সোমবার, ১১ জুন, ২০১৮

বিবর্ণ সুতো ।। রওশন রুবী




বিবর্ণ সুতো 



               হন্তদন্ত হয়ে ব্যাংকে ঢুকলেন দোলন। সামনে পেছনে আশেপাশে কে কোথায় আছে ওদিকে লক্ষ্য করার এক মুহূর্ত সময় নেই। চেক লিখে কাঁচের ছোট ছিদ্র দিয়ে অফিসারকে দেবার জন্য বাড়িয়ে রাখলেন। পাশাপাশি দুজন অফিসার বসেন এখানে। একজন একাউন্ট চেক করেন; অন্যজন ক্যাশিয়ার। চেকের সর্বডানের অংশ ছিঁড়ে; সেই টোকেনটি হাতে কম পক্ষে ত্রিশজন মানুষ গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে। দোলনের ডান পাশের অংশটি বাম হাতে। তিনি অফিসারের হাতের দিকে তাকালেন। তার হাতে দশবারোটা চেক এখনও। অগত্যা চেকটি ধরে নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে রইলেন। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তিনজন এসে তার হাতে চেক ধরিয়ে দিল। সে নিয়ে অপেক্ষাকৃত বয়স্কজনের চেকটি উপরে রাখলেন। লাইনে লোকজনের সমাগম বাড়ছে। কাউন্টার থেকে ছয় সারি হয়ে গেল ইতিমধ্যে। ছয় সারিতে কম করে হলেও পঞ্চাশ জন মানুষ হবে। হাতেগোণা কয়জন ছাড়া প্রত্যেকে কথার থলিটা ফুটো করে দিয়েছে। দুকান ভোঁ ভোঁ করছে। এরা যেন রাজ্যের কথা বলতে এখানে এসেছে। এদের মূর্খামি কখনও সুধরাতে পারবে না কেউ। এবার দোলনের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। তিনি হাতের চায়না পাখাটি দিয়ে বাতাস করছেন। এসব বাতাস থোড়াই কেয়ার করে গরম। মানুষে মানুষের গরমটাই মারাত্মক। মানুষ দাঁড়াতে দাঁড়াতে অস্থির হয়ে উঠে গরমে না যতটা; কথায় তার তিনগুণ। এর মধ্যে কথায় অতিষ্ঠ হয়ে অনেকেই অনেককে ধমক দিলেন। আরে চুপ করেন না! কী শুরু করেছেন? সামান্য সময় চুপ হয়। পরেই আবার তেতে ওঠে পরিবেশ। স্কুলের বাচ্চারা এদের থেকে শতগুণ ভালো। চুপ থাকতে বললে অন্তত পনেরো মিনিট হলেও চুপ থাকতে পারে। এরা যা করে তা ছোট বাচ্চাদেরও হারমানায়। একেক জনের ভাব দেখে পিত্তি জ্বলে যায় দোলনের। মনে হয় কত বিশেষজ্ঞ। একে তো ভ্যাপসা গরম তার উপর কাউন্টারে ভিড়। দুহাত ব্যবধানে দুটি পিলারে বাক্সবন্দি দুটি ফ্যান বাতাস দিতে দিতে নাভিশ্বাস তুলছে। পিলার থেকে পিলারের দূরত্ব প্রায় পাঁচ হাত। ওসব ফ্যানের বাতাস নস্যি যেন। এতক্ষণে অফিসারের হাতের চেকগুলো শেষ হলো। তিনি দোলনের হাতের চেকগুলো নিলেন। দোলন সেই কাউন্টারের পাশের কাউন্টারের সামনে আড়াআড়ি দাঁড়ালেন। ঘামে ভিজে উঠেছে শরীর। ব্যাগে ভেজা টিস্যু থাকলেও ব্যাগ খুলে নেবার ঝক্কিতে গেলেন না। একটু নড়া চড়া করলেই শরীরে শরীর লেপ্টে যায় যেখানে। সেখানে ব্যাগ খোলার মতো বোকামি করা যায় না। এক্ষেত্রে ছেলেরা ভীষণ নড়ছে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ সবসময় সুবিধাবাদী। গাড়িতে বসলেও তাদের হাত পা ছড়িয়ে বসার কাঙ্গালপনা থাকেই। যা গা গুলিয়ে উঠে দোলনের। সে প্রায়ই এমন লোকের পাল্লায় পড়লে নির্দিষ্টস্থানে না গিয়ে পথে নেমে অন্য গাড়িতে উঠেন। ড্রাইভারেরা কখনও কখনও বুঝে কিছু বলে না। অর্ধেক পথের ভাড়াই নেয়। কোল কোন ড্রাইভার ঐলোকগুলোর মতো চরিত্রহীন লাফাঙ্গা। ওরা নামাতে চায় না। নামানেও ডাবল ভাড়া নেয়। এক রুটে তেরো বছর চাকরী করে দোলন। নতুন দু‘একজন ড্রাইভার পড়ে যায়। এসব সামলেই চলতে হয় পথে নামলে; জানে দোলন। এখন এখানেও সুবিধাবাদী লোকগুলো নড়াচড়া করছে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। অকারণে এদিকে ওদিকে যাচ্ছে। ফলে গায়ে গা চেপে জায়গা দিতে হচ্ছে। কেউ কেউ হাত তুলে কাউন্টারের গ্লাস বা পাশের দেয়াল ধরছে। অমনি বেরিয়ে পড়ছে বগলের জমে থাকা ঘামের গন্ধ। দেখা যায় ঐ হাতের নিচে কয়জন ক্যাশিয়ার সাহেবের ডাকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সেই গন্ধে মেয়েরা মুখ বিকৃত করছে। ছেলেরা বলেই বসে, ভাই হাতটা নামিয়ে নিন। দোলন কখনও কখনও টাকা তুলতে আসা এই সব শিক্ষিত লোকদের অবাক হয়ে দেখেন। সে বুঝতে পারে না এদের স্বভাব এতো কঞ্জুসের মত কেন? 
ছেলেদের কাউন্টার, মেয়েদের কাউন্টার পৃথক হলে বেশি ভালো হতো। অথবা দুজন ক্যাশিয়ার টাকা প্রদান করলে।কতৃপক্ষ যদি এইসব ব্যপারের নজরদারি না করেন; তবে সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি হবে না কখনই। কেন তারা এই বিষয়টায় নির্লিপ্ত কে জানে। যিনি টাকা প্রদান করেন তিনি ভীষণ ধীর। ধীর হবেন নাই বা কেন? একটা ভুলের জন্য তাকে কি কম খেসারত দিতে হয়? ভুলের মাসুল গুনতে গুনতে ধীর হয়েছেন তিনি। তার আঙুল গুলোও সতর্ক হয়েছে। তিনি দুতিনবার টাকা নিয়ে হাতে গুনবেন। তারপর টাকাকে সামনে পেছনে উপর নিচ ঝাঁকি দিবেন। ঝাঁকা ঝাঁকি শেষে টাকা গণনাকারী মিশিনে দিবেন। মিশিন থেকে প্রথমবার বের করে আবার ঝাঁকিয়ে মিশেনে ঢোকাবেন। এইবার নিশ্চিত হয়ে কাউন্টারের ছিদ্র দিয়ে বাড়ানো হাতের টোকেনটি নিয়ে চেকের সাথে নম্বর মিলিয়ে টাকা হস্তান্তর করবেন। একজন টাকা পেতে হলে ক্যাশিয়ার সাহেবের হাতে চেক ওঠার পরেও দশ বারো মিনিট সময় লাগে। এরমধ্যে অন্যরকম সুবিধাভোগীরা কাউন্টারের ভেতর দিয়ে লেনদেন করছে। বাদ নেই অফিস স্টাফ এবং পরিচিতরাও। আশ্চার্য! অফিস স্টাফরা পরেওতো নিতে পারে! জনগনকে ভোগান্তি দিতে সত্যি সবারই আরাম আরাম লাগে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক ধরে বাহিরে অপেক্ষা রত মানুষগুলো অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। গুঞ্জনে গুঞ্জনে বিরক্ত লাগছে দোলনের। দূরে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু একবার কারো নাম ডাকলে সে সাড়া না দিলে পরবর্তী নাম ডাকবেন। বাদ পড়া নামগুলো সব চেকের নিচে চালান হবে। তখন মাথা কুঁটেও লাভ হবে না; সবার পরে নিতে হবে টাকা। তাই দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল দোলন। কতক্ষণ লাগবে কে জানে। দোলন গলা বাড়িয়ে টুপি মাথার লোকটিকে দেখল। এতক্ষণ চোখে চোখে রেখেছে লোকটাকে। হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছিল। আসলে সামনে তিনজন তার থেকে লম্বা লোক দাঁড়িয়েছে বলে ওনাকে দেখা যায় নি। ঐ লোকটির পরেই দোলনের ডাক পড়বে। সে চেক জমা দেবার সময় তার চেকটি উপরে দিয়েছিল। তাই ভিড়ে ক্যাশিয়ার সাহেবের কন্ঠস্বর কানে আসুক বা না আসুক। ওনাকে লক্ষ্য রাখলেই ফল পাবে দোলন। সোনালী ব্যাংকে সব সময় এমন ভিড় থাকে কিনা জানে না দোলন। সে মাসের ছয় কি সাত তারিখে টাকা তুলতে আসে। এই টাকা উপর তার বাসা ভাড়া, লোন, বাকি দোকানের টাকা, সংসার খরচ, ছেলের খরচ, অফিসে যাবার ভাড়া সব নির্ভর করে। চাকরির স্থলে কাজের পর বড় অফিসারদের মুখ ঝামটা। সেসব পার করে মাস শেষে যে টাকা ব্যাংকে আসে তা তুলতেও নাভিশ্বাস। ছেলে এই বিষয়ে সহযোগিতা করতে পারত তাকে। কিন্তু করে না। কেউ নিজের থেকে মায়া না করলে মায়া তো সৃষ্টি করা যায় না। এই টাকা তোলার পর চাল, ডাল, কাঁচা বাজার; মাছ মুরগি, বিস্কিট, ডিম, তেল ইত্যাদি কিনে বাড়ি যেতে হবে। যাবার পথে বাকি দোকানে টাকা পরিশোধ করে যাবেন। বাড়ি গিয়ে হাত মুখ ধুতে না ধুতে প্রাইভেট পড়তে চলে আসবে ছেলেমেয়েরা। সে সময় ক্লান্তিতে শরীরটা ঝিমোয়। ইচ্ছে করে দুদণ্ড শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। সেই রাত সাড়ে চারটায় ঘুম ভাঙা চোখ, যেন তাকিয়ে থাকতে চায় না। কিন্তু দোলের ছেলেটা বড় হয়েও বড় হয়ে উঠে না। সে দরজা খুলে মোবাইল নিয়ে বসে থাকবে। বলতে বলতে হয়ত আধঘন্টা পর এক কাপ চা করে দিবে। অথবা দোলন ঘরে ঢুকলে সে বেরিয়ে যাবে বা বাহিরেই থাকে। দোলন তো ছেলের কাছে বেশি কিছু চায় না। সে এলে না বলতে একমগ ঠান্ডা পানি যদি এগিয়ে দেয়। যদি এক মগ চা করে দেয়। যদি হাট-বাজারগুলো করে আনে। যদি বেতনটা তুলে আনে। এই জীবনে দোলনকে বুঝলো না কেউ। বুঝলো না নিজের সন্তানও। তার থেকে সবাই চায় আর চায়। কিন্তু তাকে কেউ বিন্দু পরিমান দিতে চায় না। বিষিয়ে উঠছে তাই দোলনের জীবনটা। হতাশা গ্রাস করছে তাকে। দিনে দিনে গুটিয়ে যাচ্ছে শামুকের মতো। অথচ সে ছিল উদ্ধমি একজন মানুষ। সবকিছুতে সতেজ থাকতে তার ভালো লাগতো। তাকে পৃথিবীর মানুষগুলো কোনঠাঁসা করে দিচ্ছে। সে কি কিছু চায় তাদের কাছে? না; চায় না কিছুই। যেই জন্মদাতা-দাত্রী তার কথা ভাবেনি। সে মানুষের কথা কেউ ভাববে এমন বোকার মতো চিন্তাও করে না দোলন। সে শুধু বাঁচতে চায়। টিকে থাকতে চায় পৃথিবীর আলো বাতাসে। কারো উপরে বোঝা হয়ে নয়। কাউকে পাওনাদার রেখে নয়। তবু কেন তারা তাকে নিয়েই খেলে? সেই ক্লাস সিক্সে প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পর বাবা মা তাকে বিয়ে দিল তিন সন্তানের এক জনকের কাছে। ভালোবাসা কি জিনিস সে কখনও তা টের পায়নি। ভদ্রলোক টাকার কুমির ছিলেন। কিন্তু ভালোবেসে তিনি কখনও দুটো কথা বলেনি। এক বিছানায় থাকেনি দোলনের সাথে। তবে? তবে কেন বিয়ে করল? বিয়ে করল তার ছেলে মেয়ের জন্য একজন দাসির দরকার ছিল বলে। তার ঘর পাহারা দেবার লোক দরকার ছিল বলে। তিনি দাসির প্রতি যথেষ্টই সহায় ছিলেন। কখনও খেলো কিনা সে খোঁজটুকু নিয়ে, খবরদারি করেননি দাসির উপর। 
দোলনকে ভালোবেসে ছিল তার গ্রামেরই এক ছেলে। জলের ধর্ম শূন্যস্থান ভরিয়ে দেয়। দোলনের শূন্য পারাবারও ভরে উঠেছিল সেই অঢেল জলে জলে। তাঁর মনে প্রবাহিত হতো সুর, ছন্দ, গান। গুনগুন করত অসংখ্য মৌমাছি। তার উড়তে ইচ্ছে করত। তাদের দেখা সাক্ষাত কোন দিন হত না। শুধু চিঠি লেন-দেন হতো। একেকটা চিঠি আসতে আসতে প্রায় পনেরো দিন পেরিয়ে যেত। তবু সেই অপেক্ষার মধুরতা তাকে সব কষ্ট থেকে পৃথক করে ফেলে। সে নিজের মধ্যে একটা জগত তৈরি করে বাঁচে। দিনে দিনে তার উপর প্রভুত্বের প্রখরতা বাড়তে থাকে। অধৈর্য, অসহিষ্ণু দোলন কোন আশ্রয় পায় না। সে ডাল-পালা ভাঙাচোরা একটি পতিত ভূমির বৃক্ষ যেন। মেয়েরা বড় হতে থাকলে প্রভুর চিন্তা শুরু হয়। ঘরে মা না থাকলে বিয়ে দিবেন কি করে? তাই তিনি একটু আধটু ভালোবাসা খরচ করতে চায় দোলনের জন্য। ততদিনে অত্যাচারিত অবহেলায় দোলন তো মরে গেছে ভেতরে ভেতর। তার যে দেহ আছে দৃশ্যত। ও দেহের বোধ নেই। সে শুধু ঘৃণা করে প্রভুকে তখন ভীষণ, ভীষণ। স্বার্থের জন্য যে ভালোবাসা সে তো ঘৃণা পাবারই যোগ্য। যে মেয়ে স্বার্থ ত্যাগের জন্য জন্মেছে; হয়ত তার ঘৃণা করা বেমানান। কিন্তু শরীরের ভেতর রক্ত মাংসগুলো তাকে কেমন জানি করে ফেলে। ভেতরে ভেতরে একটি হাই স্কুলের কেরানির সাথে যোগাযোগ করে ভর্তি বিষয়ে। তিনি প্রধান শিক্ষক এবং অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করে দোলনকে ভর্তি করেন। ভর্তির সময় দোলন তার সমস্যা বলেছিল। তাই তারা তাকে দয়া করে। সেই দয়া অনুসারে সে শুধু পরীক্ষাগুলোতে অংশ নিত। এইভাবে নবম শ্রেণিতে উঠে তার পড়া বন্ধ হয়ে যায়, ভর্তি টাকা ছিল না বলে। সে ঐ পাষাণকে বললে, টাকার বদলে তিরস্কারই পেত; জানে বলেই, বলেনি। পড়ার তৃষ্ণা তাকে আহত করত। সে দিনরাত শুধু চিন্তা করত কি করা যায়? এই চিন্তার মধ্যে একদিন তার ভালোবাসার মানুষের চিঠি আসে। সেই চিঠি প্রভুর হাতে পড়ে। ফলে নিপীড়ন চরমে উঠে। নিত্য নিপীড়নে ও শ্বাস কষ্টে আক্রান্ত হয়। সেই রোগ সারাতে দিনের পরদিন ডাক্তারেরা ঘুমের ঔষধ খেতে দেয়। ঔষধ আর মনের অশান্তিতে দোলন মাটির পুতুলে পরিণত হয়। চেয়ে থেকেও সে কিছু বুঝে না; দেখে না; জানে না; শুনে না। ঘুমের পর ঘুম; ঘুমের পর ঘুম, দোলনকে জগতের মায়া থেকে দূরে ঠেলে দেয়। প্রায় বছর দেড়েক পর, ধীরে ধীরে দোলন সুস্থ হতে থাকে। কিছুটা সুস্থ হলে সে কেমন অনুভব করে। ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার চেকাপ করে বলে আনন্দের খবর! আপনি ছেলের মা হচ্ছেনে। এখন পাঁচ মাস চলছে। আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট তাই বলছে। অবিশ্বাস্য চোখে ডাক্তারের দিকে তাকায় দোলন। সে ডাক্তারকে বলতে থাকে, এটা সম্ভব নয়! কিছুতেই সম্ভব নয়! ডাক্তার বলে, সম্ভব অবশ্যই! আপনি একজন বিবাহিত মেয়ে। দোলন ফের প্রতিবাদ করতে চায়। বলতে চায়, আমার স্বামীর সাথে তো আমার সম্পর্ক নেই। কিন্তু ভাবে, এ কি হলো! কি করে হলো! কিছুই বলে না ডাক্তারকে। প্রশ্নটা তাকে যন্ত্রণা দিতে থাকে; দিতে থাকে। অবশেষে সে বুঝতে পারে প্রভুই তাকে রেপ করেছে। সে ধর্ষিতা। ঘৃণার মাত্রা বাড়ে যখন তার মুখে শুনে, “খুব তো উড়ে ছিলে। কেমন ডানা কেটে দিলাম?” যে মানুষ জ্ঞানহীন মানুষকে ধর্ষণ করে তাকে ঘৃণাই করে দোলন। 
ছেলে সন্তান জন্ম নিল একদিন। দিনে দিনে সে বড় হতে থাকলো। দোলনকে যে ছেলে ভালোবাসে; সে কেমন করে যেন খোঁজ নিয়ে নিয়ে দোলনকে নিতে আসে। দোলন তাকে ফিরিয়ে দেয় সন্তানের কথা ভেবে। বলে, সর্বহারাকে নিয়ে ভাববেন না। সে খড়কুটোর মতো বেঁচে থাকবে। ঐ সন্তানের কথা ভাবুন। পরিচয়হীনার পরিচয় না থাকে থাকুক; ওর একটা বাবার পরিচয় তো থাকলো। ভাঙা মনে ছেলেটি চলে যায়। খাঁ খাঁ শূন্যতা নিয়ে সর্বহারা দোলন বেঁচে থাকে। তার ছেলে নিলয় স্কুলে ভর্তি হয়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার একটা সুযোগ আসে। ওকে আনা নেয়ার প্রেক্ষিতে। তাই সে খোঁজ নিয়ে ওপন ইউনিভার্সিটির এসএসসি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়। ক্লাস বা পরীক্ষা শুক্রবার করে হওয়ার, ছেলের নোট করতে যাচ্ছে বলে বেরিয়ে মাঝে মধ্যে ক্লাস করে আসে। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দেয়। একই ভাবে এইচএসসি শুরু করে। শেষ সেমিস্টার ঘনিয়ে আসে। প্রভুর মেয়েদের ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায়। তারা অতি সুখে দিন যাপন করে। ওদের চিন্তা আসে তাদের ভাইয়ের সমান সম্পদ দোলনের ছেলে পাবে। এইটুকু তারা মানতে পারে না। তাই তিনজনে মিলে কৌশলে দোলনকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। দোলন জানে এতে তার প্রভুরও সায় আছে। নয়তো তিনি অন্তত অত্যাচারে অতিষ্ঠ দোলনকে ঠাঁই দিতেন। একদিন দোলন নিজের কথা ভেবে চলে যেতে চেয়েছে। আজ সে ছেলের কথা ভেবে থেকে যেতে চায়। কিন্তু পাষাণদের কুটকৌশলের কাছে হেরে যায় সরল মনা দোলন। তার এইচএসসি ফাইলান পরীক্ষা নিকটবর্তী ছিল তাও দিতে পারে না। একদিন যে বাবা মা তাকে জবাই করেছিল। সবশেষে তাদের কাছে চলে আসে নিপীড়িত দোলন। তাকে বাড়ির কেউ, পাড়ার কেউ চিনতে পারে না। সবাই বলে কী মেয়ে, কী হয়ে গেল! অবশ্য সে ফিরে আসার বছর তিনেক আগে তার বাবা মারা যায়। আর এক বছর আগে মারা যায় মা। তাই তাকে কোন অপরাধে এমন শাস্তিময় আজাবের জীবনে পতিত করল তারা; জানা হয় না। তাকে যে ভালোবেসে ছিল। সে এখন কলেজ শিক্ষক। শেষবার দোলনের কাছ থেকে ফিরে এসে সে বিয়ে করে। তার এক মেয়ে এবং এক ছেলে নিয়ে সংসার। সুখে থাকুক আর দুঃখে। তারা টিকে আছে। তার বিয়ের কথা শুনে দোলন কষ্ট পেয়েছিন। আর সে কষ্টকে শ্রাবণের বর্ষণে ভিজিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। ছোট বোনের জামাই অনেক চেষ্টা তদবীর করে পরিবার পরিকল্পনা অফিসে তার চাকরির ব্যবস্থা করে। চকরির ফাঁকে ফাঁকে পুনরায় সে পড়াশোনা শুরু করে। বিএসএস পাশ করে আর এগুতে পারেনি পড়া দোলন। দোলন সুলতানা! দোলন সুলতানা আছেন? কে দোলন সুলতানা? দোলন তাকিয়ে দেখে সবাই খোঁজা খুঁজি করছে দোলন সুলতানাকে। আর ক্যাশিয়ার সাহেব চোখের সামনে হালকা হলুদ রঙের চেকের পাতাটি ধরে। তার মোটা ফ্রেমের ভেতরে চোখগুলো কেমন ভয়ঙ্কর ফ্যাকাসে দেখায়। দোলন কাঁচের ছিদ্র দিয়ে টোকেনটি ঢুকিয়ে দেয়। দেরির কারণে ক্যাশিয়ার সাহেবের ভয়ঙ্কর ফ্যাকাসে চোখগুলো দপ্ করে জ্বলে উঠে নিভে যায়। টাকা নিয়ে দোলন ভালো করে এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে দেখে গুণে নেয়। আরো একবার এক হাজার টাকার একটা ছেঁড়া টেপ লাগানো নোট পড়েছিল বলে সর্তক হয়েছে সে। টাকা নিয়ে ভিড় থেকে বেরিয়ে ঘড়ি দেখে চারটা বেজে গেছে। সেই দুটো বিশ থেকে চারটে। টানা এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট। এখনও যতগুলো মানুষ আছে, ঘন্টা খানেকের আগে ক্লিয়ার করতে পারবে বলে তো মনে হয় না। এর মধ্যে ক্যাশিয়ার সাহেব উঠে গেলেন চা সিগারেট খেতে। সবাই হতাস হয়ে তার প্রস্থান পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।কলাপসিবল গেইট বন্ধ করে দিচ্ছে দারোয়ান। আর কাউকে ঢুকতে দিবেন না। যারা ভেতরে আছে তারা টাকা নিয়ে যাবেন। দোলনকে একটু ফাঁকা করে দিল কলাপসিবল গেইট।গেইট দিয়ে বেরুতে গিয়ে বাধা পায়। কেউ তার ব্যাগ ধরে টান দিল। দোলন টলকে উঠে। ব্যাংকের ভেতর ভিন্ন কিছু হবে না ভেবেও ব্যাগটি শক্ত করে ধরে গ্রীবা বাকিয়ে দেখে বিউটি। ও তার বাল্যশিক্ষা থেকে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত সহপাঠি ছিল। বড় হওয়ার পর আর দেখা হয়নি। তবু বন্ধুকে চিনতে এতটুকু দেরি হল না দোলনের। এর একটা কারণ অবশ্যই আছে। সেটা হলো ওর গালে টোল পড়ে। টোল পড়া মানুষ যেমন কম দেখা যায়; তেমনি তাদের চিনতেও বেগ পেতে হয় না। তারা হাসলে বা কথা বললে মুখে যে মায়া দেখা যায়, সে কারো সাথে মিলে না। বিউটি বলে,
- অনেক সময় ধরে তোকে দেখছি আর দেখছি। ভাবছি তুই কিনা! নাকি অন্য কেউ! বারংবার ডাকতে চেয়েও থেমে গেছি। তুই বরগুনা থেকে কবে এলি? ছেলে মেয়ে ক‘জন? শুনেছি তোর সৎ ছেলেমেয়েরা তোকে মাথায় করে রাখে। তোর বরও নাকি তোকে চোখে হারায়?
দোলন ভাবে বিউটি তার সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। তাই তাকে তেমন কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। দেখা হয়েছে হাই, হ্যালো করে দিলেই হলো।
- কিরে বিরক্ত হলি? কিছু বলছিস না যে?
- ওদের কথা থাক বিউটি। আমার এক ছেলে। একটা চাকরি হওয়ার কারণে এখন এখানে থাকছি।
- ওমা তুই চাকরি করছিস্! খুব ভালো কথা। তোর ছেলেটার বয়স কত?
- ও এইচএসসি ফাস্ট ইয়ারে পড়ে ।তোর কি খবর? ছেলে মেয়ে?
- খুব ভালো আছিরে! আগের বরটা অশিক্ষিত ছিল, জ্বালাত খুব। এখন ভালো আছি।
- আবার বিয়ে করেছিস্!
- আরে আমাদের সময়ের সব মেয়েরা কি বিয়ে করতে পার তো! হাজারে দুচারজন পার তো। আমাদেরকে অভিভাবক বিয়ে দিত। আমাকেও দু‘দুবার ওরাই বিয়ে দিয়েছে। বাবা মায়ের দায়দায়িত্ব আছে না? জন্ম দিলেই তো দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আগের ঘরের একটা মেয়ে; এঘরের এক মেয়ে একছেলে নিয়ে খুব ভালো আছি। দোলন মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শোনে। কি ভীষণ অকপটে সব কথা বলে দিতে পারে বিউটি। সত্যি, কেউ ভালো আছে জানলে দোলনের ভালো লাগে। এ সময় বিউটির ডাক পড়ে। সে টাকা নিতে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
- অনেক কথা আছে। একটু দাঁড়া প্লিজ। আমি আসছি।
দোলন দাঁড়িয়ে নয় একটি খালি চেয়ার পেয়ে বসে পড়ে। চাকরির পর এই তেরো বছর দোলন বাসা ভাড়া করে থাকছে।
আজকাল দোলনের শুধু চিন্তা হয়; শেষ বয়সে কে তাকে দেখবে? একে একে সবাই তার কাছ থেকে সরে যায়। সে না চাইলেও সরে যায়। তার কপালটা এমন কেন? ঝগড়া করে না, কাউকে অবহেলা করে না; মানুষকে তার যথাযথ সম্মান দেয়। তবুও তাকে কেউ ভালোবাসে না। কেউ তাকে আগলে রাখে না। ছেলে কাছ থেকে চলে গেলে আরো একা হয়ে যাবে। কে তার খোঁজ রাখবে? নিজের অপরাধে নিজের জীবন যদি এমন হতাসাগ্রস্থ হত; তবে দোলন মেনে নিত। কিন্তু তার তো কোন অপরাধ নেই! আজকাল সে চায় কেউ তাকে ভালোবাসুক, আগলে রাখুক। কিন্তু সেই মানুষ পায় না সে। পাবে কী করে? কাউকে তো দোলন বা তার পরিবারের কেউ বলে না, তার স্বামী নেই। সবাই জানে স্বামী আছে। স্বামী থাকা একটা মানুষকে কেউ বিয়ে করতে আসবে না। প্রেম করা হয়ে উঠে না দোলনের। সে ভাবে এমন যদি কেউ আসে যার ভালোবাসার প্রয়োজন তাকে ভালোবাসা দিবে; সংসার দিবে; আগলে নিবে। যে ভালোবাসা নিয়ে হারিয়ে যাবে এমন মানুষকে সে চায় না। চাইলেই মিলে না। মিলে না বলেই দোলনের হা হুতাশ নেই। সে ভাবে অনেক ভাবনা। যদি এমন হয় সেই মানুষ ছেলেকে মেনে না নিল? যদি তাকে ছেলে মেনে না নিল? সেতো কাউকেই হারাতে পারবে না। আবার যদি এমন হয়, ছেলের লেখা পাড়ার উপর প্রভাব পড়ে? তবে তাও মেনে নিতে পারবে না সে। ছেলেকে সে যত কষ্টই হোক উচ্চ শিক্ষিত করবে। তবেই না একদিন যে সংসার তার পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিয়েছে ; সেই সংসারের মানুষগুলোর উপর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। ছেলেই তার সব কিছু। সে জানে তার ছেলে একদিন অনেক বড় হবে; অনেক বড়। সেইদিন দোলন তাকে বুকে জড়িয়ে নেবার জন্য হয়ত থাকবে না। তবু তৃপ্তি পাবে। চল চল দোলন! বিউটির তাড়া পেয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং ব্যাংকের সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসে। বিউটি বলে,
- চল একটু চা খেয়ে নেই। হোটেলে চা খেতে তোর আপত্তি নেই তো!
- আপত্তি থাকবে কেন?
ওরা ব্যাংকের নিচে নূর হোটেলে ঢুকে একটি টেবিলে বসে। দোলন দুকাপ চা ও দুটো পরোটার অর্ডার দেয়। হাই স্কুলের পাশে ছিল হোটেল। স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন তারা সেখানে ঢুকে চা ও পরোটা খেত। কখনো দোলনেরটা শেষ হলে বিউটির থেকে একটু নিয়ে খেত। কখনো বিউটির শেষ হলে দোলন থেকে নিয়ে খেত। দোলন দেখে বিউটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে। সে অবাক হয়ে বলে,
- মনে রেখেছিস!
- কেন নয়! আর কেউ আসেনি। তাই ভিড়ও ছিল না যে।
বিউটি দোলনের হাহাকার ধরতে পারে না। সে উৎফুল্ল গলায় নানান কথা বলে। দোলনও বলে। বিউটি যত কথাই বলুক ঘুরে ফিরে চলে আসে স্বামীর কথায়। তার যেন কোথাও যাবার আর পথ নেই। ভালোবাসা পেয়ে মেয়েটা অস্থির হয়ে উঠছে। কি সৌভাগ্যবতী সে। দোলনের ভালো লাগে। 
চা শেষ হলে দোলন দেখে পোনে পাঁচটা বাজে। সে উসখুস করে। বাচ্চারা পড়তে এসে যাবে। ছেলে ঘরে না থাকলে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবে কিছুক্ষণ। তারপর চলে যাবে। বাসায় পৌঁছানোর সাথে সাথে অভিভাবকদের ফোন শুরু হবে। কৈফিয়ত দিতে হবে। এই বিষয়টি বিরক্ত লাগে দোলনের। সে ব্যাগ খুলে টাকা ওয়েটারকে দিতে গেলে বিউটি বলে,
- প্লিজ! আর কিছুক্ষণ থাক না! কত বছর পর দেখা। আরেক কাপ চা খাই চল। 
ওয়েটারকে আরেক কাপ চা আনতে বলে বিউটি। ওয়েটার চলে যায় বিউটি তাঁর সুখের কাসুন্দি ঘাটছে। দোলন বার কয়েক ছেলেকে ফোন করে। সে ফোন ধরে না। দোলনের টেনশান বেড়ে যায়। তবু সে হাসি মুখে চা‘য়ে চুমুক দেয়। টুকটাক প্রশ্নের উত্তর দেয় বিউটির। আবার ফোন করে নিলয়কে। এবার ফোন ধরে ও। দোলন বলে
- বাসায় থাকিস।
- কেন?
- আমার ফিরতে দেরি হবে। কাজ আছে।
- আমি বাহিরে।
- কতদূরে?
- বাসার কাছেই।
- তাড়াতাড়ি যা।
- ঠিক আছে।
ফোনটা রেখে বিউটির দিকে তাকিয়ে হাসে দোলন। আর বলে, এবার বল। তারা আরো কিছুক্ষণ কথা বলে বেরিয়ে আসে। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। লোকজন তাই আশ্রয় নিয়েছে হোটেল ব্যাংক এবং অন্যান্য দোকানের সামনে। বিউটি তার বরের অপেক্ষায় হোটেলের বাম পাশে ঔষধের দোকানে দাঁড়ায়।দোকান থেকে হাইওয়ে হাত তিনেক দূরে। ছাতা খুলে দোলন একের পর এক আটোরিকসায় উঠবার চেষ্টা করে।এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াচ্ছে না ওগুলোর ড্রাইভার। কোন রিকশাও চোখে পড়ছে না। বাড়ি যাওয়া জরুরি। নিলয়ের ধৈর্য খুবই কম। সে বাচ্চা গুলোকে থামিয়ে রাখতে রাখতে সহজেই অধৈর্য হয়ে উঠবে। আরেকটা অটোরিকসা আসায় জিজ্ঞেস করল যাবে কিনা। সে যাবে না বলে। দোকান থেকে বিউটি তাকে ডাকে। সে ফিরে তাকিয়ে দেখে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার ভালোবাসার মানুষটি। বিউটি আবার ডাকে এদিকে আয়! এদিকে আয়! আয় না! পরিচিত হয়ে যা! আয়!  দোলনের চোখ ঘোলা হয়ে উঠে। সে ওদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে সামনে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে চা খেতে খেতে বলা বিউটির কথাগুলো কানে বাজে ঢোলকের সুতীব্র শব্দের মত। পৃথিবীর উপর প্রচন্ড অভিমান হয়। দোলন যেন পুরোন কাঁথা। ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায় যার সব সূতো। ঢের বিবর্ণ সূতোর ভেতর থেকে সে মুখ ঘুরিয়ে ফের ওদের দিকে তাকায়। ঘূর্ণিঝড়ে তছনছ করে অলেখিত বন্ধন। সেই ধ্বংস যজ্ঞ থেকে সামনে ফিরতেই একটি গাড়ি এসে ধাক্কা দেয়। পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়াতে চায়। আরেকটা গাড়ি পলকে এসে ওকে ফেলে দেয় রাস্তায়। দুমড়ান শরীর থেকে দোলন হাত বাড়িয়ে কিছু আঁকড়ে ধরতে চায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন