তরুণদের কবিতায় মৃত্যুচিন্তা
মৃত্যু। একটি শাশ্বত বিষয়, চিরন্তন বাস্তবতা। পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া কোনো জীবই মৃত্যু এড়িয়ে যেতে পারেনা। মৃতুবোধ প্রতিটি জীবেরই আছে। মানুষ ও অন্যান্য জীবের মাঝে পার্থক্য- মানুষ মৃত্যু ভাবনাকে প্রকাশ করতে পারে, অন্যরা পারেনা। আমরা মৃত্যুকে নিয়ে কি ভাবি, মৃত্যুকে কিভাবে দেখি? একেক জনের উত্তর একেক রকম হবে। কারণ- প্রত্যেক মানুষেরই একটা নিজস্ব ভাবনা থাকে, নিজস্ব চিন্তা থাকে। আর এই ব্যক্তি থিউরির বাহিরে কেউ যেতে পারেনা। যারা যেতে পারেন, তারা কবি। একজন কবির কাছে মৃত্যুর নানান রঙ আছে, বিস্তর ভাবনার প্যাটার্ন আছে। কবিও যেহেতু মানুষ, সেহেতু অন্যান্য মানুষের ভাবনা থেকে তার ভাবনাও বিচ্ছিন্ন কিছুনা। মানুষ যা বিচ্ছিন্নভাবে দেখে, কবি তা সমন্বিতভাবে দেখেন। সাধারণের থেকে বৈশাদৃশ্য এটাই- কবি চিন্তার গভিরে যেতে পারেন।
আমরা কবি জীবনান্দ দাশের কবিতায় অনেক বেশি মৃত্যুচিন্তা দেখেছি। তাকে স্যাড জেনারেশনরে কবি বলাও ভুল নয়। প্রতিটি মানুষই তো মৃত্যু ভাবনার উর্ধ্বে নয়। সেখানে একজন কবি তা নিয়ে ভাববেন না কেন? কিন্তু তরুণ কবিদের কবিতা? আমরা সমকালীন তরুণ কবিদের কবিতাতেও মৃত্যু চিন্তা গভীরভাবে দেখতে পাই। কবি কাজী মেহেদী হাসানের কবিতায়-
‘মানুষ মরে গলে মানুষের ভেতরই থাকে এক আস্ত শোকমিছিল
কবি মরে গেলে প্রতীক্ষা থাকে
ভালোবাসা থাকে
শ্লোগান থাকে’
( কোনো শোক প্রস্তাব নয় / আঙুরবালার রিকর্ড)
কবি এখানে মানুষের মৃত্যুতে শোক দেখেছেন, সাধারনও তাই দেখে। কিন্তু একজন কবির মৃত্যু? কবি কবির মৃত্যুতে শোক দেখেন না। কবির প্রতীক্ষায় থাকেন, ভালোবাসার প্রতীক্ষা করেন। কবি এখানে নস্টালিক। একজন কবিও মানুষ, তিনি মারা গেলে আর ফিরে আসেননা। কিন্তু কবির কবিতায় কবির ভালোবাসা থাকে, পরিবর্তনের শ্লোগান থাকে। কবির কবিতাই মৃত্যুতীত বাঁচিয়ে রাখে তাকে। কিন্তু সাধরনের? সাধারনের মৃত্যুর কিছু থাকেনা। তাদের আপনজনরাও এক সময় ভুলে যায় তাকে। তার অন্য এক কবিতাতে দেখতে পাই-
‘এই যে উৎসব
তবু শোকরঙা চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি’
( মিথ / আঙুরবালার রেকর্ড )
সাধারন থেকে কবি এখানে ভিন্ন। চারপাশে তো প্রতিদিনই আমরা উৎসব দেখছি, এর মাঝেই আমরা শূন্যতাও দেখছি। প্রতিদিন এক মিনিটের জন্য হলেও আমরা শোকাহত হই। শোক সে তো মৃত্যু ভাবনারই পরম্পরা শূন্যতাবোধ। উৎসব, কবি উৎসবের কথা বলেছেন, আমরা কোনো না কোনো ভাবেই এই উৎসবের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি। যদি প্রশ্ন করা যায়- কোনটা চিরন্ত এবং বৃহৎ উৎসব? মীর রবির কবিতায় আমরা এর উত্তর খুঁজে পাই-
‘মৃত্যুর থেকে বড় কোনো উৎসব নাই’
( উৎসব / মৃত্যুর নাচঘর )
এই উৎসব আমরা এড়িয়ে যেতে পারিনা। তিনি তাই আবার উচ্চারণ করেন-
‘শুধু দুটি জীবের যৌনাচারে জন্ম হলে
আমি জানি, আমাদের ভবিষ্যৎ শুধু মৃত্যু।
আমরা মৃত্যু এড়িয়ে যেতে পারিনা, তাই মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করি।’
( আবির্ভাব / মৃত্যুর নাচঘর )
মানুষের জীবন, আমরা চারপাশে তাকালে এই মানব জীবন কেন্দ্রীক সভ্যতার বিরাট কর্মযজ্ঞ দেখতে পাই। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ কি? পর প্রজন্মকে বাঁচিযে রাখার? এর কোনো অর্থ নেই। মানুষ যা কিছুই করুক, তার ভবিষ্যৎ মৃত্যুই। তাই মীর রবির কবিতাতেই দেখতে পাই-
‘ভবিষ্যৎ বলে আমার কিছু নেই
আমি দেখি শূন্য
শূন্য মানে আমার কাছে মৃত্যু
মৃত্যু মানে মৃত
মৃত আমি কবরের দিকে হেঁটে যাই’
( গন্তব্য / মৃত্যুর নাচঘর )
একজন কবির চিন্তা, দর্শন এখানেই সার্থক- মৃত্যুকে যখন তিনি চিনতে পান। যত কিছুই করা হোক, আমাদের প্রত্যেককেই মৃত্যু নামক শূন্যতার দিকে হেটে যেতে হবে। মৃত্যুর জন্যই আজ আমাদের এত সব আয়োজন। মৃত্যু আছে বলেই একজন মানুষের জন্ম কিংবা বিয়েতে না আসা মানুষটিও মৃত্যুতে সমবেত হয়। মৃত্যুজনিত এই বিরাট সমবেতই চিরন্তন উৎসব। কোনো জীবই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য আসেনি। একজন মানুষ অন্য এক মানুষের মৃত্যু দেখবে বলে ক্ষণিকের জন্য বেঁচে থাকে। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলছে, টের পাচ্ছিনা আমরা। কবি নাহিদ ধ্রুব ঠিকই তা টের পান। বলতে হয় প্রাজ্ঞ দার্শনিকতাবোধ আছে বলেই তিনি উচ্চারণ করেন-
‘আমি জানি-
মৃত মানুূষকে কবর দেওয়ার জন্যই
আমরা বেঁচে থাকি!’
( কবর / মৃত্যুর মতো বানোয়াট )
মানুষের মৃত্যু হলে তার স্বপ্ন বলে কিছু থাকেনা। আমরাও তাকে কিছু দিনের মাঝেই ভুলে যাই। মৃত মানুষটির নাম ধরে তাকে ডাকি না। কবি ইমরান মাহফুজ তাই কবিতায় উচ্চারণ করেন-
‘মা দিন শেষে আমায় আর ডেকো না
রাতদুপুরে অশোকবনে পাখি নিয়ে থেকো’
( মৃত্যুমুখী পাখির সমাবেশ / দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা )
একই কবিতায় কবি মৃত্যুকে আনন্দের সঙ্গে তুলনা করন-
‘আজ মৃতুমুখী পাখির সমাবেশ
নূপুর পায়ে শিশুর মতো
প্রার্থনা করছে- আনন্দ মৃত্যু!’
কবি এখানেও মৃত্যুকে উৎসব চিন্তকে দেখেছেন। আনন্দ তো উৎসবেরই নামান্তর!
মৃতুর পর কী? মৃত্যুর পর জীবন বলতে কিছু আছে? মৃত্যুর পর জীবন বলতে কিছু থাকেনা। চিরন্তন শূন্যতা ছাড়া মৃত্যুতে কিছু আছে বলে আমি বোধ করিনা। বিজ্ঞানের চিন্তায়- সৃষ্টির ধ্বংস বা মৃত্যু আছে, পুনর্জীবন বা পর জীবন বলে কিছু নাই। লৌকিক বা ধর্ম কেন্দ্রিক মৃত্যুর পর জীবন আমাকে কাছে টানেনা। দার্শনিকতাবোধ সম্পন্ন একজন কবিও অন্য কিছু ভাবতে পারেন না বলে আমার মনে হয়। ‘মানুষ মৃত্যুর পর কোথায় যায়? কী খায়; বেঁচে থাকে নাকি মরে যায়?’ এম ঘোর লাগা প্রশ্ন তুলেও কবি নাহিদ ধ্রুব অকপটেই কবিতায় বলেন-
‘... এর মাঝে স্যাঁতস্যাঁতে নিঃসঙ্গতা
বলে আমি একা,
অপারেশনে বাদ পড়ছে সব অভিনয়। তারপর চাপা
মাটির হুংকার চুপচাপ নিরবতা, নিরবতা
চুপচাপ... ’
( মৃত্যুর পর / মৃত্যুর মতো বানোয়াট )
মৃত্যুর পর কি- তা ধর্মবেত্তাদের কাছে অন্য কিছু, আরেকটা জীবন্ত জগৎ হতে পারে। কিন্তু একজন কবির কাছে? কবি যদি প্রথার জোয়ারে গা ভাসান তবে ধর্ম মোড়লদের থেকে তিনিও ব্যতিক্রম হবেন না। কিন্তু যদি প্রথাবিরোধীতার কথা বলেন- তবে তিনি মৃতুর পর ফুলস্টপ দিবেন। কবির ‘নিরবতা / চুপচাপ’ শব্দ তারই প্রতিনিধিত্ব করেনা!
একজন মানুষের মৃত্যু, তার চারপাশ- মৃত্যু ঘটনার একটা প্রকল্প দেয়। দায় দেয়। মৃত্যুকে ঘিরে থাকে ঘটনার ঘূর্ণিপাক। মিথ রটে। এটাও কিন্তু একজন মানুষকে হারানোর শূন্যতার সার্কে তৈরি করে। শূন্যতাবোধ বিভ্রম বলয় সৃষ্টি করে। মানুষ কিছু সরল দৃশ্যকে জটিল করে মিথের জন্ম দেয়। কবি শীতল বোরহানের কবিতয়-
‘মায়ের মৃত্যুর পর বারান্দার চাল কিংবা বাড়ির আশপাশে
এবং চলার পথে যত জায়গায় গিয়েছি
বারান্দার টিনের চালে ভাত ছিটিয়েছি; সেই কাক দুটিকে
আর কোনোদিন চোখে পড়েনি!’
( মা এবং দুটি কাক / অন্ধের দিনলিপি )
আবার, তাসনিম রিফাতের কবিতায়-
‘যতবার মৃত্যু, ততোবার বৃষ্টি,
আকাশ কালো এবং হল্লা হওয়া বুকে
কেউ একজন অবতরন করে মাটিতে,
আমাকে এনে দেয় সেই বিশুদ্ধ স্বাদ’
( মৃত্যু এবং বৃষ্টি / দুঃখবোধের ঘড়ি )
দুটি কবিতাতেই কবি তার চারপাশের খন্ড খন্ড দৃষ্টিকল্পে মৃত্যুর স্বাদ খুঁজেছেন। তাদের একজনের কাছে মৃত্যু বিশুদ্ধ বৃষ্টি হয়ে ধরা দিয়েছে। একজনের কাছে বিভ্রমতার ধাঁধাঁ, স্মৃতির বিচ্ছুরণ। আগেই বলেছি মৃত্যু একেকজনের ভাবনায় একেক রকম। ঘটনার সমাবেশও ভিন্ন আঙ্গিকের। যেমন- শিমুল জাবালির কবিতায়-
‘তীর্থের কাকা বিছানার আদর পেয়ে ডায়াসে ঘটনা রাখে
আমাদের সহরথিরা এমন এক কর্ণছায়া খুঁজছিলো
যেখানে জন্মের আগে মৃত্যুর স্বাদ নেয়া যায়।’
( মহতীর্থের কাক / সুতাশঙ্খ )
কবি জন্মের আগেই মৃত্যুর স্বাদ খুঁজছেন। কল্পনার ব্যপ্যতা রূপকথার মতো। তারপরও আমরা এট দৃশ্যকল্প তুলে ধরতে পাই- আমরা মৃত্যুর আগে বেঁচে ছিলাম, বাঁচার আগেও মৃত ছিলাম! অলীক মনে হলেও ভাবনা গভীরতা ব্যাপক- অর্থাৎ জন্মের আগে মৃত, জন্মের পরেও মৃত্যু। সরলীকরণে এর রূপরেখা এমন-
মত্যু (ভ্রুণ) - জন্ম (শিশু, পরবর্তী জীবন) - মৃত্যু
দীর্ঘ ভাবনা আপনাকে বলে দিবে- জন্মের আগের কিছু আপনি জানেন না, কারণ তখন আপনি ছিলেন না। মৃত্যুর পরেও আপনি কিছু জানবেন না, কারণ তখন আপনি থাকেবেন না। শুধু জানবে- ততোদিনের কথা, যতদিন আপনি বেঁচে ছিলেন। মাকড়সার জালের মতো মৃত্যুচিন্তার ডালপালা! ভাবতে থাকুন নতুন নতুন চিন্তা বেরুবে- মৃত্যুর খোরাক পাবেন মৃত্যুর স্বাদে!
মৃত্যু চিন্তা কখন আসে? আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ততোক্ষণে আসুন আমরা কবি শিস খন্দকারের কবিতা পড়ি-
‘খুব করে একদিন বিরাগে তবে বসবো জেঁকে,
আমিও চলে যাবো বিপন্ন জীবনের কাতারে ,
বেদনাতুর হৃদপিন্ডে ভাসিয়ে অকুল পাথারে!
কে বাড়িয়ে দেবে দুটি প্রসন্ন হাত? কে? কে?’
( বিষাদ জিজ্ঞাসা / আয়নায় অলীক সঙ্গম )
কবি এখানে বেদনাভারে কাতর হয়েছেন। দুঃখবোধ তাকে হতাশ করেছে, তিনি বিপন্নতাবোধ করেছেন নিজের জীবনের। এখানে বিষণœাতা আর হতাশার সুর আমরা পাই। যা প্রত্যেক মানুষের মাঝেই কাজ করে । নিরাশাবোধ থেকেই মানুষে মৃত্যুবোধের চিন্তা আসে। পাওয়া না পাওয়ার দোদ্যুলতা মৃত্যু চিন্তাকে জাগিয়ে তোলে। মুত্যুও যেন তখন হাত ছানিতে ডাকে। কবি মুগ্ধ মোহাম্মদ এহতেশামুল লিখেছেন-
যেখানে আকাশ থেমেছে
নতুন এক গ্রহের সন্ধানে
সেটাই আমার গন্তব্য Õ
( আকাশের গন্তব্য কোথায় / ব্যথিতরা কেবল রাতের প্রেমেই পরে )
আকাশ, আকাশের পাড়ে গন্তব্য কবিকে মৃত্যুচিন্তাতেই ভাবিয়ে তোলে। লোক বিশ্বাসে মানুষের মৃত আত্মা ওখানেই যায়। মহাশূন্যের দিকে এ যাত্রায় ভাববাদীতার ছায়া কাজ করে।
ভাববাদী বা বস্তুবাদী যে দর্শনই হোক আমরা মৃত্যু চিন্তা এড়িয়ে যেতে পারিনা। আমরা মৃত্যুর উর্ধ্বে নই। মৃত্যুকে আমরা তাচ্ছিল্য করতে পারি, কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারিনা। মৃতু শাশ্বত। কবিতায় এর প্রয়োজনীয়তা- কবিতাকে অনন্য করে তোলে। মৃত্যু কেন্দ্রিক দার্শনিক কবিতা মানুষের জীবনের একটি অনুষঙ্গ। একে বাদ দিয়ে আমরা কবিতাকে ভাবতে পারিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন