মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১৮

সৃজনশীল কাজে তরুণদের শনাক্ত করা দরকার ।। মতিন বৈরাগী

সৃজনশীল কাজে তরুণদের শনাক্ত করা দরকার

মতিন বৈরাগী

প্রতিভা ও মেধা দু’টি শব্দ প্রায় সম-অর্থবোধক মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে প্রতিভা কেবল মাত্র মেধা নয়।মেধাও হুবহু প্রতিভা নয় । অনেক খানি সম্পৃক্ততা খানিকটা ভিন্নতা রয়েছে। অনেকেই বলেন পৃথিবীতে প্রতিভা নিয়ে সমভাবে সকলে জন্মগ্রহণ করেনা। কেউ কেউ বলেন প্রতিভা সৃজনশীল কাজের সংগে যুক্ত এবং বিশেষ ক্ষেত্রে এই প্রতিভা ব্যক্তিকে বিশেষ কাজে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করে, দূর দেখতে সফলতা দেয়। দৃশ্যমানত সকলে রবীন্দ্রনাথ, গ্যোটে, কিংবা হেমিঙওয়ে, আইনেস্টাইন বা হকিংস প্রমুখ নন । কেউ কেউ আবার মেধা যা শ্রম-উৎকর্ষতায় যোগ্য করে তোলে তা কমবেশী প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকে, এবং মানুষ তার কর্মের ঐকান্তিকতা, পুন পুন চেষ্টায় তার বলবৃদ্ধি ঘটাতে পারে। প্রতিভাবানের পরবর্তি প্রজন্ম প্রতিভাবান হবে এমন কোনো কথা নেই, মেধাবী মা বাবার সন্তানরা কখনও কখনও মেধার স্বত্ব উত্তরাধিকারে লাভ করে থাকে। কিন্তু সত্য নয় যে তা লাভ করবেই, অনেক মেধাবীর পরবর্তি প্রজন্ম মেধাশূন্য এমন দৃশ্যমানতা রয়েছে। জীবনানন্দ বলেছেন ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি,’ সম্ভবত সে কথা তিনি প্রতিভাবান কবির দিকে দৃষ্টি রেখেই বলেছিলেন। সন্দেহ নেই যে প্রতিভাবান ব্যতিরেকে সৃজনশীল কাজ যেমন সাহিত্য, চিত্র, ভাস্কর্য্য, নৃত্য ও সংগীত এসবে এমন একটা কিছুর প্রয়োজন পড়ে যা সৃজনে নতুনত্ব আনে এবং ব্যক্তি উপলব্ধিকে বিশ্ব-উপলব্ধির সাথে যুক্ত করে। মেধা দরকার হয় সময়কে বুঝতে, সমকালকে উপলব্ধি করতে, নির্মাণকে নির্মোহ করতে এবং কৃতকৌশলগুলোকে বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকে সিদ্ধ করতে।
সকলেই বিশ্বশ্রুত ও নন্দিত মানুষ হয়ে পৃথিবীতে কাল কাটাতে আসেনা। তবে নিচে পড়ে যে থাকে সেও অপাঙক্তেয় নয়। সমাজে তার শ্রম বিনিয়োগে প্রতিভাদীপ্ততা না থাকলেও সামাজিক নিয়মাচারে সে বড় হয় বিষয় প্রসংগে অবগত হয়, জীবিকায় অর্জিত অভিজ্ঞতার প্রয়োগ হয় এবং এই ভাবে জাতীয় উৎপাদনে তার ভূমিকা যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করে উদ্বৃত্তমূল্য। যদিও সে আলোচ্য কোনো কালে নয়, কোনো অংশে তার কর্ম গুরুতর প্রয়োজনীয় বলে কেউ স্বীকারও করেনা, যুদ্ধে বীরের ইতিহাস হয় অথচ যুদ্ধটি করে সাধারণ সৈনিক, মরেও সে লড়েও সে। তবু একজন প্রতিভাবান জেনারেল তার প্রতিভাগত যৌদ্ধকৌশল কে ধ্রুপদী স্টাইলে পরিচালিত করে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে, একজন সাধারণ যোদ্ধার অনিবার্য জীবনদানকে রক্ষাও করতে পারে। এখানে দুটো জিনিস লক্ষণীয় এক প্রতিবাদীপ্ত জেনারেল তার প্রতিভাবলে যুদ্ধকে ছন্দবদ্ধ করে হিসেব নিকেশকে প্রায় নিখুঁত করতে পারে, এবং একজন সাধারণ সৈনিক তার স্বল্পমেধারও প্রয়োগীক শৃংখলায় আরো বেশি নিপুণ করতে পারে। এভাবে প্রতিভাবান অনেক কাজকে সৃজনশীল পর্যায় উন্নীত করে তার শিল্প সত্তা তৈরি করে নিতে পারে এবং অন্যের জন্য উদহরণ হতে পারে। তেমনি সৃজনশীল কাজে প্রতিভাবানই কেবল জরুরী অন্যেরা বা কম প্রতিভা বা মেধার মানুষের কোনো প্রয়োজন নেই, তারা কেবল তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ব্যাপার তাও সত্য নয়।
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে সৃজনশীল সকল কাজে প্রতিভাবান যতখানি উৎকর্ষতার আয়োজনটি তার নির্মাণে যুক্ত করতে পারেন, একজন মেধাবী ঠিক ততটা নির্মাণ শৈলীতে সেই অসমাপ্ত আলোটুকু দিতে পারেন না, যা মানব মনোজগতে এমন এক আলোড়ন তোলে-যা প্রকাশহীন এবং অভিব্যক্তিহীন কেবল স্তব্ধতা। যেমন প্রত্যেক সংগীত শিল্পী তার গানের বা সুরের সঠিক মাত্রাকে মেনেই গান পরিবেশন করেন এবং এতে কোনো ভুল নেই, কিন্তু একজন প্রতিভাবান শিল্পী এমন কিছু সেই সুরের মাত্রায় গেঁথে দেন যা ভিন্ন হয়ে ওঠে। যদিও এই সব বিশ্বাস ব্যাপক ভাবেই প্রগতিবিরোধিরা ব্যবহার করে নিজ অহংকে চূড়ান্ত মাত্রা দিতে চায় এবং অন্যকে অস্বীকার করে।তারা বলে শিল্প শিল্পের জন্য। ইতর প্রকৃতির দরকার পানি কচু, শিল্প কেন? তারা জানতে চায়না যে সামগ্রিকতা বলে একটা কথা আছে, ভিন্নতাও আছে। যেমন সমাজে সকলেই সামগ্রিক, কিন্তু তার ভেতরও কোনো কোনো ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতা থাকলেও সে সামগ্রিকতারই অংশ মাত্র। তার স্বাতন্ত্র্যতা বা প্রতিভার ভিন্নতা কেবল মাত্র সমাজের ওই মাত্রাটুকুকেই চিহ্নিত করে যে সে অন্যথেকে ভিন্নতর গুণসমৃদ্ধ রূপদক্ষ। কিন্তু প্রতিভাবান যদি সমাজ সত্তাকে না জানতে চায়, আপন অহংয়ে নিজ শ্রেষ্ঠত্ব দাবীই করতে থাকে তা হলে তার ভাগ্যটি হয় ‘ওয়েলস’ এর মতোই। এই প্রতিভা কোনো কাজেই লাগেনি, রাসেল কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৎসাহস দেখাতে পেরেছেন, আর ওয়েলস হয়ে রয়েছেন সময়ের ভাঁড়।
এখন আমরা আসতে পারি মূল বক্তব্যেঃ তরুণদের বেশি সাহায্য করতে হবে কেন? এর অর্থইবা কি, তরুণরা কি সোনার স্বর্গ এনে দেবেন? না , স্বাভাবিক বিবেচনা থেকে বলা যায় যে তা’ তারা এই মুহুর্তে পারবেন না। দু’একজন প্রতিভাবান তরুণ থাকলেও সমাজ ও রাষ্ট্রিক পর্যায়ে যে ভাঙচূর চলছে তাতে ওই সব প্রতিভার শনাক্তকরণ পৃষ্ঠপোষকতা কেউ দেবেনা, দেবে লুটে, দেবে সাহিত্য মাফিয়াদের। এই সমাজ এই রাষ্ট্র তাই করবে তার স্বার্থে । কারণ অসুস্থ অন্যের সেবা দেবে কি করে। নইলে দীর্ঘ সময় ধরে একটি জাতি নেশার ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হয়ে অধঃপতিত হয়েছে, তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য আশা গেছে, পরিবার অর্থসংকটে পড়েছে, নিরাশায় হারিয়ে গেছে পিতামাতা, খুন হয়েছে, নানা উপসর্গে পড়ে ধর্ষক হয়েছে, ছিনতাইকারী হয়েছে, তার উচ্ছেদে এত কাল পরে উদ্যোগ হয়েছে, তবুও ভালো দেরিতে হলেও হয়েছে, নাকি বাহানায় শেষ হবে সব অভিযান? অদ্ভুত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের মতো। এমন অনেক সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? কোনো ঘাগু বৃদ্ধ, সে কি আশা হতে পারে? না কি আগামীর প্রজন্ম যারা যুদ্ধ করতে পারে, লড়তে পারে, মরতে পারে তারাই আশা। যদিও কেউ কেউ বলেন সে গুড়ে বালি। প্রত্যেক সমাজ তার প্রয়োজনে তার প্রয়োজনীয় মানুষ তৈরি করে, যেমন স্বদেশ তৈরি করেছিল। লক্ষ করলে দেখা যাবে সামাজিক চাহিদা না হলে নতুন কিছুর সৃষ্টি হয় না। নতুন প্রতিভাও আসেনা। প্রত্যেকটি প্রতিভাবানের উপস্থিতির সময় কাল যদি লক্ষ করা যায় দেখা যাবে কোনো না কোনো সামাজিক চাহিদার কারণেই একজন সেক্সপিয়র, গ্যোটে, রবীন্দ্রনাথ, পুশকিন, টলেস্টয়, তুর্গেনেভ, দস্তয়ভস্কি,সলোখভ একজন মার্কেজ এসেছেন। সমাজ আগবাড়িয়ে তাদেরকে স্বাগতও জানিয়েছে। তবে তার জন্য প্রস্তুতি চাই। তরুণদের সৃষ্টিকে মনোযোগে নেয়া চাই, সম্ভাব্য আলোচনা চাই, ত্রুটি বিশোধনে সক্রিয় সহযোগীতা চাই। তা হলে প্রতিভাবান অনেক না হোক কিছু মেধার চাষ হতে পারে। তারাই হয়ত পারবে প্রকৃত উন্নয়নটা ঘটাতে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন