পৃষ্ঠাসমূহ

পুরনো সংখ্যা

সম্পাদকীয়ঃ কুয়াশা।। মে সংখ্যা।। ২০১৮ইং।। সংখ্যা ১৩ ।। বর্ষ ২।।


সম্পাদকীয়ঃ কুয়াশা।। মে সংখ্যা।। ২০১৮ইং।।

বাংলাদেশ আমাদের রক্তের বিনিময়ে কেনা একটি দেশ,সেকারনে আমাদের ভালোবাসা যেমন প্রগাঢ় তেমনি আমাদের বিশ্বজগতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার হিম্মতটাও প্রগাঢ়। পৃথিবীতে এই ছোট্ট একটি দেশ মর্যাদাপূর্ণ স্থান দখল করছে বিভিন্ন বিষয়ে। বাংলাদেশের দামাল ক্রিকেটারদের ভালো একটা পারফর্ম পৃথিবীজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাঙ্গনে বিভিন্ন উপাধী, পদক,স্কলারশীপ জয় করছেন ঠিক সেই মহুর্তে বাংলাদেশ নিজস্ব নামে, নিজস্ব পতকা সম্বলিত একটি স্যাটেলাইট মহাকাশে স্থান দখল -খুব বিস্ময়কর এবং মজার একটা প্রাপ্য। ভূ-স্বর্গে যেমন সুনাম বিস্তার ঘটছে মহাকাশেও এবার নাম লিখলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে স্যাটেলাইট ক্লাবের সদস্য। অনেক দেরিতে হলেও আমরা প্রযুক্তিতে বড় একধাপ এগিয়ে গেলাম।

এবারের কুয়াশা প্রতিবারের চেয়ে আরো ব্যপক পরিসরে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। জানি, আপনারা কুয়াশাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। মাসের শুরু থেকে উদগ্রীব হয়ে বসে থাকেন, কখন সেই নামের তালিকা হাতে পাবো। এবার খুব জটিলতার মধ্যে সময় পার করেছি জন্য একটু হলেও দেরি হয়ে গেলো। সেজন্য ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আগেও বলেছি 'কুয়াশা' সকলের জন্য উন্মুক্ত। লেখক নয় বরং লেখাকে বিশ্বাস করে। 

সূচিপত্রঃ কুয়াশা।। মে সংখ্যা।। ২০১৮।। সংখ্যা ১৩ ।। বর্ষ ২।।

লেখক তালিকাঃ কুয়াশা।। মে সংখ্যা।। ২০১৮।। সংখ্যা ১২।। বর্ষ ২।।


প্রবন্ধঃ
কবির মুকুল প্রদীপ, রহিমা আক্তার মৌ।

গল্পঃ
রুদ্র সুশান্ত। 

রম্য গল্পঃ
বিশ্বজিত চৌধুরী, মুহাম্মদ নাজমুল হক।

কবিতাঃ
সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়, সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী, হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুপা সাধুখা ,মতিন বৈরাগী, অমিত রায়, দ্বীপ সরকার, এ বি এম সোহেল রশিদ, পিডি বিজয়, রওশন রুবী। 

বই আলোচনাঃ
রাত উল আহমেদ। 

অণুগল্পঃ
মোহাম্মদ জসিম, জাকির মোহাম্মদ, এম এ হান্নান।

কবিতাঃ
টিপু সুলতান,সুশান্ত হালদার,আসমা মতিন, সকাল রায়, মাসুদ চয়ন, সালামিন ইসলাম সালমান, কবির হুমায়ুন, জেবুননেসা হেলেন।

মুক্তগদ্যঃ
সীমন্তিনী সাহা, সবর্না চট্টোপাধ্যায়। 

কবিতাঃ
কৃপা আচার্য, হিরণ্য হারুন, আব্দুল আজিজ, মনোজ জানা, রাশেদা আক্তার, মোহিত অনু, হাফিজ রহমান, শিশির রায়, সজল মালাকার, সিত্তুল মুনা সিদ্দিকা বশিরুজ্জামান ,মজনু মিয়া,
মামুন সুলতান। 

ছড়াঃ
স্বপন শর্মা,কবির কাঞ্চন, সাইদুর রহমান, হুমায়ুন আবিদ, রমজান আলি রনি।

প্রবন্ধঃসুররিয়ালিজমের প্রাসঙ্গিকতা ও অপ্রাসঙ্গিকতা ।। কবির মুকুল প্রদীপ

সুররিয়ালিজমের প্রাসঙ্গিকতা ও অপ্রাসঙ্গিকতা
------
------
ডাডাবাদী আন্দোলনের অন্তিমলগ্নে এই পাশ্চাত্য শিল্প আন্দোলনের সূচনা হয় যার মেন্যুফেস্টো লিখেছিলেন আঁদ্রে ব্রেঁত ।তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী,সে কারণেই ফ্রয়েডিও মনোবিকলন তত্ত্বকে শিল্পে যুক্ত করে জন্মদিলেন এই অভিনব শিল্প-আন্দোলনের।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শিল্প-বিবর্তনের মূল ভিত্তি এবং বুর্জোয়া বাস্তবতা বিরোধী ডাডাবাদ আন্দোলন যখন কিছুটা থিতু হয়ে আসে,তখনই পরাবাস্তববাদের উত্থান।এই আন্দোলন ইয়োরোপের বুর্জোয়াদের দ্বারা ধিকৃত হয় নি,কারণ ডাডাবাদের দার্শনিক ভিত্তি ছিলো বল্গাহীন ভাঙচুর ও সমস্তরকমের যুদ্ধবিরোধ এবং পুঁজিবাদী বাস্তবতাকে নস্যাৎ করে এক উদ্ভট কল্পনাজাত।ও ডাডাবাদীরের আচরণও ছিলো ততটাই উদ্ভট।কিন্তু পরাবাস্তববাদ তেমনটা নয়,ব্রেঁত নির্ধারিত পরাবাস্তবাদের মূল ভিত্তি ছিলো এরকম,-

এ-মতবাদের মূলকথা অবচেতন মনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা। এ আন্দোলনের মূল উদ্গাতা ফরাসি পুরুষ কবি-সমালোচক আঁদ্রে ব্রেঁত। ডাডাবাদীরা যেখানে চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী করতে যার মাধ্যমে সে ভেদ করতে পারবে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল, পৌঁছাতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে; সেখানে পরাবাস্তববাদ আরো একধাপ এগিয়ে বলল, প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে। পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে গভীর থেকে তুলে আনা।পরাবাস্তববাদ বিকশিত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ডাডাবাদী কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে। এ-আন্দোলনের সূচনা ফ্রান্সের প্যারিস থেকে, ১৯২০-এর দিকে। তখন থেকেই এটি ধারাবাহিকভাবে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন দেশ ও ভাষার Visual arts, Literature, Film এবং Music-এ। শুধু তাই নয়, এটি রাজনৈতিক চিন্তা (রাষ্ট্রচিন্তা) ও চর্চা, দর্শন এবং সামাজিক তত্ত্বেও (সমাজতত্ত্ব) স্থান পায়।(তথ্যসূত্র পরাবাস্তব উইকিপিডিয়া)

বাংলা শিল্প-সাহিত্যে পাশ্চাত্য শিল্পের আমদানি আমারা জানি মাইকেল মধুসূধনের হাত ধরে সূচনা হয়,তিনিই প্রথম প্রথাগত ছন্দের জড়ত্ব ভেঙে খুলে দেন এক আলাদীনের আশ্চর্য জগত।পরে রবীন্দ্রনাথের হাতে তা আরও প্রসারিত হয়,এবং পঞ্চপাণ্ডদের লেখায় আমরা সুররিয়ালিজমের মতো মতবাদের প্রয়োগ প্রবল ভাবে লক্ষ করি।অনেকেই মনে করেন ভিনদেশের মতবাদ বাংলা সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর,কিন্তু না ,এটা কিছুতেই মেনে নেয়া অসম্ভব এখন।তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে হতে হবে সচেতন। যেটা জীবনানন্দ দাস তথা তাঁর পর্বরতী অনেকেই প্রমাণ করে গেছেন যে, বৈশিক মতবাদ কীভাবে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে।আর এখন বৈশিক সাহিত্য বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে ভাবাও অসম্ভব।
আর সুররিয়ালিজমকে বাদ দিয়ে তো কবিরা ভাবতেই পারে না,কারণ কবিতায় চিত্রিত হয় কবির কল্পনাজাত সংঘাত।

তারমানে এই নয় যে কল্পনা মানেই বাস্তব বর্হিভূত কিছু বরং বলা যায় মানুষ যতটা কল্পনা করতে পারে ততটাই বাস্তব।যাঁরা বর্তমানে সুররিয়ালিজমের বিপক্ষে তাঁরা নিশ্চয়ই এই যুক্তি মেনে নেবেন না।তাঁরা বলবেন যে এসব উদ্ভট,অলৌকিক চিত্রকল্প সমৃদ্ধ কবিতা পাঠকের কোন কাজে আসে না, এই অস্থির সময়ে ও যান্ত্রিক জীবনের জটিলতায়।আরও বলবেন পরাবাস্তব দুর্বোধ্যতার কারণেই কবিতার পাঠকসল্পতা।এর ভোক্তা একধরণের অলস প্রজাতির বুর্জোয়া পাঠক যাঁদের কাজকর্ম নেই তাঁরাই এই শিল্পের জাবর কাটেন।এই দর্শনকেও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না,আধুনিক কবিতাকে ছেনে দেখলে নিশ্চয়ই এর বিহিত খুঁজে পাওয়াও সম্ভব;কিন্তু নিশ্চয়ই তা পরাবাস্তববাদের জন্য না,এর পেছনে লুকিয়ে আছে কবির সমাজবিচ্ছিন্নতা,ও ভীতি এবং প্রয়োগকৌশলগত ত্রুটি।
উদাহরণের মাধ্যমে একটু আলোচনাকে স্বচ্ছ করতে চেষ্টা করা যেতে পারে যেমন,

পল এলুয়ার-এর কবিতা
আমি তোমাকেই শুধু ভালবাসতে চাই
আমি তোমাকেই শুধু ভালবাসতে চাই
ঝড় ওঠে উপত্যকায়
মাছের নদী
আমি তোমায় আমার একাকীত্বের সঙ্গে একাত্ম করে তুলেছি
জগতজুড়ে লুকোনো
বুঝতে পারার মতন দিন ও রাত্রি
তোমায় আমি যা মনে করি
তার চেয়ে বড় বিম্ব নই আমি
তারা তোমার প্রতিমার সারা জগতজুড়ে
আর তোমার চেখের পাতায় শাসিত দিন ও রাত্রি

(মলয় রায় চৌধুরীর অনুবাদ দেয়াল থেকে)

এই কবিতাকে বিশ্লেষণের কোনো অভিপ্রায় নেই এখানে,শুধু বুঝে নিতে চেষ্টা করবো ফ্রয়েডিও মনস্তত্ত্বের আলোকে ব্রেঁত-এর ভাষ্য, ‘সত্তা হোলো যাবতীয় স্বপ্ন,সৃষ্টি,সম্ভাবনার স্বপ্নময় অন্ধকার,যেখানে মানুষের চিরন্তন রূপকল্প,মিথ এবং তার মৌল প্রতীক অতি নিঃশব্দে কাজ করে’।এবারে জীবনানন্দ দাসের কবিতা থেকে উদাহরণ দেখি,-

আমরা যাইনি মরে আজো—তবু কেবলি মনে হয়;
মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;
প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর পরে।

‘ঘোড়া’ জীবনানন্দ দাস

একজন কবি আধুনিক যুগে বসে লিখছেন, ‘প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে’ এই চিত্রকল্পকে খুব সহজ করে পরাবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না।বিশেষত যখন ‘লোভ’ এবং প্রাগৈতিহাসিক যুগের ‘ঘোড়া’র মতো শব্দের ব্যবহার উৎপ্রেক্ষা অলংকার বিমূর্ত করে তোলে।যাইহোক বাস্তবাদীদের সংজ্ঞা ধরে বললে বলতে হয় বাস্তব কি?উত্তর নিশ্চয়ই এমন হবে যে সমকালীন মানব জীবনের জৈব জটিলতা।কিন্তু তাহলে তো কাল এর ভিত্তি উল্টে যাবে!যেতেই হবে,কারণ জীবন কেবল একতরফা জটিলতায় আটকে থাকে না,সে বয় প্রবহমান।আর বাস্তববের সংঘাতে মানব মনের স্বপ্ন কিংবা কল্পনা অথবা মগ্নচৈতন্যের যে বোঝাপড়া তা কিন্তু চলতেই থাকবে;আর এই দর্শনই কালোত্তীর্ণ শিল্প-সৃষ্টি করতে পারে,যেটা প্রস্তর যুগের ঘোড়ার ঘাস খাওয়ার মতো আজও প্রাসঙ্গিক ।তারমানে এই নয় যে বাস্তবতার যে সংজ্ঞা তা অপ্রাসংগিক ? সাহিত্যের বাস্তবতাও যদি চিরকালীন দ্বন্দ্ব তৈরিতে সক্ষম হয় তাহলে সেটা অস্বীকার করার কোনো প্রশ্নই নেই।এবং এমন নজিরও কম নেই বাংলা কবিতা তথা সাহিত্যে।সময়োপয়োগী না হলে কোনো দর্শনই টেকে না শিল্পে এটাই যথার্থ মনে করি।আর এটাও মনে করি তুচ্ছকে অর্থবহ করে উপস্থাপন করাও কবির কাজ,শুধু এটা ওটা নস্যাৎ করা নয়।

প্রবন্ধঃ রবীন্দ্রানুসারী কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা ।। রহিমা আক্তার মৌ



রবীন্দ্রানুসারী কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা



বিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের সামাজিক জাগরণে নারীর অবস্থান যাঁরা নিশ্চিত করেছেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। স্বনামধন্যা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, শামসুন্নাহার মাহমুদ ও সুফিয়া কামাল-এর পর্যায়ভুক্ত তিনি। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত না হলেও সৃজনশীল মন ও বুদ্ধিবৃত্তিক মনন দিয়ে তিনি স্বকালের স্বসমাজে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ১৯০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৈতৃক নিবাস কুষ্টিয়া জেলার পাবনা শহরের নিয়াজতবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই বাঙ্গালি কবি। পিতা খানবাহাদুর মোহাম্মদ সোলায়মান ছিলেন একজন বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শক এবং মা সৈয়দা রাহাতুননেসা খাতুন ছিলেন সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী। ছয় বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মাহমুদা ছিলেন দ্বিতীয়। কৈশোরে রচিত কবিতা ও রূপকথায় তাঁর নাম পাওয়া যায় শ্রী রকিবননেছা মহম্মদা খাতুন। তাছাড়া সে সময়ে তাঁর ডাক নাম ছিল বাতাসি।

মাহমুদা খাতুনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত। আকৈশোর ছবি অাঁকার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। পরবর্তীকালে তিনি স্বাস্থ্যরক্ষা ও রন্ধনশিক্ষায় ডিপ্লোমা অর্জন করেন। পারিবারিক পরিবেশ ছিল তাঁর সাহিত্যচর্চার অনুকূলে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেখা তাঁর ‘বসন্ত’ নামক কবিতায় লিখেন-  
"আজি কত দিন পরে
বসন্ত আইল ঘরে
চারিদিক সাজাইয়া 
ঢোলবাদ্য বাজাইয়া
ফুলের সাজে আইলরে
বসন্ত আবার ঘরে
জুই বেলি চারিদিকে
বসন্ত মাঝারে থাকে
কচি কচি পাতা ফোটে
বসন্ত বাহার উঠে।"

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক  মোহাম্মদ নজিবর রহমান ছিলেন তাঁর গৃহশিক্ষক। কায়কোবাদের অশ্রুমালা ও সমকালীন সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত রচনাবলি তাঁকে প্রভাবিত করে। পিতার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে থেকেছেন। এক সময় তিনি জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিঙেও কিছুকাল অবস্থান করেছেন। তাছাড়া দিল্লি, আগ্রা, আজমির প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাননি সিদ্দিকা। বাড়িতেই উচ্চশিক্ষিত বাবার কাছে এবং গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়েছেন। আর পাঠ নিয়েছেন তিনি প্রকৃতি থেকে। সকলে তাঁকে চিরকুমারী বলেই জানে। নাসিরউদ্দিন এক লেখায় লিখেছেন, '‘বাল্যকালে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার বিবাহ হয় কিন্তু তাঁর বিবাহিত জীবন খুব স্বপ্নকাল স্থায়ী। তিনি স্বামীগৃহে যাননি, বিবাহিত জীবন উপভোগ করেননি।"

বাংলাদেশে অনেক সামান্য মানুষের, যাদের তেমন কোনো ঐতিহাসিক ভূমিকা নেই, জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী ঘটা করে পালিত হয়। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার যদি থাকত সুযোগ্য ও বিত্তবান ছেলেমেয়ে তা হলে তিনি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতেন না। মাহমুদা খাতুন তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন -

"আমি যখন মিশন স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ি, সেই সময় কবিতা লিখতে শুরু করি। বারো কি তেরো বছর বয়সে আমার প্রথম কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়। ছোটবেলা থেকে আমি মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম। মায়ের মৃত্যুর পর কোনো শাসন ছিল না বলেই আমার এক কৃষাণী বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতাম বনে-জঙ্গলে, পুকুর ধারে, বাড়ির পেছনে ছিল বিরাট আমবাগান। সেখানকার পাখির ডাক, বুনোফুল আমাকে মুগ্ধ করত। দুই-এক লাইন করে কবিতা লিখতাম। সেই সময় আমার গৃহশিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত ‘আনোয়ারা’ গ্রন্থের লেখক মজিবর রহমান। তিনি আমার কবিতা লেখায় উৎসাহ দিতেন। আমার মায়ের অনেক বই ছিল। আমি চুপি চুপি সেইসব বই পড়তাম। তা থেকেই আমি জীবন ও প্রেম সম্পর্কে সচেতন হই। বাবার একজন হিন্দু কেরানি আমাকে ‘খোকাখুকু’ ও ‘শিশুসাথী’র গ্রাহক করে দেন। আমার কবিতা লেখার পেছনে বাবার প্রেরণা ছিল। বাবার বদলির চাকরির জন্য কোনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারতাম না। তাই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেছি। রাজশাহী এসে মিশন স্কুলে ভর্তি হলাম, তখন মেমসাহেবের সংস্পর্শে এসে আমার মনে অনেক আধুনিক চিন্তাধারার সৃষ্টি হয়। বাড়িতে তখন ভীষণ কড়া পর্দা। আমার বড় বোনকে স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে পর্দায় আব্রু করা হয়েছে। আমার বেলা সেটা সম্ভব হতে দেইনি। দেশ বিভাগের পূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মানসী ও মর্ম্মবাণী, উদয়ন, বসুমতি, প্রদীপ, কিষাণ, অগ্রগতি, সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, আজকাল, দীপালি, জয়ন্তী, বঙ্গলক্ষ্মী, উত্তরায়ণ, গুলিস্তান, যুগান্তর, মোয়াজ্জিন, আনন্দবাজার [পত্রিকা], বেগম, নবশক্তি, নবযুগ, স্বাধীনতা, নায়ক, সত্যযুগ, পুষ্পপত্র ইত্যাদি পত্রিকায় আমার লেখা বের হয়েছে।"

মাহমুদা খাতুন ছিলেন অতি শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু ভেতরে তিনি ছিলেন দ্রোহী। সমাজে প্রচলিত নারীর অবরোধ প্রথা তিনি মেনে নেননি। অল্প বয়সেই বেরিয়ে আসেন তিনি সেই কারাগার থেকে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হওয়া নিয়ে তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন -

‘... "বিশ্বকবির পায়ে হাত দিয়ে সেলাম করলাম। আমি সেলাম করে উঠলে দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে চোখ বন্ধ করে বহুক্ষণ ধরে কি প্রার্থনা সারলেন। আমি অবাক হয়ে দেখছি তাঁর সর্বদেহ থেকে আলোক বিকিরণ হতে লাগলো। তার পরে তিনি পাশে বসিয়ে গল্প করতে আরম্ভ করলেন, “তোমরা যে পর্দা থেকে বাইরে এসেছ এই আমি আশ্চর্য হয়েছি। দ্যাখো সূর্য্যরে কিরণ না পেলে যেমন গাছপালা বড় হয় না, ফল-ফুল ভালো দেয় না, মানুষও তেমনি বাইরের আলো-বাতাস ছাড়া পূর্ণ হতে পারে না। পদ্ম পঙ্ক থেকে ঊর্ধ্বে উঠেই সূর্য্যরে কিরণ লাভ করে, না হলে সে লাভ করতে পারত না। আর এখানেই তার সার্থকতা।"

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা মুলত কবিতাই লিখেছেন। স্বভাবজাত প্রেরণায় তিনি অনবরত কবিতা লিখেছেন এবং সেগুলি সমকালীন সাময়িক পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কাব্যপ্রতিভা হয়তো তাঁর কর্মখ্যাতির সমতুল্য ছিল না, কিন্তু নিষ্ঠা ও প্রয়াস তাঁকে রবীন্দ্রানুসারী কবিদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট আসনে সমাসীন করেছে। মাহমুদা খাতুন সনেট এবং গদ্যছন্দেও কিছু কবিতা রচনা করেছেন। প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং মানুষ ও সমাজ তাঁর কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে। কখনও সাময়িক প্রসঙ্গ হয়েছে তাঁর কবিতার বিষয়বস্ত্ত। দুই মহাযুদ্ধের তান্ডবলীলা তাঁকে শান্তির অনিবার্যতায় আস্থাশীল করেছে। তাই শান্তির স্বপক্ষে তিনি আহবান জানিয়েছেন উদাত্ত কণ্ঠে। যেহেতু তাঁর কাছে কবিতা ছিল ‘হূদয়ের বিশুদ্ধ উচ্চারণ’, সেহেতু তাঁর নিজের কবিতাও ছিল মৌলিক এবং এক প্রশান্ত গতিপথে প্রবহমান।

১৯৩০-এর দশকের শুরুতে কবি হিসেবে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার আত্মপ্রকাশ। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘পসারিনী’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২-এ। এই বই সম্পর্কে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের মন্তব্য : ‘বাংলা ভাষায় মুসলিম (মহিলা) কবির ইহাই প্রথম প্রকাশিত আধুনিক কবিতার বই। এতে তিনি প্রকৃতি, প্রেম ও বিরহ নিয়ে কতকগুলো কবিতা লিখেছেন।'
বসন্ত বিদায় কবিতায় মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা লিখেন-
"বসন্ত উৎসব আজ হয়ে গেছে শেষ
পড়ে আছে বাসি ফুল-মালা,
রিক্ত ভূষা উদাসিনী ধরণীর বুকে
জাগে শুধু বুক ভরা জ্বালা।"

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার কবিতায় মানুষের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার আন্তরিক প্রকাশ ঘটেছে। প্রকৃতির রূপবৈচিত্র তাঁর কবিতায় প্রানের স্পর্শ লাভ করেছে। অত্যন্ত অল্প বয়সে তাঁর কবি প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি কেবল কবিতাই লিখতেন না, ‘শান্তি’, ‘দীপক’ ও ‘সবুজ বাংলা’ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছিল। দুই শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের সঙ্গে মাহমুদা খাতুন যোগাযোগ করেন। তাদের আশীর্বাদ ও অনুপ্রেরণা পান তিনি।'পরিচয়’-এ প্রকাশের জন্যে সিদ্দিকা রবীন্দ্রনাথকে একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন, কবিতা পেয়ে প্রাপ্তি স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ তাকে লেখেন -
কল্যাণীয়াসু,
আমার শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত এবং দুর্বল। যথাসাধ্য সকল কাজ থেকে নিষ্কৃতি নেওয়ার চেষ্টা করছি। তোমার কবিতাটি পরিচয়-এর সম্পাদকের কাছে পাঠাই, আশা করি তারা ছাপাবেন, কিন্তু সম্পাদকীয় বিচারবুদ্ধির ওপর আমার কোনো হাত নেই এ কথা নিশ্চিত জেনো। দেখেছি তারা অনেক সময় অনেকের ভালো লেখাকেও বর্জন করে থাকেন; তার পরিচয় পেয়েছি।
ইতি ৩ আশ্বিন, ১৩৪২ শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

"পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগস্ট, জাতীয় দিবস ২৩ মার্চ, একুশে ফেব্রুয়ারি, জিন্নাহর জন্ম-মৃত্যুদিন প্রভৃতি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। আজিমপুর কলোনির সোস্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, আজিমপুর লেডিস ক্লাব, কিংবা বাংলা একাডেমি বা পাকিস্তান কাউন্সিলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তিও হতো। তাতে একজন স্বনামধন্য কবির উপস্থিতি ছিল অবধারিত। হালকা মোটা মোটা, বেঁটে ওই মহিলা কবির নাম মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। তাঁর কাঁধে থাকতো ঝুলানো একটি কাপড়ের ব্যাগ। তাতে দু-চারখানা বই বা খাতা। তাঁর মুখে স্মিত হাসি। কথাবার্তায় গভীর মমতা। তিনি ছিলেন মৃদু হাস্যরসিক। এক মমতাময়ী মাতৃমূর্তি। প্রবীণদের তিনি ছিলেন আপা এবং আমাদের বয়েসী তরুণদের তিনি ছিলেন সবারই খালাম্মা।"--- সৈয়দ আবুল মকসুদ।

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার সাহিত্য সম্পর্কে আজাদ এহতেশাম লিখেন-

"বিশ শতকের সমাজ প্রেক্ষাপটে মুসলিম নারীর সাহিত্য চর্চা অকল্পনীয় ছিল। এ ক্ষেত্রে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের ঘেরাটোপ ছিঁড়ে প্রথম নিজেকে অসুর্যস্পর্শা মুক্ত করলেন রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন। এর পরেই মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার  অবস্থান। উচ্চশিক্ষিত না হয়েও আত্মস্বভাবজাত কবি সত্তার মৌলিকত্বে সমকালে প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিকগণের দৃষ্টি আকর্ষক হতে পেরেছিলেন। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার কাব্যের বিষয়বস্তু বহু বর্ণিল বিচিত্র অনুষঙ্গ প্রত্যক্ষীভূত না হলেও প্রকৃতি, পরিবেশ, পারিপার্শিকতা, জীবন, সমাজ ও মানুষ তাঁর কাব্যে বৃহৎ অংশজুড়ে বিস্তৃত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, প্রাণহানি, বিপর্যস্ত মানবিকতা মধ্যবিত্তের অস্তিত্বের টানাপোড়েন গোটা বিশ্বকে গভীর সংকটে নিপতিত করে। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা দেশে দেশে মানবিক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন যা তাঁর কাব্যের পঙ্ক্তিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া তাঁর কাব্যে নিসর্গ প্রকৃতি রোমান্টিক কবি মানসের সংশ্লিষ্টতায় কখনো গীতিরসাক্রান্ত আবার কখনো নিরাভরনা সৌন্দর্য ও বেদনার চিত্রকল্পে অপূর্ব বাণীমূর্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে।"

মাহমুদা খাতুনের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি: পশারিণী, মন ও মৃত্তিকা, এবং অরণ্যের সুর। এছাড়া কিছু প্রবন্ধ ও ছোটগল্পও তিনি রচনা করেছিলেন, কিন্তু সেগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। ষাটের দশক পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ও খ্যাতিমান মহিলা কবি। স্বাধীনতার পরে তিনি আড়ালে চলে যান। সমাদর ছিল না বলে জীবনের শেষ আট-দশ বছর তিনি সভা-সমাবেশে আসতেন না। ধর্মান্ধতা, গোড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার বলিষ্ট প্রতিবাদের ফলে বন্ধিত্বের অবসান ঘটিয়ে আলোয় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর সংগ্রাম ছিল সমকালীন সমাজে নারীর প্রতি অযাচিত ও অন্যায়ভাবে আরোপিত বিধি নিষেধের বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও তিনি অধিকার বঞ্চিত নিগৃহীত নিপীড়িত অসহায় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বাত্মক সহানুভূতি ব্যক্ত করেছেন নির্দ্বিধায়। শুধু কাব্যচর্চা নয়, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করতেও তিনি সমাজসেবামূলক কাজ করতেন। তাঁর কবিতার স্বভাব ছিল শীতল, ছন্দের কোমল মাধুর্য পাঠকের মনকে পরিষ্কৃত করে, তাঁর বক্তব্যে কোথাও অস্পষ্টতা নেই।

মাহমুদা খাতুন বহু সাহিত্যসভায় অংশগ্রহণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কাজী নজরুল ইসলাম-এর স্নেহধন্য হওয়ার সুযোগও তাঁর ঘটেছিল। সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জীবনযাপন তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ১৯৬৭ সালে  বাংলা একাডেমী তাঁকে সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার একুশে পদকে ভূষিত করে। ৭১ বছর বয়সে এই কবি ১৯৭৭ সালে ২মে নীরবে নিভৃতে পরলোকগমন করেন। বিভাগপূর্ব বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের কাব্যকীর্তির অপ্রতুলতায় পূর্ণতার মানসে হঠাৎ আলোর দ্যুতি নিয়ে আবির্ভাব যশস্বী কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। তিনি স্বকালে মুসলিম কবিদের অকর্ষিত ঊষর কাব্যভূমে স্বীয় মেধা, মনন ও প্রজ্ঞার অমিয় বারি সিঞ্চনে সজীব ও শ্যামলতায় প্রাণবন্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। দৃঢ় প্রত্যয় ও একনিষ্ঠতায় বিভাগপূর্ব বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের অস্তিত্বের সংকটকালে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট পথপরিক্রমায় পরবর্তী মুসলিম কবি সাহিত্যিকগণ সাহিত্য সাধনার পরম্পরা ও প্রেরণার যোগসূত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন।
           ------*****-----

ভালোবাসা সমাচার ।। রুদ্র সুশান্ত


ভালোবাসা সমাচার

রিপন সাহেব গত দুমাস আগে বিয়ে করেছেন। চাকরীর বয়স দেড় বছরের একমাস কম অর্থাৎ সতেরো মাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখা পড়া শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করতেন। সেটা ছেড়ে দিয়ে এটাতে এসেছেন। এটা অবশ্য সরকারী চাকরী। তাও আবার ব্যাংকে। আজকাল সরকারী ব্যাংকেও মোটা মানের স্যালারী পাওয়া যায়। প্রবাদ আছে-"চাকরী করুন হয় ব্যাংকে না হয় রেংকে
তিনি আবার এ চাকরীটাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছেন। মাস শেষে মোটা অঙ্কের মাইনে পেলে সবাই যেকোন চাকরীকে ভালোবাসবে, এটাই স্বাভাবিক। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবে সেটা কোন কারণ নয়।
.
সদ্য বিবাহিত বৌটাও খুব আদরের। নিশান নাম। রিপন সাহেব আদর করে নিজপত্নীকে নিশু ডাকেন। গোলাগাল চেহারার টানা টানা চোখে প্রতিমার মতো সুন্দর একজন মেয়ে। দেখলেই প্রোজ্জ্বলিত মোমবাতির মতো যেকোন পুরুষের হৃদয়ে ভালোবাসর উষ্ণ ক্ষরণ হতেই পারে। তবে এতে দোষের কিছুই নেই। বিধাতার বরাবরই নারীপক্ষে জোরালো অবস্থান। তিনি বারবার পক্ষপাতিত্ব করেছেন, নারীকে তিনি বানায়াছেন মোহনীয় করে আর পুরুষকে করেছেন কর্কশ। নারীকে দিয়েছেন অসহনীয় সহ্য ক্ষমতা পক্ষান্তরে পুরুষকে দিয়েছেন লোভ।
নারীর তুলতুলে গালে পৃথিবীর সমগ্র সুখ একসাথে উদ্দোম মনে খেলা করে। নারী হলো পৃথিবীর ফুল আর পুরুষ হলো আগাছা। পুরুষ কখনো নারীর মন বুঝেনি, দেহ বুঝেছে ।
.
রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পূর্বে রিপন সাহেব নিশানকে নিজের বুকে সেফটি পিন দিয়ে টাই আটকে রাখার মতোন করে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে লেপ্টে রাখেন। এতে নাকি রিপন সাহেবের সারারাতের ঘুমের পূর্ণতা পায়। এমন অবলীলায় বুকে নিয়ে রিপন সাহেব মাঝে মাঝে ডাকেন -"নিশু?"
মা মুরগীটার পাখা থেকে সদ্য ডিম ফোটে বের হওয়া ছানার মতোন রিপন সাহেবের বুকে থেকে মাথা তুলে নিশান বলেন-"হু"
তারপর দুজন আবার চুপচাপ।
.
রিপন সাহেব ভোর-সকালে বিছানায় চোখ খোলার আগে হাত বুলায়ে দেখে নেন নিশান আছেন কিনা? তারপর যথারীতি প্রতিদিন একই কম্ম।
নিশান সাজুগুজু খুব প্রছন্দ করেন।
শ্রাবণ এসে গেছে। আজকাল নিয়ম করেই বৃষ্টি হচ্ছে। রাত-বিরাতে। সকাল-বিকাল।
এর মধ্যে নিশান একদিন বলে বসলেন- " চলো, কাল আমরা বাইরে ডিনার করি।"
রিপন সাহেবও বলে দিলেন-"হু, চলো।"
সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে তিনি অফিস চলে এলেন। অফিস এসে দেখেন মোবাইলে চার্জ প্রায় শেষ, অফিসে যে চার্জার আছে গতো ক'দিন ধরে সেটাও নষ্ট। প্রায় বারোটার দিকে তিনি স্ত্রীকে একটা ম্যাসেজ করলেন। তাদের পারসোনাল কথা-বার্তা। মেয়েরা আবার এসব কিছু খুব প্রছন্দ করেন। যেমন- তার বর অফিস টাইমে তাকে ফোন দিক্, ম্যাসেজ করুক, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাক, রাতে বাসায় ফিরার সময় প্রায়ই এটা ওটা নিয়ে আসুক, তার স্পেশাল ডে গুলো মনে রাখুক, পালন করুক.... ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েরা মেয়েরা গল্প করার সময় এইসব গলাধঃকরণ বিদ্যা আবার উগরে দিয়ে অট্টহাসি হেসে বলবে--"এই জানিস, আমার ও না, এমন-তেমন, আমার জন্য পাগল।"
.
রিপন সাহেবের ম্যাসেজ দেখে নিশানও খুব খুশি হয়েছেন। আজ তারা বাইরে ডিনারে যাবার কথা। ব্যাংকের চাকরীতে কখনো কখনো একগলা কাজ হয়ে যায়, তখন আর চাকুরীজীবীদের ডান বাম মনে থাকে না। রিপন সাহেবেরও আজ তা-ই হলো।
.
তিনি মনেপ্রাণে কাজের ভিতর ডুবে গেলেন।
লাঞ্চ করলেন চারটারও পরে। চোখেমুখে প্রায় ঝাপসা দেখছেন। ব্যাংকে চাকুরীজীবীদের মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয়- কয়টা একশো টাকার নোটে পাঁচশো টাকা হয় সেটও ক্যালকুলেটরে হিসাব করা লাগে।
রিপন সাহেবের এমন অবস্থা হয় যে তিনি বাজার করে বাকি টাকা হিসাব করে ফেরত নিতে পারেন না, কারণ সারাদিন কাজ করে বাজরের হিসাব ভুলই হয়।
.
রিপন সাহেব বাসায় ফিরলেন রাত দশটার কিছুক্ষণ পর, ওদিকে নিশান রিপন সাহেবের মোবাইলে কল ট্রাই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। রিপন সাহেব বাসায় ফিরার পর নিশান চুপচাপ। রিপব সাহেবের ডিনার এসব কিছুই মনে নেই। তিনি বাসায় এসে যথারীতি নর্মাল প্রতিদিনের মতোই আচরণ করছেন কিন্তু নিশান রাগে ফুলে আছেন, মনে হচ্ছে আমাবস্যায় সাগরের জল ঠাঁই দাঁড়ায়ে আছে।
তিনি স্ত্রীকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলেন।
নিশান নিরুত্তর।
সে এমনভাবে রাগ করেছেন যেনো মনে হচ্ছে ঘন্টাখানেক আগে এই বাসার উপর দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে কোনো জলোচ্ছ্বাস বয়ে গেছে।
মেয়েরা জন্মগতভাবে খুবই সহজসরল হন, তাদের মনে মায়া মায়া ভাব থাকে। আবার যখন বেঁকে যায় তখন মনে হয় বিধাতা এর চেয়ে অদ্ভূদ আর কোন পদার্থ পৃথিবীতে সৃষ্টি করেননি। কারা যেনো ধর্মের দোহায় দিয়ে বলেছে- নারীদের পাঁজরের বাঁ' পাশের হাড় একটা নাকি বাঁকা, তাই তারা সহজে বশে আসে না। আর তারা যখন রাগ করে মুখ ঘুমোট করেন তখন মনে হয়, একটা কেনো? বিধাতা প্রদত্ত ২০৬ টি হাড়-ই বাঁকা। মাঝে মাঝে নারীদের অভিমান এমন পর্যায়ে চলে আসে- যদি আপনি তাঁকে বলেন, এই মুহূর্তে অভিমান না ভাঙলে প্রলয় ধ্বংস হয়ে যাবে। তাও তারা অভিমান ভাঙবেন না। আর সে অভিমান যদি প্রিয়জনের সাথে হয় -তাহলে তো হইছে, আজকে মহাকাব্য রচনা হবে।
.
রিপন সাহেবও আজকে সেই মহামাত্রর অভিমানে পতিত হলেন। করার কিছুই নাই। বিধি বাম। মেনে নেয়া আর সরি বলা ছাড়া আর কোন কথা বললে সংসারে আজই লঙ্কাকান্ড বেঁধে যাবে। হয়তো মহাপবিত্র নিকম্ভূলা যজ্ঞও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, নারীর চরম রোষানলে পড়ে।
আবার একজন মেয়ে যদি কোনো কারণে একজন পুরুষের উপর বিমোহিত বা মুগ্ধ হয় তবে সে মেয়ে কারণে-অকারণে সে পুরুষের উপর বারবার বিমোহিত হতে থাকবে।
.
রিপন সাহের ঘটনা আঁচ করলেন এবং তার মনেও পড়লো।
সো সরি বলা ছাড়া অন্য কোন ওয়ে নেই।
স্ত্রীর সামনে দাঁড়ায়ে আপাদমস্তক একজন খুনীর অপরাধীর মতো তিনি বললেন- "সরি, জান। আমার মনে ছিলো না, কাল নিশ্চয় যাবো। তাছাড়া অফিসে অনেক কাজ ছিলো।"
নিশানের কোন রিয়েক্ট নাই। চুপচাপ।
অন্যদিন ডিনারের জন্য নিশান তাকে ডাকেন। আজ তিনি স্ত্রীকে বহুবার ডেকেছেন। নিশান আসেনি।
--"নিশু,নিশু, নিশু।"
নিশান আর কিছু শুনে না।
বাচ্চা ছেলের মতোন রিপন সাহেব একাএকা খেয়ে নিলেন। খিদেও ছিলো খুউব।
তারপর নিশু নিশু ডাকতে ডাকতে তিনি কখন ঘুমায়ে পড়লেন।
.
.
প্রতিদিনের মতো রিপন সাহেবে আজও সকালে বিছানায় হাত বাড়ালেন। কিন্তু কি রে, পাশে নিশান নাই। হুট করে তিনি চোখ খুললেন, দেখলেন স্ত্রী বিছানায় নাই। দফ করে তিনি বিছানায় উঠে বসলেন।
নিশু নিশু বলে এঘর-ওঘর খুঁজলেন।
নিশান কোথাও নেই।
প্রায় পাগলের মতো হয়ে তাড়িঘড়ি করে নিজের মোবাইলটা নিয়ে নিশানকে ফোন দিলেন, বিছানার পাশে মোবাইল রিংটোন বাজছে। ওদিকে আবার ঘরের দরোজাও খোলা। মহা দুঃচিন্তার কথা। রিপন সাহেব শ্বশুর বাড়ী, নিজের বাড়ী, আরো আত্মীয় স্বজন অনেক জায়গায় খোঁজ নিলেন। কোথায় কোন খোঁজখরব পেলেন না।
নিজে উচ্চস্বরে কয়েক বার নিশু নিশু বলে ডাকলেন। কিন্তু কোন প্রতিউত্তর আসলো না। তিনি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন। কাল রাত মেয়েটা অভিমান করলো, আজ সকাল হতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েরা অভিমান করলে এমন অবস্থা হয় সমগ্র পৃথিবীর দুঃখ যেনো তাদের অন্তরে এসে জমা হয়। তাদের অভিমান ভাঙাতে হয় পরম মমতায়, চরম আদরে। আদরে মেয়েরা মহাসমুদ্রের জলের মতো মিলায়ে যায়। তখন তাদের আর দুঃখ থাকে না।
কিন্তু নিশান কই?
বাইরে ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরের মেইন দরোজা ধরে রিপন সাহের সিঁড়ি বেঁয়ে সোজা ছাদে উঠে আসলেন। তিনি দেখে অবাক হলেন যে - নিশান একাএকা বৃষ্টির জলে ভিজছেন। এরকম চরম মুহূর্ত বিয়ের পরে তিনি কখনো একা উপভোগ করেননি।
সিঁড়িঘরের গোঁড়ায় দাঁড়ায়ে তিনি ডাকলেন- "নিশু, নিশু, অ্যাই নিশু।"
শুনেও নিশান কোন কথা বললেন না, দুহাত দু'দিকে প্রসারিত করে সে ভিজেতেই আছে।
রিপন সাহের শব্দ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
আর বললেন-নিশু, তুমি একা....
সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন রিপন সাহেব। নিশান হয়তো কাঁদছেন। বৃষ্টির জলে চোখের জল বুঝার উপায় নেই। তবে চোখেমুখে একগাল হতাশা প্রদীপ্তমান।
.
রিপন সাহেব আরো কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাকে কাছে টানলেন। প্রতিমার মতো মেয়েটা কোন কথা বললো না, নিঃশব্দে জড়ায়ে গেলো স্বামীর বক্ষে।
প্রতি সকালের মিলন মেলা থেকে আজকের মিলনমেলা আলাদা। আলাদা পরিবেশ, আলাদা ভঙ্গি, আলাদা স্থান।
সব আলাদা হলোও দুজনই এক।
এবার বৃষ্টি হোক, শ্রাবন এভাবে কাঁদতে থাকুক। আর প্রকৃতি দেখুক তাদের সাথে দু'জন কেমনে একাকার হয়ে গেলো।
আজ তলায়ে যাক, আজো অজোর বর্ষণ হোক।
আজ হোক মহানন্দের মহামিলন।
আজ হোক...।



চা উইথ চানক্য কাকা ।। বিশ্বজিত চৌধুরী


চানক্য কাকা এবং সন্দীপ। চা'র দোকানে
চা উইথ চানক্য কাকা (রম্য গল্প)


ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার পরদিনই গ্রামের বাড়িতে ফিরে এল সন্দীপ।শহরে মেসে থেকে পড়াশুনা করে সে।তার খুব ইচ্ছা ছিল মনোবিজ্ঞানে ভর্তি হওয়ার।মানুষের সাইকোলজি সম্পর্কে জানার প্রচণ্ড আগ্রহ তার।কিন্তু মনোবিজ্ঞানে চান্স না পাওয়ায়, সে পড়ছে ইতিহাসে।তবে ইতিহাসে পড়লেও, মনোবিজ্ঞানের প্রতি তার আকর্ষণ একটুও কমেনি।অনেক কষ্ট করে সে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের একটি বই সংগ্রহ করেছে, যদিও বইটির একটি পাতাও তার পড়া হয়নি।এই মুহুর্তে তার ইচ্ছা, পাগলদের পাগল থাকাকালীন সময়ের অনুভূতি সম্পর্কে জানার।আর তাই পরীক্ষা শেষ হবার পরপরই তাড়াহুড়া করে গ্রামে ফিরে এসেছে সে।তার কারণ, সে তার অবসর সময়ের কিছু অংশ কাটাতে চায় তার গ্রামের চানক্য কাকার সাথে।

চানক্য রায় অমিত প্রতিভাধর একজন ব্যাক্তি।ছাত্রজীবনে পরীক্ষার ফলাফলে মেধা তালিকায় সবসময় থাকতেন প্রথম দিকে।মেধার জোরে বেশ উচ্চ পদে চাকুরিও পেয়েছিলেন।তবে সহকর্মীদের সাথে তার কী যেন একটা বিষয় নিয়ে খুব ঝামেলা হয়েছিল।তারা একজোট হয়ে তাকে খুব পিটুনি দিয়েছিল।কয়েকজন নাকি খুব জোরে তার মাথায় বেশ কয়েকবার আঘাত করেছিল।
তারপর থেকেই অতি গরমে আর অতি শীতে চানক্য রায়ের মাথায় সমস্যা হয়।এমনকি বছরের কোন সময়ে তার মাথা ভাল থাকে আর কোন সময়ে  খারাপ থাকে তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না।তবে সন্দীপ খোঁজ নিয়ে জেনেছে, এই মুহুর্তে চানক্য রায় বেশ সুস্থ আছেন।চানক্য রায়ের সাথে সময় কাটানোর এখনই মোক্ষম সময়।

সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ।আগে যতবার সে বাড়ি এসেছে, বাড়িতে পা ফেলতে না ফেলতেই, মা ও বাবাকে জড়িয়ে ধরে নানান গল্পে সে মেতে উঠেছে।একমাত্র সন্তান হওয়ায় মা-বাবার কাছে সে খুব আদরের।তবে এবার বাড়ি ফিরে সন্দীপ কারও সাথে তেমন কোনো কথা বলল না।ভেতরে ভেতরে সে খুব উত্তেজিত।দুপুরের খাবার সেরে, বিকালবেলা সে গেল চানক্য রায়ের বাড়িতে।
চানক্য রায়ের বাড়িতে তার সাথে শুধু একজন কাজের লোক থাকে।
সন্দীপ দরজায় নক করলে, কাজের লোকটি দরজা খুলে দিল।
সন্দীপ বহুবার এ বাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াত করলেও এর আগে কখনও এই বাড়িতে ঢোকেনি।বাইরে থেকে বাড়িটিকে অনেক সরু ও ছোট মনে হলেও ভেতরে ঢুকে সন্দীপ দেখল বাড়ির ভেতরটা বেশ প্রশস্ত।বাড়িতে আধুনিকতার প্রায় সব ছোঁয়াই আছে।
ড্রয়িং রুমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, চানক্য রায়ের দেখা পেল সন্দীপ।

চানক্য রায় ঘরে ঢুকে সন্দীপের দিকে তাকালেন, তবে তাকে চিনতে পারলেন না।
সন্দীপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নমস্কার কাকু।আমি সন্দীপ।গগন সেনের ছেলে।আপনার কথা ছোটবেলা থেকে অনেক শুনেছি কিন্তু আপনার সাথে সামনাসামনি কোনো আলাপ হয়নি।তাই ভাবলাম, যাই একটু কাকুর সাথে আলাপ করে আসি।
-তুমি গগনদার ছেলে? এত বড়  হয়ে গেছ তুমি! কীসে পড়াশুনা কর তুমি?
-কাকু, গতকাল আমার অনার্সের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছে।আমি ইতিহাসে পড়ি।
-বাহ, তাই নাকি! ইতিহাস তো আমার খুব প্রিয় বিষয়।শশাঙ্ক, গোপাল, ধর্মপাল থেকে শুরু করে রোমান সাম্রাজ্য, জুলিয়াস  সিজার এরা সকলেই আমার খুব প্রিয়।সত্যি কথা বলতে কি তোমার মত একজন ইয়ং লার্নারের সাথে চা খেতে খেতে ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আমার বেশ ভালই লাগবে।আজ তোমাকে আমি নিজহাতে তৈরি করে স্পেশাল চা খাওয়াব।তুমি একটু অপেক্ষা কর।
চানক্য রায় পাশের ঘরে চা তৈরি করতে গেলেন।ভীষন অস্বস্তিতে পড়ে গেল সন্দীপ।সে কাজ করতে চায় চানক্য রায়ের মনস্তত্ত্ব নিয়ে, অথচ তাকে আলোচনা করতে হবে ইতিহাস নিয়ে।ইতিহাসে পড়লেও, সন্দীপের কাছে ইতিহাস বড়ই বিরক্তিকর একটি বিষয়।

দুই হাতে বড় দুটি কাপে চা নিয়ে চানক্য রায় ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপরে এক কাপ রেখে,  সন্দীপকে তা নিতে ইশারা করলেন।তারপর সহাস্যবদনে বললেন, মৌলভীবাজারের সর্বোৎকৃষ্ট চাপাতি, সাথে দুটি লবঙ্গ, তিনটি বাসক পাতা ও চার ইঞ্চি পরিমান যষ্টিমধু।খেয়ে দেখ, একদম অমৃত।তবে চা খাওয়ার পূর্বে আমাকে একটি প্রশ্নের জবাব দাও তো।বল তো ভুটানের প্রথম রাজার নাম কী? এবং তিনি কোন ভয়ংকর জিনিস দিয়ে চা তৈরি করে খেতেন?
ভারী অপ্রস্তুত হয়ে গেল সন্দীপ।সে ভুটানের বর্তমান রাজারই নাম জানে না, প্রথম রাজা তো দূরের কথা।চায়ে চুমুক না দিয়েই সে বলে ফেলল, আসলে কাকু, আমি যদিও ইতিহাসে পড়ছি, তবে ইতিহাসে আমার কোনো আগ্রহ নেই।আমার আগ্রহ আসলে সাইকোলজিতে।আপনাকে সত্য কথাই বলি।আমি জানি, আপনি নাকি মাঝে মাঝে অপ্রকৃতস্থ থাকেন।আর তাই আমি এসেছি আসলে, পাগল থাকাকালীন আপনার অনুভূতি কেমন, তা জানতে।
চানক্য রায় চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিতে যাচ্ছিলেন।কিন্তু সন্দীপের কথা শেষ হতে না হতেই তার হাত থেকে কাপটি মাটিতে পড়ে সশব্দে ভেঙ্গে গেল।তার মুখ ছোট হয়ে এল।মুখে পড়ল একরাশ কাল মেঘের ছায়া।
নিজেকে সামলে নিয়ে চানক্য রায় বললেন, তুমি কি এ বিষয়ে জানার জন্যই আমার বাড়িতে এসেছে?

সন্দীপ বলল, হ্যা, শুধু এ কারণেই এসেছি।আপনি কিছু মনে করেননি তো?

চানক্য রায় স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সন্দীপের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।সন্দীপ চায়ের কাপে চুমুক দেবে, ঠিক এমন সময় চানক্য রায় তার হাত থেকে চায়ের কাপটি কেড়ে নিলেন।তাকে বললেন, সাইকোলজি নিয়ে আলোচনার জন্য এ চা নয়।সাইকোলজি নিয়ে আলোচনার জন্য তোমাকে আমি অন্যরকম চা খাওয়াব।সেই চা প্রকৃতই এক্সট্রা অরডিনারি।

চানক্য রায় পাশের ঘরে চলে গেলেন।

সন্দীপ সোফায় বসে ঘরের চারদিক লক্ষ্য করতে লাগল।ঘরটির চারদিকের দেয়ালে শুধু একটি দেয়াল ঘড়ি ও একটি ক্যালেন্ডার ছাড়া আর কিছু নেই।ঘড়িতে সাড়ে ছয়টা বাজে।ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের পাতায় একটি বিশাল পেঁচার ছবি আছে।সোফার সাথে লাগোয়া বক্স খাটের ওপরে একটি চিরুনি পড়ে আছে।সন্দীপ চিরুনিটা  হাতে নিয়ে, সেটা দিয়ে তার এক মাসের জমানো দাঁড়ি আঁচড়াতে লাগল।

এমন সময় চানক্য রায় দুই হাতে দুই কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকে এক কাপ চা সন্দীপের হাতে দিয়ে বললেন, খাও।

সন্দীপ কয়েকবার চুমুক দেবার পরে, চানক্য রায় বললেন, এবার এক থেকে একশ পর্যন্ত গোনো।

সন্দীপ অবাক হয়ে গুনতে লাগল, এক, দুই, তিন...

সে বাষট্টি পর্যন্ত গুনতে পারল। তারপর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে মাটিতে ঢলে পড়ল।
চোখ মেলে তাকাল সন্দীপ।প্রথমে বুঝতে পারল না, সে কোথায় আছে।মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে ধীরে ধীরে।মাথাটা বেশ ভারী মনে হচ্ছে তার।সারা শরীরে ব্যথা।সন্দীপের মনে হল, সে বোধহয় দীর্ঘদিন পরে ঘুম থেকে উঠল।দেয়ালে ঘড়ি ও ক্যালেন্ডার দেখে বুঝতে পারল, সে শুয়ে আছে চানক্য রায়ের ড্রয়িং রুমের বক্স খাটে।ঘড়িতে  বাজে সোয়া পাঁচটা।সে মনে করতে পারল না, সেদিন ছিল কী বার।বারের নাম মনে করার জন্য সে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল।ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল।অবাক হয়ে সে লক্ষ্য করল ক্যালেন্ডারটিতে সেই প্যাঁচার ছবিটি আর নেই, তার বদলে আছে একটি খেঁক শিয়ালের ছবি।।আরও অবাক করা হল, সে সময়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় ছিল মে ও জুন মাস।সন্দীপের গালে বোধহয় একটি মশা কামড়িয়েছিল।চুলকানোর জন্য গালে হাত দিতেই সে লক্ষ্য করল, তার গালের বড় দাঁড়িগুলো আর নেই।গাল একদম পরিষ্কার।গায়ে শার্ট নেই।একটি স্যান্ডো গেঞ্জি আছে, তবে সে সাধারণত যেমন স্যান্ডো গেঞ্জিটি তেমন নয়, এটি অনেক বড় ও ঢিলেঢালা।প্যান্টটিও অন্যরকম।কিছু বুঝতে না পেরে, সন্দীপ বিছানায় উঠে বসল।

সন্দীপ বিছানায় উঠে বসতেই, চানক্য রায়ের বাড়ির কাজের লোক ঘরে ঢুকল।সন্দীপকে বসে থাকা দেখে সে চিৎকার করে বলল, স্যার, এ ঘরে আসুন, বাবু উঠে গেছেন।হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন চানক্য রায়।সন্দীপের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার নাম কী?
সন্দীপ অবাক হয়ে উত্তর দিল, কেন সন্দীপ সেন!
-বাবার নাম?
-গগন সেন।
-তোমার বাড়ি কোথায়?
-জামশেদপুর।
 চানক্য রায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, যাক, তোমার অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে তাহলে!
-কেন, আমার কী হয়েছিল?
-শোন তাহলে, আজ থেকে প্রায় মাস তিনেক আগে তুমি প্রথম আমার বাড়িতে এসেছিলে আমার সাথে গল্প গুজব করতে।আমি তোমাকে এক কাপ স্পেশাল চা খেতে দিয়েছিলাম।খুব অসাধারণ চা ছিল সেটা।কিন্তু অত ভাল চা বোধহয় তোমার সহ্য হয়নি।তুমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে।তারপর থেকেই তুমি অসুস্থ।শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবে।যেহেতু দায়ভারটা আমারই, তাই তোমাকে আমি হাজার হাজার টাকা খরচ করে ডাক্তার দেখাচ্ছি।তুমি এখন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছ।এতদিন তো নিজের নামই বলতে পারনি।আজ বেশ তোমার নাম, বাবার নাম ও গ্রামের নাম বলতে পারলে।তোমায় অভিনন্দন।

সন্দীপের মাথায় কিছু কাজ করছিল না।সে অনেকক্ষণ ধরে অনেক কিছু মনে করার চেষ্টা করল, পারল না।

চানক্য রায়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে সন্দীপ জিজ্ঞেস করল, আমার বাবা মা আমার খোঁজ করে নি?
-তুমি তোমার মা-বাবার একমাত্র সন্তান।তারা তোমাকে বড্ড বেশি ভালবাসেন।তোমার বাবা তোমার এ অবস্থা সহ্য করতে পারেননি।তোমাকে দেখে হার্ট এটাকে মারা গেছেন।

বাবার মৃত্যুর কথা শুনে সন্দীপ বেশ কিছুক্ষণ মুখে হাত দিয়ে চুপ করে থাকল।তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল।তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার মা কোথায়?
-তোমার মা তোমার দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়ে তীর্থবাসী হয়েছিলেন।তবে খবর পেয়েছি, তিনি নাকি গতকাল রাতে বাড়ি ফিরেছেন।আজ হয়তো তোমাকে দেখতে আসতে পারে।  
-মা বাড়ি এসেছে, তাহলে আমিই গিয়ে মায়ের সাথে
দেখা করি।
-আহা, তুমি যাবে কী করে, তুমি তো অনেক অসুস্থ!
-না না আমি যেতে পারব।
একথা বলে সন্দীপ দরজার দিকে যেতে উদ্যত হল।
চানক্য রায় তার হাত ধরে বললেন, না, তুমি পারবে না।
সন্দীপ হেঁচকা টানে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
চানক্য রায় তাকে ধরতে গেলে, সে দৌড় দিল।
চানক্য রায় চিৎকার করে বলল, এই নরহরি, হা করে দেখছ কী, ওকে ধর।
চানক্য রায়ের চিৎকার শুনে  সন্দীপ চানক্য রায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রাণপণে দৌড় দিল।

রাস্তার লোকজন দেখল, সন্দীপ ঢিলেঢালা গেঞ্জি ও ঢিলেঢালা প্যান্ট পরে উদ্ভ্রান্তের মত করে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে দৌড়ে যাচ্ছে আর মুখে বলছে, বাবা, তুমি কোথায় চলে গেলে বাবা, তুমি কোথায় চলে গেলে?
রাস্তার পাশে একটি মাঠে কিছু ছেলেপেলে ফুটবল খেলছিল, তারা সন্দীপের দৌড় দেখে উৎসাহি হয়ে খেলা ফেলে তার পিছন পিছন দৌড়াতে লাগল।সন্দীপ বাড়িতে এসে দেখল, তার মা কল পাম্প করছে।
সন্দীপ দৌড়ে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ও মা, মা, বাবা আমাদের ফেলে কোথায় চলে গেল, মা?
সন্দীপকে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় তার মা দেখল, বাড়ির মাঝে হুড়মুড় করে অনেক ছেলেপেলে ঢুকে পড়েছে।
সন্দীপ কাঁদতে কাঁদতে মায়ের  মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মা তোমার মাথায় সিঁদুর কেন? হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার হাতে শাঁখা কেন? তুমি তো এখন বিধবা!
সন্দীপের মা তার গালে ঠাস ঠাস করে দুটি চড় মেরে বললেন, কী বলছিস আবোল তাবোল?
ইতোমধ্যে বাড়িতে মুরুব্বী গোছের কিছু লোক ঢুকলেন।সন্দীপ তাদেরকে উপেক্ষা করে বলল, কেন, আমি যে কিছুদিন আগে পাগল হয়ে গেছিলাম, আর আমাকে দেখে বাবা হার্ট এটাক করে মারা গেল!
'পাগল' শব্দটি শুনে ছেলেগুলো হো হো করে হেসে উঠল।
ছেলেগুলোর হাসি সন্দীপের সহ্য হল না।সে হাতের মুঠি শক্ত করে তাদেরকে তাড়া করল।
এমন সময় তার কানে ভেসে এল, এসব কী হচ্ছে সন্দীপ?
সন্দীপ অবাক হয়ে দেখল, বারান্দায় তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে।
সন্দীপ একপা দুপা করে এগিয়ে এসে তার মুখের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে চিৎকার করে বলল, বাবা, তুমি মরনি? ইয়াহু, হৈ হৈ বাবা মরেনি, মরেনি।
সন্দীপের কাণ্ডকীর্তি দেখে ছেলে বৃদ্ধ সকলেই হেসে উঠল।
সন্দীপের মা সন্দীপের কাছে এসে বলল, তোর কী হয়েছে, বাবা? পরশুদিন বাড়ি এসে ভাত  খেয়ে বিকেলে সেই যে বোরোলি আর এলি না।ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছিস।আজ হঠাৎ এসে আবার পাগলামি করছিস!কী হয়েছে বাবা তোর? তুই কি নেশাঠেশা করেছিস নাকি?
মায়ের কথা শুনে সন্দীপের মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল।চারদিক কেমন জানি অন্ধকার হয়ে যেতে লাগল?
তার পাশেই একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন।সন্দীপ  তাকে জড়িয়ে ধরল।এভাবে বেশ কিছু সময় কেটে গেল।কিছুক্ষণ পরে সেই লোকটি সন্দীপের কানে কানে বলল, এখন তোমার কেমন অনুভূতি হচ্ছে, সন্দীপ?
কণ্ঠটা সন্দীপের খুব পরিচিত মনে হল।সে লোকটির মুখের দিকে তাকাল।
অবাক হয়ে সে লক্ষ্য করল, লোকটি আর কেউ নন, তিনি হলেন চানক্য রায়, তার চানক্য কাকু।তিনি তার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন।

স্যার ।। মুহাম্মদ নাজমুল হক


স্যার বিড়ম্বনা


আমার মনে আছে গত কয়েক সাল আগে আমি সিলেট গিয়েছিলাম। কুশিয়ারা'র পাড়ে মুলত বেড়ানোর উদ্দেশ্যে। ছিলাম বেশকিছুদিন। পুরা জকিগঞ্জ এলাকা চষে বেড়িয়েছিলাম ও বটে। জকিগঞ্জ স্থলবন্দর, ডাকবাংলো, প্রয়াত ইমন ওরফে নায়ক সালমান শাহ্ এর গ্রামের বাড়ি, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত সহ ছোট বড় টিলা পাহাড় কি দেখিনি।
যদিও কুশিয়ারার অপর পাড়ে অবস্থিত ইন্ডিয়ার করিমগঞ্জ যেতে পারিনি অনেক সাধের পরেও, কেননা আমার পাসপোর্ট ছিলনা।
এবার আসি মুল কথায়। একবার আমি ঘুরতে ঘুরতে কালিগঞ্জ বাজার পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা, আর এলাকাটা একেবারেই মফস্বল। বলাবাহুল্য এশার পর রাস্তায় হঠাৎ বিড়াল ডেকে উঠলেও শরীরের লোম শিওরে ওঠবে।
আমি যেহেতু এলাকায় নতুন তাই বাজার থেকে ফিরে আসার পথ মনেহয় আওলিয়ে ফেলেছিলাম। তাই বাধ্য হয়েই এক মুরুব্বীকে জিগ্যেস করেছিলাম -
 "আসসালামু আলাইকুম স্যার, আমি এখান থেকে জকিগঞ্জ হাসপাতালে (উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) যাওয়ার CNG কোথায় পাবো?
এটা শোনার পর উনি আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন।
আমি আবার জিগ্যেস করলাম - চাচা, আমি জকিগঞ্জ হাসপাতাল কোথা থেকে যেতে পারবো।
উনি এরপরে উনাদের অর্ধেক আঞ্চলিক ভাষায় উত্তর দিলেন - পিছনদিক হাতের বামে গেলে একটা মোড় পাবে, সেখানেই অনেক CNG পাবে।
আমি উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসার সময় দেখেছিলাম উনি আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। হয়ত আমি আসার পর উনি নিজে নিজে অনেক হেঁসেছিলেন। আর ততক্ষণে আমিও বুঝে গিয়েছিলাম উনি কতটা সহজ সরল আর কিছুটা শিক্ষাজ্ঞ। পরে এটাও জেনেছিলাম এখানকার মানুষেরা পানের বাক্স হাতে রাখতে কতটা শিক্ষিত (দক্ষ)।
আরেকবার রাজশাহীতে আমার একবন্ধুর রুম্মেটকে বলেছিলাম - সাঈদ স্যার কেমন আছেন?
জবাবে উনি যা বলেছিলেন তা অন্তত আমি আশা করিনি। - তুমি জাননা আমি কাউকে পাড়াইনা(টিউশনি)।হয়ত উনি কিছুটা রেগে গিয়েই বলেছিলেন। যদিও তখন সমাজবিদ্যা নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম উনার কথায়। পরবর্তিতে আমি শুধু উনাকে বলেছিলাম - ভাইয়া স্যার শব্দের অর্থ কিন্তু ওরকমটা নয়!
যাইহোক, আমি নতুন কোন তথ্য পেলে এটা নিয়ে এতটুকু হলেও জানার চেষ্টা করি। তো গতকিছুদিন আগে বাংলাদেশের একজন নতুন লেখকের বই প্রকাশ হয়েছে, আর বইটা নাকি প্রশংসনীয়। তাই আমার আরেক বইপ্রেমী বন্ধুকে বললাম - দোস্ত অমুক স্যারের একটা নতুন বই বের হয়েছে, চল কিনি?
তো বন্ধুটার মুখমন্ডলের ছবি দেখে আমি নিজেই আশ্চর্য!
ও কিছুমুহুর্ত আমার দিকে দেখে বলল - অমুক? ওই মালটা আবার স্যার কবে থেকে হলো?

অথচ, আমরা সবাই টুকটাক ইংরেজি বলি। আর অতটুকু ইংরেজি বলেও আমরা যেন কতখানি তৃপ্তি পাই। - আর গর্ববোধ করি ইংরেজি বলতে পারায়। যা হয়ত বাংলাতে পাইনা! অথচ, আমরা কাউকে এই ইংরেজিতে সম্মানপূর্ণ সম্মোধন টুকুও করতে পারিনা। আবার কেউ করলেও আমরা অস্বীকার করি কিংবা লজ্জাবোধ করি।
 যাইহোক, আমরা বাংগালিরা কতটুকু শিক্ষিত হচ্ছি এটা আমার হয়ত না জানলেও চলবে। অথচ আমরা প্রায় সবাই বিদ্যানের মুখোশ পরে আছি! 


এক্সপেরিমেন্টাল ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়











এক্সপেরিমেন্টাল

একটি থালা ঢাকা ফুটন্ত কড়াই ...
হালকা আঁচ ...
আর নিজের বুক পকেটে জমানো দু-মুখো কয়েন ...
সবকটি'ই গিঁট দেওয়া দড়ির মতো; 
         — ইন্টারলিঙ্কড

ধর, দড়ির একপ্রান্তে তুমি আর অপর প্রান্তে আমি,
দুপ্রান্ত থেকে দিয়ে চলা দুজনের এক-ফোঁটা জটিল গিঁট 
একে অপরকে দুই-কদম কাছে আনে ৷
কাছে আসার আগুনে আঁচে
দড়ি যেন বাষ্প হয়ে উঠে আকাশ তৈরি করে
উল্টানো থালার মতো 

তবে যে বাষ্প টসে জেতে তা বৃষ্টি হয়ে মাটি ভেজায়ো




লাইটহাউস ।। সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী












লাইটহাউস 

মাত্র একশো ফুট দূরের বাড়ীতে ছাদজুড়ে দপদপ্ আলোর ঢেউ

অথচ বাড়ীর দরজা জানলা বন্ধ টানটান
অথচ বাড়ীটায় শূন্য হাওয়া ঘাপটি মেরে দমবন্ধ;

আজকাল ঘুম ভাঙলেও কিছু মুখ
ঘুমের মধ্যেও কিছু মুখ অযাচিত কবিতা শোনায়,
কবিতারা হুল্লোড় করে মাতলামো করে।

ওপাশের বাড়ীর আঁচল ছুঁয়ে ফিকফিক হাসতে থাকা রাস্তায়
মাঝেমধ্যে দাপিয়ে চলে যায় গম্ভীর সাইরেন;

আজ ফের মারা যাবে কেউ ...

দেখতে দেখতেই সমস্ত অঞ্চল সমুদ্র
উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে ডুবোপাহাড়ের ভাসমান মাথায়

দেখতে দেখতেই ওপাশের জনশূন্য বাড়ীটা লাইটহাউস হয়ে গেল।

হাঁটতে হাঁটতে ।। হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়










হাঁটতে হাঁটতে





হাঁটতে হাঁটতে পাশের মানুষ জানতে চাইবে
কতক্ষণ হাঁটছেন মশাই ?
তুমি ঝুলি থেকে ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড দেখাবে

হাঁটতে হাঁটতে তুমি
দরজা ফাঁক করে দেখো নি
জানলায় কান পেতে একবারও শোনো নি
প্রতিবেশীর শুকনো থালার আওয়াজ

অনেক দূর চলে এসেছ ভেবে
পিছনে ফিরে তাকাতেই তুমি দেখবে
হাত বাড়ালেই তোমার বাড়ি ।

রুপা সাধুখা এর তিনটি কবিতা
















প্রথম প্রহর

বৈশাখ প্রান্তের পড়ন্ত বিকেল
আকাশ জুড়ে মেঘের রাজত্ব
আবছা আলোয় দখিনা বাতাস
দোলা দিয়ে যায় এলো-চুল;
ছাঁদের কোণে একা দাড়িয়ে থাকা,
উদাসীনতার মায়ায় গ্রাস করা
নাম অজানা খোলাচুলো মেয়েটির।
মেঘ-কেশেরা ভর করে নীরবে
ক্ষণিকের তরে হাওয়ায়
কখনো মুখ বেয়ে চোখের উপর।
মেহেদী রাঙা দখিনা হস্ত-
ক্ষণ-ব্যস্ত আঁখি উন্মুক্তে।
দৃষ্টি তার আঁখির অজান্তে
দূর দিগন্ত পেরিয়ে
ঈশান কোণের আকাশ প্রান্তে।
জুড়ে উড়ন্ত যেন-
লাল সবুজের পতাকা
কাঁধে ঝুলানো কারুকার্য পূর্ণ
গোলাপী উড়নার আঁচল।
স্বপ্নহীন বেড়ে উঠা-
দূরন্তপনা দৃষ্টির ছেলেটি
থমকে দাঁড়িয়ে দেখে-
আজ বৈশাখের প্রথম প্রহর।


আমি নারী বলে

প্রশ্নটা নিরন্তর আমার কাছে বুকের কাঁটা
সুদূর নীলের পুরনো রেডিওর গানটা মনে পরে।
পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না ওকে গাইতে দেও
কে আমি।
সমাজের আর পাঁচটা মেয়ের মত
ঠিক আমি একজন নারী।

শৈশবে খেলতাম স্বপ্নের খেলনাবাতি,ঘরকন্না
যৌবনে দেখতাম একটা পুরুষালি লোমশ বুকের স্বপ্ন।
একটা সুখের নীড়, আশ্রয় গভীর প্রেমে
সবটাই সত্যি এই সমাজে।
আর পাঁচটা মেয়ের মত বেড়ে ওঠা
সবার কাছে শোনা তুই বড় হচ্ছিস শান্ত হ।
তারপর বিয়ে স্বপ্নের রাত্রি রজনীগন্ধা কিছু মুহূর্ত
সবটুকু কেটে যাওয়া চলে যাওয়া বদলানো দিন।
ঠিক আমি একজন নারী
কিন্তু কেন আজ আমি আবারও একলা।

পৌরুষের অহংকারে পুরুষ সমাজের শ্রেষ্ঠ জীব
সকল সমাজপতিকে প্রশ্ন?
আজ এগারমাস আমি বাপের বাড়ি আছি
কেস চলছে ,দিনান্তে কোর্টের দরজায় নিজেকে বড় ছোটো লাগে।
লজ্জা করে নিজেকে নারী ভাবতে
আচ্ছা লাথি,কিল ,চড় এগুলো কি নারী হবার উপহার।
আচ্ছা দিনান্তে উপহাস ,অবহেলা এইগুলো আমার প্রাপ্য
আচ্ছা কেন প্রতিমুহুর্তে নিজেকে কুঁড়ে খাওয়া একলা দিন।
কেন আমি নারী বলে আমার অস্তিত্বে পুরুষের অধিকার
সকল সমাজকে ধিক্কার আমার এই জীবিত মৃত্যুর।

জানি খুশি হবেন সমাজপতিরা আমি মরে গেলে
জানি আরো খুশি হবে সেই পুরুষটা যাকে দেখেছিলাম টোপর পরে।
কিন্তু আমার মৃত্যু নেই আমি ফিরে আসবো বারংবার মায়ের যোনিতে
অপেক্ষা করবো সুদিনের যেদিন ছিটিয়ে দেব থুথু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মুখে ।
যতদিন প্রশ্নটা নিরন্তর আমার বুকের কাঁটা হয়ে থাকবে
কেন আমি নারী বলে।


অনুক্রম

সব কিছুর একদিন হয় শেষ
জানি এ প্রতীক্ষার হবে না ইতি।
ওই যে পথের কিনারে ,
একাকিনী সদ্য জন্মানো কামিনীর চারা
একদিন এ গাছটিও যৌবনবতী হবে
ছড়াবে রূপের মহিমা নিসর্গের বুকে
সুতীব্র গন্ধে মাতাল হবে যুগলেরা
প্রতি ভোরে মিশে যাবে নরম ঘাসের বুকে
ওর ইচ্ছেগুলো পাবে পূর্ণতার ছোঁয়া
সময় পেরিয়ে যাবে সিঁড়ি কেটে কেটে
কিন্তু আমাদের প্রতীক্ষার হবে না শেষ
আমরা রয়ে যাব দেয়ালের দু'পাশে
হয়ত এটাই নিয়ম , এটাই অনুক্রম।

জানি এ অনুভূতির হবে না পরিমিতি
এই যে স্রোতসিনীর ছোট্ট ঢেউটি
একদিন জন্মেছিল পাহাড়ের খসখসে দেহে
তারপর ছুটে চলেছে অবিরাম
অতঃপর পার হয়ে যাবে সহস্র পল ,
ক্ষণ একদিন সাগরের উতলা বুকে
মিলে মিশে হবে একাকার , উন্মাতাল ।
কিন্তু আমাদের গোলাপী ইচ্ছেগুলো
ক্রমাগত দূর থেকে দূরে চলে গিয়ে
ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে যাবে
চলে যাবে দৃষ্টির অগোচরে
মিশে যাবে অজানা কোনো নক্ষত্রে
আমরা শুধুই দেখবো চেয়ে চেয়ে ।


বলতে নিষেধ আছে ।। মতিন বৈরাগী

















বলতে নিষেধ আছে

ওখানে ওই মাটির টিলার উপড়ে কেউ একজন নাকি বসে থাকে
সন্দেহ নেই কারণ লোকে তাই বলে আর বিশ্বাস করে
আর একজনতো একটা গান রচে ফেলেছে সে হোমার চারণ কবি
সন্দেহ নেই যে বসে থাকে এমন একজন কেউ
যে কেবল নিজের হাতটাকেই বিশ্বাস করে আর তার আঙুলে 
ট্রিগার টানার ভঙি
সে যে কবে থেকে এমন আসে বসে কেউ ভালো জানেনা
লোকে বলে তার মৃত্যু হয়েছিল একটা দেশ চাইতে গিয়ে
আর তার যে জমি জিরেত যাতে কিছু ক্ষুদকুড়ো জন্মাতো 
এখন অন্য কারো সেবাদাস-
সন্দেহ নেই আকাশটায় অবসাদ হলে সে উঠে দাঁড়ায়
আর একটা সূর্যকে খোঁজে কোনো এক আকাশে
আর লোকে বলে সে এখন একটা ছায়ামাত্র আসলে রাতেই আসে
টিলাটার উপর একটা সূর্য তার চক্ষু রক্তবর্ণ
আর তারপর সে নিচে নামে
সূর্য ডুবে গেলে টিলাটা আঁধারে হারায়-
কেউ জানেনা আগামী কাল সে আসবে কিনা
সন্দেহের কারণ অনেক আছে, কিন্তু কেউ তা বলছে না
হয়তো বলতে নিষেধ আছে-

ঢেউ ।। অমিত রায়













ঢেউ



যাওয়াই যায় 
হয়তো যাবও 
নিশির ডাকে কখনো নয় ।
অচেনা গাঁয়ের
অচেনা বাড়ি
হারিয়ে যাবার ভীষণ ভয় ।
বাদল মেঘে
বজ্র থাকে
সে তো সবার জানা কথা ।
শুকনো মেঘে
বর্ষা হলেই
মোচড় মারে বুকের ব্যাথা ।
কপালে নেই
চাঁদের টিপ
কপাল ফাঁকা ফাঁকা লাগে ।
চাঁদের বুড়ি কি
এখনো বেঁচে 
মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগে ।
চেনা মানুষ
অচেনা কেমন
কখনো ভাব, কখনো আড়ি ।
পুকুর পাড়ে
মাঠের ধারে
ভাঙ্গা চালের ছোট্ট বাড়ি ।
বন্ধ ছিল 
হোচ্ছে আবার
পৈতে – দাড়ির তুমুল বিবাদ
অনুপ্রেরণায় ?
আছে আছে
পাওনা, ভোটের ্রক্ত স্বাদ ।।

শান্ত জলে
বিদুষী ঢিল
উথাল পাথাল উঠেছে ঢেউ ।
গভীর জলে
ঢিলের বাস
শান্ত করার নেইতো কেউ ।


ক্লান্তি ।। দ্বীপ সরকার

























ক্লান্তি


আধমরা সাপটিকে বেঁচে রেখে লাভ নেই -
ওতো সুযোগ পেলে আপনাকেই ছোঁবল মারবে। 

নিশ্চিত কিছু কথা এরকম - 
হাঁপিয়ে ওঠা শরীরে সীমানা দিয়ে রাখো
প্রাচির টপকে সাহস দেখাবেই।

আমি এখন অনেক ক্লান্ত-
বিছানা দাও; এবার বিশ্রাম নেবো।
সাপের মতো আধমরা রেখোনা আর
সুযোগ পেলেই আছড়ে পড়বো আমিও..

লেখাঃ ১৩/১/১৮ইং