বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

প্রবন্ধঃভাষা নিয়ে বিশিষ্ট্য জনদের ভাবনা ।। রহিমা আক্তার মৌ

ভাষা নিয়ে বিশিষ্ট্য জনদের ভাবনা




রহিমা আক্তার মৌ
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে বাংলাসহ আরো ৪টি প্রদেশের মুসলমানেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মুসলমান প্রধান রাষ্ট্র সমূহ গঠন করা হবে। আর এ রাষ্ট্র সমূহের অন্তর্ভূক্ত ইউনিটগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত এবং সার্বভৌম। কিন্তু ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে অধিবেশন বসলে সব উলোট পালট হয়। বলা হয় শব্দটি স্টেটস হবে না, হবে ষ্টেট। ভুল করে টাইপ করার সময় একটা এস এসে বসে গেছে। তার মানে ভারতের মু্ষলিম প্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে হবে মাত্র একটি রাষ্ট যার নাম পাকিস্তান। হিন্দু-মুসলমানদের ভৌগোলিক অবস্থানগত জন সরকার নিরিখে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয় দুটি অংশে ভারত ও পাকিস্তান। আর পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আগেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা প্রসঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়।

উর্দুর পক্ষে উসকানি মুলক বক্তব্য দিয়ে বাঙ্গালীর ভাষা সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটান আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়া উদ্দিন আহমদ। তার বক্তব্যের লিখিত প্রতিবাদ জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। বাঙ্গালি জাতির এক অসাম্প্রদায়িক সহিষ্ণু চেতনার পথে লড়াই শুরু হয় এখান থেকেই। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা ‘বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তমদ্দুন মজলিস।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গনপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম অধিবেশনেই প্রস্তাব করেন। পরিষদের কার্যক্রম ইংরেজি ও উর্দু ভাষার সাথে বাংলা ভাষাতেও পরিচালিত হোক, তাঁকে সমর্থন করেছিলেন সদস্য রাজকুমার চক্রবর্তী।

১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। যুক্তি আর বাস্তবতাকে মূল্যায়ন না করে মগজে শুধু স্লোগান রাখলেন, ২১ মার্চ রেসকোর্স মাঠে ইংরেজিতে বক্তৃতা করে বলেছিলেন, “তোমাদের পরিস্কার বলে দিচ্ছি পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু আর অন্য কোন ভাষা নয়। কেউ যদি এর বিরোধিতা করে মনে করতে হবে যে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু। ২৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে ও তিনি একই প্রস্তাব করেন। সেদিন-ই জিন্নার প্রস্তাবের বিপক্ষ নেয় এবং না সুচক শব্দ বের হয়। 

মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদা দেয়ার জন্য অনেক আন্দোলন হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি হরতাল হয়েছে। মার্চ মাসের ১৩,১৪ তারিখেও ছিল হরতাল। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারিতে ধর্মঘট ডাক দেওয়া হয়। ৩১ জানুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সর্বদলীয় সমাবেশ হয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের হরতাল হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদের রাজেট অধিবেশন, তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি পেশ করার দিন ধার্য হয়। কিন্তু নূরুল আমিন সরকার ২০ তারিখেই ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে দিল। 

 ২১ তারিখে দলে দলে ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে উপস্থিত। ১৪৪ ধারা অমান্য হবে কিনা এ নিয়ে আগের দিন অনেক জটলা হয়। ১১ জন ছিল আইন অমান্য না করার পক্ষে আর ৩ জন ছিল অমান্য করার পক্ষে। কিন্তু ২১ তারিখের বেলতলার ছাত্র সভায় সাধারণ ছাত্ররা সম্মিলত ভাবে ১৪৪ ধারা অমান্য করে পথে বের হবার পক্ষে রায় দিল। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার কারণে পুলিশের কাদাঁনে গ্যাস আর বুলেটের সামনে পড়ে ছাত্র জনতা। ঘটনাস্থলে শহীদ হন আব্দুল জব্বার ও রফিক উদ্দীন আহমেদ। আহত হন আরো ১৭ জন। এর পর পরই শহীদ হন আবুল বরকত। ২২ তারিখ গায়েবানা নামাজ শেষে প্রতিবাদ মিছিল বের হলে সেখানেও পুলিশের গুলি চলে সেখানে শহীদ হন শফিউর রহমান।

 ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রনীত হয়। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি লাভ করে। স্বীকৃতি পাওয়া বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের বিশিষ্ট্য জনেরা বিভিন্ন ভাবে মত প্রকাশ করেছে,,,,,,,“রাষ্টভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, মুলতঃ শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এই দিনই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষেদের অধিবেশনে উর্দুকে পাকিস্তানের এক মাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এক মাত্র কুমিল্লার শ্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্তই উদুর্কে একমাত্র রাষ্ট ভাষা করার প্রতিবাদ করেন এবং উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি জানান। কোন বাঙ্গালি মুসলমান প্রতিবাদ করেনি। এটা লজ্জা জনক ইতিহাস। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোল শুধুমাত্র ভাষার আন্দোলন ছিল না। বাঙ্গালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন এর সাথে জড়িত ছিল।” কথা গুলো বলেছেন বঙ্গ বন্ধুশেখ মুজিবুর রহমান। 

তিনি আরো বলেন,,,,,
“ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষনা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহনের দিন থেকেই সকল সরকারী অফিস, আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করবোনা। কারন তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না। এ অবস্থায় হয়তো কিছু কিছু ভুল হবে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসেনা। এ ভাবেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে।” (১৯৭১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আজাদ, সংগ্রাম, ইত্তেফাক সুত্রে)।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাতৃভাষা চর্চার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বলেছেন,,,,,,,
“আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি এই যে, আমরা সবচেয়ে কাছের মানুষটিকেই সবচেয়ে কম জানি। আমরা ইংরেজদের কৃপায় ইংরাজি, গ্রিক ভাষা জানি, ইতিহাস জানি, তাদের সভ্যতার খবর নিই, কিন্তু আমারই গায়ে লাগিয়ে সে প্রতিবেশীর ঘর তারই কোন খবর রাখিনে বা রাখার চেষ্টা করিনে। বরং ঐ না জানার গর্ব করি বুক ফুলিয়ে। কোন মুসলমান যদি তার সভ্যতা ইতিহাস ধর্ম শাস্ত্র কোন কিছু জানতে চায় তাহলে তাকে আরবি ফার্সি বা উর্দুর দেয়াল টপকাবার জন্য আগে ভাল করে কসরৎ শিখতে হবে। ইংরেজী ভাষায় ইসলামের ফিরিঙ্গ রূপ দেখতে হবে। কিন্তু সাধারন মুসলমান ভাল করে বাংলা ভাষাও শেখে না, তার আবার আরবি ফার্সি। কাজেই ৯-মন তেল ও আসে না, রাধাও নাচেনা। আর যাঁরা ও ভাষা শেখেন তাঁদের অবস্থা “পড়ে ফার্সি বেচে তেল” আর তাদের অনেকেই শেখেনও সেরেফ হালুয়া রুটির জন্য।

 কয়জন মৌলানা আমাদের মাতৃভাষার পাত্রে আরবি ফার্সির সমু্দ্র মন্থর  করে অহত অমৃত এনে দিয়েছেন জানিনা। সে অহত তারা একা পান কোরেই ‘খোদার খাসি ’ হয়েছেন। কিন্তু এ যোদার যামি দিয়ে আর কতদিন চলবে ? তাই আপনাদের অনুরোধ করতে এসেছি এবং আপনাদের মারফতে বাংলার সকল চিন্তাশীল মুসলমানদেরও অনুরোধ করছি, আপনাদের শক্তি আছে, অর্থ আছে যদি পারেন মাতৃভাষায় আপনাদের সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস সভ্যতার অনুবাদ ও অনুশীলনের কেন্দ্রভুমি যেখানে হোক প্রতিষ্ঠা করুন। (“মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা” শীর্ষক অভিভাষন-সুত্রে)

আমাদের ভাষা সমস্যা শিরোনামে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন,,,,,


 “আমরা বঙ্গ দেশবাসী” আমাদের কথা বার্তার, ভয়-ভালোবাসার চিন্তা কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। দুঃখের বিষয়, জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধের ন্যায় এই সোজা কথাটিকেও আমাদের মধ্যে এক সম্প্রদায়কে বুঝাইয়া দিলেও তাঁহারা জোর করিয়া বুঝিতে চাহেন না। তাই মাঝে মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা কি কিংবা কি হইবে তাহার আলোচনা সামরিক পত্রিকা দিতে দেখিতে পাওয়া যায়। মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষা কানের ভিতর দিয়া মরাম পশিয়া পরান আকুল করে? মাতৃভাষা ছাড়া আর কোন ভাষার ধ্বনির জন্য প্রবাসীর কান পিয়াসী থাকে ? মাতৃভাসা ছাড়া আর কোন ভাষায় কল্পনা, সুন্দরী তাহার মনমজান ভাবের ছবি আঁকে ? কাহার হৃদয় এত পাষান যে মাতৃভাষার অনুরাগ তাহাতে জাগে না? পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করিয়া দেখ, মাতৃ ভাষার উন্নতি ব্যতীত কোনও জাতি কখনও কি বড় হইতে পারিয়াছে ? আরব পারস্যকে জয় করিয়াছিল। পারস্য আরব ধর্মের কাছে মাথা নিচু করিয়াছিল। কিন্তু আরবের ভাষা লয় নাই শুধু লইয়াছিল তাহার ধর্মভাবে আর কতকগুলি শব্দ।” 

তিনি আরো বলেছেন,,,,,
“সেদিন অতি নিকটে যেদিন বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভাষার স্থান অধিকার করবে। বিদেশীর ভাষার সাহায্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চ্চার মতন সৃষ্টি ছাড়া প্রথা কখনও টিকিতে পারে না। যতদিন পর্যন্ত তাহা না হইতেছে, ততদিন পর্যন্ত আমাদিগকে একটি সময়পযোগী শিক্ষা প্রণালী অবলম্বন করিতে হইবে।”

“মাতৃভাষা” শিরোনামে ভাষা আন্দোলনের নাট্য দলিলের নাট্যকার মুনীর চৌধুরী বলেছেন,,,,,,
 “যার যা প্রানের ভাষা। সেটাই তার মাতৃভাষা। কার মাতৃভাষা খিস্তি, কারও মিছরি। আমি নিজেও এমন অনেককে জানি, যাঁদের মাতৃভাষা ঘরে আঞ্চলিক বুলি, অফিসে ইংরেজী, প্রনয়-নিবেদনে বিশুদ্ধ বাংলা, রোষ প্রকাশ অশুদ্ধ উর্দু। আমার মাতৃভাষা কি? বাংলা ভাষা সমগ্র বাংলা ভাষা। বিচিত্র রূপিনী বাংলা ভাষা। অভিধান আছে ষোড়শ রমনী মাতৃসন্ধোধনী যোগ্য। শ্বশ্রু থেকে তনয়, গর্ভধারিনী থেকে পিতৃরমনী। ষোল নয়, আমার মাতৃভাষার ষোল শত রূপ। তার সব পঙ্খিনীর সহচরী। আমার মাতৃভাষা তিব্বতের গৃহাচারী মনসার দর্পচুর্ণ কারী, আরাকানের রাজ সভার মনিময় অলংকার, বরেন্দ্র ভুমির উদাস আহবান। মাইকেল- রবীন্দ্রনাথ- নজরুল ইসলাম আমার মাতৃভাষা। আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা।”

‘বাংলা ভাষার ক্রম বিকাশ’ শিরানামে মুহাম্মদ এনামুল হক বলেছিলেন,,,,,
 “ভাষার ক্রমবিকাশের গতি ও প্রকৃতি আলোচনা করলে সহজেই বুঝতে পারা যায়।” এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি যে শুধু জীব জগতের প্রতি প্রযোজ্য তা নয়। ভাষার ক্ষেত্রেও এই সত্য সমভাবে প্রযোজ্য। পারিপাশ্বির্ক তার সাথে যুদ্ধ করে কোন কোন দুর্বল ভাষা আজও স্বগৌরবে বেঁছে আছে। পৃথিবীর এ ভাষাগুলোকে প্রায়ই জীবিত ভাষাও বলা হয়। চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা, এখন সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নাই। এ বাংলা যে বাংলা ভাষার প্রাথমিক অবস্থা, তাও সর্বস্বীকৃত সত্য। এতৎসত্ত্বেও, হিন্দী ভাষী ও সৈথিলী ভাষী। উড়িয়াভাষী ও অহমিয়া ভাষীদের কেহ কেহ চর্যাপদকে তাদের ভাষার আদি নিদর্শন বলে দাবী তুলেছেন।

 চর্যাপদের ভাষা, ছন্দ, ভাব ও সুর সবই অনুসৃত হয়েছে বাংলাদেশে। খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অথবা মধ্য ভাগে রচিত অনন্ত বডু চন্তহীদাসের বিখ্যাত গ্রন্থ “শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন” পরবর্তী যুগের সহজিয়ো বহন করছে। ‘চর্যাপদে’ যে বঙ্গ ভাষার শৈশব কাল কেটেছে, শ্রীকৃষ্ণ কীতনে’ তা কৈশোরে পদার্পন করেছে এবং শাহ মুহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জুলেখার’ তা যৌবনুথ হয়েছে। অতপর ‘মন সামঙ্গল’ ‘ধর্মমঙ্গল’ চন্ডী মঙ্গল’ ‘রামায়ন’ মহাভারত প্রভৃতির ভাষায় বাংলা ভাষা যৌবন প্রাপ্ত হয়েছে।”

‘বাংলা ভাষা আন্দোলন’ সম্পর্কে রফিকুল ইসলাম লিখেছিলেন,,,,,,

“এ অঞ্চল বাঙালি শাসিত ছিল কদাচিৎ। বহিরাগত ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত শত বছর ধরে, ফলে স্বদেশী ভাষা সুযোগ পায়নি বিকাশ লাভের। ৪৭ সালে দেশ বিভাগ এবং উপমহাদেশ দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপনের ফলে দেশীয় ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভের সুযোগ আসে কিন্তু তখনও বাংলা ভাষা বঞ্চিত হয়।”

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান লিখেছিলেন,,,,,

 ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন’ শিরোনামে লেখা, যেখানে তিনি লিখেছিলেন- কারা বাংলা ব্যবহার করছেন এবং কারা করছেন না। আমাদের দেশে উৎপাদনে যাঁরাই নিয়োজিত আছেন- তাঁরা সকলেই বাংলা ব্যবহার করছেন আর যারা সৃজনশীলতা ও উৎপাদনে যুক্ত নন তারা বাংলা ব্যবহার করছেন না। কবি সাহিত্যিক শিল্পী এবং বিজ্ঞানী ও পন্থিদের মধ্যে যাঁরা সৃজনশীল তারা বাংলা ব্যবহার করছেন। তাছাড়া সম্পদ উৎপাদনে যাঁরা নিয়োজিত- অর্থাৎ শ্রমিক ও কৃষক তাঁরা সর্বদাই বাংলা ব্যবহার করছেন। এর বাইরে যারা না সৃজনশীল না সম্পদ উৎপাদনে সমর্থ- তাঁরা- কেবল তাঁরাই বাংলা ব্যবহার করছেন না।
বস্তুতঃ পক্ষে তাঁরা এক ধরনের পরাধীন মানসিকতায় ভুগছেন এবং এর একটা পটভুমি আছে। 

১৯৪৭ সালে ইংরেজদের বদলে যাঁরা শাসকের অসনে বসলেন তাঁরা শাসক সূলভ স্বভাবেই তাঁদের নিজেদের ভাষা উর্দু চাপিয়ে দিতে চাইলেন বাঙ্গালীর ঘাড়ে। কিছু ঐ ঘটনার আগে নব্য শাসকেরা একটা ভুল করে ফেলেছিলেন তাঁরা বাঙ্গালীকে বুঝিয়ে ছিলেন যে, ইংরেজ চলে গেলে বাঙ্গলীরা স্বাধীন হবে। কেননা তার আগে বাঙ্গালী স্বাধীনতা দেখেনি। তাই ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্টের স্বাধীনতার পর আবার পরের ভাষার দাসত্বের প্রশ্ন উঠলে চাকুরী প্রার্থী বাঙ্গালীর কন্ঠে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল। এর ফলে শিক্ষা, চাকুরী ও ব্যবহারিক জীবনে পরের ভাষার দাসত্ব থেকে মুক্তি এবং নিজের ভাষা ব্যবহারের স্বাধীনতা লাভ করে।

 ‘একুশের চেতনা আমার’ শিরোনামে মমতাজ উদ্দীন আহমেদ লিখে ছিলেন- 
“আমার অশন, বসন, শয়ন, স্বপন সবার মধ্যেই আমার বাংলা ভাষা। বাংলা আমার মা আর বাংলা ভাষা আমার মায়ের ভাষা। যাকে কবি শ্রী মুধুসুধন বলেছেন- মাতৃভাষা। আগের কবিরা বলতো দেশী ভাষা। দুটোই ঠিক। মাতৃভাষা আর দেশী ভাষা, সবই আমার আপন ভাষা। আমার সঙ্গে আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিলে মিশে এমন হয়েছে যে, আমি ছাড়া ভাষা নেই আর ভাষা ছাড়া আমি নেই। মজার ব্যপার হল, দেব নির্ভর পন্ডিতের কথা বাঙ্গালিরা শোনেনি। যেন রাজাদের কৌলীন্য অত্যাচারে জর্জরিত নিন্ম বর্নের বাঙালিরা শাস্ত্রে ও ধর্মে জীবনের ব্যাথা খোঁজনি। খুঁজতে লোক জীবনাচরনের মধ্যে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গঠন। বিকাশ ও অগ্রগতির মধ্যে যে খোঁজা খুঁজির অজস্র প্রমান আছে। পাল রাজাদের পতনের সময় পেলাম বৌদ্ধ সহজযান পন্থার গান চর্যাগীতি, যেন রাজাদের পলায়নের পর পেলাম শেক শুভোদয়া, গীত গোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, আর পাঠানদের যাবার কালে পেলাম যত মঙ্গল কাব্য। ধর্ম ঠাকুর আর কালুগাজী সত্য পীরের গান। মোঘলদের যাবার পর পেলাম বিদ্যা, সুন্দর, কবিগান ও পুঁথি কাব্য। দেবও রাজন্যবর্গের অনুশাসন ও পরি দর্শনার বাইরে এই হল বাংলা ও বাঙ্গালির জীবন পরিচয়। বাংলার ঐ এক কথা, আমার যা সত্য, যা প্রয়োজন এবং আনন্দ তার মধ্যেই আমার অধিবাস। যেখানে তুমি ইংরেজি আর তুমি পাকিস্তানী তোমাদের হুকুমে, ইঙ্গিতে ও দন্ডাদেশের ভয়ে আমি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ছলনা করতে পারব না।”

ভাষা বোধ ছিল বলেই চর্যাপদের ভুসুকু পা বলেন,,,,,,,
আমি ভুসুকু, বাঙ্গালী ভইলী। আর মধুসুদন ঠাট্টা করে বলেন আমি শুদ্ধ বাঙ্গালী নহি, আমি বাঙাল। ৬০ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন- আমরা হিন্দু মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশিসত্য আমার বাঙালি। মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী বলেছিলেন- বাংলা বাংলার পৌনে ষোল আনা লোকের মাতৃভাষা। ইহাতে হিন্দু মুসলমানের কোন পার্থক্য নেই। জগতে এমন কোন হাতির দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায় না। যাহারা মাতৃভাষার সাহায্য ব্যতীত উন্নত সোপানে আরোহন করিতে সক্ষম হইয়াছে।’

সেলিনা হোসেন বলেছেন- “মাতৃভুমি ও মাতৃভাষাকে ভালো কে না বাসে ? এই ভালোবাসা মানুষের স্বভাবের মধ্যে এমন ভাবে মিশে আছে যে সংকটে পতিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ এ ভালবাসার কথা ভুলেই যায়। মাতৃ ভাষা ও মাতৃভুমির প্রতি ভালবাসার কথা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় প্রয়োজনে মাতৃভাষার জন্য হৃদয়ের ফগ্লু ধারায় মাতা ভালবাসা থাকাই যথেষ্ট নয়। সে ভালবাসার প্রকাশ প্রয়োজন।
       -

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন