শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

প্রচ্ছদ


সম্পাদকীঃ কুয়াশা ওয়েবজিন। সেপ্টেম্বর সংখ্যা। ২০১৭ইং।


সম্পাদকীঃ কুয়াশা ওয়েবজিন। সেপ্টেম্বর সংখ্যা। ২০১৭ইং।

খুব সঙ্কটপূর্ন  সময়ে আমার প্রাণের দেশ বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা ইস্যু এখন সবচে' আলোচিত এবং গুরুত্বের।এই সময়ে সকলের ভেতরেই একটা উদ্বিগ্নতা কাজ করছে।সকলের চোখ মুখ চিন্তা সেদিকে। এর মধ্যে সাহিত্য নিয়ে কাজ করা অনেকটাই কষ্টকর।অনেকের নিকট থেকে লেখা চেয়েও পাইনী। আবার অনেকের লেখা নির্বাচন হয়নি বলে প্রকাশ করিনি।এটা নিয়ে অনেকেই ভুল বুঝতে পারেন।তবে লেখার বিকল্প নাই। লিখতে থাকেন, পাশে থাকেন, হতাশ হবার কোন কারন নেই।


আমরা ভালো নেই। ইতিমধ্যে বন্যা এদেশকে ডুবিয়েছে। অনেক জান মালের ক্ষতি হয়েছে। তার মধ্যেই যারা সাহিত্যকে ভুলে যাননি তারাই এক সময় সম্ভাবনাময় লেখক। ভালোবাসা থেকেই এ জগত আবিষ্কৃত।কোন লাভ নেই,উপকার নেই,তবুও আমরা ছুটে চলেছি সামাজিক দায়বদ্ধতা কাঁধে নিয়ে। মানুষ এই জগতটাকে তাই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভাবেন। সমাজে, গ্রামে একজন কবি,সাহিত্যিক তৈরী হওয়া মোটেও সহজ কথা নয়। তাই তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র। এটা যুগে যুগে ছিলো এবং মহাযুগের দাবি থেকেই হচ্ছে এবং হবে।

আপনাদিগকে অবশেষে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা....

সূচীপত্রঃ কুয়াশা ওয়েবজিন। সেপ্টেম্বর। ২০১৭ইং।

সূচীপত্রঃ কুয়াশা ওয়েবজিন। ২০১৭ইং। 


প্রবন্ধঃ
মীর রবি....

কবিতাঃ
হেলাল হাফিজ,টোকন ঠাকুর, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, মতিন বৈরাগী,আদিত্য পিয়াস,
সুনীতি দেবনাথ, দ্বীপ সরকার,শেখর ঘোষ,সিদ্দিক প্রাণিক....

উপন্যাসঃ
তৈমুর মল্লিক....

কবিতাঃ
দেবজ্যোতি কাজল, সুধাংশু চক্রবর্তী,অনন্ত সুজন, রাজন্য রুহানী,নকিব মুকশি,সিয়ামুল হায়াত সৈকত,শ্রীলেখা চ্যাটার্জী,সতেজ মাসুদ, বর্ণালী চ্যাটার্জী, পঙ্কজ চন্দ্র শীল.....

গল্পঃ
দেবাশিষ রায়, রুপা সাধুখা, রওশন রুবী, সৌমিত্র সৌম্য.....

কবিতাঃ
রায়ান নুর, এলিজা আজাদ, মোঃ নুরুল গনী,অনিমেষ সিংহ, রিদওয়ান নোমানী, বন্যা ইসলাম, ঝুমা চৌধুরী, তানভীর মুছলেমী রামেন, কামরান চৌধুরী, সৈয়দ শরীফ, মোনাব্বর হোসেন, আলমগীর সরকার লিটন, ডঃ রহমত উল্ল্যা খান, বিচিত্র কুমার...

ছড়াঃ
মোঃ মাজেদ হোসেন, বাউল মজনু....

তরুণদের কবিতায় মৃত্যুচিন্তা ।। মীর রবি



তরুণদের কবিতায় মৃত্যুচিন্তা


মৃত্যু। একটি শাশ্বত বিষয়, চিরন্তন বাস্তবতা। পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া কোনো জীবই মৃত্যু এড়িয়ে যেতে পারেনা। মৃতুবোধ প্রতিটি জীবেরই আছে। মানুষ ও অন্যান্য জীবের মাঝে পার্থক্য- মানুষ মৃত্যু ভাবনাকে প্রকাশ করতে পারে, অন্যরা পারেনা। আমরা মৃত্যুকে নিয়ে কি ভাবি, মৃত্যুকে কিভাবে দেখি? একেক জনের উত্তর একেক রকম হবে। কারণ- প্রত্যেক মানুষেরই একটা নিজস্ব ভাবনা থাকে, নিজস্ব চিন্তা থাকে। আর এই ব্যক্তি থিউরির বাহিরে কেউ যেতে পারেনা। যারা যেতে পারেন, তারা কবি। একজন কবির কাছে মৃত্যুর নানান রঙ আছে, বিস্তর ভাবনার প্যাটার্ন আছে। কবিও যেহেতু মানুষ, সেহেতু অন্যান্য মানুষের ভাবনা থেকে তার ভাবনাও বিচ্ছিন্ন কিছুনা। মানুষ যা বিচ্ছিন্নভাবে দেখে, কবি তা সমন্বিতভাবে দেখেন। সাধারণের থেকে বৈশাদৃশ্য এটাই- কবি চিন্তার গভিরে যেতে পারেন। 

আমরা কবি জীবনান্দ দাশের কবিতায় অনেক বেশি মৃত্যুচিন্তা দেখেছি। তাকে স্যাড জেনারেশনরে কবি বলাও ভুল নয়। প্রতিটি মানুষই তো মৃত্যু ভাবনার উর্ধ্বে নয়। সেখানে একজন কবি তা নিয়ে ভাববেন না কেন? কিন্তু তরুণ কবিদের কবিতা? আমরা সমকালীন তরুণ কবিদের কবিতাতেও মৃত্যু চিন্তা গভীরভাবে দেখতে পাই। কবি কাজী মেহেদী হাসানের কবিতায়- 
‘মানুষ মরে গলে মানুষের ভেতরই থাকে এক আস্ত শোকমিছিল
কবি মরে গেলে প্রতীক্ষা থাকে
ভালোবাসা থাকে 
শ্লোগান থাকে’ 
( কোনো শোক প্রস্তাব নয় / আঙুরবালার রিকর্ড) 

কবি এখানে মানুষের মৃত্যুতে শোক দেখেছেন, সাধারনও তাই দেখে। কিন্তু একজন কবির মৃত্যু? কবি কবির মৃত্যুতে শোক দেখেন না। কবির প্রতীক্ষায় থাকেন, ভালোবাসার প্রতীক্ষা করেন। কবি এখানে নস্টালিক। একজন কবিও মানুষ, তিনি মারা গেলে আর ফিরে আসেননা। কিন্তু কবির কবিতায় কবির ভালোবাসা থাকে, পরিবর্তনের শ্লোগান থাকে। কবির কবিতাই মৃত্যুতীত বাঁচিয়ে রাখে তাকে। কিন্তু সাধরনের? সাধারনের মৃত্যুর কিছু থাকেনা। তাদের আপনজনরাও এক সময় ভুলে যায় তাকে। তার অন্য এক কবিতাতে দেখতে পাই- 
‘এই যে উৎসব 
তবু শোকরঙা চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি’ 
( মিথ / আঙুরবালার রেকর্ড ) 

সাধারন থেকে কবি এখানে ভিন্ন। চারপাশে তো প্রতিদিনই আমরা উৎসব দেখছি, এর মাঝেই আমরা শূন্যতাও দেখছি। প্রতিদিন এক মিনিটের জন্য হলেও আমরা শোকাহত হই। শোক সে তো মৃত্যু ভাবনারই পরম্পরা শূন্যতাবোধ। উৎসব, কবি উৎসবের কথা বলেছেন, আমরা কোনো না কোনো ভাবেই এই উৎসবের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি। যদি প্রশ্ন করা যায়- কোনটা চিরন্ত এবং বৃহৎ উৎসব? মীর রবির কবিতায় আমরা এর উত্তর খুঁজে পাই- 

‘মৃত্যুর থেকে বড় কোনো উৎসব নাই’
( উৎসব / মৃত্যুর নাচঘর ) 

এই উৎসব আমরা এড়িয়ে যেতে পারিনা। তিনি তাই আবার উচ্চারণ করেন- 

‘শুধু দুটি জীবের যৌনাচারে জন্ম হলে 
আমি জানি, আমাদের ভবিষ্যৎ শুধু মৃত্যু। 
আমরা মৃত্যু এড়িয়ে যেতে পারিনা, তাই মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করি।’ 
( আবির্ভাব / মৃত্যুর নাচঘর ) 

মানুষের জীবন, আমরা চারপাশে তাকালে এই মানব জীবন কেন্দ্রীক সভ্যতার বিরাট কর্মযজ্ঞ দেখতে পাই। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ কি? পর প্রজন্মকে বাঁচিযে রাখার? এর কোনো অর্থ নেই। মানুষ যা কিছুই করুক, তার ভবিষ্যৎ মৃত্যুই। তাই মীর রবির কবিতাতেই দেখতে পাই- 

‘ভবিষ্যৎ বলে আমার কিছু নেই 
আমি দেখি শূন্য 
শূন্য মানে আমার কাছে মৃত্যু 
মৃত্যু মানে মৃত 
মৃত আমি কবরের দিকে হেঁটে যাই’ 
( গন্তব্য / মৃত্যুর নাচঘর ) 

একজন কবির চিন্তা, দর্শন এখানেই সার্থক- মৃত্যুকে যখন তিনি চিনতে পান। যত কিছুই করা হোক, আমাদের প্রত্যেককেই মৃত্যু নামক শূন্যতার দিকে হেটে যেতে হবে। মৃত্যুর জন্যই আজ আমাদের এত সব আয়োজন। মৃত্যু আছে বলেই একজন মানুষের জন্ম কিংবা বিয়েতে না আসা মানুষটিও মৃত্যুতে সমবেত হয়। মৃত্যুজনিত এই বিরাট সমবেতই চিরন্তন উৎসব। কোনো জীবই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য আসেনি।  একজন মানুষ অন্য এক মানুষের মৃত্যু দেখবে বলে ক্ষণিকের জন্য বেঁচে থাকে। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলছে, টের পাচ্ছিনা আমরা। কবি নাহিদ ধ্রুব ঠিকই তা টের পান। বলতে হয় প্রাজ্ঞ দার্শনিকতাবোধ আছে বলেই তিনি উচ্চারণ করেন- 

‘আমি জানি- 
মৃত মানুূষকে কবর দেওয়ার জন্যই 
আমরা বেঁচে থাকি!’ 
      ( কবর / মৃত্যুর মতো বানোয়াট ) 

মানুষের মৃত্যু হলে তার স্বপ্ন বলে কিছু থাকেনা। আমরাও তাকে কিছু দিনের মাঝেই ভুলে যাই। মৃত মানুষটির নাম ধরে তাকে ডাকি না। কবি ইমরান মাহফুজ তাই কবিতায় উচ্চারণ করেন- 
‘মা দিন শেষে আমায় আর ডেকো না 
রাতদুপুরে অশোকবনে পাখি নিয়ে থেকো’
( মৃত্যুমুখী পাখির সমাবেশ / দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা ) 

একই কবিতায় কবি মৃত্যুকে আনন্দের সঙ্গে তুলনা করন- 

‘আজ মৃতুমুখী পাখির সমাবেশ 
নূপুর পায়ে শিশুর মতো 
প্রার্থনা করছে- আনন্দ মৃত্যু!’ 

কবি এখানেও মৃত্যুকে উৎসব চিন্তকে দেখেছেন। আনন্দ তো উৎসবেরই নামান্তর! 

মৃতুর পর কী? মৃত্যুর পর জীবন বলতে কিছু আছে? মৃত্যুর পর জীবন বলতে কিছু থাকেনা। চিরন্তন শূন্যতা ছাড়া মৃত্যুতে কিছু আছে বলে আমি বোধ করিনা। বিজ্ঞানের চিন্তায়- সৃষ্টির ধ্বংস বা মৃত্যু আছে, পুনর্জীবন বা পর জীবন বলে কিছু নাই। লৌকিক বা ধর্ম কেন্দ্রিক মৃত্যুর পর জীবন আমাকে কাছে টানেনা। দার্শনিকতাবোধ সম্পন্ন একজন কবিও অন্য কিছু ভাবতে পারেন না বলে আমার মনে হয়।  ‘মানুষ মৃত্যুর পর কোথায় যায়? কী খায়; বেঁচে থাকে নাকি মরে যায়?’ এম ঘোর লাগা প্রশ্ন তুলেও কবি নাহিদ ধ্রুব অকপটেই কবিতায় বলেন- 

‘... এর মাঝে স্যাঁতস্যাঁতে নিঃসঙ্গতা 
বলে আমি একা, 
অপারেশনে বাদ পড়ছে সব অভিনয়। তারপর চাপা 
মাটির হুংকার চুপচাপ নিরবতা, নিরবতা 
চুপচাপ... ’ 
( মৃত্যুর পর / মৃত্যুর মতো বানোয়াট )  

মৃত্যুর পর কি- তা ধর্মবেত্তাদের কাছে অন্য কিছু, আরেকটা জীবন্ত জগৎ হতে পারে। কিন্তু একজন কবির কাছে? কবি যদি প্রথার জোয়ারে গা ভাসান তবে ধর্ম মোড়লদের থেকে তিনিও ব্যতিক্রম হবেন না। কিন্তু যদি প্রথাবিরোধীতার কথা বলেন- তবে তিনি মৃতুর পর ফুলস্টপ দিবেন। কবির ‘নিরবতা / চুপচাপ’ শব্দ তারই প্রতিনিধিত্ব করেনা! 

একজন মানুষের মৃত্যু, তার চারপাশ- মৃত্যু ঘটনার একটা প্রকল্প দেয়। দায় দেয়। মৃত্যুকে ঘিরে থাকে ঘটনার ঘূর্ণিপাক। মিথ রটে। এটাও কিন্তু একজন মানুষকে হারানোর শূন্যতার সার্কে তৈরি করে। শূন্যতাবোধ বিভ্রম বলয় সৃষ্টি করে। মানুষ কিছু সরল দৃশ্যকে জটিল করে মিথের জন্ম দেয়। কবি শীতল বোরহানের কবিতয়- 

‘মায়ের মৃত্যুর পর বারান্দার চাল কিংবা বাড়ির আশপাশে  
এবং চলার পথে যত জায়গায় গিয়েছি 
বারান্দার টিনের চালে ভাত ছিটিয়েছি; সেই কাক দুটিকে 
আর কোনোদিন চোখে পড়েনি!’ 
( মা এবং দুটি কাক / অন্ধের দিনলিপি )                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                   

আবার, তাসনিম রিফাতের কবিতায়-   


‘যতবার মৃত্যু, ততোবার বৃষ্টি, 
আকাশ কালো এবং হল্লা হওয়া বুকে 
কেউ একজন অবতরন করে মাটিতে, 
আমাকে এনে দেয় সেই বিশুদ্ধ স্বাদ’ 
( মৃত্যু এবং বৃষ্টি / দুঃখবোধের ঘড়ি )

দুটি কবিতাতেই কবি তার চারপাশের খন্ড খন্ড দৃষ্টিকল্পে মৃত্যুর স্বাদ খুঁজেছেন। তাদের একজনের কাছে মৃত্যু বিশুদ্ধ বৃষ্টি হয়ে ধরা দিয়েছে। একজনের কাছে বিভ্রমতার ধাঁধাঁ, স্মৃতির বিচ্ছুরণ। আগেই বলেছি মৃত্যু একেকজনের ভাবনায় একেক রকম। ঘটনার সমাবেশও ভিন্ন আঙ্গিকের। যেমন- শিমুল জাবালির কবিতায়- 

‘তীর্থের কাকা বিছানার আদর পেয়ে ডায়াসে ঘটনা রাখে 
 আমাদের সহরথিরা এমন এক কর্ণছায়া খুঁজছিলো 
যেখানে জন্মের আগে মৃত্যুর স্বাদ নেয়া যায়।’ 
( মহতীর্থের কাক / সুতাশঙ্খ ) 

কবি জন্মের আগেই মৃত্যুর স্বাদ খুঁজছেন। কল্পনার ব্যপ্যতা রূপকথার মতো। তারপরও আমরা এট দৃশ্যকল্প তুলে ধরতে পাই- আমরা মৃত্যুর আগে বেঁচে ছিলাম, বাঁচার আগেও মৃত ছিলাম! অলীক মনে হলেও ভাবনা গভীরতা ব্যাপক- অর্থাৎ জন্মের আগে মৃত, জন্মের পরেও মৃত্যু। সরলীকরণে এর রূপরেখা এমন- 

মত্যু (ভ্রুণ) - জন্ম (শিশু, পরবর্তী জীবন) - মৃত্যু

দীর্ঘ ভাবনা আপনাকে বলে দিবে- জন্মের আগের কিছু আপনি জানেন না, কারণ তখন আপনি ছিলেন না। মৃত্যুর পরেও আপনি কিছু জানবেন না, কারণ তখন আপনি থাকেবেন না। শুধু জানবে- ততোদিনের কথা, যতদিন আপনি বেঁচে ছিলেন। মাকড়সার জালের মতো মৃত্যুচিন্তার ডালপালা! ভাবতে থাকুন নতুন নতুন চিন্তা বেরুবে- মৃত্যুর খোরাক পাবেন মৃত্যুর স্বাদে!  

মৃত্যু চিন্তা কখন আসে? আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ততোক্ষণে আসুন আমরা কবি শিস খন্দকারের  কবিতা পড়ি- 

‘খুব করে একদিন বিরাগে তবে বসবো জেঁকে, 
আমিও চলে যাবো বিপন্ন জীবনের কাতারে , 
বেদনাতুর হৃদপিন্ডে ভাসিয়ে অকুল পাথারে! 
কে বাড়িয়ে দেবে দুটি প্রসন্ন হাত? কে? কে?’ 
( বিষাদ জিজ্ঞাসা / আয়নায় অলীক সঙ্গম ) 

কবি এখানে বেদনাভারে কাতর হয়েছেন। দুঃখবোধ তাকে হতাশ করেছে, তিনি বিপন্নতাবোধ করেছেন নিজের জীবনের। এখানে বিষণœাতা আর হতাশার সুর আমরা পাই। যা প্রত্যেক মানুষের মাঝেই কাজ করে । নিরাশাবোধ থেকেই মানুষে মৃত্যুবোধের চিন্তা আসে। পাওয়া না পাওয়ার দোদ্যুলতা মৃত্যু চিন্তাকে জাগিয়ে তোলে। মুত্যুও যেন তখন হাত ছানিতে ডাকে। কবি মুগ্ধ মোহাম্মদ এহতেশামুল লিখেছেন- 

যেখানে আকাশ থেমেছে 
নতুন এক গ্রহের সন্ধানে 
সেটাই আমার গন্তব্য Õ
( আকাশের গন্তব্য কোথায় / ব্যথিতরা কেবল রাতের প্রেমেই পরে ) 

আকাশ, আকাশের পাড়ে গন্তব্য কবিকে মৃত্যুচিন্তাতেই ভাবিয়ে তোলে। লোক বিশ্বাসে মানুষের মৃত আত্মা ওখানেই যায়। মহাশূন্যের দিকে এ যাত্রায় ভাববাদীতার ছায়া কাজ করে। 

ভাববাদী বা বস্তুবাদী যে দর্শনই হোক আমরা মৃত্যু চিন্তা এড়িয়ে যেতে পারিনা। আমরা মৃত্যুর উর্ধ্বে নই। মৃত্যুকে আমরা তাচ্ছিল্য করতে পারি, কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারিনা। মৃতু শাশ্বত। কবিতায় এর প্রয়োজনীয়তা- কবিতাকে অনন্য করে তোলে। মৃত্যু কেন্দ্রিক দার্শনিক কবিতা মানুষের জীবনের একটি অনুষঙ্গ। একে বাদ দিয়ে আমরা  কবিতাকে ভাবতে পারিন।

একটি পতাকা পেলে ।। হেলাল হাফিজ




একটি পতাকা পেলে


কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার
অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী
সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,
-‘পেয়েছি, পেয়েছি’।
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের
সকালে ,
ওম নেবে জাতীয় সঙ্গীত শুনে
পাতার মর্মরে।
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির
গান জ্যৈষ্ঠে- বোশেখে,
বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসম্মানে সাদা
দুধে-ভাতে।
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-
খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে
সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো সংসারে।

দেখি রাক্ষসের মুখ, পাই ডাইনির নিঃশ্বাস ।। টোকন ঠাকুর

দেখি রাক্ষসের মুখ, পাই ডাইনির নিঃশ্বাস

আয়নার মধ্যে তাকিয়ে নিজেকে রাক্ষস মনে হলো!
সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসের মানে, সংক্ষিপ্ত বাঙলা অভিধানে পাওয়া গেল- নরখাদক জাতি, নিশাচর, কর্বূর, প্রাচীন অনার্যজাতি ইত্যাদি... যদিও, রাক্ষসের একটা অপ্রত্যাশিত ভয়ঙ্কর মুখচ্ছবি আঁকা আছে মনুষ্যকুলের মনে। এটা জানি, কারণ অ্যাদ্দিন আমিও মানুষের রোল প্লে করে এসেছি। অ্যাদ্দিন আমিও মানুষ ছিলাম।
কিন্তু আজ! আজই, নাকি কয়েকদিন ধরেই, যখনই আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দাঁড়াই, বিলিভ ইট, আমার চোখেই ধরা পড়ে আমি একটা রাক্ষস! আমার সারামুখে ডাইনিদের মিহি-নিঃশ্বাসের আঁচে পৃথিবী দেখার মায়াময় ম্যাপ আঁকা হয়ে চলেছে, মুখ বিভাজিত হয়ে পড়ছে...

বিশেষ দ্রষ্টব্য ১. 
ডাইনিদের একেকটি নিঃশ্বাস কমপক্ষে বারোমাস মাথার মধ্যে কিংবা ঘরের দেওয়ালে ঝুলে থাকে; তারপর আরেকটি নিঃশ্বাসে ছাপা হয় আবার একটি বাৎসরিক ক্যালেন্ডার

বিশেষ দ্রষ্টব্য ২. 
ডাইনিদের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে অনেক তরুণ যোদ্ধা অকালেই মরে ভূত হয়ে যায়। যারা ভূতে বিশ্বাস করে না, আমার মতোন, একদিন আয়নার মধ্যে তাকিয়ে দ্যাখে সে নরখাদক, সুযোগ পেয়ে নিজেকে খেয়েছে; সে নিশাচর, আঁখিতে আঁধি চারণ করেছে; সে প্রাচীন অনার্য, কারণ তার অনুচ্চবর্গের দেহ;
দেখি, আয়নার মধ্যে আনস্পেকটেড একটি অচেনা মুখ, রাক্ষসের।

নীল বোতাম খুলে হাসছে জানালা ।। দেবাশিস মুখোপাধ্যায়


নীল বোতাম খুলে হাসছে জানালা

রাধা হয়ে আছে সন্ধ্যার শরীর ।পাড়াকে কীর্তনে পেয়েছে । 
করতাল আর খোলের যুগলবন্দী আকাশকে একটি গৌরচন্দ্রিকা দিল । 
রাগ আগে পূর্ব পেলে মেঘেও কৃষ্ণ দর্শন
বাঁশির ঘুম ভেঙে গেলে রান্না পুড়ে যায় । 
পেখম পাবার আগে ময়ূরটি খুঁজি । প্রেমের শীতল কলসটি গ্রীষ্ম চায় । 
কলঘরে ঝরে যাচ্ছে রজস্বলার
কান্না । দেবতাটিকে তবে কী দেবে !
সুদর্শন নাকি পাঞ্চজন্য !

ব্রজের ধূলির ভিতরে গোঁসাই গোপী হয়ে পড়ে । 
নিঃসঙ্গ । একাকী । মন্থর সময় । অতুল প্রসাদে ডোবে । রজনীকান্ত পায়।
পা পা করে চলে যাচ্ছে গোপাল । রাত্রি কখন পরমোৎসব
শবের ভিতরে ভালোবাসা বসে উচ্চারণ করছে নতুন বাসার খবর।

অস্থিরতার দিনলিপি ।। মতিন বৈরাগী


আস্থিরতার দিনলিপি

ভুমধ্য সাগর থেকে উঠে আসা প্রাণহীন শিশু হাত পা’ নাড়ে
পূর্ব ও পশ্চিমের সন্যাসীরা দেখে শিশুর জন্মক্ষণ গ্রহ-নক্ষত্র রাশির হিসেব
ক্যামেরাগুলো ঝলকায় আর ‘রিপোটার্স ধারাপাঠ’ ইথার কাঁপায়
নপুংশক পৃথিবীর যাবতীয় শৃগাল ও ষণ্ড ফিনে ফিনে বিছানায় পরখ করে
কতটা যোগ্য তাদের প্রবল দণ্ডটি গমনে ঘর্ষণে
শিশুটি এখন ধরিত্রিমাতার শুয়ে আছে কোলে জল ছুঁয়ে গেলে নড়ে
হাত পা ছোড়ে নতুন মুদ্রায়

ফুটফুটে শিশু ক্যামেরার কাঁরুকাজ আরও ঘনো হয়ে বসে মুখে, ঊর্ধমুখী পায়
শাদায় শাদায় ছাতা মেলে আলাপ আয়োজনে শ্যাম্পেন ঠোঁট
কত পড়ে থাকে আফ্রিকায়, কত এশিয়ায়, সোপানের জল দোলে
খাঁচার ভেতর গঞ্জালোর চোখ জ্বলে -উলঙ্গ অধ্যাপক- মুমিয়ার চিৎকার-
দেখে নাও পশু আর মানুষের পরিমাপ
নেশার বড়িতে আইএস লড়ে
চালাও, হত হও বিলুপ্ত হও ফুটো করো ফুটো হও শিসের কামড়
শিয়ালেরা হাসে-

বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

দন্ডিত কাপুরুষ ।। আদিত্য পিয়াস


দণ্ডিত কাপুরুষ


হে নারী,
তোমার মনে অবাধ বিচরণের দিগ্বিজয়ী বাসনা 
এখন আমাকে কুকড়ে খায় না।
.
এখন মন খুজে বেড়ায়না
তোমার কপালের কালো টিপের মায়া,
তোমার অবাধ হাসিতে  সৃষ্ট টোলের শিল্প  সৌন্দর্য্য
কিংবা তোমার ছোট খাট অভিমানের নিখুঁত কারণ।
.
এখন নাসান্দ্রিয় গভীর শ্বাসে খুজে বেড়ায়না
তোমার সুবাসিত শরীরের মাদকতা।
তার চেয়ে এখন বেশি প্রিয়,
কষ্টার্জিত কচকচে নোটের সুঘ্রাণ।
.
তোমার সুমুধুর কন্ঠস্বরের চেয়ে
এখন বেশি প্রিয় ফুটন্ত চালের শব্দ।
.
ভালবাসার চেয়ে বেশি  প্রিয় মিছে অভিমান,
সুখের চেয়েও বেশি কাব্যময় এখন
শূন্য পাতিল,
শূন্য ঘর,
শূন্য বিছানা,
শূন্য ব্যলকনির ইজি চেয়ার,
বিষন্ন গোধূলি বিকেল
কিংবা একাকী জ্যোৎস্নাময় রাত।
.
তোমার সান্নিধ্যের চেয়ে এখন
দুমুঠো চাল,চুলো  আমার কাছে অতি আবশ্যিক।
.
তোমার উপর শত অভিমান
আজ আমি কবিতার উপর চাপিয়ে দিয়ে
সুখে থাকি এক পরম শূন্যতায়।
এ আমার প্রতিশোধ...
বলতে পারো উপায়হীনতাও।

আমি স্নিগ্ধ হবো লাবণ্যতা ।। সুনীতি দেবনাথ


আমি স্নিগ্ধ হবো লাবণ্যলতা  

বহুদিন পরে ক্লেদাক্ত দিনের পরে
আমি আবার তোমাকে চাই তোমাকেই চাই__
সময়ের নোংরা হাওয়া লেগেছে শরীরে
আমি আজ নোংরা হয়ে গেছি ঘিনঘিনে,
কোথায় তুমি লাবণ্যলতা আলোকলতা?
একটিবার এসো আমার হাত ধরো।
আমাকে নিয়ে যাও সেই ঝর্ণার ধারে
যে জলে ডুব আর ডুব অবগাহনে আমি
পরিশ্রুত হবো তারপর হয়ে উঠবো পবিত্র।
তুমি জানো না লাবণ্যলতা এখন এখানে
এমন কোন ক্লেদাক্ততাহীন টলমলে জলাশয় নেই,
এখানে এমন কোন কলস্বিনী নদীও নেই
সুবিমল প্রবাহিত শীতল সুস্বচ্ছ ধারা
যে ধারা সব ধুলোবালি সব ক্লেদ গ্লানি
ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবে দেহ আর আত্মা
আমার সকল আমিকে।আমি তারপর
আবার হবো দূর নক্ষত্রের আলোর মতন বিমল।
এবার আমাকে সেই স্বচ্ছতোয়া নিত্যপ্রবাহিনী
অরণ্যছায়ার কলকল্লোলিনী অলৌকিক ধারার কাছে
সেই ঝর্ণার কাছেই আবার যেতে হবে,
জীবনের ওপার থেকে এসো লাবণ্যলতা
হাত ধরো আমার পথ ভুলে গেছি আমি
দিগ্ভ্রান্ত আমি একটিবার এসো নিয়ে চলো
সেই লোকান্তরের অলৌকিক জলবতীর তীরে।
আমি পাথরের সিঁড়ি বেয়ে তরতর নেমে যাবো
আমি লাফিয়ে লাফিয়ে পার হবো জলসিঁড়ি
ধাপে ধাপে নেমে যাবো জলে স্নান করবো আমি।
আজ যখন রক্তাম্বরে ভোর এসে জানালায় তাকালো
তার চোখে হাসির টুকরো ঝিলিকও দেখিনি,
ওরাও এসেছিলো চেনাজানা দোয়েল পাখিরা
ছটফটি ভুলে  স্তব্ধ চোখে চেয়ে ওড়াওড়ি করে
চলে গেলো গাইলো না কোন গান,
জানি ওরা আর কোনদিন কোনদিনই ফিরবে না।
অনেক সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত খেয়া পারাপার হলো
সব শেষে রাতের ঠিকানায় পোঁছে গেছি,
আজ আর পারাপার নেই আছে শুধু
স্তব্ধ গতির রুদ্ধ অন্তরের আত্মার ক্রন্দন
অন্ধকারে মিশে থাকা বিশ্রস্ত চলাচল-
আমি আলো হাতে যেতে চাই সেই অস্তাচলে
আলো হাতে যেতে চাই ঝুম অন্ধকারে
যেখানে বাতাসও স্তব্ধ নিস্তব্ধ তমিস্রা,
সেইখানে আলো হাতে স্পষ্ট কণ্ঠে বলতে চাই
এসো নীরাবতী এসো এই আলোয় এসো
তনু স্নিগ্ধ করো আলোর ধারা অবগাহনে।
এখানে সকাল হবে সেই উজ্জ্বল সূর্য
শত শত রশ্মিজালে তোমাকে আমাকে
সঞ্জীবনী ধারাস্নানে ধুয়ে মুছে বৃষ্টিধোয়া
অলোকলতার মত সোহাগে দোলাবে।
আজ আমার আলো নেই প্রাণের উচ্ছলতা নেই
গতির উদ্দামতাও গিয়েছে হারিয়ে তাই
একটিবার, হয়তো শেষবার লাবণ্যলতা এসো
হাত ধরে এই দুস্তর অরণ্য পেরিয়ে
পথহারা পথ পেরিয়ে নক্ষত্রের অশ্রুঝরা
সুশীতল ধারার কাছে নিয়ে যাও।
ওখানে স্নান করে আমি পরিশুদ্ধ হবো।
আর সেই আগেকার মত দেহ মন সহ
আত্মা আমার স্নিগ্ধতার আবেশে উদ্বেলিত হবে
আমি দীপ্ত হয়ে দৃপ্ত ছন্দে চলেই যাবো
ঐ উপুড় করে রাখা আকাশটর নীচে,
আকাশের অনন্ত আচ্ছাদনে ঘেরা থেকে
আকাশের ছোঁয়ায় দাঁড়িয়ে আমি
আরেকটি বার হয়তো শেষবার
আমি আকাশই হতে চাই আকাশই মম হবো
লাবণ্যলতা এবার তুমি আকাশেরই মত এসো।

দুঃখ ফেরত খাম ।। দ্বীপ সরকার



দুঃখ ফেরত খাম

বেশ কয়েক দিন আগে পাঠিয়েছিলাম
একটি নীলাভ খামে-খামভর্তি কিছু দুঃখলিপি...
সেখানে লেখা ছিলো কিছু
রৌদ্রময় দুঃখের সারাংশ,
আর কিছু শব্দবৃত্তের প্রেম।
এক বিকালে ডাকপিয়ন এসে
ফেরত দিয়ে চলে গেলো সেই চিঠি,
প্রেমের মুদ্রণে হুবহু ছাপানো
একটি চোখ
একটি খাম
একটি কবিতা
সীমিত অভিজ্ঞতায় কিভাবে অক্ষরগুলো
জড়ো হয়ে কবিতা হয় বলো,
কবিতারা অাজ অন্য রকম আমার
কবিতার বেশুমার পালকগুলো
ঝেরে উঠছে দুঃখ মহাসড়কে-ক্রন্দন মিছিলে।
জানোতো, যখনই দুঃখগুলোর প্রশ্নের
মুখোমুখি হই আমি
তখনই যেনো নদ- নদীরা
চিত্রায়িত করে আমার প্রেমিকার শরীর।
উদোম শর্ষে ফুলের গায়ে হলুদ ঝরছে
দেখে ইদানিং আর দুঃখ হয়না আমার,
হয়তো সম্পর্কের দূরত্বে
কিছুটা দূরবর্তী হচ্ছি
হলুদ হচ্ছি
নীল হচ্ছি
ছায়া হচ্ছি এই তো!!
অতঃপর ছেঁড়া পকেটে রেখে দেই সযত্নে সেই খাম
যাকে আমি আমার ধ্বংস বলে ডাকি।
লেখাঃ ২৭/১১/১৬ইং

সাঁঝ বেলাতে ফুল ফোটে ।। শেখর ঘোষ



সাঁঝবেলাতে সুর ফোটে

লালচে বেগুনি রঙের এক সন্ধ্যায়
আমরা বসে আছি শব্দসেতু হয়ে
সব কাহিনিরই ভিত্তি হলো হিংসা,ঘৃণা,ঈর্ষা আর লোভ ৷

ভালবাসা মানেই তো চোখের জল
দুঃখ, কষ্ট, আর বেদনা
আবার পাশাপাশি এক সীমাহীন স্বর্গীয় আনন্দ
অসীমের স্পর্শ ৷

সন্ধ্যামালতী ফুল সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে
ফুলগুলো ফোটে
মৃদু গন্ধে কেমন যেন পবিত্র পবিত্র মনে হয় ৷

নিরীহ শূন্য দশক

আমার বাগান ভরে আছে সদ্য ফোটা সন্ধ্যামালতী ফুলে
নকশিকাথার মাঠে নকশাদার পোশাক পরা এক বাঁশিয়ালা 
সন্ধ্যালোকে সুর জাগায় ৷৷

তিনশ, বছর পরে ।। সিদ্দিক প্রাণিক


তিনশ' বছর পরে

তিনশ' বছর পরে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি,
তুমি-আমি-আমরা আর আমাদের পোষা কুকুর ও
কবিতারা কেউ বেঁচে নেই, বেঁচে নেই দুগ্ধপোষ্য শিশু,
নাবালক আঁকা-আঁকি আর হিংস্র নখের আচর। 

শুধু বেঁচে আছে বৈধ-অবৈধ সংগম,
তাদের উত্তরাধিকার, যারা ঘর থেকে ঘরে 
অস্থির উন্মাদনায় ছুটছে আর
গোপন সিন্দুক থেকে আবিষ্কার করছে 
কামসূত্র আর সমগ্র খিস্তিখেউর 


স্বপ্ন ও শেষ অধ্যয় ।। তৈমুর মল্লিক


স্বপ্ন ও শেষ অধ্যায় 
                 (২য় খণ্ড)

রিনি কোথায় বিথি ? এখনও দেখতে পেলাম না। ও জানেনা আজ সকাল আট্টায় খুব গুরুত্ত-পুর্ন একটা ক্লাস আছে? 
আমি জানিনা তবে আসার সময় রিনির রুমের দরজা বন্ধ দেখলাম। নক করেছি কয়েকবার কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পেলাম না।
কি বলছিস বিথি ? তুই ঠিক দেখেছিসতো ? 
হ্যা রে রুমি , আমি ঠিক দেখেছি । পরে ভাবলাম ঘুমাচ্ছে তাই আর দেরি করিনি । 
তুই চলে এলি? এতটা নির্বোধ হলি কি করে ? রিনি এতসময় ঘুমায়-দেখেছিস আজপর্যন্ত ? 
রুমি দেখ আমার মন ভালো নেই । তোর এত চিন্তা হচ্ছে তাহলে তুই খোজ নিলিনা কেন? এখন যা , দেখে আয় কি করছে । 
তুই ভাল করেই জানিস বিথি আমি কেন এত সকালে চলে আসি। আমার অর্থনৈতিক অবস্থা কি । বলতে গেলে লেখা পড়ার খরচ আমার নিজেকেই চালাতে হয়। আজ কিছু টাকা পাবার কথাছিল। সকালে উঠে গিয়েছিলাম সেই টাকাটা আনতে। আমি তোদের মত সোনার চামুচ মুখে নিয়ে জন্ম নেইনি । যাইহোক বাদ দে এসব কথা , আমার এইসব বলতে আর ভালো লাগে না । তুই যা বিথি, আমি দেখে আসি রিনি কি করছে। 
রুমির কথাগুলো শুনে বিথির মন খারাপ হয়েগেলো । নিজেকেই নিজে দোষারোপ করতে থাকে । বুঝতে পারে রিনি কে কষ্ট দেয়া ঠিক হয়নি । অবশেষে সিদ্ধান্ত বদলায় বিথি ।
রুমি দাড়া, আমিও যাব তোর সাথে। 
রুমি থমকে দাঁড়ায় , অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে বিথির দিকে । 
কি দেখছিস ও ভাবে রুমি ? চল , দ্রুত যেতে হবেতো । তা না হলে হয়তো ক্লাসটাই আর করা হবে না । 
তুই যাবি বিথি ? তাও আবার রিনির খোজে? 
তোরা আমাকে খুব সার্থপর মনে করিস তাইনা রুমি? 
ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ভাসিয়ে রুমি বলে - তুই বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। শখ করেই এই হোষ্টেলে থাকিস। তোর সাথে আমাদের তুলনা করা ঠিক না। এতে তোর মান সম্মান নষ্ট হবে। 
রুমি এভাবে বলিস না। তোরা আমার অনেক কিছুই জানিস না। 
কথাগুলো বলতে বলতে বিথির গলাটা ধরে আসে। চোখের কোনে ভেসে ওঠে কষ্টের নোনা জল । 
কিরে বিথি তোর চোখে পানি? 
নিজেকে সামলে নিয়ে বিথি বলে – চল , এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে ।
।।
চলবে

একাকীত্ব একদিন ।। দেবজ্যোতি কাজল


একাকীত্ব একদিন
 

আমি উষ্ণ সূর্যাস্ত দেখতে গেলাম
   কি-ভাবে একটা রেড-সার্কেল
   আকাশে ছিটকে পড়ে থাকে ভেবে ।

   সূর্যাস্তটি যেনো একটি আহত দম্পত্তি
       তুমি আর আমি পাশাপাশি হাঁটছি
                   একজন চিত্রশিল্পীর রঙে 
                                 আমরা দুজনই ,
                   হুবাহু সূর্যাস্তের আকাশে ।

ততক্ষণে তৃণভূমিটি শান্ত রেড পাণ্ডা
      সেখানে কেউ নেই ; আমি ছাড়া
              গুমোট নিরাকার পরিবেশ 
                আমি প্রশস্ত নিশ্বাস , 
                 ভিতরে টেনে নিতেই
         আমার হৃদয় দৌঁড়ে ছুটে গেল-
                        তার উড়ন্ত আঁচলে ।
            এ যেনো তোমারই ছদ্মবেশ ।

আকাশ কে আমার লিভিং ছাদ মনে হ'লো
      তারপর এক ঝাঁক পাগল পাখি
         ডানা ঝাপটায় উড়তে উড়তে
            একটি পরিবারের মত
        আকস্মিক বিদ্যুৎ চমকায় চোখে
 তার রোমাঞ্চ শ্বাসের হাত স্পর্শ করে ।

অন্তর্ধান দূরত্বে , স্ট্রীটলাইটের প্রাচীন মায়া
      রোমিও উজ্জ্বলতার চিকণ আভা
রাত্রিকে আকার দেয় মহাকায় হলমার্কে
  আমি দ্রবনীয় জল , আচরণীয় মেঘ ।
   দু মুঠো অন্ধকার উপরে ছুড়ে দেই
                      বৃষ্টি হয়ে ফিরে আসে 
                        তোমার পায়ে পায়ে ।
  

নদীর রজঃস্বলা বাতাস চুলে ঝড় তুলে
   ভিতরে টান দেয় তার দীর্ঘ বাহু
এই সন্ধ্যায় শরৎ মুখোমুখি দাঁড়ায়
                      একেক রাতের মত ।

আমি পরিস্কার শুনতে পায় নীরবতায়
  বাতাসে ভেসে আসা গানের সিম্ফনি
অন্ধ সুরের গতি পরমাণু তরঙ্গে অণুতে ভাঙ্গে
          অতীত কাছে এসে বসে 
         আমার রক্ত তোমাকে ছুঁয়ে
বেদনার সূর্যাস্তে আমি অশ্বারোহী
সব মিলে আমার-
ব্যর্থতার ছোট পাখিটি গেয়ে ওঠে ,
                এই করেছ ভাল , নিঠুর ,
                           এই করেছ ভাল 
                  এমনি করে হৃদয়ে মোর 
                          তীব্র দাহন জ্বালো ।...  ... ..

এক ঝলকে ।। সুধাংশু চক্রবর্তী


এক ঝলকে 


দিবসের বিলীয়মান আলোকে ক্রমেই ঝাপসা হচ্ছে চারপাশ
পাখির ডানায় ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠছে সেই অবসরে
সবাইকে একদিন ফিরে যেতেই হবে ফেলে আসা নীড়ে  

ছুটন্ত ট্রেনের জানালা স্পর্শ করে গেল যে মেয়েটির শ্রীমুখখানি 
বুকের ভেতর তোলপাড় তুলে সে যে সরে যায় আরও আরও দূর
বুকের ভিতর চলকে ওঠা রক্তকে চিনিয়ে যায় অতীতের কালো গহ্বর

অতি নাটকীয়তা ছেড়ে এবার আসল কথায় চলে আসি 
দিনের বিলীয়মান আলোক আবারও ফিরে পাবে এই তমসাচ্ছন্ন পৃথিবী
সামান্য বিশ্রামের পর পাখির ডানাও ফিরে পাবে তার হারানো সুখ 
অথচ ছুটন্ত ট্রেনের জানালায় আর ধরা দেবে না মেয়েটির শ্রীমুখ । 


  


ভ্রমণ ।। অনন্ত সুজন

ভ্রমণ 

অপ্রত্যাশিত অথচ অবিরাম বৃষ্টির আদরে আদরে
আমরা পৃথিবীর বাইরে চলে গিয়েছিলাম! 

বিসর্পিল ছায়াপথ ধরে, ব্রহ্মাণ্ডের অসম্ভব-অনধীত
জংশনে, বন্দরে, রঙধনু বিছানো পথের উপর---
নামিয়ে দিয়েছি ব্যথার প্রপাত,
নিভৃতের অশ্রুপাত কোন! 

যন্ত্রযানে উড়ছি অলৌকিক, অধরা নির্জনে
পেছনে শোভান্বিত তুমি, ধরে আছো কল্প-পারিজাত।
স্কন্ধের মধ্যভাগে আছড়ে পড়ছে প্রশ্বাসের উষ্ণ হিল্লোল 
স্ফুরিত ছোবল রক্তিম উদ্ভাসে বিমন্দ্রিত! 

ঈর্ষাকবলিত গ্রহে গ্রহে শিহরণ, গুচ্ছ গুচ্ছ ঝলক-ঝড়
বিরচিত চুমুর চাঁদমারি আসক্তির আয়াতে অফুরান বাজে!
                      মোহমগ্ন বিউগল যেনো!

আমরা ততক্ষণে নেপচুনের হিমেল বনভূমিতে
বিলীন হচ্ছি একে অন্যের ভেতর!  

নির্ঘন্ট জিঞ্জির ।। রাজন্য রুহানী


নির্ঘন্টজিঞ্জির

দেখিস ভাঙা পা, একদিন আমাদের আত্মাও প্রিজমা হয়ে যাবে, 
একদিন আমরাও পেয়ে যাবো উড়বার ডানা, 
চিরায়ত ল্যান্সের বাইরে তুলে নেবো নির্ঘণ্টজিঞ্জির...

 পালিশচামড়া ছুঁয়ে বলিরেখা তৈরি করছে চোরকুঠুরি, 
দৃষ্টিনন্দিত মুখোশে হাসছে বালক, ধর্মকল বাতাসে নড়ছে 
আর আমরা দেখছি মৃত্যুকূপজলে নিজের মুখটা কী রকম ভয়ঙ্কর হতে পারে...

 এইসব বাতুলতা ছেড়ে নিচু ডালে ঝুলে থাকে 
অনির্ণীত মেসবাড়ি, ছেঁড়াখোঁড়া চোখ...

পুরুষস্নান ।। নকিব মুকশি


পুরুষস্নান

কাপর নিংড়ানোর কৌশলে যদি ঝরে
যাপনের সব পাপ, জটাভুল...
অ-শ্রীময় উবে যাবে একদিন, একদম
একদিন, তন্দ্রার গমনে...

পুরুষস্নান, গন্ধ মোচার ঢঙ,—নদীর
সান্নিধ্যের এক উদযাপন... প্রজলতানে
অবনত নারীঠাকুর—রিল্যাক্সময়...

মধ্যবর্তী পথ ।। সিয়ামুল হায়াত সৈকত


মধ্যবর্তী পথ 

বাভারীয় আল্পসের উত্তরে যদি এসে
শুকনোর মধ্যে পাখাটির ঘূর্ণন, এক
মায়া অথবা সমুদ্র জানে আগুনের গুণ

প্রেতাত্মা জুড়ে দক্ষিণ মন, ভয় নেই
জেগে উঠলেই ভুল সামতান সম্মুখের
মূর্খ আমি, নিঃসঙ্কোচ–বেঁচে থাকি এইতো
আবার ঘুমে উত্তরের তুমি, আহ্ জাদুকর!

প্রত্যয় ।। শ্রীলেখা চ্যাটার্জী


প্রত্যয় 
              
আমার প্রত্যয় ! তোমায় দিলাম কবে 
প্রস্ফুট আশ্বাস ! ভ্রমরের কাণে কাণে 
ফুলের সঙ্গম ! মুসাফির পথ টানে  
জমাবে বাসরে ছোট ছোট পাড়ী যবে | 

দিগন্ত ভাসানে , অতলে তলিয়ে যায় 
তীব্ৰ বেদনায় ! অসফুট চাহিদা কাঁদে ,
রাতের কপোলে , বৃস্টি হয়ে ঝরে ফাঁদে ;
আমার প্রত্যয় ! মেঘেরা নিলাম চায় | 

বর্ষার দেয়ালে , অরণ্যে মদিরা আসে ; 
জোনাকি নর্তকী ,মাতাল কুহেলী ভ্রূণে !
কুয়াশা জড়ানো বর্ষা বিলাস মৈথুনে !
প্রত্যয় ছড়ায়ে বর্ষার যৌবন বাসে ! 

শিথিল নিয়মে বাঁধা বিধির লিখন ;
বিধৌত সমাজ কার নিদানের ক্ষণ ? 

দৃশ্যমুখি ।। সতেজ মাসুদ


দৃশ্যমুখি 
 
 অন্য পারেই গলে আছো— ভিন্ন স্বাদে :
 অকারণে ঝলসে যাও মনোদিত এসিডে।

 মাঝের যে সেতু
 তফাৎ তার নাটাই আর আকাশগামী ঘুড়ি।
 নির্ণীত পারাপার কেবলই সাদৃশ্য গাঁথে,
 অদৃশ্য থেকে যায় স্বাগতিক সংসার । 

 অভিনীত পর্দা আঁটাও মুখে 
 বিন্দুগত ভাষা ঢেকে রাখতে চাও। 
 অথচ, জাননা তুমি !
 চোখই ঘটনার চিহ্ন, সঙ্কেত, সাক্ষী আর মন্ত্র বহনকরে।

বাড়ির পথ ।। বর্ণালী চ্যাটার্জী


বাড়ির পথ

সবাই বলছে সম্পর্ক তো সেই কবেই শেষ তবে এখন কেন?
তবুও বাড়ি চেনা প্রয়োজন,চিনে রাখা ভালো।
কি যেন বলেছিলো...
স্টেশান থেকে দু'পা হেঁটে।
ডানদিক বলেছিলো নাকি বাম!
হ্যাঁ,হ্যাঁ ডানদিক,স্টেশান থেকেই দেখা যায়...
প্রথমে ডানে তারপরে বাম,তারপর তিনমাথা পার করে ছোট্ট বাঁকে গলিপথে বড়ো বাড়ি।
একমাত্র রাস্তা তাও খুঁড়ে রেখেছে কোনো এক আক্কেলহীণ মানুষের দল।
চার-পাঁচটা রাস্তা ঘুরে,বৃষ্টিভেজা আহ্লাদ নিয়ে পাওয়া গেলো সে বাড়ি।
একেবারে বেরঙিন যেটুকু রঙ ছিলো কল্পনার তা।
স্বপ্নের ইঁট দিয়ে গড়া ছিলো ইমারত,আসলে একচালা।
ফিরতে হবে শীঘ্রই দূর থেকে দেখার সাধ মিটে গেছে,পাছে দেখে ফেলে কেউ।
চারটে বাঁক পেরিয়ে যে রাস্তাটা পড়বে সেই রাস্তায় আরও তিনটে মোড় ঘুরে,ছোটো গলিপথ পেরোলেই পড়বে স্টেশান,
তারপরে বাড়ি ফেরা।
তাও বলবো তোর বাড়ি তোর চেয়ে কম গোলমেলে

চিঠির ভাষা ।। পঙ্কজ চন্দ্র শীল


চিঠির ভাষা


আজই আমি লিখবো চিঠি,আমার প্রিয়ার কাছে
ফোনের ভাষা ভাল্লাগেনা চিঠিতে মন নাচে!
চিঠির ভাষা নেই কেনো আজ,কাঁদি মনের দুখে
সকাল-দুপুর চিঠি পেলে হাসতো প্রিয়া সুখে।

চিঠি হলো মনের ভাষা,ফোনে বলা যায়না
ফোনগুলি আজ রোগ-জীবানু! চিঠি হৃদয় আয়না।
চিঠি হলো মান-অভিমান, মায়ের মুখের হাসি
মোবাইল হলো মান-অবসান,বিরাট সর্বনাশী!

মোবাইল-ফোনে ফিরিত করে,হারায় বাড়ি-গাড়ি,
দেওয়ার জন্য সাধ থাকেনা,প্রিয়ার ওই লাল শাড়ী।
শাড়ীর বায়না লিখা ছিলো সোনার চিঠির মাঝে,
'আমি প্রিয়র বউ হবো কি!' ভাবতো সকাল-সাজে।

চিঠির জন্য আমার মাতা প্রতীক্ষা ওই মাসে
ছেলের চিঠি পেলে মাতা,প্রাণ খুলে যে হাসে।
চিঠির মাঝে যত ভাষা, সেই ভাষা নেই ফোনে!
চিঠির মাঝেই বিষাদ-বৃষ্টি দু-নয়নের কোণে।

তবু তোমরা চিঠি লিখো প্রিয়দেরই কাছে
বাংলার বুকে একটাই দাবী,চিঠি যেনো বাঁচে।
চিঠির ভাষায় আকুল পরাণ,অন্তর ভরা সুখে,
চিঠির ভাষা প্রাণের ভাষা,লালন করি বুকে।


রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বটগাছ ।। দেবাশিষ রায়


বটগাছ                                                       


এই বাড়িতে বউ হয়ে যেদিন এসেছিল সুচেতনা,দেখেছিল ছাদের রেলিংয়ের একপাশে
একটা বেশ বডসড় বট গাছ কংক্রীট ভেদ করে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে.নিজের
মতের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে গিয়ে এই বিয়েতে তাকে মত দিতে হয়েছে. বাবার আচমকা
একটা ভালো মাপের স্ট্রোক আচমকাই তাদের পরিবারকে বেশ শক্ত একটা
প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল. কন্যাদায়গ্রস্ত বলাটা ঠিক
হবে না. তবে সুচেতনা বুঝতে পেরেছিল বাবা চাইছেন যত তাড়াতাড়ি হোক ওর একটা
বিয়ে দিয়ে যেতে পারলে উনি সুখী হবেন. সুচেতনা পাত্রী হিসেবে যথেষ্ট
গুণবতী. তাই কন্যার পছন্দের নাকটিও মুখের ওপর বসানো নাকটির মতই তীক্ষ্ণ
ছিল. কিন্তু বাবার আচমকা স্ট্রোকটা সব পছন্দ অপছন্দকে নডবডে করে তুললো.
ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এই বিয়েতে তাকে মত দিতে হোল. টাকমাথা কালো গোলগাল
দাঁত উঁচু স্বামীর সাথে সেদিন সে ওই ছাদের বট গাছটার এক অদ্ভুত সাদৃশ্য
খুঁজে পেয়েছিল. তার মনের প্রাসাদের দেওয়ালে অনাহুত অতিথির মত জোরজার করে
ঠাঁই করে নেওয়া স্বামীটিকে মনে হয়েছিল যেন ওই গাছটি.
বিয়ের পর থেকে একটা বিষয়ে তার খটকা লাগছিল. অফিস থেকে স্বামীর ফেরত আসবার
সময়টি যেন মনে হোত অস্বাভাবিক দেরী হচ্ছে. বললে সে বলে-জানো না তো আমাদের
অফিসে কেমন কাজের চাপ. তাই বলছো.



একদিন ওর এক সহকর্মীর কাছ থেকে একটা খবর পেলো. একটু সন্ধ্যে করে বাসে এসে
খান্নার সামনে নামলো. চুপ করে উদ্দিস্ট জায়গায় পৌঁছে দেখলো যা শুনেছে তা
নির্ভুল. সে ফুটপাতের এককোনায় মাদূর পেতে বসে সাত আটটি অল্পবয়সী
বস্তিবাসীর সন্তানদের তন্ময় হয়ে পড়াচ্ছে.
রাত্রিবেলায় খাওয়ার টেবিলে বসে সুচেতনা বললো- “আমার কাছে লুকোনোর কোন
দরকার ছিলো কি? আমি কি বাধা দিতাম?”
শুকনো হেসে সে উত্তর দিলো-“নতুন বউ তুমি. ভয় ছিল.শুনলে যদি বেঁকে
বসো.নতুন বউকে সময় না দিয়ে বস্তির ছেলেমেয়েদের পড়ানো? আসলে অনেককেই
দেখেছি বিয়ের পরে এই কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে. তাই ভয় তো একটু ছিলোই.”
সেই রাতে সুচেতনা স্বপ্ন দেখলো ছাদের বটগাছটা বিশাল বড় হয়েছে. বহু মানুষ
তার ছায়ায় নিশ্চিন্ত আশ্রয় নিয়েছে.
সুচেতনার ছাদে এখন রুফটপ গার্ডেন. অনেক রকম গাছের ঝলমলানো হাসিতে মনের
আকাশ উজ্জ্বলতর.বট গাছটা আছে এখনও. তার শেকড় ছড়িয়েছে বাড়িটার দেওয়াল
জুড়ে. কংক্রীট ভেদ করে ভেতরে ঢুকে এসেছে অনেকটা.

অরুণ ।। রুপা সাধুখা

অরুণ
      

অরুণ আজ খুব খুশি। আর হবে না ই বা কেন.! ছেলে সাউথ সিটি তে ফ্ল্যাট কিনেছে। ভাবা যায়.! ১১ তলায় ফ্ল্যাট, সেখান থেকে পুরো শহরটাই যেন দেখা যাই ব্যালকনি তে দাড়িয়ে। কি সুন্দর ভাবে সাজানো ড্রয়িং রুমটা, এত ফার্নিচারের বহর, আর শোবার ঘর থেকে কিচেন সবেতে এ.সি। অরুনের চোখে খুশির সাথে গর্ব। কখন যে এত বড় হয়ে গেল ওর ছোট্ট শুভো.! ওর সারাটা জীবন তো বাস এ ধাক্কা খেয়ে, উত্তরপাড়ার ছোট ছোট গলিতে ঘোরাফেরা করে আর টু বেডরুম এর ছোট ফ্ল্যাট এ ই কেটে গেছে, কখনো ভাবেনি যে একটা দিন ও এই কলকাতা শহরের ৪৫ লাখের ফ্ল্যাট চোখেও দেখবে.! না, লোভ হচ্ছে না, সেটা ওর কখনই ছিল না, আনন্দ হচ্ছে, ছেলের জন্য, ছেলের এত সুন্দর একটা জীবনের জন্য।
"তাহলে আমরা কবে এখানে শিফট করছি শুভো.?"
"আমরা.! বাবা শুধু আমি শিফট করছি। আসলে ত্রিশা আর আমি বিয়ের পর একটু পারসনাল টাইম চাই, তাই তো এই ফ্ল্যাট টা কিনলাম। আর উইক এন্ডস এ তো দেখা হবেই.! আর তুমি এই বয়সে তোমার পুরনো জায়গা ছাড়বে না কি.!"
চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো অরুনের, জলে। নিজেকে খুব বোকা লাগছিল, কেন ভাবলো যে ওই ফ্ল্যাটটা তে ওরা একসাথে থাকবে.! ৩০ বছর ছেলের সাথে কাটিয়েছে বলে আরো জীবনের বাকি কয়েকটা বছর ও যে ছেলে ওদের সাথে কাটাবে এর কি মানে আছে.? এটা ভাবাই হয়ত ভুল.! হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পরে গেল, ছেলের পাঁচ বছরের জন্মদিনটা বড় করে করবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ব্যবসাটা সেই মাসে ভালো চলেনি, তাই নিজের কেসিওটা বিক্রি করে দিয়েছিল। আজ ওই কেসিওটার কথা খুব মনে পরছিল, কানে বাজছিল যেন সুর গুলো।
হঠাৎ পাশ থেকে এসে দুটো নরম হাত ওর হাতটা কে আঁকড়ে ধরল। এই দুটো হাতই ওকে ৩৫ টা বছর ধরে সামলেছে। খুব অদ্ভুত লাগলো অরুনের, সুজাতার চোখে তো জল নেই, এত বড় একটা খবর শুনেও.! "তোমার খারাপ লাগছে না.?"
"না তো, আমি তো জানতাম এটা হবে। আসলে মা রা ছেলেদের বেশি চেনে। শুভো তোমার মতন না, প্রথম থেকেই। খুব হিসেবী ও, যাই হোক ৩৫ বছর একসাথে কাটিয়েছি আমরা, বাকি গুলো ও কাটিয়ে দেব। তবে এবার একটু অন্য রকম ভাবে বাঁচব, শুধু দুজনের জন্যে”
অরুনের মুখে হাসি..., হঠাৎ মনে হলো এই টু বেডরুমস ফ্ল্যাট, উত্তরপাড়ার সরু গলি গুলো, আর এই মিষ্টি মুখের একজন শুধু ওর..., এই গুলো ওর কাছ থেকে কেউ কখনো নিতে পারবে না........
হ্যাঁ, তিন বছর পরে শুভো ফিরেছিল। তৃষার সাথে ওর সম্পর্কটা টেকেনি, ডিভোর্স এর দরজায় ওরা, আর ত্রিশা এলিমনি তে সাউথ সিটির ফ্ল্যাট টাই চেয়েছে। বিধ্বস্ত চেহারায় সেই রাতে ফিরেছিল শুভো, মা বাবার কাছে, নিজের বাড়িতে, নিজের লোকের কাছে। পরের দিন সকালে কফি নিয়ে সুজাতা ওর কাছে গিয়েছিল যখন মা কে জড়িয়ে ধরেছিল শুভো, হয়ত একটা আশ্রয় খুঁজছিল ও.! সুজাতা ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, "ধীরে ধীরে নিজের জন্যে একটা ফ্ল্যাট খুঁজে নিস। আসলে তোর সাথে থাকার অভ্যেস টা আমাদের কেমন চলে গেছে, আর এই বয়সে নতুন করে আর অভ্যেস তৈরি করতেও আমাদের ইচ্ছে করছে না। শনি রবিবার আসিস, দেখা হবে.!" শুভর সেইদিন এক মুহুর্তের জন্য একটা ধাক্কা লেগেছিল, তারপর মনে হয়েছিল মা বাবা ওর মতন হিসেব করতে কবে শিখল.!!....

ঝড় ।। রওশন রুবী


ঝড়


নিনাদ সম্পাদকীয়টা শেষবার পরখ করছে, প্রেসে পাঠাবার আগে তাকে প্রতিটি লেখার সেটিং খুঁটিয়ে দেখতে হয়। পত্রিকার কাজে প্রায় রাতে ফিরতে ভোর হয়। গরম জলে রেডি’টির প্যাকেট দিয়ে চুমুক দিতে দিতে আনমনা হয়ে যায় নদীর বিধ্বংসী উচ্ছ্বাস শুনতে শুনতে মনে মনে ‘লাহাওলা ওয়ালা-কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহি....পড়তে পড়তে হাতের কাজ দ্রুত গুছিয়ে ফেলে বৃষ্টি ঝড়োবাতাস মাথায় বেরিয়ে পড়লেন, হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ে যায় তার, মা বলতো খুব বিপদে এই দোয়াটা বেশি বেশি পড়িস্ খোকা। এই বিপদের দিনে কতোগুলো বছর পর মায়ের কথা মনে পড়ল, আসলেই বিপদে পড়লেই বুঝিবা শ্রেষ্ঠ আশ্রয়ের কাছে ফিরতে চায় মানুষ, আর ছায়া চায়, প্রার্থনা চায় মৌলিক। পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ অফিস ও বাসা, জোরালো বাতাসের মুখে উড়ে যাচেছ ঘরের চাল, গাছের ডাল আরো অন্যান্য । ঘূর্ণিঝড়টি দ্রুত ধেয়ে আসছে তার শোঁশোঁ শব্দ কতটা ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছে, তা একজন ভুক্তভূগি ছাড়া বুঝতে পারবেনা কেউ। নিনাদ সংবাদটি জানতো, এবং এনিয়ে আজ সম্পাদকীয়ও লিখেছে, ভেবে রেখেছে আজ একটু আগেই বাড়ি ফিরবে, কিন্তু কাজ পাগল মানুষ কাজ করতে করতে ভুলে গেছে সব, দশ নম্বর বিপদ সংকেত ছিলো এবং ও রাতের শেষ দিকে হানাদেবে উপকূলীয় অঞ্চলে। এর গতি পলকের চেয়ে দ্রুত। তিনতলা বাসার নিচ তলায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সন্তানের জন্য মনটা কেমন করে উঠেসর্বগ্রাসীর গর্জনটা রাক্ষসের মত এগিয়ে আসছে এবং খুব দ্রুত বুঝতে পেরে জোরে পা চালালেন, বাতাসের ঝাপটা, বৃষ্টির ছাটে পথ দেখা মুশকিল, অন্ধের মতো খেয়ালেই এগুচ্ছেন। বাসাটা আজ বেশ দূরে লাগছে, মনে হচ্ছে হিমালয় অতিক্রম করছেন। প্রায় পেছনে  বিধ্বংসী শব্দটা হতেই এবার দৌড়ানো শুরু করলেন নিনাদ। জল আর  বাতাসের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা চারটি খানি কথা নয়। যেভাবেই হোক ঝড়ের আগে পৌঁছোতে হবে, পিয়াল ঝড় বাতাসকে খুব ভয় পায়। চাবিটা বের করে হাতে নিয়ে রাখলে সময় বাঁচবে। দশ বছর বয়সী পিয়াল, সাতবছর থেকে কাজে থাকা সহায় সম্বলহীন ষাটঊর্ধ্ব কাজের বুয়াসহ ঘরে থাকে গত ডিসেম্বর থেকে পাকাপাকি ভাবে ¯েœহা চলে যাবার পর থেকেই। প্রতিদিন দেরি হয় ফিরতে তাই সন্ধ্যায় দুটো দরজার একটিতে তালা দিয়ে বের হয়, একটি ওরা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেয়। হঠাৎ আৎকে ওঠে নিনাদের হৃপিন্ড, দৌড়ের মধ্যেই ভালো ভাবে পকেট হাতড়ায়, উফ! নেই! নেইই! পায়ে এসে আছড়ে পড়ে নদী উপছানো জল, চাবি কি অফিসে? বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে প্যান্ট বদলেছে সেখানেকি রয়ে গেছে? না কিছুতেই মনে আসছে না, কেন, কেন? বৃষ্টির মধ্যেও নিনাদ ঘামছে টের পায়। হাটবিট বেড়ে যায়, গলা শুকিয়ে ওঠে, আজ বাসাটা এতো দূর কেন? পিয়ালের জন্য ঢুকরে ওঠে বুক; ছেলেটা ঝড় বাতাসের আতংকে মরবে? আর বুয়া ? যার কেউ নেই , নিনাদকে তার সন্তান ভাবে। মা! মা! হ্যাঁ ভুলে থাকা মায়ের মুখটা আজ বারংবার মনের কোণে ভেসে উঠছে এবং শেষমুহূর্তে যখন জলোচ্ছ্বাসের মত আগলে নিলো নিনাদকে তখনি তিন ঘরের জানালায় আবছা দু’টো ছায়ার মত দেখতে পেলেন, যার একটি ছোট্ট পিয়াল চিৎকারে বোধগম্য হলো, সে চিৎকার করে বলেেছ “ বাবা জলদি! দৌড়াও বাবা! দৌড়াও!” বুয়ার চিৎকারও মিলায় সেই সঙ্গে “ ও বাজান একটু পা জোরে ফ্যালাও! দৌড়াও না বাজান! বাতাস গিল্লা নিবো তোমাক! আল্লাহ্ আমারার বাজানরে জোর দাও! আল্লাগো জো-র-র দা- -ও।” আর কিছু শুনতে পায় না নিনাদ জলের ও বাতাসের তোড়ে ।
যখন নিনাদ চোখ খোলে দেখে মুখের উপর ঝুঁকে আছে দু’জোড়া ভেজা অপেক্ষার চোখ। তাদের মাথার ফাঁক দিয়ে শাদাছাদ দেখা যাচ্ছে, মুখগুলো হেসে উঠলো হারিয়ে মূল্যবান বস্তু ফিরে পেয়ে যেমন হাসে কেউ। কি হয়েছিলো মনে করতে করতে উঠে বসে, পিয়াল পাকামু গলায় বলে “ বাঁচালে গো বাবা, বাঁচালে; ভয় পেয়ে ছিলাম তোমাকেও বুঝি হারালাম এই ভেবে। এই বুড়িমা তোমাকে টেনে তুলেছে বিছানায়, নয়তো তুমি পানিতে ভেসে থাকতে, দেখ ঘরে কেমন পানি থৈথৈ করছে, আমাদের জানালা গুলো উড়ে গেছে, সেদিক দিয়ে বাতাসের পাক ঢুকতে ঢুকতেই জলও ঢুকে পড়লো। দেখ বুড়িমা তোমাকে তুলতে গিয়ে পায়ের আঙুল উল্টে ফেলেছে, অনেক রক্ত ঝরেছে।” ছেলেকে কোলে টেনে আদর করে নিনাদ, বুয়ার পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধতে হবে। পিয়াল আবার বলে- “ বাবা সকাল থেকে কিছু খাইনি আমরা, উঠো খাবো না? খুব খিদে পেয়েছে।” হ্যাঁ যাচ্ছি , ফ্লাটের সবাই এখানে ছিলো কি পিয়াল? মনে হলো কারো কারো কথা শুনছিলাম। “ হ্যাঁ বাবা সবাই ছিল। কাল তনয়া আন্টি আমাদের ডেকে বলেছিল ঝড় হবে। না বললেতো আমরা কিছুই দেখতে পেতাম না তাই না ?” সবাই তোমাকে দেখতে এসেছিল, নিখিল কাকু বলেছে পিয়াল ঝড়বাতাস ভয় পায়, সইতে পারবে না ; এখন দেখি নিনাদ সাহেবও একই রকম, আমি ওনাকে চিকিৎসা দিয়েছি, প্রেসার হাই হবার কারণে এমন হয়েছে। নিনাদ চেয়ে দেখে বুয়া নেই, কখন সরে গেছে। ঐ শুভার্থীরাও নেই, যে যার মতো চলে গেছে, মেঝেতে পানির ¯্রােতে ভিজে; ভেসে পড়ে আছে নানান জিনিস, ঘরের অনেক জিনিস বাতাসে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে। মেঝের দিকে তাকাতেই নিনাদ আৎকে উঠে, পানিতে ভাসছে মাবাবার ছবি, মায়ের হাতের শেষ চিঠি, যার একটি শব্দও বোধ হয় তুলতে গেলে পানি থেকে রক্ষা পাবেনা। স্মৃতিচিহ্ন আর কিছুই রক্ষা করা গেলনা,  বুয়া নিজের মত কাজ করছে, কিছু শুকাতে ছাদে তুলছে, কিছু ফেলে দেবার জন্য এক জায়গায় জড়ো করছে। নিনাদকে বললো “ বাজান সবতো গেইলো যাক তুই রক্ষা পাইছো হেয়াই শান্তি।” নিনাদ বিছানার নিচে জ্যাবজ্যাবে পানিতে পা রেখে খাটের কোনায় বসেন, নিচতলায় তিন পরিবারের সবার একই অবস্থা, দুপুর গড়িয়েছে পানি নামছে সামান্যই, খোলা দরজায় একটি ট্রেতে কয়টি বাটি নিয়ে তিনতলার আরিফ সাহেবের বড় মেয়ে নদীয়া দাঁড়িয়ে, প্রায় বিশ বছর বয়সী কলেজ পড়–য়া সুশ্রী মেয়ে নদীয়া। ওকে ঘরে ঢুকতে ইসারা দিলেন নিনাদ, সে ঘরে ঢুকে বাটিগুলো নিনাদের পাশে খাটের কোনায় রাখে আর মিহি সুরে বলে কাকু মা বলেছে দুপুরে ও রাতে আমাদের ওখানে খেতে। 
মাথাটা ভার হয়ে আছে, চা খাওয়া দরকার। অফিসে কি হলো না হলো খোঁজ নেয়া প্রয়োজন, দেখতে যেতে হয় মানুষের অবস্থা, পাশে দাঁড়াতে হবে বিপদগ্রস্থ মানুষের। নিনাদের আতঙ্ক বেড়ে যায় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তি ভয়াবহতা দেখে, কি জানি একমাত্র বোন লায়লা ও তার পরিবারের কি অবস্থা! কত মানুষ নিখোঁজ রয়েছে এখনও, অফিসের,বাসার পাশোবর্তী যে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, সেগুলোতে গিয়ে মানুষের দূর্দশা দেখে ঢুকরে উঠে বুকের ভেতর, নিমাই নামের এক যুবক কেঁদে ভাসালো, বলে ‘ দাদা সব হারিয়ে মৃত্যুর মত বেঁচে আছি। আবেগে আপ্লুত ফরিদ বলে চোখের সামনে সব মরে পড়ে রয়েছে, কাউকে বাঁচাতে পারিনি ভাই, আত্মসত্বা রেবেকা ভাঙা ঘরের দাওয়ায় বসে স্বামীর জন্য বিলাপ করছে। একটি শিশু একটি লাশের পাশে বসে মা মা বলে চিৎকার করে গগন ফাটাচ্ছে। কে শুনে কার চিৎকার। বৃদ্ধ হানিফ বলে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সব, এই জীবনে দুইবার দেখলাম, স্বজনহীন বেঁচে থাকা এই বয়সে দূর্বিসহ, অপেক্ষায় আছি তবু স্বজনদের ফিরবার,বহু পরিবার অপেক্ষা করে আছে স্বজনদের জন্য, হয়তো কোনদিন কেউ ফিরবে না। স্বজন হারা পরিবারের কান্না নিনাদের শিরা-উপশিরার প্রকোষ্ঠে বিঁধে।