রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

অরুণ ।। রুপা সাধুখা

অরুণ
      

অরুণ আজ খুব খুশি। আর হবে না ই বা কেন.! ছেলে সাউথ সিটি তে ফ্ল্যাট কিনেছে। ভাবা যায়.! ১১ তলায় ফ্ল্যাট, সেখান থেকে পুরো শহরটাই যেন দেখা যাই ব্যালকনি তে দাড়িয়ে। কি সুন্দর ভাবে সাজানো ড্রয়িং রুমটা, এত ফার্নিচারের বহর, আর শোবার ঘর থেকে কিচেন সবেতে এ.সি। অরুনের চোখে খুশির সাথে গর্ব। কখন যে এত বড় হয়ে গেল ওর ছোট্ট শুভো.! ওর সারাটা জীবন তো বাস এ ধাক্কা খেয়ে, উত্তরপাড়ার ছোট ছোট গলিতে ঘোরাফেরা করে আর টু বেডরুম এর ছোট ফ্ল্যাট এ ই কেটে গেছে, কখনো ভাবেনি যে একটা দিন ও এই কলকাতা শহরের ৪৫ লাখের ফ্ল্যাট চোখেও দেখবে.! না, লোভ হচ্ছে না, সেটা ওর কখনই ছিল না, আনন্দ হচ্ছে, ছেলের জন্য, ছেলের এত সুন্দর একটা জীবনের জন্য।
"তাহলে আমরা কবে এখানে শিফট করছি শুভো.?"
"আমরা.! বাবা শুধু আমি শিফট করছি। আসলে ত্রিশা আর আমি বিয়ের পর একটু পারসনাল টাইম চাই, তাই তো এই ফ্ল্যাট টা কিনলাম। আর উইক এন্ডস এ তো দেখা হবেই.! আর তুমি এই বয়সে তোমার পুরনো জায়গা ছাড়বে না কি.!"
চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো অরুনের, জলে। নিজেকে খুব বোকা লাগছিল, কেন ভাবলো যে ওই ফ্ল্যাটটা তে ওরা একসাথে থাকবে.! ৩০ বছর ছেলের সাথে কাটিয়েছে বলে আরো জীবনের বাকি কয়েকটা বছর ও যে ছেলে ওদের সাথে কাটাবে এর কি মানে আছে.? এটা ভাবাই হয়ত ভুল.! হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পরে গেল, ছেলের পাঁচ বছরের জন্মদিনটা বড় করে করবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ব্যবসাটা সেই মাসে ভালো চলেনি, তাই নিজের কেসিওটা বিক্রি করে দিয়েছিল। আজ ওই কেসিওটার কথা খুব মনে পরছিল, কানে বাজছিল যেন সুর গুলো।
হঠাৎ পাশ থেকে এসে দুটো নরম হাত ওর হাতটা কে আঁকড়ে ধরল। এই দুটো হাতই ওকে ৩৫ টা বছর ধরে সামলেছে। খুব অদ্ভুত লাগলো অরুনের, সুজাতার চোখে তো জল নেই, এত বড় একটা খবর শুনেও.! "তোমার খারাপ লাগছে না.?"
"না তো, আমি তো জানতাম এটা হবে। আসলে মা রা ছেলেদের বেশি চেনে। শুভো তোমার মতন না, প্রথম থেকেই। খুব হিসেবী ও, যাই হোক ৩৫ বছর একসাথে কাটিয়েছি আমরা, বাকি গুলো ও কাটিয়ে দেব। তবে এবার একটু অন্য রকম ভাবে বাঁচব, শুধু দুজনের জন্যে”
অরুনের মুখে হাসি..., হঠাৎ মনে হলো এই টু বেডরুমস ফ্ল্যাট, উত্তরপাড়ার সরু গলি গুলো, আর এই মিষ্টি মুখের একজন শুধু ওর..., এই গুলো ওর কাছ থেকে কেউ কখনো নিতে পারবে না........
হ্যাঁ, তিন বছর পরে শুভো ফিরেছিল। তৃষার সাথে ওর সম্পর্কটা টেকেনি, ডিভোর্স এর দরজায় ওরা, আর ত্রিশা এলিমনি তে সাউথ সিটির ফ্ল্যাট টাই চেয়েছে। বিধ্বস্ত চেহারায় সেই রাতে ফিরেছিল শুভো, মা বাবার কাছে, নিজের বাড়িতে, নিজের লোকের কাছে। পরের দিন সকালে কফি নিয়ে সুজাতা ওর কাছে গিয়েছিল যখন মা কে জড়িয়ে ধরেছিল শুভো, হয়ত একটা আশ্রয় খুঁজছিল ও.! সুজাতা ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, "ধীরে ধীরে নিজের জন্যে একটা ফ্ল্যাট খুঁজে নিস। আসলে তোর সাথে থাকার অভ্যেস টা আমাদের কেমন চলে গেছে, আর এই বয়সে নতুন করে আর অভ্যেস তৈরি করতেও আমাদের ইচ্ছে করছে না। শনি রবিবার আসিস, দেখা হবে.!" শুভর সেইদিন এক মুহুর্তের জন্য একটা ধাক্কা লেগেছিল, তারপর মনে হয়েছিল মা বাবা ওর মতন হিসেব করতে কবে শিখল.!!....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন