বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮

গল্পঃ বিরাঙ্গনার সন্তান ।। রওশন রুবী


বীরাঙ্গনার সন্তান 

  
 
হাসপাতালের কেবিনে ঢুকেই আলী উল দেখে বড়মামা শিশুর মত ঘুমাচ্ছেন বকের পালক রঙা বিছানায়। বড় মামার বন্ধু হাসমত আলী সাহেব এক কোনে সোফায়   চুপচাপ বসে আছেন। যার স্নেহের পরশ এখনও মাথায় লেগে আছে আলী উলের। তাঁর বৈঠকখানায় সেবার বসেছিল মামার পাশে। অনেক জানাশুনা তাঁর, সেই সুবাদে মামা চেয়েছিল যদি আলী উলের মাকে খুঁজে পাওয়ার কোন পথ বের করা যায়? যেতেই শুনে হাসমত আলী সাহেব বৈঠকখানায় উপস্থিতিদের বলছেন - দেশে কি যে চলছে। কিছুই তার ঠিক ঠিকানা নেই। যার যেমন লুটেপুটে খাচ্ছে। আমরা দেখছি আর আঙুল চুষছি।  যেই দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে লড়েছিলাম।  সেই দেশে ছেয়ে গেছে কুটিল জটিল লোকজনে। আগুনে ঝলসে দিচ্ছে মানুষদের। পথে ঘাটে আতঙ্কিত মানুষের চলাচল। জানমালের একপয়সা নিরাপত্তা নেই।  এই দেশে মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে প্রকৃতজনদের খুঁজে পাওয়া মুসকিল হবে। শত্রুদের আবার কি তাড়াতে হবে রুহুল? আবার কি অস্ত্র হাতে নিতে হবে? আলী উলের মামার দিকে চেয়ে রইলেন কথাগুলো বলে। আলী উলের মামা রুহুল আমিন বলেন
-  তাইতো দেখছি।  প্রয়োজনে আবার তাড়াব ওদের। আবার তুলে নিবো অস্ত্র।  অস্তিত্ব যদি বিলুপ্ত হয় তবে  কি থাকবে বাঙালির?  যদি এখন হাঁটুর উপর প্যান্ট  তুলে দাগটা দেখিয়ে দেই পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ছোড়া গুলির দাগটা। যদি হাসমত আলীর পাজামা নামিয়ে পেছনটা দেখাতে পারত তবে কিছুটা হলেও বুঝতে দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে কি গভীর ক্ষত পেয়েছে দেশের প্রকৃতজনেরা এবং তা কতটা যন্ত্রণাময় ছিল। কিড়া পড়ে ছিলো পর্যন্ত সেই ক্ষতে। একদিন তো যন্ত্রণা সইতে না পেরে দা গরম করে কোমরের ক্ষতের মধ্যে লাগিয়ে আজরাইলের থাবায় পড়ে দ্বিতীয়বার মরতে মরতে বেঁচে গেলেন হাসমত আলী। আজো শিউরে উঠি কতো খান্নাশ ছিল সেইসব মানুষ, কত নাফরমান বেইমান ছিল। নিজ জাতি ধর্মের মানুষের সাথে এমন কুকর্ম, এমন পিচাশের মত আচরণ করে কেউ? অথচ তারাও জ্ঞানী ছিলো, কোরআন পড়ত, কোরআনের তর্জমাও জানতো। বিদায় হজের ভাষণ সম্পর্কেও কম জানতো না। তারা কিন্তু তাদের কার্যকলাপে জাহেলিয়া যুগকেও হারমানিয়েছে। আসলে তারা ছিলো জ্ঞান পাপী, ইয়াজিদের গোষ্ঠি। দয়া মায়া বুদ্ধি বিবেচনা বলতে কিছুই ছিল না তাদের। এর মধ্যে একজন বলে উঠলো
-  ওদের বিরুদ্ধে মামলা কইরে দেই এলাকাবাসীরা? ওরা স্বায়ধীনতার শত্রু, যুদ্ধ অপরায়ধী হইয়েও দিব্বি বুক ফুলাইয়া ঘুইরে বেড়ায় । দেইশপ্রেমিক, সায়ধারণ মানুষের উয়পর অত্যাচার কয়রে।  ভিন্ন ধর্মের মায়নুষদের অত্যাচারে অতিইষ্ঠ কইরে তুইলছে। গাড়ি, ঘরবাড়ি, দোকান পাট জ্বালায়ে দেয় আইজো। মাইয়ারা ঘরের বাইরে হবার পারে না।  আয়সলে এইদের বুক পিঠ নাই। ডাণ্ডার ঘা পইড়লে আর জয়নসাইধরণের লাত্থিউষ্টা খাইলে ঠিক হইয়া যাইবো বেইমানেরা। নায়মে মুসলমান। আরেক জন বলে
-   এতো ভাবা ভাবির কাম নাইক। হেরা কোন কামই ঠিক কয়রে নাই। চইলেন থানায় যাই । হাসমত আলী স্নেহের গলায় থামালেন ঐ ব্যাক্তিকে।  বললেন
-   আরে বাবা প্যাটপ্যাট না কইরে ভোট নে সবার থেকে। কে কে মামলা করার পক্ষে । তোরা তরুণ। তোগর দিকেই তো এখন সমাজের সব কাম চেয়ে থাকবে। মামলা দিতে কয়জন চায় দেখি। প্রায় সবাই হাত তুলল। বাড়ির ভেতরে খবর পাঠালেন  রান্না করতে। মজলিসে বললেন আপনেরা আজ দু'টো ডাল ভাত খেয়ে যাবেন। আমার নাতি আসছে। ওর ওছিলায় খাইবেন। আর ওর মায়ের জন্য দোয়া করবেন। সে নিরুদ্দেশ হয়েছে। আলী উলের কচি মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন সরলতায় ভরা। ও একজন বীরাঙ্গনার সন্তান। তার জন্ম নিয়ে সন্দেহ করবার কিছু নেই। সরল রেখার চেয়েও সরল তার জন্ম কথা। আলী উলের চৌদ্দ বছরের চোখ মজলিসের সবার মুখকে দর্শন করে।  ওর ঘন লোমে ঢাকা ভ্রু আর মসৃন বুক কাঁপে। সেই কাঁপন দেখে মনে হয় সত্য কখনও কখনও যুদ্ধের চেয়ে ভয়াবহ। আলী উলের রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। ওর বোধে উপছে পড়া কষ্টের   পরিমান কম নয়। সেই উপলব্ধি কতটা প্রগাঢ় ও মৌলিক তা তার শিরা উপশিরা জানে। আর বুঝি জেনে ছিলেন হাসমত আলী। তাই তিনি প্রশান্তির ছায়া দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আলী উলকে। তার বুকে ওর মাথাটা আশ্রয় পেয়ে হেলে থাকে বেশ কিছু সময়। এবয়সেই আলী উল বুঝেছে বীরাঙ্গনার সন্তানেরা সমাজের ডাস্টবিন। ওদের দেখলেই গন্ধ বেরুক আর না বেরুক নাকে রুমাল চেপে সরে যায় মানুষ। ঘৃণা পেয়ে বেড়ে উঠে তারা।  যেখানে যায় সেখানেই তারা দেখে মানুষের নিঠুরতা, ঘৃণা, অবহেলা। যেন যুদ্ধের সময় তারাই আর্মি ছিল, আর বিভৎস নির্যাতনের পর হত্যা করেছে অগণিত মা, বোনকে। যেন দিনের পর দিন নির্বিচারে হত্যা করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের।

সেই ছোট বেলা আলী উলকে ফেলে রেখে নিরুদ্দেশ হয়েছেন লজ্জা, ঘৃণা, ক্ষোভে, দুঃখে তার মা। হাঁটতে শেখা , চলতে শেখা ছিল তার কম বেশি অনাদর অবহেলায় মামার বাড়িতেই। ছোট ও মেজ মাসী ছিলো সহোদরা। তাই তারা মিল করেই যেন অবেহেলাগুলো করতো আলী উলের প্রতি। সেই অসহনীয় অবহেলা মামাদের সামনে কখনোই প্রকাশ করতো না সে। মামারা তাকে যথেষ্ট ভালোবাসতো। তারা ঐসব জানতে পারলে মামীদের সাথে হয়তো খারাপ আচরণ করবে। তাই সব হযম করেই বেড়ে উঠেছে সে। বড় মামা এবং তার পরিবার ছিল ভিন্ন। ভিন্ন হলেও তাদের কাছে থাকা ছিল অসম্ভব। কারণ বড় মামা একজন রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে আহত হওয়াতে তাঁর শারীরিক অক্ষমতার জন্য কোন কাজ করা তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক মানুষ জনের মতো নয় বলে। একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন। যার আয় দিয়ে কোন ভাবে তাঁর সংসার চলে। সেই সংসারে বাড়তি একজন মানুষ সত্যি অবিচার করা হবে। মামা তবু মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে যায় । মামীও খুব যত্ন করে তখন তার সামর্থ্য অনুযায়ী । একটা যুদ্ধ একটা জাতির কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নেয়। আলী উলের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তার মাকে। পরিবার হয়না কোন বীরাঙ্গনার। আলী উলের মাও পরিবার পায়নি। গতকাল ভোরে আলী উল বাজারে বটগাছের শিকড়ে বসে মনের সুখে গান গাইছিল আর কুড়িয়ে আনা বকুলগুলো এ হাত থেকে ও হাতে নিচ্ছে, নাকের কাছে ধরে সুবাস নিচ্ছে এমন সময়  দোকানী রাহাত এসে বললো " ফোন এসেছে। " অবাক হয়েছে আলী উল। তবু ছুটলো ফোন দোকানের দিকে। ফোনে বড় মামার অসুখের খবর পেয়ে ঢাকায় এসেছে। তবে মামাকে দেখে আজই ফিরতে হবে আগামী পরশু ষোল ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এইবার অন্যরকম ভাবে পালন করার কথা গ্রামের যুবকদের দিবসটি। হয়ত সেই প্রোগ্রামের আয়োজন করছে যুবকেরা। তারা তার উপস্থিতি টের পেলে যথেষ্ট অপমান করবে তাকে। তবু স্মৃতিসৌধের একটু দূরে ঝোঁপের আড়ালে বসে প্রস্তুতি থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সব দেখবে আলী উল। তার এই ইচ্ছে পূর্ণ  হবে কিনা এখন সে সন্দিহান। প্রতি বছর এই দিনে  বিশিষ্টজনেরা যখন বক্তৃতায়  মহান মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলে, যখন তাঁরা বীরাঙ্গনাদের কথা বলে। বলে বীরাঙ্গনারাও মুক্তিযোদ্ধা। তখন গঙ্গার স্নান করে উঠে আসা মানুষের মতো পবিত্র লাগে তার। আর সেসময় ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমি বীরাঙ্গনার ছেলে। দেখুন দেখুন আমি বীরাঙ্গনা ছেলে। কিন্তু পারে না পর মুহূর্তে ওদের কন্ঠ যখন ঝাঁঝালো হয়ে উঠে। যখন তারা সেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে " ঐসব হারামির বাচ্চারা তাদের যে বীজ রেখে গেছে সেই বীজ থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে কুকুরেরাই কুকুরের  জন্মদাতা হয়। ঐ কুকুরদের বীজ কুকুরই হবে। ওদের দেখলেই বয়াবহ যুদ্ধ সময় স্থির হয়ে যায়, মনে পড়ে যায় সেই জ্বলন্ত গ্রাম, শহরের ছবি। মা মেয়েকে চুলের সাথে বেঁধে বাবার ছেলেকে ধর্ষণ করতে বলা। তারা অস্বীকৃতি জানালে নির্দয় ভাবে তাদের সামনে ধর্ষণ ও পরে ওদের হত্যা করে মেয়েদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া। মায়ের কোল থেকে শিশুকে নিয়ে উপর দিকে ছুঁড়ে ফেলে ব্রাসফায়ার করে শিশুর ছিন্ন ভিন্ন দেহের টুকরোর দিকে তাকিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠা ।  ওদের নিঃসংশতার কথা মনে হলে গা শিউরে উঠে কোটি কোটি উদাহরণ আছে এমন নিসংশতার । ইয়াহিয়া তার পোষাকুত্তা আর্মিদের বলেছেন "যে ভাই হয়ে ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করে এমন বাঙালিদের সত্য পথে আনার জন্য যতো পারো সুসন্তানের জন্ম দাও।" সেই ইয়াহিয়ার জঘন্যতম নির্দেশের নির্মম স্বীকার আমাদের মা বোনেরা। তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা । আর সেই পাকির জারজ সন্তানদের প্রতি ঘৃণা। উপস্থিতির মধ্যে এ কথার পক্ষে বিপক্ষে গুঞ্জন উঠলেও জোরালো হয়না। তখন শুধু মনে হয় এই পাপ জন্ম থেকে মুক্তি পাওয়া দরকার। এই পৃথিবীর কেউ এই জীবনকে চায় না। এই পৃথিবীর সব অবহেলা অবজ্ঞা শুধু তার মতো সন্তানদের জন্য। যারা কোন দিনই পরিচয় পায় না মানুষের । তারা সমাজ পায় না। পরিবার পায় না। পায় অবহেলা আর অবহেলা। তাদের বেঁচে থাকার কি প্রয়োজন ? কিন্তু আলী উলের মৃত্যুর আগে সেই দুঃখীনি মাকে দেখতে ইচ্ছে করে। তার মন বলে মা ফিরে আসবেই। মা দেখতে আসবেই তাঁর সন্তানের ঘৃণ্য অবস্থান। ঝোঁপের আড়াল থেকে স্মৃতিসৌধকে তার মায়ের মতো লাগে। কতো গভীর রাতে এই স্মৃতিসৌধের ধূলিমেখে মনে প্রশান্তি পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতো যে সে বীরাঙ্গনার সন্তান।

বাড়ি যাওয়া হলো না রুহুল মামার অবস্থা বাড়াবাড়ি হওয়ার কারণে আলী উলের। কালই ষোল ডিসেম্বর। এখানে কোথায়আছে স্মৃতিসৌধ কে জানে। কাউকে জিজ্ঞেস ও তো করা যাবে না। যদি গ্রামের মানুষের মতো এরাও আলী উলকে কটাক্ষ করে? তবে হাসপাতালে এসেছে অব্দি কেউ তাকে বাঁকা চোখে বা ঘৃণার চোখে দেখেনি সে লক্ষ্য করেছে। যে যার মতো ছুটছে। কারোরই ভ্রুক্ষেপ নেই কোথায় বীরাঙ্গনার সন্তান পড়ে আছে আর কোথায় পড়ে আছে সুস্থ পরিবারের সন্তান । যে যার মতো ছুটছে। এই এতো বছরে দুটো রাত একটা দিন বেহেস্তি সুখে কাটে আলী উলের। কিন্তু কাল সকালে কি করে সে সেই স্মৃতিসৌধের কাছে যাবে? দূর থেকে হলেও মাকে দেখবে? ভাবতে ভাবতে জল গড়ায় চোখ দিয়ে । সেই জল বুকের ভেতর সমুদ্রের মতো ঢেউ তোলে আর হুহু করে বাড়তে থাকে বেগ। এখানেও ভেসে আসছে যুদ্ধের গান, বিজয়ের গান, সর্বহারার গান। এখানের মানুষেরাও নিশ্চয় সম্মান জানায় সে সব বীর এবং বীরাঙ্গনাদের। ষোল ডিসেম্বর গভীর রাতে ক্লিনিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুলের তোড়া হাতে রাস্তায়  মানুষের ঢল নামতে দেখে আলী উল। তারও ঐ শোভাযাত্রার সাথে যেতে ইচ্ছে করে। ওরা নিশ্চয়ই কোন না কোন স্মৃতিসৌধের দিকে যাচ্ছে। রুহুল মামা বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। মনটাকে আর ধরে রাখতে পারে না আলী উল। সে নিচে নেমে যায় । দারোয়ানকে অনুরোধ করে গেইট খুলে বেরিয়ে পড়ে। একটা শোভাযাত্রার একটু দূর দিয়ে  হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে। সে লক্ষ্য করে তাকে অনেকেই দেখছে কিন্তু সে চোখ বাঁকা নয়। তার মন বড় হতে থাকে সে আরো কাছে আসে। তখনও কেউ তাকে ছাল উঠা কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছেনা। সে আরো ঘন হয়ে মিশে যায় শোভাযাত্রার সাথে। ঠিক তখনই  তার শরীর বেয়ে বুক থেকে নেমে যায় বড় এক কালো পাথর। পাথরের ভারহীন হয়ে সে হাঁটে। জীবন এখানে বেহেস্তের মতো লাগছে তার কাছে। এই প্রথম সে শ্বাস নিচ্ছে বিশুদ্ধ বাতাসে। স্মৃতিসৌধের  সামনে এলে সবাই সবার হাতের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে সরে যায়। আলী উলের হাতে ফুল নেই দেখে তার পাশের সাদা পাঞ্জাবী পরা লোকটি একটি ফুল এগিয়ে দেয়। স্বপ্নের মতো লাগে আলী উলের। সে হাত বাড়িয়ে ফুলটি নিয়ে। নিজের গায়ে চিমটি কাটে। না, এ স্বপ্ন নয়। এই বাস্তবতার জগত তাকে ধিক্কার দিচ্ছে না। ঘৃণা করছেনা। অবহেলার বিষবাণেও ক্ষতবিক্ষত করছেনা। ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়েও তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে হচ্ছে না। কি আশ্চর্য! কি অদ্ভুত! দীর্ঘ  বছরের অপমানের অগ্নিগিরীর লাভা নির্গত হয়। আলী উল স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে গিয়ে ফুল বিছানো সিঁড়ি পর সিঁড়ি চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তোলে আর আবেগে পাগলের মতো  চিৎকার করে বলে আমি বীরাঙ্গনার সন্তান। আমি বীরাঙ্গনার সন্তান। অসংখ্য তেজি আলো মুহূর্তে আলী উলকে ঘিরে ধরে। অসংখ্য মাইক্রোফোন আলী উলের মুখের সামনে ছুটে আসে। অসংখ্য প্রশ্ন বানে আলী উল বিদ্ধ হতে থাকে। অসংখ্য চোখ তাকে অবাক হয়ে দেখছে। সে সেই সবের সামনে দু'হাত পাখির মতো মেলে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফের চিৎকার করে উঠে " আমি বীরাঙ্গনা নসিমনের সন্তার। আমি নসিমনের সন্তান।" 
হঠাৎ তার হাতে অসংখ্য হাতের টান পড়ে। হাতগুলো তাকে টেনে যে সিঁড়ি গুলো দিয়ে উপরে উঠে এসেছে তা দিয়ে নামিয়ে আনে। এবং একটি গাড়িতে তুলে দেয়। একজন সাদা পোশাকের মানুষ ইনজেকশন হাতে এগিয়ে আসে। সব হাতগুলো তাকে চেপে ধরে। ইনজেকশনের ক্রিয়া তার শিরা-উপশিরায় প্রবেশ করতে থাকে, মুহুর্তে ঘোলা হয়ে উঠে সবকিছু। ঘোলা চোখগুলো বন্ধ হবার আগের মুহূর্তে একটি ভারি কন্ঠস্বর শুনতে পায়। সেই কন্ঠস্বর বলছে " এর কন্ডিশন ভালো নয়। একে পাবনার পাগলা গারদে পাঠাও দ্রুত।" কথাটি শুনে আলী উল প্রাণপণে চিৎকার করে। কিন্তু সেই চিৎকার কেউ শোনে না।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন