গ
ল
প্রবাদপ্রতিম কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আবির্ভূত হন কল্লোল যুগে। উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনার ক্ষেত্রে তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর রচনা বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অজর অমর সাহিত্য সৃষ্টি তাকে আকাশচুম্বী খ্যাতি এনে দিয়েছে। তিনি সমসাময়িক লেখকদের থেকে স্বতন্ত্র। সাবলীল ভাষা শব্দ ব্যবহারে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তিনি জীবন ও সমাজ জীবনের অবক্ষয় তার সাহিত্যে অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করে নিরীক্ষার মাধ্যমে মনোজাগতিকতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সাহিত্য রচনায় ব্যাপৃত হয়েছেন।
আর কিছু অজানা কাহিনীর কথা বলব।
প্রথম গল্প ও নামের মাহাত্ম্য --চার ভাইবোনের পর জন্ম হল ঘুটঘুটে এক কালো ছেলের। অমন গায়ের রং দেখে আঁতুড় ঘরেই নাম দেওয়া হল কালোমানিক।
বামুনের ছেলে। রীতমতো গণক ডেকে জন্মঠিকুজি তৈরি করা হল। ঠিকুজিতে নাম রাখা হল অধরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই নামে কেউ কোনও দিনও ডাকল না।
এমনকী বাবা হরিহর সাধ করে ছেলের নাম রাখলেন প্রবোধকুমার। সেই নামও আড়ালেই থেকে গেল। ভালবেসে কালোমানিক বলেই ডাকত সকলে।
তারপর যা হয়, বয়স বাড়তে কালোমানিক থেকে কালো গেল খসে। পড়ে রইল শুধু মানিক। ওই নামেই জীবনের প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ ছাপা হয়েছিল। তখন গণিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। একদিন কলেজ ক্যান্টিনে বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল তর্ক। এক বন্ধুর লেখা গল্প কোনও একটি নাম করা পত্রিকা থেকে অমমোনীত হয়ে ফেরত এসেছে। সেই বন্ধু মহা খাপ্পা হয়ে বলল, বড় পত্রিকাগুলি নামী লেখকদের লেখা ছাড়া ছাপায় না। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলেন মানিক।— ‘‘এটা হতেই পারে না। তুমি ভুল বলছ। তোমার গল্প ভাল হয়নি বলেই তারা ছাপেনি। পছন্দ হলে নিশ্চয়ই ছাপত।’’ বন্ধু চ্যালেঞ্জ শুনলাম ছুড়লেন , ‘‘প্রমাণ করে দেখাতে পারবে?’’
‘বেশ, আমি আগামী তিন মাসের মধ্যে একটা গল্প লিখে কোনও নামী পত্রিকায় ছাপিয়ে দেখাব।’’তিন মাস নয়, তিনদিনের মধ্যে একটা গল্প লিখে ফেললেন। গল্পকারের নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখতে গিয়েও থমকালেন।
জীবনের প্রথম গল্প। সম্পাদকের পছন্দ হবেই সে বিষয়ে নিশ্চিত। কিন্তু বারো তেরো বছর বয়সের মধ্যেই বাংলার সেরা সাহিত্যগুলো যার পড়া হয়ে গেছে সেই মানিক কিন্তু বুঝেছিলেন ‘অতসী মামী’ আসলে ‘অবাস্তব রোম্যান্টিকতায় ভরা’। সেই সংকোচেই প্রবোধকুমারের বদলে লিখলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর সেই গল্প নিয়ে নিজেই সটান হাজির ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার দফতরে। সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ সেই সময় দফতরে ছিলেন না। তার জায়গায় বসেছিলেন আরেক দিকপাল সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। স্মৃতিকথায় অচিন্ত্যকুমার লিখছেন, ‘‘একদিন বিচিত্রার দফতরে কালোপানা একটি লম্বা ছেলে এল। বলল গল্প এনেছি। বললাম, দিয়ে যান। সেই ছেলে লম্বা হাত বাড়িয়ে গল্পের পাণ্ডুলিপি দিয়ে বলল, এই যে রাখুন। এমন ভাব যেন এখুনি ছাপতে দিয়ে দিলে ভাল হয়। চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস চুঁইয়ে পড়ছে। গল্প জমা দিয়ে সে চলে গেল। আমি তারপর এমনিই গল্পে একবার চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠলাম। এ যে রীতিমতো দুর্দান্ত গল্প!’’ সেই গল্প প্রকাশ তো পেলই, বাংলার পাঠকমহলেও হইহই পড়ে গেল। বিচিত্রার সম্পাদক খোঁজখবর নিয়ে ছুটে এলেন মানিকের সঙ্গে দেখা করতে। লেখার সাম্মানিক কুড়িটা টাকা হাতে দিয়ে অনুরোধ করলেন, ‘‘আপনি আবার গল্প দিন আমাদের।’’ ইচ্ছে ছিল ত্রিশ বছরের আগে কোনও দিন গল্প লিখবেন না, কিন্তু কুড়ি বছর বয়েসেই বাজি রেখে গল্প লিখে বিখ্যাত হয়ে সেদিন আবার গল্প লিখতে রাজি হতে হল, আর সেদিনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়তি।
দস্যিপনার নির্দশন- ছোট বয়স থেকেই সাংঘাতিক দস্যি। ফলে একের পর এক দুর্ঘটনা। হাঁটতে শিখেই বাড়ির আঁশবটিতে নিজের পেট কেটে প্রায় দুই ফালা করে ফেলেছিলেন। ডাক্তারবাবু সেলাই করলেন। সেই সেলাই নিয়েই পরদিন ওই হাসপাতালেই দাপাদাপি শুরু। দস্যিপনার সঙ্গে ছিল এক উদ্ভট স্বভাব। যতই চোট-ব্যথা লাগুক কিছুতেই কাঁদতেন না। কাঁদার পরিবর্তে বিচিত্র সুরে কালোয়াতি গান ধরতেন। ফলে বাড়ির বড়রাও কেউ বুঝতে পারতেন না, মানিক আবার কোনও বিপদ ঘটাল কি না।
সবার অলক্ষ্যে উনুন থেকে চিমটে দিয়ে জ্বলন্ত কয়লা তুলে খেলতে গিয়ে সেই কয়লা পড়ল পায়ের গোড়ালির পাশে। ব্যস, কালোয়াতি গান শুরু। কেউই বুঝতে পারে না আসলে কী হয়েছে।
তারপর মাংস পোড়ার গন্ধ পেয়ে সকলে ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে চোখের জলে গলা বুক ভেসে যাচ্ছে মানিকের, কিন্তু গলায় গান আর পায়ে গর্ত হয়ে গেঁথে যাওয়া গনগনে কয়লার টুকরো। সেই এক ইঞ্চি পোড়া দাগ আর জীবনে ওঠেনি।
নিখোঁজের পরিণাম- বাঁশি তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। মাঝেমাঝেই বাঁশি হাতে বেরিয়ে পড়েন একা। আদাড়েবাদাড়ে, নদীর ধারে ঘুরে বেড়ান। সঙ্গে গান আর বাঁশি। বাড়ি ফেরার হুঁশ থাকে না। ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান কিংবা নৌকোর মাঝিদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে আড্ডা। এক-এক দিন থেকেও যান তাঁদের সঙ্গে। তখন চোদ্দ কী পনেরো বছর বয়স হবে, হঠাৎই বাড়ি থেকে নিখোঁজ। কয়েক দিন পেরিয়ে গেল মানিকের খবর নেই। বাড়ির সকলে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। মা কেঁদেকেটে অস্থির। অনেক খোঁজের পর মানিককে পাওয়া গেল টাঙ্গাইলের নদীর ধারে য নোঙ্গর করা নৌকোয় মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে। দিব্যি রয়েছেন দুই বেলা তাদের সঙ্গে গল্প,গান খাওয়াদাওয়া করে । অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার বাড়ি ফেরানো হল। সেদিন কেই বা জানত মাঝির সঙ্গে, নদীর সঙ্গে ছেলেটির বিশেষ আত্মীয়তাই একদিন জন্ম দেবে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ নামের এক উপন্যাস!
১৯৩৩ সালে কলকাতায় এসেছিল এক বিখ্যাত পুতুল নাচের দল। সেই কার্নিভালের নাচ দেখে এমনই মুগ্ধ হলেন যে সেই পুতুলদের সঙ্গে মানুষের জীবনকে মিলিয়ে লিখতে শুরু করলেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’।
সেই উপন্যাস লিখতে বসে নিজের কথাই যেন ভুলে গেলেন মানিক। অনেক পরে এক চিঠিতে লিখেওছেন সেই কথা। যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘অপ্রকাশিত মানিক’ বইয়ের ২৪ নম্বর চিঠিতে দেখতে পাই মানিক লিখছেন, ‘‘প্রথমদিকে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রভৃতি কয়েকটা বই লিখতে মেতে গিয়ে যখন আমি নিজেও ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার একটা শরীর আছে এবং আমার পরিবারের মানুষরাও নিষ্ঠুরভাবে উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন। তখন একদিন হঠাৎ আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। একমাস থেকে দু’তিনমাস অন্তর এটা ঘটতে থাকে। তখন আমার বয়স ২৮/২৯, ৪/৫ বছরের প্রাণান্তকর সাহিত্যসাধনা হয়ে গেছে।’’
আরো কিছুদিন পৃথিবীর বুকে থাকলে থাকলে নতুন সৃষ্টিকর্ম এবং অজানার কাহিনী স্পর্শ পেতাম।
তথ্যঋণ
১). অঞ্জন আচার্যর প্রকাশিতব্য গ্রন্থ- আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়,
২). কিশোর রচনা সমগ্র,মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়- (সম্পা- সৈয়দ আজিজুল হক),
৩). মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মশতবর্ষ সংখ্যা-উত্তরাধিকার,
৪).সাহিত্য করার আগে-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়,
৫). দিবারাত্রির মানিক-বিনোদ ঘোষাল
৬). মানিক চিন্তা- কোরক,
৭).মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যা-আলোর পাখি, শঙ্খ ঘোষ, মুহিত হাসান,
৮). কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র
৯). মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য কীর্তি-সাগর জামান
১০).মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাজ জিজ্ঞাসা – নিতাই বসু
১১). বাংলাদেশে মানিক চিন্তা- বৈশাখী
বাঁশদ্রোণী কলকাতা
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন