রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ঝড় ।। রওশন রুবী


ঝড়


নিনাদ সম্পাদকীয়টা শেষবার পরখ করছে, প্রেসে পাঠাবার আগে তাকে প্রতিটি লেখার সেটিং খুঁটিয়ে দেখতে হয়। পত্রিকার কাজে প্রায় রাতে ফিরতে ভোর হয়। গরম জলে রেডি’টির প্যাকেট দিয়ে চুমুক দিতে দিতে আনমনা হয়ে যায় নদীর বিধ্বংসী উচ্ছ্বাস শুনতে শুনতে মনে মনে ‘লাহাওলা ওয়ালা-কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহি....পড়তে পড়তে হাতের কাজ দ্রুত গুছিয়ে ফেলে বৃষ্টি ঝড়োবাতাস মাথায় বেরিয়ে পড়লেন, হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ে যায় তার, মা বলতো খুব বিপদে এই দোয়াটা বেশি বেশি পড়িস্ খোকা। এই বিপদের দিনে কতোগুলো বছর পর মায়ের কথা মনে পড়ল, আসলেই বিপদে পড়লেই বুঝিবা শ্রেষ্ঠ আশ্রয়ের কাছে ফিরতে চায় মানুষ, আর ছায়া চায়, প্রার্থনা চায় মৌলিক। পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ অফিস ও বাসা, জোরালো বাতাসের মুখে উড়ে যাচেছ ঘরের চাল, গাছের ডাল আরো অন্যান্য । ঘূর্ণিঝড়টি দ্রুত ধেয়ে আসছে তার শোঁশোঁ শব্দ কতটা ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছে, তা একজন ভুক্তভূগি ছাড়া বুঝতে পারবেনা কেউ। নিনাদ সংবাদটি জানতো, এবং এনিয়ে আজ সম্পাদকীয়ও লিখেছে, ভেবে রেখেছে আজ একটু আগেই বাড়ি ফিরবে, কিন্তু কাজ পাগল মানুষ কাজ করতে করতে ভুলে গেছে সব, দশ নম্বর বিপদ সংকেত ছিলো এবং ও রাতের শেষ দিকে হানাদেবে উপকূলীয় অঞ্চলে। এর গতি পলকের চেয়ে দ্রুত। তিনতলা বাসার নিচ তলায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সন্তানের জন্য মনটা কেমন করে উঠেসর্বগ্রাসীর গর্জনটা রাক্ষসের মত এগিয়ে আসছে এবং খুব দ্রুত বুঝতে পেরে জোরে পা চালালেন, বাতাসের ঝাপটা, বৃষ্টির ছাটে পথ দেখা মুশকিল, অন্ধের মতো খেয়ালেই এগুচ্ছেন। বাসাটা আজ বেশ দূরে লাগছে, মনে হচ্ছে হিমালয় অতিক্রম করছেন। প্রায় পেছনে  বিধ্বংসী শব্দটা হতেই এবার দৌড়ানো শুরু করলেন নিনাদ। জল আর  বাতাসের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা চারটি খানি কথা নয়। যেভাবেই হোক ঝড়ের আগে পৌঁছোতে হবে, পিয়াল ঝড় বাতাসকে খুব ভয় পায়। চাবিটা বের করে হাতে নিয়ে রাখলে সময় বাঁচবে। দশ বছর বয়সী পিয়াল, সাতবছর থেকে কাজে থাকা সহায় সম্বলহীন ষাটঊর্ধ্ব কাজের বুয়াসহ ঘরে থাকে গত ডিসেম্বর থেকে পাকাপাকি ভাবে ¯েœহা চলে যাবার পর থেকেই। প্রতিদিন দেরি হয় ফিরতে তাই সন্ধ্যায় দুটো দরজার একটিতে তালা দিয়ে বের হয়, একটি ওরা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেয়। হঠাৎ আৎকে ওঠে নিনাদের হৃপিন্ড, দৌড়ের মধ্যেই ভালো ভাবে পকেট হাতড়ায়, উফ! নেই! নেইই! পায়ে এসে আছড়ে পড়ে নদী উপছানো জল, চাবি কি অফিসে? বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে প্যান্ট বদলেছে সেখানেকি রয়ে গেছে? না কিছুতেই মনে আসছে না, কেন, কেন? বৃষ্টির মধ্যেও নিনাদ ঘামছে টের পায়। হাটবিট বেড়ে যায়, গলা শুকিয়ে ওঠে, আজ বাসাটা এতো দূর কেন? পিয়ালের জন্য ঢুকরে ওঠে বুক; ছেলেটা ঝড় বাতাসের আতংকে মরবে? আর বুয়া ? যার কেউ নেই , নিনাদকে তার সন্তান ভাবে। মা! মা! হ্যাঁ ভুলে থাকা মায়ের মুখটা আজ বারংবার মনের কোণে ভেসে উঠছে এবং শেষমুহূর্তে যখন জলোচ্ছ্বাসের মত আগলে নিলো নিনাদকে তখনি তিন ঘরের জানালায় আবছা দু’টো ছায়ার মত দেখতে পেলেন, যার একটি ছোট্ট পিয়াল চিৎকারে বোধগম্য হলো, সে চিৎকার করে বলেেছ “ বাবা জলদি! দৌড়াও বাবা! দৌড়াও!” বুয়ার চিৎকারও মিলায় সেই সঙ্গে “ ও বাজান একটু পা জোরে ফ্যালাও! দৌড়াও না বাজান! বাতাস গিল্লা নিবো তোমাক! আল্লাহ্ আমারার বাজানরে জোর দাও! আল্লাগো জো-র-র দা- -ও।” আর কিছু শুনতে পায় না নিনাদ জলের ও বাতাসের তোড়ে ।
যখন নিনাদ চোখ খোলে দেখে মুখের উপর ঝুঁকে আছে দু’জোড়া ভেজা অপেক্ষার চোখ। তাদের মাথার ফাঁক দিয়ে শাদাছাদ দেখা যাচ্ছে, মুখগুলো হেসে উঠলো হারিয়ে মূল্যবান বস্তু ফিরে পেয়ে যেমন হাসে কেউ। কি হয়েছিলো মনে করতে করতে উঠে বসে, পিয়াল পাকামু গলায় বলে “ বাঁচালে গো বাবা, বাঁচালে; ভয় পেয়ে ছিলাম তোমাকেও বুঝি হারালাম এই ভেবে। এই বুড়িমা তোমাকে টেনে তুলেছে বিছানায়, নয়তো তুমি পানিতে ভেসে থাকতে, দেখ ঘরে কেমন পানি থৈথৈ করছে, আমাদের জানালা গুলো উড়ে গেছে, সেদিক দিয়ে বাতাসের পাক ঢুকতে ঢুকতেই জলও ঢুকে পড়লো। দেখ বুড়িমা তোমাকে তুলতে গিয়ে পায়ের আঙুল উল্টে ফেলেছে, অনেক রক্ত ঝরেছে।” ছেলেকে কোলে টেনে আদর করে নিনাদ, বুয়ার পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধতে হবে। পিয়াল আবার বলে- “ বাবা সকাল থেকে কিছু খাইনি আমরা, উঠো খাবো না? খুব খিদে পেয়েছে।” হ্যাঁ যাচ্ছি , ফ্লাটের সবাই এখানে ছিলো কি পিয়াল? মনে হলো কারো কারো কথা শুনছিলাম। “ হ্যাঁ বাবা সবাই ছিল। কাল তনয়া আন্টি আমাদের ডেকে বলেছিল ঝড় হবে। না বললেতো আমরা কিছুই দেখতে পেতাম না তাই না ?” সবাই তোমাকে দেখতে এসেছিল, নিখিল কাকু বলেছে পিয়াল ঝড়বাতাস ভয় পায়, সইতে পারবে না ; এখন দেখি নিনাদ সাহেবও একই রকম, আমি ওনাকে চিকিৎসা দিয়েছি, প্রেসার হাই হবার কারণে এমন হয়েছে। নিনাদ চেয়ে দেখে বুয়া নেই, কখন সরে গেছে। ঐ শুভার্থীরাও নেই, যে যার মতো চলে গেছে, মেঝেতে পানির ¯্রােতে ভিজে; ভেসে পড়ে আছে নানান জিনিস, ঘরের অনেক জিনিস বাতাসে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে। মেঝের দিকে তাকাতেই নিনাদ আৎকে উঠে, পানিতে ভাসছে মাবাবার ছবি, মায়ের হাতের শেষ চিঠি, যার একটি শব্দও বোধ হয় তুলতে গেলে পানি থেকে রক্ষা পাবেনা। স্মৃতিচিহ্ন আর কিছুই রক্ষা করা গেলনা,  বুয়া নিজের মত কাজ করছে, কিছু শুকাতে ছাদে তুলছে, কিছু ফেলে দেবার জন্য এক জায়গায় জড়ো করছে। নিনাদকে বললো “ বাজান সবতো গেইলো যাক তুই রক্ষা পাইছো হেয়াই শান্তি।” নিনাদ বিছানার নিচে জ্যাবজ্যাবে পানিতে পা রেখে খাটের কোনায় বসেন, নিচতলায় তিন পরিবারের সবার একই অবস্থা, দুপুর গড়িয়েছে পানি নামছে সামান্যই, খোলা দরজায় একটি ট্রেতে কয়টি বাটি নিয়ে তিনতলার আরিফ সাহেবের বড় মেয়ে নদীয়া দাঁড়িয়ে, প্রায় বিশ বছর বয়সী কলেজ পড়–য়া সুশ্রী মেয়ে নদীয়া। ওকে ঘরে ঢুকতে ইসারা দিলেন নিনাদ, সে ঘরে ঢুকে বাটিগুলো নিনাদের পাশে খাটের কোনায় রাখে আর মিহি সুরে বলে কাকু মা বলেছে দুপুরে ও রাতে আমাদের ওখানে খেতে। 
মাথাটা ভার হয়ে আছে, চা খাওয়া দরকার। অফিসে কি হলো না হলো খোঁজ নেয়া প্রয়োজন, দেখতে যেতে হয় মানুষের অবস্থা, পাশে দাঁড়াতে হবে বিপদগ্রস্থ মানুষের। নিনাদের আতঙ্ক বেড়ে যায় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তি ভয়াবহতা দেখে, কি জানি একমাত্র বোন লায়লা ও তার পরিবারের কি অবস্থা! কত মানুষ নিখোঁজ রয়েছে এখনও, অফিসের,বাসার পাশোবর্তী যে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, সেগুলোতে গিয়ে মানুষের দূর্দশা দেখে ঢুকরে উঠে বুকের ভেতর, নিমাই নামের এক যুবক কেঁদে ভাসালো, বলে ‘ দাদা সব হারিয়ে মৃত্যুর মত বেঁচে আছি। আবেগে আপ্লুত ফরিদ বলে চোখের সামনে সব মরে পড়ে রয়েছে, কাউকে বাঁচাতে পারিনি ভাই, আত্মসত্বা রেবেকা ভাঙা ঘরের দাওয়ায় বসে স্বামীর জন্য বিলাপ করছে। একটি শিশু একটি লাশের পাশে বসে মা মা বলে চিৎকার করে গগন ফাটাচ্ছে। কে শুনে কার চিৎকার। বৃদ্ধ হানিফ বলে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সব, এই জীবনে দুইবার দেখলাম, স্বজনহীন বেঁচে থাকা এই বয়সে দূর্বিসহ, অপেক্ষায় আছি তবু স্বজনদের ফিরবার,বহু পরিবার অপেক্ষা করে আছে স্বজনদের জন্য, হয়তো কোনদিন কেউ ফিরবে না। স্বজন হারা পরিবারের কান্না নিনাদের শিরা-উপশিরার প্রকোষ্ঠে বিঁধে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন