বৃহস্পতিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৮

অণুগল্পঃ অনুভূতির লুব্রিক্যান্ট ।। তাইমুর মাহমুদ শমীক


অনুভূতির লুব্রিক্যান্ট     

বাসাটা অর্ণবের মতোই বিষণ্ণ, স্থবির। যেন থেমে আছে অনন্তকাল ধরে। অর্ণব বেশিরভাগ সময় কাটায় তার ঘরে। জায়গাটা তার কম্ফোরট জোন। হুইল চেয়ারে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা বই পড়ে সময় কাটাতে তার ভালো লাগে। পাশের ঘরে থাকে মা। প্রায়ই অর্ণবের ঘরে এসে মা বন্ধুর মতো গল্প করে। তারপর ছেলের মন ভালো করতে না পেরে দীর্ঘশ্বাস খুব সাবধানে গোপন করে অন্য ঘরে চলে যায়। 

এই অর্ণব ছোটবেলায় ভীষণ ব্রাইট ছিলো। প্রতি ক্লাসে বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরুলে সেকেন্ড অথবা থার্ড হতো। সংস্কৃতমনা ছিলো সে। স্টেজে ভালো অভিনয় করে প্রায়ই চমকে দিতো সবাইকে। কলেজে উঠবার পর বেরুলো তার গদ্য লিখবার প্রতিভা। সে সময় দিস্তার পর দিস্তা লিখে গেছে অর্ণব। সময়ের পরিক্রমায় লেখায় এসেছে পরিণতবোধ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে হৃদির সাথে তার তুমুল প্রেম হলো। রোড এক্সিডেন্টে দুটো পা হারাবার আগ পর্যন্ত সে আর হৃদি পুরোটা শহর দাপিয়ে বেড়িয়েছে। 

এখন তো হৃদি কানাডায়। তার বরের দুটো পাই ঠিক আছে। হা হা ! চলাফেরায় অক্ষম অর্ণবের কথা হৃদি নিশ্চয়ই ভাবে। অতো স্মৃতি এক জীবনে কি ভোলা যায় ! 

অর্ণবের জীবনটা এই বয়সে এসেই হয়ে গেছে চারদেয়ালে বন্দি। বামপন্থী বুড়ো মা তাকে অনুপ্রেরণা দেয়। লেখালেখি চালিয়ে যেতে বলে। পঙ্গু মানুষ যারা জীবনে সফল হয়েছে, তাদের গল্প রসিয়ে রসিয়ে শোনায়। অর্ণব বিরক্ত হয় মনে মনে। মা তাকে এতো দুর্বল মনের তুচ্ছ অপুরুষ ভাবে কেন? তার তো এসব সফলগাঁথা শুনবার প্রয়োজন নেই। সে ভালো আছে। বেশ ভালো আছে। 

বিকেলবেলায় ব্যালকনিতে বসে সে দীর্ঘ সময় ধরে মানুষ দেখে। আর কথা বলে নুনার সাথে। নুনা তার পোষা ময়না। বড় ভালো নুনা। কেমন মায়াচোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে চোখের পলক না ফেলে। সে চোখে অর্ণব আজ অব্দি করুণা দেখতে পায়নি।  

রাত তিনটা বাজলে অর্ণবের মনে হয় এই বুঝি সন্ধ্যা হলো ! রাত হলে কতো কি যে ঘোরে তার মাথায়। নস্টালজিয়া কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে তার মস্তিষ্ক। অথবা জিভ দিয়ে লেহন করে অক্ষত যোনীর মতো তার পা না থাকার বিশুদ্ধ ক্ষত জায়গায় ! 

অর্ণবের বন্ধুরা দলে দলে চাকরিতে ঢুকছে। স্যুট টাই পরে তারা ঝা চকচকে ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিলে অর্ণব মন দিয়ে দেখে। তার আফসোস হয়না। একদিন কিভাবে যেন হৃদি আর তার বরের ঘনিষ্ঠ একটা হাসিখুশি ছবি তার চোখের সামনে এসে পড়ে। অর্ণব দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থেকে একসময় আওয়াজ করে বিষণ্ণ হাসবার পর স্বগোক্তীর মতো করে বলে ওঠে, জীবনটা এতো অদ্ভুত কেন কেউ কি জানো? কেউ কি সত্য করে বলবে আমাকে, একদিন পরম নির্ভরতায় বুকে মাথা রাখা মানুষটা কোন জাদুবলে অন্যের হয়ে গিয়ে অমন সুখে বেঁচে থাকে?   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন