বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

প্রবন্ধঃ মানুষ বনাম শূন্যতা ।। মতিন বৈরাগী

প্রবন্ধঃ  মানুষ বনাম শূন্যতা

মতিন বৈরাগী
শূন্যতা এক বাস্তবতা মানুষের জীবনের। মানুষ বহুতে যেমন যুক্ত, তেমনি এককে এক শূন্যতা তার সমস্ত অস্তিত্ব বেষ্টন করে রাখে। এই শূন্যতা মূলত অস্তিত্ব সংকট। আবার বৃহতে ছড়িয়ে সামগ্রিক হয়। শূন্যতা অর্থহীন নয়, আবার ক্ষণিকেরও না। প্রতিমুহুর্তে মানুষ তার নিজের দিকে ফিরাতে চায় অর্থবোধকতা তার অস্তিত্বের, আর সেই উদ্যম থেকে জন্ম লয় স্বার্থ। এই স্বার্থ কখনও ব্যক্তিকে আগ্রাসী করে তোলে, কখনও জীবনে বিরাজমান এই শূন্যতা ব্যক্তিকে অস্তিত্বহীনতার দিকে ধাবিত করে এবং এক অসহায়ত্বের বলয় সৃষ্টি করে। কখনও ব্যক্তির শূন্যতা এবং সমাজকাঠামোয় ব্যক্তির অবস্থান, বিরাজমান শূন্যতা ব্যক্তিতে ব্যাক্তিতে মিলে সমাজপ্রকৃতি হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে তার কোনো অর্জন শূন্যতাকে পরিপূর্ণ করতে পারে না। সে এক শূন্যতার ক্ষুদ্রতা থেকে ক্রমাগত বৃহতে নিপতিত হয় এবং উপলব্ধিহীন পরিস্থিতির মধ্যে নিজকে খোঁজে তার তৃপ্তির অনুষঙ্গ। সে যেমন শূন্যতার মধ্যে এসেছে তা একটা আকস্মিকতা তেমনি সে সেই আকস্মিকতাকে বিস্তার দিতে চায় নিজের দিকে সব কিছু টেনে। এর মধ্যে তার অসাহয়ত্বের একটা সহায় বা অবলম্বন সে খুঁজে নেয়। এর কোন বিরাম বা ক্লান্তি নেই।কারণ মনোজগতে শূন্যতারও কোনো স্থবিরতাও নেই। জাগতিক আর্জনে তার কোনো অনীহা নেই কারণ এক শূন্যতা তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে। তবু বাস্তবের অভিঘাতে মানুষ এই শূন্যতাকে খুব একটা আমলে নিতে পারে না কারণ সে ইতোমধ্যে একটা সমাজ গড়ে তুলেছে, যার মধ্যে তার অধিষ্ঠান এবং সেখানে আধিপত্য করার অন্যকে অধীন করার সুযোগ রয়েছে, [এর মধ্যে শূন্যতা পুরণ প্রয়াস] এই সুয়োগ শূন্যতা থেকেই উদ্ভুত। মানুষ এবং মানুষ তা কতগুলো কার্যকরণের ফলশ্রুতি, শারিরীক রাসায়নিক ক্রিয়ার একটা গঠন বা বিস্তার থেকে প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের উদ্ভব, যা স্ব-নিয়ন্ত্রিত স্ব-বিস্তৃত এবং স্ব-বুদ্ধির বৃত্তান্ত। তবে তার বিকাশ উন্নয়ণে মানুষ স্বভাবগত ভাবে ও জীবন আচরণের পদ্ধতির মধ্য থেকে বুদ্ধিবিকাশের ধারায নিজেকে যুক্ত করছে প্রতিমুহূর্তের চলমানতায় যা আপাতত তার শূন্যতাকে স্পর্শ থেকে অনুভুতির দরজাথেকে দূরে রাখছে। অর্থাৎ মৌলিক শূন্যতা মানুষের মধ্যে চির বিরাজমান থাকলেও চলমানতায় সে আর তার অবস্থানকে নির্ণয় করতে পারছে না, বা করে না। কিন্তু একটা সময় যখন জাগতিক সকল বিষয়-আশয় থেকে তার অনুপস্থিতি শুরু হয়, [ দৈহিক অক্ষমতা থেকে] অর্থাৎ রিলের কাঠিটি অন্যের হস্তগত হয়, তখন সে আস্তে আস্তে এক শূন্যতার স্পর্শ অনুভব করে। তখন তার মধ্যে জাগতিক অস্তিত্বের চেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরাজাগতিক অনুভব কল্পনায় নির্মাণ করে সামাজিক সূত্রগুলো থেকে। এই খানে তার নিস্পৃহতা, নিসঙ্গতা ধীরলয়ে মহাশূন্যের অস্তিত্বকে প্রকট করলেও সে সব বিষয় নিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারে না, সামাজিক অবস্থানের কারণে।
সমাজের চলমান লোভ, আধিপত্য, নিজ শ্রেষ্ঠত্ব, বা টিকে থাকবার, বেঁচে যাবার চলমান চিন্তাগুলো তাকে চাগিয়ে রাখে এবং একসময় তার অস্তিত্বহীনতার সংকটকে অনেকাংশে নিস্পৃহ করে তোলে। তখন তার মধ্যে জাগে এক অপেক্ষা, মৃত্যুর অপেক্ষা। এ মৃত্যু যেন তার প্রার্থিত, তার সাধনার। অর্থাৎ এখানে আর তার কোনো কাজ নেই, এখানে আর তার কোনো ভোগ নেই, যা আছে তা এখন ওই খানে।ওই খানটাও সে কল্পনা করে নেয়, কেমন থাকবে কীকী পাবে বা পাবেনা, পেতে হলে কী ধরণের সংকটা মোকাবেলা করতে হবে,কী প্রশ্ন হতে পারে, কী জবাব সে দেবে আর দেয়ার তরিকাগুলো কী ভাবে ধর্মীয় নিয়মাবলীতে বিধিবদ্ধ তাই নিয়ে ভাবে। এ ভাবে মানুষ ওইখানের অস্তিত্বকে প্রলম্বিত করে এবং মৃত্যুকে নিজের জন্য গ্রহণ করে।শূন্য থেকে মহাশূন্যে প্রস্থানের একটা চিত্র দাঁড় করায়। আসলে মানুষ শুন্যতাকে অগ্রাহ্য করতে পারেনা,সে মেনে নিতে পারেনা তার অস্তিত্বহীনতা।
দার্শনিকরা এই শূন্যতাকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করে তার বিপরীতে অস্তিত্বকে স্থির প্রজ্ঞা হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। বহুতর নান্দনিক ভাষ্য ও ব্যাখ্যাবলী রচিত হয়েছে, লেখক কবি শিল্পী ও দার্শনিকের ভাষ্যে। অনস্তিত্বের বিপরীতে অস্তিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস রয়েছে এবং এভাবে দার্শনিক চিন্তার অস্তিত্বের অনর্থতাকে ভরাট করে মানব মনে, মানবজ্ঞানে প্রথিত করার চেষ্টা করছে, করেছে। কিন্তু তবু মানুষ শূন্যের হাত থেকে তার ছোবল থেকে নিজেকে পরিপূর্ণ উদ্ধার করতে পারেনা। তাদের এই সব ব্যাখ্যাবলী প্রমাণ করতে চাইছে, শূন্যতার আস্তিত্ব মানুষের নিজের মধ্যে যাকে ভরিয়ে তোলা হয় আস্তিত্ব চিন্তাদ্বারা। আর অস্তিত্ব চিন্তা মানুষের মনের অর্থহীনতাকে প্রশমিত করে। ‘আমি বেঁচে আছি কারণ আমি চিন্তা করতে পারি’। এই বেঁচে আছি চিন্তা তাকে শূন্যতা থেকে নিরাপত্তা দেয়। আবার ধর্মীয় বিবৃতিগুলো শূন্যতাকে ভরাট করে মানুষ তার অস্তিত্ব ঈশ্বরের সংগে যুক্ত করে নেয়। ঈশ্বর বৃহত অংকে মহাশূন্য, তার রূপ নেই, ব্রহ্মাণ্ড অস্তিত্বের চাইতেও বিশাল সে কল্পনায়, আবার অনস্তিত্বও সে কারণ কেউ তাকে দেখেনি। তার উপস্থিতি মহাশূন্যের দিকে, মানে ঈশ্বরই শূন্য অস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বমান, এবং মানুষ ক্ষুদ্র অস্তিত্ব থেকে ঈশ্বর অস্তিত্বে লীন হলে শূন্যতা সক্রিয় এমন এক শূন্যতা যার কোনো পরিমাপ থাকে না, আপনা আপনি সক্রিয় এবং নিস্ক্রিয়তায় রূপবান হয়।
এই শূন্যতা মানবজীবনে অস্তিত্বের সন্ধানে অমৃতের মতো কাজ করে, তাই সে সমাজবদ্ধ। অসায়ত্ব থেকে সহায়ের চিন্তা রাষ্ট্র, সমাজ, ক্ষমতা, অন্যকে ক্ষমতাহীন করার পায়তারা সবই সে করে। বলা যেতে পারে শূন্যতা মানব জীবনের ভোগের পূর্ণতা প্রদানের উদ্দীপনা। শূন্যতা থেকেই মানুষ ভরাতে চায় নিজেকে পূর্ণ করে নিতে চায় সকল ভাঁড়ার। কারণ শূন্যতাকে কোনো সীমায় অস্তিত্বহীন করতে পারে না। নাই এই চিন্তা থেকে আছের চিন্তা, পুরাতনকে ভাঙা, নতুনের আরো অনুসন্ধান এবং বিষয়কে সহজে নিজের দিকে অস্তিত্বমান করার ভাবনা মানুষের শূন্যতার বোধ থেকেই আরম্ভ।

গোষ্ঠিবদ্ধতা ব্যক্তির শূন্যতারই ভরাট আকাঙ্ক্ষা। আর গোষ্ঠি থেকে অন্যগোষ্ঠিকে দখলে নেয়া তাদের নিজস্বতার বিলোপ করে দেয়া শক্তিমানদের শূন্যতা ভরাটেরই প্রয়াস। আর এ ভাবে বহু বহু কাল থেকে যুদ্ধ-বিগ্রহ-ধংস-নির্মাণ হত্যা-লুট মানব সমাজকে এতোদূর এনেছে। ইতিহাসের ধারায় লক্ষ করলে দেখা যায়, দরকার নেই তবু তার চাই, ভোগে, বিলাসে, উশৃঙ্খল জীবন আচরনে, আনন্দে, তার তৃপ্তি নেই, আরো প্রয়োজন। কখনও কখনও ব্যক্তির এই অর্থহীনতা গোষ্টি বা ব্যস্টিকেও মোহান্ধ করে।কারণ তাদেরও শূন্যতা। ফলে এক ধারা থেকে অন্য ধারার অধীনতা প্রকৃত পক্ষেই শূন্যতা ভরাটের কোনো উপশম দেয় না, আপাতত তার অতৃপ্তি আস্তিত্ব সংকট এই ঘটমান ঘটনাবলী নিস্তার দিলেও সে তার শূন্যতাকে ভরাট করতে পারে না। ফলে সংকট তীব্র হয়, এবং নানা ভাবে তার বিস্তার ঘটে। যদিও এই শূন্যতা দৃশ্যমান নয়, [আবার অস্তিত্বহীনও নয়] তবু তার উপস্থিতি রয়েছে মানুষের মনোজগতে। এই জগতে আলো পড়লেই সে তার হীনতা ক্ষীণতা অসায়ত্ব সবই উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু উপযুক্ত মনোউণ্নয়ন ব্যবস্থার অভাবে এই অনর্থকে অর্থরূপে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে না। ক্ষমতা দখল ভোগ, সম্পদ কুক্ষিগতকরণ, যথেচ্ছচারীতা সবই মানসিক শূন্যতার ফলাফল, কারণ এর মধ্যে পিছনে তাড়া করে ফেরা অনর্থ আড়াল হয়। আবার যারা হতাশাক্রান্ত হয়, তাও এক শূন্যতা আর তা অপসারণের শক্তিহীনতায় সে অধীন হয় এবং শূন্যতা থেকেই তার পরিণতিকে মহাশূন্যতায় যুক্ত করে ভাগ্য বলে মেনে নেয়।
শূন্যতা যেমন একদিকে নিস্পৃহতার দিক নির্দেশ করে অন্যদিকে ব্যক্তিকে গোষ্ঠিকে, এমনকী গোটা একটা সমাজকেও তা পূরণে উৎসাহিত করে। এরই পথ ধরে আমরা লক্ষ করি সভ্যতার অগ্রযাত্রা। যদিও চুড়ান্ত অবস্থায় ব্যক্তি শূন্যতা থেকে সামগ্রিক অস্তিত্বকে নিরঙ্কুশ করতে পারে না, কেবল মাত্র সমাজে কর্মচাঞ্চল্য দ্বারা তা ভরাট করে রাখা যায়। সে কারণে সমাজ-রাষ্ট্র কাঠামোতে যা কিছু কল্যাণকর তা সবই শূন্যতাকে ভরাট করে। আবার যা কিছু রযে গেছে এখনও দিকপাতের বাইরে তাই রয়েছে শূন্যতা তীব্রতার পক্ষে। ফলে আমরা পাহাড়ি, আদিগোষ্ঠি, সমতলি, উন্নত অনুন্নত ইত্যাদি পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত হয়ে মানব মিলনের পথকে দুর্গম দুঃসহ করে রাখছি। এর মধ্যে আরো বহুতর অনুষঙ্গ রয়েছে। ক্ষুদ্র মানব সত্তা বৃহতে সামাজিক সত্তা বর্ণে গোত্রে ভাগ হয়ে গেছে। প্রত্যেক মানুষই আদিমানুষের কোনো না কোনো শাখার বিবর্ততিত রূপ। কোনো মানব সত্তাও আজ আর তার অতীতের উপরে দাঁড়িয়ে নেই। আদি গোষ্ঠিগুলোও কেবলমাত্র আদিরূপেই দাঁড়িয়ে আছে তাও সত্য নয়, তাদের অগ্রগতি বৃহতের অগ্রগতির সংগে সংযুক্ত হয়নি তাদের গোষ্ঠিবদ্ধ অস্তিত্বহীন প্রবণতার কারণে, তারা এই ভাবনাকে গ্রহণ করতে পারেনি যে অন্তর সত্তায় সে এবং বৃহত একই বস্তু-বিশ্লিষ্ট রূপ।[ যা তাকে করতেও দেয়া হয় না] তার অভ্যেস রুচি ভাষাকে বদলাবার ক্রিয়ায় যে সুযোগগুলো আজ আশু প্রয়োজন সমতলিরা শূন্যবৃত্তির তাড়ণায় তাকে তামাশা করে রেখেছে।তাদেরকে করে রেখেছে জীবন্ত এন্টিকস। এখানেই তৈরি হয়েছে তার অস্তিত্বহীনতা। তার স্বাধীনতা হীনতা। আর তা’ নিয়ে পরিকল্পিত কর্মপন্থার পরিবর্তে তাকে আদিগোষ্ঠিরূপে চিরকালের প্রদর্শনী করার মধ্যে অন্যের যে বানিজ্য আছে তাকেও চিনতে পারা দরকার। তাকে বৃহতের সংগে মিলিয়ে বৃহত মানবগোষ্ঠির মধ্যে আত্মিকরণ করার কাজটি আজ বড় জরুরী।
সংগত কারণে মানব জনম যে শূন্যতাকে বহন করছে যা সামাজিক সৃষ্টি তাকে পরিপূর্ণ করা যায় মানব কল্যাণবুদ্ধির ধারে কিন্তু বৃহত তা করে না, আর ক্ষুদ্ররা বিশ্বাসও করতে পারে না পরিপূর্ণ আস্থায় নিজেদেরকে স্থানান্তরীত করে। মানুষ অস্তিত্ব হীন হতে চায় না তার শরীরকাঠামো তাকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত।[ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটে] আর তাই সে তার অস্তিত্বকে জাগিয়ে রাখতে চায় তার সামাজিক ইচ্ছার মধ্যে। এতে বহু মানুষের যুক্ততা পাওয়া যায় আবার চক্রান্ত রয়েছে বৃহতের এবং বহুর ইচ্ছার মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ ধংস রিরংসা চালিয়ে নেয়ার। পাবো না এই বৃত্তান্ত থেকে যেমন চুরি করা, পাবো এই প্রত্যাশা থেকে নির্মাণ করা। শূন্যতা থেকে মানুষের মুক্তি নেই/[আছে], সত্য হয়ে থাকবে ততক্ষণ যতক্ষণ না মানুষ কর্মের মধ্যে তাকে অপসারণ করবে ব্যক্তি নয় গোষ্ঠি নয় সামগ্রিক মানবিক কল্যাণ বোধ। সীমাবদ্ধ মানুষ অসীম হয়েছে এই শূন্যতা অনেকাংশে বিদুরিত করতে পারার করণে। ক্ষুদ্র জাতি সত্তাগুলোর মঙ্গল বৃহতে, বৃহতের মঙ্গল নতুনে এবং শূন্যতা পরিহার করে মননে সেই তেজ ও দীপ্তি আনা যে বৃহত হয়ে সে বৃহতকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তার অসায়ত্ব ভাঙণের ক্রিয়ায়। এখানেই শূন্যতার উপশম।

১০.০৬.১৭.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন