বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮

গল্পঃ আলোর ছিঠি ।। এস আই জীবন



আলোর চিঠি 

যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি, সামাজিক এই ব্যাধিতে জর্জরিত সারা দেশ। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক মা বোনকে অকালে সুন্দর দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। প্রতিটি বিদায়ের সাথে লেখা ছিলো, লোভ লালসা আর হীনতার ভয়ানক গ্রাসের প্রতিক্রিয়া।সভা সমাবেশে রাস্তা ঘাটে হাটে বাজারে সকলেই যৌতুকের বিপক্ষে কেমন সাধুবাণী গেয়ে বেড়ায়, তবুও তার আড়ালেই সমাজের শিরা উপশিরায় চলছে যৌতুক আদানপ্রদানের কালো গ্রাস। সরকারের আইনের সাদা পাতায় কালো দাগে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যৌতুক নেয়া এবং দেয়া দুটোই অপরাধ। তার পরেও গোপনে বা প্রকাশ্যে চলছে যৌতুক আদান প্রদানের রমরমা লেনদেন। যৌতুকের প্রতি লোক দেখানো ঘৃণা বেশীরভাগ মানুষের। যৌতুকের প্রতি লোভ নেই এমন মানুষ সংখ্যায় অতি সামান্য।


বন্ধুদের মুখে শোনা, গাইবান্ধা জেলায় মেয়ের বিয়ের আগেই বাবারা মেয়েকে নিয়ে যতটা ভাবেন, তার চেয়ে বেশী ভাবেন যৌতুক নিয়ে। ধনী গরীব সবার মাঝেই শিরা উপশিরায় শক্ত শিকর গেড়ে বসেছে এই যৌতুক নামক ক্যান্সার। যৌতুকের জালে আটকে আছে বাংলাদেশ ভারত নেপাল সহ আরো বেশ কিছু দেশ। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে সবখানেই যেনো যৌতুক একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। যৌতুক নামক ক্যান্সারে অহরহ প্রাণ দিতে হচ্ছে মা বোনদের। দারিদ্র্য থেকে মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত সকল শ্রেণীর মাঝেই যৌতুকের  আদানপ্রদান বিরাজমান। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারা যেনো অসহায় একটা ভিন্ন জাতি। যৌতুক লোভী স্বামী বা শশুর পক্ষের ধারণা কন্যার পিতা এমন একটা ব্যাংক যে ব্যাংক থেকে চাইলেই টাকা উত্তোলন করা যায়, তার জন্য কোনো চেক বা জামানত অথবা একাউন্টের দরকার পরেনা। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কন্যাই যেনো রিজার্ভ ব্যাংকের একাউন্ট। ছেলের যোগ্যতা বা দুর্বলতাই হলো যৌতুকের চেক বই। ছেলে যত বেশী যোগ্যতাসম্পন্ন, যৌতুকের মাত্রাটাও ততোই বেশী।
হারুন গাজী, বাড়ি বরিশাল সদর থানার চরকাউয়া ইউনিয়নের চরকরঞ্জী গ্রামের সমাপ্তির একটু অগ্রভাগে। এ গ্রামের ৮০% মানুষ কৃষিকাজে জড়িত। আধুনিক কলের লাঙ্গলের পাশাপাশি সনাতনী পদ্ধতি এখনো চোখে পড়ার মতো। সকাল হলেই কৃষকের মাঠে যাওয়ার তাড়া অবাক করবে আপনাকে, এগ্রামের শিক্ষার হার ৮০% এর বেশী। হারুন গাজী কৃষিকাজের পাশাপাশি বাজারে একটা ছোট্ট দোকান দিয়েছে। দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে মোটামুটি সুখের সংসার তার। বড় মেয়ে আলো,  নামের সাথে তার রূপের কোনো বর্ণনা হয়না। এ গ্রামে সুন্দরী মেয়েদের তালিকা করা হলে তার প্রথম নামটাই দখল করবে আলো। তার মতো সুন্দর নম্র ভদ্র বিনয়ী মেয়ে এ গ্রামে আর এক জনও নেই। আলো যেদিন দুনিয়ার আলো দেখেছে, সেদিন থেকেই হারুন গাজীর সংসারে সুখের যাত্রা শুরু হয়েছে। কোনো কাজে কোনো পরামর্শ দরকার হলে হারুন গাজী তার মেয়ের সাথে বসে মেয়ের সাথে পরামর্শ করেন। আলো যেমন রূপবতী, তেমন বুদ্ধিমতী ও বটে।
    
মেয়ে যদি সুন্দরী আর সাবালিকা হয়, তাহলে ঘটকের আনাগোনা একটু বেশী থাকে। বেশ কয়েকটি প্রস্তাব আছে, ভালো পাত্রের হাতে মেয়েটি  তুলে দিতে সকল বাবাই চেয়ে থাকেন। কে ভালো আর কে মন্দ এমন দন্দ্বে ভুগেন সকল বাবাই, অবশেষরূপে ভাগ্যই নির্ধারণ করে ভবিষ্যৎ। 
শহর থেকে একটি পাত্রের সন্ধান নিয়ে সন্ধ্যা বাদে মালেক ঘটক হারুন গাজীর দোকানে। গরম চায়ের কাপে একটু ফুঁক দিয়ে ঠোঁট ভেজাতে ভেজাতে বললেন।
বাপু মেয়ে যখন বড় হয়েছে বিয়ে তো দিতেই হবে আজ দাও আর কাল দাও, এমন তো নয় আজীবন ঘরে রাখবে। এমন ভালো পাত্র হাতছাড়া হলে আর একটাও পাবেনা। কত পাত্রই তো দেখাতে চাইলাম সায় দিলেনা, মেয়ে এতো বেশী শিক্ষিত করে কি হবে। কদর থাকতেই বিয়ে দেয়া ভালো। পাশে বসা একজনকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসু ভাবেই বললো, কি বলো রমিজ, ঠিক কি না? রমিজ মাথা নাড়িয়ে ঘটকের কথায় সম্মতি জানালো, কে পাত্র কে পাত্রী তা না জেনেই, গ্রাম গঞ্জে এমনটা স্বাভাবিক। জন্ম থেকেই সবাই সবাইকে চেনা জানা। দেখে আসছে, মুরুব্বীদের কথায় সায় দেয়া এটাও একপ্রকার ভদ্রতা।
হারুন গাজী এতক্ষণ কিছুই বলেনি, এক কেজী আটা মাপতে মাপতে বললো,
মালেক চাচা, মেয়ে বিয়ে দেবোনা তা তো বলিনি, আলোর আই এ পরীক্ষা শেষ হলেই এ বিষয়ে চিন্তা করবো। আর মেয়েও এখন বিয়েতে সম্মতি দিচ্ছেনা। জোর জবরদস্তি তো বিয়ে সাদীর কাজে হয়না। মেয়ে শিক্ষিত হোক, সালাম মাস্টার প্রায়ই বলেন, শিক্ষিত মা পারে শিক্ষিত জাতী উপহার দিতে।
কি যে যুগ পড়েছে বাবা, মেয়ে আবার সম্মতি।
বলেই চায়ের কাপে শেষ চুমুক না দিয়েই একপ্রকার বিরক্তি অনুভব করেই চায়ের শেষটুকু রেখে ছাতা বগলে করে চলে গেলেন। মালেক ঘটককে কেউ কখনো ছাতা মুড়ো দিতে দেখেনি। এই ছাতা তার বগল বন্ধু বলা যায়। এই ছাতারও এক ইতিহাস আছে তা অন্য একদিন বলবো। আলোর পরীক্ষা শেষ, হারুন গাজী আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, পরীক্ষা শেষ হলেই মেয়ের বিয়ে দিবেন। শহরের ভালো পাত্র পেলে সবচেয়ে ভালো হতো। বিকেলে দোকানের সামনে দিয়ে মালেক ঘটক যেতেই আজ হারুন গাজী নিজে থেকেই ডাকলো। চাচা এদিক এসো তোমার সাথে কথা আছে।
ঘটক পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললো,
    কি কথা?
এবার ভালো একটা পাত্র দ্যাখো মেয়ের বিয়ে দেবো।
ঘটকের মুখে অনেক দিন পরে হাসি দেখা গেলো, খুশির স্বরে বললো। আমাদের আলোর জন্য পাত্র খুঁজতে হবেনা বাপ, পাত্ররাই লাইন দিয়ে আছে। ওপারায় একটু তাড়া আছে সন্ধ্যা বাদে আসবো।
ঠিক আছে চাচা, তো ছাতাটাকে বগলে চেপে আর কতো কাল কষ্ট দিবেন, রোদের তাপ তো মাথায়, ছাতাটা মেলে রোদ ঠেকান। হারুন জানে তার কথায় সে ছাতা মেলে মাথায় ধরবেনা। ঘটক আকাশের দিকে তাকিয়ে ফের চলে গেলো।
এশার নামাজ শেষে দোকান বন্ধ করবে ঠিক এমন সময় মালেক ঘটকের কণ্ঠস্বর, 
দোকান বন্ধ করবে নাকি হারুন। কাস্টমার নাই, কি করবো চাচা।
বিকেলে পাত্রের কথা বলেছিলে, ভালো একটি পাত্র আছে,  সত্যিই কি আলোর বিয়ে দিবে? তোমার তো মতের ঠিক নাই বাপু।
হ্যাঁ চাচা বিয়ে দেবো,
তোমার মেয়ে তারা অনেক আগেই দেখেছে, তাদের অনেক আগেই পছন্দ করা, তুমি আগে আমার সাথে গিয়ে ছেলের খোঁজখবর তাদের পারিবারিক অবস্থা দেখবে। ছেলের বাবার অঢেল সম্পত্তি। একটাই ছেলে টাকা পয়সার অভাব নাই। তোমার মেয়ে মাশাল্লাহ সুখেই থাকবে। তুমি গোপনে আগে দ্যাখো বাদে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেখবে।
     
ছেলে পক্ষের বিশাল অবস্থা দেখে প্রথমে না মত দিয়েছিলো,  পরে ভাবলো রূপে গুণে জ্ঞানে আমার মেয়ে কারো চেয়ে কম নয়, এ বাড়িতে বিয়ে দিলে মেয়েটা বেশ সুখেই থাকবে।
উভয় পক্ষের আনুষ্ঠানিক দেখাশোনার পরে এলো লেনদেনের পর্ব। ছেলের বাবা বললো,
যা দিবেন আপনার আলো আর পলকেরই থাকবে। মা মণির সাথে ৫ ভড়ি স্বর্ণ আর পলককে একটা মটর সাইকেল। আনুষঙ্গিক  যা পেতে পারে। পলক বলেছিলো ইতালি যাবে, যখন যাবে তখন যদি লাখ পাঁচেক টাকা দিয়ে উপকার করতে পারেন। তাহলে ভালো হতো, পান চিবুতে চিবুতে আবার বললো, আজকাল যা দিন পড়েছে বেয়াই, যৌতুকে সব ছেয়ে গেছে।আমি এসব যৌতুকের মধ্যে নেই। যৌতুককে আমি বড্ড ঘৃণা করি। এটুকু তো আজকাল একটা ছেলে পেতেই পারে কি বলেন!  ঘটকের দিকে তাকি হাস্যমুখ করে বললো পলকের বাবা।
পলকের বাবার কথা শুনে হারুন গাজীর মস্তিষ্ক হিসাব কষতে শুরু করেছে। এতক্ষণ যে উজ্জলতা ছিলো তা মলিনতায় ছেয়ে গেলো কিছুটা।
পলকের বাবা লক্ষ্য করলো বিষয়টা, অভয় দিয়ে বললো,
বেয়াই এতো ঘাবড়ে যাবার কি আছে, আপনি যদি না চান তো কিছুই দিতে হবেনা। আপনার সাধ্যমত যা পারেন তাই দিয়েন।
বেশ আনন্দ আয়োজনের মধ্যদিয়ে আলোর বিয়ে হয়ে গেলো, আপন ধানি জমি বিক্রি করে স্বর্ণালংকার মোটর সাইকেল দিলো আলমারি শোকেজ থেকে সব কিছু। নিজের পারিবারিক দুর্বল অবস্থা যেনো শহুরে মানুষ বুঝতে না পারে।  তার জন্য কোনো কিছুর কমতি রাখেনি। মেয়ের সুখের জন্য অনেক টাকা ঋণ করতে হয়েছে। মেয়ের সুখের কাছে, আপন ঋণের বোঝা মোটেই ভারি নয়। বাবারা কখনো নিজের সুখের কথা ভাবেনা, তারা সব সময় মেয়েদের সুখেই বেশী সুখী।
আলো শশুড় বাড়ীতে পা রাখতেই সবার দৃষ্টি আলোর অলংকারের দিকে, কেউ কেউ হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বলছে।
এগুলো খাঁটি স্বর্ন তো। নাকি সিটি গোল্ড!
একজন মায়ের বয়সী মহিলা,হাতের বালা স্বর্ণকারের মতো পর্যবেক্ষণ করে ঠোঁট ভেঙচি কেটে বলতে লাগলো, এতো পাতলা কেউ আজকাল মেয়ের সাথে দেয়।
কেউ একবার বললোনা তোমরা মেয়েকে কি দিয়েছো,
আলো বোবা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে অশ্রুতে, ঘোমটার আড়ালে কেউ দেখছেনা। এই প্রাসাদে প্রথম পা রেখেই আলো বুঝতে পারলো।  তার চেয়ে তার অলংকার বেশী মূল্যবান। 
কেউ একজন পাশ থেকে বলেছিলো,
ঘরের বৌকে কি দরজায় দাঁড়িয়ে রাখবেন। এমন ভাবে দেখা শুরু করেছেন যেনো আগে কখনো দেখেননি।
কিছুটা কর্কশ ভাবে শব্দগুলো আলোর কানে এসে বাজলো, রাগে নাকি প্রতিবাদের শব্দ তার কিছুই বুঝতে পারলোনা। 
অলংকার নিয়ে যাদের এতো গবেষণা,  তারা বেশ লজ্জা পেলো, কিন্তু একটু দূর থেকে ভেসে আসা প্রতিবাদী কন্ঠের উপরে কেউ কথা বলার সাহস পেলোনা। আলোর ইচ্ছে হচ্ছিলো তার মুখটা একবার দেখার। আলো ভাবলো,  মেয়েদের বিয়ে হলে হয়ত তারা এভাবেই দেখে শহরের মানুষে, আমাদের গ্রামের বাড়িতে নতুন বৌ এলে আগে দেখে বৌয়ের মুখ, আর শহরে কি আজব নিয়ম। তারা আগে দেখে বৌয়ের সাথের অলংকার।
আলোর বিয়ের বয়েস ৬ মাস হতে চললো। একদিন রাতে খাবার টেবিলে শশুর প্রথম সুর তুললেন।
পলকের বিদেশ যাবার ভিসা তো রেডি,  তোমার বাবাকে বলো ৫ লাখ টাকা দিতে। এখন খুব উপকারে আসবে। বিয়ের সময়ই অবশ্য বলে রেখেছিলাম। বেয়াই দিতেও সম্মতি জানিয়েছেন। ধার হিসেবেই দিবেন, পলক ইতালি চলে গেলে বাদে বেয়াইকে ফেরত দিয়ে দিবে পলক।
আলো অতি ধীর স্বরেই বললো,
বাবা এতো টাকা কোথায় পাবে? আমার বাবার কি আছে না আছে তা আপনারা ভালো করেই জানেন।
শাশুড়ি শশুড়ের দিকে তাকিয়ে চোখ লাল করে বলতে লাগলেন,
দেখেছো,  বাবার জন্য কতো দরদ বৌয়ের।
শশুর আর কিছুই বললো না, চুপ করে রইলেন। পলকও চুপচাপ খেয়ে বাইরে চলে গেলো।
অনেক রাত করে বাসায় ফিরলো পলক, মুখ থেকে বিশ্রী মদের গন্ধ। মদের গন্ধ এই প্রথমবার আলোর নাকে প্রবেশ করলো, আলো জানেনা এটা মদের গন্ধ। আলো বিছানার চাদর গোছাতে গোছাতে বললো। কি খেয়েছো?  এতো বিশ্রী গন্ধ কিসের।
আলোর চোখের দিকে ভয়ংকরী ভাবে তাকিয়ে বললো,
বন্ধুদের সাথে রস খেয়েছি।
পলকের কথার অস্বাভাবিকতায় বুঝলো, সে মদ খেয়েছে। নয়তো অন্য কোনো নেশা করেছে।
এসব বাজে জিনিস আর কখনো খেওনা।  এসব খাওয়া ভালো নয়।
চুপ চুপ একদম চুপ। ভালো মন্দ আমাকে শেখাতে এসোনা। কালকেই তুমি তোমার বাবার বাড়িতে যাবে। গিয়ে টাকার কথা বলে আসবে।। এমাসের মধ্যেই আমার টাকা চাই- বলতে বলতেই, পলক বিছানায় ঢলে পড়লো।
১৫ দিন বাদে, হারুন গাজী মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ির দরজার দিকে যাচ্ছিলেন। পূর্ব আকাশ তখন রক্তিমা বিছিয়ে ছিলো, সূর্য তখনো অপ্রকাশিত। এতো সকালে আলোর একার আগমন দেখে কিছুটা অবাক হলেন, বাবা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
কিরে... কেমন আছিস মা, এতো সকালে তুই একা। জামাই বাবাজী এলো না। কি হয়েছে।
যেমন দোয়া করেছো বাবা, তেমনই আছি তার চেয়ে ভালো থাকি কি করে?
মেয়ের কথার মাঝে যে অনেক রহস্য তা বাবার বুঝতে বাকি রইলোনা। তবুও বিস্তারিত জানার আগ্রহে বললো। 
কি হয়েছে আমায় খুলে বল।
ঘরে চলো।
এতো সকালে মেয়েকে দেখে মা খুশি হলেন ঠিকই তার মাঝে বেশী অবাক হলেন। মেয়ের একার আগমনে।
বাবা মা দুজনেই আলোর সামনে বসে আছে। জানার অপেক্ষায়, যে মেয়ের মুখে সবসময় হাসি ছড়াতো সেই মেয়ের মুখ আজ মলিন।
আলো বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো।
আমি কি তোমাদের ঘাড়ে এতো বড়ই বোঝা ছিলাম যে আমাকে জাহান্নামে ঠেলে দিয়েছো?
এভাবে বলছিস কেনো,  কোনো সন্তানই তাদের বাবা মায়ের ঘাড়ে বোঝা হয়না।
বাবা, আমি কি বলেছিলাম তোমার জায়গাজমি বিক্রি করে আমাকে বড়লোক ছেলের কাছে বিয়ে দিতে?
বাবা কতক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন।
মা,  যা করেছি সবই তোর সুখের জন্য।
আমার সুখের জন্য! আমার সুখ। এখন আরো ৫ লাখ টাকা দাও। ৫ লাখ টাকা নিয়ে যেতে বলেছে।  টাকা ছাড়া বাসায় গেলে ওরা আমার সাথে অনেক খারাপ ব্যাবহার করবে।
বাবা, তুমি যৌতুক দিবেনা পণ করেছিলে কিন্তু যৌতুকের বিকল্প দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে গেলে।
বাবা, শুধু বললো, মা তুই চিন্তা করিস না। আমি এখনো বেঁচে আছি।
আলোর গালে কপালে নির্যাতনের চিহ্ন দেখেই বাবা বুঝে নিলেন তার আদরের আলো কতোটা সুখে আছে।
আলোর সারা দেহ জুড়ে যে অত্যাচারের নির্মমতা কাপরে আড়াল করা আছে।  যার যন্ত্রণা আলো লুকিয়ে রেখেছে। তা প্রকাশ করলে বাবা হয়ত সহ্য করতে পারবেনা।
   
বাবা আবারো ধার দেনা সুদের উপরে মোট তিন লাখ টাকা এক সপ্তাহ বসে যোগাড় করলেন। উদ্দেশ্য শুধু মেয়ের একটু সুখ। টাকা সাথে করে নিজেই মেয়েকে নিয়ে গেলেন মেয়ের শশুরের বাসায়। পলকের বাবার হাতে তিন লাখ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে পলকের আবার হাতে ধরে বললেন, আমাকে আর দু মাস সময় দিন বেয়াই সাহেব। দু মাসের মধ্যেই বাকি দু লাখ টাকা যেভাবেই হোক দিয়ে যাবো। আলোর উপরে কোনো অত্যাচার করবেন না।
আলোর শশুড় টাকা পেয়ে একঝলক হাসি দিয়ে বললো। আলো আমাদের মেয়ের মতো ওর উপড়ে কেনো অত্যাচার করবো। কি যে বলেন বেয়াই। আলো আমাদের ঘরের লক্ষ্মী।  ওরা স্বামী স্ত্রী হয়ত একটু ঠুলামুলি করেছে।  তাই আলো রাগ করে বাড়িতে চলে গেছে, আমি ভাবলাম অনেকদিন পরে যখন গেলো কয়েকদিন বেড়াক,  বাদে গিয়ে নিয়ে আসবো,  তা তো আবার আপনিই নিয়ে আসলেন। কি বলবো বেয়াই। আজকালকার ছেলে মেয়ে বাবা মায়ের কথা শুনে ক জন?
আলোর বাবা আর বেশি কিছু বললেন না, শুধু বললেন।
তাহলে এখন আসি বেয়াই, গিয়ে আবার দোকান খুলতে হবে।
দু মাস না যেতেই একদিন খবর এলো, আলো গলায় ফাঁশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। বাবার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।  বাবা বুঝতে পারলো এটা আত্মহত্যা নয়। এটা হত্যা। কিন্তু কেনো? অনেক প্রশ্ন এসে জটলা পাকাচ্ছে বাবার ভারি
বুকের ব্যথার সাথে। বাবা খবর পেয়েই ছুটে গেলেন বরিশালে। বাসায় পৌঁছানোর আগেই পুলিশ লাশ নিয়ে চলে গেছে ময়নাতদন্তের জন্য। বাবা সব কিছুই অনুমান করে বুঝে নিলেন। পলকের বাবাকে কিছুই আর জিজ্ঞেস করেননি। তিনি ভাবলেন ময়নাতদন্তে সঠিক অথ্য বের হয়ে আসবে। তখন তিনি আইনি ব্যবস্থা নিবেন। কিন্তু কি আজব। লাশের ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলছে আত্মহত্যা করেছে আলো। কিন্তু কেনো আত্মহত্যা করেছে তার কারণ কেউ জানেনা। বাবা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার বাকশক্তি রুদ্ধ হয়ে এলো। আলোর বাবা তার জীবনে কোনো দিন থানার দরোজায়ও যাননি, আর মামলা তো অনেক দূরের কথা।
আলোর লাশ দাফন করা হয়েছে তিনদিন হলো, বাবা মায়ের মুখে এখনো কেউ দানাপানি দিতে পারেনি। শোকের ছায়ায় অন্ধকার হয়ে আছে সবকিছু। প্রভাত কেটে ঝলমল করছে প্রকৃতি। ডাকপিয়ন তার সাইকেল নিয়ে কিছুটা তাড়া গতির মতোই থামিয়ে বললো,
হারুন চাচা, আলোর চিঠি আছে।
 সকলেই যেনো অবাক, আলোর চিঠি! ভুল ঠিকানা নয়তো?
 হারুন গাজী কান্না জড়িত ভাবেই বললো। বাবা আমাদের আলো তো নেই, চিঠি লিখবে কে!
চাচা এ চিঠি আরো দশদিন আগের।
দেখিতো।
চিঠিটা বাবার হাতে দিয়ে ডাকপিয়ন চলে গেলো। বাবা উৎসুক হয়ে পড়তে লাগলেন পত্রটি।
এলাহী ভরসা,
বাবা, আমার সালাম নিবেন। আশা করি আল্লাহতালার অশেষ রহমতে আপনারা সবাই ভালো আছেন। আর আমি, আমিও একপ্রকার ভালো আছি বাবা।
   
    পর সমাচার,
বাবা, সেদিন সকাল বেলা যখন আপনি আমাকে দেখেছিলেন। তখন আমার সারা শরীর জুড়ে ছিলো বেতের লাঠির অসংখ্য আঘাত। সারা রাত আমি ছিলাম বাসার দরোজায়, পলকের একটাই কথা ছিলো, টাকা নিয়ে বাসার ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। পলকের বাবা মায়ের নিরবতায় বুঝেছি তাদের ইন্দোনেই আমার উপর এমন অত্যাচার নির্যাতন চলছে। আপনি তিন লাখ টাকা দিয়ে যাবার চারদিন পর থেকে আবার আমার উপরে বাকি দু লাখ টাকা নিয়ে আসার জন্য আমার উপরে চাপ প্রয়োগ করে, আমি শুধু এটুকু বলেছিলাম, তোমাদের এতো সম্পদ থাকার পরেও কেনো পরের টাকার উপরে এতো লোভ। এ কথা বলতে না বলতেই আমার উপর ঝড়ের বেগে নেমে আসে নির্যাতন। বাবা আমি যে এবাড়ির কে, কেনো আমাকে এখানে আনন্দ আয়োজন করে আনা হয়েছে তার উত্তর আজো পাইনি। গত তিনদিন ধরে নাহারে পরে আছি কেউ একবার জিজ্ঞেস করেনা, আমি খেয়েছি কিনা। নম্র ভদ্র মুখোশ পরা যে মানুষ গুলোর প্রশংসা করো সেই মুখোশের আড়ালে এক একটা হায়েনা বসত করে। পলক একটা নেশাখোর মাতাল, দেখে শুনে তোমরা আমায় নরকে পাঠালে বাবা। পলক প্রতিদিন আমায় বলে,  ' মরিস না ক্যান হারামজাদি। হয়তো মরে যা নয়তো তোর বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আয়' বাবা আমি পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি, আমি আর টাকার জন্য বাবার কাছে যেতে পারবোনা। আমাকে যদি ওরা মেরে ফেলে, আমার লাশটা আপনি এসে নিয়ে বাড়িতে কবর দিবেন। আবিদ যেনো আমার লাশটা তার নিজ হাতে কবরে রাখে। এটাই আমার শেষ অনুরোধ।
আর একটা কথা বলি বাবা, আমাদের গ্রামের আবিদ আমায় খুব ভালোবাসতো, কিন্তু আমি কখনোই ওকে পাত্তা দিতাম না।  আমি কখনই চাইনি আমার কোনো কাজে বা সিদ্ধান্তে আপনার উঁচু মাথা নিচু হোক, আমি মনে মনে ওকে ভালোবাসতাম। এই দুনিয়াতে একমাত্র আমি ছাড়া আর কাউকেই সেটা বুঝতে দেইনি। ওর সাথে আমায় বিয়ে দিলেও আপনার এতো বড় ক্ষতি হতোনা। পলকের অত্যাচারে নির্যাতনে আমি বুঝতে পারছি। আমার চারদিক খুব শিঘ্রই অন্ধকারে ঢেকে যাবে।
ইতি,
আপনার আদরের আলো


বাবা পত্রটি পড়ে বাবা অজ্ঞান হয়ে উঠোনে পরে গেলেন। বিকেলে যখন বাবার জ্ঞান ফিরলো, তখন বাবার কন্ঠ থেকে শুধু প্রকাশ হলো, আমার আলো আত্মহত্যা করেনি, আলোকে মেরে হত্যা করা হয়েছে। আলোর পত্রের খবর সারা গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। প্রতিবাদ প্রতিশোধের আগুনে ফুলকে উঠলো গ্রামের সবাই। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর বিচার চায় গ্রামবাসী।  এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে থানায় উপস্থিত আলোর বাবা।
আলো হত্যা মামলায় যাদের আসামী করা হয়েছে তাদের নাম শুনেই চমকে উঠলো থানার দারোগা। দারোগা জিজ্ঞেস করলো, এ আস্বামীরা কি জীবিত নাকি মৃত? আসুন আমার সাথে। থানার সামনেই ক্ষতবিক্ষত তিনটি লাশ পরে আছে, লাশ তিনটি ছিলো, পলক, পলকের বার আর পলকের মায়ের। রাতে অজ্ঞাত খবর সূত্রে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ একই পরিবারের লাশ তিনটি উদ্দার করে। পুলিশের ধারণা তাদের ব্যবসায়ীক জেরেই প্রতিপক্ষ এমন হত্যাকান্ড করেছে। আলোর বাবা লাশ তিনটির দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন। আল্লাহ্‌ বিচার করেছেন। 
চার যুগ বাদে আলোর বাবা যখন বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু শয্যাগত। তখন আবিদ আলোর বাবাকে একবার দেখতে এলো,  আলোর বাবা আবিদের দিকে তাকিয়ে বললো, চিরকুমার ই থেকে গেলি বাবা।
আলোর বাবার কানে কানে আবিদ বলেছিলো। আলো হত্যার প্রতিশোধ আমি নিয়েছি। দেহ আলাদা হলেও ভালোবাসা কখনো আলাদা হয়না কাকা, পরম শান্তির একটা নিঃশ্বাস নিলেন আলোর বাবা। আস্তে করে অস্পষ্ট কিযেনো বলেছেন আবিদের দিকে তাকিয়ে। হয়ত বলেছেন; ভালোবাসার জয় হলো। জয় হোক ভালোবাসার।
   
  ( সমাপ্ত)
      
     ১৮-১-২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন