিন পর্যন্ত আমাদিগকে একটি সময়পযোগী শিক্ষা প্রণালী অবলম্বন করিতে হইবে।”

“মাতৃভাষা” শিরোনামে ভাষা আন্দোলনের নাট্য দলিলের নাট্যকার মুনীর চৌধুরী বলেছেন,,,,,,
 “যার যা প্রানের ভাষা। সেটাই তার মাতৃভাষা। কার মাতৃভাষা খিস্তি, কারও মিছরি। আমি নিজেও এমন অনেককে জানি, যাঁদের মাতৃভাষা ঘরে আঞ্চলিক বুলি, অফিসে ইংরেজী, প্রনয়-নিবেদনে বিশুদ্ধ বাংলা, রোষ প্রকাশ অশুদ্ধ উর্দু। আমার মাতৃভাষা কি? বাংলা ভাষা সমগ্র বাংলা ভাষা। বিচিত্র রূপিনী বাংলা ভাষা। অভিধান আছে ষোড়শ রমনী মাতৃসন্ধোধনী যোগ্য। শ্বশ্রু থেকে তনয়, গর্ভধারিনী থেকে পিতৃরমনী। ষোল নয়, আমার মাতৃভাষার ষোল শত রূপ। তার সব পঙ্খিনীর সহচরী। আমার মাতৃভাষা তিব্বতের গৃহাচারী মনসার দর্পচুর্ণ কারী, আরাকানের রাজ সভার মনিময় অলংকার, বরেন্দ্র ভুমির উদাস আহবান। মাইকেল- রবীন্দ্রনাথ- নজরুল ইসলাম আমার মাতৃভাষা। আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা।”

‘বাংলা ভাষার ক্রম বিকাশ’ শিরানামে মুহাম্মদ এনামুল হক বলেছিলেন,,,,,
 “ভাষার ক্রমবিকাশের গতি ও প্রকৃতি আলোচনা করলে সহজেই বুঝতে পারা যায়।” এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি যে শুধু জীব জগতের প্রতি প্রযোজ্য তা নয়। ভাষার ক্ষেত্রেও এই সত্য সমভাবে প্রযোজ্য। পারিপাশ্বির্ক তার সাথে যুদ্ধ করে কোন কোন দুর্বল ভাষা আজও স্বগৌরবে বেঁছে আছে। পৃথিবীর এ ভাষাগুলোকে প্রায়ই জীবিত ভাষাও বলা হয়। চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা, এখন সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নাই। এ বাংলা যে বাংলা ভাষার প্রাথমিক অবস্থা, তাও সর্বস্বীকৃত সত্য। এতৎসত্ত্বেও, হিন্দী ভাষী ও সৈথিলী ভাষী। উড়িয়াভাষী ও অহমিয়া ভাষীদের কেহ কেহ চর্যাপদকে তাদের ভাষার আদি নিদর্শন বলে দাবী তুলেছেন।

 চর্যাপদের ভাষা, ছন্দ, ভাব ও সুর সবই অনুসৃত হয়েছে বাংলাদেশে। খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অথবা মধ্য ভাগে রচিত অনন্ত বডু চন্তহীদাসের বিখ্যাত গ্রন্থ “শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন” পরবর্তী যুগের সহজিয়ো বহন করছে। ‘চর্যাপদে’ যে বঙ্গ ভাষার শৈশব কাল কেটেছে, শ্রীকৃষ্ণ কীতনে’ তা কৈশোরে পদার্পন করেছে এবং শাহ মুহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জুলেখার’ তা যৌবনুথ হয়েছে। অতপর ‘মন সামঙ্গল’ ‘ধর্মমঙ্গল’ চন্ডী মঙ্গল’ ‘রামায়ন’ মহাভারত প্রভৃতির ভাষায় বাংলা ভাষা যৌবন প্রাপ্ত হয়েছে।”

‘বাংলা ভাষা আন্দোলন’ সম্পর্কে রফিকুল ইসলাম লিখেছিলেন,,,,,,

“এ অঞ্চল বাঙালি শাসিত ছিল কদাচিৎ। বহিরাগত ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত শত বছর ধরে, ফলে স্বদেশী ভাষা সুযোগ পায়নি বিকাশ লাভের। ৪৭ সালে দেশ বিভাগ এবং উপমহাদেশ দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপনের ফলে দেশীয় ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভের সুযোগ আসে কিন্তু তখনও বাংলা ভাষা বঞ্চিত হয়।”

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান লিখেছিলেন,,,,,

 ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন’ শিরোনামে লেখা, যেখানে তিনি লিখেছিলেন- কারা বাংলা ব্যবহার করছেন এবং কারা করছেন না। আমাদের দেশে উৎপাদনে যাঁরাই নিয়োজিত আছেন- তাঁরা সকলেই বাংলা ব্যবহার করছেন আর যারা সৃজনশীলতা ও উৎপাদনে যুক্ত নন তারা বাংলা ব্যবহার করছেন না। কবি সাহিত্যিক শিল্পী এবং বিজ্ঞানী ও পন্থিদের মধ্যে যাঁরা সৃজনশীল তারা বাংলা ব্যবহার করছেন। তাছাড়া সম্পদ উৎপাদনে যাঁরা নিয়োজিত- অর্থাৎ শ্রমিক ও কৃষক তাঁরা সর্বদাই বাংলা ব্যবহার করছেন। এর বাইরে যারা না সৃজনশীল না সম্পদ উৎপাদনে সমর্থ- তাঁরা- কেবল তাঁরাই বাংলা ব্যবহার করছেন না।
বস্তুতঃ পক্ষে তাঁরা এক ধরনের পরাধীন মানসিকতায় ভুগছেন এবং এর একটা পটভুমি আছে। 

১৯৪৭ সালে ইংরেজদের বদলে যাঁরা শাসকের অসনে বসলেন তাঁরা শাসক সূলভ স্বভাবেই তাঁদের নিজেদের ভাষা উর্দু চাপিয়ে দিতে চাইলেন বাঙ্গালীর ঘাড়ে। কিছু ঐ ঘটনার আগে নব্য শাসকেরা একটা ভুল করে ফেলেছিলেন তাঁরা বাঙ্গালীকে বুঝিয়ে ছিলেন যে, ইংরেজ চলে গেলে বাঙ্গলীরা স্বাধীন হবে। কেননা তার আগে বাঙ্গালী স্বাধীনতা দেখেনি। তাই ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্টের স্বাধীনতার পর আবার পরের ভাষার দাসত্বের প্রশ্ন উঠলে চাকুরী প্রার্থী বাঙ্গালীর কন্ঠে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল। এর ফলে শিক্ষা, চাকুরী ও ব্যবহারিক জীবনে পরের ভাষার দাসত্ব থেকে মুক্তি এবং নিজের ভাষা ব্যবহারের স্বাধীনতা লাভ করে।

 ‘একুশের চেতনা আমার’ শিরোনামে মমতাজ উদ্দীন আহমেদ লিখে ছিলেন- 
“আমার অশন, বসন, শয়ন, স্বপন সবার মধ্যেই আমার বাংলা ভাষা। বাংলা আমার মা আর বাংলা ভাষা আমার মায়ের ভাষা। যাকে কবি শ্রী মুধুসুধন বলেছেন- মাতৃভাষা। আগের কবিরা বলতো দেশী ভাষা। দুটোই ঠিক। মাতৃভাষা আর দেশী ভাষা, সবই আমার আপন ভাষা। আমার সঙ্গে আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিলে মিশে এমন হয়েছে যে, আমি ছাড়া ভাষা নেই আর ভাষা ছাড়া আমি নেই। মজার ব্যপার হল, দেব নির্ভর পন্ডিতের কথা বাঙ্গালিরা শোনেনি। যেন রাজাদের কৌলীন্য অত্যাচারে জর্জরিত নিন্ম বর্নের বাঙালিরা শাস্ত্রে ও ধর্মে জীবনের ব্যাথা খোঁজনি। খুঁজতে লোক জীবনাচরনের মধ্যে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গঠন। বিকাশ ও অগ্রগতির মধ্যে যে খোঁজা খুঁজির অজস্র প্রমান আছে। পাল রাজাদের পতনের সময় পেলাম বৌদ্ধ সহজযান পন্থার গান চর্যাগীতি, যেন রাজাদের পলায়নের পর পেলাম শেক শুভোদয়া, গীত গোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, আর পাঠানদের যাবার কালে পেলাম যত মঙ্গল কাব্য। ধর্ম ঠাকুর আর কালুগাজী সত্য পীরের গান। মোঘলদের যাবার পর পেলাম বিদ্যা, সুন্দর, কবিগান ও পুঁথি কাব্য। দেবও রাজন্যবর্গের অনুশাসন ও পরি দর্শনার বাইরে এই হল বাংলা ও বাঙ্গালির জীবন পরিচয়। বাংলার ঐ এক কথা, আমার যা সত্য, যা প্রয়োজন এবং আনন্দ তার মধ্যেই আমার অধিবাস। যেখানে তুমি ইংরেজি আর তুমি পাকিস্তানী তোমাদের হুকুমে, ইঙ্গিতে ও দন্ডাদেশের ভয়ে আমি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ছলনা করতে পারব না।”

ভাষা বোধ ছিল বলেই চর্যাপদের ভুসুকু পা বলেন,,,,,,,
আমি ভুসুকু, বাঙ্গালী ভইলী। আর মধুসুদন ঠাট্টা করে বলেন আমি শুদ্ধ বাঙ্গালী নহি, আমি বাঙাল। ৬০ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন- আমরা হিন্দু মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশিসত্য আমার বাঙালি। মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী বলেছিলেন- বাংলা বাংলার পৌনে ষোল আনা লোকের মাতৃভাষা। ইহাতে হিন্দু মুসলমানের কোন পার্থক্য নেই। জগতে এমন কোন হাতির দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায় না। যাহারা মাতৃভাষার সাহায্য ব্যতীত উন্নত সোপানে আরোহন করিতে সক্ষম হইয়াছে।’

সেলিনা হোসেন বলেছেন- “মাতৃভুমি ও মাতৃভাষাকে ভালো কে না বাসে ? এই ভালোবাসা মানুষের স্বভাবের মধ্যে এমন ভাবে মিশে আছে যে সংকটে পতিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ এ ভালবাসার কথা ভুলেই যায়। মাতৃ ভাষা ও মাতৃভুমির প্রতি ভালবাসার কথা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় প্রয়োজনে মাতৃভাষার জন্য হৃদয়ের ফগ্লু ধারায় মাতা ভালবাসা থাকাই যথেষ্ট নয়। সে ভালবাসার প্রকাশ প্রয়োজন।
       -

বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

প্রাণ ।। শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায়














প্রাণ

প্রাণের ভিতর, আমি জানি, সেই জমিদারবাড়ি
এখনও সদম্ভে আছে, যেন তার প্রতিপত্তি খুব।
সামনে দিয়ে চলে গেছে এঁকেবেঁকে, রাস্তাটি পাহাড়ি।
দরিদ্র চাঁদের দেনা রাত কবে করেছে মকুব...
এমতাবস্থায় কারা ছাদের কিনারে উঠে এসে
ঝাঁপিয়ে আকাশে উঠে চলে যেতে চায় বারেবার
আমার সমস্ত ভাবনা চিরকালীনের স্রোতে মেশে
অথচ আগামীকাল কী হবে তা জানা নেই আর।
প্রাণ, সে মহত্বপ্রিয়, অবশ্য কিছুটা দীনও বটে
পুরাতন জুড়িগাড়ি, সে যেরূপ নিঃস্ব, রাজকীয়
আজও এ-বাড়ির মধ্যে ব্যাখ্যাহীন বহু কিছু ঘটে।
আমি দেখি ডানা মুড়ে নেমে এসেছেন হোরেশিও...
মৃত্যুর সীমার কাছে যে-পাঁচিল শেষ, তারই ধারে
অতীত দাঁড়িয়ে আছে হাত পেতে, প্রজাসমাহারে।

খেরোখাতাঃ ডিসেম্বর ২০ ।। রহমান হেনরী



















খেরোখাতা: ডিসেম্বর ২০ 


প্রথম পৃষ্ঠা
দরোজা-জানালা, এমনকি, গবাক্ষহীন সেই প্রাসাদের অন্তরে দিগ্বিজয় আপনার। গোটা ভূখণ্ডের আলোকসমগ্র
কক্ষবন্দি করেছেন। একা মানুষ আপনি, কী করবেন এত আলো ও উত্তাপ? আলোলালায়িত গণরাত্রিগুলো
বৃত্তাকার; ক্রমশ কেন্দ্রিভূত হচ্ছে—
ভূখণ্ডময় রাত্রির অজগর আপনাকে বেষ্টন করবার আগেই, অন্তত কিছু আলো, অন্ধকারমূর্চ্ছিত মানুষদের জন্য, অবমুক্ত করুন!


দ্বিতীয় পৃষ্ঠা
ভূতের পেট ফেঁড়ে, দেখছি— সরিষা আর সরিষা!


তৃতীয় পৃষ্ঠা
প্রগতি— কুঁচকানো ত্বক। তার চিপা থেকে, উদাহরণস্বরূপ, বেরিয়ে আসছে: লুডুঘরের সাপ— এগিয়ে যাও, সাপকে এবার সাপের বিষেই রাঁধো! রাক্ষুসে শালিখ্য-সংকেত। ধানগুলো, পুনরায় ক্ষেতেই পালিয়ে যাচ্ছে— এসো, ধানকে এখন ধানের শীষেই বাঁধো!
স্বপ্ন হাতে লাফিয়ে ওঠো: পাহাড়ে, জঙ্গলে, মাঠেমাঠে; তামাদি দুঃখদিনের রোদনই সংগীত— কল্পিত সুর কব্জা করে ঠোঁট ও গলা সাধো!


চতুর্থ পৃষ্ঠা
দ্বিভাজিত অগ্নিশিখার মধ্যে শুয়ে আছি— আর, দূরে, শ্বেতকেশরেণু ঝরে পড়ছে, নির্বিকার— মাঠে মাঠে জমে থাকা তুষার আয়নায় হয়তো তোমারই মুখ, নির্লিপ্ত— একবিংশ নগরীর ধ্রুবসন্ন্যাসিনী, হয়তো তোমরই চোখ জ্বলে, দাউ দাউ— আর আমি আরণ্যক; চকিত প্লাবনে ভেসে যাই।
দ্বিভাজিত অগ্নিশিখার মধ্যে প্রবাহিত লাভা, তোমরই আভায় উদ্বেলিত— অগ্নিপাহাড়ে বসে, দেখে যাচ্ছি:
দূরতম তুষারপাতের দিন— তুমি যার অংশভাক কখনও হবে না;


পঞ্চম পৃষ্ঠা 
ঘটনা এই যে, বিপ্লবীরাই অনেক যোগ্য ছিলো বিপ্লবের চেয়ে; অথচ কিছুই ঘটে নি। পানীয়গুলো উৎকৃষ্ট ছিলো পানশালার তুলনায়; কিন্তু পরিবেশিত পানপাত্রগুলো চুমুকের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে পানসে হয়ে গেছে। যদিও সমগ্র রাত্রির তলদেশ জুড়ে, আমরাই কোরাসে গেয়েছিলাম: 'কাস্তেটা শান দাও বন্ধু'— তবু, উৎসব শেষ হয়েছে দুপুরেই, শ্মশান হয়ে গেছে জমায়েতস্থল, একটা অসমাপ্ত গানের শুরুটা কারা যেন গেয়ে উঠেছিলো; কিন্তু ভেস্তে গেছে আরেকটা শুরুর সম্ভাবনা। এখন অপেক্ষায় আছি; কিংবা ভুলে গেছি:
প্রতিটি আজকের থাকে আরও একটি আগামিকাল

দীর্ঘশ্বাস ।। মোহাম্মদ ইকবাল














দীর্ঘশ্বাস



বিষণ্নতার সরোবরে ঘাই মারে বেদনার গাংচিল!
রাতগুলো অলস শুয়ে শুয়ে যুবতি হয়, পোয়াতি হয়, প্রসব করে কষ্টের নীল ভোর! 
বিশ্বাসের দেয়ালে লতিয়ে উঠে আস্থাহীনতার হেমলক,
ভালোবাসার বৃন্দাবনে চাতুর্যে নঙ্গর ফেলে রূপের সওদাগর!
কাঁচা রূপায় রূপের বিকিকিনি!
বানিজ্যের বেদিতে খুন ভালোবাসা!
সওদাগর বানিজ্য বুঝেন বটে! 
নিংড়ানো মথিত ভালোবাসা চাটে বণিকের জিহ্বা!
রাতের আঁধার বাষ্পরুদ্ধ হয় প্রেয়সীর অনুশোচনার দীর্ঘশ্বাসে।
বাতাস সেই দীর্ঘশ্বাসগুলি জোছনার নীল মাখিয়ে আমাকেই পাঠায়!
আমি শুধু বোবাদৃষ্টিতে চেয়েই থাকি!
তাঁকে ধরে রাখার অক্ষমতার আক্ষেপ নখ বসায় হৃদৎপিণ্ডে!
পিঠে যুগপৎ চাবকিয়ে যায় আফসোস ও দৈন্যের চাবুক!

রুপা সাধুখা'র চারটি কবিতা














অনুভূতি


অনুভূতিদের আসতে দেরী হলো
অপ্রয়োজনীয় সম্পর্কের শব যাত্রায় ব্যস্ত ছিল বলে ।
শেষ ছাইটুকু দেখার ইচ্ছেতে
শ্বশান অবধি গিয়েছিল ,
তারপর নিঃসঙ্গ একাকী পথে
হাঁটতে হাঁটতে
আকাশকে ছোঁয়ার বাসনায়
দেরী হলো
বড়ো বেশী দেরী হলো ।
রাতের আঁধারে চাঁদ ডুবে গেলে
হাওয়াদের স্পর্শে
উষ্ণ অনুরাগে
অনুভূতিরা জেগে থাকে
ভালোবাসাকে ভালোবেসে ।



বুনন

মেঘ ছিলো, ছিলো কিছু রোদ্দুর
আকাশে আকাশে, কিছু সুখের সাথে
ছিলো কিছু এলোমেলো দুঃখ একাকার
মিলেমিশে।

পরিপাটি চোখের কাজলে
গোপন বিষাদ ঢেকে
ফুলশয্যায় ডুব দিলো
যে মায়াবতী মেয়ে,
সে এখন গোধুলী উঠোনে
রূপকথা কুড়োয় হাওয়ায়
হাওয়ায় একঢা্ল এলোচুল মেলে।

দীঘির শান্ত জলে রোদ মরে এলে
কুহকিনী পিছু ডাকে কাঁচপোকা টিপ,
ডুরে শাড়ীর জমিনে থৈ থৈ অন্ধকারে
ভাসে তার জলজ প্রেম। শাপলা বিকেলে
দুরন্ত যুবা এক ছায়াঘন মেঘ এঁকে
পানকৌড়ি হৃদয়ে বলেছিলো,
"পাশে থেকো।"

দূরে থাকা কি শুধুই দূর
দুঃখনীল ক্যানভাসে ?
ভুলে থাকা মানে ভুলে যাওয়া
নির্জন অবকাশে ?
নাকি নিরন্তর বুনে চলা
নীলাভ এক রেশমী প্রহর
অভিমানের বিনি সুতোয় ?


খুন !

এইতো একটু আগেই প্রত্যাখানের ছুরিতে
নিজ হাতে গলা চিরে খুন করে এলাম
আমার ভালোবাসা পূর্ণিমা চাঁদের তিথিকে।
দেবতার মুখোশের আড়ালে প্রতারক
দন্তবিকশিত হাসির ফোয়ারা তার
দিয়েছি চাপা ক্রোধের বজ্রনির্ঘোষে।

চেনা সময়ের মোলায়েম হাতে
পরিয়েছি অচেনার হ্যান্ডকাফ।
তস্করের হাতে দিয়েছি তুলে স্বেচ্ছায়
জীবনের ভল্টে সঞ্চিত সুখের ডিপোজিট।
ব্ল্যাঙ্ক চেকে সই করে সজ্ঞানে
ভালো্বাসাকে দিয়েছি নির্বাসন দ্বীপান্তরে।

রক্তমাখা আমার আততায়ী দু'হাতের পানে চেয়ে
মৃদু হেসে স্মৃতিরা বলে, " বেশ তো, যাবজ্জীবন দণ্ডে
দন্ডিত আসামীর চোখের জলে সিঞ্চিত হোক তবে
আগামীর দীর্ঘশ্বাসের কচি পাতা বিটপির কান্ড-মূল।"


ইচ্ছেগুলো

ইচ্ছেগুলো সেই আগের মত
উত্তাল বসন্তে প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য
ঝকঝকে কুঁড়ি হতে চায় না
শরতের শাদা বিকেলে কিংবা জাফরানি সন্ধ্যায়
ঘুড়ি হয়ে আকাশে ওড়ার কোন তাড়নাই নেই
এলোমেলো বরষায় বিষ্টির ফোঁটা হয়ে
মাটির বুকে একাকার হতে বড্ড অনীহা
পূর্ণিমায় জ্বলজ্বলে স্ফটিকরাতে
চায় না হতে পাগলকরা তারকাপুঞ্জ
কিংবা নিস্তব্ধ অমাবস্যায় ক্ষুদ্র আগুনের জোনাকি
অথবা মোলায়েম ভোরে ভৈরবীর মোহময় তান
কি জানি, হয়ত কোন এক ঝড়ো দুপুরে
বোঁটা ছিঁড়ে গেছে না ফোঁটা কুঁড়ির
ঘুড়িটাও হয়ত গোৎ খেয়ে পড়ে গেছে
আকাশের বুকে খরা, অজানা গন্থব্যে মেঘ
তারা খসে গেছে এক নিকষ রাতে
এখানে ওখানে ঝোঁপ ঝাড়ের স্বল্পতা
সুর হারিয়ে গেছে বেসুরের মাঝে
ইচ্ছেগুলো সেই আগের ছটফটে রূপে নেই
কেমন নিস্প্রভ নির্লিপ্ত নিশ্চুপ ।


কৃষকতা ।। ভাস্কর চৌধুরী




















কৃষকতা

এই দিন
উথাল পাথাল দিন
ধানগুলো বীজ ফেলে যায়, 
ধানগুলো সব বীজ রেখে যায়
বাদল দিনে উথাল পাথাল কাব্যখানি
জলের জটায় ভাসছে সাপের একটা মাথা
শরীর ছিলো জলের নিচে
পদ্মারাগে বলেছিলো সেই বিবাগী
উথাল পাথাল বর্ষা ঝরে
এমন দিনে মাটি কেবল
বীজের কথা বলেছিলো পাতার কাছে
ঘরের ভেতর আগুন ছিলো, 
কৃষ্ণনাভি খুলেই এবার বলেছিলো
আয় বুকে আয়
আমার কাছে আমার দেহে আলাপ আছে।
সেই আলাপে পড়েই আমি 
ভিজে গেলাম বীজের কৃষক
কৃষকতা ভিন্ন আলাপ
ভিন্ন সুরে বাজিয়ে দিলো ভিল রমণী।

যে ভাষা কথা বলে ।। নাসির ওয়াদেন












  যে ভাষা কথা বলে  

       

যে ভাষা কথা বলে সে আমার প্রাণ
রক্ত দিয়ে, সহিষ্ণুতার কাঁটা বিঁধেয়ে
গোলাপ ডালে ঝুলে থাকে
বলে,আমায় ছুঁয়ে দেখো ---

ভেতরে কিলবিল করে বিশ্বাসের দৌড়
জীবন্ত প্রাণের কালোভোমর

বিচিত্র ফুল ফোটে নরম বিলাসী  বাতাসে

ভালবাসা বিছিয়ে বিছিয়ে বুঝে নিও
এখনও অনেক রোদ বাকি ---

পথ হেঁটে হেঁটে চলে•••

গোধূলির বিবর্ণ শরীর জোৎস্নার জনস্বার্থে
আহত শব্দের পাশে দাঁড়িয়ে,বিরক্তির অক্ষর
লাশ হয়ে ভেসে যায় লগ্নভ্রষ্টা জলে,
ক্ষণিকের চাঁদ উত্তাপ দিয়ে রাখে

শুধুই রক্তমাখা ভাষা প্রজ্ঞাজলে মুখ ধুই
কথা বলে সভ্যতার মৃত ঢিবিগুলো••••

বদলে বদলে গেছে শরীর বাঁধন
কণ্ঠধ্বনি থেকে সুর লহরী অবধি
এবার মুক্তি দাও,প্রাণ খুলে হাসি
কথা বলি, কথা বলি দারুণ আক্ষেপে ---

মায়াবী অন্তর্জাল ।। সীমান্ত হেলাল



















মায়াবী অন্তর্জাল


আজ
এমন
করে
করিসনে বারন
পাগল হতে;
যদি 
হই
খুন
তোকে ভালোবেসে 
ক্ষতি কি তাতে!
আজ
কোন
কারনে
হোসনে তুই
চোখের আড়াল,
মনের
খুব
কাছে
ছায়া হয়ে থাকিস
মায়াবী অন্তর্জাল।

আ ব্ল্যাক পোয়েট ফ্রম দ্য ক্যারিবিয়ান ।। সুনীতি দেবনাথ









আ ব্ল্যাক পোয়েট ফ্রম দ্য ক্যারিবিয়ান 



'আ ব্ল্যাক পোয়েট ফ্রম দি ক্যারিবিয়ান '—
নিজের ও দেশের আইডেনটিটি সন্ধানী 
অতলান্তিক সামুদ্রিক দুটি চোখ, 
তৃণগুচ্ছের শিশির বিন্দুর বিন্যাসের বিলাস থেকে 
কৃষ্ণগহ্বরের বিপুল গভীরতা দর্শনে সক্ষম। 
আকাশের বিষণ্ণ নীল আর
সমুদ্রের গম্ভীর গর্জন দেখে নিতে
অনুভবে তন্নতন্ন করে গেঁথে নিতে
শুধু সেই কবিই সক্ষম ছিলেন। 
এ এক বহুমাত্রিক চেতনার প্রকাশ! 
সমুদ্রশাসিত কবি অতলান্তিক চেতনায়
ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটি ছোট্ট দ্বীপ
সেন্ট লুসিয়ার ক্যাস্ট্রিজ শহরে জন্মেছিলেন,
বিশ্বকে বিস্মিত করে পেলেন নোবেল পুরস্কার, 
ক্যারিবিয়ান কবি ডেরেক অনটন ওয়ালকট। 

আজন্ম সমুদ্র - প্রেম পার্থিব দর্শন
ইংল্যান্ড আফ্রিকীয় শিকড়ের টান
ছিঁড়েখুঁড়ে নতুন সত্তা গড়েছিলেন, 
জীবনকে দেখেছেন কত না বিচিত্র আবহে, 
তাঁর বর্ণিল চেতনার বিস্তারের পরিধি বহুমাত্রিক। 
সেই দ্বীপ সাম্রাজ্যে ঔপনিবেশিক শাসন ছিলো , 
সৃষ্টির আখ্যানে বিরল জাদুর একক চেতনা 
গড়ে উঠেছিল ঈশ্বরের মত স্বয়ম্ভূ এককে। 

'আ ব্ল্যাক পোয়েট ফ্রম দ্য ক্যারিবিয়ান '
অমরত্ব - আইডেন্টিটি দিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে, কলম্বাসের আবিষ্কৃত সে দেশ  আমেরিকার উপনিবেশ হয়েছিল।
ইতিহাসের পরিব্রাজক তিনি আফ্রিকা ইংল্যান্ডের শিকড় ছিঁড়ে খাঁটি ক্যারিবিয়ান! 
দ্বীপজ মৃত্তিকার অতল গভীরে শিকড়ের জাল পেতে ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান জেলে,বেশ্যা, ভূমিপ্রভুদের নিখুঁত
টাটকা তুলে এনেছেন সুদক্ষ জেলের মতন।
অথবা এ যেন ইতিহাসে মহা পরিভ্রমণ, তীর্থযাত্রা।
'ওমেরস '(Omeros) মহাকাব্যিক কবিতা
ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান ইতিহাস পরিভ্রমণের
সেই মহান তীর্থযাত্রার কবিতা,
আলোড়ন তুলেছিলো নোবেল প্রদান কমিটিতে। 
সমগ্র পৃথিবীর বিচিত্র সংস্কৃতি যাত্রার প্রভাব আবিষ্কার
আর হালের ক্যারিবিয়ান
আইডেনটিটি গঠনে এতে কতখানি প্রভাবিত
তারই সন্ধানী ছিলেন ওয়ালকট।  
ইতিহাসের বিবর্তন আর ক্যারিবিয়ানদের প্রতি
সমুদ্র সমুুদ্র ভালোবাসা কবিতার পূণ্যশ্লোক হয়ে
কবিকে আন্দোলিত করেছিল, কারণ তিনি জানতেন
কবিতা জীবন সাধনার মার্গ ও মন্ত্রোচ্চারণ, 
ক্যারিবিয়ানদের উন্মত্ত সামুদ্রিক তরঙ্গের
অভিঘাত মুখর নোনা মৃত্তিকায় শিকড় মেলে
পূর্বজ অত্যাচারী ইংরেজ আফ্রিকানদের
ঘৃণা করেছেন নোবেলজয়ী কৃষ্ণাঙ্গ কবি ওয়ালকট।

কবিতার শরীরে অনুরণন কেবলই
ঐতিহাসিক বর্ণিল ঘটনার,
নিয়ামক এরা কাব্যিক সৃজনে।
আফ্রিকায় পূর্বপুরুষদের  ক্রীতদাসদের আক্রমণ,
ইউরোপীয় আক্রমণ নেটিভ আমেরিকানদের, ফ্রান্সের যুদ্ধজাহাজ ব্রিটেনের ওপর —
এসব আরো কতসব কুৎসিত
হত্যা মৃত্যু প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়, 
ধাক্কা দেয় তাঁকে শোসণকারী উপনিবেশের পত্তন।
হায় ক্যারিবিয়া! হায় ক্যারিবিয়ান!
দ্বীপ- সমুদ্র সঙ্গমজাত বিচিত্র সংস্কৃতির জনগণ, ক্লিন্ন ক্লেদাক্ত পরিচিতির, 
মৌলিক সত্য মিস্টিক জাদুময়তা, 
তাঁর সৃষ্টির চত্বরে চত্বরে অভিনব অনুরণন তোলে । 
কবি আইডেনটিটির সন্ধানী,
ক্যারিবিয়ানদের মাঝে জন্ম আইডেনটিটি হারিয়ে গেছে তার ঘৃণ্য পরিচয়ে। 
কলোনিয়াল সম্মোহনী ঐতিহ্য ওয়েস্ট ইণ্ডিজের
আকাশে বাতাসে সমুদ্রে মাটিতে প্রবাহিত দুরন্ত গতিতে, 
ক্যারিবিয়ানদের নিখাদ ভালোবাসাই নিয়ন্তা হলো, 
ঔপনিবেশিক ইংরেজ শঠতায় ঘৃণ্য হলো ত্যাজ্য  হলো।
ওয়ালকট দ্বীপজ জাদুবাস্তবতা থেকে
সৃষ্টির ঔদ্ধত্যে প্রতিভার সুকঠিন প্রাবল্যে
বেরিয়ে এলেন দুরন্ত পদে—
কারণ তিনি জানতেন ভাষা তার প্রভু ভৃত্যের চেয়ে উচ্চে,
আর কবিতা শ্রেণী, জাতি, অহমের বিরুদ্ধে শাণিত অস্ত্র, 
এই অস্ত্রবলে  সব সীমা পেরিয়ে কবি  স্বকীয় আইডেনটিটি গড়ে তুলতে সক্ষম।

কৃষ্ণকায় দুর্ধর্ষ কবি, ডেরেক ওয়ালকট,
'আ ব্ল্যাক পোয়েট ফ্রম দ্য ক্যারিবিয়ান ',
সমুদ্র বেষ্টিত দ্বীপজ ক্যারিবিয়ানদের আইডেনটিটি, পরিচিতি, সংস্কৃতি, জীবন ও যাপনের কঠোর বেদনা,
অত্যাচারিত নোনা জলের ইতিহাস নিয়ে কবিতা লিখলেন।
নির্যাতিত সেই আদিবাসী জনের ডায়ালেক্ট স্বচ্ছন্দে
ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার করে সাবলীল মহান সৃষ্টি করলেন।
ওয়ালকট বিশ্ব কবিতার সুমহান একক স্রষ্টা জাদুকর।
তাঁকে কবিতার কোন স্কুলের বা গোষ্ঠীর বলা যাবে না। 
নোবেল বিজেতা তাঁকে মৃদুকণ্ঠে হয়তো কেউ কেউ বলেন — ন্যাচারালিস্টিক, এক্সপ্রেশনিস্টিক, সুররিয়ালিস্টিক, ইমেজিস্টিক, হারমেটিক অথবা কনফেশনাল কবি,  বা মেটাফিজিক্যাল রিয়ালিস্ট।
একটা কথা কিন্তু সবার জানা
বিশ্ব কবিতার অবিসংবাদিত মহান জাদুকর তিনি। 




মানিব্যগ জাদুঘরে জমা ।। ইউসুফ তাপস














মানিব্যাগ জাদুঘরে জমা 



আপেলের দোকানে দাঁড়িয়েছি
ভুল ক্রেতা
তিন আঙুলের ভাঁজে দুয়েকটি আঙুর
আহা, শিহরণ!
প্যাকেট প্যাকেট আপেল
প্যাকেট প্যাকেট কমলা
প্যাকেট প্যাকেট আঙুর
নিয়ে যাচ্ছে ওরা
দেখছি অজস্র উজ্জ্বল মুখ
আমার মানিব্যাগ বহু আগেই জাদুঘরে জমা;
কপালে এঁকেছি বিষণ্নতা
তবুও মুগ্ধ দর্শক...
ক্রেতারা চলে গেছে যে যার মতো
দোকান পুরোপুরি ফাঁকা
ঝাঁপি নামিয়ে দিচ্ছে বিক্রেতা

জোনাকীদের ফড়িংহাত ।। দ্বীপ সরকার












জোনাকীদের ফড়িংহাত


কিছু তারা দেউড়িখুলে নিতম্ব ছুঁয়ে বসে আছে;
ঝকঝকে নীল এবং গেরুয়া রঙা আকাশ,
সমুদ্রবিপনীরা ঝাপি তুলে বিক্রি করছে কিছু শোকাবহ রাত;

এই নীরবতাকে ঠোঁটে তুলে নিলো জোনাকী,
কবর পাড়ের উচ্ছন্নে জোনাকীদের ফড়িংহাতে বাজছে একতারা - দোতরা ;

কিছু বন্ধ্যা কুকুর এসে কামড়ে দিলো জোনাকীদের স্তন;
দেউড়ি খোলা তারারা সব দেখছে..

জনৈক তারকা মেঘপাখির লেজে গুঁজিয়ে দিলো আবাবিলের পাথর,
ইভটিজার কুকুর পাথরের বর্ষণে বিনাশ হচ্ছে- এবং
জোনাকীদের ঠোঁটে জমা হচ্ছে অবশিষ্ট আতঙ্ক ;

লেখাঃ ১০/১২/১৭ইং

নষ্ট কুটুম ।। রেবেকা রহমান















নষ্টকুসুম


অতঃপর তাহারা সুখে কালাতিপাত করিতে লাগিল। এমন রুপকথার কথাগুলি যদি কথা হতো? তাহলে এত অসহিষ্ণুতা আমাদের গ্রাস করতোনা। আমাদের আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবই কি আমাদের দুরত্বের জন্য দায়ী নয়?
দাম্পত্যর মধু আর তার সুলুকসন্ধানের জন্য সত্যি কি দারস্থ হওয়া যায় কোন
জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কাছে? যেদিন আমাদের পেপারে আমরা সাইন করলাম। আমাদের সেপারেশন হয়ে গেলো। কানাঘুসা চারপাসে
: ইস! এমন রাজযোটক, বড় প্যাথেটিক ব্যাপার!
: সেই তো আমরা তো ওদের সুখী দম্পতি বলেই জানতাম।
আমরা কিন্ত নির্বিকার ছিলাম। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আলাদা দুই ফ্ল্যাটে দুইজন। তারপর আলাদা শহর আরো পরে আলাদা
দেশ...
আজ বুঝি দুইজনের অসম্ভর কেরিয়ারিস্ট
ছিলাম বলেই আমাদের একসাথে থাকা হলোনা। আমাদের একে অন্যকে সময় দেয়ার অবকাশটা বলো ছিলো কোথায়? 
সেখানে সন্তানের ভাবনা বলাবাহুল্য।
এতদিন পরে আজ তোমার ফোন পেয়ে
আমি এত বিহ্বল হয়ে গেছি। তুমি আমায় দেখতে চেয়েছো জ্যোতিষ্মান! আমার আপাদমস্তক এভাবে দুলে উঠলো কেন?
প্রাক্তন স্বামীর জন্য এভাবে এতদিন পর এত অস্থিরতা!
আজ এই প্রথম মনে হলো আমি বড় একা..
" ভালবাসার অষ্ট প্রহর " যৌথ অণুগল্পের বই

বীর গাঁথা ।। আসমা মতিন











বীরগাথা

এক মহাদুর্যোগের ক্রান্তিকালে মাটির মানুষেরা
আপন মাটিতে জ্বলে উঠলেন দাউ দাউ করে,
জ্বলে উঠলেন আগুনের চোখে!
ঘাতক বুলেটে বিচুর্ণ হলো কারও কার মাথার খুলি,
বুকের তাঁজা শোণিত ধারা
গ্রন্থিল মাংশপেশি ছিন্নভিন্ন হলো নাড়ীভুঁড়িও!
রাজপথে আর্তনাদ করে উঠেছিল পবিত্র দেহাংশ!
থেমে যায় কবিতা পাঠ,
পাখীর গান,নদীর কলতান!
রক্ত গঙ্গায় অবগাহন করেন বীরগণ,
পলাশ রাঙ্গা জামা পরে এক ফাগুনে তাঁরা উঠে আসেন শ্রেষ্ট বীর,রাজার ভেসে
ছিনিয়ে আনেন বর্ণমালার যতার্থ সম্মান!
সভ্যতার সভ্য সভায়,আবার ও হয় কবিতা পাঠ
পাখী গায় গান,
এই যুগে বাংলায় লেখা হয় বৈদেশিক সড়কের নাম!

অনুবাদ কবিতাঃ মশা ।। মাহমুদ দারবিশ ।। অনুবাদ ।। অরণ্য আপন










মশা
------

মূলঃ মাহমুদ দারবিশ ( ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি) 

বাংলায়নঃ অরণ্য আপন

মশাটা, যার
আরবিভাষায় কোনো পুরুষ শব্দ আছে নাকি আমি জানি না 
মশা একটা সেলেন্ডারের চেয়ে 
একজন ট্রামের চেয়ে ভয়ানক 
সে শুধু তোমার রক্ত খেয়েই সন্তুষ্ট হবে না
তোমাকে একটা ফলহীন যুদ্ধে নামাবে 
তোমার কাছে অন্ধাকারে আসবে 
যুদ্ধজাহাজের মতো তোমার কানের কাছে ঘ্যানরঘ্যানর করবে যা
তোমার রক্ত চুষে খাওয়া অব্দি তুমি শুনতে পাবে না 
তুমি যখন বাতি জ্বালিয়ে দিবে
সে অদৃশ্য হয়ে যাবে 
ঘরের কোণায় নিজেকে আড়াল করবে 
দেয়ালের সাথে ভাব জমিয়ে মিশে যাবে 
একটা নিরবতা, শান্তি আসবে
যেন সে চলে গেছে 
তুমি পায়ের জুতা দিয়ে মারতে চাইবে
সে তোমাকে ধন্দে ফেলিয়ে দিবে
ছলনার ফাঁদ পাতাবে
তুমি চিৎকার দিয়ে শাপ শাপান্ত করবে
কিন্তু সে কানেই নিবে না 
তুমি হয়তো নরম গলায় বন্ধুর মতো একটা বোঝাপড়া করে নিবে যে
তুমি ঘুমাও, আমিও ঘুমাই
তোমার মনে হবে যে তুমি তাকে বুঝাতে পেরেছ
তুমি বাতি নিভিয়ে দিলে 
এবং তুমি ঘুমাতে নিলে
সে তোমার রক্তে খেয়ে আবার গুনগুন করে গান ভাজতে শুরু করবে
তোমার মেজাজ চড়ে যাবে
তোমাকে সে সহায়ক একটা যুদ্ধে আবার নামিয়ে ছাড়বে 
তুমি ঘেমে গেছ
তুমি চড়ে গেছ 
তুমি আবার বাতি জ্বালিয়ে দিলে
তুমি মশা আর ঘাম
দুটোরেই চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়লে 
মশাটা তোমার খোলা বইয়ের ওপর বসে পড়ল
তুমি খুশি খুশি ভেবে নিলে যে এটা একটা ফাঁদ
তুমি বইয়ের মুখ বন্ধ করে দিলে 
চেঁচালে, আমি মেরেই ফেলব
আমি শেষ করে ফেলব 
তুমি যখন বইটা খুললে
দেখতে পেলে সেখানে কোনো মশা নেই
কোনো অক্ষর নেই
পুরো বই ফাঁকা 
মশাটা, যার আরবি ভাষায় কোনো পুরুষ শব্দ আছে নাকি আমি জানি না 
এটা কোনো রুপক নয় 
এটা কোনো বিভ্রান্তি নয়
এটা কোনো শব্দের খেলাও নয় 
এটা একটা কীট
যে তোমার রক্ত পছন্দ করে
বিশ মাইল দূরে থেকে রক্তের গন্ধ পায় 
তুমি রেহাই পেতে পার একমাত্র যুদ্ধবিরতি দিয়ে
তোমার রক্তের গন্ধ পাল্টে দিয়ে।

বই আলোচনাঃ কবি সুশান্ত হালদার ও তার কাব্যগ্রন্থ "নক্ষত্রের পতন"।। পার্থ মল্লিক

কবি সুশান্ত হালদার ও তার কাব্যগ্রন্থ "নক্ষত্রের পতন"

আলোচকঃ পার্থ মল্লিক


কবি সুশান্ত হালদার। জন্মগ্রহণ করেছেন মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার সুতালড়ী গ্রামে, ১৯৭৪৪ সালের ১০ জানুয়ারি।  কবি সুশান্ত হালদার বর্তমান সময়ের নবীন কবিদের মধ্যে একটি অন্যতম নাম। আমার জানামতে তিনি প্রধানত একজন প্রতিবাদী কবি। তার প্রতিটি কবিতাতেই ফুটে ওটে বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তাছাড়াও কবির কবিতায় দেশপ্রেম, বিরহ, অন্তঃর্জ্বালা প্রভৃতি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। কবি সুশান্ত হালদারের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সংখ্যা ৯ টি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো- মুক্তির গান, লাল সবুজের ভালোবাসা, অনির্বাণ, ধূলিঝড়, নীলা, স্মৃতির দেয়াল, নির্বাক ভালোবাসা ও রক্তাক্ত জমিন। কবিতায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ইতোমধ্যে কয়েকটি পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

এবার তার কাব্যগ্রন্থ "নক্ষত্রের পতন" নিয়ে আলোচনা করা যাক----
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮ উপলক্ষে অন্যধারা পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থটি। এই গ্রন্থটি মূলত প্রতিবাদ, প্রেমবোধ ও বিরহের বন্ধনে গড়া একটি স্বার্থক কাব্যগ্রন্থ। "নক্ষত্রের পতন" শিরোনামের কবিতাটি পাঠ করলেই বোঝা যাবে, কবি কতো সুন্দরভাবে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের ভালোবেসে অবেলায় পতন, তার আশা, দেশের প্রতি তার প্রেম ও ভালোবাসা ফুটিয়ে তোলেছেন। নিচে পাঠকদের জন্য "নক্ষত্রের পতন" কবিতাটি উপস্থাপন করা হলো-


অন্ধকার আকাশে কোনো নক্ষত্রের
যদি হয় পতন কোনোকালে
জানিও প্রিয়ে, জীবন সায়াহ্নে
হয়তো কিছু অব্যক্ত কথা চেয়েছিলো বলতে তোমাকে!
হয়তো ভাববে সবাই-এ তেমন কিছু নয়
এ রকম ঘটে প্রতিদিন প্রতিরাতে!
কিন্তু তুমিতো জানো
 এ নক্ষত্র আরো কিছুকাল চেয়েছিলো থাকতে ঐ নীলাকাশে
যেখানে তারাদের উজ্জ্বল বিভায়
চেয়েছিলো নিজেকে উজ্জ্বল করে রাঙাতে!

যদি হয় পতন নক্ষত্রের পতন এ বাংলার মাটিতে
নিজেই হবে ধন্য এ নদী নারী দূর্বা লতা ঘাস ভালোবেসে
যদি হয় পতন এ নক্ষত্রের কোনোকালে
জানিও প্রিয়ে, জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে
দিয়েছিলো কিছু আলো বাংলার আকাশ ভালোবেসে
যদি দেখো সন্ধ্যাকাশে তারাটিও নেই নৈঋত কোণে
জানিও প্রিয়ে, ধূপের গন্ধে সেও না হয় এসেছিলো
তোমার পরশে জ্বালবে বলে।



.
কবিতাটি পাঠের পর খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, কবি তার কবিতায় নক্ষত্রকে উজ্জ্বল তারুণ্যের সাথে তুলনা করেছেন। আমরা জানি তরুণেরা অনেক আশাবাদী হয়। জীবনে অনেক বড়ো কিছু করতে চায়। কখনো কখনো তারা প্রকৃতির প্রেমে পড়ে। বয়ে যাওয়া নদী, নারীর রূপ, চিরসবুজ ঘাস এসব তাদের মুগ্ধ করে। তারা মাতৃভূমিকে নিজের মায়ের মতোই ভালোবাসে। তরুণরা দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলে। কিন্তু কখনো কখনো জীবন থমকে যায়। দেশের জন্য অনেক সময় তরুণরা নিজের বলিদান দেয়। আমাদের সমাজ অন্যায় আর অবিচারে ভরে আছে। আর তরুণরাই তার প্রতিবাদ করে। কিন্তু কখনো কখনো ক্ষমতাসীনদের শক্তির মুখে তার জীবন দিতে হয়। তবু তারা পিছ পা হয়না কখনো। কারণ, তারা কখনো হারতে জানে না। নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে এক অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
এই কবিতায় কবি তরুণের প্রেম, বর্তমান সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তার বলিদান, কিছু আশা খুব সুন্দর ভাবে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন। তবু তরুণরাই বিজয়ী, উজ্জ্বল নক্ষত্র।


হে মানবী! করেছো দুরাশা
দিয়েছো অঢেল প্রেম ভালোবাসা
করেছো নিষ্কণ্টক দান
চাওনি তো কভু প্রতিদান
তবে কেনো আজ দীপাবলি জ্বেলে
অশ্রুজলে আঁখি ভেজাও? (সংক্ষেপিত)

এই কবিতায় কবি এক সবুজ প্রেমের গল্প তুলে ধরেছেন। যে কোনো কিছুর চাওয়া পাওয়া ছাড়াই শুধু ভালোবেসে গেছে, কোনোদিন কোনো প্রতিদান সে চায়নি। তবু শেষ পর্যন্ত সেই মানবী অশ্রুজল ফেলে গেছে।


যদি যাই চলে
এই বাংলা ছেড়ে কোনোকালে
জানিবে আমিও ছিলাম
এই আকাশ বাতাস মাটি ভালোবেসে। (সংক্ষেপিত)

আহা, কতো মধুর দেশপ্রেম প্রিয় কবির। তিনি একদিন ঠিকই চলে যাবেন। কিন্তু চলে যাওয়ার পরও তিনি থেকে যেতে চান এই বাঙলার আকাশে, বাতাসে, মাটিতে। কতোটা দেশপ্রেম থাকলে এভাবে লেখা যায়, তা আপনারাই ভালো করে বিচার করবেন। যার হৃদয়ে দেশের জন্য এতো ভালোবাসা, তিনি তো বাঙলাতেই মিশে থাকবেন।

আমরা কবি সুশান্ত হালদারের নক্ষত্রের পতন কবিতাটি এবং বাকি দুটি কবিতার কিছু অংশ পাঠ করেই বোঝতে পারি, কবির লেখা কতোটা শক্তিশালী, কতোটা সুতীক্ষ্ণ। নক্ষত্রের পতন কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই এভাবে সাজানো। সবগুলো কবিতাই কবিতা প্রেমিকদের সঠিক কবিতার স্বাদ দেবে আশা করি। পাঁচ ফর্মার এই বইটিতে মোট ৬৭ টি কবিতা রয়েছে। শিল্পি মোতালেব হোসেনের প্রচ্ছদে, ঝকঝকে কাগজ ও চমৎকার বাঁধাইয়ে বইটি সকলের মন কেড়ে নেবে। বইটির মূল্য ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। গ্রন্থটি এবারের বইমেলায় অন্যধারা পাবলিকেশন্সের ( স্টল নং-) স্টলে পাওয়া যাবে। পরিশেষে কবি সুশান্ত হালদারের জন্য অনেক শুভকামনা ও ভালোবাসা রইলো। কবির কবিতা আরো শক্তিশালী ও দীর্ঘজীবী হোক।