বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৮

গল্পঃ বেশ্যার সংলাপ কিংবা একটি নগ্ন হাত ।। রায়ান নূর

বেশ্যার সংলাপ কিংবা একটি নগ্ন হাত


বেওয়ারিশ একটা নিথর লাশ মর্গের টেবিলে পড়ে আছে  ৷ একটু পরেই তার পোষ্টমর্টেম ৷ তার শার্টের পকেটে পাওয়া গেল একটা মোচরানো চিরকুট ৷ চিরকুটে নিচের অর্ধেক অংশ সাদা খালি পড়ে আছে ৷ চিরকুটের শেষ অংশে লেখা ‘বন্যা’, উপরে কয়েকটি লাইন—
   ‘ ধারাপাতের কোন পাতায় তোমাকে      খুঁজে না পেয়ে খোঁজ নিলাম হোটেলে ৷ সেখানেও তুমি নেই,খোঁজ নিলাম খাজাঞ্চিখানায়, হৃদয়ের হাটে— সেখানেও তুমি নেই ৷ চণ্ডীমণ্ডপ থেকে রাজপথে তোমাকে না পেয়ে হানা দিলাম রাজদ্বারে ৷ কিন্তু গিয়ে জানতে পারি সেখানে আমার প্রবেশাধিকার নেই ৷ তখন বুঝলাম এখানেই আমার হৃদয় বিক্রিত হয়েছে ৷’
   চিরকুটটি ছুড়ে ফেলে দেয় হাতে বালাপরা খর্বাকৃতির ডোম ৷ মৃতদের কোন পরিচয় থাকতে নেই, এখন শুধু ব্যবচ্ছেদের প্রতীক্ষা ৷ 


— সে কি! আপনি কারো হাত ধরেন নি! 
—না ৷
—বোকা নাকি আপনি!
—তাই মনে হয়?
—এমন কোন পুরুষ আমি আজো দেখিনি, যে কোন নারীকে স্পর্শ করে নি ৷
—তাহলে আজ দেখলে কি !
শিখা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাশ ফিরিয়ে হাতটা চেপে ধরে বলল, ‘ইস ’ হাতটা কেটে গেল ৷’  
     ‘কোথায় দেখি?’
মারুফ এগিয়ে গেলো ৷ শিখা অবাক চোখে তার দিকে তাকালো ৷
   ‘আপনি কি পুরুষ?’
     ‘কেন!’
শিখার মোবাইল বেজে উঠল ৷ মোবাইলের ভাইব্রেটর ঘরটাকে সম্পূর্ণ বদলে দিল ৷
   ‘কোথায় মিলন ? আমার কাছেই তাকে পাঠিয়ে দাও ৷ আসার সময় একটা বোতল পাঠিয়ে দিও ৷ ওহ,হ্যাঁ ভুলো না যেন ৷’
   শিখা মোবাইল হাতে নিয়ে কথা বলতে বলতে দরজার দিকে এগিয়ে যায় ৷ একটু পর সে বাইরে যায় ৷ আবার কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে ৷
  ‘ একটা পাঁচশ টাকার নোট দিন তো ৷ পরে দিয়ে দেবো ৷ ’
  মারুফ মানিব্যাগ থেকে একটা নোট বের করে দেয় ৷ শিখার সাথে তার চোখাচোখি হয় ৷ শিখা হেসে বলে— 
   ‘আজ একটু ব্যস্ত আছি, কাল কথা হবে ৷ আসুন এখন ৷’
  মারুফ বস্তি থেকে বের হয়ে যায় ৷ শিখার সজ্জিত ঘরটির দৃশ্য তার মনে বারবার ভেসে ওঠে ৷ রেললাইনটা পার হতেই একটা লোক তার পিছু নেয় ৷
   ‘ভাই, একটা কথা বলব,কিছু মনে কইরেন না ৷’
    ‘বলুন’
    ‘আপনার গার্লফ্রেন্ড নাই?’
    ‘না’
     ‘ভাই, এখানে আপনে আর আসবেন না, পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে ৷’
    মারুফ তার কথার কোন উত্তর দিল না ৷ হাঁটতেই থাকল ৷ লোকটি পাশ কেটে চলে গেল ৷ 
  ট্রেনের সিগনাল পড়ল রাস্তায় ৷ গাড়ি সব বন্ধ হয়ে গেল ৷ দুই-তিনজন যুবকবয়সী ছেলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ৷ হাত ইশারা করে মারুফকে ডাকল ৷ কোন কিছু বুঝার আগে তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল ৷
   ‘আপনি শিখার কাছে গিয়েছিলেন ? কেন গিয়েছিলেন?’
    ‘সেই তো ডেকে নিয়ে গেছে ৷ একই কলেজের কিনা ৷ ’
একজন গলা উচিয়ে বলল—   
    ‘মিথ্যে বলার জায়গা পাওনা মিয়া? শিখা কি তোমার গার্লফ্রেন্ড লাগে ?’
     ‘বুঝলাম না আপনার কথা ৷ ’
     ‘বুঝে কাম নাই ৷ পকেটে কি আছে বের কর ৷ মিলন তুই গাড়ি স্টার্ট দে ৷’
মারুফের মোবাইল আর মানিব্যাগ নিয়ে দুইজনে মোটরসাইকেলে উঠে তীর্যকভাবে বলল,
     ‘দেখে তো ভদ্রঘরের মনে হয় ৷ বেশ্যার কাছে কিসের আনাগোনা ? 
   জোরে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে তারা চলে গেল ৷
   ঘটনাটি মুহূর্তেই ঘটে গেল ৷ দুচারজন আশেপাশে জড়লেও কেউ টের পেলো না ৷ কেউ কিছু জিজ্ঞাসাও করল না ৷
  মারুফ রাস্তায় ভীড়ের মধ্যে হাঁটতে থাকলো ৷ শিখার চেহারা একবার বিভৎস,আরেকবার রমনীয় হয়ে তার মনে ভেসে উঠছে ৷
     শিখা রাস্তা থেকে তাকে ভাই বলে ডেকে নিয়ে গেছে ৷ সে নাকি কলেজের জুনিয়র ব্যাচের ছিল, আগে বোরকা পড়ত,তাই মারুফ চেনে না ৷ কোনদিন কথা বলার সুযোগ নাকি হয় নি ৷ এমন কত কথা বলে শিখা তাকে ডেকে নিয়ে গেছে ৷
   

প্রখর রোদ ৷
মারুফ বসে আছে ক্যাম্পাসে ৷ তার এক বন্ধু রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল ৷ মারুফকে নীরস দেখে বলল,
  ‘বন্ধু, তোর বন্যাকে একজনের সাথে রিক্সায় ঘুরতে দেখলাম ৷’
  বন্ধুটি না দাঁড়িয়েই চলে যায় ৷ কিছুক্ষণ পর এক বান্ধবী তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরছিল ৷ মারুফের কাছে এসে তাকে বয়ফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ৷
    ‘মারুফ, বন্যা তোকে ছ্যাঁকা দিয়ে ফ্লাট করে বেড়াচ্ছে ৷ তুই হা হয়ে তার কথা ভাবিস কেন? তুই পারস না ?’
    মারুফ কোন উত্তর দেয় না ৷            বান্ধবীও চলে যায় ৷ 
  মারুফ একটা ফোন দেয় বন্যাকে, বন্যা তাকে ভালোবাসে না, সে জানে ৷ তবুও সত্যিটা সে জানতে চায় ৷
   ‘বন্যা, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি ৷ তুমি কি পিউর আছো, হ্যা অথবা না উত্তর দিবে ৷ ’
 অপর প্রান্ত থেকে মোবাইলে ভেসে ওঠে তার কণ্ঠ ৷
     ‘বেয়াদব,তুমি আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন কর? এত সাহস? তোমাকে আমি খুন করব ৷ ’
মারুফ লাইনটা কেটে দেয় ৷ উত্তরটা তার পাওয়া হলো না ৷ আবার হাঁটতে থাকে ক্যাম্পাসে ৷ বন্যাকে আর বিশ্বাস করতে পারে না ৷ সামনের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে নিয়ে সেটাতে টান দিয়ে ধোয়া ছোড়ে আকাশে, আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ৷
     মারুফের মনে পড়ে যায় পাঁচটি বছরে অতীতের কথা ৷ সে বন্যাকে অনেক ভালোবাসতো ৷ তবে বন্যা তাকে একটুকুও বোঝে নি ৷ দুজন কতো কাছাকাছি ছিল ৷ কতবার মারুফ তার হাতদুটো ধরতে চেয়েছিল— পারে নি ৷ বন্যা তাকে হাসি আর গানে মাতিয়ে রাখত ৷ মারুফের মনের কথা তার শোনার সময় ছিল না ৷ তাদের বিদায়টা ছিল বিজলীছটার মতো ৷
    মারুফ হাঁটতে হাঁটতে তার দুঁফোটা অশ্রু হাতের তালুর পিঠ দিয়ে মুছল— ‘পাগলিটা একটা কথা বলতে চেয়েছিল, আজো বলে গেলো না ৷’

মধ্যরাত ৷ ঝিঝি পোকা ডাকছে ৷
মারুফ শিখার ঘরের পাশে পড়ে গেল, মুখে তার মদের গন্ধ ৷
     চোর চোর বলে বস্তির ছেলেরা সেখানে জড়ো হয়ে তাকে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করল ৷
   হইহুল্লোর শুনে শিখা কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে বের হলো ৷ তার সঙ্গে মিলনও ঘর থেকে বের হলো ৷ শিখার চোখে বিস্ময় ৷
     ‘মিলন! একি!’
    ‘মরে গেছে মনে হয়?’
   ‘ লোকটাকে আমিই নিয়ে এসেছিলাম ৷’
    ‘ভালো করেছো৷’
    ‘মানে কি!’
   ‘তার সবকিছু উসুল করেই তো আজ চলছে ইয়ার ৷ সব চুকে গেছে ৷’
   ‘লোকটা শুধু আমার একটা হাত ধরতে চেয়েছিল ৷’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন