মঙ্গলবার, ১৩ মার্চ, ২০১৮

অণুগল্পঃ ভালবাসা যারে খায় ।। দীলতাজ রহমান


ভালবাসা যারে খায়

প্রথমেই একটু একটু করে ভাল লাগতে শুরু করে অফিস কলিগ সায়মাকে। কিন্তু মন সরিয়ে না নেয়াতে দ্রুত তুহীনের অবচেতন মনেও সবটুকু গেড়ে থাকে সায়মার ছায়া । তুহীন ভাবে, একটি মানুষ এত অকপট, সাবলীল হয় কি করে ! 
যদিও সায়মার অত কিছু জানে না তুহীন। তবু তার মন ধীরে ধীরে এগোয় তার  দিকেই ! 
কিন্তু সেটা অনেকদিন বন্ধুত্বের ভেতরই ধরেবেঁধে সীমিত রাখা হয় । যেন তুহীন চেষ্টা করেও তার গন্ডি পেরোতে পারে না! তুহীনের নিজস্ব বৈশিষ্ট তেমন কিছু নেই। কিন্তু সায়মা নাকি নাচ, গান, আবৃত্তি, বিতর্ক সব পারে। আর সে নিজে শুধু একটি ভাল চাকরি করে। তবে সেটা সায়মাও করে ! তবে নিজে সেও দেখতে মন্দ নয়। মা-বাবা দুজনেই কলেজ শিক্ষক ছিলেন। এখন দুজনেই অবসর জীবন যাপন করছেন। একটিমাত্র বোন ডাক্তার । স্বামী বিদেশে থাকে বলে দুটি সন্তান নিয়ে সে মা-বাবার কাছেই আছে। এখন তারা সবাই মিলে পাত্রী খুঁজছে তুহীনের জন্য। 
বোনের কাছে একদিন তুহীন সায়মার কথা পাড়তেই বলেছিল, ‘শোনো, আপা, একেবারে সায়মাই হতে হবে তেমন নয়। তবে ওর মতো হলে ভাল হয়।’
বোন জানতে চাইলো, ‘সেই মতোটা আসলে কিরকম ?’
তুহীন বললো, ‘এই যেমন ওর মুখের দিকে তাকেলে মনেহয়, কী আছে, কী নেই..., এমনটা ভাবতে ভাবতে যেন জীবন কেটে যায় !’

বোন সায়মাকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে, তুহিন বলেছিলো, তুমি একদিন আমার কাছে কোনো কাজের উছিলায় অফিসে এসো! 

তাই হলো। অফিসের ব্যস্ত সময় একটুমাত্র গল্প করে হিসেবি মিতুলও মুগ্ধ হলো সায়মার বাচনভঙ্গিতে । আর হাসিটুকু তো ফুলঝরা ...! শেষে বোন মিতুলের পরামর্শে এক ছুটির দিনের আগের দিন তুহীন সায়মাকে অফিসেই কাজের ফাঁকে বললো, আমি গল্প করতে আপনার বাসায় কাল যেতে চাই’
সায়মা জানালো, ‘আসতে পারেন, আমার তাতে খুব অসুবিধা হবে না! ছুটির দিনগুলোতে একটু কেনাকাটা করতে যাই, শিল্পকলা, জাদুঘরে অনুষ্ঠান দেখতে, কখনো অংশগ্রহণ করতে যাই। যাক, সে না হয় আরেকদিনই হবে !’

ড্রয়িং রুমের দেয়ালে বড় করে বাঁধানো স্বামী আর বছর তিনেক বয়সের এককন্যাকে সাথে নিয়ে সায়মার ছবি দেখে আঁৎতে ওঠে তুহীন। বলে, ‘আপনি বিবাহিত ? সন্তানও আছে ? আগে বলেননি তো ?’
সায়মা বেশ থতমত খেয়ে বললো, ‘আমি বিবাহিত ! সন্তান আছে ! তা অফিসে আপনাকে আমার যেচে বলার মতো কী কোনো কারণ ঘটেছিলো ? এই দু’বছরে, কোনোদিন ? 
ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া তুহীন সায়মার দিকে কিছুক্ষণ শুখনো চোখে অপলক তাকিয়ে থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। 
অতিথি আগমনের খবর পেয়ে সায়মার ঘর-গেরস্থ সামলানো আটপৌরে মা আর তিন পুরুষের ব্যাবসা আগলানো ভুঁড়িওয়ালা বাবা এসে দেখলো ঘরে কেউ নেই ! ! পরে তারা ভাবলেন, মেয়ে নাটকের কোনো সংলাপ আউড়েছিলো...।
সেদিনের পর থেকে সপ্তাহখানেক সময় সায়মার চোখে চোখ পড়ে, এমনভাবে একবারও তাকায়নি তুহীন ! 
আর সায়মা তো থোড়াই কেয়ার, কে আগবাড়িয়ে বাড়িতে গল্প করতে গিয়ে দেয়ালে একখানা ছবি দেখে বেরিয়ে এসে একটানা ‘তোমার দিকে আর তাকাচ্ছি না’র মতো ভান ধরে থাকবে, আর তাকে সে খেয়াল করবে! কক্খনো না !
কিন্তু নিজেকে অবদমনের সব ইচ্ছে ক’দিন পরই বালির বাঁধের মতো ভেঙে তুহীন এক গভীররাতে সায়মাকে ফোন করে উন্মাদের মতো বললো, ‘আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি সায়মা!’
সায়মা নিরুদ্বেগকন্ঠে বললো, ‘জানি তো !’
: ‘কী করে জানো ?’
: ‘একাউন্টিং আমার সাবজেক্ট হলেও মনোবিজ্ঞান পড়া আমার নেশা!’
: ‘আমার কী হবে এখন? তুমি সব ছেড়ে আমার কাছে আসতে পারো না?’
: ‘সব ছেড়ে আসতে হবে কেন? সবাইকে তোমার কাছে নিয়েই আসতে পারি যদি অনুমতি দাও !
: ‘মজা করছো?’
: ‘কেন, কাউকে ভালবাসলে তার ভালবাসার মানুষগুলোকেও ভালবাসতে শেখো! খালি নিজের কথা ভাবলে চলে ?’
আচমকা ঘুমভাঙা সায়মা বুঝতে পারে না, কখন সে নিজেও তুহীনকে তুমি তুমি করে বলা শুরু করেছে এবং কথার গরমিলে শুরুতেই সে ধরা পড়ে গেছে, সেদিন তুহীনের দেখা দেয়ালের সে ছবি সায়মার নয়, ওটা ওর জমজ বোন সায়রার। যে কিনাআজ থেকে বছর পাঁচেক আগেই এক আর্মি অফিসারকে  নিজে পছন্দ করে, কলেজ অবদিই লেখাপড়ার পার্ট চুকিয়ে মহাসুখে সংসার করছে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন