বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮

প্রবন্ধঃ স্বাদহীন স্বাধীনতা ।। সৌমিত্র চক্রবর্তী


স্বাদহীন স্বাধীনতা
স্বাধীনতা তুমি কার? আবহমান এ প্রশ্ন উদিত দেশ কাল জাতি বর্ণ নির্বিশেষে। উত্তর নিয়ে নানান বিতর্ক, আলোচনা অব্যাহত এবং স্বতঃই অমীমাংসিত। কিন্তু রোজকার চলার পথে এর হাজারো উত্তর মাঝে মাঝে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের প্রকৃত অবস্থাকে দেখিয়ে দেয়।
যেতে যেতে পথের ধারে যে অপুষ্ট শিশুকে দেখি, একটা থালাও যার সম্বল নেই। ফেলে দেওয়া অতিরিক্ত উচ্ছিষ্ট হুমড়ি খেয়ে গোগ্রাসে গিলছে। যে মা কে দেখি হাড় জিরজিরে সন্তানকে একপাশে বসিয়ে রেখে তার গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে নিজের দেহ উন্মুক্ত করে খুবই কম মূল্যের বিনিময়ে। কিম্বা কাশির সঙ্গে রক্ত উঠে আসা, দেনার দায়ে মাথার শেষ চুল বিক্রী হয়ে যাওয়া বন্ধ কারখানার শ্রমিক বা দাম না পাওয়া আলুচাষী আত্মহত্যার সবচেয়ে শস্তার উপায় খোঁজে। তখন অন্তত বোঝা যায় স্বাধীনতা নামের আপ্তশব্দ এদের জন্য নয়।
রবীন্দ্রনাথ কবে লিখেছিলেন তেত্রিশ কোটি জনসংখ্যার ভারতবর্ষের কথা। আজ তার প্রায় চারগুণ মাথার ভারে ন্যুব্জ ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের জনভূমি। শেষ গণনার থেকে চার বছর পরে এখন প্রায় ১২০ কোটি (সরকারী মতে) মাথার দেশ ভারতের প্রচারিত অর্থনীতি নাকি এখন বেশ সবল। 
“১৯৫০-এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত ভারত সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করে চলে। স্বাধীনতা-উত্তর যুগের অধিকাংশ সময় জুড়ে ভারতে যে আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তাতে বেসরকারি উদ্যোগ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ওপর কঠোর সরকারি বিধিনিষেধ আরোপিত থাকত। ১৯৯১ সালে অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে ভারত তার বাজার উন্মুক্ত করে দেয়। বিদেশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উপর সরকারি কর্তৃত্ব শিথিল করা হয়। এর ধনাত্মক প্রভাবে মার্চ ১৯৯১ সালে ৫.৮ বিলিয়ন  মার্কিন ডলার থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় ৪ জুলাই, ২০০৮ তারিখে বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ঘাটতি কমে আসে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বাজেটগুলিতে। যদিও সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ এবং কোনও কোনও সরকারি খাত বেসরকারি ও বৈদেশিক অংশীদারদের নিকট মুক্ত করে দেওয়ায় রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
ভারতের মোট স্থুল আভ্যন্তরীক উৎপাদন বা জিডিপি ১.২৪৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) পরিমাপে ৪.৭২৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতূল্য। জিডিপি'র মানদণ্ডে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। চলতি মূল্যে ভারতের মাথাপিছু আয় ৯৭৭ মার্কিন ডলার (বিশ্বে ১২৮তম) যা ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) ভিত্তিক পরিমাপে ২,৭০০ মার্কিন ডলারের সমতূল্য (বিশ্বে ১১৮তম)। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে কৃষি প্রধান দেশ হিসাবে পরিচিত ভারতের বর্তমান জিডিপিতে পরিষেবা খাতের অবদান ৫৪ শতাংশ ; ইতিমধ্যে কৃষিখাতের অবদান হ্রাস পেয়ে ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং শিল্পখাতের অবদান মাত্র ১৮ শতাংশ। বিগত দুই দশকে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি ভারতের গড় বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৭ শতাংশ।
৫১৬.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমশক্তির দেশ। এই শক্তির ৬০ শতাংশ নিয়োজিত কৃষিখাতে ও কৃষিসংক্রান্ত শিল্পগুলিতে, ২৮ শতাংশ পরিষেবা ও পরিষেবা-সংক্রান্ত শিল্পে এবং ১২ শতাংশ নিযুক্ত শিল্পখাতে। প্রধান কৃষিজ ফসলগুলি হল ধান, গম,তৈলবীজ, তুলা, পাট, চা, আখ, আলু । প্রধান শিল্পগুলি হল অটোমোবাইল, সিমেন্ট, রাসায়নিক, বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, যন্ত্রশিল্প, খনি, পেট্রোলিয়াম, ভেষজ, ইস্পাত, পরিবহণ উপকরণ ও বস্ত্রশিল্প। ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদগুলি হল আবাদি জমি, বক্সাইট, ক্রোমাইট, কয়লা, হীরে, আকরিক লৌহ, চুনাপাথর, ম্যাঙ্গানিজ, অভ্র, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও আকরিক টাইটানিয়াম ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শক্তির চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, ভারত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের ষষ্ঠ বৃহত্তম ও কয়লার তৃতীয় বৃহত্তম ভোক্তা।
বিগত দুই দশকের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ভারত বিশ্বের সর্বাপেক্ষা দারিদ্র্যপীড়িত রাষ্ট্র। শিশু-অপুষ্টির হারও বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় ভারতে সর্বাধিক: ২০০৭ সালের হিসেব অনুযায়ী ৪৬ শতাংশ) । তবে বিশ্বব্যাঙ্ক নির্ধারিত দৈনিক ১.২৫ মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখার (২০০৪ সালের হিসেব অনুযায়ী, ক্রয়ক্ষমতা সমতা নামমাত্র হিসেবে নগরাঞ্চলে দৈনিক ২১.৬ টাকা ও গ্রামাঞ্চলে দৈনিক ১৪.৩ টাকা) নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১৯৮১ সালে ৬০ শতাংশ থেকে ২০০৫ সালে ৪২ শতাংশে নেমে এসেছে।  সাম্প্রতিক দশকগুলিতে ভারত মন্বন্তর প্রতিরোধ করতে পারলেও, দেশের অর্ধেক শিশু ওজন ঘাটতিতে ভুগছে। এই হার সারা বিশ্বের নিরিখে কেবল উচ্চই নয়, এমনকী সাব-সাহারান আফ্রিকার হারের প্রায় দ্বিগুণ।
বর্তমানে ভারত  সফটওয়্যার ও অর্থসংক্রান্ত, গবেষণাসংক্রান্ত ও প্রকৌশলগত পরিষেবার এক বৃহৎ রপ্তানিকারক। ২০০৭ সালে রপ্তানি ও আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ২১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বস্ত্র, রত্ন, ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদি ও সফটওয়্যার ভারতের প্রধান রপ্তানি পণ্য। প্রধান প্রধান আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে অপরিশোধিত তেল যন্ত্রপাতি, সার ও রাসায়নিক দ্রব্য। 
ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের দ্বাদশ বৃহত্তম; ২০০৭ সালে এর মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন ছিল ১.০৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ব ব্যাংকের করা নতুন হিসাব অনুযায়ী মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। ভারতের বিশ্বের প্রবৃদ্ধিশীল অর্থনীতিগুলির মধ্যে দ্বিতীয় দ্রুততম; ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে ভারতের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হার ছিল ৯.৪%। কিন্তু ভারতের বিরাট জনসংখ্যার কারণে মাথাপিছু আয় মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে মাত্র ৪,১৮২ মার্কিন ডলার এবং আর্থিক ভিত্তিতে মাত্র ৯৬৪ ডলার (২০০৭ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী)। বিশ্বব্যাংক ভারতের অর্থনীতিকে একটি স্বল্প-আয়ের অর্থনীতি হিসেবে শ্রেণীকরণ করেছে”।
সরকারী পরিসংখ্যান পড়লে মনে হবে আমরা সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বা সমতুল কোনো উন্নত দেশের সমতুল পর্যায়ে চলে গেছি। কিন্তু আসল অবস্থা কি? 
দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা ভারতের একটি প্রধান সমস্যা এবং এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতা অর্জনের জন্য একটি বড় বাধা। দারিদ্র্য এখনও একটি প্রকট সমস্যা, তবে স্বাধীনতার পর দারিদ্র্যের পরিমাণ অনেক হ্রাস পেয়েছে। সরকারী হিসাব মতে ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে ২৭% ভারতীয় দরিদ্র ছিলেন।
তাহলে হিসাব অনুযায়ী দেশের অগ্রগতির এই সুফল ভোগ করছেন এক বিপুল জনগোষ্ঠীর মানুষ এবং বাকীরাও উন্নতির পথে অগ্রসরমান। কিন্তু এ যে কতবড় এক ধোঁকা তা আপামর জনসাধারণ জানেন।
উন্নতির যে সুফল তা প্রায় সম্পূর্ণ ভোগ করে চলেছেন সমাজের উচ্চস্তরের মাত্র ১৫% বিত্তশালী মানুষ। বিত্তশালী বললেও সম্ভবত অনেক কম বলা হয়। এঁরা নিজেদের ভারতীয় মনে করেন না। পৃথিবীর বিভিন্ন  দেশে এঁদের সম্পত্তি ও ব্যাংকব্যালেন্স আছে। শুধু প্রমোদেই এঁরা রোজ কোটি টাকা খরচ করে থাকেন। 
মধ্যস্বত্ত্বভোগী মানে আমরা যাঁদের মধ্যবিত্ত বলে থাকি তাদের সংখ্যাও প্রায় ১৫%। স্বচ্ছল পরিধির বাসিন্দা এঁরা মনে মনে এক একটি আম্বানি, হিন্দুজা হওয়ার স্বপ্ন লালন করেন। নীচুতলার প্রতি এঁদের ঘৃণা অপর্যাপ্ত। 
বাকী রইলো যে ৭০ শতাংশ জনজাতির মানুষ, তাদের মধ্যে আবার প্রায় ৫০ শতাংশই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। এঁরা ভাত, রুটি খাওয়া তো দূরের কথা সেইসব খাদ্যের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। বনজঙ্গলের শিকড় বাকড়, কন্দমূল, মেঠো ইঁদুর, ফসল সংগ্রহের পরে পড়ে থাকা শষ্যদানা, জঙ্গলের পাতা সংগ্রহ ও বিক্রী করে সামান্য অর্থসংগ্রহ, অসংগঠিতভাবে তুচ্ছ সরঞ্জামের মাধ্যমে মাছ ধরা, ইত্যাদি এঁদের জীবিকা। মাসের প্রায় অর্ধেকদিনই অভুক্ত থাকার অভ্যাস এঁরা রপ্ত করেন বংশানুক্রমে। কোনো কোনো বংশধর এই শোষনের প্রতিবাদ জানালে জোটে লাঠি-বেয়নেট-ধর্ষণ-আগুন-হত্যা। 
আসলে সামন্ততান্ত্রিক জনজাতির প্রতিভূরা এখনো মনে মনে সেই সামন্তযুগেই বাস করেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুঁজিবাদের শোষক মানসিকতা। আর এই দুই এ মিলে এগিয়ে চলেছে ১৫+১৫% এর ভারতবর্ষ। স্বাধীনতার সুফল ভোগকারী এরাই। তাই স্বাধীনতা এদেরই। বাকীরা ১৯৪৭ এর আগেও যে তিমিরে পড়েছিল, এখনো সেখান থেকে একচুলও এগোতে পারেন নি। লক্ষ ঢক্কানিনাদ সত্বেও একজনও কালোবাজারী নিকটবর্তী ল্যাম্পপোস্টে ঝোলেনি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন