বুধবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৮

অণুগল্পঃ প্রমশন ।। গোলাম রব্বানী টুপুল


প্রমোশন


সেই কবেকার ছোটবেলার কথা, এখনও মনে আছে মুহিবের। পাশের বাড়ির সিরাজ। ওর বাবা তল্লাটের ডাকসাইটে। দশ গ্রামের মানুষ ওদের সমীহ করে চলে। স্কুলের বেঞ্চে যখন এক ঝলক অবসর ঠিক তখন কোচা থেকে কাগজে মোড়ানো সন্দেশের দলা বেশ সময় করেই বের করতো সিরাজ। প্রথম দিকে তাকিয়ে থাকতো মুহিব। দিন মাস গড়াতেই সব সহ্য হল ওর। তারপর থেকে আর তাকাতো না। একদিন হাত ফসকে গোল আর সাদা ফকফকে একটা চিনির সন্দেশ বেঞ্চের উপর পড়ে চক্কর দিতে দিতে এসে পড়ল মুহিবের হাতের কিনারে। ওর তখন মনোযোগ বইয়ের পাতায়। একবার মাত্র তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো মুহিব। সিরাজ বাজপাখির মত ছোঁ মেরে উঠিয়ে নিলো সেই সন্দেশের চাকতি। সেদিনও কষ্ট লাগেনি মুহিবের। বরং মনের মধ্য বড় একটা জেদ চেপেছিল সেদিন। কী সে জেদ! মুখে না বললেও কাজে বুঝিয়েছে সে। 
সিরাজের বাবা স্কুলের সভাপতি। সভাপতির ছেলে অকৃতকার্য হলে মান থাকে না। মুহিবকে দেখিয়ে বহুবার শাসন করেছে সিরাজকে। আর এজন্যেই মুহিব সিরাজের আজন্ম শত্রু। কারণে অকারণে গায়ে হাত তুলেছে মুহিবের। স্যারদের কাছে বিচার দিয়েও বিচার পায়নি মুহিব। শুধু সহমর্মিতা জানিয়ে বিদায় দিয়েছেন স্যারেরা। সিরাজ সভাপতির ছেলে। ওকে শাসন করলে হিতে বিপরীত হবে। মুহিবের ছোট্ট হৃদয় সবই বুঝতেপারে। ওর বাবা তো সিরাজের বাবার ধারে কাছেও নয়। না পেশিশক্তিতে না অর্থবিত্তে। অসম লড়াই চলে কী করে! তাই তার শক্তি বিদ্যাকে মেনেছে মুহিব। এই একমাত্র মুক্তির পথ।ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি নিয়েই স্কুল ছেড়েছে মুহিব। সময়ের সাথে সাথে সিরাজরা পিছিয়ে পড়ছে দিনে দিনে। ভাল লাগে মুহিবের। শক্তি নয় বিদ্যে দিয়েই হারাবে ওদের। সিরাজের আর পড়ালেখা এগোয় না।মুহিবের অবারিত পথ আর ফুরোয় না। জীবনের সিঁড়ি গুলো অনায়াসে পেরিয়ে যায়। গ্রামের সেই ভূমিহীন কৃষকপুত্র এখন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র। রাজধানীর বাসিন্দা। দশ গ্রামের মানুষ এখন ওকে চেনে একজন ভদ্র মেধাবী ছাত্র হিসেবে।একবার হেমন্তে ঢাকা থেকে গ্রামে গিয়ে বড় হোচট খেয়েছে। হৃদয়ে দাগ কেটেছে। সিরাজদের জমি চাষ করে মুহিবের বাবা। ভাগের ধান নিয়ে তর্ক। মুহিবের বাবার গায়ে হাত তোলে সিরাজ। প্রতিবাদ করায় সিরাজের ভাড়াটে গুন্ডাদের হাতে মারখায় মুহিব। সেই থেকে ওর পুলিশ অফিসার হবার বড় ইচ্ছে।


মুহিব দক্ষ তীরন্দাজের মতই লক্ষ্যে পৌঁছেছে। আজ সমস্ত মন জুড়ে সুখের বাতাস হু হু করে বইছে। অবশেষে আইনের পোষাকের সোল্ডারে র্যাং ব্যাচ নিয়েই ঘরে ফিরেছে মুহিব। জীবনে সত্য কে ব্রত করেই এগোতে চায় সে। যেদিন পুলিশের বড় কর্তার চেয়ারে বসলো ঠিক সেদিন থেকেই সেবার ব্রত কে আঁকড়ে ধরলো মুহিব। নীতি আদর্শ কে কখনই জলাঞ্জলী যেন না দেয় এই হল পুত্র মুহিবের প্রতি পিতার নির্দেশ। অাঁধার তখন ঘুটঘুটে। একা অন্ধকারে নিজের ঘরে বার কয়েক বুকের উপর হাত রেখে বাবার কথার সাথে একাত্মতা স্বীকার করে শপথ নিয়েছে মুহিব। গ্রামের সিরাজ এখন শহরের বাসিন্দা। চোখের পলকে কী করে সময় গুলো চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল খেয়ালই করে নি সে। ক্লাসে পেছনের বেঞ্চের ছাত্ররাই সামনের বেঞ্চের ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করে, সিরাজ তার একনিষ্ঠ প্রমান। এখন কত কত ভাল ছাত্ররা তার কাছে চাকরির সুপারিশ নিতে আসে। ভাবতে ভাল লাগে সিরাজের। যে যেলেটি স্টুডেন্ট বানান করতে দশবার দাঁত ভাঙতো আর আজ সে সরকারি দলের এমপি। ভাবতেই কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয় সিরাজের। খানদানী রক্ত কখনই হার মানে না। সিরাজও মানে নি। ওর বাবার মৃত্যুর পর নিতান্তই একা হয়ে যায় সে। এলাকার রাকিব চেয়ারমেন রাজনৈতিক নেতা। তার হাত ধরেই এ পথে এসেছে সিরাজ। টাকা আর পেশি শক্তি দিয়ে অল্পদিনেই খোদ রাকিব চেয়ারমেনকেও সরিয়েছে সে। এভাবে ধাপের পর ধাপ। রাজনৈতিক প্রমোশন তার ঠিকই হলেও একজনের প্রমোশনের গলায় দড়ি ঝুলেগেল। মুহিব, দীর্ঘ দেড়যুগ ধরে তার সততার লড়াই। তবু কোন প্রমোশন নেই। তার দক্ষতায় প্রশাসন অনেক সাফল্য পেলেও মুহিবের জন্য প্রশাসন নীরব। এপর্যন্ত যতবার বোর্ড বসেছে ততোবারই বাদ। জুনিয়র ছেলেপুলেরা প্রমোটেড হয়ে বস হয়ে গেলেও মুহিব যেন গল্পের আদু ভাই। এটা লজ্জার, এটা অপমানের। কারণটা বুঝতে একটু সময় লেগে গেল। ততোদিনে পেছনের সারি অনেকদূর এগিয়েছে। মুহিবের নিয়োগ এই সরকারের আমলে নয়। এই তার দোষ। এই দোষে দুষ্ট হয়ে অধিকার বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে তাকে। কী একটা দেশ কী এমন নীতি। সরকারি চাকুরেরা রাজনীতির বাইরে থাকার কথা থাকলেও কারো কোনো তোয়াক্কা নেই। দেদারছে চলছে তেলবাজি। সেই তেলের সাগরে ভেসে আছে নেতারা। জানালার গ্রীল ধরে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুহিব। গতকাল সকালে পুরনো শত্রুর ডেরায় যেতে হয়েছিল তাকে। সেই সিরাজ, এখন তার অদৃশ্য আঙ্গুলের ইশারায় চলে পুলিশ প্রশাসন। মুহিবকে দেখেই অট্ট হাসিতে ফেটে পড়েছিল সিরাজ। এ হাসি তাচ্ছিল্যের হাসি এ হাসি শয়তানের বিজয়ের হাসি। ফিরে এসেছে মুহিব। লাগবে না তার প্রমোশন। বিকেলে শহরে রাজনৈতিক মিটিং আছে। নিরাপত্তার দায়িত্ব মুহিবের কাঁধে। শুরুটা ভালই ছিল। শেষে এক পাতি নেতার সাথে অধস্থন অফিসারের তর্ক দেখে প্রথম বারের মত মেজাজ হারালো মুহিব। আচ্ছামত ধোলাই শুরু করল সে। চকিতেই ভুলে গেল সব। মনে হচ্ছে সয়ং সিরাজ তার সামনে। অট্ট হাসির শব্দ কানের ভেতর দিয়ে মর্মে আঘাত হানছে। জুনিয়র অফিসার দৌড়ে এসে মুহিবকে থামানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। স্যার কি করছেন স্যার! থামুন স্যার থামুন। অন্য সদস্যরা মুহিবকে সরিয়ে নিয়েগেল। ততোক্ষণে সংবাদিকের ক্যামেরা বসে নেই। আজ ভোরে সবগুলো দৈনিকে ফলাও করে ছাপা হয়েছে সেই খবর। মুহুর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় মুহিবের আক্রমনের ছবি সামাজিক যোগাগাযোগ মাধ্যমে।মুহিবের জানালায় এতো আলো তবু কিছুিই দেখছে না সে। চারি দিক অন্ধকারে ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন