বৃহস্পতিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৮

প্রচ্ছদ।। মাসিক কুয়াশা।। এপ্রিল সংখ্যা ।। ২০১৮ইং ।।


সম্পাদকীয়ঃ মাসিক কুয়াশা ।। এপ্রিল সংখ্যা ।। ২০১৮ইং।।


সম্পাদকীয়ঃ মাসিক কুয়াশা ।।  এপ্রিল সংখ্যা ।।  ২০১৮ইং।। 
''কুয়াশা' সাহিত্যপ্রেমিদের মনন ও বিকাশ ঘটিয়ে আসতে আসতে ঠিক এতোদূর পথ পাড়ি দিয়েছে। 'কুয়াশা' সকল সঙ্কট উতড়িয়ে একটা সম্ভাবনাময় স্থান দখল করে নিতে পেরেছে জন্য আমার এবং কুয়াশা পরিবারের সকলের গৌরব। দেখতে দেখতে ১২টি সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে। খুব সরলভাবে কেটে গেলো একটি বৎসর। এজন্য সমগ্র সাহিত্য জগতকে কুয়াশার পক্ষ হতে শুভেচ্ছা।

'কুয়াশা' যেমন লেখক তৈরিতে বিশ্বাসী, তেমনি লেখা তৈরিতেও বিশ্বাসী। এখানে লিখে লিখে অনেকে লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন, এটাই 'কুয়াশা'র দাবি। পৃথিবীতে কোন কবিই কোন কবির প্রতিবন্ধক নয়,  নয় বিকশিত পথের বিরুদ্ধ উচ্চারন। প্রত্যকে প্রত্যকের জন্য দর্পনস্বরূপ। এজন্যই কুয়াশায় নবীন প্রবীণের সমাহার। কুয়াশা নবীন প্রবীণের মেলবন্ধনের কাজ করে। সাঁকো হয়ে কাজ করে।

এখানে বলতে দ্বিধা নেই যে, দুই বাংলার কবি লেখকদের সমান সমাদর 'কুয়াশা' করে থাকে। কলকাতার অনেক লেখক নিয়মিত ল্যাখেন, আর আমার প্রিয় বাংলাদেশের কবি লেখকগণতো আছেনই। 

এপ্রিল সংখ্যাটা আরো ভালো করে সাজানোর চেষ্টা করেছি। তবুও কিছু অসঙ্গতি থাকাটা অমূলক কিছু নয়। এর জন্য আপনাদের সুপারিশ ও পরামর্শ একান্তভাবে কাম্য। 

সূচিপত্রঃ মাসিক কুয়াশা ।। এপ্রিল সংখ্যা ।। ২০১৮ইং ।। বর্ষ ২ ।। সংখ্যা ১২।।

সূচিপত্রঃ মাসিক কুয়াশা ।।  এপ্রিল সংখ্যা ।। ২০১৮ইং

প্রবন্ধঃ
চঞ্চল রায়, কবির মুকুল প্রদীপ

গল্পঃ
মোহাম্মদ ইকবাল, জুঁই জেসমিন।

বই আলোচনাঃ
রুবেল পারভেজ।

অণুগল্পঃ
সজল মালাকার, তাইমুর মাহমুদ শমীক,মজনু মিয়া। 

অনুবাদ কবিতাঃ
আর্তুর র‌্যাবোঁ।

কবিতা
নাসির ওয়াদেন, সুধাংশু চক্রবর্ত্তী,
আতাউর রহমান রোদ্দুর, আবু আশফাক্ব চৌধুরী, সিদ্দিক প্রামাণিক, অরণ্য আপন
মৌসুমী মন্ডল দেবনাথ,পূর্ব মিজান,অনিরুদ্ধ দেব, পূবালী রানা, প্রত্যয় হামিদ, গোলাম রব্বানী টুপুল, এ বি এম সোহেল রশিদ, এ কে এম আব্দুল্লাহ, রুদ্রাক্ষ রায়হান।

মুক্তগদ্যঃ
সুনীতি দেবনাথ, দ্বীপ সরকার।

কবিতাঃ
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাসুম মীকাঈল, দীপান্বিতা সামন্ত, এলিজা আজাদ,আবু আফজাল মোঃ সালেহ, ওয়াসীম রহমান সানী, প্রিতম গোর্কি, মোঃ নূরুল গনী,কাজী জুবেরী মোস্তাক, শিশির রায়, কৃপা আচার্য, সুমন আহমেদ, শ্রীলেখা চ্যাটার্জি রেবেকা ইসলাম, বাদল মেহেদী।

প্রবন্ধঃ নববর্ষ ও অসাম্প্রদায়িকতা ।। চঞ্চল রায়

নববর্ষ ও অসাম্প্রদায়িকতা

ঋতুর পরিক্রমায় চৈত্র অবসানে বিদায়নেয় পুরাতন বছর । বিবণ, বিশীণ, জীণ অতীতকে পশ্চাতে ফেলে নতুন বছরের নতুন স্বপ্ন নিয়ে আসে পহেলা বৈশাখ । আসে নববষের সমুজ্জল শুভলক্ষণ । বাঙালির আবহমান জীবন ধারায় নববষ এক বিশেষ তাৎপযের দিন । জীণ ক্লান্ত পুরাতনকে বিসজন দিয়ে নববষ জীবনকে এক নতুন অধ্যায়ে উপনিত করে । উৎসব আনন্দে মেতে উঠে সারা দেশ । অন্যদিকে বাংলা নববষ উদযাপন এখন আর নিছক কোন বষবরণ অনুষ্ঠান নয় , কালে কালে এটা সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতি বছর অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিয়তাবাদী চেতনায় উৎবদ্ধ হওয়ার , নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার উৎসবে পরিনত হয়েছে । নববষ আর নিছক সাংস্কতিক উৎসব নয় , প্রতিবাদ – প্রতিরোধের উৎসব ।  
            পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন । এই দিনে নতুন বছরের শুরু । বাঙালি সমাজে এই দিনটি নববষ হিসেবে পালিত হয় । পুরাতন বছরের ক্লান্তি ,জড়তা ,ব্যাথতাকে পেছনে ফেলে এই দিনে বাঙ্গলি জনগোষ্ঠি এক নতুন সম্ভাবনার স্বপ্নে উদ্বেলিত হয় । পহেলা বৈশাখের প্রথম আলোকে সম্পাতে বেজে ওঠে নতুনের জয়গান । প্রকৃতির পালবলের পটভূমিতে এক নতুন চেতনার আবেগে সকলের কন্ঠে উচ্চরিত হয়ঃ
                      ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো 
                       তাপসও নিঃশ্বাসও বায়ে
                      মুমূষরে দাও উড়ায়ে  
                      বৎসরের আবজনা দূর হয়ে
                      যাক  যাক যাক ।
              পুরাতনকে , ব্যাথ অতীত আর দুঃখ গ্লানি কে ধুয়ে মুছে মানুষ চিরকাল নতুনের স্বপ্নে রচনা করে চলে । মানুষের এই চিরন্তন প্রত্যাশাকে জাগ্রত করে তোলে নববষ ।
              পৃথিবীর প্রায় সব জাতিই নানাভাবে নববষ উৎযাপন করে থাকে । প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী মিশরীয় ,ফিনিশীয়, ইরানীয়রা পালন করতো বলে জানা যায় । প্রাচীন আরবীয়রা ও কাজের মেলায় এবং প্রাচীন ভারতীয়রা ‘ দোল পূণিমার ‍দিনে নববষ উদযাপন করতো । খ্রিস্টান জগতে পহেলা জানুয়ারী নববষ পালিত হয় । মধ্যপ্র‌াচ্যের মুসলিম জগতে নববষ আসে মহরমের আশুরা থেকে ।
              ইরানীয়দের নববষ হচ্ছে ‘নওরোজ’ । ইহাদের নববষ হচ্ছে ‘রাশহাসান ‘। বস্তুত বাঙ্গালি , ইংরেজ, ফরাসি , চীনা , জাপানি প্রত্যেকেই নিজ নিজ নববষ উৎসব পালন করে থাকে । যে যেভাবেই এই উৎসব পালন করুক না কেন থাকে এই নববষের মূল চেতনা হচ্ছে পুরাতন বছরের গ্লানি ও ব্যাথতাকে ভুলে জীবনকে আবার নতুন করে সাজানো । পৃথিবীর প্রতিটি জাতির সংস্কতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে নববষের উৎসব ও আনন্দ এমনিভাবে সংযুক্ত ।
                ষোড়শ শতকে মোগল সম্রটি আকবরের আমল থেকে বাংলা নববষের প্রবতন হয় । সমসায়িক কালে বঙ্গদেশ ছিল মোগল সম্রাটের করদ রাজ্য অথাৎ খাজনা দাতা রাজ্য । খাজনা অদায়ের সুবিধার জন্য এই শুষ্ক মৌসুমকে বেছে নেয়া হয় । বাংলা সনের মূল স্রষ্টা পতেহউল্লাহ সিরাজী । মোগল সম্রাট আকবর যেদিন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন সেই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বাংলা সন ও নববষের প্রবতন করা হয়েছিল । সেই থেকে চাষাবাদ ,খাজনা পরিশোধ ,হিসাব-নিকাশ ,হালখাতা ,তারিখ নিধারণ প্রভৃতি বাংলা বষপঞ্জি অনুসারে পালিত হয়ে আসছে ।    
                 নববষ কেবল প্রত্যাহিকতার জীন জীবন থেকে মুক্তি আর নতুন সম্ভাবনার বাতা নিয়েই আসে না । বাঙ্গালির জীবনে নববষ আসে নানা অনুষ্ঠান আর উৎসবের ডালা সাজিয়ে । পহেলা বৈশাখ বাংলার প্রতিটি গৃহকোন হয়ে উঠে পরিস্কার –পরিচ্ছন্ন । নতুন পোশাকে , নতুন শাড়ি-গহনায় সাজে অনেকেই । হালখাতা , পুন্যাহ, বৈশাখী মেলায় মেতে ওঠে বাংলার গ্রাম –গঞ্জের জনপদ ।
              ‘ হালখাতা নববষের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান । এ দেশের বনিক –ব্যবসায়ী সমাজে সু-প্রাচীন কাল থেকেই হালখাতা প্রচলিত । এই দিনে দোকানী –ব্যাবসায়ী তার দোকান পাট ব্যবসা কেন্দ্র ধুয়ে মুছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে পুরাতন বছরের লেনদেন , লাভ-ক্ষতির , হিসাব-নিকাশ মিটিয়ে নতুন বছরের হিসাব রাখার জন্য খোলেন হালখাতা । ব্যবসা কেনা-কাটার সঙ্গে কিংবা নানা কাজকমে জড়িত যারা তাদেরকে হালখাতার দিনে দই, চিড়া , মিষ্টান্ন ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় ।ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পারিক সৌহাদে হালখাতার দিনটি হয়ে ওঠে আন্তরিকতাপূণ । এই দিনে বকেয়া পরিশোধের কোন তাগদা থাকে না । হালখাতার আপ্যায়ন সৌজন্য মূলক হলেও এই দিনে দোকানি কিংবা ব্যবসায়ীর অনেক বকেয়া পাওনা আদায় হয় । হালখাতার দিনে কেউ বাকির ঘরে নাম লেখাতে চায় না । নববষের দিনে হালখাতার মধ্যে দিয়ে ব্যবসায়ী মহলে আবার নতুন উদ্যমে বেচা-বিক্রি শুরু হয় ।
                 বাংলা নববষের সঙ্গে সংযুক্ত আরো একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান ‘ পূণ্যাহ ’ । নববষের দিনে জমিদার-তালুকদারদের কাছারিতে ‘ পূণ্যাহ ‘ অনুষ্ঠিত হতো । ‘ পূণ্যাহ ’ শব্দের মৌলিক অথ পূণ্য কাযাদি অনুষ্ঠানের পক্ষে জ্যোতিশ শাস্ত্রানুমোদিত প্রশস্ত দিন হলেও বাংলায় এর বিশেষ অথ দাড়িয়ে গিয়েছিল জমিদার কতৃক প্রজা-সাধারণের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানসূচক দিন । এই দিনে প্রজারা নানা উপটোকন সহ খাজনা পরিশোধ করতে জমিদার মহলে উপস্থিত হতো । জমিদার প্রজা-সাধারণকে পান-সুপারি এবং মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন । পূন্যাহ উপলক্ষে কেবল জমিদারের খাজনাই আদায় হতো না । এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জমিদার-প্রজার মধ্যে সম্পকের উন্নয়ন ঘটতো ।খাজনা আদায়ের পাশা-পাশি এ সময় জমিদার প্রজার সুখ-দুঃখের খোঁজ-খবর নিতেন । জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে । তবে পাবত্য অঞ্চলে উপজাতীয় রাজাদের মধ্যে এখনও ‘ পূণ্যাহ ‘ অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে ।
                  বাংলা নববষের একটি অন্যতম আকষণীয় অনুষ্ঠান বৈশাখী মেলা । পহেলা বৈশাখ বাংলর গ্রাম –গঞ্জে বটের মূলে, নদীর কূলে বৈশাখী মেলা বসে । উৎসব মুখর বৈশাখী মূলত একঠি সবজনীন লোকজ মেলা । প্রাণের আবেগ আর উছলে পড়া আনন্দে বৈশাখী মেলা প্রঙ্গণে গ্রাম-বাংলার মানুষ এক অকৃত্রিম উৎসবের আনন্দ খুঁজে পায় ।
                নাগরদোলা ,সাকাস, তাল-পাতার ভেপু, মাটির খেলনা, হাড়ি-পাতিল, কাচের চুড়ি , কারুপন্য, মন্ডা-মিঠাই, বাউল গান, লোকগীতি প্রভৃতির সমারোহ বৈশাখ মেলার এক চিরায়ত ঐতিহ্য । নানা রকম জিনিস পত্রের সমারোহ, নানা বয়সী মানুষের সমাবেশে নববষের আনন্দময় রুপটি প্রত্যক্ষ করা যায় বৈশাখী মেলাতে । আধুনিক সভ্যতা ও ক্ষয়িষ্ঞু অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবলে বৈশাখী মেলা বাঙ্গালির সংস্কৃতিকে ঐতিহ্যের এক চিরায়ত আনন্দ-উৎসব ।
                  নগরজীবনেও বাংলা নববষ জাঁকজমকপূণ আয়োজনে ও উৎসাহে উদযাপিত হয় । এ যেন বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন । এ দেশের বড় বড় মহরগুলো নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যদিয়ে নববষকে বরণ করে নেয় । উদ্যানে , লেকের ধারে , বৃহৎ বৃক্ষমূলে প্রত্যেষে নগরবাসিরা সমবেত হয় নববষকে স্বাগত জানাতে । ছেলেরা পরিধান করে পাজমা –পাঞ্জাবি। মেয়েরা করে লালপেড়ে সাদা শাড়ি কপালে টিপ , হাতে বাহাড়ি রঙের চুড়ি, খোপায় ফুল , গলায় ফুলের মালা । সবকিছু মিলিয়ে বাঙালি জীবনের এক অনিন্দ্য পটভূমি রচনা করে তারা । নানাবিধ রলাক-উপকরণ নববষের আয়োজনকে বণাঢ্য করে তোলে । নৃত্য-গীতি , রঙে-সঙে, পান্তাভাতের আয়োজনে নগরজীবনে এক মোহনীয় আনন্দে বাংলা নববষ উৎযাপিত হয় ।
                 পহেলা বৈশাখের শুভক্ষণে নতুন বছরকে বরণের আয়োজনে রাজধানী ঢাকায় এক বণাঢ্য আনন্দ মেলায় পরিনত হয় । পহেলা বৈশাখের প্রথম আলোক প্রভায় রমনা উদ্যানে ও এর আশেপাশে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ । নববষকে স্বাগত জানাতে রমনা বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীদের কন্ঠ থেকে ঝরে পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাশ্বত আগমনী গান – ‘ এসো হে বৈশাখ এসো এসো । ’ রমণার বটমূলে ছায়ানটের বষবরণ অনুষ্ঠান এক অনবদ্য ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে ।
          ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুল তলার প্রভাঅনুষ্ঠানের স্বাগত জানানো হয় বাংলা নববষকে। চারুকলার ছাত্র-ছাত্রীদের বণাঢ্য র‌্যালিতে নাচে-গানে উপস্থাপন করা হয় বাংলার চিরায়ত রুপকে । চারুশিল্পীদের বণাঢ্য শোভাযাত্রা মুগ্ধ করে অবাল বৃদ্ধ-বণিতা সকলকে । বাউল গান, কবির লড়াই ,কবিতা পাঠ ,আলোচনা সভা ,পুতুল নাচ , বায়স্কোপ , লোক সামগ্রী পসরা প্রভৃতি রাজধানী ঢাকাতে বষবরণের এক অপরিহায অঙ্গ । মাটির সানকিতে ইলিশ ভাজা আর লঙ্কা-পেয়াঁজ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির এক উপভোগ্য নাগরিক আয়োজন। এটুকু ছাড়া বসবরণের বণাঢ আয়োজন নিষ্প্রভ ।
বাংলাদেশের বৃহৎ বাঙালি সমাজের পাশাপাশি রয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন উপজাতীয় নৃগোষ্ঠী । এসব নৃগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। এরাও তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসারে বষবরণ করে থাকে । বাংলা নববষ উপলক্ষে পাবত্য উপজাতীয় নৃগোষ্ঠী আনন্দ মুখোর পরিবেশে তাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ পালন করে থাকে । এ উৎসবকে ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠী ‘বৈসুক ‘ মারমা নৃগোষ্ঠি ‘ সবাই  এবং চাকমা নৃগোষ্ঠী ‘বিজু ‘ নামে আখ্যায়িত করে থাকে । তবে সমগ্র পাবত্য এলাকায় ( রাঙ্গামাটি , বান্দরবান , খাগড়াছড়ি ) এই বষবরণ উৎসব ‘ বৈসাবি ‘ নামে পরিচিত।
           বাংলা নববষ উপলক্ষে জাতীয় পযায়ে কমসূচি গ্রহন করা হয় । এই দিনে বাংলা নববষকে বরণ করার জন্য ‘ বাংলা একাডেমি ‘, ‘নজরুল একাডেমি ‘,‘ নজরুল ইনস্টিটিউট’, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ‘, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ‘, জাতীয় জাদুঘর ‘, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ‘,প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন কমসূচি গ্রহণ করে থাকে । এদিনে রেডিও, টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানপ্রচার করা হয় । বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা গুলো ক্রোরপত্র প্রকাশ করে থাকে ।
           নববষ উৎসব অনুষ্ঠানে একটি সাবজনীন  অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান ।
এ বষবরণকে উপলক্ষ করে বাঙালি জীবনে এক আনন্দময় সামাজিক যোগাযোগ ঘটে । নববষ আমাদের সামনে সম্ভাবনার যে নতুন আহ্বান বয়ে আনে তাকে জীবনের আনন্দ ও কল্যানে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে । নববষের উৎফুল্ল মিলনোৎসবের মধ্য দিয়ে আমাদের সামষ্টিক চেতনা ও মানবিক চেতনা যেন আরো উজ্জীবিত হয় । আমরা যেন ধম,বণ, গোত্র, চেতনার উদ্ধে ওঠে পারস্পরিক প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিনিমাণ করতে পারি সুন্দর ও সমৃদ্ধ আগামী ।
     বাঙালি জাতীয় জীবনে যতগুলো উৎসব বা দিবস আছে , বাংলা নববষ হচ্ছে সবচেয়ে পুরনো অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রধানতম উৎসব । ধম-বণ নিবিশেষে বাঙালি জাতি এ দিবসটি পালন করে আসছে হাজারো বছর ধরে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে । তবে বাংলা নববষ এখন যেভাবে যে রুপে পালিত হচ্ছে তা কিন্তু বেশি দিনের নয় । বাংলা নববষ বা পহেলা বৈশাখ পালনের বতমান যে রুপে তা মূলত শুরু হয়েছে ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বাঙ্গালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অশুভ চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রতিবাদ স্বরুপ । এক কথায় বলা যায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ও বাহক বাংলা নববষ উৎসব এখন বাঙ্গালির প্রানের উৎসবে পরিনত হয়েছে । এমনকি প্রবাস থেকেও অনেকে ছুটে যান ছায়ানটের বষবরণ অনুষ্ঠানসহ অন্য অনুষ্ঠানগুলোতে যোগ দিতে । তবে অশুভ শক্তি বারবার নানাভাবে নববষ উৎসবকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছে ,কখনো বা রাষ্টীয় পৃষ্ঠ পোষকতায় কখনো ধমীয় লেবাসের আড়ালে আবার কখনো বা হত্যা খুনের মাধ্যমে । যা এখনো  অব্যাহত রয়েছে । হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে অতিসম্প্রতি অভিজিত রায় এবং ওয়াশিকুর রহমানসহ মুক্তমনা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ব্লগারদের হত্যা করাও এর অংশ্। উদ্দেশ্য একটাই , মুক্তমনা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার লোকজনকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিনত করা । বাঙালি জাতিকে মেধাশূণ্যকরা , যার শুরু ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজবি হত্যার মাধমে । তবে আশার কথা হলো সমাজ প্রগতির ঢাকা পেছনের দিকে য়ায় না ।
             তাই শত চেষ্টা করেও এই অন্ধকারের অশুভ শক্তি তাদের লক্ষ্য হাসিল করতে পারবে না । এই অশুভ শক্তিকে প্রতিহত এবং জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দমন করতে হলে শুধু রাষ্ট্র বা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয় । রাষ্ট্রীয় উদ্যেগের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি সন্মিলিত প্রতিরোধ ও প্রয়াসই কেবল পারে জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করে নববষ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মানের পক্ষে সুগম করতে ।
            পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙ্গালি জীবনের এক অনবদ্য আনন্দের উৎস । পুরাতন গ্লানি ও ব্যথতাকে পশ্চাতে ফেলে নববষ বয়ে আনে নতুন স্বপ্ন নতুন সম্ভাবনা । কাল বৈশাখীর তাণ্ডব উড়িয়ে নিয়ে যায় জীবনের ব্যথ সঞ্চয়ের জীণস্তপ । নববষ নতুন অনিশ্চিতের সুনিশ্চিত সম্ভাবনার আহ্বান । এই দিনে চির নতুনের প্রথম গানে বিকশিত হয়ে ওঠে সবার জীবন । নববষ জীবনের তুচ্ছতাকে পশ্চাতে ফেলে নতুন আনন্দে যুক্ত হওয়ার এক অবিনাশী প্রত্যয় । বাংলা নববষ উৎযাপন এখন আর নিছক কোন বষবরণ অনুষ্ঠান নয় ,কালে কালে এটা সাম্প্রদয়িকতা  ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতি বছর অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার , নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার উৎসবে পরনিত হয়েছে । নববষ ও অসাম্প্রদায়িকতা নিছক সাংস্কৃতিক উৎসব বা হালখাতার উৎসব নয় , প্রতিবাদ-প্রতিরোধের উৎসব । নববষ ও অসাম্প্রদায়িকতাই পারে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নিমানের পথকে সুগম করতে । তাই নববষ ও অসাম্প্রদায়িকতা হোক আমাদের নতুন বছরের দৃঢ় প্রত্যয় ।
                                      (সমাপ্ত)
      
      
                            

            

প্রবন্ধঃ কবি সালু আলমগীরের কবিতায় 'শূন্যের শূন্যতা, ।। কবির মুকুল প্রদীপ



কবি সালু আলমগীরের কবিতায় 'শূন্যের শূন্যতা,



মানুষ অস্তিত্বহীন,কিন্তু এই সত্যকে আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না,ভাবতেই পারি না মৃত্যুর পরে কিছু নেই।তাই বিভিন্ন তত্ত্ব ছেনে ছেনে কল্পনা করতে থাকি,কল্পনায় সাজাতে থাকি এক অলৌকিক জগত।এই জগতকে কেন্দ্র করে কিছুটা স্বস্তি,কিংবা জীবনের ব্যর্থতার উপশম নিয়ে এক নিরন্তর বাঁচার প্রয়াসের নামই হয়ত জীবন।অথচ আজ বিজ্ঞানের ক্রম অগ্রগতি সেই ভাবনার ছেদ টানে,দর্শন মানুষকে আরও বেশি শক্ত করে,কর্মে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়;তারপরও আমরা ভাবতে থাকি ভাবতেই থাকি,নিঃসংগ হই নিঃসঙ্গতার ভেতরে বাঁচতে থাকি,সুখ দুঃখ কুড়াই।এবং শেষতক আমরা বুঝতে পারি যে সেই শূন্যের দিকেই এগোচ্ছি আমি বা আমরা।শূন্য কী?সেখানে কী কিছু আছে?এই প্রশ্নেরও কোনো সমাধান আজও পাওয়া যাচ্ছে না।তবে গণিতের শূন্য (০) অর্থ আমরা জানি যেমন, 'সহজ ভাবে বলা যায় শূন্য হচ্ছে -১ এবং ১ এর মধ্যবর্তী একটি সংখ্যা ।গণিতে শূন্য পরিমাপ করতে এর ব্যবহার হয়ে থাকে !ধরুন,আপনার কাছে দুটো কলম আছে, আপনার কোন বন্ধুকে এই দুটো কলম দিয়ে দিলেন ।এখন আপনার কাছে কতটি কলম বাকি রইল?এর উওর হবে শূন্য ।এই শূন্য সংখ্যাটি ধনাত্মক সংখ্যাও না এবং ঋণাত্মক সংখ্যাও না ।আর শূন্য অন্যান্য সংখ্যার একটি স্থানধারক ডিজিট হিসেবে ব্যবহৃত হয়(যেমন২০,২০৪,২৮০)উদাহরণস্বরূপ:২০৪ = ২ × ১০০+০×১০+৪×১এটা স্পষ্ট যে শূন্য ধনাত্মক বা ঋণাত্মক সংখ্যা নয়।

তাহলে আমরা বুঝতে পারি শূন্য (০)মূলত শেষ অথবা শুরু।কিন্তু শূন্যতা অন্য বিষয়,শূন্যতা মানুষকে স্থিরতার দিকে নিয়ে যায়,পথভ্রষ্ট করে,আমরা ক্লান্ত হই,উপশমহীন বেদনার অনুভব মৃত্যুতেই মুক্তি খোঁজে।যাকে এক কথায় অটোসাইকোগ্রাফ বলা যেতে পারে।আমরা এই প্রবনতা বিভিন্ন সময়ের কবিদের মধ্যে লক্ষ করেছি,দেখেছি অনেক কবিই উশৃংখল জীবনযাপন করেছেন,কেউ মাদকাশক্ত,কেউ কেউ করেছেন আত্মহত্যা।এর কারণ খুঁজতে দেখতে গেলে দেখা যায় মুনুষ্যজাতির ইতিহাসই প্রকৃতিবিরোধী,প্রকৃতি থেকে বেরিয়ে নান্দনিক জীবনবোধই মানুষের মনে জন্ম দিয়েছে এই শূন্যতার,অপ্রাপ্তির।তবে এই শূন্যতার থেকে মানুষ বেরিয়েও-ছে তাইতো আমরা পেয়েছি আধুনিক পৃথিবী,কিন্তু শূন্যতামুক্তি ঘটেনি,ঘটবেও না কোন কালে।অহর্নিশ মানুষের এই শূন্যতার সাথেই লড়াই চলছে চলবে।যুক্তি দিয়ে এই শূন্যতাকে দমিয়ে যে জীবন,সেখানে নান্দনিকতা নেই,আছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আরো না’নান মতবাদ।আর কবির যে জীবন সে জীবন এই শূন্যতাকে লালন করেই,শূন্যতার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে নিরন্তর তার রহস্যসন্ধান করে যাওয়া কবির কাজ।শূন্যতার ভেতরে কি আছে?নাকি কিছু নেই?যদি বলি নেই;সেটা মেনে নেয়ার ক্ষমতা মানুষের নেই।যদি বলি আছে,তবে কি আছে?যেমন জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’ (বনলতা সেন)কি এই অন্ধকার?এক কথায় জানি না।কিন্তু নিঃসঙ্গতায় খুঁজতে বসি,কিছু নেই জেনেও খুঁজতে ভালো লাগে,দুঃখে,কষ্টে,একাকিত্বে আমরা এই শূন্যতার দ্বারস্ত হই;ভাঙ্গিগড়ি।হয়ত এই খেলার অপর নামই জীবন।

ব্যক্তি বিশেষ এই শূন্যতার ধরণ আলাদা,তার মধ্যেই আমরা একে অপরের সাথে মিল খুঁজি।আর বিজ্ঞানের কন্ট্রাম গবেষণা বলে মিল আছেও;সেখান থেকেই তৈরি হয় মানুষে মানুষে মিথক্রিয়া।আর তখনই ব্যক্তি চেতনা সামগ্রিকতায় মিশে যায়,যা আমরা দেখেছি কবিতায়,নাটকে।কি রাজা ইডিপাস,অথবা রক্ত করবী,টি এস এলিয়েট,শেলি কিংবা এগডার এলান পো থেকে জীবনানন্দ।কবি সালু আলমগীরের কবিতায়ও আমরা দেখতে পাই এই শূন্যতার।হয়তো এর পেছনে কাজ করে কবির বেড়ে ওঠা,সামাজিক রাষ্ট্রীক রাজনীতি,অর্থনীতি,ধর্ম,মিথ মূলত এই সবকিছু মিলিয়ে কবির জীবনযন্ত্রণা,আর এর পেছনে থাকতে পারে প্রিয়জন হারানোর বেদনা,প্রজন্মের জন্য হতাশা,অসুখ।যেমন কবি সালু আলগীর লিখেছেন,-

লিখেছো যথার্থ পঙক্তি-
রৌদ্রদিন,স্পর্শ আর হতাশার
এইবার বিদায়ের পালা
দিঘল দিনের বিকিকিনি হয়েছে অনেক।

দিঘল সূত্র(কফিন কাঠের ঘুম)

এখানে আমরা বুঝতে পারছি কবি কোন বিদায়ের কথা বলছেন।নিশ্চিত সেই মৃত্যু খুব কাছেই আমাদের।এই সত্যকে মেনে নিতেই হবে,এই বেদনাকেও মেনে নিতেই হবে,যেনো নিয়তি নির্ধারিত হয়ে আছে।কিন্তু কেউকি এই বিদায় সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেন!বলা সহজ,তবে মোটেই সহজ নয়।এখান থেকেই শুরু হয় খোঁজ,যাঁরা ধার্মিক তাঁদের মতে এরপর আছে সেই জগত,যাকে বলে স্বর্গ,সেখানে মৃত্যু নেই;শুধু সুখ আর সুখ।কিন্তু ধার্মিকের মতেই সেখানে পৌঁছানো সহজ নয়,আছে পাপ-পুণ্যের সিঁড়ি সে সিঁড়িও মানুষের পক্ষে অতিক্রম সম্ভব নয়।তাহলে বোঝা যায় ধার্মিকও এই শূন্যতাকে অস্বীকার করতে পারেন না।আর বিজ্ঞান আজ যেখানে এসেছে সেখানে মৃত্যুপরবর্তি কিছু নেই,শুধু শূন্য ছাড়া।এর কোনোটাকেই মানুষ সহজ ভাবে নিতে পারে না,নিজের ভেতরে নিরন্তর খোঁজে খুঁজেই চলে;আর তৈরি করে শূন্যতার জগত।

আবার এই শূন্যতা আছে জৈবিকতায়ও যেমন কবি সালু আলমগীরের লেখা আর একটা কবিতার আংশে দেখি তিনি লিখেছেন,-

পাঞ্জেগানা মনু ভাই ওজু ধরে রাখে
দিনি মেহনতে আবারও চিল্লায় গেলো
এবারে একশ বিশ

কীসের আশায় ভাবী দরজা ভিড়িয়ে রাখে
খুলে রাখে সুরক্ষা কপাট?

পড়শি(কফিন কাঠের ঘুম)

কি গেলো কিংবা কেন ভাবী খুলে রেখেছে সুরক্ষা কপাট?এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজি,অনুভবও করি কিন্তু প্রকাশ করতে পারি না;এও এক শূন্যতা।মানুষ জীবনে যত কিছু পাক তবুও মনে হবে পাইনি কিছুই।এই সূত্রে কবি অরিন্দম গাঙ্গুলীর একটি প্রবন্ধের কথা মনে পড়েছে, ‘আকাশ ছোঁয়া ইমারত অতলান্ত হতাশা’।তবে আমরা জানি এই পৃথিবীতে মানুষ কেন,কোনো কিছুই চির অবিনশ্বর নয়;যেমন নগ্ন হয়ে এসেছি ঠিক সেভাবেই ফিরতে হবে।আবার এমন নয় যে মানুষ একা বলেই একাএকা বাঁচতে পারে,না তাও পারে না বরং সামগ্রিকতায় বাঁচার মাঝে এই শূন্যতা কিছুটা আড়াল হয়।কবি সালু আলমগীরেই এই চেতনা কিছুটা রোমান্টিকতার লগ্ন,রোমান্টিক কবিতায় আমরা দেখি এই শূন্যতাকে ঈশ্বর রূপে কল্পনা করা হয়;তবে রোমান্টিক ধারার যে দাসত্ব তা নেই কবি সালু আলমগীরের কবিতায়।বরং বলা যায় আধুনিক দর্শনের মাঝে যেনো কিছুটা রোমান্টিকতা উঁকি মারছে।এই প্রসঙ্গে কবি সালু আলমগীর বলেন,- ‘রোমান্টিকতাকে অস্বীকার করে কবিতা হয় না’।যাই হোক এখন খুঁজে দেখার বিষয় এই যে,কবি সালু আলমগীর রোমান্টিকতার শূন্যতার থেকে কীভাবে মুক্তি খুঁজেছেন;নাকি খোঁজেননি!সেই হতাশা, শূন্যতার মাঝে বিলিন হওয়াই সার কথা এই বোঝাতে চেয়েছেন?কিন্তু আধুনিক মানুষতো এর থেকে মুক্তি খুঁজবে,নেই জেনেও খুঁজবে।তাহলে আমাদেরও বুঝে নিতে হবে যে,কবি কি মুক্তি খুঁজেছেন,না খোঁজার গতি বাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে,নাকি শূন্যতার মাঝে বেঁচে থাকার সাহস যুগিয়েছেন।

হয়তো এর কোনোটাই কবির কাজ না,তাঁর কাজ কবিতা লেখা।আর পাঠকের কাজ কবিতাকে নতুনরূপে আবিস্কার করা।কবিতায় একসময় শুধুই রসের কারবার চলতো ,আজও চলে;কিন্তু বর্তমান আধুনিক উত্তরাধুনিক কবিতা শুধু রস সর্বোস্বে চলে না,অর্থময়তারও দাবী করে।কবি সালু আলমগীরের কবিতায়ও অন্তর্নিহিত অর্থ আছে।এখন বিষয়টা হোলো,বাস্তব,পরাবাস্তব,অধিবাস্তব,অতিপ্রাকৃত,ব্যাপারগুলি এক নয়;এর প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বৈচিত্র আছে।বাস্তবতা কী?অনেকের খুব সহজে বাস্তবতার যে সংজ্ঞা দাঁড় করেন,তা আসলেই বাস্তবতা নয়,শুধু ক্ষণিকের জন্য মনে হয় যেনো এই বাস্তব;পরে নিজের ভেতরেই সে প্রশ্নবাণে আপেক্ষিক হয়ে যায়।তাই বাস্তবতা কী এই দ্বন্দ্বের আজও শেষ হয়নি।আবার পরাবাস্তবতার অপ্রয়োজনীয়তা নিয়েও অনেক আলোচক আলোচনা করেন,কিন্তু আমি মনে করি পরাবাস্তব মানেই বাস্তব বহীর্ভূত কিছু নয়;সমকালীন অস্থিরতার অভিঘাতেই কবি মনে পরাবাস্তবতা,বা কল্পনা আসে।কেউকি এমন স্বপ্ন দেখেছেন যা আপনি কোথাও দেখেন নি,বা কল্পনা করতে পারেন নি?কল্পনা ততটুকুই যা বাস্তবেরই অংশ।আর বুস্তুবাদী বাস্তবতাই যে কেবল বাস্তবতা তা কিন্তু নয়,বস্তুর প্রয়োজনীয়তা ফুরায়,চাহিদাও পালটায় তাই বলা যায় এর বাস্তবতা স্থির বা চিরস্থায়ী কিছু নয়।তবে এই নিয়েও কবিতা লেখা হয়,তার প্রয়োজনও আছে,আবার সেই পরম মুক্তির খোঁজের কবিতাও দরকার আছে,কারণ বস্তুজগতের প্রয়োজনীয়তা ফুরাবেই;আর তাই মানুষ আত্মিক মুক্তিও খুঁজবেই।পরম মুক্তি বলতে ঈশ্বর সন্ধান না,বরং আমরা কোথা থেকে এলাম কোথায় যাব এই প্রশ্ন আজ নিশ্চিত হয়ে আছে।কিন্তু মানব দেহের ভেতরে যে প্রাকৃতিক রহস্য সেই রহস্যকে উপলব্ধি করাই এর মূলে,যা করে গেছেন লালন।এই খোঁজে যে আত্মশুদ্ধি দরকার,সেখানে পৌঁছোতে নিজের সাথে নিজেকে লড়তে হয়,লড়তে হয় রিপুর সাথে।মৃত্যুর পরে এই সাধনা হয় না,বা জন্মের আগে।

কবি সালু আলমগীরের কবিতায়ও আমরা এই খোঁজের প্রয়াস লক্ষ করি যেমন,-

সুগন্ধরাতের কাছে
নারী আর ঘর উভয়ে গোপন
মূলত প্রতিটি নাভির নিচেই
হিম পাহাড়ের ধস সফল মৃত্যুর অন্ধকার

পাহাড়ধস(কফিন কাঠের ঘুম)

এই অন্ধকার যে শূন্যতার,এটা উপলদ্ধি করা খুব কঠিন নয়,তবে এ যেমন বুস্তুবাদী বাস্তব,তেমনই শুধু বস্তুবাদী বাস্তবতায় এর বিশ্লেষণও সহজ না;তাই ফ্রয়েডিও মনোবিকলন তত্ত্বে প্রভাবিত বেঁত দ্বারা নির্ধারিত পরাবাস্তবতার কাছে যেতে হয়।আর তখনই বুঝতে পারি এই কবিতা শুধু বস্তুবাদী বাস্তবতা নয় বরং বাস্তব আর কল্পনার সংমিশ্রণ যা আমাদের সেই শূন্যতারই অনুভব করিয়ে দেয়।

কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয় যে,কবি সালু আলমগীর তাঁর কবিতায় শুধু এই নির্বেদ শূন্যতার মায়াজাল রচনা করেছেন,বরং বলা যায় তিনি তাঁর কবিতায় জীবন বোধের না’নান দিক,বহুমূখি জটিলতা এক কাতারে বাঁধতে স্বক্ষম হয়েছেন।আমার আলোচ্য বিষয় যেহেতু এককেন্দ্রিক শূন্যতা তাই আমি এর বাইরের ভাবনাকে মূখ্য হিসেবে দেখাতে চাইছি না,কারণ তাহলে আলোচনা ঘোলাটে হয়ে যাবে,অন্য রসদ নিয়ে অন্য কেউ আলোচনা করবে নিশ্চয়ই পরে।এই তো শেষ নয়,বরং শুরু।

আর কবি সালু আলমগীরের সাথে কথাসূত্রে বহুবার এই আলোচনা হয়েছেও যে,তাঁর শরীর দীর্ঘ কঠিন কর্কট রোগে আক্রান্ত থাকার দরুন,মৃত্যুচেতনা বা তার শূন্যতা বারবার বহুভাবে স্বতঃস্ফূর্ত এবং ভিষণ সাবলীল উপলব্ধির মধ্যে দিয়েই এসেছে যেমন,-

সৃষ্টি ও লয়ের মধ্যে প্রাত্যহিক ঝুলে আছি
জন্মমুহূর্ত থেকেই
মৃত্যু পেছনহাঁটা কুকুর
ঘ্রাণ চিনে চিনে
ঠিক তার লক্ষ্যবস্তু স্থির রাখে

গন্তব্য(কফিন কাঠের ঘুম)

আমি এর আগে কয়েকটা প্রশ্নের উল্লেখ করেছিলাম যেমন,কবি কী এই শূন্যতার থেকে মুক্তি খুঁজেছেন?না খোঁজের ব্যাপারে পাঠককে উস্কে দিয়েছেন?কিংবা খোঁজার চেষ্টাই করেন নি?তো শেষপর্যন্ত এসে যেটা বুঝতে পারি তা হোলো,কবি তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে এটাই পরিস্কার করতে চেয়েছেন যে,বেঁচে থেকে শুধু শারীরিক যন্ত্রণার কাল্পনিক মুক্তি খোঁজা ছাড়া মানুষের আর উপায় নেই।আর তা সেই শূন্যতার অন্ধকারে আটকে থাকে,যার থেকে পাঠক তাঁর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী রস আস্বাদন করে;এই রস বোধোর মধ্যে বিশেষত করুণ রসই বেশি প্রবল হয় আর তাকে বীর রসের দ্বারা জয় করার প্রবনতা লক্ষ করি আমরা।যেমন,-

তোমার লোভের তাবৎ ইশারা
নিয়তই গুঁড়িয়ে দিই
পায়ের উচ্ছ্বাসে
সুপ্রকাশ হই নিকট দূরত্বে
চুপকথার আলিঙ্গনে বলি
মৃত্যু দিয়েই আমি পেতে চাই
জন্মের পূর্ণ স্বাদ

জন্মস্বাদ(কফিন কাঠের ঘুম)

কিংবা

অনেকেই হেরে যায় জেনেও
বারবার হেরে যাবে কোনো বেকুব জুয়াড়ি
আর এইসব বিষণ্ণ উৎসব শেষে
ঝরাপাতায় মুদ্রিত হবে কেবলই চলে যাওয়া
চলে যাওয়া...

মুদ্রিত প্রস্থান(কফিন কাঠের ঘুম)

অনেক পাঠক এই শূন্যতাকে পরম বা স্রষ্টা কিংবা সত্তা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন;ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তো বহু ভাবে করাই যায়।কিন্তু কবি সালু আলমগীরের সাথে দীর্ঘ আলোচনা সূত্রে জেনেছি তিনি মৃত্যুপরবর্তী কোনো সত্যতে বিশ্বাস রাখেন না,তিনি খোঁজেন প্রকৃতির রহস্য মনব মনের গহিনে বাসরত সেই পরম সত্তা।এতে করে কবি সালু আলমগীরের কবিতা পাঠ করে জীবন আরও অর্থবহ হয়ে ওঠে,বারে মূল্যবোধ,সংবেদন।আর বেঁচে থেকে মৃত্যুকে জয় করার সাহস যা কবি নিয়তই জুগিয়ে চলেছেন।যে ভাবনা আজ আমাকেও পালটে দিয়েছে অনেকখানি।






গল্পঃ অনঘ লগন ।। মোহাম্মদ ইকবাল

অনঘ লগন 


ঘুম ভাঙ্গার পর চলচ্চিত্রের দৃশ্যপটের মত মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে গত রাতের ঘটনাবলী মেঝেতে পড়ে থাকা মেয়েলী অন্তর্বাস দেখেই সম্বিৎ ফিরলো
তড়িঘড়ি পাশের ফ্লাটে তোমার দরজায় গিয়ে দেখি দরজায় তালা!
ফোন,ফেইস বুক, কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না টেবিলে রেখে যাওয়া তোমার চিরকুট ততক্ষণে পেয়ে যাই।
তাতে লিখেছ;
তোমাকে অবজ্ঞা কিংবা দুরে ঠেলে দেয়া কখনই অবলেহা ছিল না। ছিল বিশুদ্ধ গভীর প্রেম!
যখন জেনেছি শরীরে বাসা বেঁধেছে সংক্রামক মরণ ব্যাধি তখন থেকে তোমাকে সব সময় সুকৌশলে দুর রাখার চেষ্টা করেছি!
কিন্তু দেখো নিয়তির কাছে আমরা কেমন অসহায়!
নিয়তি যা চেয়ে ছিল আমার সহস্র চেষ্টায় তা রোধ সম্ভব হল কি!?

মনে পড়লো গত রাতের ঘটনা;
মন থেকে তোমাকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতে নামী  কড়া ব্যান্ডির তীব্র নেশায় ডুবে আছি নিঃসঙ্গ! 
আমাকে অবজ্ঞা, দুরে ঠেলে দেয়ার প্রবনতায় দ্বিধান্বিত, বিভ্রান্ত, অপমানিত আমি!

নৈশ্যপ্রমোদ শেষে বাড়ী ফিরছো!
লিফ্ট থেকে বের হয়ে এলোমেলো পায়ে কোনো ভাবেই ফ্লাটের ফটকে পৌছাতে পারছোনা!
নেশা পুরোপুরিভাবে তোমাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে! সহায়তার হাত বাড়ালাম, কিন্তু চাবির সন্ধান মিলছে না।
বাহিরে ঘন তুষারপাত, 
তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কয়েক ডিগ্রী নিচে!
অনুষ্ণতা রীতিমত হাত পায়ে হুল ফুটাতে শুরু করে দিয়েছে, গত্যন্তর না দেখে ঘরে তোলে প্রথমেই ভারি কম্বলে জড়াই,কালবিলম্ব না করে ফায়ার প্লেসের আগুনটা দেই উস্কে,মাথায় জড়িয়ে থাকা বরফ কুঁচি সরিয়ে দিয়ে আলতো করে কপালে অধরের ছোঁয়া দিতেই দুচোখ বেয়ে নেমে আসে অবেগী ধারা!
নিবিড় আলিঙ্গনে বেঁধে নিলে আমাকে!
এরই মধ্যে কখন পূর্ণ যৌবনা নারী হয়ে উঠলে!
নেশায় মাঝে নিখাদ ভালোবাসার প্রবল টান প্রণয়কে আরো ছন্দায়িত করে তোলে!!
প্রমিক আমি অবলিলায় হয়ে উঠি প্রেমিক পুরুষ! 
প্রাণের সাথে মিশে প্রাণ,শরীরের সাথে শরীর!

তুমি আরো লিখেছো;
মৃত্যুকে ভয় নেই তবে, চোখের সামনে ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে তোমাকে দেখা সম্ভব নয় তাই দুরে সরে গেলাম,অনেক দুরে,চিরকুটে দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো!

আজকাল দিন কাটেছে বিষণ্নতায়,সংক্রামক ব্যাধি পুনর্বাসন কেন্দ্রে! আমার জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষটি বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা!
অসুস্থতার কারণ জানার পর একে একে সবাই ছিন্ন করেছেন প্রায় সব রকমের যোগাযোগ, বিন্দুমাত্র দুঃক্ষবোধ নেই তাতে।কেন্দ্রের সামনের ঝীলের জলে পানকৌড়িদের জলকেলির দৃশ্য পুনশ্চ কবি হতে উদ্বুদ্ধ করে,নৈসর্গিক নান্দনিকতা এখনো স্পন্দিত হয় হৃদয়!

সময় যেন এখন আর কাটতেই নারাজ! 
একাকিত্বের নির্দয় চাবুক বাতাসে শিস কেটে যায় সাপের ছোবলের মত,অপেক্ষার অসহায় পিঠ রক্তাক্ত হয় সময়ের আঁচড়ে!

তুমি বেঁচে আছো? 
না কি নেই? 
জানিনা!
মৃত্যুর প্রহর গুনছি প্রতিনিয়ত!
তবুও প্রষন্নতা এবং আত্মতৃপ্তিতে মন!
এই ভেবে;
প্রেমহীন অনন্তকাল বেঁচে থাকার চেয়ে শ্রেয়
আমাদের এক পলকের সেই নৈকষ্য প্রণয়ী অনঘ লগন!

গল্পঃ সম্মান ।। জুঁই জেসমিন


সম্মান


তাজমিন শহর থেকে বাড়ি ফিরার পথে চান্নু চোরের সাথে দেখা, তাজমিনের নিজ এলাকার মানুষের সাথে দেখা হওয়ায়, তার প্রাণ খুশিতে নেচে উঠে, যেন সারা পাড়া ও মানুষজনকে মমতায়, বুকে আঁকড়ে ধরতে মন চায় তার- চান্নুকে হাসি মুখে সালাম করে বলে, " চান্নু ভাই আসলামু আলাইকুম, কেমন আছিস ভাই, ভাল? চান্নু বড় অবাক হয়, জীবনো কেউ তাকে সালাম করেনি, আজ তাজমিন তাকে সালাম করছে, যেন অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ভেবে, খুশিতে তার বড় বড়, যুগল চোখে- চৈত্র দুপুরে বর্ষার ঢল নামে।
তাজমিন জিজ্ঞেস করে, কি ভাই, তোর কি শরীল ভালানা? কান্দেছিস নাকি,---?
চান্নু- না বহিন কান্দিম ক্যানহা? কতদিন পর তোক দেখিনু, মোর বেটি আর তুই তো এক সমবয়সী। তোক দেখে হামার পারুলের কথা মনে পড়িল। তুই তো পড়ালেখা করেছিস, আর হামার মাই, সংসারত বাচ্চা কাচ্চা লে আসান নাই। "
চান্নু চোর কথা টা ঘুরিয়ে, তার মেয়েকে নিয়েই বিড়বিড় করে বলতে থাকে।
তাজমিন সব শুনার পর কিছুটা বিস্মিত কন্ঠে আহারে বাছা! এই বলে, বিদায় নেয়।
চান্নু জনশূন্য মাঠে কাঁঠাল গাছ আঁকড়ে চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদে। সংসারের অভাবে সে চুরি করতে বাধ্য হয়েছে, কচি কচি সাত সাতটা ছেলে মেয়ের মুখে আহার দিতে, দিন মজুর করেও হয়না। বাধ্য হয়ে রাতের বেলায়, যার তার ঘরের মুরগী, হাঁস, পাতিল কড়াই এসব চুরি করে - দূর গ্রামে তা বিক্রি করে চাল ডাল বস্ত্র -স্ত্রী সন্তানদের জন্য, কিনে নিয়ে আসতো।
চান্নুর ছেলে মেয়ে আজ অনেক বড়, ছয় ছেলেই বিয়ে করে ঘর সংসার করছে, ছেলেরা যখন থেকেই ইনকাম করতে শিখেছে এবং মোটামুটি জ্ঞান হয়েছে তাদের, সেই থেকেই বাবাকে চুরি করতে নিষেধ করে।
ছয় ছেলেই রিকশা চালিয়ে সুন্দর ভাবে জীবন সংসার চালায়, তারা এক মাস করে ভাগ করে নেয়,বাবা মাকে খাওয়াপরা ব্যাপারে। বড় ছেলে বলে, বাবা মাক হামা আলাদা থাকিবা খাওয়াবা দিমোনাই, হামরা ছয় ভাই, প্রত্যেকেই এক মাস করে বাবা মাক খাওয়াবো। সুবিধা অসুবিধা দেখিমো চিকিৎসাপাতি করিমো। "
চান্নু ভাবে, "বেটালার সংসারেত দুজন স্বামী স্ত্রী খাচ্ছি পরছি। " চান্নু, তাজমিনের একদিনের প্রথম সালামে জীবনের সংজ্ঞা খুঁজে, খুঁজে জীবনের অর্থ আর দশ জন মানুষের মতো যশ সুনাম, সম্মান -!
বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, অথচ আজ পর্যন্ত কারো কাছে সম্মান পেলোনা, সালাম পেলোনা! চান্নু চোর নামেই যতটুকু সমাজে পাওনা, পরিচিতি।
চান্নুর বুক হাহাকার করে, হঠাৎ সালাম ও সম্মান পেতে- তাজমিনের ব্যবহার দেখে।
সে আযানের সুরে সুরে বিধাতার কাছে হাত তোলে - সম্মান পেতে!
ক্রমশ আযান শুনতে শুনতে তার আযান মুখস্থ হয়ে যায়, সু মধুর কন্ঠে আযান দিতে পারে নিজে নিজে। মসজিদে গিয়ে পড়ে থাকা শুরু হয়, তার আর এক জীবন। এক সময় মসজিদে যিনি আযান দেন তিনি হঠাৎ দেশের বাড়ি চলে যান, মসজিদে কে আযান দেবেন সময় মতো, সহী শুদ্ধ ভাবে? এমন মানুষ,,,,
হঠাৎ গ্রামের কয়েকজন ছেলে মজলিসে বলেন, অপরাধ মাফ করবেন, চান্নু ভাই আযান দিলে কেমন হয়,? তাঁর সবাই আমরা আযান শুনেছি, অনেক সু মধুর। "
তাছাড়া চান্নু ভাই তো বেশির ভাগ সময় তো মসজিদতেই পড়ে থাকে,নামাজ কালাম পড়ে।, "
চান্নু- এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব শুনে ভয়ে কাঁপতে থাকে- না জানি কেউ এই বলে উঠবে- চান্নু তো চোর, চোর হয়ে আযান দেবে? এই ডা কেউ মাইনবোনা।"
কিছু মানুষ ব্যাপারটা আপত্তি করলেও শেষমেশ চান্নুর ওপর দায়িত্ব পড়ে আযান দেওয়ার। চান্নু ডুকরে কেঁদে ওঠে---,
অনেকজনে তার মনে সাহস জোটায় পিঠ চাপড়ে। চান্নু ভাই চিন্তা করিস না, তুই পাড়িবো, হামরা তো আছি!"
চান্নু খুশির হাওয়ায় বাড়ি ফেরে-
সে তার বউকে ভীষণ ভালবাসে, একসাথে খাওয়া, ঘুমানো, তাদের মহব্বত এতো টাই লোভনীয়,, অনেকেই তাদের দেখে বলে শালিক পাখির জোড়া। বউকে জড়িয়ে খুশির খবর টা সে দেয়।
" সাদিকা সাদিকা মুই আজ থেকে মসজিদে আযান দিমু, কপালে চুমু খেয়ে বলে "ও বউ তুই খুশিতো? জানিস, মোর জীবনো মুই এমন খুশি পাওনিরে,,,সাদিকা!"
বউ বলে গলা জড়িয়ে" মুইও খুব খুব খুশি খোদা যাতে হামার সব গুনহা মাফ করে দেয় গো।"
চান্নু বলে, " আমিন।"
পরদিন হতে চান্নু আযান দেওয়া শুরু করে ফজর হতে এশা-
গ্রামের সব ছেলে মেয়ে মুরুব্বী, চান্নুকে সালাম করে এখন রোজ, সম্মান করে, ভাল ভাবে কথা বলে। চান্নুর এই যেন জীবনের বিরাট পাওয়া। সে এখন মুয়াজ্জিন নামেই পরিচিত। চান্নু তার অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের জন্য তাজমিনকে ভুলতে পারেনি, আর পারবেওনা কখনো কোনদিন।

বই আলোচনাঃ কাঠ কয়লার ধারাপাত ।। রুবেল পারভেজ

কাঠ কয়লার ধারাপাতঃ হোমায়রা মোর্শেদা আখতার
বইয়ের নামঃ কাঠ কয়লার ধারাপাত
লেখকের নামঃ হোমায়রা মোর্শেদা আখতার
ধরনঃ কবিতার বই 
প্রকাশনীঃ ছায়াবীথি
প্রচ্ছদশিল্পীঃ ধ্রুব এষ
পৃষ্ঠাঃ ৪৮
মূল্যঃ ১৫০ টাকা

আধুনিক বাংলা কাব্যসাহিত্যে একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য দুঃখবাদ ও ক্ষণজীবনবো। যা বর্তমান সময়ের জীবনঘনিষ্ঠ হৃদয় সচেতন কবি হোমায়রা মোর্শেদা আখতার এর কবিতার মূলসুর এবং তাঁর কবিতার স্বর।এবং সেই সাথে শৈল্পিক চেতনায় তা নবতর সুরের সাধক।এছাড়াও সৌমার্য, সৌজন্য ও শ্রেয়োসংবিদের অনটন আধুনিকতার অন্যতমলক্ষণ। যা তাঁর কবিতায় অরূপ সৌন্দর্যের পেলবে বাঙময় হয়ে উঠেছে ধ্যানস্থ উচ্চারণে। 
তাঁর ‘কাঠ কয়লার ধারাপাত’  কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘বোধ’ এ উচ্চারিত হয়েছে সেই চিরচেনা স্বরূপ, জীবনঘনিষ্ঠতার বোধিতায়তনে জীবন জিজ্ঞাসার আদলে। ব্রিটিশ কবি ও সমালোচক ম্যাথুউ আর্নল্ড কবিতা সম্পর্কে স্বগতোক্তি করে বলেছেন, ‘Criticism of life’ অর্থাৎ জীবন-দীপিকা বা জীবন-জিজ্ঞাসা।  কবির এই জীবন-জিজ্ঞাসাই কবিতাকে বিমূর্ত করে তুলেছে।  ‘জীবন কি কখনও শুদ্ধতম হয়?’ এ জিজ্ঞাসা যেন কবির নিজের কাছেই। বোধের নিগঢ়ে ধাবমান জীবনের বোধ ক্ষয়ে গেলে পড়ে থাকে বোধের কঙ্কাল। পাপপুণ্যের বিচার জীবনের জঞ্জাল মনে হয়। জীবন সময়ের প্রবহমানতা নাকি সময়ের কড়িকাঠে ক্রুদ্ধ বয়স, বয়স কি জানে শুদ্ধতম জীবন কি?। কবির মনে প্রশ্ন জাগে। কবি মনে করেন, জীবন মানে হারায়, জীবন মানে পাল্টায়। মূলত, গতিশীলতা-ই জীবনের ধর্ম আর স্থবিরতা মৃত্যুর নামান্তর।

জীবন কি কখনও শুদ্ধতম হয়?
বোধের নিগঢ়ে দূরন্ত জীবন যে ধাবমান
বোধ ক্ষয়ে যায়, থাকে কেবল বোধের কঙ্কাল,
পাপপুণ্যের বিচার সেও কি জীবনের জঞ্জাল!
জীবন কি তবে সময়ের প্রবহমানতা
নাকি সময়ের কড়িকাঠে ক্রুদ্ধ বয়স
বয়স কি জানে শুদ্ধতম জীবন কি?
তাই জীবন মানে হারায়
              জীবন মানে পাল্টায়।
রয়ে যায় শুধু মুখোশ
না মুখোশের আড়ালে খোলস।
                              (বোধ)


বোধের গভীরে ‘রয়ে যায় শুধু মুখোশ/ না মুখোশের আড়ালে খোলস’। কবিতার শেষ লাইনে সমার্থক উপমা ‘মুখোশ’ এবং ‘খোলস’ ব্যবহার করায় শেষটা ঠিক জমে ওঠেনি। মুখোশ অর্থ বাইরের আবরণ এবং খোলস অর্থও বাইরের আবরণ। এখানে ‘মুখোশের আড়ালে খোলস’ এর পরিবর্তে ‘মুখোশের আড়ালে মুখ’ বা অন্য কোন বিপরীতার্থক উপমার ব্যবহার হলে পঙ্‌ক্তিটি অর্থবোধক হতো।

কবি বিনয় মজুমদার তাঁর ‘ভালোবাসা দিতে পারি’ কবিতায় আক্ষেপ করে বলেছিলেনঃ ‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?’  প্রকৃতঅর্থে সত্যিকারের ভালোবাসা যেমন পাওয়া কঠিন তেমনি সেই ভালোবাসা গ্রহণ করাও কঠিন। আর কেউ যদি সেই ভালোবাসা একবার পেয়ে যায় তাহলে তার জন্য একজীবন হেসে খেলে পার করে দেওয়া অনেক সহজ। কেননা, ভালোবাসার জীবন অনেক সংক্ষিপ্ত হয়। কবি হোমায়রা মোর্শেদা আখতার এর ‘সুখ ছন্দ’ কবিতায় সেই একমাত্র প্রেমের সুরই অনুরণিত হয়েছে সচেতনতার দিদৃক্ষায়।

এক জীবনে একটা প্রেম
বাঁচার জন্য মন্দ কি?
সুখের অসুখ আছে কি জানি
অসুখের সুখ ছন্দ কি?
এই তো ভালো একটা প্রেম
এক জীবনের ভালোবাসা
বেঁচে থাকার শান্তি আশা।
                   (সুখ ছন্দ)

কবি মালতিময় সন্ধ্যায় তাঁর দাদিমার সাথে খুনসুটি করতে করতে হাসনাহেনা ভিজে যাওয়া জ্যোৎস্নায় শুনতেন রূপকথার ডালিমকুমারের গল্প। যে ডালিমকুমার একদিন রাজকন্যা কঙ্কাবতীকে তার বাবার মৃত্যুর পর শয়তান চাচার কাছ থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে। একজন পানওয়ালার পরামর্শে ব্যঙ্গমা দিয়ে বার্তা পাঠিয়ে প্রথমে রাজকুমারীকে জানায় নিজের পরিচয় এবং সেই সাথে  প্রেমের প্রস্তাব দেয় ডালিমকুমার। রাজকুমারীও ডালিমকুমারকে ভালোবেসে ফেলে এবং ফিরতি বার্তায় ব্যঙ্গমী দিয়ে বার্তা পাঠিয়ে ভালোবাসার কথা জানায়। সুকৌশলে পরিকল্পনা করে সেই দেশের মহারাজার সাহায্যে শয়তান চাচাকে গ্রেফতার করিয়ে রাজকুমারীকে মুক্ত করে ডালিমকুমার।  তারপর ডালিমকুমার আর রাজকুমারীর বিয়ে হয়। 
সাদা কড়িফুলের মালা হাতে কবির গাঁয়ের সখিরা পুকুর জলে অর্ঘ্য নিবেদন করতেন, আর কবি কচুরিপানায় সাজাতেন এবং ভালবাসতেন সেইসব ফুলেদের। শৈশবজুড়ে যে অনামী, অনার্য ফুলেদের ভালোবেসে শিখেছেন প্রকৃতির পাঠ।  কবির এই কবিতায় ব্যবহৃত চিত্রকল্প যেন শৈশবের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় স্বপ্নলোকে ভাসিয়ে। এখানেই কবি সার্থক। কবিতা যখনই পাঠককে ভাবায়, ভাসায়, নিয়ে যায় কল্পলোকে, তখনই কবিতা সার্থক হয়ে ওঠে। ‘ইমাজিসম’ ধারার পথিকৃৎ কালজয়ী মার্কিন কবি ও সমালোচকএজরা পাউন্ড ইমেজ বা চিত্রকল্প বা বাক্‌-প্রতিমা সম্পর্কে  বলেছেন, "An 'Image' is that which presents an intellectual and emotional complex in an instant of time.
......জ্যোৎস্নাস্নাত হাস্নাহেনা আর
রাতভর রূপকথার ডালিমকুমার, কড়িফুলের মালা হাতে
গাঁয়ের সখিরা অর্ঘ্য করেছে নিবেদন,
তা ভাসায়েছি পুকুর জলে, কলমি, পানাফুলে সাজিয়েছি,
আর ভালবেসেছি তোদের। আমার শৈশবজুড়ে
তোদের ভালোবেসে শিখেছি প্রকৃতির পাঠ,
অনামী, অনার্য ফুলেরা আমার।
(প্রকৃতি পাঠ)

মৃত্যুর অবগুণ্ঠনে মানুষ হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় কোন অন্তহীন নিরুদ্দেশের পথে। মানুষ আসে। মানুষ যায়। কোথায় যায় কেউ তা জানেনা। সুদূরের হাতছানির সেই অনুভবে কবির মন নৈরাশ্যের বেদনায় নিষিক্ত হয়। তাঁর ‘অনুভব’ কবিতায় বর্ণিত হয়েছে সন্তান হারানো এক মায়ের জীবনের করুণ পরিণতির কথা। যে মায়ের নবজাতক মেয়ে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েই মারা যায়। এই কবিতা সেই মায়ের আদরের ছোট্ট সন্তানকে নিয়েই। 
সাদা রঙের প্রতি মায়ের পক্ষপাতিত্ব। এই সাদা রঙ এখানে মৃত্যুর প্রতীক। সন্তান যেমন তার প্রাণের সুখ তেমনি ভীষণ রকম বেদনারও। বারান্দার টবে ফোটা রেইন লিলি ফুল যেন ঘরময় একরাশ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার সন্তান। সন্ধ্যার শ্বেত সন্ধ্যামালতীর পাপড়িতেও মা তার শরীরের গন্ধ পান। স্নিগ্ধ সাদা গোলাপ দেখে ভাবেন ছোট্ট শিশু দুষ্টু হাসি ছড়িয়ে তাকে ডাকছে। না ফেরার দেশে চলে গেছে মায়ের বুকের মানিক। তাকে রঙিন মায়ায় ছুঁতে না পারার দুঃখে তিনি বিহ্বল। তাই কল্পনায় শুভ্রতার মতো সন্তানের মুখখানি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না তিনি।   

ইদানীং সাদা রঙয়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আমার
কারণ কিন্তু তুই
আমার প্রাণের ছোট্ট সুখও তুই
ভীষণ রকম বেদনায়ও তুই
শ্বেত শুভ্র কাশফুল সাদা মেঘপরি, শিশির ভেজা শিউলি
বারান্দার টবে যখন রেইন লিলি ফোটে,
সে তো তুই একরাশ হাসি ছড়িয়ে
দাঁড়িয়ে আছিস ঘরময়।
সন্ধ্যার শ্বেত সন্ধ্যামালতীর পাপড়িতে
আমি তো শরীরের গন্ধ পাই।
স্নিগ্ধ সাদা গোলাপ দেখে ভাবি
ছোট্ট তুই দুষ্টু হাসি ছড়িয়ে আমায় ডাকছিস।
তোকে তো রঙিন মায়ায় ছুঁতে পাইনি
তাই শুভ্রতার মতো তোর মুখখানি ছাড়া
আর যে কিছুই দেখছি না মা।
(অনুভব)

পুরুষ শাসিত সমাজে এখনও সব নারী তার যোগ্য অধিকার পায়নি। এখনও পরাধীন সমাজের যাঁতাকলে। তার কোন দুঃখ থাকতে নেই, দিন-রাত, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, স্নিগ্ধ সকাল কিংবা গোধূলি বিকেল কিচ্ছু থাকতে নেই। ভাতঘুম দুপুরের আলস্যে তার শরীর জুড়াতে নেই। নারী যেন গৃহিণী এবং জননী শব্দের সমার্থক। গৃহিণী হয়ে গৃহে কাজ করবে, জননী হয়ে জনন অঙ্গ সঁপে দেবে স্বামীর কাছে আর সন্তান জন্ম দেবে।  সব বিতর্কের সম্ভাবনাকে খারিজ করে দিয়ে বলতে চাই, সমাজে ভালো নারী যেমন আছে ভালো পুরুষও তেমন আছে। পাশাপাশি খারাপ নারী এবং পুরুষও আছে। খারাপরা সব সময় সোরগোল করে বলে তাদেরটা কানে আসে কিন্তু ভালোরা নিরব থাকে বলে তাদেরটা চোখে পড়ে না।
আমি ইথার সম্ভুতা মানবী
ফটোশপ চর্চিত কমনীয় ছবি
আমার প্রোফাইল শোভিত আমি দেবী না নারী!
আমার শোক দুঃখ থাকতে নেই,
দিবস ও রজনী থাকতে নেই,
ক্ষুধা ও তৃষ্ণা থাকতে নেই,
ইচ্ছা ও অনিচ্ছা থাকতে নেই,
স্নিগ্ধ সকাল, গোধূলি বিকেল
ভাতঘুম দুপুর থাকতে নেই।
               (এলেবেলে জীবনের গল্প)

‘তরুণ ও তরুণী কবি’ কবিতায় দশার্ণ গ্রামের তরুণীর জবানীতে প্রিয়তমর প্রতি ভালোবাসার কথা গভীরভাবে ব্যক্ত হয়েছে নিপুণ শিল্পীর সুদক্ষ কারুকার্যে। যে প্রিয়তমর হাত ধরে আষাঢ়ী পূর্ণিমা রাতে বৃষ্টি স্নান করতে চায়। তার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে উজ্জয়নী নগরের পথে, ইচ্ছে করে শিপ্রা নদীর জলে পা ডুবিয়ে জলকেলি করতে আর প্রিয়তম কবিকে খুঁজতে। দশার্ণ গ্রামের তরুণী আম্রছায়া ঘেরা পথে পথে কুঞ্জফুলের মালায় সাজিয়ে, কপালে কুমকুমের টিপ পরে নীলাম্বরী শাড়িতে তরুণী তার তরুণ কবির প্রতীক্ষায় থাকবে। মধুরতম এই প্রতীক্ষা। ভালোবাসার প্রতীক্ষার কাটানো প্রতিটা প্রহর ভালোবাসাময়।

কোন এক আষাঢ়ী পূর্ণিমা রাতে
আমি বৃষ্টি স্নান করব তোমার হাত ধরে কবি,
আমার ফিরতে ইচ্ছে করে
সেই উজ্জয়নী নগরের পথে,
শিপ্রা নদীর জলে পা ডুবিয়ে জলকেলি করতে করতে
তোমাকে খুঁজব কবি,
দশার্ণ গ্রামের তরুণী আমি
আম্রছায়া ঘেরা পথে পথে কুঞ্জফুলের মালায় সাজিয়ে
কপালে কুমকুমের টিপে
নীলাম্বরী শাড়িতে শরীরী মুগ্ধতা,
তোমার প্রতীক্ষায় আমি কবি।
                  (তরুণ ও তরুণী কবি)
কবির হৃদয় আন্দোলিত ও উদ্বেলিত হয়ে ওঠে স্মৃতিচারণে। অভাবনীয় ইন্দ্রিয়জ অনুষঙ্গ সজাগতায় তাঁর অন্তর থেকে উৎসারিত হয়ঃ

সেই স্মৃতি আর ফেরে না
যেমন ফেরে না দাদীমার মুখ,
নীল শাড়িপরা, পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে
আমাদের আসার প্রতীক্ষায়
কেউ নেই আর। তবুও কীসের টানে
ছুটে যাই সেই জন্মভিটায়!!
                 (আমার জন্মভিটা)
কবি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ফিরে যান স্মৃতির সেলুলয়েডে ভর করে অতীত দিনের স্মৃতিচারণে। স্মৃতিরা আর ফিরে আসে না। ফিরে আসেনা প্রিয় দাদীমার মুখ, যে দাদীমা একদিন নীল শাড়ি পরে পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কেউ নেই তবুও জন্মভিটা কবিকে টানে। কবি ছুটে যান জন্মভিটায়। মানুষকে একদিন তার শেকড়ের কাছেই ফিরতে হয়। জন্মভূমি এবং জন্মভিটার প্রতি মানুষের টান সহজাত। একটা নাড়ীর সম্পর্ক সব সময় মানুষকে নিবিড় মমতায় টানে অমোঘ গন্তব্যের দিকে। যেমন টানে মৃত্যু।
তবুও জন্মদাত্রীর অপমানে
প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ জ্বলেছিল।
রক্ত আর আগুনের থেকে জন্মেছিল
সেই ভূমির। পলির পরতে উর্বর,
রক্তস্নানে স্বজীবনা দহনে শুদ্ধ
জন্মজন্মান্তরের এক নাম বাংলাদেশ।
(বাংলাদেশ)
‘বাংলাদেশ’ কবিতায় বর্ণিত হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা। পাকহানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। জন্মদাত্রীর অপমানে বীর বাঙালির মনে জ্বলে উঠেছিল প্রতিশোধের তীব্র আগুন। বীর বাঙালি প্রিয় জন্মভূমিকে শত্রু মুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জীবন বাজি রেখে। অনেক আত্মত্যাগ আর জীবনের বিনিময়ে, রক্তস্নানে আর দহনে অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।
কবিতায় আধুনিকতা একটি বিশেষ বোধ ও বিশেষ মনন ভঙ্গি যা কবি হোমায়রা মোর্শেদা আখতারের সত্তার সাথীতে পর্যবসিত। জন্মভূমির প্রতি আত্মিক নৈবেদ্যের ডালি সাজিয়ে তিনি লোক লোকান্তরে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করতে নিরলস শিল্প স্রষ্টার ভূমিকা পালনে তৎপর। আধুনিক কবিতার ধারা যেমন বহুমুখী। তেমনি এর গতি প্রকৃতি অন্তর্দগ্ধ চেতনায় সঞ্জীবিত। জন্মভূমির প্রেম তাঁর বুকের ডহরে আজন্ম জড়িয়ে আছে লতা পাতার স্নিগ্ধ মোহনীয়তায়। কবির রক্ত মাংসের সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে তাঁর জন্মভূমি প্রেম আত্মদীপ্ত শিখায় দেদীপ্যমান। 
কবি হোমায়রা মোর্শেদা আখতারের অধিকাংশ কবিতায় দেশ প্রেম, মানব প্রেম, নিসর্গ ভাবনা, দুঃখবোধ, সমাজ সচেতনতা অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে ধরা দিয়েছে। তাঁর কবিতায় জীবনের ঘ্রাণ আছে, আছে মাটির সোদাগন্ধ। পাঠক তাঁর কবিতা পাঠে পরিতৃপ্তি পাবে বলে আমার বিশ্বাস।