বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮

গল্পঃ মৃত্যুই হাদারামের মুক্তি ।। মোঃ আহসান হাবিব

মৃত্যুই হাদারামের মুক্তি


হাদারাম পাল খুব সাধারণ আর সাধাসিধা একজন ন্যায়পরায়ণ মানুষ। পরজীবনের প্রতি শ্রোদ্ধা রেখে সে অনেক আত্মসংযমী হয়ে চলার চেষ্টা করে। তাই সাধারণের পক্ষে যে ভাবে চলাচল, বাদ বিচারহীন, বিবেক হীন ভাবে করা সম্ভব হাদারামের পক্ষে সেভাবে চলাচল করা সম্ভব হয়ে উঠে  না। মানুষকে ঠকিয়ে, মানুষকে বিপদে ফেলে নিজের স্বার্থ হাচিল করা হাদারামের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। মানুষকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য সে নিজের প্রাপ্য থেকে অনেক কিছু হাসি মুখে ছেড়ে দিতে পারে কিন্তু মানুষকে কষ্ট দিতে পারে না কোন ক্রমেই। বর্তমান যেখানে উল্টো স্রোতের বাজার সেখানে হাদারামের সততার কারণে অনেক কষ্টে দিন যাপন করতে হয়। হাদারামের নিজের কোন জায়গা নেই। পরের জমিতে কোন রকম একটা ছাপড়ার ঘর তুলে ছেলে, মেয়ে আর বউকে নিয়ে  সংসার তার খুব কষ্টে চলছিল। গ্রামের উপার্জন কম হওয়ায় হাদারাম পাল অর্থা উপর্জনে ঢাকা শহরে আসে। ছোট বেলা থেকে তার একটাই নেশা কম্পিউটার চালানোর। তাই কম্পিউটারে তার ভাল দক্ষতা ছিল। একটা প্রোজেক্টে হাদারাম কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে কাজ পায় হাদারাম। এর ভিতরে হাদারামের অনেক ভাল ভাল উচ্চ বংশিও ধ্বনী পরিবারের সাথে উঠা বাসা চলে কাজের সুবাদে। বাড়িতেও টাকা পাঠায় হাদারম নিয়মিত। এক সময় প্রজেক্ট শেষ হয়ে যায়। প্রজেক্ট শেষ মানে চাকুরী ও শেষ। হাদারাম মহা বিপদের পড়ে । অফিসে পক্ষ থেকে বলা হয় প্রজেক্ট শেষ হলেও কাজ এখনও শেষ হয়নি। তাই কেউ যদি বাকী কাজ গুলো সমাপ্ত করার কাজে সহযোগিতা করে তাকে পরবর্তী প্রোজেক্টে চাকুরি দেওয়া হবে। পরবর্তী প্রোজেক্ট আসতে ২/৩ মাস সময় লাগবে। 


এই দুই তিন মাস বিনা বেতনে ভলেনটারী সার্ভিস দিতে হবে। সবাই রাজি হয়ে যায়। যে হেতু একটা চাকুরি নিতে বড় স্যারদেরকে ১০/১৫ লক্ষ টাকা চা-নাস্তা খেতে দিতে হয়, আর এত টাকার দেওয়ার ক্ষমতাও হাদারামের নেই। তাই দুই-তিন মাস বিনা বেতনে পরিশ্রম করাই তার জন্য যুক্তি যুক্ত। শুরু হয় বিনা বেতনে কাজ করা। বিভিন্ন আমলা তান্ত্রিক জটিলতার কারণে নতুন প্রজেক্ট আসতে দেরী হয়। এদিকে হাদারামের জমানো যা টাকা ছিলো সেটা শেষ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জনের কাছে ধার দেনা করতে করতে ঋণের একটা পাহাড় জমা হয়ে যায় হাদারামের মাথার উপরে। তবু হাদারামের ভর্ষা যে, চাকুরি টা পেলে সব ঋণ শোধ করে দিতে পারবো। কিন্তু চাকুরী নামের সোনার হরিণের কোন দেখা নেই। হাদারাম কাজ করেই চলেছে চাকুরীর আশায়। দিন গড়াতেই আছে। পাওনাদাররা টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। পরিবারে আর্থিক খরা দেখা দিল। সংসারে ফাটল সৃষ্টি হলো । হাদারামের কাছে কোন টাকা নেই। যেই হাদারাম ৫০০/১০০০ টাকা মানুষের কাছে চাওয়া মাত্রই পরিচিতরা তাকে দিয়ে দিতো। সেই হাদারমকে এখন কেউ আর ১০ টাকাও ঋণ দিতে নারাজ। একই রুমে থাকে হাদারামের রুমমেট রা এখন হাদারাম কে আর কোন সাপোর্ট দেয় না। হাদারাম মহা বিপদে পড়ে গেছে। হাদারাম এখন পায়ে হেটে ৫ মাইল পথ অত্রিক্রম করে অফিস করে নিয়মিত। হাদারামের অফিসে অনেক ধণী লোকও কাজ করে। কিন্তু তারা হাদারামের মত আরো যারা কাজ করে তাদের কোন খোঁজ খবর নেয় না। এমনও লোক আছে যারা নিজেরাই জানে না যে ব্যাংকে তাদের মোট কত টাকা আছে। ঢাকা শহরে ৭-৮ টা বাড়ির মালিক। তবে সবাই যে এমন তা নয়। একদিন , দুই দিন পর পর এক সাজ করে খাওয়া মেলে হাদারামের। অফিসের বড় বাবুরা খাওয়ার পরে যে খানা থাকে অফিস পরিচ্ছন্ন কর্মীরা সেই খাবার হতে নিজেরা কিছু খায় আর কিছু হাদারামের জন্য পাঠায়। দুই একদিন অভূক্ত থাকার পরে সামান্য খাবারের স্বাদ হাদারামের চোখে জল এনে দেয়। অনেক সময় দেখা গেছে হাদারাম খাচ্চে আর তার চোখ দিয়ে পানি পড়েছে অঝর ধারায়। হাদারামের অফিসে এক জন মানুষের কথা হাদারাম কোন দিনও ভুল তে পারবে না। সে হলো এনামুল কবির স্যার, যিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। তার সব চেয়ে বড় গুণ হলো তিনি মানুষে প্রচুর পরিমানে খাদ্য খাওয়াতেন। ক্ষুধার্ত মানুষেকে গোপনে খাদ্য খাওয়ানো তার বিশেষ গুণ। প্রায় দুপরে সে হাদারামকে ডেকে শুনতেন, হাদারাম- দুপরে খাওয়া হয়েছে। হাদারাম বলতো – না, স্যার, কিছু খাই নি। স্যার বলতেন। ঠিক আছে দুপরে আমার সাথে খেয়ো। যদি কোন দিন এনামুল হক স্যার খানা অন্যদেরকে নিয়ে খেতেন তখন হাদারামের হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে বলতেন- যাও নিচে থেকে কিছু কেয়ে এসো। স্যারের যে খুব কপি পতি তা কিন্তু নয়, তবে তিনি দু’হাতে অসহায়ের বিপদে খরাচ করতেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে হাদার সর্বদা সেই স্যারের জন্য সুভকামনা করে। অসহায় ব্যাক্তিই কেবল অসহায় এর মর্ম বোঝে। হাদারাম ভাবে দু:খের পরে সুখ আসবেই। রাতের পরে তো দিন আসেই। এই একটাই আশায় হাদারম এখনও বেঁচে আছে। ক্ষুধার কষ্ট হাদারাম কি তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। ম্যাসের অন্য মেম্বাররা খানার যে অবশিষ্ট অংশ থাকে তা মেসের বুয়া সকারে ফেলে দেয়। হাদারাম বুয়াদের কে বলে রেখেছে যে,  খানা গুলো ফেলে না দিয়ে হাদারাম কে দিতে। হাদারম সেই খাওয়ার খাই। একদিন হাদারাম কিছু ভাত নিয়ে রুমে যায় খাবে বলে। ক্ষুধার তাড়নায় শুধু ভাত ক্ষেতে শুরু করে। রুমের আর একজন ভাত তরকারি রান্না করে খায়। হাদারাম দেখে খাড়িতে ডাইল রান্না করেছে। হাদারাম মনের সুখে ডাউল দিয়ে ভাত খাই। মনে মনে ভাবে যার হাড়ি থেকে ডাউল নিয়েছে সে আসলে তাকে বললে যে, তার হাড়ি থেকে ডাউল নিয়ে খেয়েছে। যথা সময় ঐ লোক আসে, হাদারাম তাকে বলে যে, সে না বলে তার হাড়ি থেকে ডাউল নিয়ে খেয়েছে। উত্তরে ঐ লোক জানায় যে, সে তো ডাউল রান্না করেনি। তরকারি খাওয়ার পর হাড়িতে পানি ঢেলে রেখে গিয়েছিল। হাদারমের বুঝতে বাকী থাকে না যে, সে ডাউল ভেবে কি দিয়ে ভাত খেয়েছে। হাদারাম চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। এক দৌড়ে বাথরুমে চলে যায়। এবং অঝরে কাঁদতে থাকে। চোখের বৃষ্টি যেন থামতেই চাইছে না, হাদারামের। রাস্তায় যখন হাটতে থাকে আর দেখে রাস্তার পাশে ডাস্টবিনের খাবার গুলো কুকুরে খাচ্ছে, তখন হাদারামের ইচ্ছা হয় কুকুরের মুখ থেকে খাবার গুলো কেড়ে নিয়ে নিজে খেতে কিন্তু আত্ম সম্মানবোধ সেটা করতে সায় দেয় না। এ দিকে প্রজেক্ট পাশ হওয়ার কোন খবর নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় হাদারামের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই এই ক্ষুধার্থ পৃথিবীতে। অনেক বার ই সে গাড়ীর নিচে মাথা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আত্মহত্যার করার শক্তিও তার থাকে না, প্রভু যাদের কে এ কঠিন ক্ষমাত দেননি হাদারাম তার মধ্যে একজন। এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় এভাবে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। পারিবারিক যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন। ফেবুতে বিভিন্ন লোকের কাছে সাহায্য চায়। কেউ তাকে সাহায্য দেয়ে না। টিটকারি করে। দুই এক জন কিছু সাহায্য দেয়। দু’এক জন ভাবে ভন্ড ব্যবসায়ী। আজব বিশ্বচরাচরের নিয়মে সে হাবুডুবু খাচ্ছে। মরার জন্য যখন হাদারাম পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় ঠিক তখনই হাদারামের মোর পরিবর্তন করে দেয়, প্রেরণা, প্রেরণা একজন স্কুল শিক্ষিকা। তার স্বামী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার, বিভিন্ন সমাজ সেবা কাজের সাথে জড়িত প্রেরণা। প্রেরণার টাকা পয়সা যা থাক না কেন, একটা বড় মন আছে । সে হাদারামের পাশে বট বৃক্ষের মত দাড়িয়ে যায়। সব চেয়ে অবক করা বিষয় হল ফেবুতে উভরের পরিচায়। এমন অপরিচত হাদারামের পাশে বট গাছেরমত প্রেরণা যখন দাড়ায় তখন হাদারামের সংকীর্ণ পৃথিবীটা অনেক বড় হয়ে যায়। হাদারম কল্পনাও করতে পারে না যে, বিশ্বচরাচরে এমন নি:শ্বার্থ মানুষ থাকতে পারে। প্রায় সর্বস্তরে হাদারামকে সাহায্য করে প্রেরণা। হাদারাম ভাবতে থাকে এভাবে সে প্রেরণার কাছে বহু ঋণী হয়ে যাচ্ছে। শুধু নিচ্ছে তো নিচ্ছে। দেওয়ার মত তো কিছু নেই হাদারামের। হাড়ির তলা যেমন ছিদ্র হলে তাকে পানি দিয়ে পূর্ণ করা যায় না। ঠিক তেমনি প্রেরণার দেওয়া সকল কিছু হাদারাম কে পূর্ণতা করতে পারে না। কারণ প্রেরণা যাই দেয় না কেন, হাদারাম সেটা নি:শ্বেস করে ফেলে। জীবন কে নিয়ে আর এক দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় হাদারাম। এমন ভাবে প্রেরণার কাছে ঋণী হতে থাকলে নিজে বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে হবে। এমন সময় ফেবুতে হাদারামে এক বন্ধবী জোটে নাম নিলাঞ্জনা চম্পা সিরাজী, সে হাদারামকে বলে যে, তুমি যদি লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিঃশ্বেস করে ফেল তবে কোন দিন ও উপরে উঠতে পারবে না। সারা জীবন তোমাকে ঋণ নিয়েই যেতে হবে। কোন দিন পরিশোধ করতে পারবে না। তোমাকে যে কোন একটা কাজ করতে হবে। তাই সে কাজটা যত ছোট ই হোক না কেন। নিলাঞ্জনার কথা মতো হাদারাম একটা ছোট্ট কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। ইনকাম যদিও সামান্য তারপরও কাজ টা করে হাদারাম গর্ব অনুভব করলো। নিলাঞ্জনা তকে পরিশোধ করার শর্তে কিছু টাকা দিল। যদিও সে টাকা হাদারাম নিলাঞ্জনা কে পুরো পুরি পরিশোধ করতে পারিনি এখনও, কিন্তু হাদারামের মনের বিশেষ একটি শ্রোদ্ধার স্থানে নিলাঞ্জনাকে জায়গা করে দিল। হাদারাম উপলব্ধি করলো যে কাউ সাহায্য করতে হলে এমন ভাবেই সাহায্য করা উচিত, যেতে তার কর্মসংস্থান হয়। নতুন বা খাদ্যের জন্য ঋণ দিলে আজীবন ঋণ দিতেই হবে, দিতেই হবে কিন্তু তার অবস্থার পরিবর্তন হবে না। নিলাঞ্জনার পর্ব এখানে শেষ হইলেও প্রেরণা পর্ব শেষ হলো না। প্রেরণা তো হাদারামের একমাত্র বটবৃক্ষ। যে কোন বিপদেই হাদারাম প্রেরণার দ্বারস্থ হয়। আর প্রেরণা তাকে পূর্ণ করে দেয় চাহিদা সমূহ। প্রেরণার কাছে কোন কিছু চেয়ে হাদারাম খালি হাতে ফিরে এসেছে এমন নজির নেই। বরং যা চেয়েছে হাদারাম প্রেরণা তাকে পূর্ণ করে দিয়েছে তা দিয়ে অথবা তার চেয়ে বেশী দিয়ে। প্রেরণা হাদারামের মনে এমন ভাবে স্থান করে নিয়েছে যে হাদারারেম ধারণা বাঁচতে হলে একমাত্র প্রেরণার জন্য বাঁচতে হবে। নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রেরণায় হাদারাম যখন নতুন ভাবে বেঁচে থাকবার বড় আকংঙ্খা নিয়ে পথ চলতে শুরু করে ঠিক তখনই প্রেরণা অজানা এক অভিমান বুকে নিয়ে হাদারামের সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। হাদারামের জীবন হয়তো আগের মত অভব নেই। ডাস্টবিনের ধারে হয়তো খাদ্য কুড়াতে হয় না। কিন্ত প্রেরণা তার সবকিছু নি:স্ব করে হাদারাম কে মুক্ত করে দিয়েছে। হাদারাম এখন চির মুক্ত, তাকে শাসন করার আর কোন প্রেরণা নেই। হাদারাম গাড়ীর নীচে মাথা দেওয়ার যে শক্তিটা অর্পূণ ছিল সেটা বুঝি এবার পূর্ণ হবে। প্রভু শুধু দেয় আর কেড়ে নেয়। এবার হাদারামের আকুতি প্রভু যেন তাকে জীবন থেকে চিরমুক্তি দেয়। হাদারাম আর পৃথিবীর জোয়ার ভাটার খেলা দেখতে চায় না। সে এখন মুক্তি চায় চির মুক্তি। প্রেরণা যখন তাকে মুক্তি দিয়েছে। পৃথিবীও তখন মুক্তি দিয়ে দিক। হাদারামের চাওয়া প্রেরণা সুখে থাক, আর এমন হাদারাম যেন পৃথিবীতে আর জন্ম না নেয়। প্রভুর এই পৃথিবীতে এমন হাজারও হাদারাম মুখ লুকিয়ে আছে নিরব আঁধার বুকে নিয়ে। সকল হাদারাম মুক্তি পাক আর প্রেরণা সুখে থাক। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন