সোমবার, ১১ জুন, ২০১৮

এভাবে ঘুমানো যায় ।। সজল মালাকার



এভাবে ঘুমানো যায়

পায়ে বিঁধে যাওয়া কাচের টুকরোগুলি অমানুষিকভাবে বের করছে ডাক্তার। আমি 'মাগো' বলে সজোরে চিৎকার করছি। মা ঘুমচোখে আমার রুমে ছুটে এলেন। ব্যতিব্যস্ত হয়ে লাইট জ্বালালেন। আমাকে কয়েকবার ডাকলেন। সাড়া দিলাম না। দিতে পারলাম না।
আমার কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম আঁচল দিয়ে মুছে নিজের রুমে ফিরে যাচ্ছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু ঠোঁট, জিহ্বা, চোখের পাতা, শরীর কিছুই নাড়াতে পারছি না।



পাশ দিয়ে, লাবণ্য দিদি ক্ষিপ্রগতিতে হেঁটে যাচ্ছেন। কোর্টপয়েন্টের জ্যামের যানবাহন দিদির সাথে পাল্লা দিতে পারছে না। তা দেখে কিছু হাসি আড়ষ্ট ঠোঁট কিঞ্চিৎ প্রসৃত করলো। 
শক্ত ঝাঁকুনিতে দুজন লোক প্রায় সমস্বরে 'ইয়া আল্লা...' বলতেই আমি সিএনজির বামপাশের রডটা শক্ত করে চেপে ধরি। অল্পের জন্য দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা পেয়ে ওসমানী মেডিকেলে পৌঁছাই।


ভীষণতর চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সুমনের কথা মনে পড়ে। খারাপ লাগছে। তাকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলাম না। কী করব, লালাখাল যাওয়ার জন্য রেডি হলেও মেডিকেল যাওয়াটাই জরুরি হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে, যেতে হলো খাবার নিয়ে।



ঘুম আসছে না। সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণনের শব্দে মেয়েটার চিৎকার শুনছি। রাতের নিস্তব্ধতা তার অসংলগ্ন কথাগুলো আবৃত্তি করছে। মেয়েটির মায়ের পীড়িত মুখখানি ঘুম তাড়াচ্ছে চোখে বসে।

বাস-সিএনজি সংঘর্ষে মেয়েটির ডানহাতের হাড্ডি-মাংস পিষে, মিশে গেছে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এখন সে পাগলপ্রায়। সনজিতা বলেছিলো, মেয়েটি অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিতে সিলেট আসার পথেই...



চোখ বুজতেই সনজিতা হাত চেপে ধরলো। খুব ভয় পাচ্ছে সে। বেশ কদিন আগে রিকশা থেকে নামতে গিয়ে পায়ের আঙ্গুল কেটেছে। ইনফেকশন হওয়ায় এখন ছোটখাটো অপারেশন লাগবে।
বিড়ালটার যন্ত্রণায় ঘুমানো গেল না। হাতের উপর শুয়ে আছে। বিরক্তি নিয়ে টেলা দিতেই পালঙ্ক থেকে পড়ে ম্যাঁউ ম্যাঁউ শুরু করলো। নয় বছর বয়সী ছেলেটা 'মাগো মাগো' চিৎকারের মতো কানে বাজলো বিড়ালের ডাক। অপারেশন থিয়েটারের দেয়াল ভেদ করে ছেলেটার চিৎকার কানে এসে ভেতরটা নাড়া দেওয়ার মুহূর্তটা মনে পড়তেই গায়ে কাটা দিলো।


দুপুরে বেরিয়ে রাত প্রায় বারোটায় বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েছি। কিন্তু ঘুমাতে পারলাম কই। দিনটির খণ্ডখণ্ড দৃশ্যপট জীবন্ত হয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিচ্ছে।


 সনজিতাকে ঘুমে রেখেই এসেছি।

সে আর পিসি যখন খাচ্ছিলেন, দেখলাম- গলা দিয়ে ভাত নামছে না কারো। এমন পরিবেশে খাওয়া যায়। তবু খেতে হয়।


অস্বস্তি লাগছে। ঘুম আসছে না। সন্ধ্যে সাতটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত অপারেশন থিয়েটারের সামনে সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষায় বসে থাকার মধ্যে কী আর কম অস্বস্তি, বিরক্তি ছিল। তখন তো ঘুমের ঢল নামতে চাইছিলো চোখে। কিন্তু এখন...

এখানে তো কেউ যন্ত্রণায় চেঁচাচ্ছে না, এখানে কেউ ছেলের জন্য কান্নাকাটি করছে না, হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে কেউ ছোটাছুটি করছে না, জামায় রক্তের দাগ নিয়ে কেউ বসে নেই, এক্সিডেন্টের বর্ণনা শুনিয়ে কেউ দেখাচ্ছে না হাত-পায়ের ছিলে যাওয়া চামড়া, ট্রলিতে বাবাকে নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে নেই, কেউ গার্ডের সাথে তর্কাতর্কি করছে না, সিরিয়ালের অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে কেউ গালাগালিও করছে না। তবে?

চোখ জ্বলছে। মাথা ধরেছে ভীষণ। পাখির কিচিরমিচির বিরক্ত লাগছে। অথচ ভোরে পাখির কিচিরমিচির শোনার জন্য কত রাত জেগেছি।


'উন্নয়নের মহাসড়কে', 'ট্রাফিক আইন মেনে চলুন', 'মহাকাশে বাংলাদেশ', 'দেশ এগিয়ে যাচ্ছে' 'বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত ২৩, নিহত ৩ জন'। 
টুকরো টুকরো কথাগুলো কানে বাজছে।
উফ! এই সাতসকালে টিভি দেখছে কে?

চোখ বন্ধ অবস্থায় হাঁক দিলাম, স্বর্ণা...

কাচ ভাঙ্গার শব্দ শুনে চমকে উঠলাম।


এভাবে ঘুমানো যায়?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন