মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী এর গুচ্ছকবিতা ।। সমসাময়িক কবিতা।। কুয়াশা

মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী এর গুচ্ছকবিতা ।। সমসাময়িক কবিতা।। কুয়াশা











মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী এর গুচ্ছকবিতা

কাচঘেরা যুদ্ধের অন্তরীক্ষ


কাশ্মীর এক কাচঘেরা টপোগ্রাফি—
ঘুমের কোলাজে আঙুল হয়ে ওঠে সীমান্ত।
বারুদের গন্ধে মৌমাছিরা শরণার্থী,
ঝিঁঝি ডাক নয়, বেহালার ছিন্ন তারের বিলাপ।
একটা পায়রা, ঠোঁটে জ্যোৎস্না, ডানায় ছাই,
প্রতিদিন উড়ে আসে—পোস্ট-ট্রুথ ভালোবাসায়।
চোখ এখন রাষ্ট্রীয় ক্যামেরা,
আর বুক? এক নিরবতাস্নাত প্রতিবাদের হোলোগ্রাম।




সংবাদ ফেরিওয়ালার জলছাপ


আমি এক গ্রামীণ সংবাদকর্মী—
হাওরের হাহাকারে জন্ম নেওয়া হিজল গাছের ছায়া,
ধানগাছের কান্না গায়ে মেখে ঘুরে বেড়াই খবরের পিছুপিছু,
পারিশ্রমিকহীন, বেহিসাবি আমি—
বুকের ভিতরে কেবল সঞ্চয় করি জলের আলিফ-লা-মীম।

মসজিদের মাইকে ওঠে গজল—
আর আমার গলায় আটকে থাকে ভিজে কাগজের পঙক্তি।
মোবাইলে ছবি তুলি—
প্রতিটি ক্লিকে হারিয়ে যায় একটি করে চাওয়া,
ডুবে যায় হেলাল, রুবেল, হাশেম ভাইয়ের জীবনের ডায়েরি।

বানভাসি মানুষের চোখে আঁকি দোয়েলহীন আকাশ,
ত্রাণের নামে প্রলেপ দেয়া কাঁচা ওয়াদার সংবাদ
তুলে দিই ই-মেইলের ঠাণ্ডা খামে—
যেন জলের ওপরে কোরআন তিলাওয়াতের রেকর্ডিং
ভেসে বেড়ায় কাকভোরের বাতাসে।

কাগজওয়ালারা আমার ক্যামেরা চায়—
কিন্তু কখনও জানতে চায় না
আমার মায়ের হাঁটু জলে পচে যাচ্ছে কিনা।
“ভাইজান, নিজে কেমন আছেন?”—
এই লাইনটি কোনো প্রেস-রিলিজে আসে না।

২০২২-এর বানে আমি ত্রাণের খবর লিখেছি—
নামহীন শিশুদের খালি পেটে ঢেউয়ের ব্যাকরণ অনুবাদ করেছি,
তবু আমার সন্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল না একমুঠো মুড়ি,
সে আজও চেয়ে থাকে মাদ্রাসার বারান্দায়,
যেন শুকিয়ে যাওয়া ছাতার নিচে হেলালের গুমরে ওঠা দীর্ঘশ্বাস।

আমার কলম থেমে যায়নি—
আমি লিখেছি বানভাসি কিশোরীর চুলের ভাঁজে লুকানো নদীর মানচিত্র,
যেখানে আজানের ধ্বনি আর জলের গর্জন
মিলে যায় এক অজানা তাওবার ঘূর্ণিপাকে।

প্রতিটি সংবাদ আমার বুকে খোদাই করা দাগ—
তবু আমার দাফনের খবর কেউ ছাপে না।
আমি সেই নামহীন শিরোনাম,
যে কেবল জল ছুঁয়ে চলে যায়
কোনো প্রেস-কার্ড না রেখে,
কোনো স্মারক না রেখে...।


মানুষ, তারও ওপরে


এই মুহূর্তে সীমান্তের ওপারে গোলাবর্ষণ চলছে, 
প্রতিদিনের মতোই— স্বরবর্ণ ছিন্ন করে আকাশের 
বুক চিরে ছুটে আসে যুদ্ধবিমানের গর্জন। 
সংবাদপত্র লেখে: "Retaliation is necessary", 
একটি রাষ্ট্র বলছে—“সার্জিক্যাল”, অন্যটি বলছে—“প্রতিরক্ষা”। 
তবে হাশিমপুরের যে শিশুটি আজ তার বাবাকে 
খুঁজে ফিরছে, তার কাছে কোনো রাষ্ট্রই উত্তর নয়।
পাকিস্তানের বালাকোটে আজ একটি স্কুলঘরে কেবল শবদেহ, 
আর ভারতের কুপওয়ারায় একটি মা ঘুম
পাড়ায় মৃত সন্তানের নাম জপে। এই কি ধর্ম? 
এই কি কাঁটাতারের দর্প? আমরা কি এখনো বুঝিনি— ধর্ম নয়, 
জাতীয়তা নয়— মানুষের রক্তের রং সর্বত্র লালই? 
যেখানে মিনারে আজান থেমে যায় আতঙ্কে, 
আর মন্দিরে ঘণ্টাধ্বনি ঢেকে যায় গোলার শব্দে— 
সেখানে কেউ কি বলতে পারে— সত্যের দখল কার? 
পলিটিক্যাল টক শো-র অতিথিরা বলছেন, “প্রয়োজনে 
আরও অভিযান চালাতে হবে।” তারা বোঝেন না— 
ড্রোনের ক্যামেরায় ধরা পড়া আগুন একটি ছিন্ন 
হৃদয়ের ছবি বহন করে। আমরা বলতে এসেছি— 
এই কবিতা কোনো নিরপেক্ষতা নয়, এ এক সক্রিয় পক্ষগ্রহণ— 
মানবতার পক্ষে। শান্তি এখন এক রাজনৈতিক লুজার শব্দ নয়— 
এখন, এই সময়েই, এই কবিতা চাই রেজিস্ট্যান্স 
হোক পতাকার ওপরে মানুষের মুখ চেনার ডাক। 
আমি বলি— রাষ্ট্রেরা নিজেদের Update করুক, 
কিন্তু মানুষ হোক Version-less— একটি নামহীন মুখ,
যার চোখে কেবল ভালোবাসা, স্মৃতি, প্রতিবাদ— 
আর একটি জিজ্ঞাসা: "এই শিশুটিকে কেন মারলে?" 
আমরা চাই, কেউ আর না বলুক— “পূর্বপুরুষেরা 
যুদ্ধ করেছিল”— বরং বলুক— “তারা ভালোবেসেছিল,
প্রতিরোধ করেছিল শুধু মানুষ হয়ে।”

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন