সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৭

গল্পঃ প্রকৃতজন ।। রওশন রুবি

প্রকৃতজন


জানালা দিয়ে বিকেলের শীতল আলো আসছে । আজ অনেক মন খারাপ আসাদের। মামা মোশাররফ খসরু তাকে দেখে অবাক হয়নি। যেন জানতো সে আসবে। এমন পরিস্থিতিতে আসাদ অস্বস্তিতে ভোগে। তিনি জেগে ওঠায় সালাম দিয়ে কেমন আছেন জানতে চাইলে সেই উত্তর না দিয়ে বললো
-  খেয়েছো? তোমার চাকরি কেমন লাগছে? অন্য কোথাও চেষ্টা করা ছেড়ে দিয়েছো নাকি? 
-  জ্বি খেয়েছি। কলেজের জন্য নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়েছি।
রেজাল্ট বেরুনোর অপেক্ষায়। 
-  গুড। চেষ্টা করে যাও। প্রায়োজন হলে বলবে।অবশ্য প্রাইমারি স্কুলের প্রতি সরকারের এখন নেকনজর পড়েছে। বেতন স্কেলও ভালো দিচ্ছে। কোথাও চাকরি না পেলে পড়ে থাক। তোমার বড় আব্বার সাথে জমিজমা ঝামেলা মিটমাট হয়েছে?
-  না। এখনও কোন সুরাহা হয়নি। 
-  কি বলতে চাইছেন তিনি?
-   তিনি বলছেন ঘরের ভিটে আর বাগানগুলো মা তার কাছে বিক্রি করে টাকা নিয়েছে। তখন তিনি রেজিষ্ট্রি করে নেননি পরে নিবে বলেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে মা তাকে আর পাত্তা দেন নাই। এখন আমাকে সব লিখে দিতে হবে। এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে মামলা করবে।
-   গাছে আর মাছে মিথ্যে কথা। তোমার মা তাদের থেকে কোন সহানুভূতিই পায় নাই। উপযুক্ত প্রমাণ না দেখাতে পারলে এই মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। রায়ে তুমিই জয়ী হবে। আর জমিগুলো তো সব তোমার মায়ের নামে নয়। তোমার বাবারও আছে। তোমার বাবারগুলো কি তোমার মা বিক্রি করতে পারতো? তাদের কথা অনুযায়ী তোমার বাবার গুলোও তোমার মায়ের। এরা মিত্থুক। তোমারে একা পেয়ে জুলুম করছে সব চুষে নেবার জন্য। তোমার বাবার অনেক জমিজমা ছিলো। সেগুলোর কি করেছে না করেছে আল্লাহ্ জানে। তিনি তো বলবার সময় ও পায়নি কোথায় কি আছে না আছে। তার নিরুদ্দেশ যাত্রা শেষ হতে না হতেই তিনি চলে গেলেন। কে জানতো নিরুদ্দেশ থেকে ফিরে এলেন একেবারে চলে যাবার জন্য। তোমার ফুফুদের সাথে যোগাযোগ রেখো। একবার ভূমি অফিসে গিয়ে খোঁজ নিও। টাকা পয়সা খরচ হলেও দলিল পত্রগুলো তুলে নিও। বাড়ির পূবঘরের তোমার আমানত দাদার থেকে সঠিক তথ্য পাবে। লোকটার মধ্যে জালিয়াতি নেই। তার থেকে কিছু জেনে নিতে চেষ্টা করিও।
-  এখন আমার কি করা উচিত মামলার বিষয়ে মামা?
-  সে বিষয়ে অবশ্যই  চুপচাপ থাকা উচিত। যদি তারা আইনি ব্যবস্থা নেয় তখন মনোবল না হারিয়ে পদক্ষেপ নিবে। আর যদি জোর জবরদস্তি করে নেয়  তখনও লড়তে হবে। দেশের প্রচলিত আইন ন্যায়ের পক্ষে থাকবে। সেরকম কিছু হলে তুমি পূরবীর সাথে যোগাযোগ করবে সে সিভিলের ল'ইয়ার। হাই কোর্টে আছে জানো তো?
-  জ্বি মামা।
পূরবী আসাদের বড় মামার বড় মেয়ে। ছ'বছরেরর বড় আসাদ থেকে। প্রতি শীতে স্কুল ছুটিতে মামা ওদের নিয়ে গ্রামে বেড়াতে আসতো। নিজের বাড়ি, বোনদের বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন তিনি ছেলে মেয়েদের নিয়ে। বড় মুরগি, রাজহাঁসটি, পুকুরের রোয়া উঠা রুই, শোল, কাতলা মাছ তোলা হতো এবং রাতে রান্না করে রাখলে সকালে সর পড়া মাছ তরকারি দিয়ে ধোঁয়া উঠা গরম ভাত খেয়ে  মোশাররফ খসরু পরিতৃপ্তিতে ঢেকুর তুলতেন আর ডান হাত দিয়ে ভরা পেটে হাত বুলাতেন যা দেখলে রাঁধুনির চোখ জুড়িয়ে যেত। তারা বেণুকা খালার বাসায় এলেই দেখা হতো ওদের সাথে। আসাদের বাবা নিরুদ্দেশের পর, যখন কাকারা আসাদের মা ও আসাদকে বের করে দিলো। তখন কেউ নয় আসাদের বেণুকা খালাই তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলো। বড় মামী এবং মামাতো ভাই বোনেরা  ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। ওরা আসাদকে খুব ভালোবাসতো। আসাদ ও তার মাকে ওদের বাসায় যেতে অনুরোধ করতো। আসাদের জন্য খেলার অনেক কিছু ও নতুন জামাকাপড় নিয়ে আসতো। মামা আসাদকে নিজের কাছে বসিয়ে নলা তুলে খাওয়াতো।  সব সময় পূরবী আপা ও নীলা আপা আসাদের জন্য হরেক রকমের চকলেট আনতো। সানি ও সকিল ভাই টেনিস বল, ক্রিকেট বল, ব্যাডমিন্টন , অনেক গল্পের বই নিয়ে আসতো। বলতো স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তোমার জন্য কিনেছি। ওরা সবাইকে তুমি করেই ডাকে আসাদকেও তুমি করে ডাকতো। অনেকবার আসাদ ওদের বাসায় গিয়েছে। ওর মায়ের সাথে কখনও, কখনও বড় মামার সাথে। যে কয়দিন শহরে থাকতো বড় মামী কত রকমারি মুখরোচক খাবার রান্না করতো। বেণুকা খালার সাথে কিছু মিলতো কিছু মিলতো না। পাঁচ খালা ও দুই মামার মধ্যে আসাদের কাছে বেণুকা খালা, তার মা ও বড় মামাকে একই ছাঁচে তৈরি মনে হয়। অন্যরা ভীষণ আল্লাহ্ ভক্ত হলেও। অথচ গরিব আত্মীয়কে গরীব বলে দূরে ঠেলে রাখতেও কুন্ঠা বোধ করে না বরং আনন্দিত হয় একবার বেণুকা খালার দাওয়াতে সব বোন এবং ভাইয়েরা এলো। মেঝখালা আসার সময় সবার জন্য আলাদা ভাবে প্রবাস থেকে পাঠানো শ্যাম্পু, সাবান, কফিগুড়ো আনলো। সবাইকে ভাগ করেও দিলো কিন্তু কিছুই আসাদকে দেবার কথা ভাবলো না। আসাদের মায়ের সামনে পড়ে যাওয়ায় বললো
- আপনাদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আপা। পরে কিছু পাঠিয়ে দিবো। সেই পর আর কখনও হয়নি। মায়ের চোখ ছিল সেদিন নির্লিপ্ত। ঠোঁটে ছিল স্মিত হাসি। যা দেখে তার বেদনা ছুঁতে পারেনি তার পাষাণ বোন। কিন্তু রাতে যখন ছেলের ঘুমন্ত মাথা বুকে জড়িয়ে ডুকরে উঠেছিলেন ঘুম ভাঙা ছেলেটি ঠিক মায়ের সে ব্যথা বুঝতে পেরেছিলো। যা আজও দুখিনী মায়ের মুখের দিকে তাকালে বা দূরে থাকলে সেই শ্রেষ্ঠ মুখ মনে পড়লে ব্যথায় মুচড়ে উঠে বুক। 
    
       খসরু মামা কথা বলতে বলতে সেই যে ঘুমিয়েছেন আর উঠেন নি। এখন সন্ধ্যে ছ'টা পঁচিশ। সুশ্রী একজন নার্স এলেন । খুব মোলায়েম তার চলা। যেন মোমের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মোমের পুতুল। ওর চামড়া উপর দিয়ে ভেতরের রন্ধ্রের মধ্যে রক্ত চলাচলও দেখা যায় । আসাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সেই বিকেল বেলায় হাসান মামা আবার আসবো বলে চলে গেছে আর আসেনি। হাসান মামা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আসাদের মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধু । আসাদের একটু বাইরে যাবার ছিলো তবুও যেতে পারেনি। খসরু মামাকে একা ফেলে যায় কি করে? হাসান আলীই একদিন আসাদের বাবাকে খুঁজে পেয়ে নিয়ে এসেছিলো। তিনি সিলেট গিয়েছিলেন ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত দেখতে মাধবকুন্ডে গিয়েছিলেন। সেখানে একজন লোকের ধাক্কায় পড়ে গেলেন স্রোতের মধ্যে। নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটির দিকে রাগাম্বিত চোখে তাকিয়েই রাগ পড়ে গেল। কারণ লোকটি একজন পাগল। হাসান আলীকে ফেলে দিতে পেরে হলুদ দুখানি দাঁতে কালো হয়ে যাওয়া উপরের পাটির সামনের চারটি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে হি হি করে হাসছে আর বলছে 
-  হি হি হি! ফাইলে দেইলুম। ফাইলে দেইলুম। আমাকে যে ফাইলে দেইলু। মর! মর! মর ! হি হি হি ...... হাসান আলী স্রোত থেকে উঠে আর পাগলকে দেখতে পেলেন না। তিনি ভেজা কাপড় নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে চলে আসবার জন্য সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে প্রবেশ মুখর কাছে এলে দেখলেন পাগল এক পানদোকানের নিচ থেকে পানের বোঁটা, পরিত্যক্ত কাগজ ইত্যাদি তুলে তার ব্যাগে রাখছে। দু'জন লোক পান কিনতে এলে একজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলা আবার হি হি হি করে হাসছে আর ঐ বাক্যগুলো বলছে। দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি যা যা, দূরহ্! দূরহ্! পাগল বলে পাগলকে তাড়িয়ে দিলে পাগল তার ধূলোবালি জমে থাকা নোংরা মোটা কালো দুটি বুড়ো আঙ্গুল তুলে বলে -  কেইচু কেইচু কইরতে পেরবি আনেস। কি মেইজা! কি মেইজে! তুই মর মর মর আনেস। হি হি হি .... নামটা খুব পরিচিত এবং পাগলের মুখে নামটি শুনে ওদের রেখে কিছু সামনে এগিয়ে আসা হাসান আলী ফিরে ভালো ভাবে মুখটি দেখে। নোংরা কালো মুখটি তার তখন চেনা লাগে। সে সেখানের প্রশাসনিক সহায়তা নিয়ে পাগলকে পাবনা পাগলা গারদে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সেখানে দীর্ঘ সময় চিকিৎসার ফলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। এবং একদিন হাসান আলী তাকে মোশাররফ খসরুসহ আসাদের বেণুকা খালার বাড়ি নিয়ে আসেন। আসাদের বাবার আগমনে প্রতিটি মানুষ খুশি হলেও আসাদের বড় আব্বা খুশি হয়নি। মৃত্যুর আগে আসাদ ও তার মাকে বলে গেছেন আসাদের বাবা -  ও আইমারি লোইকজেন দেইয়ে মাইরে পাড়োর নেইচে ফাইলে দেইছে। 
আসাদের বড় আব্বা এইসব কথা পাগলের প্রলাপ বলে উড়ি দিয়েছে। আসাদরা আর্থিক ও সামাজিক দূর্বলতার কারণেই বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে পারেনি। নার্স তার কর্তব্য পালন করতে করতে ডাক্তার বিমল সাহা এলেন। বহুবছর আগে মামার বাসায় তাকে দেখেছিল আসাদ। তখন থেকে এখন অনেক বদলেছে। তখন ছিল সদ্য পাশ করা ডাক্তার। দৃষ্টি ও স্মরণ শক্তি  তীক্ষ্মতা দেখে অবাক আসাদ। তাকে দেখেই চিনতে পারে এবং জানতে চায়
-  কি মোবারক কেমন আছো? অনেক বড় হয়ে গেছো? আসাদের অন্য নাম মোবারক হোসেন। ঠিক মনে রেখেছেন তা। 
-  জ্বি, ভালো মামা। আপনি?
-  আর আমাদের থাকা.....
খসরু মামা এর মধ্যে উঠে পড়েছেন। হাসান আলীও এলেন তিন বন্ধুকে রেখে আসাদ ব্যলকনিতে দাঁড়ালো।

তিন বন্ধুর গল্পের ভেতর পূরবী আপা, সানি ও সাকিল ভাই এলো। রাত বাড়তেই একে একে সবাই চলে গেছে আসাদ ও মোশাররফ খসরুকে রেখে। ওদের যাবার ভঙি এরকম ছিল " আচ্ছা  থাক। আমরা কাল আসবো।" আসাদ আশ্চার্য হয়েছে। ওদের বাবা; ওরা এভাবে আসাদের ভরসায় ফেলে চলে গেলো? যদি আসাদ না আসতো তবে কে থাকতো মামার কাছে? শহরে থাকতে থাকতে মানুষগুলো কেমন যান্ত্রিক ও বোধহীন হয়ে পড়ে। খুব অবাক হয় আসাদ। গ্রাম্য জীবনে সম্পর্কের প্রতি সম্পর্কের যে সম্মান বোধের শীতলতা তা আসাদকে গভীর ভাবে নাড়া দেয়। সে রুমের পাশে ছোট ব্যালকনিতে গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। আকাশ দেখা যায় না অসংখ্য হলুদ লাইটের তীব্র ছটায় । যেখানে আকাশ দেখা যায় না, ঘাস, মাটি স্পর্শ পায়না মানুষ। পাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙে না। পাখিদের ঘরে ফেরা ডানার মিহি শব্দ গাঁথেনা প্রাণে। ভাটিয়ালি, রাখালিয়া যান্ত্রিক বাক্সে বেজে চলেছে সেখানকার মানুষদের দিনে দিনে ক্ষয়িষ্ণু হয় বোধ। মায়ামমতা এরা কিনে নেয় টাকার বদলে। হায়রে দুনিয়া ! হলুদ লাইট জুড়ে উড়ছে অজস্র পোকা। লাইটগুলোকে আকাশের অনুজ্জ্বল তারা মনে হয়। যেন নেমে এসেছে দলবেঁধে তারারা এই শহরে। দীপাবলির আলো যেমন দোলায় রাতের উর্ধ্ব আবরণ। মনে হয় এই আলো রাতের অন্ধকারকে ছিন্ন ভিন্ন করে তেমনি দীপাবলীর আনন্দে স্বেচ্ছায় জেগে থাকা কিশোর কিশোরীদের পরিতৃপ্ত আত্মার অবিকল নৃত্য করে। সেই নৃত্যের রেশ লেগে থাকে চোখে ও মনে। প্রায় অবলুপ্ত  মাটির গন্ধ শুঁকে শুঁকে তবু যেন কতো কতো লোক ছুটে যায় মধ্যবিত্তের আঙ্গিনার দিকে । কতো কতো লোক ছোটে নিন্ম আয়ে জোড়া সংসারের দিকে। খুব কম সংখ্যকই খুঁজে পায় অট্টালিকার উদ্ভিদের মাটি ছাড়া মাটির গন্ধ। সেখানেও আজকাল মিশে যাচ্ছে অজৈব উপাদান। বেঁচে থাকার তাগিদে তবু যে যেখানে, যে যেমন তেমনি বেঁচে থাকা শিখে যায়। প্রথম খাদ্য গ্রহণ কেউ যেমন শেখায়না। শিশু অনুসন্ধান করে নিকটজন সহৌযোগিতা করে তেমনি বেঁচে থাকাও যার যার তার তার।  কার্তিকের শুরু থেকে যে-বোষ্টমীপরিবার করতাল বাজিয়ে ঘুম ভাসিয়ে নিয়ে যেতো কাকভোরে 
ভুলতে পারেনি তাদের আসাদ । আজও তাই নিদ্রাহীন রাতের কোলে শুয়ে ওদের কথা কেন যেন খুব মনে পড়ে। অনিতা বোষ্টমির গলাটা ঘুমের গহ্বর থেকে তুলে আনতো চৈতন্যকে। জেগে উঠতো আসাদ। জানালা খুলে কার্তিকের ঘুমভাঙা প্রকৃতিকে দেখে মুগ্ধ হতো
যাপিত স্বপ্নে সমারোহে বিভোর হয়ে থাকা ছাড়া আর কিইবা করার আছে। গ্রামে বা শহরে কোথাও বোষ্টমিদের এখন সাক্ষাত পাওয়া যায় না তেমন। ব্যস্ত জীবনের চোরা স্রোতে অজান্তেই ভেসে যায় কতো জীবনতরী। তারাও হয়তো তাদের মতো শিখে গেছে বেঁচে থাকা। 

মাথার কাছে রাখা মোবাইল ফোনের কাঁপুনিতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখলো রাত দেড়টা বাজে। ঘুম জড়ানো গলায়
-   হ্যালো! বলতে বলতে ব্যালকনিতে চলে গেলো আসাদ। আড় চোখে দেখে নিলো মামা টের পেয়েছে কিনা। না তিনি ঘুমচ্ছেন। 
-  আমি  আরিফ রেহমান। ঘুমিয়ে পড়েছিস না? ভেবেছিলাম লিখছিস। তাই ফোন কলাম। দোস্ত জরুরী কথা আছে তুই আমার সাথে একটু কথা বলতে পারবি? 
-  পারবো। চাইলে দেখাও করতে পারি। 
-  মানে কি দাঁড়ায়! তুই এখন এই শহরে?
-  হুম। গতকাল থেকে । বড় মামা স্টোক করেছে।  
- থাকবি ক'দিন।
-  কাল পর্যন্ত।
-  দেখা না করে চলে যাবি না।
-   016189510.. এই নাম্বারে ফোন করিস। যেটায় কথা বলছি ওটা দিনে বন্ধ থাকে।
- ওকে। 
-  মামা এখন কেমন আছে?
-   ভালো।
-   তাকে দেখতে যাবো। তবে বলতে পারছিনা কখন। অফিসে গেলে বুঝবো। তোর সাথে দেখা ওখানেও হয়ে যেত পারে।
-   ঠিক আছে। ফোন দিস্।
-  তবে এখন রাখ। মামা জেগে উঠতে পারে। কাল সব ঠিক করে নিবো। গুড নাইট।
-  ভালো থাকিস। গুড নাইট।
রাতেই আরেক জন ফোন দিয়ে জানালো তিনি জ্বীন জাতি। ঘুমের ঘোরে শুয়ে শুয়ে নিচু স্বরে আসাদ বললো "হু" তারপর বিভিন্ন হেদায়েত দেয়ার চেষ্টা করলো। ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জদের নামাজ পড়তে বললো। খুব সরুগলায় দু'চারটা প্রশ্ন করলো আসাদ তাকে। উত্তর দিতে পারলোনা। অপ্রয়োজনীয় ফোনে ঘুম ভেঙে গেলো। আর ঘুম এলো না। খুব ভোরে কাকের ডাকাডাকি তে বুঝলো গভীর রাতের শান্ত ঢাকা শহর জেগে উঠেছে। আসাদ বিছানা ছেড়ে ভোরের হাওয়া মেখে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো। কী শীতল শান্ত লাগছে সব কিছু। আশ্চার্য আধাঘন্টা পেরুতে না পেরুতে চোখের সামনের দৃশ্যগুলো বদলে গেলো। আসাদ প্রাত কাজ শেষ করে এক গ্লাস পানি খেলো। সকালে খালি পেটে পানি খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। ছোট থেকেই আসাদের মা অভ্যাসটা করিয়েছে। সকালে নার্স এসে মামার প্রাতঔষধের নিয়মাবলী সারলে মামাকে কিছুক্ষণ একা রেখে আসাদ নিচে নামলেন। নাস্তা করে উপরে উঠে দেখলেন নীলা আপা এসেছে। তিনি মোশাররফ খসরুকে খাওয়াচ্ছেন। আসাদকে দেখে বললেন 
-   কেমন আছো?
-  জ্বি ভালো। আপনি?
-  বাবা অসুস্থ থাকলে মেয়েরা যেমন থাকে তেমন।
- ওখানে তোমার নাস্তা আছে খেয়ে নাও।
-  আমি খেয়েছি।
-  শুনো আসাদ বাবাকে ওভাবে একা ফেলে নিচে যাবে না। আমার বাসায় থাকার প্রবলেম। খুব ছোট ছোট তিনটে রুমে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকছি তাই বাসা বদল করার আগে আমার কাছে রাখতে পারবো না বাবাকে। বড় আপার শশুর শাশুড়ি দুজনে তাদের কাছে থাকে এবং দুজনেই খুব অসুস্থ তার উপর ওর বড় ছেলেটা অটিস্টিক। নিজে নিজে খেতে পর্যন্ত পারে না। ছোট মেয়েটার বয়স তিন বছর। ধরতে গেলে চারজনই শিশু। এ অবস্থায় বাবাকে সেও টেককেয়ার করতে পারবে বলে মনে হয়না। বাবার যে কন্ডিশন তাতে ওনাকে একা ও রাখা ঠিক নয়। উভয় সঙ্কটে পড়েছি। তুমি কি কিছু দিন বাবার কাছে থাকতে পারবে? 
আসাদ বুঝতে পারে না নীলা আপার মাথায় গন্ডগোল আছে কিনা। যদি গন্ডোগোল না থাকে তবে কি করে একজন অসুস্থ মানুষের সামনে এই সব কথাবার্তা বলে মানুষটার মন ভেঙে দিচ্ছে? যেখানে তাকে টেনশান মুক্ত রাখা জরুরী। সেখানে আরো টেনশান চাপিয়ে দেয়ার মতো নিঠুরতা? তাছাড়া আসাদ একজন সরকারি চাকরিজীবী। তার তিনদিন ছুটি শেষে সে ওপেনিং ডে তে তো কর্মস্থলে থাকতে হবে। তারপর হয়তো তিনদিনের ছুটি নিয়ে আবার আসতে পারে। কিন্তু এরা তো পুরোই আসাদের উপর ঢিল ছুঁড়ে বসে আছে। এরা তো মনুষত্ব হারাতে হারাতে এমন হয়েছে যে অন্যের সমস্যা থাকতে পারে তা ভাবতেই পারেনা। এই এদের সাথে শৈশবে দেখা এদের কোন মিল নেই। কেন এতোটা দ্রুত মানুষ বদলে যায়?
পনেরো মিনিট আরো থেকে তিনি চলে গেলেন। সেই থেকে ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে অাসাদ।
আরিফ রেহমানের ফোন আসার কথা। এলো না। তাই টেনশান হচ্ছে আসাদের। কি বলতে চাইলো? কি জরুরী কথা ছিলো? ওর অফিসে যেতে হবে, নাকি যেতে হবে না ? ও কি আদো আসবে? ভাবতে ভাবতেই ফোন তুলে নিলো আসাদ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন