কবি কাজী নজরুল ইসলাম
আমির হোসেন
কবি কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক ও রাজনীতিবিদ। বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী, উদ্দীপ্ত যৌবনের কবি কাজি নজরুল ইসলাম। ধুমকেতুর মহাবিস্ময় নিয়ে যিনি প্রবল আলোড়ন তুলেছেন বাংলার সাহিত্যাকাশে। রচনাও করেছেন দুনিয়ার সব মজদুর ও সর্বহারাকে নিয়ে কবিতা গান। কৃষক, শ্রমিক, জেলে, কুলি, মজুর, ছাত্রজনতা সবাইকে নিয়ে লিখেছেন প্রেমের, বিরহের, প্রকৃতির, ঋতুবৈচিত্রের কবিতা, গান; তিনি রচনা করেন নানা ভাবের গান, লোকসংগীত, ইসলামী গানগুলির মধ্যে আছে গজল, হামদ-নাত জাতীয় প্রশস্তিগীতি ও নিবেদনের সুর; আছে ভক্তিমূলক গান যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈষ্ণবীয় ভাবকীর্তন এবং শক্তিগান যা সংখ্যায় অজস্র।
সাম্যবাদের এ কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয় গ্রামে এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন। তাঁর বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাজারের খাদেম। নজরুল ছিলেন তাঁর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ৬ষ্ঠ সন্তান। নজরুলের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। ১৯০৮ সালে মাত্র আট নয় বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাঁকে। ১৯০৯ সালে গ্রামের মক্তব থেকে মাত্র নিম্ন প্রাইমারী পাশ করে মক্তবে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর মাজারের খাদেম ও মসজিদের মোয়াজ্জেন হিসেবে কাজ করেন। মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোক শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন লেটো দলের (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল) সদস্য ও পালাগান রচনা করেন। তাঁর চাচা বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় তাঁর দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয় নজরুল বজলে করিমের প্রভাবেই লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর গোদা কবি এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই মূলত তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এ দলের সাথে তিন বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি নাটক, কবিতা এবং সাহিত্য সমন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একইসাথে তিনি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমুহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তিনি দলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধ। একদিকে মসজিদ, মাজার, মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের প্রচুর উপাদান সরবরাহ করেছে। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। ১৯১১ সালে মাথরুন গ্রামে নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউটে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন।
১৯১২ সালে তিনি স্কুল ত্যাগ করে বাসুদেবের কবি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন, রেলওয়ের গার্ড সাহেবের খানসামা, আসানসোলে এম বখ্শের চা-রুটির দোকানে কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তাঁর বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। রুটির দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর ময়মনসিংহের কাজী রফিজউল্লাহ ও তাঁর পুত্রশা মসুন্নেসা খানমের স্নেহ লাভ করেন। দোকানে বসে একা একা নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। কাজী রফিজউল্লাহর সহায়তায় ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের কাজীর-সিমলা, দরিরামপুর গমন করেন এবং দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯১৫ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি রানিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। তখন তাঁর শৈলজানন্দের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। প্রিটেস্ট পরীক্ষার আগে তিনি সেনাবাহিনীর ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন।
১৯১৭ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সময়কাল তাঁর সৈনিক জীবন প্রধানত, করাচিতে গনজা বা আবিসিনিয়া লাইনে অতিবাহিত হয়। তখন তিনি ব্যাটালিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার পদে উন্নতি লাভ করেন এবং সাহিত্য চর্চা করেন। কলকাতার মাসিক সওগাতে ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামে গল্প এবং ত্রৈমাসিক বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকায় ‘মুক্তি’ নামের কবিতা প্রকাশিত হয়। করাচির সেনানিবাসে বসে নজরুল যে সমস্ত রচনাগুলি সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েঝে বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম কবিতা প্রকাশ),গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। সৈনিক অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ^যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে সেনাবাহিনী থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-সমিতির ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটস্থ দফতরে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। মূলত কলকাতার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন তিনি তখন শুরু করেন। মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় তাঁর বিবিধ রচনা প্রকাশ হতে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহর্রম, ফাতেহা-ই দোয়াজ্দম্, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এরপর সাংবাদিক হিসেবে তিনি সে সালের মে মাসে এ. কে. ফজলুল হকের সান্ধ্য-দৈনিক ‘নবযুগ’ পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক পদে যোগদান করেন। পরে নবযুগ পত্রিকার চাকরি পরিত্যাগ করে তিনি দেওঘর গমন করেন।
১৯২১ সালে দেওঘর থেকে প্রত্যাবর্তন করে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে ‘মোসলেম ভারতে’র সম্পাদক আফজাল-উল-হকের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন এবং পুনরায় ‘নবযুগ’ পত্রিকায় যোগদান করেন। এপ্রিল মাসে তিনি মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচিত হন। তার সাথে তিনি কুমিল্লা গমন করেন। সেখানে তিনি কান্দির পাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ও বিরজাসুন্দরী দেবীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। আর এখানে তার পরিচয় ঘটে প্রমীলা দেবীর সাথে। যার সাথে প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল। তিনি আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুর গমন করেন এবং সেখানে তিনি দুই মাস অবস্থান করেন। তখন বাংলা ১৩২৮ সালের ৩ আষাঢ় তিনি আলী আকবার খানের ভাগেনেয়ী সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস আসার খানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহে কুমিল্লা থেকে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পরিবারের সকলেই যোগদান করেন। বিবাহের আখত সম্পন্ন হবার পর কাবিনে নজরুলের ঘরজামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘরজামাই থাকতে অস্বীকার করেন। এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই অর্থাৎ বিবাহের রাত্রেই নজরুল দৌলতপুর ত্যাগ করে কুমিল্লা এসে অবস্থান করেন এবং বিবাহ সংক্রান্ত গোলযোগের খবর কলকাতায় প্রেরণ করেন। কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে নজরুল খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং প্রমীলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
নজরুল সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন। তিনি মুসলিম হয়েও তাঁর চার সন্তানের নাম বাংলা এবং আররি/ফারসি উভয় ভাষাতেই নামকরণ করেন। যেমন: কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সাব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ। জুলাই মাসে মুজফ্ফর আহমদের সাথে কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর হয়ে কলকাতা ফিরে যান। সেখানে ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়িতে অবস্থান করেন। অক্টোবরে তিনি অধ্যাপক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে শান্তিনিকেতন ভ্রমণ করেন। তখন তিনি রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। নভেম্বর মাসে তিনি পুনরায় কুমিল্লায় গমন করেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এরপর তিন কলকাতায় ফিরে যান। ডিসেম্বরের শেষের দিকে কলকাতার তালতলা লেনের বাড়িতে বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেন। কবিতাটি সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ ও মাসিক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ছাপানো হলে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। মার্চ মাসে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ প্রকাশিত হয়। যার উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখেছিলেন ‘ মানসী আমার! মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ব করলুম’। এ সালের ১২ আগস্ট অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধুমকেতু’ প্রকাশিত হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। অক্টোবর মাসের ২৫ তারিখ তাঁর ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্য ও ‘যুগবাণী’ প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়। অগ্নি-বীণার উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখেছিলেন-ভাঙা-বাংলার রাঙা-যুগের আদি পুরোহিত, সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্র কুমার ঘোষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু। যুগবাণী সরকার কতৃক বাজেয়াপ্ত ঘোষিত হয়। ধুমকেতুতে প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ও বাজেয়াপ্ত হয়। নভেম্বর মাসে নজরুলকে কুমিল্লায় গ্রেপ্তার করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে আটকে রাখা হয়। ধুমকেতু পত্রিকার ১৯২২ সালের ১৩ অক্টোবর সংখ্যায় নজরুল প্রথম ভারতের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেছিলেন।
১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর বিচারকালে নজরুলের বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ আদালতে উপস্থাপন করা হয়। ১৬ জানুয়ারি বিচারের পর তাঁকে এক বছর সশ্রম কারাদÐ হয় এবং তাঁকে আলিপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাটকটি উৎসর্গ করেন। এরপর নজরুলকে হুগলি জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে মে মাসে নজরুল অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। শিলং থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে টেলিগ্রাম করেন। টেলিগ্রামে তিনি লেখেন- Give up hanger strik, our literature claims you’
বিরাজাসুন্দরী দেবীর অনুরোধে তিনি অনশন ভঙ্গ করেন। জুলাই মাসে তাঁকে বহরমপুর জেলে স্থানান্তর করেন এবং ডিসেম্বর মাসে তিনি মুক্তিলাভ করেন। অক্টোবর মাসে তাঁর কবিতা ও গানের গ্রন্থ ‘দোলন-চাঁপা প্রকাশিত হয়। ১৯২৪ সালে তিন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মেদিনীপুর শাখার একাদশ বার্ষিক অধিবেশনে যোগদান করেন। ১০ আগস্টে কবির ‘বিষের বাঁশী’ ও ভাঙার গান প্রকাশিত হলে বরং কিছুদিন পরই সরকার কতৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়। বিষের বাঁশী গ্রন্থটির উৎসর্গ পত্রে কবি লেখেছিলেন-বাংলার অগ্নি-নাগিনী মেয়ে মুসলিম-মহিলা-কূল-গৌরব আমার জগজ্জননী-স্বরূপা মা মিসেস এম. রহমান সাহেবের পবিত্র চরণারবিন্দে। যার সহযোগিতা ও মধ্যস্থতায় তাঁর প্রমিলার সাথে বিয়ে হয়েছিল। এবং তখন প্রমিলাকে নিয়ে তিনি হুগলিতে সংসার পেতেছিলেন। আর ভাঙার গান গ্রন্থটির উৎসর্গ পত্রে লেখা ছিল-মেদিনীপুরবাসীর উদ্দেশ্যে। হুগলিতেই তাঁর প্রথম পুত্র আজাদ কামালের জন্ম হয় ও অকাল মৃত্যু হয়। ১৯২৫ সালের মে মাসে তিনি কংগ্রেসের ফরিদপুর অধিবেশনে যোগদান করেন। সে অধিবেশনে যোগদান করেছিলো মাহাত্মা গান্ধি এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। জুলাই মাসে কবি বাঁকুড়া সফর করেন। সেখানে তাঁর ‘কল্লোল’ পত্রিকার সাথে সম্পর্ক হয়। ডিসেম্বর মাসে নজরুল ইসলাম, হেমন্তকুমার সরকার, কুতুবউদ্দীন আহমদ ও শামসুদ্দিন হোসাইন কর্তৃক ভারতীয় কংগ্রেসের অন্তর্গত, মজুর স্বরাজ পার্টি গঠিত হয়। ডিসেম্বরে শ্রমিক প্রজা স্বরাজ দলের মুখপত্র ‘লাঙল’ প্রকাশিত হয়। যার সম্পাদক ছিলেন নজরুল ইসলাম। লাঙল ছিল বাংলা ভাষায় প্রথম শ্রেণিসচেতন পত্রিকা। ঐ বছর ১২ জানুয়ারি তাঁর গল্প গ্রন্থ ‘রিক্তের বেদন’ প্রকাশিত হয়। এবং ২৫ আগস্টে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতা ও গানের গ্রন্থ ‘চিত্তনামা’। গ্রন্থটির উৎসর্গ পত্রে তিনি লেখেন-মাতা বাসন্তী দেবীর শ্রীশ্রীচরণারবিন্দে। এই সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত কবির কবিতা ও গানের বই। গ্রন্থটির উৎসর্গ পত্রে তিনি লেখেন-আমার শ্রেয়তম রাজলাঞ্চিত বন্ধু মুজফ্ফর আহ্মদ ও কুতুবউদ্দীন আহ্মদ করকমলে। কবির ‘সাম্যবাদী’ কবিতা গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় এই সালের ২০ ডিসেম্বর। ১৯২৬ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতা ও গানের বই ‘পূবের হাওয়া’।
১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকে কবি কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন। মার্চ মাসে তিনি মাদারিপুরে নিখিল বঙ্গীয় ও আসম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মেলনে যোগদান করেন। এপ্রিল মাসে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত হলে তিনি রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথকে তাঁর ‘চল চঞ্চল বাণীর দুলাল’ ‘ধ্বংসপথের যাত্রীদল’ এবং ‘শিকল-পরা ছল’ গান শোনান। মে মাসে কৃষ্ণনগরে কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীত ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’, কিষাণ সভায় ‘কৃষাণের গান’ ও ‘শ্রমিকের গান’ এবং ছাত্র ও যুব সম্মেলনে ‘ছাত্রদলের গান’ পরিবেশন করেন। জুলাই মাসে চট্টগ্রাম, অক্টোবর মাসে সিলেট এবং যশোর ও খুলনা সফর করেন। সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের জন্ম হয়। তিনি তখন চরম আর্থিক সংকটে পরেন। তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি তিনি তখনই রচনা করেন। নভেম্বর মাসে পূর্ববঙ্গ থেকে কেন্দ্রীয় আইন সভার উচ্চ পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করে পরাজয় বরণ করেন। সে বছর ডিসেম্বর থেকে তাঁর গজল রচনার সূত্রপাত হয়। ‘বাগিচায় বুলবুলি’, ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’, ‘দুরন্ত বায়ু পুরবইয়াঁ’, ‘মৃদুল বায়ে বকুল ছায়ে’ প্রভৃতি গান ও ‘খালেদ’ কবিতাটি তিনি তখনই রচনা করেন। এর পর নজরুলের ক্রমাগত অসুস্থতা বাড়তে থাকে। এই সালের ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত হয় কবির ছোটদের কবিতা গ্রন্থ ‘ ঝিঙে ফুল’। এবং অক্টোবরে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘দুর্দিনের যাত্রী’ এবং কবিতা ও গানের গ্রন্থ ‘সর্বহারা’। সর্বহারা গ্রন্থটি নজরুল ইসলাম উৎসর্গ করেন তাঁর শাশুড়ি বিরজাসুন্দরী দেবীকে। গ্রন্থটির উৎগর্স পত্রে তিনি লেখেন-মা (বিরজাসুন্দরী দেবী)-র শ্রীচরণারবিন্দে।
১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ঢাকা সফর করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করে তাঁর ‘খোশ আমদেদ’ গানটি পরিবেশন ও ‘খালেদ’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন। তিনি তখন বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মুজফ্ফর আহমদ সম্পাদিত কৃষক ও শ্রমিক দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘গণবাণী’ এর জন্য এপ্রিল মাসে ‘ইন্টারন্যাশনাল’, ‘রেড ফ্লাগ’ ও শেলির ভাব অবলম্বনে যথাক্রমে ‘অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত’, ‘রক্ত-পতাকার গান’ ও ‘জাগর তূর্য’ রচনা করেন। ফলশ্রæতিতে জুলাই মাসে ‘গণবাণী’ পত্রিকা অফিসে পুলিশ হানা দেয়। আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ তখন তুঙ্গে উঠে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী, নজরুল, সজনীকান্ত দাস, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত প্রভৃতি সাহিত্যিকের মধ্যে ‘প্রবাসী, শনিবারের চিঠি, কল্লোল, কালিকলম প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় বির্তকের ঝড় বয়ে যায়। ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্সি কলেজে রবীন্দ্র পরিষদে রবীন্দ্রনাথের ভাষণ, ‘সাহিত্যে নবত্ব’ প্রবন্ধ এবং নজরুলের ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ ‘রক্ত’ অর্থে ‘খুন’ প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়। বির্তকের অবসানে প্রমথ চৌধুরী ‘বাংলা সাহিত্যে খুনের মামলা’ প্রবন্ধ লেখেন।
ইসলাম দর্শন, মোসলেম দর্পণ, প্রভৃতি রক্ষণশীল মুসলমান পত্রিকায় নজরুলের প্রচুর সমালোচনা প্রকাশিত হয়। কিন্তু ইব্রাহিম খান, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল কালাম শামমুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, আবুল হোসেন প্রমুখ সাহিত্যিকগণ নজরুলকে সমর্থন করেন। নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘রুদ্রমঙ্গল’ কবিতা ও গানের গ্রন্থ ‘ফণি-মনসা’ উপন্যাস গ্রন্থ ‘বাঁধনহারা’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। ১৯২৭ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত উপন্যাসটির উৎসর্গ পত্রে কবি লেখেন-সুর-সুন্দর শ্রীনলিনীকান্ত সরকার করকমলেষু। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে কবি যোগদান করেন। এই সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীতের জন্যে তিনি ‘নতুনের গান’ রচনা করেন। ঢাকায় অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, অধ্যাপক কাজী মোতহার হোসেন, বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, মিস্ ফজিলাতুনন্নেসা, প্রতিভা সোম, উমা মৈত্র প্রমুখের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা হয়। মে মাসে নজরুলের মাতা জাহেদা খাতুন মৃত্যুবরণ করেন।
সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা ইউনিভার্সিটি হলে কবি শরৎ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দিলীপকুমার রায়, সাহানা দেবী ও নলিনীকান্ত সরকারের সঙ্গে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। অক্টোবরে তাঁর ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশিত হয়। ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় নজরুলের প্রচুর বিরোধীতা করা হয়। আবার ‘সওগাত’ পত্রিকা নজরুলকে সমর্থন করেন। সে সালের ডিসেম্বর মাসে নজরুল ইসলাম রংপুর ও রাজশাহী সফর করেন। এর পর তিনি কলকাতায় নিখিল ভারত কৃষক ও শ্রমিক দলের সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন। এরপর নেহেরুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কলকাতায নিখিল ভারত সোশিয়ালিস্ট যুবক কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদান করেন। কবি গোলাপ মোস্তফা নজরুলের প্রচুর বিরোধিতা করেন। ডিসেম্বরের শেষে কৃষ্ণনগর থেকে তিনি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করে ‘সওগাত’ এ যোগদান করেন। প্রথমে ১১নং ওয়েলেসলি স্ট্রিটে ‘সওগাত’ অফিস সংলগ্ন ভাড়া বাড়িতে ও পরে ৮/১ পান বাগান লেনে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন। তখন নজরুলের গ্রামোফোন কোম্পনির সাথে যোগাযোগ হয়। কবিতা গ্রন্থ ‘সিন্ধু-হিন্দুল’ প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালের যা কবি উৎসর্গ করেন ‘বাহার ও নাহারকে। একই সালের ১৪ অক্টোবর প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতা ও গানের গ্রন্থ ‘সঞ্চিতা’। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেন বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথকে। উৎসর্গ পত্রে তিনি লেখেন-বিশ্বকবি সম্রাট শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীশ্রীচরণারবিন্দুষু। ১৯২৮ সালে আরো প্রকাশিত হয় ‘বুলবুল, জিঞ্জীর ও চক্রবাক। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর এলবার্ট হলে নজরুলকে জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। উদ্যোক্তা ছিলেন ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরউদ্দীন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, হাবীবুল্লাহ বাহার প্রমুখ। সংবর্ধনা সভায় সভাপতি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং প্রধান অতিথি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু।
১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয় সন্ধ্যা, চোখের চাতক। মৃত্যু-ক্ষুধা উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসে। এই সালে আরো প্রকাশিত হয় ‘অনুবাদ কবিতা ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ, গান নজরুল গীতিকা, ঝিলিমিলি ও প্রলয়-শিখা গ্রন্থটি। প্রলয়-শিখা গ্রন্থটি এই সালের আগস্টে প্রকাশিত হওয়ার পর ১৭ সেপ্টেম্বরে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়। এবং ১১ ডিসেম্বর কবির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। যার জন্য কবির ছয় মাসের কারাদন্ড হয়। সেই সালের ১৬ ডিসেম্বর কবি জামিন লাভ করেন এবং আপিল করেন। ১৯৩১ সালের ৪ মার্চে অনুষ্ঠিত গান্ধি-ডারউইন চুক্তির ফলে সরকার পক্ষের অনুপস্থিতিতে ৩০ শে মার্চ কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে কবি মামলা থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। সে সময় কবির প্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু হয়। ১৯৩১ সালে তাঁর সিনেমা ও মঞ্চ-জগতের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তাঁর ‘আলেয়া’ গীতিনাট্য রঙ্গমঞ্চে মঞ্চস্থ হয়। এসময় তিনি অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু প্রলয়-শিখা’র নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকে। ১৯৪৮ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৩১ সালের ২১ জুলাই প্রকাশিত হয নজরুলের কুহেলিকা উপন্যাসটি। নজরুল-স্বরলিপি প্রকাশিত হয় এই সালে ২৫শে আগস্ট। সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয় চন্দ্রবিন্দু। গানের এ গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত হয় এই সালের ১৪ অক্টোবর এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় ১৯৪৫ সালের ৩০ নভেম্বর। ১৯৩১ সালের ১৬অক্টোবর তাঁর ‘শিউলিমালা’ গল্প গ্রন্থটিও প্রকাশিত হয়। এই সালে আরো প্রকাশিত হয় গীতিনাট্য ‘আলেয়া’। কবি নজরুল ইসলাম ১৯৩২ সালের নভেম্বরে সিরাজগঞ্জে ‘বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনে’ সভাপতিত্ব করেন। এবং ডিসেম্বরে ‘বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের’ পঞ্চম অধিবেশনে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এই সালে কবির গানের বই যথাক্রমে ৭ জুলাই ‘সুরসাকী’ ও ১৩ অক্টোবর বন-গীতি প্রকাশিত হয়। বনগীতি গ্রন্থটির উৎসর্গ পত্রে কবি লেখেন-ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতকলাবিদ আমার গানের ওস্তাদ জামিরউদ্দিন খান সাহেবের দস্ত মোবারকে। কবির গানের বই ‘জুলফিকার প্রকাশিত হয় এই সালের ১৩ অক্টোবর। ১৯৩৩ সালের গ্রীষ্মে ‘বর্ষবাণী’ সম্পাদিকা জাহান আরা চৌধুরীর সঙ্গে দার্জিলিং ভ্রমণ করেন ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ‘ধ্রুব’ চিত্রে নারদের ভূমিকায় অভিনয় ও সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত কবির ছোটদের নাটিকা ও কবিতা গ্রন্থ ‘পুতুলের বিয়ে’। ১৯৩৩ সালের ২৭ জুন আরো প্রকাশিত হয় কবির ‘গুল-বাগিচা’ গানের গ্রন্থটি। ২৭ নভেম্বর প্রকাশিত হয় তাঁর অনুবাদ গ্রন্থ ‘কাব্য-আমপারা’। ১৯৩৪ সালে তিনি গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকান ‘কলগীতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সালে প্রকাশিত হয় কবির গীতি-শতদল, সুরলিপি, সুরমুকুর ও গানের মালা। ১৯৩৬ সালে তিনি ফরিদপুর ‘মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের কনফারেন্সে’ সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৮ সালের এপ্রিল মাসে কবি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে’ কাব্য শাখার সভাপতিত্ব করেন। তখন তিনি ছায়াচিত্র ‘বিদ্যাপতির’ কাহিনী রচনা করেন। এবং ১৯৩৯ সালে ছায়াচিত্র ‘সাপুড়ে’র কাহিনী রচনা করেন। এই সালের ২৩ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতা ও গানের বই ‘নির্ঝর’। ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে নব পার্যায়ে প্রকাশিত ‘নবযুগে’র প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। এবং ডিসেম্বরে কলকাতা মুসলিম ছাত্র সম্মেলনে ভাষণ প্রদান করেন। সে সময় প্রমীলা নজরুল পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন।
১৯৪১ সালের মার্চ মাসে বনগাঁ সাহিত্য-সভার চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ৫ ও ৬ এপ্রিল নজরুলের সভাপতিত্বে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জুবলি উৎসবে সভাপতিরূপে জীবনের শেষ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ ‘ যদি আর বাঁশি না বজে’ প্রদান করেন। ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই কবি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। ১৯ জুলাই কবি জুলফিকার হায়দারের চেষ্টায় ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আর্থিক সহায়তায় নজরুলের বায়ু পরিবর্তনের জন্য ডাঃ সরকারের সঙ্গে মধুপুর গমন করেন। মধুপুরে তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। ২১ অক্টোবর তিনি মধুপুর থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ডা. গিরীন্দ্রশেখর বসুর ‘লুম্বিনি পার্কে’ চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। অবস্থার উন্নতি না ঘটায় তিন মাস পর তিনি বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৪৪ সালে বুদ্ধদেব সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার ‘নজরুল সংখ্যা’ (কার্তিক-পৌষ ১৩৫১) প্রকাশিত হয়। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নজরুলকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ প্রদান করেন। এই সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতা গ্রন্থ ‘নতুন চাঁদ’।
১৯৪৬ সালে নজরুল পরিবারের অভিভাবিকা নজরুলের শাশুড়ি গিরিবালা দেবী নিরুদ্দেশ হন। নজরুলের সৃষ্টিকর্ম মূল্যায়নে প্রথম গন্থ কাজী আবদুল ওদুদ কৃত ‘নজরুল-প্রতিভা’ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের পরিশিষ্টে কবি আবদুল কাদির প্রণীত নজরুল-জীবনীর সংক্ষিপ্ত রূপরেখা সংযোজিত হয়। ১৯৫২ সালে ‘নজরুল নিরাময়’ সমিতি গঠন করা হয়। যার সম্পাদক ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। জুলাই মাসে নজরুল ও তাঁর পুত্রকে রাঁচি মানসিক হাসপাতালে প্রেরণকরা হয়। চার মাস চিকিৎসার পর সুফলের অভাবে তাঁকে ফিরিয়ে কলকাতা আনা হয়। ১৯৫৩ সালের মে মাসে কবি ও কবি পুত্রকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানো হয়। সেখানে মানসিক চিকিৎসক উইলিয়ম স্যারগন্ট, ই. এ. বেটন, ম্যাকসিক ও রাসেল ব্রেনের মধ্যে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ব্যাপারে মতভেদ দেখা দিলে ডিসেম্বরে নজরুলকে ভিয়েনাতে পাঠানো হয়। ভিয়েনায় বিখ্যাত আয়ুর্বিদ চিকিৎসক ডা.হ্যান্স হফ্ কর্তৃক সেরিব্রাল এনজিওগ্রাম পরীক্ষার ফলে জানা যায় যে নজরুল ‘পিকস ডিজিজ’ নামে মস্তিস্ক রোগে আক্রান্ত এবং তা চিকিৎসার বাইরে বলে প্রতীয়মান হয়। ডিসেম্বর নজরুল ও তাঁর পুত্রকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯৫৫ সালে তাঁর কবিতা ও গানের বই ‘সঞ্চয়ন’ এবং ১৯৫৯ সালে কবিতা, গানের বই ‘শেষ সওগাত’ ও অনুবাদ গ্রন্থ ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম প্রকাশিত হয়। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার কর্তৃক নজরুলকে ‘পত্মভূষণ’ উপাধি প্রদান করা হয়। এই সালে কবির গীতিনাট্য ‘মধুমালা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৬২ সালের ৩০শে জুন নজরুল-পতœী প্রমীলা নজরুলের দীর্ঘ রোগ ভোগের পর পরলোক গমন করেন। প্রমীলা নজরুলকে চুরুলিয়ায় দাফন করা হয়। নজরুলের দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ইসলাম ও কাজী অনিরুদ্ধ ইসলামের মৃত্যু হয় যথাক্রমে ১৯৭৪ সালে ও ১৯৭৯ সালে। ১৯৬৬ সালে কবি আবদুল কাদিরের সম্পাদনায় ঢাকার ‘কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড’ কর্তৃক ‘নজরুল-রচনাবলী’ প্রথম খÐ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে সম্বিতহারা কবির অসুস্থতার সপ্তবিংশ বৎসর পূর্ণ এবং সর্বত্র কবি কাজী নজরুল ইসলামের সপ্ততিতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হয়। কলকাতার রবীন্দ্র-ভারতী বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃক নজরুলকে সম্মানসূচক ডি. লিট. উপাধি প্রদান করা হয়। আর এই ১৯৬০ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে কবির ঝড়, ধূমকেতু, পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে, রাঙাজবা, আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল-রচনা-সম্ভার, নজরুল রচনাবলী প্রথম খন্ড-দ্বিতীয় খন্ড-তৃতীয় খন্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫মে নজরুল জন্মবার্ষিকীর দিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নব পর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়।
নজরুলের আবির্ভাব ও কর্মকাল রবীন্দ্রযুগের অর্ন্তভূক্ত। তবু তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয়ের সম্পূর্ণ বাইরে থেকে অসংখ্য গান রচনা করেছেন ও সুরারোপ করেছেন। তিনি বাংলা বাংলা গানে বিচিত্র সুরের উৎস। তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সুগায়ক ছিলেন। নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক। তাঁর গানগুলি নজরুল সংগীত নামে পরিচিত। পৃথিবীর কোন ভাষায় একক হাতে এত বেশি সংখ্যক গান রচনার উদাহরণ নেই। এই সকল গানের বড় একটি অংশ তাঁরই সুরারোপিত। তাঁর রচিত ‘চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল’ গানটি বাংলাদেশের রণসংগীত। তাঁর কিছু গান জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে গানে মালা, গুল বাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। পরবর্তীকালে আরো কিছু গান সংগ্রন্থিত হয়েছে। তবে তিনি প্রায়শই তাৎক্ষণিকভাবে লিখতেন; একারণে অনুমান করা হয় প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের অভাবে বহু গান হারিয়ে গেছে।
১৯৩৮ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হন। সেখানে তিনটি অনুষ্ঠান যথাক্রমে ‘হারামণি’, ‘নবরাগমালিকা’ ও ‘গীতবিচিত্রা‘র জন্য তাঁকে প্রচুর গান লিখতে হতো। ‘হারামণি’ অনুষ্ঠানটি কলকাতা বেতার কেন্দ্রে প্রতি মাসে একবার করে প্রচারিত হতো যেখানে তিনি অপেক্ষাকৃত কম প্রচলিত ও বিলুপ্ত প্রায় রাগের পরিচিতি দিয়ে সেই রাগের সুরে তাঁর নিজের লেখা নতুন গান পরিবেশন করতেন। এই সব হারানো রাগের উপর তিনি চল্লিশটিরও বেশি গান রচনা করেন। নজরুল বহু পরিচয়ের মধ্যে একটি হলো তিনি গদ্য লেখক। গল্প দিয়েই শুরু হয়েছিল তাঁর সাহিত্যচর্চা। যদি তাঁর দুই দশকের সাহিত্যিক জীবনে মাত্র তিনখানা গল্পগ্রন্থে (ব্যথার দান, রিক্তের বেদন এবং শিউলিমালা) আঠারটি ছোটগল্প গ্রথিত হলেও তাঁর প্রতিটি গল্পই যেন আন্তরিক বেদনার রঙে রঙিন। তাঁর গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রেম। নিখাদ প্রেমের চিরকালীন আকুতি ফুটে উঠেছে তাঁর গল্পে। এ প্রেম শুধু মানসির প্রথি নয় দেশের প্রতিও। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ব্যথার দানের প্রথম গল্প ‘ব্যথার দান’ দারুণ একটি দেশপ্রেম ও ভালোবাসার কাহিনী। জীবনের প্রথম গল্পগ্রন্থেই নজরুল মাতৃভূমিকে মায়ের সমান মর্যাদা দিয়েছেন। তুলে ধরেছেন পরাধীনতার গ্নানি ও যন্ত্রণার কথা। নজরুলের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ রিক্তের বেদন গল্পগ্রন্থের গল্পগুলিতে লক্ষ্য করা যায় ভালোবাসার ত্যাগের কথা ও কোমল হৃদয়ের পাশাপাশি কঠিন দিকনির্দেশনার কথা।
উপন্যাসিকের আন্তরিকতায় উপন্যাসের পরিণতি আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। নজরুল যে ক‘টি উপন্যাস রচনা করেছেন, তার মধ্যে শিল্পাঙ্গিক ও জীবনবোধের সফলতায় মৃত্যুক্ষুধা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। মৃত্যু-ক্ষুধা উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরের চাঁদ সড়কের নিম্ন শ্রেনির দরিদ্র হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দারিদ্র ও দুঃখভরা জীবন নিয়ে উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের একদিকে মৃত্যু আর একদিকে ক্ষুধা। সেখান থেকেই উপন্যাসের নামকরণ মৃত্যুক্ষুধা। তারা অভাবের কারণে ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করে। আবার পরস্পরের দুঃখে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ায়। নজরুলের উপন্যাস-চিন্তার সর্বশেষ ভাষ্য ‘কুহেলিকা’। এ উপন্যাসে সে যুগের যুব-মানসের রক্তচাঞ্চল্য অনুভব করা যায়। উপন্যাসের রূপকর্ম সম্পর্কে বলা যায়, ‘কুহেলিকা’ সামায়িক উপন্যাসের গ্রোত্রভুক্ত হলেও কাহিনী পরিচর্যায় লেখকের মুনশিয়ানা রয়েছে। ভাষা এখানে যেমন ব্যঙ্গ, হাস্যরস ও প্রাণের স্পর্শে জেগে উঠেছে, তেমনি বর্ণনারীতিতেও একটা মিথ-কথনের প্রয়াস দেখি। কবিত্বময় ভাষা এখানে স্বাস্থ্য আর লাবণ্যে বেশ দ্যুতিময়। মাত্র তিনটি উপন্যাস রচনা করলেও নজরুলের উপন্যাস সমাজের, দেশের, মাটির ও মানুষের কাছাকাছি-বিশেষ করে মুত্যুক্ষুধা উপন্যাস। কাহিনী বৈচিত্র, ভাষা ও রচনাশৈলীতে নজরুলের উপন্যাসগুলি অসাধারণ। নিঃসন্দেহে নজরুল সমাজ-সচেতন, ইতিহাস-সচেতন, দেশপ্রেমিক দরদি ও কুশলী ঔপন্যাসিক।
নজরুলের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা’(সওগাত, কার্ত্তিক ১৩২৬)। পরের বছর নজরুলের তিনটি প্রবন্ধ ‘জননীদের প্রতি’, ‘পশুর খুঁটিনাটি বিশেষত্ব’ ও ‘জীবন বিজ্ঞান’ প্রকাশিত হয় মোসলেম ভারত প্রত্রিকায়। নজরুলের প্রথম প্রকাশিত মৌলিক প্রবন্ধ ‘উদ্বোধন’ (বকুল, আষাঢ় ১৩২৭) পরে এটি ‘জাগরনী’ নামে ‘যুগবাণী’ গ্রন্থে সংকলিত হয়। উদ্বোধন বা জাগরনী বকুল ফুল নিয়ে একটি আবেগপ্রবণ রচনা।
প্রাবন্ধিক নজরুলের বিকাশ ঘটে তিনি সাংবাদিক হওয়ার পর থেকে। সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ (১৯২০ খ্রি.), অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধুমকেতু’ (১৯২২ খ্রি.), সাপ্তাহিক ‘লাঙল’(১৯২৫-২৬ খ্রি.), সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’(১৯২৬ খ্রি.) ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নজরুলের প্রবন্ধ ও নিবন্ধগুলি। এসব রচনাগুলিতে আমরা দেখতে পাই সমকালীন দেশকাল, সামাজিক অসঙ্গতি, ধর্মীয় বাড়াবাড়ি ও আর্ন্তজাতিক বিশ্বের ঘটনাবলী নিয়ে বিশ্লেষণাত্বক প্রতিধ্বনি। রাষ্ট্রধর্ম ও স্বাধীনতা, শিক্ষাদর্শন, বিজ্ঞান বিষয়ক, চরিতাদর্শমূলক, সাহিত্য ও শিল্প ভাবনা বিষয়ক ইত্যাদি নিয়ে তার প্রতিটি রচনা পাঠকের মানস চেতনায় নবজাগরনের সৃষ্টি করেছে।
উপরোক্ত সুদীর্ঘ আলোচনার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে প্রকৃতপক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের মধ্যবর্তী বাংলার তারুণ্যেও প্রতিমূর্তি। নজরুলের মানস সংগঠনের প্রাথমিক পর্যায়সমূহ এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। এক দিকে অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলন কেন্দ্রিক হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি রক্ষার প্রচেষ্টা। অন্যদিকে রুশ বিপ্লব প্রভাবিত সাম্যবাদী চিন্তা-চেতনা নজরুল নামে এক বিশিষ্ট মানবতাবাদের জন্ম দিয়েছিল। ধ্বনিত হয়েছিল তাঁর কন্ঠে যুগবাণী। তাঁর সে বাণী তাঁর কবিতা ও গানের মতো তাঁর প্রবন্ধ কিংবা বক্তৃতা বিবৃতিতেও মূর্ত হয়ে ফুঁটে উঠেছিল-উন্মাতাল করে তুলেছিল সারা দেশের তরুনচিত্তকে।
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নজরুল-জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে নজরুলকে সপরিবারে ঢাকায় আনা হয়। ধানমন্ডির কবিভবনে বসবাসের জন্য তিনি অবস্থান করেন। এবং সেখানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড্ডীন করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে কবির প্রথম জন্মবার্ষিকী কবিকে নিয়ে উদযাপন করা হয়। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক কবিভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ১৯৭৪ সালে কবিকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডি.লিট. উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৪ সালেই কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটারবাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই কবিকে পি. জি. হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এবং ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত মোট এক বছর এক মাস আট দিন পিজি হাসপাতালের ১৯৭নং কেবিনে কবি নিঃসঙ্গ জীবন কাটান। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘একুশে পদক’ প্রচলন করা হয় এবং কবিকে এ পদক প্রদান করা হয়। ঐ বছর আগস্ট মাসে কবির স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। ২৭ আগস্ট শুক্রবার বিকেল থেকে কবির শরীরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তিনি ব্রঙ্কো-নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। ২৯ আগস্ট রবিবার সকালে কবির দেহের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে ১০৫ ডিগ্রি অতিক্রম করে যায়। কবিকে অক্সিজেন দেয়া হয় এবং সাক্শান-এর সাহায্যে কবির ফুসফুস হতে কফ ও কাশি বের করার চেষ্টা চলে। কিন্তু চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্তে¡ও কবির অবস্থার উন্নতি হয় না-সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেদিন সকাল ১০টা ১০মিনিটে কবি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বেতার এবং টেলিভিশনে কবির মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হলে পিজি হাসপাতালে শোকাহত মানুষের ঢল নামে। করিব মরদেহ প্রথমে পিজি হাসপাতালের গাড়ি বারান্দার ওপরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি-ও সামনে রাখা হয়। অবিরাম জনস্রোত কবির মরদেহে পুষ্প দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
কবির নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় বাদ আসর সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জানাজায় লক্ষ লক্ষ মানুষ শামিল হন। নামাজে জানাজা শেষে শোভাযাত্রা সহযোগে কবির জাতীয় পতাকা শোভিত মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয়। কবির মরদেহ বহন করেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম. এইচ. খান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ. জি. মাহমুদ, বি. ডি. আর. প্রধান মেজর জেনারেল দস্তগীর। নজরুল তাঁর একটি গানে লিখেছেন: মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই/যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই। কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।
কবির মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সালে কবি আবদুল কাদিরের সম্পাদনায় নজরুল-রচনাবলীর চতুর্থ খন্ড এবং ১৯৭৮ সালে পঞ্চম খন্ড প্রকাশিত হয়। আবদুল আজিজ আল-আমানের সম্পাদনায় ১৯৭৮ সালে ‘নজরুল-গীতি অখন্ড’ এবং ১৯৮৯ সালে ‘অপ্রকাশিত নজরুল’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯১ সালে ‘জাগো সুন্দর চির কিশোর’ শিারোনামের গ্রন্থ সংগ্রহ ও সম্পদনা করেন আসাদুল হক। ১৯৯৮ সালে কবিতা ও গানের গ্রন্থ সম্পাদনা করেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। ২০০১ সালের ফেব্রূয়ারি মাসে সেলিনা বাহার জামান এর সংগ্রহ সম্পাদনায় নজরুল সম্পাদিত পত্রিকার একত্রিত পুনর্মুদণ প্রকাশিত হয়। একই বছর মে মাসে মুহম্মদ নূরুল হুদাও নজরুল সম্পাদিত পত্রিকার পুনর্মুদণ সম্পাদনা করেন। ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা কাজী নজরুল ইসলাম রচনাবলী প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ খন্ড প্রকাশ করেন।
আমির হোসেন, কথাসাহিত্যিক
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks