সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৭

গল্পঃ আমাদের সাদা ঘোড়া ।। নীলিমা নিগার






আমাদের সাদা ঘোড়া



সকাল বেলা থেকেই নীলের মা ভীষন ব্যস্ত।নাস্তা তৈরি করছে অনেক কিছু।সুজির হালুয়া,পরোটা,ডিমপোচ, আলু ভাজি,নিরামিশ,চালের রুটি,সেমাই,গরুর মাংস ভূনা, মুরগীর ঝোল এইসব।এক হাতেই তার সব করতে হয়।বেগম নামে একটি মেয়ে আছে,সেও তাকে সাহায্য করে সকল কাজে।এদিকে অনেক আয়োজন।তার মামা শ্বশুর এসেছে গতকাল বাড়িতে।প্রায় একমাস অবধী থাকবেন।তিনি অচল মানুষ।ছোটবেলায় তার জ্বর হয়েছিল,সেই থেকে তার দুটো পা অবশ হয়ে গেছে। সেই থেকে আর চলাফেরা করতে পারেনা।কোন রকম লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটে।অনেক চিকিৎসা করা হইছে,কিন্তু লাভ হয়নি।এদিকে সংসারের সকল দায় দায়িত্ব তার বধূই পালন করে থাকে।তার পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে।অনেক বড় সংসার।এরপর থেকে তিনি চলাফেরা করার জন্য ঘোড়া কিনে নিলেন।সাথে সহিস সবসময় থাকত।হাটে যেতেন,এইপাড়া,ওইপাড়ায় যেতেন ঘোড়ায় চড়েই।ঘরে বসে তিনি গড়গড়া টানেন।পিতলের লম্বা কলসীর মতো, তার সাথে
লম্বা পাইপযুক্ত।
মতিদাদু বাসায় বেশির ভাগ সময় বসে বসেই জাল বুনতেন,আর পান খেতেন।তিনি বিশাল জমিজমার মালিক।সারাদিন অনেক বর্গাদার আসেন,তাদের সাথে জমিজমার খোঁজ খবর
নেন আর পান খান।মনের আনন্দে খোঁশ গল্প
করতে থাকেন।তার টাকা পয়সার অভাব নেই।
ছোট ছেলে সুলতান সবসময় বাবার কাছে কাছে
থাকে।ওকে তিনি খুব ভালোবাসেন,যেখানেই
যান,সুলতানকে সাথে করে নিয়ে যান।
মাঝে মাঝে তার আবার শহরতলীতে তার বড় ভাগিনা আব্দুল লতিফের বাসায় বেড়াতে আসেন।মতিদাদুরা একভাই একবোন।তার
বোনের নাম শাবান।দেখতে অসম্ভব সুন্দরী।শাবানের চাঁদে হয়েছেন,তাই বাবা / মা
এই নাম রাখেন।দুই ভাইবোনের আবার খুব মিল মহব্বত। একজন আর একজনকে না দেখে থাকতে পারেন না।তাই মাঝে মাঝে একে অপরের বাড়িতে ঘুরে আসেন।সারাদিন দুইভাইবোন গল্পগুজব করেন,আর নামাজকালাম,দোয়াদরুদ পড়েন।
নীলের এই দাদুভাইটার নাম মতি।
গ্রামের লোকজন সবসুদ্ধ তাকে ডাকে লেংড়ামতি।তিনি আবার অনেক ধনবান।নিজ বাড়িতে একটা মসজিদও করেছেন।
ঈমাম সাহেব বাড়িতেই থাকেন।কাচারিঘরে সবসময় মেহমান,অতিথি লেগেই থাকত।বাড়ি ভর্তি কামলা আর জায়গির বসবাস। সবসময় ব্যস্ততা।একের পর এক ফসল আসতেই থাকে।কখনও ধান,কখনও গম,কখনও আখ,সরিষা,তিল এইসব।বাড়িতে হাঁস,মমুরগী,কবুতর,ছাগল,গরুর অভাব নেই।এছাড়া পাড়ার মাতব্বর ও তিনি ছিলেন।সকল সমস্যা,বিপদআপদে সবাই তার কাছেই ছুটে আসে।তিনি বিচক্ষন ভাবে সবসময় তাহা সমাধা করেন।সকলেই তার রায় একবাক্যে মেনে নেন,আর কোন দ্বিমত পোষন করেন না।যেহেতু সে চলাফেরা করতে পারেনা,তাই সব সময় ঘোড়াও সহিস তার সাথেই থাকে।
সকাল বেলা থেকেই নীল আর তার বড়আপুর লেখাপড়ায় মন নেই।কখন ঘোড়াটাকে নিয়ে পাড়ায় বেড়াতে যাবে,এই বাহানা খুঁজতে থাকে।কিন্তু তার মা আবার খুব কড়া।কিছুতেই তিনি রাজি হবেন না। সামনেতাদের বার্ষিক পরিক্ষা।মা,লেখাপড়ায় খুব সিরিয়াস। এখানে কোন ওজর আপত্তি চলবেনা। সাদা ঘোড়াটা দেখতে খুব সুন্দর।লেজের আগায় একগুছো চুল।মনে হয় বেণি করে দেই।ওকে নিয়ে বের হলে আজকেতো পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা ওদের পিছন পিছন ঘুরঘুর করবে। মাতিয়ে উঠবে পুরোটা শহর। নীল মনে মনে ভাবতে লাগল,আজ খুবই মজা হবে।কিন্তু মাকে কিভাবে পটাবে চিন্তা করছে, মা,কেমনে যেন সব বুঝে যায়,মায়ের নাকি চারটে চোখ আছে,দুটি চোখ সামনে,আর দুটি চোখ পিছনে।সব অপকর্ম ফাস হয়ে যায়। ওদিকে স্কুলেরও সময় হয়ে গেল। দাদু বিছানায় ঘুমাতে পারেনা,নামাওঠা করা তার জন্য জুলুম,কষ্টকর।তাই তিনি আসলে সবসময় নীচে বিছানা করে দেয়া হয়,দাদু সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে,আর নাতনীদের সাথে গল্পগুজব করে সময় কাটিয়ে দেয়।মজার মজার সব রূপকথার গল্প তার জানা আছে।ঠাকুরমার ঝুলি সব তার মুখস্হ।এতো মজা ককরে বলে সেগুলি শুনতেও বেশ আনন্দ লাগে।পড়াশোনা তখন একেবারেই হয় না,এই নিয়ে নীলের মা আবার বেশ চিন্তিত।সামনে
মেয়েদের পরিক্ষা।কি হবে ককে জানে!!! এরা
দুইবোনতো সারাদিন দাদুর ঘরেই আছে,পড়ার টেবিলের ধারে কাছেও নেই।দাদু আবার চুপিচুপি ওদের টাকাও দেয়,টিফিন আর এটা সেটা খাবার জন্য,এজন্য দাদুভাইটা আসলে তখন ঈদ ঈদ মনে হয়,মাও অনেক মজার মজার রান্নাবাড়া করেন।পড়াশোনা ফাঁকি দেয়া যায় অতি সহজেই।নীল বসে বসে ১৬ ঘরের নামতা মুখস্হ করছিল।এই একটা জ্বালা হয়েছে।তার মা সব নামতা মুখস্হ করিয়ে তবেই ছাড়বে।সেদিন পিতাপুত্র অংকটা ভুল করে এসেছে,এতে মা খুব রাগ হয়েছে।আজকে পাঁচ প্রশ্নমালার সব অংক করতে বলছে,কিন্তু নীলের এসব কিছুই ভালো লাগছে না। নীলেরএদিকে পড়ায় একদমই মন নেই।সে
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সাদাঘোড়াটা দেখল।ইসসস!!! কখন ঘোড়া
নিয়ে বাইরে যাবে তবেই তার শান্তি।মা,এসব
কিছুই বোঝে না,শুধু শুধু গাদাগাদা পড়া দিয়ে রাখে।নীলের এখন ইচ্ছে করছে ঘোড়ায় চড়ে
সারাটা পাড়া টহল দিতে,সে উপায় কি আর আছে?ঘোড়ার পিঠে উঠে যখন পাড়াটার মধ্য ঘুরতে থাকে তখন কেমন একটা রাজকীয় ভাব চলে আসে।সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে।তখন বেশ হাসি পায়,আবার মজাও লাগে।সবাই সারি বেঁধে ঘোড়ায় চড়ার জন্য আবদার করতে থাকে।
এটাও বেশ উপভোগ্য।বাবা দেখলে বকা দেয়,এই
শিগগির নাম!!! পড়ে যাবে এখনি, পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙবে এইসব।একটা ম্যাসাকার হবে।
সামনে তোমার পরিক্ষা।
সহিস ছেলেটাও কম বয়সের।সে একের পর
এক সবাইকে নিয়ে ঘুরিয়ে আনে,এতে তার
কোন ক্লান্তি নেই।সেও উপভোগ করে বিষয়টি।
নীল তাকিয়ে দেখল ঘোড়াটা ছোলা,ভূসি খাচ্ছে
মহাসুখে,নীল ঘোড়াটাকে একটু আদর করে দিল।আর কানে কানে বলল,এই শোন!!!
আজ সারাদিন তুই আমার বুঝলি,তোকে নিয়ে
আজ অনেক ঘুরে বেড়াব।আমার সব সখিদের
সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।তুই কিন্তু ওদেরকে
পিঠ থেকে ফেলে দিস না আবার!!!
নীল রান্নাঘরে গেল, 
-----ওমা কি করছ?
----কাজ করছি দেখছনা,
----মা!!! শোন আমি আজকে স্কুলে যাবনা,
কেন?খুব পেট ব্যথা করছে,
----শুধু শুধু পেটব্যথা কেন করবে?
---আমি তার কি জানি,কিন্তু করছেতো?
----সত্যিই করছে নাকি?
-----হা,একদম সত্যি কথা,খুব ব্যথা করছে মা।
----কেন? হঠাৎ করেই খুব ব্যথা করছে,
----আজ আর স্কুলে যাবনা কিন্তু,
----আচ্ছা যেও না,এখন যাও দাদুভাইকে নাস্তাটা দিয়ে আস।কাছে বসিয়ে খাওয়াবে,খেলায় রেখ কোন অসুবিধা যেন না হয়।তারপরঃ ঔষধ খেয়ে
শুয়ে থাক।একদম বাইরে খেলতে যাবেনা
বলছি।
নীল তখন বেশ খুশিমনে দাদুর নাস্তাটা নিয়ে তার ঘরে গেল।আজ সারাদিন ঘোড়াটা তার।আপুও নিতে পারবেনা।কারন আপুর স্কুল আছে।আপু তার তিন বছরের বড়।দুজনের বেশ ভাব।কিন্তু সেই সবসময় ঘোড়াটা কাছে রাখে,তার ইচ্ছেমতোই চলে সব কিছু।সহিস বেটাও তার কথাই বেশি শুনে।নীল একদৌড়ে গিয়ে দেখে আসল ঘোড়াটা কি খাচ্ছে?
খা!! বেটা খা!!! বেশি করে খা!!!
আজ অনেক খাটুনি হবে তোর।
সহিস ছেলেটা তখন ঘোড়াকে বেশ আয়েশ করে গোছল করাচ্ছে,বেশ আয়োজন করে নিয়েছে।নীলের খুব ইচ্ছে করছিল সেও ঘোড়াকে গোছল করায় তার সাথে।কিন্তু মায়ের ভয়।মা খুব রাগ হবে।এসব মা এএকদমই পছন্দ করেন না।তাছাড়া আপাতত তাকে মা
চুপ করে শুয়ে থাকতে বলেছে।নীল যে স্কুল
ফাঁকি দিয়েছে সেটা মার বুঝতে অনেক দেড়ি
হয়ে গেল।
এই আপু আমি কিন্তু আজ আর স্কুলে যাবনা,
----কেন যাবিনা?
---আমার আজ খুব পেটে ব্যথা,
--- ওমা!কি বলিস,
----তাহলে তুই আজকে আর ঘোড়ায় চড়তে পারবিনা,তাইনা!!!
----কে বলেছে পারবনা,অবশ্যই পারব,
যাহ,ততক্ষণ কি আর থাকবে,ঔষধ খেয়েছি,মা বলেছে ভালো হয়ে যাব,আর ব্যথাতো বেশি না,অল্প অল্প।
---আমারও আজ মাথা ব্যথা করছে বুঝলি,
---হমমম
----ভাবছি আমিও আজ স্কুলে যাবনা,
----সত্যি বলছিস
----হা,সত্যি
---মা বকেনি,
----নাহ,খুব ব্যস্ত ছিল,রান্নাবাড়া করছে,
----ও,আচ্ছা!!! তাহলে মা কে বলে আয়,
----বলেছি,মা বলেছে চুপচাপ শুয়ে থাকতে,তাই
শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছি,এখন তবে
চল আমরা দাদুভাইয়ার কাছে গিয়ে শুয়ে
থাকি,আর রূপকথার সব গল্প শুনি।
নীলের মায়ের বুঝতে আর বাকি থাকল না,এরা
দুইবোন স্কুল ফাঁকি দদিয়েছে।কাওকে ঘরে পাওয়া গেলনা।এরা একজনের মাথা ব্যথা আর একজনের পেটের ব্যথা কোথায় চলে গেল।তারা
এখন পুরোপুরিভাবে সুস্হ হয়ে গেছে।
মা ডাকতে থাকল নীল!!! এই নীল!!!
কই গেলি?
কোন সাড়াশব্দ নেই!!!
সহিস ছেলেটারও কোন খবর নেই,ওকে একটু
বাজারে পাঠাতে চেয়েছিল।মেয়ে দুটোরও হদিস
নেই।কারণ নীলরা দুইবোন
তখন সাদা ঘোড়া নিয়ে সারাটা পাড়া ঘুরতে গেছে,আজ তাদের মহা আনন্দের দিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন