বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮

প্রচ্ছদঃ কুয়াশা ।। মার্চ সংখ্যা। ২০১৮ইং।।


সম্পাদকীয় ।। মার্চ সংখ্যা ।। ২০১৮ইং ।। ২য় বর্ষ ।। সংখ্যা ১১ ।।


সম্পাদকীঃ মার্চ সংখ্যা।২০১৮ইং।।
মার্চ মাস। খুব ভয়াল এবং স্বরনীয় একটি মাস। বারোটি মাসের মধ্যে মার্চ মাস আসলেই আমাদের মধ্যে নেমে আসে স্মৃতিময় ইতিহাস।  
খুব গুরত্ববহন করা এই মাসে বাঙ্গালীরা প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালী হয়ে উঠেছিলো। ৭ই মার্চ, ২৫শে মার্চ, ২৬শে মার্চ। এই তারিখগুলো মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের জন্ম এবং অস্তিত্বের সাতকাহন। 

একাত্তরের আকাশের ঠিক এই রকম হাওয়া বয়নি। এই রকমভাবে পাখিরা গান গাইতে পারেনি। উড়তে পারেনি। দিন মজুরেরা মন খুলে ভাওয়াইয়া,ভাটিয়ালী গাইতে পারেনি। দ্রিম দ্রিম করে যখন বোম্বিং হচ্ছিলো তখন আজকের মতো মন খুলে চোখ খুলে কেউ হাসতে পারেনি। তারি নাম একাত্তর। তারি নাম স্বাধীনতার বৎসর। মা, বোনেরা ইজ্জত দিয়ে যখন পাগলীনী হয়ে পথে পথে ঘুরেছে, কেউ তাদের রক্ষা করতে পারেনি -এরি নাম দিয়েছি আমরা স্বাধীনতা।চোখ মুছতে মুছতে ক্ষয় হয়ে যাওয়া চোখের কোনে তাদের এই দূর্বিসহ স্মৃতিগুলো আজো ভাসে। অনেকেই বেঁচে নেই। অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে পথে পথে ঘুরছেন। তবুও তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা। তাদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

স্বাধীনতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে যে  স্বপ্ন নিয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন সেইখানে মানুষের মনে অনেকটাই প্রশ্ন। দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্ত কোথায় যেনো স্বাদহীন। স্বাদ পাচ্ছিনা। মানুষের একটা ভয়, আতঙ্ক জড়িয়ে আছে। পরিস্কার করে মুক্তভাবে কথা বলতে পারছিনা। এখানে মতবিরোধ থাকবে। থাকতেই পারে। একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে সব ধর্ম, সব দল, সব বর্ণের মানুষ থাকবে। তারা তাদের মত কথা বলবে। কিন্ত এইখানেই যত বিরোধ বিপত্তি।
আকাশের পাখ পাখালিরা যেমন খোশ মেজাজে থাকে, ঠিক সেই রকমই মানুষদেরও খোশ মেজাজে থাকলে তবেই মনে করবো আমরা প্রকৃত পক্ষে স্বাধীন জাতি। স্বাধীনতার স্বাদ তখনই পাওয়া যাবে। তবুও এই দেশ আমাদের। আমাদের প্রাণের দেশ, বাংলাদেশ।


কুয়াশা'ও দেখতে দেখতে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার মাসে কুয়াশাকে সব সময় স্বাধীনতা বিষয়ক লেখা দিয়ে সাজাতে চেয়েছিলাম। অধিকাংশই স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের লেখা স্থান পেয়েছে। কিছু লেখা আছে এর বাইরে। এটাও বৈচিত্র ঠিক রাখার কৌশল। তাই কুয়াশার সঙে যারা আছেন, ছিলেন সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন। আপনারা কুয়াশার পাশেই থাকুন। এই কামনায়। 

সূচিপত্রঃ কুয়াশা।। মার্চ সংখ্যা ।। ২০১৮।।

সূচিপত্রঃ কুয়াশা। মার্চ সংখ্যা। ২০১৮ইং।।


প্রবন্ধঃ
সৌমিত্র চক্রবর্তী।

কবিতাঃ
নির্মলেন্দু গুণ, মহুয়া মুখোপাধ্যায়, বীরেন মুখার্জী, আবুল বাসার, মোহাম্মদ ইকবাল, কবির মুকুল প্রদীপ, দেবজ্যোতি কাজল, মোকসেদুল ইসলাম ,পল্লবসেন গুপ্ত, এ কে এম আব্দুল্লাহ, আক্তারুজ্জামান লেবু , দ্বীপ সরকার, সিদ্দিক প্রামানিক। 

গল্পঃ
রওশন রুবী, মোঃ আহসান হাবিব, এস আই জীবন। 

কবিতাঃ
আবু আশফাক্ব চৌধুরী, সিলভিয়া ঘোষ, শ্রীলেখা চ্যাটার্জি, সুনীতি দেবনাথ, রুদ্রাক্ষ রায়হান, কবির হুমায়ুন, বর্ণালী চ্যাটার্জ্জী, লায়লা আঞ্জুমান ঊর্মি, আব্দুল আজিজ, কাজী জুবেরী মোস্তাক, এলিজা আজাদ, কৃপা আচার্য, সুশান্ত হালদার, সবর্না চট্রোপাধ্যায়।

অণুগল্পঃ
সুধাংশু চক্রবর্ত্তী, দীলতাজ রহমান

কবিতাঃ
নাসির ওয়াদেন, আবু আফজাল মোঃ সালেহ, জেলী আক্তার, জেবুননেসা হেলেন, বাদল মেহেদী, সুমন আহমেদ, শিশির রায়, অভিলাষ মাহমুদ, ইয়াসমিন আক্তার মনি, আনজানা ডালিয়া, কে এম বায়েজিদ, টি কে এম আজেমি

ছড়াঃ
মাইন উদ্দিন পাঠান, ইকবাল বাবুল, মজনু মিয়া, জুঁই জেসমিন। 

প্রবন্ধঃ স্বাদহীন স্বাধীনতা ।। সৌমিত্র চক্রবর্তী


স্বাদহীন স্বাধীনতা
স্বাধীনতা তুমি কার? আবহমান এ প্রশ্ন উদিত দেশ কাল জাতি বর্ণ নির্বিশেষে। উত্তর নিয়ে নানান বিতর্ক, আলোচনা অব্যাহত এবং স্বতঃই অমীমাংসিত। কিন্তু রোজকার চলার পথে এর হাজারো উত্তর মাঝে মাঝে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের প্রকৃত অবস্থাকে দেখিয়ে দেয়।
যেতে যেতে পথের ধারে যে অপুষ্ট শিশুকে দেখি, একটা থালাও যার সম্বল নেই। ফেলে দেওয়া অতিরিক্ত উচ্ছিষ্ট হুমড়ি খেয়ে গোগ্রাসে গিলছে। যে মা কে দেখি হাড় জিরজিরে সন্তানকে একপাশে বসিয়ে রেখে তার গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে নিজের দেহ উন্মুক্ত করে খুবই কম মূল্যের বিনিময়ে। কিম্বা কাশির সঙ্গে রক্ত উঠে আসা, দেনার দায়ে মাথার শেষ চুল বিক্রী হয়ে যাওয়া বন্ধ কারখানার শ্রমিক বা দাম না পাওয়া আলুচাষী আত্মহত্যার সবচেয়ে শস্তার উপায় খোঁজে। তখন অন্তত বোঝা যায় স্বাধীনতা নামের আপ্তশব্দ এদের জন্য নয়।
রবীন্দ্রনাথ কবে লিখেছিলেন তেত্রিশ কোটি জনসংখ্যার ভারতবর্ষের কথা। আজ তার প্রায় চারগুণ মাথার ভারে ন্যুব্জ ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের জনভূমি। শেষ গণনার থেকে চার বছর পরে এখন প্রায় ১২০ কোটি (সরকারী মতে) মাথার দেশ ভারতের প্রচারিত অর্থনীতি নাকি এখন বেশ সবল। 
“১৯৫০-এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত ভারত সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করে চলে। স্বাধীনতা-উত্তর যুগের অধিকাংশ সময় জুড়ে ভারতে যে আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তাতে বেসরকারি উদ্যোগ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ওপর কঠোর সরকারি বিধিনিষেধ আরোপিত থাকত। ১৯৯১ সালে অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে ভারত তার বাজার উন্মুক্ত করে দেয়। বিদেশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উপর সরকারি কর্তৃত্ব শিথিল করা হয়। এর ধনাত্মক প্রভাবে মার্চ ১৯৯১ সালে ৫.৮ বিলিয়ন  মার্কিন ডলার থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় ৪ জুলাই, ২০০৮ তারিখে বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ঘাটতি কমে আসে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বাজেটগুলিতে। যদিও সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ এবং কোনও কোনও সরকারি খাত বেসরকারি ও বৈদেশিক অংশীদারদের নিকট মুক্ত করে দেওয়ায় রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
ভারতের মোট স্থুল আভ্যন্তরীক উৎপাদন বা জিডিপি ১.২৪৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) পরিমাপে ৪.৭২৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতূল্য। জিডিপি'র মানদণ্ডে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। চলতি মূল্যে ভারতের মাথাপিছু আয় ৯৭৭ মার্কিন ডলার (বিশ্বে ১২৮তম) যা ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) ভিত্তিক পরিমাপে ২,৭০০ মার্কিন ডলারের সমতূল্য (বিশ্বে ১১৮তম)। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে কৃষি প্রধান দেশ হিসাবে পরিচিত ভারতের বর্তমান জিডিপিতে পরিষেবা খাতের অবদান ৫৪ শতাংশ ; ইতিমধ্যে কৃষিখাতের অবদান হ্রাস পেয়ে ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং শিল্পখাতের অবদান মাত্র ১৮ শতাংশ। বিগত দুই দশকে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি ভারতের গড় বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৭ শতাংশ।
৫১৬.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমশক্তির দেশ। এই শক্তির ৬০ শতাংশ নিয়োজিত কৃষিখাতে ও কৃষিসংক্রান্ত শিল্পগুলিতে, ২৮ শতাংশ পরিষেবা ও পরিষেবা-সংক্রান্ত শিল্পে এবং ১২ শতাংশ নিযুক্ত শিল্পখাতে। প্রধান কৃষিজ ফসলগুলি হল ধান, গম,তৈলবীজ, তুলা, পাট, চা, আখ, আলু । প্রধান শিল্পগুলি হল অটোমোবাইল, সিমেন্ট, রাসায়নিক, বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, যন্ত্রশিল্প, খনি, পেট্রোলিয়াম, ভেষজ, ইস্পাত, পরিবহণ উপকরণ ও বস্ত্রশিল্প। ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদগুলি হল আবাদি জমি, বক্সাইট, ক্রোমাইট, কয়লা, হীরে, আকরিক লৌহ, চুনাপাথর, ম্যাঙ্গানিজ, অভ্র, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও আকরিক টাইটানিয়াম ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শক্তির চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, ভারত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের ষষ্ঠ বৃহত্তম ও কয়লার তৃতীয় বৃহত্তম ভোক্তা।
বিগত দুই দশকের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ভারত বিশ্বের সর্বাপেক্ষা দারিদ্র্যপীড়িত রাষ্ট্র। শিশু-অপুষ্টির হারও বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় ভারতে সর্বাধিক: ২০০৭ সালের হিসেব অনুযায়ী ৪৬ শতাংশ) । তবে বিশ্বব্যাঙ্ক নির্ধারিত দৈনিক ১.২৫ মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখার (২০০৪ সালের হিসেব অনুযায়ী, ক্রয়ক্ষমতা সমতা নামমাত্র হিসেবে নগরাঞ্চলে দৈনিক ২১.৬ টাকা ও গ্রামাঞ্চলে দৈনিক ১৪.৩ টাকা) নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১৯৮১ সালে ৬০ শতাংশ থেকে ২০০৫ সালে ৪২ শতাংশে নেমে এসেছে।  সাম্প্রতিক দশকগুলিতে ভারত মন্বন্তর প্রতিরোধ করতে পারলেও, দেশের অর্ধেক শিশু ওজন ঘাটতিতে ভুগছে। এই হার সারা বিশ্বের নিরিখে কেবল উচ্চই নয়, এমনকী সাব-সাহারান আফ্রিকার হারের প্রায় দ্বিগুণ।
বর্তমানে ভারত  সফটওয়্যার ও অর্থসংক্রান্ত, গবেষণাসংক্রান্ত ও প্রকৌশলগত পরিষেবার এক বৃহৎ রপ্তানিকারক। ২০০৭ সালে রপ্তানি ও আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ২১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বস্ত্র, রত্ন, ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদি ও সফটওয়্যার ভারতের প্রধান রপ্তানি পণ্য। প্রধান প্রধান আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে অপরিশোধিত তেল যন্ত্রপাতি, সার ও রাসায়নিক দ্রব্য। 
ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের দ্বাদশ বৃহত্তম; ২০০৭ সালে এর মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন ছিল ১.০৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ব ব্যাংকের করা নতুন হিসাব অনুযায়ী মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। ভারতের বিশ্বের প্রবৃদ্ধিশীল অর্থনীতিগুলির মধ্যে দ্বিতীয় দ্রুততম; ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে ভারতের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হার ছিল ৯.৪%। কিন্তু ভারতের বিরাট জনসংখ্যার কারণে মাথাপিছু আয় মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে মাত্র ৪,১৮২ মার্কিন ডলার এবং আর্থিক ভিত্তিতে মাত্র ৯৬৪ ডলার (২০০৭ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী)। বিশ্বব্যাংক ভারতের অর্থনীতিকে একটি স্বল্প-আয়ের অর্থনীতি হিসেবে শ্রেণীকরণ করেছে”।
সরকারী পরিসংখ্যান পড়লে মনে হবে আমরা সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বা সমতুল কোনো উন্নত দেশের সমতুল পর্যায়ে চলে গেছি। কিন্তু আসল অবস্থা কি? 
দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা ভারতের একটি প্রধান সমস্যা এবং এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতা অর্জনের জন্য একটি বড় বাধা। দারিদ্র্য এখনও একটি প্রকট সমস্যা, তবে স্বাধীনতার পর দারিদ্র্যের পরিমাণ অনেক হ্রাস পেয়েছে। সরকারী হিসাব মতে ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে ২৭% ভারতীয় দরিদ্র ছিলেন।
তাহলে হিসাব অনুযায়ী দেশের অগ্রগতির এই সুফল ভোগ করছেন এক বিপুল জনগোষ্ঠীর মানুষ এবং বাকীরাও উন্নতির পথে অগ্রসরমান। কিন্তু এ যে কতবড় এক ধোঁকা তা আপামর জনসাধারণ জানেন।
উন্নতির যে সুফল তা প্রায় সম্পূর্ণ ভোগ করে চলেছেন সমাজের উচ্চস্তরের মাত্র ১৫% বিত্তশালী মানুষ। বিত্তশালী বললেও সম্ভবত অনেক কম বলা হয়। এঁরা নিজেদের ভারতীয় মনে করেন না। পৃথিবীর বিভিন্ন  দেশে এঁদের সম্পত্তি ও ব্যাংকব্যালেন্স আছে। শুধু প্রমোদেই এঁরা রোজ কোটি টাকা খরচ করে থাকেন। 
মধ্যস্বত্ত্বভোগী মানে আমরা যাঁদের মধ্যবিত্ত বলে থাকি তাদের সংখ্যাও প্রায় ১৫%। স্বচ্ছল পরিধির বাসিন্দা এঁরা মনে মনে এক একটি আম্বানি, হিন্দুজা হওয়ার স্বপ্ন লালন করেন। নীচুতলার প্রতি এঁদের ঘৃণা অপর্যাপ্ত। 
বাকী রইলো যে ৭০ শতাংশ জনজাতির মানুষ, তাদের মধ্যে আবার প্রায় ৫০ শতাংশই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। এঁরা ভাত, রুটি খাওয়া তো দূরের কথা সেইসব খাদ্যের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। বনজঙ্গলের শিকড় বাকড়, কন্দমূল, মেঠো ইঁদুর, ফসল সংগ্রহের পরে পড়ে থাকা শষ্যদানা, জঙ্গলের পাতা সংগ্রহ ও বিক্রী করে সামান্য অর্থসংগ্রহ, অসংগঠিতভাবে তুচ্ছ সরঞ্জামের মাধ্যমে মাছ ধরা, ইত্যাদি এঁদের জীবিকা। মাসের প্রায় অর্ধেকদিনই অভুক্ত থাকার অভ্যাস এঁরা রপ্ত করেন বংশানুক্রমে। কোনো কোনো বংশধর এই শোষনের প্রতিবাদ জানালে জোটে লাঠি-বেয়নেট-ধর্ষণ-আগুন-হত্যা। 
আসলে সামন্ততান্ত্রিক জনজাতির প্রতিভূরা এখনো মনে মনে সেই সামন্তযুগেই বাস করেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুঁজিবাদের শোষক মানসিকতা। আর এই দুই এ মিলে এগিয়ে চলেছে ১৫+১৫% এর ভারতবর্ষ। স্বাধীনতার সুফল ভোগকারী এরাই। তাই স্বাধীনতা এদেরই। বাকীরা ১৯৪৭ এর আগেও যে তিমিরে পড়েছিল, এখনো সেখান থেকে একচুলও এগোতে পারেন নি। লক্ষ ঢক্কানিনাদ সত্বেও একজনও কালোবাজারী নিকটবর্তী ল্যাম্পপোস্টে ঝোলেনি। 

বসন্ত বন্দনা ।। নির্মলেন্দু গুণ





বসন্ত বন্দনা

হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে,
হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে
বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি
তবুও ফুটেছে জবা,—দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে,
তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।

এলিয়ে পড়েছে হাওয়া, ত্বকে কী চঞ্চল শিহরন,
মন যেন দুপুরের ঘূর্ণি-পাওয়া পাতা, ভালোবেসে
অনন্ত সঙ্গীত স্রোতে পাক খেয়ে, মৃত্তিকার বুকে
নিমজ্জিত হতে চায়। হায় কি আনন্দ জাগানিয়া।

এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতই ফেরাই চোখ,
যতই এড়াতে চাই তাকে, দেখি সে অনতিক্রম্য।
বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্যখানি
নবীন পল্লবে, ফুলে ফুলে। বুঝি আমাকেও শেষে
গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে।

আমি তাই লঘুচালে বন্দিলাম স্বরূপ তাহার,
সহজ অক্ষরবৃত্তে বাঙলার বসন্ত বাহার।

ভুলের সব ক্যানভাস পেরিয়ে ।। মহুয়া মুখোপাধ্যায়












ভুলের সব ক্যানভাস পেরিয়ে


পালাতে চাই বেহিসেবি জীবন থেকে
যেখানে অবকাশ পেয়েছে অতৃপ্ত শব্দরা, 
সেখানে থাকবে খোলা আকাশের ভাঙন  
চাঁদ চুঁয়ে পড়া মেঘের গোঙানিতে 

বুকচেরা আকুলি নিয়ে বাতাসে  
আছে কিছু শুকনো হাহাকার
ভেজা সত্যি যখন ঠোঁটের গায়ে লাগে -
স্যাঁতস্যাঁতে কিছু চোখের জল'ও পিছলে যায়- 
বাকরুদ্ধ হয় ঠোঁট  

শব্দেরা পরিশলীলিত নয় 
কথারা কথা শুনতে ভয় পায় তাই -  
চেতনে অবচেতনে হতে থাকে কেবলই ক্ষতবিক্ষত
সশব্দ প্রেমের চেয়ে
নিশ্চুপ ক্ষতবিক্ষত হওয়া অনেক সুন্দর 
তবু ,ক্লান্ত লাগে 
মাঝে মাঝে নিখাদ ইচ্ছে জাগে 
ঘুটঘুটে অন্ধকারে সবার আড়ালে -
যদি পলাতক হতে পারতাম

ঠিক ভুলের সব ক্যানভাস পেরিয়ে -
মুক্তি, মুক্তি, মুক্তি  নিতাম - 
নিঃশব্দে চুপিসারে

উপমার খোঁজে ।। বীরেন মুখার্জী












উপমার খোঁজে 

ফেলে দেওয়া দানার ভেতর উঁকি দিয়েছিলে, না-বালক ঈর্ষা থেকে তবুও ফেরাইনি কথোপকথন; লক্ষ্য করো- এভাবেই, খুব কাছের সুড়ঙ্গে চোখ রেখে আহ্বান জানাতে পারতাম অমোচনীয় এক সম্পর্কের যুগ্ম পৃথিবীকে, অথচ- শীতনিদ্রা পৃথক হতেই, কালো পাখি ভালোবেসে বেরিয়ে এসেছি উপমার খোঁজে; আর কণ্ঠস্বরের তীব্রতা থেকে খসে পড়া উন্মাদনা
সরিয়ে জাগিয়ে তুলেছি ভ্রমণের শর্ত!

 এভাবে, দিনানুদিনের প্রার্থনা থেকে যে সংশয় তোমাকে মুখর রেখেছিল, তার রং এবং মৌলিকত্ব নিয়ে, পারতাম, প্রশ্নশীল     হতে; স্মৃতির মালকোষে গেঁথে দিতে পারতাম সার্বভৌম স্বর ও সংকেত! এখন ঋতুর আবহ ভাঙছি, সন্ধান করছি দল             নিরপেক্ষ হাওয়ার; সামনে বসন্ত দিন... প্রতিজ্ঞা পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ধারণাবিন্দু থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারছি না!

মুখোশ ।। আবুল বাসার








মুখোশ

মুখোশের আগে মুখ
নাকি মুখের আগে মুখোশ
মানুষ চিনতে মানুষের লাগে
সত্যি বহুত যুগ ৷

এক মুখে থাকে আদর্শনীতি 
এক মুখে ছলনা ;
এ সব তোমার কেমন রীতি 
বলো বঙ্গ ললনা !

কাল যা ছিল তাঁতের শাড়ী 
আজ তা বমকাই !
আজ যা হবে লাল বেনারসী
কাল তার খোল নাই ৷
সীমন্তের সীমানা লালে
ভেদ শুধু টাকাটাই !
এক দিকে থাক সুগন্ধি বুক
চোখ জুড়ে রোশনাই,
আর দিকে সুখ ভরা বুক
অন্তরে আলো নাই !
মুখ ও মুখোশে দড়ি টানাটানি
সংসার পুড়ে ছাই ৷

একদিকে ফোঁটে ভোরের চামেলি 
এক দিকে রাতে বেলি ;
গোলাপ রজনী দিনান্তে মুখোশে
সব ছিড়ে দেয় ফেলি ৷

মধুকর পাখি আজ সব ফাঁকা
ফড়িং তবু ছন্দে ,
রাত ভোর হলে সুগন্ধি ফুল
পড়ে রাস্তার বক্ষে !

খোলা থাক পথ অচল অবাক
জীবন নদীর সন্ধ্যে
একা পথ চলা নির্বাক্‌ সবলা
আজকে নদীর বক্ষে ৷

অভিবাসী ।। মোহাম্মদ ইকবাল












অভিবাসী 



গোধূলির আকাশে হঠাৎ একশত আশি ডিগ্রী বাঁক 
নিয়ে উড়ে গেল একঝাঁক অতিথি পাখি, 
গন্তব্য শহরের শান্ত স্নিগ্ধ ঝিল,
পালকের আচ্ছাদনে ওরা এক একটি অভিবাসী হৃদয়,
নীড়ের উষ্ণতা তাদের ক্ষনিকের,
সময়ের প্রয়োজনে বারংবার যাযাবর!
মানুষের এক একটি ঘর থাকে দেশ থাকে।
একটি ঘরে অনন্তকাল কাটিয়ে দেয় মানুষ,
কখনও কখনও কেউ ঘর হারিয়ে ফেলে 
কেউ কেউ দেশও!
কেউ কেউ ঘরের রাস্তা কখনওই খুঁজে পায়না।
অতিথি পাখিরা বছরের এই সময় ঠিকই ফিরে শহরের 
এই স্নিগ্ধ ঝিলে এবং প্রতি বছরই ফিরে।

তেঁতুলদূপুর ।। কবির মুকুল প্রদীপ

















তেঁতুলদূপুর

তেঁতুল দূপুরের শূন্যতা মেখে বাটিটা পড়ে আছে
একলাছাদ কি যেনো ভাবছে তখন
উলঙ্গ বাতাসে দুলছে তারে ঝোলা অন্তর্বাস
ঝিমধরা গাছের মমত্বে বড়ছে ভূতঘুম
ভেসে আসছে আজানের মিহি সুর
কয়েকটা চড়ুই নাচছে কার্ণিশে সোৎসাহে
এই জীবন কেনো চড়ুইজীবন নয়,যৌনময়
অথচ প্রাচীনকাল হতে মানুষ-চড়ুই একঘরে সহবাস
নিয়মেই ঢলে পড়েছে সূর্য
চুরি যাওয়া উত্তাপে অন্তর্বাসে লেগে থাকা মল শুকোবে না
শুকোবে না ভেতরে চড়ুইয়ের খচখচ
ওদের আমি পুষি; নিয়ন্ত্রণহীন,ভয়,কখন না বেরিয়ে আসে



জীবন কাঠুরে ।। দেবজ্যোতি কাজল

















জীবন কাঠুরে




আমার গায়ের গন্ধে বিকেল নামে উষ্ণতায়
নামে তেজপাতা রঙের সন্ধ্যে ধূসর বিছানায়

আমায় ডাকছে শরীর ঝুঁকে
ঠাণ্ডা রাতের তলপেট থেকে

আমি আজ অসুস্থ , সবুজ ত্বকের জানলা বুকে
কবোষ্ণ শরীর উড়ে যায় চিতার আগুন শুঁকে ।

ঘুমায় চোখ রোদের ফাঁকে
ছেঁড়া বাতাস সম্পর্ক চুকে

আমি নিজেকে নিজে ডেকে পাই না সাড়া শেকড়ে
শীতের রাতে মরা শহর কেঁদে যায় জীবন কাঠুরে ।

মোকসেদুল ইসলাম এর দুটি কবিতা

















পৃথিবী একটা ওপেন বায়স্কোপ


কিছু স্বপ্ন চিহ্নিত করে রাখি 
ঘুমভাব ঘুম ঘুম পরী
নৈসর্গিক রূপে হাজির আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুধা।
সব রূপ-ই ধার করেছি
আকাশের কাছ থেকে মেঘের কাছ থেকে
বাতাসের কাছ থেকেও নিয়েছি কিছুটা।

শুধুমাত্র মানুষের মুখগুলো আমায় খুব টানে
এমনকি জিরো ফিগারের মেয়ে সেও
আপন ঠিকানা খুঁজি চোখে, মুখে এমনকি বুকেও
যেন দীর্ঘতম পৃথিবীতে সব এক একটা ওপেন বায়স্কোপ।


ডাক


স্তনের বাধ্যবাদকতা মেনে নিয়ে গর্ভবাস শেষে বের হলাম মাত্র। 
অসহ্য অন্ধকারের ভেতর যে অহঙ্কারের বীজটা বাড়তে ছিল
ভ্রষ্টাচারী বধ্যভূমির টান আমাকে আর থাকতে দিল না সেথায়। 
হাতে সময় বড্ড কম 
জোয়ারের জলে দ্রুত ধুয়ে ফেলতে হবে শরীরের পাপ
জলও দেখি অহঙ্কারী অথচ মেঘদের কৃপায় বেঁচে থাকে সে।

সংসারের দরজা খুলে বসে থাকে কেউ কেউ
কে নেবে যৌবনের রসদ? দু’ফোটা জল মাতাল প্রণয়
দখলের নেশায় নয় মধ্যরাতের আদর বইছে যার বুকে
অলীক স্বাদের এ জমির ফসলসমূহ তার।





আমি কিভাবে বাঁচবো ।। পল্লবসেন গুপ্ত












আমি কিভাবে বাঁচাবো


বাঁচবে তো আমার সাধের সংস্কৃতি?
এতো যে আঁধার ছড়িয়ে আছে হৃদয়ে,
এতো যে আতঙ্ক,
শুধু বাংলাকে বাঁচাতে গিয়ে দিনের পর দিন প্রতিদিন হিমশিম খাচ্ছে আমার অক্ষর,
চলছে ভ্রুণে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র,
হৃদয়ের এক মাটিতে সজীব অক্ষর ঘিরে কত আর রক্তপাত
শিশুঘরে গলা টিপে রুদ্ধ করতে চাইছে তাঁর কণ্ঠস্বর
এই অক্ষর, এই ভাষাকে আমি কিভাবে বাঁচাবো?
এতো যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন,
এতো ষড়যন্ত্র
জিভ বদলের এই‌ ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোন সর্বনাশে,
শিশু যদি তার মাকে না চেনে, কি করে ডালবাসবে তার দেশ, কি করে?
বড় অনাদরে পড়ে আছে বাংলা 
পোষাক বদলের মতো চলছে ভাষা বদলের নিপুন কারসাজি
আমি কি করে বাঁচাবো দেশ?
কি করে বাঁচাবো ভাষা, সমৃদ্ধ তার সংস্কৃতি?
আমি কি করে এই বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখবো?
এক মুঠো ভাত হলে প্রাণে বেঁচে যাওয়া যায়,
কিন্তু একটু ভালবাসা ছাড়া আমি কি করে ছড়িয়ে দেব এর সুবাতাস ঘরে ঘরে?
বলছি না এ ঘরে পড়শীর প্রবেশ নিষেধ,
তারা আসবে আপ্যায়ন নিয়ে চলে যাবে দূরে,
শিশুটি ধুলিতে খেলতে খেলতে আদরে ডাকবে তার মাকে
মা, এই অন্তহীন আমি ডুব দিয়ে খুঁজবো তোমাকে।
ফেব্রুয়ারি 21 2018

কুড়িয়ে পাওয়া পঙতি ।। এ কে এম আব্দুল্লাহ








কুড়িয়ে পাওয়া পঙক্তি


এখনও মাঝে মাঝে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে পূর্বপূরুষের হাড্ডি। তার ভাঁজে ভাঁজে জন্ম নেয় পলাশ আমরা সেই পলাশ হত্যা করে দাফন দেই ঘরের ভিতর রাত ঘন হলে লাশ থেকে বেরিয়ে আসে খুলি শিশুর মতো কাঁদে আমি সেই কান্না মুছতে গেলে,খুলিগুলো শব্দ করে পালাতে থাকেআমিও পিছনে পিছনে দৌড়াতে থাকি

এরপররাত স্পর্শ করে ভোরের ঠোঁট আর খুলিগুলো লুকিয়ে যায় - দোয়েলচত্বরের পাথরে

 

সুন্দরবন সমাচার ।। আক্তারুজ্জামান লেবু

















সুন্দরবন সমাচার

১.
সুন্দরবন একটি পরিপূর্ণ কবিতার নাম-
সুতরাং আপনি কবিতা লিখতে সুন্দরবনকে কপি করলে 
চলেনা-- কখনোই না।
২.
আপনি এই অসময়ে সিগারেট হাতে কেন আমি জানি
একটু আগেই কবিতার খাতায় উগলেছেন কিছু সস্তা প্রতিবাদ
এখন একটা ছদ্ম নাম খুঁজতে বৃক্ষের নিচেই দাঁড়িয়ে আছেন
বুকে এত ভয় নিয়ে বৃক্ষের মুখোমুখি দাঁড়ান কি করে শুনি?
৩.
এই যে সুন্দরবনের ফাঁসির রায় হলো
পুড়িয়ে ফেলা হলো সুন্দরবনের স্বপক্ষের সমস্ত নথিপত্র 
তবুও তো সে আটকে দেয়নি নিশ্বাসের গোপন তত্ত্ব
প্রতিরক্ষার সমর কৌশল- অহিংসবাদ
সুতরাং আপনাকে বুঝতে হবে
শুধু কবিতা লিখে পার পেয়ে যাওয়ার মত ধারক নিয়ে 
সুন্দরবন দাঁড়িয়ে থাকেনা...

আমি যুদ্ধ করিনি তাতে কি ।। দ্বীপ সরকার





আমি যুদ্ধ করিনি তাতে কি

আমি যুদ্ধ করিনি তাতে কি, আমি অস্ত্র ধরিনি তাতে কি
এ দেশকে ভালোবাসি
পতাকার ভেতর রক্তফুল রাশি রাশি।

আমি তখনও পৃথিবী দেখিনি, তখনও ফুলকে বুঝিনি
যতোটা বুঝেছি শূণ্য দশকে এসে
এদেশে পদ্মা মেঘনা যমুনার ঢেউ ভাসে। 

মা, মাটি, নারী - বেদনার ঘর, আকাশে নীলদের ঝলোর
হায়েনাদের চিনে ফেলেছে সবাই
আমরা শুদ্ধতার স্কেলে মেপে নিচ্চি নিজেরাই।

অঙ্কটার হিসেব ছিলো ভুল, কিছু ফাগুন বিষম রোদফুল
ইস ! পতাকাটা যাচ্ছে পুড়ে নিরবে
অাজ একটা কবিতার জন্ম হবে । 

পটভূমিকার ইতিহাস জানি, শয়তান খুব নিকটের - মানি
ঝাপসা অক্ষরে লিখেছি বাংলাদেশ
বিষবৃক্ষের ডালে ঝুলে আছে অবশেষ।

লেখাঃ ৬/৩/১৮ইং

সিদ্দিক প্রামানিক এর দুটি কবিতা
















শিকারী 


দোনালা বন্দুকের সাথে কয়েকটা শিকারি হ্যাট
আজ জংগলে যাবে, সাথে যাবে সিগারেটের প্যাক, 
হুডখোলা জীপ আর দোধারের চাকু

পূর্নিমা রাত হলেই ভালো। ফায়ার শুরু হলে-
পরে থাকবে নীলগাই, আবার হরিণ কিম্বা
বিকেলের সেই একজোড়া সোনালী সারশ-

পেছনে জড়ো করে বেঁধে ফিরে আসবে
জীপ- ছিমছাম সেই ডাকবাংলোয়। রাত গাঢ় হবে, 
আরো গভীর হলে তবেই বেরুবে মাংসের ঘ্রাণ

ভেলভেটের পর্দাও সচকিত দেখে নেবে
বিদেশী মদের সাথে নর্তকীর ঘনিষ্ট নাচ। 
তারপরেই কিছুটা মাতাল আর বেসামাল
হতে হতে বিভোর ঘুমে চাঁদ ডুবে যাবে


প্রশংসা 

ডাইনিং টেবিলে ফলভারাবত নাস্তার প্লেটগুলো
আমার মুখোমুখি বসে-
কবিতার প্রশংসা করলে
আমি যথার্থ আনন্দ পাই।

আমার নতুন ও পুরনো পোষাকগুলো
আমার  কবিতার স্তুতি করতে করতে
অক্টোপাসের আলিঙ্গনে জাপটে ধরলে
আমি খুব খুশি হয়ে বেলুনের মতো ফুলতে থাকি-
সহপাঠে পড়া সেই গল্পের মতো-
একটা গর্বিত ব্যাঙ গরুর ফুঁ-তে ফুলতে ফুলতে
যেভাবে ফেটে গিয়েছিল

গল্পঃ বিরাঙ্গনার সন্তান ।। রওশন রুবী


বীরাঙ্গনার সন্তান 

  
 
হাসপাতালের কেবিনে ঢুকেই আলী উল দেখে বড়মামা শিশুর মত ঘুমাচ্ছেন বকের পালক রঙা বিছানায়। বড় মামার বন্ধু হাসমত আলী সাহেব এক কোনে সোফায়   চুপচাপ বসে আছেন। যার স্নেহের পরশ এখনও মাথায় লেগে আছে আলী উলের। তাঁর বৈঠকখানায় সেবার বসেছিল মামার পাশে। অনেক জানাশুনা তাঁর, সেই সুবাদে মামা চেয়েছিল যদি আলী উলের মাকে খুঁজে পাওয়ার কোন পথ বের করা যায়? যেতেই শুনে হাসমত আলী সাহেব বৈঠকখানায় উপস্থিতিদের বলছেন - দেশে কি যে চলছে। কিছুই তার ঠিক ঠিকানা নেই। যার যেমন লুটেপুটে খাচ্ছে। আমরা দেখছি আর আঙুল চুষছি।  যেই দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে লড়েছিলাম।  সেই দেশে ছেয়ে গেছে কুটিল জটিল লোকজনে। আগুনে ঝলসে দিচ্ছে মানুষদের। পথে ঘাটে আতঙ্কিত মানুষের চলাচল। জানমালের একপয়সা নিরাপত্তা নেই।  এই দেশে মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে প্রকৃতজনদের খুঁজে পাওয়া মুসকিল হবে। শত্রুদের আবার কি তাড়াতে হবে রুহুল? আবার কি অস্ত্র হাতে নিতে হবে? আলী উলের মামার দিকে চেয়ে রইলেন কথাগুলো বলে। আলী উলের মামা রুহুল আমিন বলেন
-  তাইতো দেখছি।  প্রয়োজনে আবার তাড়াব ওদের। আবার তুলে নিবো অস্ত্র।  অস্তিত্ব যদি বিলুপ্ত হয় তবে  কি থাকবে বাঙালির?  যদি এখন হাঁটুর উপর প্যান্ট  তুলে দাগটা দেখিয়ে দেই পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ছোড়া গুলির দাগটা। যদি হাসমত আলীর পাজামা নামিয়ে পেছনটা দেখাতে পারত তবে কিছুটা হলেও বুঝতে দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে কি গভীর ক্ষত পেয়েছে দেশের প্রকৃতজনেরা এবং তা কতটা যন্ত্রণাময় ছিল। কিড়া পড়ে ছিলো পর্যন্ত সেই ক্ষতে। একদিন তো যন্ত্রণা সইতে না পেরে দা গরম করে কোমরের ক্ষতের মধ্যে লাগিয়ে আজরাইলের থাবায় পড়ে দ্বিতীয়বার মরতে মরতে বেঁচে গেলেন হাসমত আলী। আজো শিউরে উঠি কতো খান্নাশ ছিল সেইসব মানুষ, কত নাফরমান বেইমান ছিল। নিজ জাতি ধর্মের মানুষের সাথে এমন কুকর্ম, এমন পিচাশের মত আচরণ করে কেউ? অথচ তারাও জ্ঞানী ছিলো, কোরআন পড়ত, কোরআনের তর্জমাও জানতো। বিদায় হজের ভাষণ সম্পর্কেও কম জানতো না। তারা কিন্তু তাদের কার্যকলাপে জাহেলিয়া যুগকেও হারমানিয়েছে। আসলে তারা ছিলো জ্ঞান পাপী, ইয়াজিদের গোষ্ঠি। দয়া মায়া বুদ্ধি বিবেচনা বলতে কিছুই ছিল না তাদের। এর মধ্যে একজন বলে উঠলো
-  ওদের বিরুদ্ধে মামলা কইরে দেই এলাকাবাসীরা? ওরা স্বায়ধীনতার শত্রু, যুদ্ধ অপরায়ধী হইয়েও দিব্বি বুক ফুলাইয়া ঘুইরে বেড়ায় । দেইশপ্রেমিক, সায়ধারণ মানুষের উয়পর অত্যাচার কয়রে।  ভিন্ন ধর্মের মায়নুষদের অত্যাচারে অতিইষ্ঠ কইরে তুইলছে। গাড়ি, ঘরবাড়ি, দোকান পাট জ্বালায়ে দেয় আইজো। মাইয়ারা ঘরের বাইরে হবার পারে না।  আয়সলে এইদের বুক পিঠ নাই। ডাণ্ডার ঘা পইড়লে আর জয়নসাইধরণের লাত্থিউষ্টা খাইলে ঠিক হইয়া যাইবো বেইমানেরা। নায়মে মুসলমান। আরেক জন বলে
-   এতো ভাবা ভাবির কাম নাইক। হেরা কোন কামই ঠিক কয়রে নাই। চইলেন থানায় যাই । হাসমত আলী স্নেহের গলায় থামালেন ঐ ব্যাক্তিকে।  বললেন
-   আরে বাবা প্যাটপ্যাট না কইরে ভোট নে সবার থেকে। কে কে মামলা করার পক্ষে । তোরা তরুণ। তোগর দিকেই তো এখন সমাজের সব কাম চেয়ে থাকবে। মামলা দিতে কয়জন চায় দেখি। প্রায় সবাই হাত তুলল। বাড়ির ভেতরে খবর পাঠালেন  রান্না করতে। মজলিসে বললেন আপনেরা আজ দু'টো ডাল ভাত খেয়ে যাবেন। আমার নাতি আসছে। ওর ওছিলায় খাইবেন। আর ওর মায়ের জন্য দোয়া করবেন। সে নিরুদ্দেশ হয়েছে। আলী উলের কচি মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন সরলতায় ভরা। ও একজন বীরাঙ্গনার সন্তান। তার জন্ম নিয়ে সন্দেহ করবার কিছু নেই। সরল রেখার চেয়েও সরল তার জন্ম কথা। আলী উলের চৌদ্দ বছরের চোখ মজলিসের সবার মুখকে দর্শন করে।  ওর ঘন লোমে ঢাকা ভ্রু আর মসৃন বুক কাঁপে। সেই কাঁপন দেখে মনে হয় সত্য কখনও কখনও যুদ্ধের চেয়ে ভয়াবহ। আলী উলের রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। ওর বোধে উপছে পড়া কষ্টের   পরিমান কম নয়। সেই উপলব্ধি কতটা প্রগাঢ় ও মৌলিক তা তার শিরা উপশিরা জানে। আর বুঝি জেনে ছিলেন হাসমত আলী। তাই তিনি প্রশান্তির ছায়া দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আলী উলকে। তার বুকে ওর মাথাটা আশ্রয় পেয়ে হেলে থাকে বেশ কিছু সময়। এবয়সেই আলী উল বুঝেছে বীরাঙ্গনার সন্তানেরা সমাজের ডাস্টবিন। ওদের দেখলেই গন্ধ বেরুক আর না বেরুক নাকে রুমাল চেপে সরে যায় মানুষ। ঘৃণা পেয়ে বেড়ে উঠে তারা।  যেখানে যায় সেখানেই তারা দেখে মানুষের নিঠুরতা, ঘৃণা, অবহেলা। যেন যুদ্ধের সময় তারাই আর্মি ছিল, আর বিভৎস নির্যাতনের পর হত্যা করেছে অগণিত মা, বোনকে। যেন দিনের পর দিন নির্বিচারে হত্যা করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের।

সেই ছোট বেলা আলী উলকে ফেলে রেখে নিরুদ্দেশ হয়েছেন লজ্জা, ঘৃণা, ক্ষোভে, দুঃখে তার মা। হাঁটতে শেখা , চলতে শেখা ছিল তার কম বেশি অনাদর অবহেলায় মামার বাড়িতেই। ছোট ও মেজ মাসী ছিলো সহোদরা। তাই তারা মিল করেই যেন অবেহেলাগুলো করতো আলী উলের প্রতি। সেই অসহনীয় অবহেলা মামাদের সামনে কখনোই প্রকাশ করতো না সে। মামারা তাকে যথেষ্ট ভালোবাসতো। তারা ঐসব জানতে পারলে মামীদের সাথে হয়তো খারাপ আচরণ করবে। তাই সব হযম করেই বেড়ে উঠেছে সে। বড় মামা এবং তার পরিবার ছিল ভিন্ন। ভিন্ন হলেও তাদের কাছে থাকা ছিল অসম্ভব। কারণ বড় মামা একজন রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে আহত হওয়াতে তাঁর শারীরিক অক্ষমতার জন্য কোন কাজ করা তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক মানুষ জনের মতো নয় বলে। একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন। যার আয় দিয়ে কোন ভাবে তাঁর সংসার চলে। সেই সংসারে বাড়তি একজন মানুষ সত্যি অবিচার করা হবে। মামা তবু মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে যায় । মামীও খুব যত্ন করে তখন তার সামর্থ্য অনুযায়ী । একটা যুদ্ধ একটা জাতির কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নেয়। আলী উলের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তার মাকে। পরিবার হয়না কোন বীরাঙ্গনার। আলী উলের মাও পরিবার পায়নি। গতকাল ভোরে আলী উল বাজারে বটগাছের শিকড়ে বসে মনের সুখে গান গাইছিল আর কুড়িয়ে আনা বকুলগুলো এ হাত থেকে ও হাতে নিচ্ছে, নাকের কাছে ধরে সুবাস নিচ্ছে এমন সময়  দোকানী রাহাত এসে বললো " ফোন এসেছে। " অবাক হয়েছে আলী উল। তবু ছুটলো ফোন দোকানের দিকে। ফোনে বড় মামার অসুখের খবর পেয়ে ঢাকায় এসেছে। তবে মামাকে দেখে আজই ফিরতে হবে আগামী পরশু ষোল ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এইবার অন্যরকম ভাবে পালন করার কথা গ্রামের যুবকদের দিবসটি। হয়ত সেই প্রোগ্রামের আয়োজন করছে যুবকেরা। তারা তার উপস্থিতি টের পেলে যথেষ্ট অপমান করবে তাকে। তবু স্মৃতিসৌধের একটু দূরে ঝোঁপের আড়ালে বসে প্রস্তুতি থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সব দেখবে আলী উল। তার এই ইচ্ছে পূর্ণ  হবে কিনা এখন সে সন্দিহান। প্রতি বছর এই দিনে  বিশিষ্টজনেরা যখন বক্তৃতায়  মহান মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলে, যখন তাঁরা বীরাঙ্গনাদের কথা বলে। বলে বীরাঙ্গনারাও মুক্তিযোদ্ধা। তখন গঙ্গার স্নান করে উঠে আসা মানুষের মতো পবিত্র লাগে তার। আর সেসময় ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমি বীরাঙ্গনার ছেলে। দেখুন দেখুন আমি বীরাঙ্গনা ছেলে। কিন্তু পারে না পর মুহূর্তে ওদের কন্ঠ যখন ঝাঁঝালো হয়ে উঠে। যখন তারা সেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে " ঐসব হারামির বাচ্চারা তাদের যে বীজ রেখে গেছে সেই বীজ থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে কুকুরেরাই কুকুরের  জন্মদাতা হয়। ঐ কুকুরদের বীজ কুকুরই হবে। ওদের দেখলেই বয়াবহ যুদ্ধ সময় স্থির হয়ে যায়, মনে পড়ে যায় সেই জ্বলন্ত গ্রাম, শহরের ছবি। মা মেয়েকে চুলের সাথে বেঁধে বাবার ছেলেকে ধর্ষণ করতে বলা। তারা অস্বীকৃতি জানালে নির্দয় ভাবে তাদের সামনে ধর্ষণ ও পরে ওদের হত্যা করে মেয়েদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া। মায়ের কোল থেকে শিশুকে নিয়ে উপর দিকে ছুঁড়ে ফেলে ব্রাসফায়ার করে শিশুর ছিন্ন ভিন্ন দেহের টুকরোর দিকে তাকিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠা ।  ওদের নিঃসংশতার কথা মনে হলে গা শিউরে উঠে কোটি কোটি উদাহরণ আছে এমন নিসংশতার । ইয়াহিয়া তার পোষাকুত্তা আর্মিদের বলেছেন "যে ভাই হয়ে ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করে এমন বাঙালিদের সত্য পথে আনার জন্য যতো পারো সুসন্তানের জন্ম দাও।" সেই ইয়াহিয়ার জঘন্যতম নির্দেশের নির্মম স্বীকার আমাদের মা বোনেরা। তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা । আর সেই পাকির জারজ সন্তানদের প্রতি ঘৃণা। উপস্থিতির মধ্যে এ কথার পক্ষে বিপক্ষে গুঞ্জন উঠলেও জোরালো হয়না। তখন শুধু মনে হয় এই পাপ জন্ম থেকে মুক্তি পাওয়া দরকার। এই পৃথিবীর কেউ এই জীবনকে চায় না। এই পৃথিবীর সব অবহেলা অবজ্ঞা শুধু তার মতো সন্তানদের জন্য। যারা কোন দিনই পরিচয় পায় না মানুষের । তারা সমাজ পায় না। পরিবার পায় না। পায় অবহেলা আর অবহেলা। তাদের বেঁচে থাকার কি প্রয়োজন ? কিন্তু আলী উলের মৃত্যুর আগে সেই দুঃখীনি মাকে দেখতে ইচ্ছে করে। তার মন বলে মা ফিরে আসবেই। মা দেখতে আসবেই তাঁর সন্তানের ঘৃণ্য অবস্থান। ঝোঁপের আড়াল থেকে স্মৃতিসৌধকে তার মায়ের মতো লাগে। কতো গভীর রাতে এই স্মৃতিসৌধের ধূলিমেখে মনে প্রশান্তি পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতো যে সে বীরাঙ্গনার সন্তান।

বাড়ি যাওয়া হলো না রুহুল মামার অবস্থা বাড়াবাড়ি হওয়ার কারণে আলী উলের। কালই ষোল ডিসেম্বর। এখানে কোথায়আছে স্মৃতিসৌধ কে জানে। কাউকে জিজ্ঞেস ও তো করা যাবে না। যদি গ্রামের মানুষের মতো এরাও আলী উলকে কটাক্ষ করে? তবে হাসপাতালে এসেছে অব্দি কেউ তাকে বাঁকা চোখে বা ঘৃণার চোখে দেখেনি সে লক্ষ্য করেছে। যে যার মতো ছুটছে। কারোরই ভ্রুক্ষেপ নেই কোথায় বীরাঙ্গনার সন্তান পড়ে আছে আর কোথায় পড়ে আছে সুস্থ পরিবারের সন্তান । যে যার মতো ছুটছে। এই এতো বছরে দুটো রাত একটা দিন বেহেস্তি সুখে কাটে আলী উলের। কিন্তু কাল সকালে কি করে সে সেই স্মৃতিসৌধের কাছে যাবে? দূর থেকে হলেও মাকে দেখবে? ভাবতে ভাবতে জল গড়ায় চোখ দিয়ে । সেই জল বুকের ভেতর সমুদ্রের মতো ঢেউ তোলে আর হুহু করে বাড়তে থাকে বেগ। এখানেও ভেসে আসছে যুদ্ধের গান, বিজয়ের গান, সর্বহারার গান। এখানের মানুষেরাও নিশ্চয় সম্মান জানায় সে সব বীর এবং বীরাঙ্গনাদের। ষোল ডিসেম্বর গভীর রাতে ক্লিনিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুলের তোড়া হাতে রাস্তায়  মানুষের ঢল নামতে দেখে আলী উল। তারও ঐ শোভাযাত্রার সাথে যেতে ইচ্ছে করে। ওরা নিশ্চয়ই কোন না কোন স্মৃতিসৌধের দিকে যাচ্ছে। রুহুল মামা বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। মনটাকে আর ধরে রাখতে পারে না আলী উল। সে নিচে নেমে যায় । দারোয়ানকে অনুরোধ করে গেইট খুলে বেরিয়ে পড়ে। একটা শোভাযাত্রার একটু দূর দিয়ে  হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে। সে লক্ষ্য করে তাকে অনেকেই দেখছে কিন্তু সে চোখ বাঁকা নয়। তার মন বড় হতে থাকে সে আরো কাছে আসে। তখনও কেউ তাকে ছাল উঠা কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছেনা। সে আরো ঘন হয়ে মিশে যায় শোভাযাত্রার সাথে। ঠিক তখনই  তার শরীর বেয়ে বুক থেকে নেমে যায় বড় এক কালো পাথর। পাথরের ভারহীন হয়ে সে হাঁটে। জীবন এখানে বেহেস্তের মতো লাগছে তার কাছে। এই প্রথম সে শ্বাস নিচ্ছে বিশুদ্ধ বাতাসে। স্মৃতিসৌধের  সামনে এলে সবাই সবার হাতের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে সরে যায়। আলী উলের হাতে ফুল নেই দেখে তার পাশের সাদা পাঞ্জাবী পরা লোকটি একটি ফুল এগিয়ে দেয়। স্বপ্নের মতো লাগে আলী উলের। সে হাত বাড়িয়ে ফুলটি নিয়ে। নিজের গায়ে চিমটি কাটে। না, এ স্বপ্ন নয়। এই বাস্তবতার জগত তাকে ধিক্কার দিচ্ছে না। ঘৃণা করছেনা। অবহেলার বিষবাণেও ক্ষতবিক্ষত করছেনা। ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়েও তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে হচ্ছে না। কি আশ্চর্য! কি অদ্ভুত! দীর্ঘ  বছরের অপমানের অগ্নিগিরীর লাভা নির্গত হয়। আলী উল স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে গিয়ে ফুল বিছানো সিঁড়ি পর সিঁড়ি চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তোলে আর আবেগে পাগলের মতো  চিৎকার করে বলে আমি বীরাঙ্গনার সন্তান। আমি বীরাঙ্গনার সন্তান। অসংখ্য তেজি আলো মুহূর্তে আলী উলকে ঘিরে ধরে। অসংখ্য মাইক্রোফোন আলী উলের মুখের সামনে ছুটে আসে। অসংখ্য প্রশ্ন বানে আলী উল বিদ্ধ হতে থাকে। অসংখ্য চোখ তাকে অবাক হয়ে দেখছে। সে সেই সবের সামনে দু'হাত পাখির মতো মেলে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফের চিৎকার করে উঠে " আমি বীরাঙ্গনা নসিমনের সন্তার। আমি নসিমনের সন্তান।" 
হঠাৎ তার হাতে অসংখ্য হাতের টান পড়ে। হাতগুলো তাকে টেনে যে সিঁড়ি গুলো দিয়ে উপরে উঠে এসেছে তা দিয়ে নামিয়ে আনে। এবং একটি গাড়িতে তুলে দেয়। একজন সাদা পোশাকের মানুষ ইনজেকশন হাতে এগিয়ে আসে। সব হাতগুলো তাকে চেপে ধরে। ইনজেকশনের ক্রিয়া তার শিরা-উপশিরায় প্রবেশ করতে থাকে, মুহুর্তে ঘোলা হয়ে উঠে সবকিছু। ঘোলা চোখগুলো বন্ধ হবার আগের মুহূর্তে একটি ভারি কন্ঠস্বর শুনতে পায়। সেই কন্ঠস্বর বলছে " এর কন্ডিশন ভালো নয়। একে পাবনার পাগলা গারদে পাঠাও দ্রুত।" কথাটি শুনে আলী উল প্রাণপণে চিৎকার করে। কিন্তু সেই চিৎকার কেউ শোনে না।  

গল্পঃ মৃত্যুই হাদারামের মুক্তি ।। মোঃ আহসান হাবিব

মৃত্যুই হাদারামের মুক্তি


হাদারাম পাল খুব সাধারণ আর সাধাসিধা একজন ন্যায়পরায়ণ মানুষ। পরজীবনের প্রতি শ্রোদ্ধা রেখে সে অনেক আত্মসংযমী হয়ে চলার চেষ্টা করে। তাই সাধারণের পক্ষে যে ভাবে চলাচল, বাদ বিচারহীন, বিবেক হীন ভাবে করা সম্ভব হাদারামের পক্ষে সেভাবে চলাচল করা সম্ভব হয়ে উঠে  না। মানুষকে ঠকিয়ে, মানুষকে বিপদে ফেলে নিজের স্বার্থ হাচিল করা হাদারামের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। মানুষকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য সে নিজের প্রাপ্য থেকে অনেক কিছু হাসি মুখে ছেড়ে দিতে পারে কিন্তু মানুষকে কষ্ট দিতে পারে না কোন ক্রমেই। বর্তমান যেখানে উল্টো স্রোতের বাজার সেখানে হাদারামের সততার কারণে অনেক কষ্টে দিন যাপন করতে হয়। হাদারামের নিজের কোন জায়গা নেই। পরের জমিতে কোন রকম একটা ছাপড়ার ঘর তুলে ছেলে, মেয়ে আর বউকে নিয়ে  সংসার তার খুব কষ্টে চলছিল। গ্রামের উপার্জন কম হওয়ায় হাদারাম পাল অর্থা উপর্জনে ঢাকা শহরে আসে। ছোট বেলা থেকে তার একটাই নেশা কম্পিউটার চালানোর। তাই কম্পিউটারে তার ভাল দক্ষতা ছিল। একটা প্রোজেক্টে হাদারাম কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে কাজ পায় হাদারাম। এর ভিতরে হাদারামের অনেক ভাল ভাল উচ্চ বংশিও ধ্বনী পরিবারের সাথে উঠা বাসা চলে কাজের সুবাদে। বাড়িতেও টাকা পাঠায় হাদারম নিয়মিত। এক সময় প্রজেক্ট শেষ হয়ে যায়। প্রজেক্ট শেষ মানে চাকুরী ও শেষ। হাদারাম মহা বিপদের পড়ে । অফিসে পক্ষ থেকে বলা হয় প্রজেক্ট শেষ হলেও কাজ এখনও শেষ হয়নি। তাই কেউ যদি বাকী কাজ গুলো সমাপ্ত করার কাজে সহযোগিতা করে তাকে পরবর্তী প্রোজেক্টে চাকুরি দেওয়া হবে। পরবর্তী প্রোজেক্ট আসতে ২/৩ মাস সময় লাগবে। 


এই দুই তিন মাস বিনা বেতনে ভলেনটারী সার্ভিস দিতে হবে। সবাই রাজি হয়ে যায়। যে হেতু একটা চাকুরি নিতে বড় স্যারদেরকে ১০/১৫ লক্ষ টাকা চা-নাস্তা খেতে দিতে হয়, আর এত টাকার দেওয়ার ক্ষমতাও হাদারামের নেই। তাই দুই-তিন মাস বিনা বেতনে পরিশ্রম করাই তার জন্য যুক্তি যুক্ত। শুরু হয় বিনা বেতনে কাজ করা। বিভিন্ন আমলা তান্ত্রিক জটিলতার কারণে নতুন প্রজেক্ট আসতে দেরী হয়। এদিকে হাদারামের জমানো যা টাকা ছিলো সেটা শেষ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জনের কাছে ধার দেনা করতে করতে ঋণের একটা পাহাড় জমা হয়ে যায় হাদারামের মাথার উপরে। তবু হাদারামের ভর্ষা যে, চাকুরি টা পেলে সব ঋণ শোধ করে দিতে পারবো। কিন্তু চাকুরী নামের সোনার হরিণের কোন দেখা নেই। হাদারাম কাজ করেই চলেছে চাকুরীর আশায়। দিন গড়াতেই আছে। পাওনাদাররা টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। পরিবারে আর্থিক খরা দেখা দিল। সংসারে ফাটল সৃষ্টি হলো । হাদারামের কাছে কোন টাকা নেই। যেই হাদারাম ৫০০/১০০০ টাকা মানুষের কাছে চাওয়া মাত্রই পরিচিতরা তাকে দিয়ে দিতো। সেই হাদারমকে এখন কেউ আর ১০ টাকাও ঋণ দিতে নারাজ। একই রুমে থাকে হাদারামের রুমমেট রা এখন হাদারাম কে আর কোন সাপোর্ট দেয় না। হাদারাম মহা বিপদে পড়ে গেছে। হাদারাম এখন পায়ে হেটে ৫ মাইল পথ অত্রিক্রম করে অফিস করে নিয়মিত। হাদারামের অফিসে অনেক ধণী লোকও কাজ করে। কিন্তু তারা হাদারামের মত আরো যারা কাজ করে তাদের কোন খোঁজ খবর নেয় না। এমনও লোক আছে যারা নিজেরাই জানে না যে ব্যাংকে তাদের মোট কত টাকা আছে। ঢাকা শহরে ৭-৮ টা বাড়ির মালিক। তবে সবাই যে এমন তা নয়। একদিন , দুই দিন পর পর এক সাজ করে খাওয়া মেলে হাদারামের। অফিসের বড় বাবুরা খাওয়ার পরে যে খানা থাকে অফিস পরিচ্ছন্ন কর্মীরা সেই খাবার হতে নিজেরা কিছু খায় আর কিছু হাদারামের জন্য পাঠায়। দুই একদিন অভূক্ত থাকার পরে সামান্য খাবারের স্বাদ হাদারামের চোখে জল এনে দেয়। অনেক সময় দেখা গেছে হাদারাম খাচ্চে আর তার চোখ দিয়ে পানি পড়েছে অঝর ধারায়। হাদারামের অফিসে এক জন মানুষের কথা হাদারাম কোন দিনও ভুল তে পারবে না। সে হলো এনামুল কবির স্যার, যিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। তার সব চেয়ে বড় গুণ হলো তিনি মানুষে প্রচুর পরিমানে খাদ্য খাওয়াতেন। ক্ষুধার্ত মানুষেকে গোপনে খাদ্য খাওয়ানো তার বিশেষ গুণ। প্রায় দুপরে সে হাদারামকে ডেকে শুনতেন, হাদারাম- দুপরে খাওয়া হয়েছে। হাদারাম বলতো – না, স্যার, কিছু খাই নি। স্যার বলতেন। ঠিক আছে দুপরে আমার সাথে খেয়ো। যদি কোন দিন এনামুল হক স্যার খানা অন্যদেরকে নিয়ে খেতেন তখন হাদারামের হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে বলতেন- যাও নিচে থেকে কিছু কেয়ে এসো। স্যারের যে খুব কপি পতি তা কিন্তু নয়, তবে তিনি দু’হাতে অসহায়ের বিপদে খরাচ করতেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে হাদার সর্বদা সেই স্যারের জন্য সুভকামনা করে। অসহায় ব্যাক্তিই কেবল অসহায় এর মর্ম বোঝে। হাদারাম ভাবে দু:খের পরে সুখ আসবেই। রাতের পরে তো দিন আসেই। এই একটাই আশায় হাদারম এখনও বেঁচে আছে। ক্ষুধার কষ্ট হাদারাম কি তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। ম্যাসের অন্য মেম্বাররা খানার যে অবশিষ্ট অংশ থাকে তা মেসের বুয়া সকারে ফেলে দেয়। হাদারাম বুয়াদের কে বলে রেখেছে যে,  খানা গুলো ফেলে না দিয়ে হাদারাম কে দিতে। হাদারম সেই খাওয়ার খাই। একদিন হাদারাম কিছু ভাত নিয়ে রুমে যায় খাবে বলে। ক্ষুধার তাড়নায় শুধু ভাত ক্ষেতে শুরু করে। রুমের আর একজন ভাত তরকারি রান্না করে খায়। হাদারাম দেখে খাড়িতে ডাইল রান্না করেছে। হাদারাম মনের সুখে ডাউল দিয়ে ভাত খাই। মনে মনে ভাবে যার হাড়ি থেকে ডাউল নিয়েছে সে আসলে তাকে বললে যে, তার হাড়ি থেকে ডাউল নিয়ে খেয়েছে। যথা সময় ঐ লোক আসে, হাদারাম তাকে বলে যে, সে না বলে তার হাড়ি থেকে ডাউল নিয়ে খেয়েছে। উত্তরে ঐ লোক জানায় যে, সে তো ডাউল রান্না করেনি। তরকারি খাওয়ার পর হাড়িতে পানি ঢেলে রেখে গিয়েছিল। হাদারমের বুঝতে বাকী থাকে না যে, সে ডাউল ভেবে কি দিয়ে ভাত খেয়েছে। হাদারাম চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। এক দৌড়ে বাথরুমে চলে যায়। এবং অঝরে কাঁদতে থাকে। চোখের বৃষ্টি যেন থামতেই চাইছে না, হাদারামের। রাস্তায় যখন হাটতে থাকে আর দেখে রাস্তার পাশে ডাস্টবিনের খাবার গুলো কুকুরে খাচ্ছে, তখন হাদারামের ইচ্ছা হয় কুকুরের মুখ থেকে খাবার গুলো কেড়ে নিয়ে নিজে খেতে কিন্তু আত্ম সম্মানবোধ সেটা করতে সায় দেয় না। এ দিকে প্রজেক্ট পাশ হওয়ার কোন খবর নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় হাদারামের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই এই ক্ষুধার্থ পৃথিবীতে। অনেক বার ই সে গাড়ীর নিচে মাথা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আত্মহত্যার করার শক্তিও তার থাকে না, প্রভু যাদের কে এ কঠিন ক্ষমাত দেননি হাদারাম তার মধ্যে একজন। এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় এভাবে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। পারিবারিক যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন। ফেবুতে বিভিন্ন লোকের কাছে সাহায্য চায়। কেউ তাকে সাহায্য দেয়ে না। টিটকারি করে। দুই এক জন কিছু সাহায্য দেয়। দু’এক জন ভাবে ভন্ড ব্যবসায়ী। আজব বিশ্বচরাচরের নিয়মে সে হাবুডুবু খাচ্ছে। মরার জন্য যখন হাদারাম পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় ঠিক তখনই হাদারামের মোর পরিবর্তন করে দেয়, প্রেরণা, প্রেরণা একজন স্কুল শিক্ষিকা। তার স্বামী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার, বিভিন্ন সমাজ সেবা কাজের সাথে জড়িত প্রেরণা। প্রেরণার টাকা পয়সা যা থাক না কেন, একটা বড় মন আছে । সে হাদারামের পাশে বট বৃক্ষের মত দাড়িয়ে যায়। সব চেয়ে অবক করা বিষয় হল ফেবুতে উভরের পরিচায়। এমন অপরিচত হাদারামের পাশে বট গাছেরমত প্রেরণা যখন দাড়ায় তখন হাদারামের সংকীর্ণ পৃথিবীটা অনেক বড় হয়ে যায়। হাদারম কল্পনাও করতে পারে না যে, বিশ্বচরাচরে এমন নি:শ্বার্থ মানুষ থাকতে পারে। প্রায় সর্বস্তরে হাদারামকে সাহায্য করে প্রেরণা। হাদারাম ভাবতে থাকে এভাবে সে প্রেরণার কাছে বহু ঋণী হয়ে যাচ্ছে। শুধু নিচ্ছে তো নিচ্ছে। দেওয়ার মত তো কিছু নেই হাদারামের। হাড়ির তলা যেমন ছিদ্র হলে তাকে পানি দিয়ে পূর্ণ করা যায় না। ঠিক তেমনি প্রেরণার দেওয়া সকল কিছু হাদারাম কে পূর্ণতা করতে পারে না। কারণ প্রেরণা যাই দেয় না কেন, হাদারাম সেটা নি:শ্বেস করে ফেলে। জীবন কে নিয়ে আর এক দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় হাদারাম। এমন ভাবে প্রেরণার কাছে ঋণী হতে থাকলে নিজে বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে হবে। এমন সময় ফেবুতে হাদারামে এক বন্ধবী জোটে নাম নিলাঞ্জনা চম্পা সিরাজী, সে হাদারামকে বলে যে, তুমি যদি লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিঃশ্বেস করে ফেল তবে কোন দিন ও উপরে উঠতে পারবে না। সারা জীবন তোমাকে ঋণ নিয়েই যেতে হবে। কোন দিন পরিশোধ করতে পারবে না। তোমাকে যে কোন একটা কাজ করতে হবে। তাই সে কাজটা যত ছোট ই হোক না কেন। নিলাঞ্জনার কথা মতো হাদারাম একটা ছোট্ট কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। ইনকাম যদিও সামান্য তারপরও কাজ টা করে হাদারাম গর্ব অনুভব করলো। নিলাঞ্জনা তকে পরিশোধ করার শর্তে কিছু টাকা দিল। যদিও সে টাকা হাদারাম নিলাঞ্জনা কে পুরো পুরি পরিশোধ করতে পারিনি এখনও, কিন্তু হাদারামের মনের বিশেষ একটি শ্রোদ্ধার স্থানে নিলাঞ্জনাকে জায়গা করে দিল। হাদারাম উপলব্ধি করলো যে কাউ সাহায্য করতে হলে এমন ভাবেই সাহায্য করা উচিত, যেতে তার কর্মসংস্থান হয়। নতুন বা খাদ্যের জন্য ঋণ দিলে আজীবন ঋণ দিতেই হবে, দিতেই হবে কিন্তু তার অবস্থার পরিবর্তন হবে না। নিলাঞ্জনার পর্ব এখানে শেষ হইলেও প্রেরণা পর্ব শেষ হলো না। প্রেরণা তো হাদারামের একমাত্র বটবৃক্ষ। যে কোন বিপদেই হাদারাম প্রেরণার দ্বারস্থ হয়। আর প্রেরণা তাকে পূর্ণ করে দেয় চাহিদা সমূহ। প্রেরণার কাছে কোন কিছু চেয়ে হাদারাম খালি হাতে ফিরে এসেছে এমন নজির নেই। বরং যা চেয়েছে হাদারাম প্রেরণা তাকে পূর্ণ করে দিয়েছে তা দিয়ে অথবা তার চেয়ে বেশী দিয়ে। প্রেরণা হাদারামের মনে এমন ভাবে স্থান করে নিয়েছে যে হাদারারেম ধারণা বাঁচতে হলে একমাত্র প্রেরণার জন্য বাঁচতে হবে। নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রেরণায় হাদারাম যখন নতুন ভাবে বেঁচে থাকবার বড় আকংঙ্খা নিয়ে পথ চলতে শুরু করে ঠিক তখনই প্রেরণা অজানা এক অভিমান বুকে নিয়ে হাদারামের সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। হাদারামের জীবন হয়তো আগের মত অভব নেই। ডাস্টবিনের ধারে হয়তো খাদ্য কুড়াতে হয় না। কিন্ত প্রেরণা তার সবকিছু নি:স্ব করে হাদারাম কে মুক্ত করে দিয়েছে। হাদারাম এখন চির মুক্ত, তাকে শাসন করার আর কোন প্রেরণা নেই। হাদারাম গাড়ীর নীচে মাথা দেওয়ার যে শক্তিটা অর্পূণ ছিল সেটা বুঝি এবার পূর্ণ হবে। প্রভু শুধু দেয় আর কেড়ে নেয়। এবার হাদারামের আকুতি প্রভু যেন তাকে জীবন থেকে চিরমুক্তি দেয়। হাদারাম আর পৃথিবীর জোয়ার ভাটার খেলা দেখতে চায় না। সে এখন মুক্তি চায় চির মুক্তি। প্রেরণা যখন তাকে মুক্তি দিয়েছে। পৃথিবীও তখন মুক্তি দিয়ে দিক। হাদারামের চাওয়া প্রেরণা সুখে থাক, আর এমন হাদারাম যেন পৃথিবীতে আর জন্ম না নেয়। প্রভুর এই পৃথিবীতে এমন হাজারও হাদারাম মুখ লুকিয়ে আছে নিরব আঁধার বুকে নিয়ে। সকল হাদারাম মুক্তি পাক আর প্রেরণা সুখে থাক। 

গল্পঃ আলোর ছিঠি ।। এস আই জীবন



আলোর চিঠি 

যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি, সামাজিক এই ব্যাধিতে জর্জরিত সারা দেশ। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক মা বোনকে অকালে সুন্দর দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। প্রতিটি বিদায়ের সাথে লেখা ছিলো, লোভ লালসা আর হীনতার ভয়ানক গ্রাসের প্রতিক্রিয়া।সভা সমাবেশে রাস্তা ঘাটে হাটে বাজারে সকলেই যৌতুকের বিপক্ষে কেমন সাধুবাণী গেয়ে বেড়ায়, তবুও তার আড়ালেই সমাজের শিরা উপশিরায় চলছে যৌতুক আদানপ্রদানের কালো গ্রাস। সরকারের আইনের সাদা পাতায় কালো দাগে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যৌতুক নেয়া এবং দেয়া দুটোই অপরাধ। তার পরেও গোপনে বা প্রকাশ্যে চলছে যৌতুক আদান প্রদানের রমরমা লেনদেন। যৌতুকের প্রতি লোক দেখানো ঘৃণা বেশীরভাগ মানুষের। যৌতুকের প্রতি লোভ নেই এমন মানুষ সংখ্যায় অতি সামান্য।


বন্ধুদের মুখে শোনা, গাইবান্ধা জেলায় মেয়ের বিয়ের আগেই বাবারা মেয়েকে নিয়ে যতটা ভাবেন, তার চেয়ে বেশী ভাবেন যৌতুক নিয়ে। ধনী গরীব সবার মাঝেই শিরা উপশিরায় শক্ত শিকর গেড়ে বসেছে এই যৌতুক নামক ক্যান্সার। যৌতুকের জালে আটকে আছে বাংলাদেশ ভারত নেপাল সহ আরো বেশ কিছু দেশ। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে সবখানেই যেনো যৌতুক একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। যৌতুক নামক ক্যান্সারে অহরহ প্রাণ দিতে হচ্ছে মা বোনদের। দারিদ্র্য থেকে মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত সকল শ্রেণীর মাঝেই যৌতুকের  আদানপ্রদান বিরাজমান। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারা যেনো অসহায় একটা ভিন্ন জাতি। যৌতুক লোভী স্বামী বা শশুর পক্ষের ধারণা কন্যার পিতা এমন একটা ব্যাংক যে ব্যাংক থেকে চাইলেই টাকা উত্তোলন করা যায়, তার জন্য কোনো চেক বা জামানত অথবা একাউন্টের দরকার পরেনা। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কন্যাই যেনো রিজার্ভ ব্যাংকের একাউন্ট। ছেলের যোগ্যতা বা দুর্বলতাই হলো যৌতুকের চেক বই। ছেলে যত বেশী যোগ্যতাসম্পন্ন, যৌতুকের মাত্রাটাও ততোই বেশী।
হারুন গাজী, বাড়ি বরিশাল সদর থানার চরকাউয়া ইউনিয়নের চরকরঞ্জী গ্রামের সমাপ্তির একটু অগ্রভাগে। এ গ্রামের ৮০% মানুষ কৃষিকাজে জড়িত। আধুনিক কলের লাঙ্গলের পাশাপাশি সনাতনী পদ্ধতি এখনো চোখে পড়ার মতো। সকাল হলেই কৃষকের মাঠে যাওয়ার তাড়া অবাক করবে আপনাকে, এগ্রামের শিক্ষার হার ৮০% এর বেশী। হারুন গাজী কৃষিকাজের পাশাপাশি বাজারে একটা ছোট্ট দোকান দিয়েছে। দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে মোটামুটি সুখের সংসার তার। বড় মেয়ে আলো,  নামের সাথে তার রূপের কোনো বর্ণনা হয়না। এ গ্রামে সুন্দরী মেয়েদের তালিকা করা হলে তার প্রথম নামটাই দখল করবে আলো। তার মতো সুন্দর নম্র ভদ্র বিনয়ী মেয়ে এ গ্রামে আর এক জনও নেই। আলো যেদিন দুনিয়ার আলো দেখেছে, সেদিন থেকেই হারুন গাজীর সংসারে সুখের যাত্রা শুরু হয়েছে। কোনো কাজে কোনো পরামর্শ দরকার হলে হারুন গাজী তার মেয়ের সাথে বসে মেয়ের সাথে পরামর্শ করেন। আলো যেমন রূপবতী, তেমন বুদ্ধিমতী ও বটে।
    
মেয়ে যদি সুন্দরী আর সাবালিকা হয়, তাহলে ঘটকের আনাগোনা একটু বেশী থাকে। বেশ কয়েকটি প্রস্তাব আছে, ভালো পাত্রের হাতে মেয়েটি  তুলে দিতে সকল বাবাই চেয়ে থাকেন। কে ভালো আর কে মন্দ এমন দন্দ্বে ভুগেন সকল বাবাই, অবশেষরূপে ভাগ্যই নির্ধারণ করে ভবিষ্যৎ। 
শহর থেকে একটি পাত্রের সন্ধান নিয়ে সন্ধ্যা বাদে মালেক ঘটক হারুন গাজীর দোকানে। গরম চায়ের কাপে একটু ফুঁক দিয়ে ঠোঁট ভেজাতে ভেজাতে বললেন।
বাপু মেয়ে যখন বড় হয়েছে বিয়ে তো দিতেই হবে আজ দাও আর কাল দাও, এমন তো নয় আজীবন ঘরে রাখবে। এমন ভালো পাত্র হাতছাড়া হলে আর একটাও পাবেনা। কত পাত্রই তো দেখাতে চাইলাম সায় দিলেনা, মেয়ে এতো বেশী শিক্ষিত করে কি হবে। কদর থাকতেই বিয়ে দেয়া ভালো। পাশে বসা একজনকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসু ভাবেই বললো, কি বলো রমিজ, ঠিক কি না? রমিজ মাথা নাড়িয়ে ঘটকের কথায় সম্মতি জানালো, কে পাত্র কে পাত্রী তা না জেনেই, গ্রাম গঞ্জে এমনটা স্বাভাবিক। জন্ম থেকেই সবাই সবাইকে চেনা জানা। দেখে আসছে, মুরুব্বীদের কথায় সায় দেয়া এটাও একপ্রকার ভদ্রতা।
হারুন গাজী এতক্ষণ কিছুই বলেনি, এক কেজী আটা মাপতে মাপতে বললো,
মালেক চাচা, মেয়ে বিয়ে দেবোনা তা তো বলিনি, আলোর আই এ পরীক্ষা শেষ হলেই এ বিষয়ে চিন্তা করবো। আর মেয়েও এখন বিয়েতে সম্মতি দিচ্ছেনা। জোর জবরদস্তি তো বিয়ে সাদীর কাজে হয়না। মেয়ে শিক্ষিত হোক, সালাম মাস্টার প্রায়ই বলেন, শিক্ষিত মা পারে শিক্ষিত জাতী উপহার দিতে।
কি যে যুগ পড়েছে বাবা, মেয়ে আবার সম্মতি।
বলেই চায়ের কাপে শেষ চুমুক না দিয়েই একপ্রকার বিরক্তি অনুভব করেই চায়ের শেষটুকু রেখে ছাতা বগলে করে চলে গেলেন। মালেক ঘটককে কেউ কখনো ছাতা মুড়ো দিতে দেখেনি। এই ছাতা তার বগল বন্ধু বলা যায়। এই ছাতারও এক ইতিহাস আছে তা অন্য একদিন বলবো। আলোর পরীক্ষা শেষ, হারুন গাজী আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, পরীক্ষা শেষ হলেই মেয়ের বিয়ে দিবেন। শহরের ভালো পাত্র পেলে সবচেয়ে ভালো হতো। বিকেলে দোকানের সামনে দিয়ে মালেক ঘটক যেতেই আজ হারুন গাজী নিজে থেকেই ডাকলো। চাচা এদিক এসো তোমার সাথে কথা আছে।
ঘটক পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললো,
    কি কথা?
এবার ভালো একটা পাত্র দ্যাখো মেয়ের বিয়ে দেবো।
ঘটকের মুখে অনেক দিন পরে হাসি দেখা গেলো, খুশির স্বরে বললো। আমাদের আলোর জন্য পাত্র খুঁজতে হবেনা বাপ, পাত্ররাই লাইন দিয়ে আছে। ওপারায় একটু তাড়া আছে সন্ধ্যা বাদে আসবো।
ঠিক আছে চাচা, তো ছাতাটাকে বগলে চেপে আর কতো কাল কষ্ট দিবেন, রোদের তাপ তো মাথায়, ছাতাটা মেলে রোদ ঠেকান। হারুন জানে তার কথায় সে ছাতা মেলে মাথায় ধরবেনা। ঘটক আকাশের দিকে তাকিয়ে ফের চলে গেলো।
এশার নামাজ শেষে দোকান বন্ধ করবে ঠিক এমন সময় মালেক ঘটকের কণ্ঠস্বর, 
দোকান বন্ধ করবে নাকি হারুন। কাস্টমার নাই, কি করবো চাচা।
বিকেলে পাত্রের কথা বলেছিলে, ভালো একটি পাত্র আছে,  সত্যিই কি আলোর বিয়ে দিবে? তোমার তো মতের ঠিক নাই বাপু।
হ্যাঁ চাচা বিয়ে দেবো,
তোমার মেয়ে তারা অনেক আগেই দেখেছে, তাদের অনেক আগেই পছন্দ করা, তুমি আগে আমার সাথে গিয়ে ছেলের খোঁজখবর তাদের পারিবারিক অবস্থা দেখবে। ছেলের বাবার অঢেল সম্পত্তি। একটাই ছেলে টাকা পয়সার অভাব নাই। তোমার মেয়ে মাশাল্লাহ সুখেই থাকবে। তুমি গোপনে আগে দ্যাখো বাদে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেখবে।
     
ছেলে পক্ষের বিশাল অবস্থা দেখে প্রথমে না মত দিয়েছিলো,  পরে ভাবলো রূপে গুণে জ্ঞানে আমার মেয়ে কারো চেয়ে কম নয়, এ বাড়িতে বিয়ে দিলে মেয়েটা বেশ সুখেই থাকবে।
উভয় পক্ষের আনুষ্ঠানিক দেখাশোনার পরে এলো লেনদেনের পর্ব। ছেলের বাবা বললো,
যা দিবেন আপনার আলো আর পলকেরই থাকবে। মা মণির সাথে ৫ ভড়ি স্বর্ণ আর পলককে একটা মটর সাইকেল। আনুষঙ্গিক  যা পেতে পারে। পলক বলেছিলো ইতালি যাবে, যখন যাবে তখন যদি লাখ পাঁচেক টাকা দিয়ে উপকার করতে পারেন। তাহলে ভালো হতো, পান চিবুতে চিবুতে আবার বললো, আজকাল যা দিন পড়েছে বেয়াই, যৌতুকে সব ছেয়ে গেছে।আমি এসব যৌতুকের মধ্যে নেই। যৌতুককে আমি বড্ড ঘৃণা করি। এটুকু তো আজকাল একটা ছেলে পেতেই পারে কি বলেন!  ঘটকের দিকে তাকি হাস্যমুখ করে বললো পলকের বাবা।
পলকের বাবার কথা শুনে হারুন গাজীর মস্তিষ্ক হিসাব কষতে শুরু করেছে। এতক্ষণ যে উজ্জলতা ছিলো তা মলিনতায় ছেয়ে গেলো কিছুটা।
পলকের বাবা লক্ষ্য করলো বিষয়টা, অভয় দিয়ে বললো,
বেয়াই এতো ঘাবড়ে যাবার কি আছে, আপনি যদি না চান তো কিছুই দিতে হবেনা। আপনার সাধ্যমত যা পারেন তাই দিয়েন।
বেশ আনন্দ আয়োজনের মধ্যদিয়ে আলোর বিয়ে হয়ে গেলো, আপন ধানি জমি বিক্রি করে স্বর্ণালংকার মোটর সাইকেল দিলো আলমারি শোকেজ থেকে সব কিছু। নিজের পারিবারিক দুর্বল অবস্থা যেনো শহুরে মানুষ বুঝতে না পারে।  তার জন্য কোনো কিছুর কমতি রাখেনি। মেয়ের সুখের জন্য অনেক টাকা ঋণ করতে হয়েছে। মেয়ের সুখের কাছে, আপন ঋণের বোঝা মোটেই ভারি নয়। বাবারা কখনো নিজের সুখের কথা ভাবেনা, তারা সব সময় মেয়েদের সুখেই বেশী সুখী।
আলো শশুড় বাড়ীতে পা রাখতেই সবার দৃষ্টি আলোর অলংকারের দিকে, কেউ কেউ হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বলছে।
এগুলো খাঁটি স্বর্ন তো। নাকি সিটি গোল্ড!
একজন মায়ের বয়সী মহিলা,হাতের বালা স্বর্ণকারের মতো পর্যবেক্ষণ করে ঠোঁট ভেঙচি কেটে বলতে লাগলো, এতো পাতলা কেউ আজকাল মেয়ের সাথে দেয়।
কেউ একবার বললোনা তোমরা মেয়েকে কি দিয়েছো,
আলো বোবা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে অশ্রুতে, ঘোমটার আড়ালে কেউ দেখছেনা। এই প্রাসাদে প্রথম পা রেখেই আলো বুঝতে পারলো।  তার চেয়ে তার অলংকার বেশী মূল্যবান। 
কেউ একজন পাশ থেকে বলেছিলো,
ঘরের বৌকে কি দরজায় দাঁড়িয়ে রাখবেন। এমন ভাবে দেখা শুরু করেছেন যেনো আগে কখনো দেখেননি।
কিছুটা কর্কশ ভাবে শব্দগুলো আলোর কানে এসে বাজলো, রাগে নাকি প্রতিবাদের শব্দ তার কিছুই বুঝতে পারলোনা। 
অলংকার নিয়ে যাদের এতো গবেষণা,  তারা বেশ লজ্জা পেলো, কিন্তু একটু দূর থেকে ভেসে আসা প্রতিবাদী কন্ঠের উপরে কেউ কথা বলার সাহস পেলোনা। আলোর ইচ্ছে হচ্ছিলো তার মুখটা একবার দেখার। আলো ভাবলো,  মেয়েদের বিয়ে হলে হয়ত তারা এভাবেই দেখে শহরের মানুষে, আমাদের গ্রামের বাড়িতে নতুন বৌ এলে আগে দেখে বৌয়ের মুখ, আর শহরে কি আজব নিয়ম। তারা আগে দেখে বৌয়ের সাথের অলংকার।
আলোর বিয়ের বয়েস ৬ মাস হতে চললো। একদিন রাতে খাবার টেবিলে শশুর প্রথম সুর তুললেন।
পলকের বিদেশ যাবার ভিসা তো রেডি,  তোমার বাবাকে বলো ৫ লাখ টাকা দিতে। এখন খুব উপকারে আসবে। বিয়ের সময়ই অবশ্য বলে রেখেছিলাম। বেয়াই দিতেও সম্মতি জানিয়েছেন। ধার হিসেবেই দিবেন, পলক ইতালি চলে গেলে বাদে বেয়াইকে ফেরত দিয়ে দিবে পলক।
আলো অতি ধীর স্বরেই বললো,
বাবা এতো টাকা কোথায় পাবে? আমার বাবার কি আছে না আছে তা আপনারা ভালো করেই জানেন।
শাশুড়ি শশুড়ের দিকে তাকিয়ে চোখ লাল করে বলতে লাগলেন,
দেখেছো,  বাবার জন্য কতো দরদ বৌয়ের।
শশুর আর কিছুই বললো না, চুপ করে রইলেন। পলকও চুপচাপ খেয়ে বাইরে চলে গেলো।
অনেক রাত করে বাসায় ফিরলো পলক, মুখ থেকে বিশ্রী মদের গন্ধ। মদের গন্ধ এই প্রথমবার আলোর নাকে প্রবেশ করলো, আলো জানেনা এটা মদের গন্ধ। আলো বিছানার চাদর গোছাতে গোছাতে বললো। কি খেয়েছো?  এতো বিশ্রী গন্ধ কিসের।
আলোর চোখের দিকে ভয়ংকরী ভাবে তাকিয়ে বললো,
বন্ধুদের সাথে রস খেয়েছি।
পলকের কথার অস্বাভাবিকতায় বুঝলো, সে মদ খেয়েছে। নয়তো অন্য কোনো নেশা করেছে।
এসব বাজে জিনিস আর কখনো খেওনা।  এসব খাওয়া ভালো নয়।
চুপ চুপ একদম চুপ। ভালো মন্দ আমাকে শেখাতে এসোনা। কালকেই তুমি তোমার বাবার বাড়িতে যাবে। গিয়ে টাকার কথা বলে আসবে।। এমাসের মধ্যেই আমার টাকা চাই- বলতে বলতেই, পলক বিছানায় ঢলে পড়লো।
১৫ দিন বাদে, হারুন গাজী মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ির দরজার দিকে যাচ্ছিলেন। পূর্ব আকাশ তখন রক্তিমা বিছিয়ে ছিলো, সূর্য তখনো অপ্রকাশিত। এতো সকালে আলোর একার আগমন দেখে কিছুটা অবাক হলেন, বাবা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
কিরে... কেমন আছিস মা, এতো সকালে তুই একা। জামাই বাবাজী এলো না। কি হয়েছে।
যেমন দোয়া করেছো বাবা, তেমনই আছি তার চেয়ে ভালো থাকি কি করে?
মেয়ের কথার মাঝে যে অনেক রহস্য তা বাবার বুঝতে বাকি রইলোনা। তবুও বিস্তারিত জানার আগ্রহে বললো। 
কি হয়েছে আমায় খুলে বল।
ঘরে চলো।
এতো সকালে মেয়েকে দেখে মা খুশি হলেন ঠিকই তার মাঝে বেশী অবাক হলেন। মেয়ের একার আগমনে।
বাবা মা দুজনেই আলোর সামনে বসে আছে। জানার অপেক্ষায়, যে মেয়ের মুখে সবসময় হাসি ছড়াতো সেই মেয়ের মুখ আজ মলিন।
আলো বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো।
আমি কি তোমাদের ঘাড়ে এতো বড়ই বোঝা ছিলাম যে আমাকে জাহান্নামে ঠেলে দিয়েছো?
এভাবে বলছিস কেনো,  কোনো সন্তানই তাদের বাবা মায়ের ঘাড়ে বোঝা হয়না।
বাবা, আমি কি বলেছিলাম তোমার জায়গাজমি বিক্রি করে আমাকে বড়লোক ছেলের কাছে বিয়ে দিতে?
বাবা কতক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন।
মা,  যা করেছি সবই তোর সুখের জন্য।
আমার সুখের জন্য! আমার সুখ। এখন আরো ৫ লাখ টাকা দাও। ৫ লাখ টাকা নিয়ে যেতে বলেছে।  টাকা ছাড়া বাসায় গেলে ওরা আমার সাথে অনেক খারাপ ব্যাবহার করবে।
বাবা, তুমি যৌতুক দিবেনা পণ করেছিলে কিন্তু যৌতুকের বিকল্প দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে গেলে।
বাবা, শুধু বললো, মা তুই চিন্তা করিস না। আমি এখনো বেঁচে আছি।
আলোর গালে কপালে নির্যাতনের চিহ্ন দেখেই বাবা বুঝে নিলেন তার আদরের আলো কতোটা সুখে আছে।
আলোর সারা দেহ জুড়ে যে অত্যাচারের নির্মমতা কাপরে আড়াল করা আছে।  যার যন্ত্রণা আলো লুকিয়ে রেখেছে। তা প্রকাশ করলে বাবা হয়ত সহ্য করতে পারবেনা।
   
বাবা আবারো ধার দেনা সুদের উপরে মোট তিন লাখ টাকা এক সপ্তাহ বসে যোগাড় করলেন। উদ্দেশ্য শুধু মেয়ের একটু সুখ। টাকা সাথে করে নিজেই মেয়েকে নিয়ে গেলেন মেয়ের শশুরের বাসায়। পলকের বাবার হাতে তিন লাখ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে পলকের আবার হাতে ধরে বললেন, আমাকে আর দু মাস সময় দিন বেয়াই সাহেব। দু মাসের মধ্যেই বাকি দু লাখ টাকা যেভাবেই হোক দিয়ে যাবো। আলোর উপরে কোনো অত্যাচার করবেন না।
আলোর শশুড় টাকা পেয়ে একঝলক হাসি দিয়ে বললো। আলো আমাদের মেয়ের মতো ওর উপড়ে কেনো অত্যাচার করবো। কি যে বলেন বেয়াই। আলো আমাদের ঘরের লক্ষ্মী।  ওরা স্বামী স্ত্রী হয়ত একটু ঠুলামুলি করেছে।  তাই আলো রাগ করে বাড়িতে চলে গেছে, আমি ভাবলাম অনেকদিন পরে যখন গেলো কয়েকদিন বেড়াক,  বাদে গিয়ে নিয়ে আসবো,  তা তো আবার আপনিই নিয়ে আসলেন। কি বলবো বেয়াই। আজকালকার ছেলে মেয়ে বাবা মায়ের কথা শুনে ক জন?
আলোর বাবা আর বেশি কিছু বললেন না, শুধু বললেন।
তাহলে এখন আসি বেয়াই, গিয়ে আবার দোকান খুলতে হবে।
দু মাস না যেতেই একদিন খবর এলো, আলো গলায় ফাঁশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। বাবার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।  বাবা বুঝতে পারলো এটা আত্মহত্যা নয়। এটা হত্যা। কিন্তু কেনো? অনেক প্রশ্ন এসে জটলা পাকাচ্ছে বাবার ভারি
বুকের ব্যথার সাথে। বাবা খবর পেয়েই ছুটে গেলেন বরিশালে। বাসায় পৌঁছানোর আগেই পুলিশ লাশ নিয়ে চলে গেছে ময়নাতদন্তের জন্য। বাবা সব কিছুই অনুমান করে বুঝে নিলেন। পলকের বাবাকে কিছুই আর জিজ্ঞেস করেননি। তিনি ভাবলেন ময়নাতদন্তে সঠিক অথ্য বের হয়ে আসবে। তখন তিনি আইনি ব্যবস্থা নিবেন। কিন্তু কি আজব। লাশের ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলছে আত্মহত্যা করেছে আলো। কিন্তু কেনো আত্মহত্যা করেছে তার কারণ কেউ জানেনা। বাবা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার বাকশক্তি রুদ্ধ হয়ে এলো। আলোর বাবা তার জীবনে কোনো দিন থানার দরোজায়ও যাননি, আর মামলা তো অনেক দূরের কথা।
আলোর লাশ দাফন করা হয়েছে তিনদিন হলো, বাবা মায়ের মুখে এখনো কেউ দানাপানি দিতে পারেনি। শোকের ছায়ায় অন্ধকার হয়ে আছে সবকিছু। প্রভাত কেটে ঝলমল করছে প্রকৃতি। ডাকপিয়ন তার সাইকেল নিয়ে কিছুটা তাড়া গতির মতোই থামিয়ে বললো,
হারুন চাচা, আলোর চিঠি আছে।
 সকলেই যেনো অবাক, আলোর চিঠি! ভুল ঠিকানা নয়তো?
 হারুন গাজী কান্না জড়িত ভাবেই বললো। বাবা আমাদের আলো তো নেই, চিঠি লিখবে কে!
চাচা এ চিঠি আরো দশদিন আগের।
দেখিতো।
চিঠিটা বাবার হাতে দিয়ে ডাকপিয়ন চলে গেলো। বাবা উৎসুক হয়ে পড়তে লাগলেন পত্রটি।
এলাহী ভরসা,
বাবা, আমার সালাম নিবেন। আশা করি আল্লাহতালার অশেষ রহমতে আপনারা সবাই ভালো আছেন। আর আমি, আমিও একপ্রকার ভালো আছি বাবা।
   
    পর সমাচার,
বাবা, সেদিন সকাল বেলা যখন আপনি আমাকে দেখেছিলেন। তখন আমার সারা শরীর জুড়ে ছিলো বেতের লাঠির অসংখ্য আঘাত। সারা রাত আমি ছিলাম বাসার দরোজায়, পলকের একটাই কথা ছিলো, টাকা নিয়ে বাসার ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। পলকের বাবা মায়ের নিরবতায় বুঝেছি তাদের ইন্দোনেই আমার উপর এমন অত্যাচার নির্যাতন চলছে। আপনি তিন লাখ টাকা দিয়ে যাবার চারদিন পর থেকে আবার আমার উপরে বাকি দু লাখ টাকা নিয়ে আসার জন্য আমার উপরে চাপ প্রয়োগ করে, আমি শুধু এটুকু বলেছিলাম, তোমাদের এতো সম্পদ থাকার পরেও কেনো পরের টাকার উপরে এতো লোভ। এ কথা বলতে না বলতেই আমার উপর ঝড়ের বেগে নেমে আসে নির্যাতন। বাবা আমি যে এবাড়ির কে, কেনো আমাকে এখানে আনন্দ আয়োজন করে আনা হয়েছে তার উত্তর আজো পাইনি। গত তিনদিন ধরে নাহারে পরে আছি কেউ একবার জিজ্ঞেস করেনা, আমি খেয়েছি কিনা। নম্র ভদ্র মুখোশ পরা যে মানুষ গুলোর প্রশংসা করো সেই মুখোশের আড়ালে এক একটা হায়েনা বসত করে। পলক একটা নেশাখোর মাতাল, দেখে শুনে তোমরা আমায় নরকে পাঠালে বাবা। পলক প্রতিদিন আমায় বলে,  ' মরিস না ক্যান হারামজাদি। হয়তো মরে যা নয়তো তোর বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আয়' বাবা আমি পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি, আমি আর টাকার জন্য বাবার কাছে যেতে পারবোনা। আমাকে যদি ওরা মেরে ফেলে, আমার লাশটা আপনি এসে নিয়ে বাড়িতে কবর দিবেন। আবিদ যেনো আমার লাশটা তার নিজ হাতে কবরে রাখে। এটাই আমার শেষ অনুরোধ।
আর একটা কথা বলি বাবা, আমাদের গ্রামের আবিদ আমায় খুব ভালোবাসতো, কিন্তু আমি কখনোই ওকে পাত্তা দিতাম না।  আমি কখনই চাইনি আমার কোনো কাজে বা সিদ্ধান্তে আপনার উঁচু মাথা নিচু হোক, আমি মনে মনে ওকে ভালোবাসতাম। এই দুনিয়াতে একমাত্র আমি ছাড়া আর কাউকেই সেটা বুঝতে দেইনি। ওর সাথে আমায় বিয়ে দিলেও আপনার এতো বড় ক্ষতি হতোনা। পলকের অত্যাচারে নির্যাতনে আমি বুঝতে পারছি। আমার চারদিক খুব শিঘ্রই অন্ধকারে ঢেকে যাবে।
ইতি,
আপনার আদরের আলো


বাবা পত্রটি পড়ে বাবা অজ্ঞান হয়ে উঠোনে পরে গেলেন। বিকেলে যখন বাবার জ্ঞান ফিরলো, তখন বাবার কন্ঠ থেকে শুধু প্রকাশ হলো, আমার আলো আত্মহত্যা করেনি, আলোকে মেরে হত্যা করা হয়েছে। আলোর পত্রের খবর সারা গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। প্রতিবাদ প্রতিশোধের আগুনে ফুলকে উঠলো গ্রামের সবাই। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর বিচার চায় গ্রামবাসী।  এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে থানায় উপস্থিত আলোর বাবা।
আলো হত্যা মামলায় যাদের আসামী করা হয়েছে তাদের নাম শুনেই চমকে উঠলো থানার দারোগা। দারোগা জিজ্ঞেস করলো, এ আস্বামীরা কি জীবিত নাকি মৃত? আসুন আমার সাথে। থানার সামনেই ক্ষতবিক্ষত তিনটি লাশ পরে আছে, লাশ তিনটি ছিলো, পলক, পলকের বার আর পলকের মায়ের। রাতে অজ্ঞাত খবর সূত্রে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ একই পরিবারের লাশ তিনটি উদ্দার করে। পুলিশের ধারণা তাদের ব্যবসায়ীক জেরেই প্রতিপক্ষ এমন হত্যাকান্ড করেছে। আলোর বাবা লাশ তিনটির দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন। আল্লাহ্‌ বিচার করেছেন। 
চার যুগ বাদে আলোর বাবা যখন বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু শয্যাগত। তখন আবিদ আলোর বাবাকে একবার দেখতে এলো,  আলোর বাবা আবিদের দিকে তাকিয়ে বললো, চিরকুমার ই থেকে গেলি বাবা।
আলোর বাবার কানে কানে আবিদ বলেছিলো। আলো হত্যার প্রতিশোধ আমি নিয়েছি। দেহ আলাদা হলেও ভালোবাসা কখনো আলাদা হয়না কাকা, পরম শান্তির একটা নিঃশ্বাস নিলেন আলোর বাবা। আস্তে করে অস্পষ্ট কিযেনো বলেছেন আবিদের দিকে তাকিয়ে। হয়ত বলেছেন; ভালোবাসার জয় হলো। জয় হোক ভালোবাসার।
   
  ( সমাপ্ত)
      
     ১৮-১-২