কবিতার অর্থহীনতা ও নান্দনিক মূল্য ড. আলী রেজা।। article by d. ali reza--kuasha

 প্রবন্ধ


কবিতার অর্থহীনতা ও নান্দনিক মূল্য
ড. আলী রেজা


সাহিত্যের নান্দনিক মূল্য অনেক এবং এই নান্দনিকতা প্রধানত প্রতিফলিত হয় কবিতার মাধ্যমে। সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমের নান্দনিক মূল্য থাকলেও সেখানে সমাজচিত্র, সময়বাস্তবতা ও ব্যক্তিসংকট প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। গল্প, উপন্যাস, নাটক কিংবা প্রবন্ধে যেখানে সহজ ও স্বাভাবিক ভাষাশৈলীর মাধ্যমে বিষয়বস্তুকে বর্ণনা করা হয় কবিতায় সেখানে উপমা বা রূপকার্থ ব্যবহার করে ভাষায় বিশেষ ব্যঞ্জনা তৈরি করা হয়। কবিতা যেহেতু ছন্দবদ্ধ কথামালা, তাই সেখানে ভাষার লালিত্য ও ভাবের তীব্রতা থাকে ও ব্যক্তির মনে এক বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ব্যক্তির মনে এই বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করার শক্তি আছে একমাত্র কবিতায়। তাই শিশুরা যেমন কবিতা পরে আনন্দ পায় তেমনি বড়রা এমনকি প্রবীণেরাও কবিতা পড়ে আলোড়িত হন।
গদ্যের ক্ষেত্রে আক্ষরিক ব্যাখ্যাই প্রধান। গদ্যের রূপকার্থ অতটা রহস্যঘেরা নয়। গদ্যের ব্যাখ্যা একমাত্রিক। কিন্তু কবিতার ব্যাখ্যা নানামাত্রিক। কবি যে অর্থে কবিতা লিখেন, পাঠক সে অর্থে কবিতাকে গ্রহণ নাও করতে পারেন। পাঠক অনেক সময় কবিতাকে নিজের মতো করে বুঝে নেন। সমালোচক বা ব্যাখ্যাকারগণও একেক জন একেকভাবে কবিতাকে বিশ্লেষণ করেন। এই নানামাত্রিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই কবিতার সৌন্দর্য। বলা যায়, নানামাত্রিক কবিতাগুলোই শ্রেষ্ঠ কবিতা। কবিতা নানামাত্রিক হওয়ার একটি প্রধান কারণ হলো উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও রূপকার্থের ব্যবহার। গদ্যে রূপকার্থের ব্যবহার কম এবং গদ্যের রূপকার্থ অতটা রহস্যঘেরা নয়। কিন্তু কবিতার রূপকার্থই প্রধান। এই রূপকার্থই কবিতাকে অস্পষ্ট ও রহস্যময় করে তোলে। রূপকার্থের কারণে কবিতা অনেক সময়ে বস্তুগতভাবে অর্থহীন মনে হতে পারে। কিন্তু এই অর্থহীনতাই কবিতার প্রাণ। এই অর্থহীনতাই কবিতাকে নান্দনিক করে তোলো। কবিতাকে সৌন্দর্যম-িত করে তোলার জন্য এ ধরনের অর্থহীনতা কখনো কখনো অপরিহার্য হয়ে ওঠে। 

কবিতাকে আক্ষরিক অর্থে খুব কম ক্ষেত্রেই ব্যাখ্যা করা যায়। রূপকার্থ বিশ্লেষণ করেই কবিতার মর্ম উপলব্ধি করতে হয়। তবে কবিতার রূপকার্থের ব্যাখ্যা অতটা সহজ নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কবিতা রহস্যঘেরা। কবিতার গীতিময়তা আছে। সুরারোপ করলে কবিতাগুলো গান হয়ে উঠতে পারে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদগুলো চর্যাগীতিকা হিসেবেও বিবেচিত। গান বা কবিতা যাই বলি না কেন- ব্যক্তিমনে বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করতে হলে ভাব, ভাষা, বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলীকে হতে হয় অস্পষ্ট। কবিতার পাঠক সরাসরি কবিতাকে বুঝে নিবেন না। কবিতা পড়ে প্রথমত পাঠকের মনে ভাবের উদয় হবে। তারপর বিষয়বস্তু অনুসন্ধান করে কবিতার বস্তুগত দিক নির্ণয় করবেন পাঠক। এক্ষেত্রে কবিতার ব্যাখ্যা নানামাত্রিক হতে পারে। একই কবিতা নানাজনে নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। এই বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা যে কবিতায় থাকবে সেই কবিতাই পাঠকের মনে ভাবের উদ্রেক করতে পারবে। তাই অনেকার্থক কবিতাগুলোই সবচেয়ে বেশি নান্দনিক মূল্য বহন করে। আর অনেকার্থক কবিতাগুলো প্রত্যক্ষভাবে অর্থহীন মনে হতে পারে।


 

কবিতায় সরাসরিভাবে বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের প্রকাশ ঘটতে পারে। বক্তব্যধর্মী বা শ্লোগানধর্মী এসব কবিতা বিশেষ সময়ের চাহিদার প্রেক্ষিতে রচিত হয় এবং এসব কবিতার শক্তি পাঠককে উজ্জীবিত করে, আলোড়িত করে। এ ধরণের কবিতায় ভাষার তীব্রতা ও বিষয়বস্তুর বাস্তবতা প্রধান বিষয় হয়। ফলে কবিতার নান্দনিক দিকটি গৌণ হয়ে যায়। কবিতার নান্দনিক মূল্য নির্ভর করে কবিতার বিষয়বস্তুকে উপমা-উৎপ্রেক্ষার মাধ্যমে প্রকাশ করার ওপর। উপমা মানেই রূপকার্থ। রূপকার্থের এই ব্যবহারের ফলে কবিতা অর্থহীন মনে হয়। আর এই অর্থহীন কবিতাগুলোই হয়ে ওঠে নান্দনিক। ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা/ চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’ (লোকছড়া)- আক্ষরিক অর্থ প্রয়োগ করলে এই কবিতাংশটি অর্থহীন বলেই বিবেচিত হবে। কিন্তু এই অর্থহীনতাই কবিতাংশটিকে নান্দনিক করে তুলেছে। নান্দনিক কবিতাগুলো প্রথম পাঠে পাঠকের কাছে অর্থহীন মনে হতে পারে। কিন্তু এই অর্থহীনতা থেকেই পাঠক অনুসন্ধান করে কবিতার মর্মার্থ।
‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ (আব্দুল হাকিম)- এই কবিতাংশটির বক্তব্য সরাসরি বা উপমাবর্জিত। তাই পাঠক এখানে আলোড়িত হয়, উজ্জীবিত হয়। কিন্তু কবিতার যে দিকটি পাঠকের মনে সুখানুভূতির সৃষ্টি করে, যে দিকটি পাঠককে সাহিত্যের রসাস্বাদনের সুযোগ করে দেয়, উল্লিখিত কবিতাংশে তা অনুপস্থিত। তাই কবিতা যত সরাসরি হবে কবিতার নান্দনিক মূল্য তত কমে যাবে। কবি যখন বলেন, ‘কবিতা তোমায় দিলেম আজিকে ছুটি/ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/ পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ (সুকান্ত ভট্টাচার্য)- তখন কবি যে রূপকার্থের আশ্রয় নেন তাতে কবিতার নান্দনিক মূল্য বেড়ে যায়। প্রকৃত বিষয়বস্তুর বিচারে কবিতাংশটি নিরেট বাস্তবতাকে তুলে ধরলেও উপমা ব্যবহারের মাধ্যমে কবি তাঁর কবিতাকে নান্দনিক করে তুলেছেন। তাই পাঠক এখানে শুধু ক্ষুধার বাস্তবতা উপলব্ধি করেন না, একই সাথে সাহিত্যের সৌন্দর্যও উপভোগ করেন। বক্তব্য সরাসরি নয় বলে এখানে পাঠককে উপমা বিশ্লেষণ করে মর্মার্থ উদ্ধার করতে হয়।    
পরোক্ষভাবে বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কবিতায় যে বিশেষ ধরনের নির্মাণ ও ভাষাশৈলী ব্যবহার করা হয়, যে রূপক ভাষার ব্যবহার করতে হয় তা আক্ষরিক অর্থে বিশ্লেষণ করতে গেলে কবিতা অর্থহীন বলেই প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু কবিতার এই অর্থহীনতার আরবণ কবিতার নান্দনিক মূল্যকে বাড়িয়ে দেয়। কবিতার বক্তব্য যত আবরণযুক্ত হবে, যত রহস্যঘেরা থাকবে, যত পরোক্ষ বা বিমূর্ত হবে কবিতার নান্দনিকতা বা সাহিত্যিক সৌন্দর্য তত বেশি প্রকটিত হবে। কবিতায় যখন বলা হয়, ‘স্বাধীনতা তুমি/ রবী ঠাকুরের অজড় কবিতা, অবিনাশী গান’ কিংবা ‘স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন’ (শামসুর রাহমান)- তখন আক্ষরিক অর্থে কবিতাংশটি স্বাধীনতার কোন অর্থ বা সংজ্ঞা বহন করে না। বাস্তবে স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই বলা হয় না। তাই আক্ষরিক অর্থে কবিতাংশটি অর্থহীন। কিন্তু উপমা বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার যে স্বরূপ পাঠকের সামনে ভেসে ওঠে তার নন্দনতাত্ত্বিক মূল্য অনেক। তাই কবিতার নান্দনিক মূল্য বাড়াতে হলে তাকে প্রত্যক্ষভাবে অর্থহীন বলে প্রতিপন্ন হওয়া ভাল।
‘ভাত দে হারামজাদা/ তা না হলে মানচিত্র খাব’ (রফিক আজাদ)- বহুলপঠিত ও দ্রোহচেতনায় সমৃদ্ধ এই কবিতাংশ ব্যক্তিমনে যে আলোড়ন সৃষ্টি করে তা কিন্তু অর্থহীন শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের কারণেই। বাস্তবে মানচিত্র কোন খাদ্য পদবাচ্য নয়। তাই সেটা খাওয়ার কথা একটি অর্থহীন বক্তব্য। অথচ এই অর্থহীন বক্তব্যটুকু থাকার কারণেই কবিতাংশটি দ্রোহ প্রকাশের পাশাপাশি নান্দনিকতাও প্রকাশ করেছে। অর্থহীন শব্দগুচ্ছ কিংবা রূপকার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে এভাবেই কবিতা সুন্দর হয়ে ওঠে। পাঠক কবিতার রসাস্বাদন করে পরিতৃপ্ত হয়। এ কারণেই ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটরের বনলতা সেন’ (জীবনানন্দ দাশ)- কবিতাংশটি আমরা মুখে মুখে বলি। বনলতা সেনের চোখ পাখির বাসা নামক একটি জড় বস্তুর মতো। আক্ষরিক অর্থে এটা কোন আকর্ষণীয় বিষয় নয় বা এটা হওয়াও সম্ভব নয়। কিন্তু এই অর্থহীন শব্দগুচ্ছ প্রয়োগ করে জীবনানন্দ দাশ কবিতাকে নান্দনিক করে তুললেন। আমরা বনলতা সেনের চোখের সৌন্দর্য যুগ যুগ ধরে কবিতার পাঠকগণ উপভোগ করে আসছেন। অথচ ঐ অর্থহীন অংশটুকু না থাকলে আমরা সেখানে কোন সৌন্দর্য খুঁজে পেতাম না।
কবিতায় চাঁদকে রূপকার্থে ব্যবহার করা হয়। শুধু চাঁদ কেন- সৌন্দর্যপ্রসবিনী সকল কিছুকেই কবিতায় ব্যবহার করা হয়। এতে কবিতার শরীরেও সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। কবিতাকে নান্দনিক করে গড়ে তোলার জন্য কত অর্থহীন শব্দই যে ব্যবহার করতে হয় তার হিসেব নেই। কখনো কখনো এই অর্থহীন শব্দগুলোই কবিতার শরীর নির্মাণের প্রধান উপাদান হয়ে ওঠে। ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেব খোপায় তারার ফুল/ কর্ণে দোলাবো তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল (কাজী নজরুল ইসলাম)।’ বাস্তবে চাঁদ বা তারা কোনটাই খোপার ফুল কিংবা কানের দুল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। আক্ষরিক অর্থে বিচার করলে উক্তিটি অর্থহীন। এই অর্থহীন কথাটি কী দারুণ ভালবাসায় মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত বা গীত হচ্ছে। এই অর্থহীনতাকে পরিহার করে কবি যদি অর্থপূর্ণ কোন শব্দগুচ্ছ দিয়ে তাঁর কবিতা বা গান রচনা করতেন, প্রকৃতপক্ষে খোপায় বা কানে যা পরা হয় সেগুলো থেকেই যদি বেছে নিতেন তাঁর শব্দমালা তাহলে তা অর্থপূর্ণ হলেও অতটা সৌন্দর্য ছড়াতো না। অর্থহীন সৌন্দর্যপ্রসবিনী শব্দগুচ্ছই মানুষের মনোজগতে বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করে। ‘ভাত দিবার পারস না ভাতার হবার চাস/ কেমন জোয়ান মরদ তুই হারামজাদা/ নিত্যি রাইতে গতরে গরত ঠেকাস (কাজী রোজী)’ কবিতাংশটি অভাবগ্রস্ত পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর যৌনবিলাসকে কটাক্ষ করা হয়েছে। এখানে কোন পাঠক কর্মক্ষম দরিদ্র স্বামীর প্রতি দ্রোহী মনোভাব পোষণ করতে পারেন। কেউ বা স্ত্রীর ক্ষুধার জ¦ালা অনুভব করে তার প্রতি দরদী হয়ে উঠতে পারেন। কোন পাঠক আবার অভাব ও যৌনতাকে পাশাপাশি রেখে উভয়ের তীব্রতার স্বরূপ সন্ধান করতে পারেন। কবিতাটিতে কাজী রোজী যে চাবুকটি ব্যবহার করেছেন তা পাঠককে ভাবায়, আলোড়িত করে। এখানে পাঠক যতটা বাস্তবতার গন্ধ খোঁজেন ততটা সৌন্দর্য খোঁজেন না। তাই কবিতাটি যতটা পাঠকপ্রিয় ততটা নান্দনিক নয়। এর কারণ কবিতাটির ভাষা সরাসরি এবং বস্তুগত বা আক্ষরিকভাবেই অর্থপূর্ণ।
তাই অর্থহীন বা আলঙ্কারিক শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের ফলে কবিতার শিল্পমান বা নান্দনিক মূল্য বেড়ে যায়। অর্থহীন শব্দগুলো কবিতার শরীরে অলঙ্কার ও প্রসাধনী হিসেবে কাজ করে। অর্থপূর্ণ শব্দগুচ্ছ প্রধানত কবিতার বস্তুগত দিকটিকে সমৃদ্ধ করে। আর অর্থহীন বা রূপকার্থক শব্দগুচ্ছ প্রধানত কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক দিকটিকে সমৃদ্ধ করে। কবিতার ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তু ভিন্ন ভিন্ন হবে পারে। কবিতার নির্মাণশৈলীও সব সময় অভিন্ন হয় না। এই ভিন্নতার মাঝে পাঠক কখনো খুঁজে বেড়ায় কবিতার বস্তুগত সত্যতা। আবার কখনো খুঁজে বেড়ায় শৈল্পিক সৌন্দর্য বা নান্দনিকতা। আর এই নান্দনিকতা খুঁজে পাওয়া যায় অর্থহীন শব্দগুচ্ছ বা রূপকার্থের ভেতর। প্রকৃতপক্ষে কবিতা অর্থহীন নয়। কবিতার অর্থ অনুসন্ধান করতে হয় রূপকার্থকে বিশ্লেষণ করে। আর রূপকার্থের যুতসই ব্যবহারের মাধ্যমে একটি কবিতা যতটা নান্দনিক হয়ে ওঠে অন্য কোন উপায়ে কবিতাকে অতটা নান্দনিক করে উপস্থাপন করা যায় না। 

ড. আলী রেজা
প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যচিন্তক




with thanks & regards____

image

দ্বীপ সরকার

editor of kuasha

+88001719751792

kuasha.mag@gamil.com

https://mkuasha.blogspot.com/

facebook

twitter

linkedin


Post a Comment

Thanks

নবীনতর পূর্বতন