রবিবার, ১০ জুন, ২০১৮

উত্তর লেখার কাগজ ছিলো না ।। দীলতাজ রহমান


উত্তর লেখার কাগজ ছিলো না


আগে শুধু মানুষের মুখে শুনেছি, অস্ট্রেলিয়ায় এসে স্বচক্ষে দেখছি, প্রায়ই বাড়ির সামনে বাড়ির ভেতরের সব খুচরো জিনিসপত্রসহ, নতুন পুরনো সব আসবাব ফেলে দেয়া হয়েছে। আবার অন্য কেউ কেউ তাদের গাড়ি ভিড়িয়ে অকপটে বাড়ির মানুষ সাথে এনে, পরামর্শ করে যেটা তাদের দরকার, তুলে নিচ্ছে। নিতে নিতে যা থাকে একসময় সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে ফেলে দিচ্ছে । এখানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মাল টানাটনির ঝামেলা কেউ পোহায় না!
আমি দ্বিতীয়বার অস্ট্রেলিয়া এসে পাশের বাড়ির সামনের এরকম জিনিসপত্রের স্তূপ থেকে একখানা চেয়ার এনেছিলাম । তা দেখে, আমার জামাতা ফুঁসে উঠে আমার নাক বরাবার আঙুল এনে বললো, ‘ মা, আবার যদি দেখি, কারো কোনো কিছু বাড়ির সীমানায় এনেছেন, তাহলে আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হবে !’ 
জামাইয়ের কথায় সারাদুনিয়ার খোলা পথ সংসারের যাঁতাকলে পড়ে থাকা আমার বন্দী পায়ে এসে নেচে উঠলো ! ‘আহা কি মুক্তি, কি মুক্তি...’ বলে । 
কিন্তু নাচন থামিয়ে জামাইকে বললাম, আমাদের গাড়ির থেকে দামি গাড়িওয়ালারা মানে আমাদের থেকে সামর্থবান মানুষেরা এসে কী স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা দরকার, তুলে নিচ্ছে। আর আমি তো প্লাস্টিকের একটি চেয়ার এনেছি। তাও বাইরে রাখার জন্য !

জামাই ধমকালে কি হবে, এখানে কাছাকাছি বসবাস করা আমার বড়ছেলে আমাকে একট্রাক মাটি কিনে দিয়েছিলো, ইচ্ছেমতো চাষবাস খেলতে। রাস্তা থেকে ফুলের বড় টব আনা তো সম্ভব নয়, তাই ছোট ছোট টব পেলে আমি এনে এনে তুলি। আর জামাই দেখে ফেললে বলি, আশেপাশের মানুষের কথা, অমুক দিয়েছেন, তমুক দিয়েছেন। জামাতা অবিশ্বাস করে না, কারণ অন্যান্য দেশ থেকে আগতরাও সবাই এখানে আমার চায়ের প্রশংসা করেন। তাই চা আর দুধ-চিনির ঘাটতি দেখে শাশুড়ির প্রতি অবিশ্বাসের ভাবটি আর জামাইয়ের থিতু থাকে না ।
কাল আরেক পাশের বাড়িরও জিনিসপত্র সব সে বাড়ির সামনে স্তূপ করা! যাওয়া-আসা নেই, তবু মনটা কেঁপে উঠলো ! মানে এত কাছাকাছি বসবাস করা মানুষরা দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে । সান্ধ্যভ্রমণ শেষে ব্যাকুল পায়ে আমি বাড়ির গেটে ঢুকতে যাবো, সে বাড়াড়ির একটি প্যাকেটে কটা খাতা-ডায়েরী দেখে লোভাতুর হয়ে বুকে জড়িয়ে এনে ঘরের এককোনায় লুকিয়ে রাখলাম। 
রাখতে রাখতে আমি তখন এই সময়ে ছিলাম না। টিউব লাইটের আলোয় ভেসেও মনে হচ্ছিলো হারিকেনের আলোতে ফিরে গেলাম ! বহু পুরনো, খাতা, বহু পুরনো ডায়রী থেকে আমি অনেক কিছু পেয়েছি, যা অনেক ক্ষেত্রে একটি সম্পূর্ণ বইতেও পাইনি ! 
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়ির অনেকেই যখন তাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল, তখন তেমনি শহর থেকে গ্রামে পালিয়ে বাঁচতে আসা একবাড়ির দুই পরিবারের দুই তরুণ তরুণী একই বাড়িতে থেকেও দুজন দুজনকে চিঠি লিখতো। কাগজের অভাবে একজন পেন্সিলে লিখে পাঠাতো, আরেকজন তার ওপরে কলম দিয়ে উত্তর পাঠাতো ! দেশ স্বাধীন হবার বছরখানেক পর তরণীটিকে তার বাবা বিয়ের জন্য ঢাকায় নিয়ে এলে, অনন্যোপায় তরুণী নাকের জল চোখের জল এককরে সে চিঠি বর্ষার থইথই উঠোনঘেঁষা জলের অতলে ফেলে আসে। 
দীর্ঘ নমাস ভয়ার্ত, হুলুস্থূল দৌড়াদৌঁড়ির ভেতরও তাদের চিঠি চালাচালি যেমন কোনোভাবেই বন্ধ থাকেনি, তেমনি বিষয়টি অতবড় বাড়ির কারো অজানাও থাকেনি। কেবল হাতেনাতে তারা কেউ ধরা পড়েনি এই যা রক্ষে !
তরুণী বিবাহিত জীবনে ঢুকে যুবতী হতে হতে আমিও আর ছোট থাকলাম না। একবার বিয়ের আগেই গ্রামে গিয়ে এক চাচির সাথে ভাব জমে উঠলো। কিছু কিছু চাচি থাকে না, সব ভাগ্নে-ভাগ্নি, তার নিজের দেওর থেকে পাড়ার দেওরদেরও সে প্রিয় ভাবি, এই চাচিটাও তেমন! তো চাচি একদিন কথায় কথায় বললো, “দেখ তো নূরজাহানের বুদ্ধি, ওকে ওর বাবা নিতে এলে, ও ওকে লেখা শাহেদের সব চিঠি ঘাট থেকে দূরে গভীর পানিতে বোধহয়, পোটলা বেঁধে ফেলে গেছে! হামারজাদি ওগুলো এমনি ছেড়ে দিলে তো পানিতে গলে যেতো। তা না করে, পোটলাবাঁধা চিঠি পানি খেয়ে দূরের থেকে ভেসে উঠে কূলে ভিড়ে ছিল, আমি কলসে পানি আনতে গিয়ে, পানি আনবো কি ? গড়া ফেলে সে চিঠির বোচকা ঘরে এনে চুপি চুপি চুলোয় শুকিয়ে একবছর পর্যন্ত সেসব পড়েছি !”

এমন ঘটনা মনে গেঁথে থাকার কারণে কোথাও একটি শূন্য কাগজও পড়ে থাকতে দেখলে, মুক্তিযুদ্ধর পুরো বিষয়টিই আমার মাথায় রিপ্লে হয়! আর এও ভাবি, কাগজের অভাবে কতজনার কত কথা না লেখা থেকে গেছে ! কাগজের সদ্ব্যবহার করতে একখানা চিঠির কোনাকানাও বিঃ দ্রঃ দিয়ে মানুষ ভরিয়ে দিতো অহেতুক খবরে ! 
আর ওই যে চাচি যে রসদ সংগ্রহ করছে, তা-ই অনুমান করে, আমি চাচির সাথে প্রায় লেপটে থাকতাম, কিছু তার পেতে ! চাচির হাতের টুকটার কাজ টেনে নিয়ে করে দিতাম কিছু রসদের লোভে ! 
যদিও প্রথমদিন চাচির এমন কথায় আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলেছিলাম এবং আমার গায়ে কাঁটা দিয়েছিলো, এখনো মনে আছে! এখনো মনে আছে, আমরা ছোটবেলায় একান্তে কাউকে কিছু লিখতে দেখলেই দলবেঁধে তক্কে তক্কে থাকতাম, কখন ওটা তচনচ করে হলেও খুঁজে পড়া যাবে ! আহা সেই তুলনায় সেই বয়সে আমাদের ছেলেমেয়েরা কত নিষ্পাপ ! আমার মনেহয় 77/78 এ আমাদের যাদের মেট্রিক, আমরা বোধহয় অন্যরকম পাঁজি ছিলাম...।

কাল আমি তীব্র আশায় জেগে আছি, কখন ঘরের সবাই ঘুমাবে আর আমি ডায়রী, খাতাগুলো খুলে পড়তে শুরু করবো !
আমার তর সইছিলো না, সবাই পুরোপুরি ঘুমানোর আগেই আমি প্যাকেটটি খুলে ফেললাম। কিন্তু লেখা কই, সব সাদা, ঝকঝকে ! ইনট্যাকক্ট এবং একেকটা একেক রকম ! 
তাও অবদমিত হয়ে যেখান থেকে এনেছি, সেখানে রেখে আসার কথা ভাবলাম না। সাদা কাগজই তো  ! জামাতার কৈফিয়তের উত্তর দিতে মনে মনে সাহস সন্চয় করে যুক্তি দাঁড় করালাম, ‘আমার কাছেও তো কিছু ডলার থাকে, না কি ? আমি কি দুএকটি খাতা বই কেনার হিম্মত রাখি না ?’
কিন্তু যে জন্য এত যুক্তি, ভেবেছিলাম, এগুলোতে একেক বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করবো! কতকথা গোছালাম, কিন্তু একি, ভেতরটা একেবারে শূন্য, নিজেকে ফসলহীন গোলার মতো খা খা লাগছে ! কাগজ কলমে লেখা যে আসে না । মন-মগজ এক করে আঙুল শুধু যন্ত্রের দিয়ে ধাবিত হয়...। আঙুল কম্পিউটারের কিবোর্ড ছাড়া লিখতে সচল হয় না! কলমে প্রাণ জেগে উঠছে না। এই মুহূর্তে অন্তত একটু কাঁদতে পারলেও ভালো লাগতো ! কিন্তু কাঁদবার ক্ষমতাও তো কত দামি নয়! সেই বা থাকবে কেন যান্ত্রিক মনে-মগজে ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন