উত্তরাধুনিকতাবাদ(পোস্টমডার্নিজম) ধোঁয়াশা
রাজনৈতিক মানদণ্ডে উত্তরাধুনিকতাবাদ মূলত মার্কসবাদী দর্শনকে অস্বীকার করে এমনটা ধারণা করা হয়।সাহিত্যেও উত্তরাধুনিকতাবাদকে চিহ্নিত করার বহু কসরত দেখেছি কিন্তু কোন দার্শনিক, সমালোচক স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারছেন না;সে অক্ষমতা স্বীকারও করেন তাঁরা ।অবশ্য যাঁরা নিজেদের উত্তরাধুনিক কবি-সাহিত্যিক দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন,তাঁরাও নাকি এই বিষয়ে তেমন কোন যুক্তি-তত্ত্ব খাড়া করতে পারছেন না।বিষয়টা কী আসলেই ফাফা?নাকি রোমান্টিসিজম খুব সহজে আধুনিকতাবাদকে স্বীকার করেছে?কিংবা কোন মতবাদকে খুব সহজে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে?এসব প্রশ্নের উত্তর জানার দরকার নেই,শুধু একটু ভাবনার মধ্য রেখে আমি বলতে চাচ্ছি যে সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে এখন উত্তরাধুনিকতার সংজ্ঞা নির্ণয় করা জরুরী বোধ করি।আর সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই আমি এই প্রবন্ধ লেখার উৎসাহ অনুভব করছিলাম ঠিক তখনই গুগোল উত্তরাধুনিক উইকিপিডিয়া জানালো এই তথ্য। যা নিচে উদ্ধৃতি হিসেবে পেশ করা হলো দেখুন,-
দুবাংলায় উত্তর আধুনিকরা ‘উত্তর’ ও Post-এর পার্থক্য হাজির করে বলছেন, উত্তর আধুনিকতা ও Postmodernism এক কথা নয়। ‘আধুনিকতা’র আগে ‘উত্তর’ প্রয়োগ দ্বারা তারা ‘আধুনিকতা-উত্তীর্ণ’ হওয়াকে বোঝাচ্ছেন। পাশ্চাত্যে কিন্তু Postmodernism দ্বারা তা বোঝানো হয়নি। তারা Modernism-এর আগে Post ব্যবহার করে কালগতভাবে Modernism-এর পরবর্তী ধাপকে বুঝিয়েছে। যাই হোক, উত্তর আধুনিকতা বলতে বুঝায় সেই অবক্ষয় বা স্বেচ্চাচারিতা থেকে উত্তরণের প্রয়াসকে, যে অবক্ষয় বা স্বেচ্ছাচারিতা দোর্দণ্ড প্রতাপবান আধুনিকতার আস্তাকুঁড়ে জন্ম লাভ করেছে। উত্তর আধুনিকদের মতে, আমরা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি আধুনিকতার কারণে। অবশ্য কোনো কোনো মহল, যেমন দৃষ্টান্তবাদীরা, এমন কিছু মনে করেন না। তাদের মতে, অবক্ষয় বিভিন্ন কারণে আসতে পারে, কিন্তু এর জন্য কেবল আধুনিকতাকে দোষারোপ করা যায় না। যদি করা হয়, তবে পরোক্ষভাবে যুক্তিবাদিতা, ধর্মনিরপ্রেক্ষতা ইত্যাদির মতোন আধুনিক আলোককে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেলা হয়। উত্তর আধুনিকরা আধুনিক-পূর্ব সময়ের মিথ, উপকথা, লোকবিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস, কৃষ্ণ, হাছন, লালন ইত্যাদিকে সামনে রেখে পুনর্চর্চায় ব্রতী হতে সবাইকে আহ্বান করে।
আচ্ছা বেশ সেতো হতেই পারে কিন্তু তাতে কি আবার ফিরে আসবে পুরাতন ঐতিহ্য?যা গেছে তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, বা সে চেষ্টা করাও বৃথা।তবে ওসবের পুনর্বির্ণিমান হতেই পারে এবং সে হচ্ছেও সাহিত্যে।যাইহোক তর্ক নয়;ওসবে আগ্রহও নেই।তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে উত্তরাধুনিকরা আধুনিকতাবাদকে অস্বীকার বা আক্রমণ করেই নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।কিন্তু কীভাবে?সেটা বুঝতে আধুনিকতাবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক তাই আগে সংক্ষিপ্তভাবে একটু আধুনিকতাবাদ নিয়ে দুচার কথা বলে নেয়া ভালো।কিন্তু আধুনিকতাবাদেরও খুব সহজ সংজ্ঞা হয় না,তবুও চেষ্টা করা দেখা যাক।
আধুনিকতা একটি দার্শনিক আন্দোলন যা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা সমাজে সুদূর প্রসারী ও ব্যাপক রূপান্তরের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রবণতা ও পরিবর্তনের সাথে সাথে উত্থান লাভ করে। যেসব ফ্যাক্টর আধুনিকতাবাদকে বর্তমান রূপ দান করে তার মধ্যে শিল্পভিত্তিক সমাজ গঠন, নগরের দ্রুত বিকাশ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। আধুনিকতাবাদ আলোকায়নের চিন্তাধারার অভ্রান্ততাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং অনেক আধুনিকবাদী ধর্মীয় বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করেন।
সাধারণভাবে আধুনিকতাবাদের অন্তর্ভুক্ত সেইসব লোকেদের কাজ ও সৃষ্টিকর্ম যারা অনুভব করেন ঐতিহ্যবাহী শিল্প, স্থাপত্য, সাহিত্য, ধর্মীয় বিশ্বাস, দর্শন, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, দৈনন্দিন কাজকর্ম এমনকি বিজ্ঞানও পুরোপুরি শিল্পায়িত সমাজের উত্থানের ফলে নতুন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও সেকেলে হয়ে পড়েছিল। কবি এজরা পাউন্ডের ১৯৩৪ সালের "এটি নতুন করে করুন" এর ডাক আন্দোলনটির যাকে তারা পুরনো দিনের সংস্কৃতি হিসাবে দেখত তার প্রতি অগ্রসর হওয়ার একটি স্পর্শপাথর ছিল। এর আলোকে এর নানা উদ্ভাবন যেমন চেতনা-প্রবাহের উপন্যাস, প্রায়শ্চিত্তমূলক ও বার সুরের সংগীত, ডিভিশনিস্ট ছবি ও বিমূর্ত চিত্রকলা সবই ঊনিশ শতকের অগ্রদূত ছিল।
আধুনিকবাদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল আত্মসচেতনতা এবং সামাজিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্য নিয়ে বিদ্রুপ, যা প্রায়ই কাঠামো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে নিয়ে যেত ও ছবি, কবিতা ও দালান ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা পদ্ধতি ও উপকরণ প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট করত। আধুনিকতা স্পষ্টতই বাস্তবতাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে এবং অতীতের কাজগুলোকে নতুন করে দেখা, লেখা, বিবেচনা ও বিদ্রুপ করে।
কিছু ভাষ্যকাররা আধুনিকতাকে চিন্তার একটি ধারা হিসাবে ব্যাখ্যা করেন- এক বা একাধিক দার্শনিকভাবেসংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্যগুলি, যেমন আত্নসচেতনতা বা আত্মোল্লেখ, যা সমস্ত নৃতাত্ত্বিক ও শিল্পকর্মের মধ্যে চলছে। বিশেষ করে পশ্চিমা জনগণ, যারা একে সমাজে চিন্তার প্রগতিশীল ভাবধারা বলে মনে করে, যা মানুষকে ব্যবহারিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা প্রযুক্তির সাহায্যে তাদের পরিবেশ সৃষ্টি, উন্নয়ন ও পুনঃনির্মাণ করার ক্ষমতাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এদিক থেকে আধুনিকতাবাদ যা অগ্রগতিকে আটকে রাখছিল তা খুঁজে বের করার লক্ষ্যে বাণিজ্য থেকে দর্শন পর্যন্ত অস্তিত্বের প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিবেচনাকে এবং একই প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য নতুন উপায়ে তা প্রতিস্থাপন করার লক্ষ্যে উত্সাহ দেয়। অন্যরা নান্দনিক আত্মঃদর্শন হিসাবে আধুনিকতার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া এবং ফ্রেডরিখ নিৎশে (১৮৪৪-১৯০০খ্রি.) থেকে শুরু করেন স্যামুয়েল বেকেট (১৯০৬-১৯৮৯ খ্রি.) পর্যন্ত বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও শিল্পীদের প্রযুক্তিবিরোধী ও নাস্তিবাদী দিকগুলো বিবেচনা করা হয়।(তথ্য সূত্র/আধুনিকতাবাদ উইকিপিডিয়া)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন