বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৮

অনুবাদ গল্পঃ স্কুল।। ডোনাল্ড বার্থালমি ।। ভাষান্তর।। রহমান হেনরী





স্কুল 



মূলঃ ডোনাল্ড বার্থালমি 
ভাষান্তর: রহমান হেনরী
ভালো কথা, দেখুন, চারা রোপনের জন্য এই  ত্রিশজন ছেলেমেয়ে ছিলো আমাদের, কেননা আমরা শনাক্ত করেছিলাম সেটা... তা ছিলো ওদের শিক্ষার অংশ, আপনারা জানেন, এটা দেখার জন্য যে উদ্ভিদের মূলতন্ত্র কিভাবে কাজ করে... আর দায়িত্ববোধের ব্যাপারটাও, কোনকিছুর যত্ন নেওয়া, স্বতন্ত্রভাবে দায়িত্ব নেওয়া। কী বোঝাতে চাইছি আপনারা জানেন। আর সবগুলো চারা মরে গিয়েছিলো। ওগুলো ছিলো কমলালেবুর চারা। জানিনা, কেন মরলো, শুধু বলতে পারি মরে গিয়েছিলো। হয়তো মাটিরই কোনও সমস্যা কিংবা বীজতলা থেকে যে চারাগুলো আমরা পেয়েছিলাম সেগুলো উৎকৃষ্ট প্রকৃতির ছিলো না। এ ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছিলাম। তো আমরা ত্রিশজন ছেলেমেয়ে পেলাম, প্রত্যেক ছেলে বা মেয়ের জন্য নির্ধারিত একটা করে ছোট্ট গাছ রইলো আর আমরা পেলাম ত্রিশটি মৃত চারা। ছেলেমেয়েরা ওইসব ছোট্ট বাদামি কাঠিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো, সেটা ছিলো খুব হতাশাজনক ব্যাপার।

ওটা খুব খারাপ ব্যাপার ছিলো না যে চারাগুলো নিয়ে এসব ঘটার মাত্র দু সপ্তাহ আগে, সবগুলো সাপ মরে গিয়েছিলো। কিন্তু আমার মনে হয় সাপগুলো— আচ্ছা, সেটার কারণ সাপগুলো লাত্থিয়ে বিদেয় করা হয়েছিলো...  সেটা আপনাদের স্মরণে থাকতে পারে, হরতালের কারণে চারদিন বয়লার বন্ধ ছিলো, সেটা ব্যাখ্যাযোগ্য ঘটনা। এ ব্যাপারে আপনি বাচ্চাকাচ্চাদের বোঝাতে পারবেন যে হরতালের জন্য এমনটি ঘটেছে। বলতে চাইছি, ছেলেমেয়েগুলোর কারুরই মা-বাবা তাদের তর্কসীমা অতিক্রম করতে দিতো না আর তারা জানতো একটা ধর্মঘট কর্মসূচি চলমান আছে এবং সে কথার অর্থ কী। কাজেই, ধর্মঘটের পর যখন সব কাজ চালু হলো আর আমরা দেখলাম সাপগুলো মরে গেছে, ওরা খুব একটা বিচলিত হয়নি।

ঔষধি বাগানের ক্ষেত্রে এটা হয়তো অতিজল ঢালার ঘটনা ছিলো, আর এখন ওরা অন্তত বুঝলো বেশি জল ঢালা চলবে না। ছেলেমেয়েরা ঔষধি বাগানের ব্যাপারে অতিসচেতন ও দায়িত্ববান ছিলো আর তাদেরই কেউ কেউ... আপনারা জানেন, যখন তাদের দিকে অতটা নজর দেয়া হয়নি, সম্ভবত অতিরিক্ত জল ঢেলে ফেলেছিলো। কিংবা হতে পারে... আচ্ছা ঠিক আছে, সাবটেজ তথা অন্তর্ঘাতের কথাটা আমি ভাবতে চাই না, যদিও এসব আমাদের সাথে ঘটতো। বোঝাতে চাইছি, এটা এমন এক ঘটনা যা আমাদের মনে তার্কিক ভাবনা জাগিয়ে তুললো। আমরা এভাবে ভাবছিলাম তার কারণ সম্ভবত এই যে, এর আগে মরু ইঁদুর, শাদা ইঁদুর আর সালসান্ডারগুলোও মরে গিয়েছিলে... যা হোক, বাচ্চারা এখন জেনে গেছে প্লাস্টিকের ব্যাগে করে ওগুলো আনা-নেওয়া যাবে না।

অবশ্যই আমরা স্বীকার করি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ মরে যাবে, এটা কোনও আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। সংখ্যাগুলো খেয়াল করুন, ওরা পেট ভেল্টিয়ে চিত হয়ে জলের উপরিতলে ভাসতে থাকে। কিন্তু শিক্ষণ পরিকল্পনা করা হয়েছিলো ওইসব মাছের ওপর, এ ব্যাপারে, আমাদের কিছুই করার ছিলো না, প্রতিবছরই এটা ঘটছে, আপনাদের উচিত এ ব্যাপারটাকে দ্রুত অতীতের দিকে ঠেলে দেয়া।

আমাদের কাছে এমনকি কুকুর ছানাও ছিলো না।

আমাদের কাছে এমনকি একটাও ছিলো না, সেটা ছিলো নিতান্তই একটা কুকুরছানা, একদিন কানাডিয়ান বংশোদ্ভূত মেয়েটি ওকে একটা মালবোঝাই ট্রাকের নিচে দেখতে পেয়েছিলো আর সে ভয় পেয়েছিলো যে মাল সরবরাহ শেষ হলে চালক হয়তো ওর ওপর দিয়েই ট্রাকটা চালিয়ে দেবে, কাজেই সে ছানাটাকে তুলে তার ব্যাগে পুরে স্কুলে নিয়ে এলো। তো, আমরা সেই কুকুরছানাটা পেলাম। দেখামাত্রই ভাবলাম, হায় খ্রিষ্ট, বাজি ধরে বলতে পারি এ ছানাটা হয়তো সপ্তাহ দুয়েক বাঁচবে আর তারপর... এবং সে ওরকমটিই করেছিলো। শ্রেণিকক্ষের ভেতরে আদৌ এটার থাকার কথা নয়, শ্রেণিকক্ষের বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে, কিন্তু আপনি তাদের বলতে পারেন না যে শ্রেণিকক্ষে তারা কুকুরছানা আনতে পারবে না, যখন ইতোমধ্যেই ওটা ওখানে আছে, ওদের সামনেই মেঝেতে ছোটাছুটি করছে আর জিহ্বা বের করে কুটুকুটু করে বেড়াচ্ছে। ওরা ছানাটার নাম দিলো এডগার— তার মানে, ওরা আমার নামেই নাম দিলো কুকুরছানাটার। ওর পিছনে ছুটে টেংলাতে খুব ভালো লাগছিলো ছেলেমেয়েগুলোর। ‘‘এদিকে, এদিকে, এডগার; খুব সুন্দর, খুব সুন্দর, এডগার।’’ হেসে কুটিকুটি বাচ্চারা শ্রেণিকক্ষটাকে নরক বানিয়ে ছাড়লো। ওরা এই দ্ব্যর্থকতার আস্বাদন পেয়ে গেল। আমি নিজেও উপভোগ করতে লাগলাম। বাচ্চামি স্বভাবে মনঃক্ষুণ্ণ হলাম না। ছানাটার জন্য শিক্ষা-উপকরণ সরবরাহ কক্ষের পাশে ওরা একটা ঘরও বানালো আর চলতে থাকলো এসব। ওটা কেন মরলো জানি না। আমার ধারণা, মেজাজ বিগড়িয়ে। খেলার মত কিছু হয়তো ছিলো না ছানাটার। প্রতিদিন আমি উপকরণকক্ষ ও তার আপপাশটা পর্যবেক্ষণ করতাম। বাচ্চারা স্কুলে আসার আগেই ওটাকে বের করে আনতাম। আমি ওর রক্ষক হয়ে উঠেছিলাম।

আর তারপর এলো কোরিয়ান এতিম শিশুটির ব্যাপার যাকে শিশুকর্মসূচির আওতায় আমরা পালক দিয়েছিলাম, এর আওতায় ছেলেমেয়েদের প্রত্যেকেই এক মাসের জন্য ওদের কোয়ার্টারে বাস করবে, এটাই ছিলো পরিকল্পনা। সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক হয়েছিলো, বাচ্চাটার নাম কিম আর হয়তো তাকে বেশ দেরিতে পালক দেয়া হয়েছিলো বা ওরকমই কিছু একটা। যে চিঠি আমরা পেলাম তাতে মৃত্যুর কারণ লেখা ছিলো না, আমাদেরকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো কিমের বদলে অন্য আরেকটা বাচ্চা আমরা যেন ওদেরকে দত্তক দিই, ওরা খুব আকর্ষণীয় সমীক্ষা প্রতিবেদন দেবে আমাদেরকে, কিন্তু আমাদের হৃৎপিণ্ডে আর সাহস ছিলো না। ছাত্রছাত্রিরা এ ঘটনাকে খুব কঠিনভাবে নিয়েছিলো ( যতদূর মনে পড়ে, সরাসরি কেউ আমাকে কিছু বলেনি) এ অনুভবে যে হয়তো বিদ্যালয়টারই কোনও ত্রুটি আছে। কিন্তু আমার মনে হয় না স্কুলের কোনও বাজে ব্যাপার আছে, বিশেষত, আমি এখনকার সবচে ভালো ও খারাপ দিনগুলো দেখেছি। এটা কেবলই একটা দুর্ভাগ্য। চোখের পলকে আমাদের অস্বাভাবিক সংখ্যক ছেলেমেয়ের পিতামাতা বিগত হলো, এসবের মধ্যে আমার মনে পড়ে দু দুটো হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া আর দুটো আত্মহত্যা, একটা জলে ডুবে মরা আর সড়ক দুর্ঘটনায় একসাথে চারজনের মৃত্যু। আরেকটা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। আর আমাদের দাদা-দাদি নানা-নানিদের স্বাভাবিক মৃত্যুহারও বেশি, কিংবা হতে পারে এবছর মৃত্যুহার আরও বেশি, সেরকমই মনে হয়। আর শেষকথা হলো এটা মর্মান্তিক।

মর্মন্তুদ ঘটনা তখনই ঘটলো যখন ম্যাথু ওয়েন ও টনি ম্যাভরোগর্দো ওখানে খেলতে লাগলো যেখানে নতুন ফেডারেল ভবনের নির্মাণসামগ্রি স্তূপ করে রাখা। ওখানে কাঠের বিশাল বিশাল বাটাম সাজিয়ে রাখা ছিলো, আপনারা জানেন, নির্মাণসামগ্রির গাদাগুলোর সামনে। ওখান থেকেই একটা মামলার উদ্ভব হলো, অভিবাবকগণ অভিযোগ তুললেন বাটামগুলো ঠিকঠাক সাজানো ছিলো না। জানি না কোনটা সত্য কোনটা নয়। এটা এক অদ্ভূত বছরে পরিণত হলো।

বিলি ব্যান্ডের বাবার কথা উল্লেখ করতে ভুলে গেছি যাকে মুখোশধারি এক অবৈধ অনুপ্রবেশকারি তার বাড়িতে এসে চাকু মেরেছিলো।

একদিন শ্রেণিকক্ষে আমাদের আলোচনা বসলো। ওরা জানতে চাইলো, ওগুলো কোথায় গেল?  গাছের চারাগুলো, সালাম্যান্ডার, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ, এডগার, বাবাগুলো, মাগুলো, ম্যাথু আর টনি, ওরাসব কোথায় গেল? আর আমি বললাম, জানি না, আমি জানি না। আর ওরা বললো, কে জানে? এবং আমি বললাম, না, সেটাই জীবন যেটা বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করে। তখন তারা বললো, মৃত্যু কি মৌলিক উপাত্ত হিসেবে গণ্য নয়, এটার অর্থ হলো— মৃত্যুর মাধ্যমে দৈনন্দিনতা থেকে ভিন্নদিকে যাত্রাকে অবশ্যম্ভাবি করা হয়—
আমি বললাম, হ্যাঁ, হয়তো।
তারা বললো, সেটা আমাদের পছন্দ নয়।
আমি বললাম, শুনতে ভালো লাগছে।
তারা বললো, এটা ন্যাক্কারজনক।
আমি বললাম, তাই।
তারা বললো, তুমি কি এখন হেলেনের সাথে দৈহিক মিলন ঘটাবে( হেলেন আমার পাঠদান সহায়িকা) যাতে করে আমরা দেখতে পারি কীভাবে এসব হয়? আমরা জানি হেলেনকে তুমি পছন্দ করো।
হেলেনকে নিশ্চয় পছন্দ করি কিন্তু বললাম সেটা আমি করবো না।
আমরা এসবের কথা অনেক শুনেছি, তারা বললো, কিন্তু কীভাবে ঘটে তা আমরা দেখিনি।
আমি বললাম আমাকে গুলি করা হোক আর তবুও ওটা আমি করবো না, কখনই না, একদম না, প্রদর্শনী করবো না। হেলেন জানাপথে বাইরে তাকিয়ে থাকলো।
তারা বললো, প্লিজ, দয়া করে করো হেলেনের সাথে, মূল্যবোধের একটা তাত্ত্বিক ধারণা আমাদের দরকার, আমরা শংকিত।

আমি বললাম যে তাদের শংকিত হওয়া উচিত নয় (যদিও আমি প্রায়শই শংকাবোধ করি) আর বললাম সর্বত্রই মূল্যবোধ বিরাজমান। হেলেন এগিয়ে এলো আর আলিঙ্গন করলো আমাকে। আমি ওর চোখের পাতায় চুমু খেলাম কিছুক্ষণ। পরস্পরকে জাপটে ধরে থাকলাম। ছেলেমেয়েরা প্লুত বোধ করলো। তখন দরোজায় এক ধরণের টোকা পড়লো, দরোজা খুললাম আর নতুন একটা মরু ইঁদুর ঢুকে পড়লো শ্রেণিকক্ষে। দুর্দান্ত উল্লাসে ফেটে পড়লো বাচ্চাকাচ্চারা। 


1 টি মন্তব্য: