গল্পঃ গুহা ।। আফরোজা হীরা

গুহা


কমলা হিসাব করে বের করার চেষ্টা করে, কয় মাস হল? চৈত্র মাসে মিলিটারি আসল দেশে, আর এখন শ্রাবণ মাস। তাহলে কত হল- পাঁচ না ছয়?  বৈশাখের প্রথম দিকে অঞ্জলির বাবা একদিন সন্ধ্যায় বিল থেকে বড় একজোড়া বোয়াল মাছ ধরে এনে কমলার হাতে দিয়ে বলেছিল ভাল করে রান্না কর, শুনে আসলাম দেশে খান সেনারা আইছে সামনে যারে পাচ্ছে তারেই গুলি করে মারতিছে, কয়দিন বাঁচব তার তো আর এখন কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। সেদিনই প্রথম মাছ কাটতে গিয়ে কমলা টের পেলো দেশে শুধু খান সেনারা নয়, তার ভিতরেও নতুন কেউ প্রবেশ করেছে। তাদের ঘর আলো করে আসছে তাদের চতুর্থ সন্তান। ঘটনা নতুন নয় তাই বলি বলি করেও আর বলা হলনা, অনেকটা সময় পার করে উমেশের বুকে মাথা রেখে যে রাতে কমলা জানাল সে আবার মা হতে চলেছে, উমেশ ঘুমের ঘোরে বলল হু, তারপর আর কোনো শব্দ করলনা। কমলাও এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল, তারপর মধ্যরাতে সে কী পটকা ফোটানোর মত বিকট আওয়াজ! যেন কানে তালা লেগে যাবার উপক্রম। মধ্যরাতে এমন আওয়াজ বড়দিনে রাত বারটার সময় শুনেছে কমলা, কিন্তু এখন তো ডিসেম্বর মাস ন। তাহলে এ কিসের আয়োজন? তার নবজাত সন্তানের জন্য স্বাগতম বাণী! এ কী কোনো দেব’শিশু! কমলা ডান হাতটা রাখে পাশের বালিশে, না কেউ নেই সেখানে উমেশের বালিশ টা খালি। শব্দ শুনে সে আরো আগে উঠে বাহিরে গেছে, এবার কমলা বাঁ হাত দিয়ে হাতড়ে বাচ্চাগুলোকে খোঁজে। ভয়ে সবগুলো একসাথে গুটিসুটি মেরে আছে। কমলা এবার অন্ধকারে ডাকে ও অঞ্জলির বাবা কোই তুমি?  
উমেশ বলে- বাইরে আয়, দেখ কী কান্ড।
কমলা শাড়িটাকে কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে ছুটে আসে বাহিরে, আকাশে একাদশির চাঁদ, কিন্তু সেই চাঁদের আলোকে ম্লান করে দিয়ে আগুন কুন্ডুলী পাকিয়ে উপর দিকে উঠে আকাশটাকে সিঁদুরের মত লাল করে ফেলেছে। একটা নয় দুটো নয় বহু আগুনের কুন্ডুলী। বড়দিনে জাহাজ থেকে আতশবাজি আকাশের দিকে উঠতে দেখেছে সে কিন্তু এমন কুন্ডুলি পাকিয়ে ধোঁয়া আর মধ্যরাতে সিঁদুর রাঙ্গা আকাশ আজ প্রথম দেখল কমলা। সে আস্তে আস্তে উমেশের হাতটা চেপে ধরে। কী জ্বলে এমন করে অঞ্জলির বাপ? অবাক বিস্ময়ে প্রশ্নটা করে কমলা।
উমেশ- সকাল না হলি তো কওয়া যাবে না, যা ঘরে যা।
কমলা উমেশের ডান হাতটা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, সারারাত দুজনের কেউ সেখান থেকে নড়তে পারেনা। তাদের সাথে একে একে এসে যোগ দেয় অঞ্জলী, কাজলী, মহেশ আর বৃদ্ধ বাবা মা ও। কিছুক্ষন পরপর শুধু ভেসে আসে কানে তালা লাগানো গুলির শব্দ।
পরদিন সকালে উমেশ খবর আনে মিলিটারি প্রবেশ করেছে বন্দরে। বেশ কয়েকটা জাহাজ জ্বালিয়ে দিয়েছে। গুদামঘর, দোকানপাট সব এক রাতে পুড়ে ছারখার। বহু মানুষ মেরে ফেলেছে রাতে, যেখানে যাকে সামনে পেয়েছে গুলি করে মেরেছে।
বৃদ্ধ বাপের দিকে চেয়ে উমেশ বলে- ও বাবা এখন কী করব? কোই যাবা? ছেলেপেলে নিয়ে তো আর এই যায়গায় থাকা যাবেনা। যেকোনো সময়ে মিলিটারি আইসে সামনে পালি গুলি কইরে মারবে।
সমরেশ সরকার বলেছিলেন- এই শেষ বয়সে বাড়ি ঘর থুয়ে কনে যাব? তোরা যেদিক যাবি যা, আমি মরলি আমার বাড়ি বইসেই মরব। সেই কথা শুনে প্রমিলা বালাও বলেছিলেন আমিও কোনো যায়গায় যাচ্ছি না। বাঁচি মরি এক সাথে বাঁচব এক সাথে মরব।
পরে বাধ্য হয়েই সবাই মিলে এক বুদ্ধি বের করল, বাড়ির পিছন দিকে বাঁশ ঝাড়ের পিছনে একটা বড় গর্ত খুঁড়ে তার উপরে কাঠের পাটাতন আর খড় কুটো দিয়ে একটা গুহা তৈরি করা হবে। সেখানে সবাই লুকিয়ে থাকবে।
যেই কথা সেই কাজ। সবাই মিলে এক বেলার মধ্যে বেশ বড় একটা গর্ত তৈরি করে ফেলল, তার নিচে কিছু কাঠ দিয়ে পাটাতন আর গর্তের উপরে কিছু তক্তা দিয়ে পাটাতন তৈরি করে তার উপরে পলিথিন বিছিয়ে পলিথিনের উপরে খড়ের মাচা তৈরি করা হল। আসা যাওয়ার জন্য রাখা হল ছোট্ট একটু ফাঁক। সেখানেই শুরু হল উমেশ কমলার নতুন সংসার। শ্রাবণ মাস সারাদিন বৃষ্টি থাকে সেই বৃষ্টির পনি ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। তাই বাধ্য হয়ে সেটাও বন্ধ করে রাখতে হয়, ভূতুড়ে অন্ধকারে রাত দিন এক সাথে সাতটা প্রাণী আজ চারদিন যাবত আটকে আছে। এরই মধ্যে একদিন মিলিটারি তাদের বাড়ি এসে ঘুরে গেছে, গুলি করে তালা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে সারা ঘর তছনছ করে রেখে গেছে।  কিছুক্ষণ পর পর বাড়ির সামনের রাস্তাটা ধরে দৌড়ে দৌড়ে এক দল মিলিটারি পার হয়ে যায়। তখন বুটের শব্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে বাচ্চাগুলো, বুড়ো শ্বশুর শাশুড়ি আর কমলা। হায়েনাগুলো কখন যে কার বাড়ি ঢুকে পড়বে কেউ জানেনা। এই চারদিনে একবারও চুলায় আগুন জ্বলেনি রান্নাবাড়া কিছু হয়নি, ঘরে মজুদ চিড়া মুড়ি আর গুড় খেয়ে দিন কেটেছে। কিন্তু এভাবে আর কত? কমলা আঙ্গুল গুনে বের করে পাঁচ মাস প্রায় শেষ আর দুইদিন পার হলে এই ভাদ্র মাস আসলেই ছয় মাসে পড়বে। এরই মধ্যে পেটের ভিতর বাচ্চাটা বেশ নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছে। কমলার পায়ে পানি এসে ফুলে গেছে। বাইরে গিয়ে একটু হাঁটাচলা না করলে এভাবে বাঁচা দায়।
শাশুড়ি প্রমিলা বললেন- আর এট্টু ধৈর্য্য ধরো সন্ধ্যার পর অন্ধকার নামলি তখন বাইরে যাইয়ে একটু হাটা চলা কইরো।
এই কয়দিন সবাই তাই করেছে, সারাদিন গুহার ভিতর আর সন্ধ্যার পর যাবতীয় কাজ কর্ম সারা। তবে এখন থেকে রাতেও অতি সাবধানে বের হতে হবে। কারন কাল সন্ধ্যার পর রাস্তায় স্বপ্না সকিনা সহ আরো অনেকের কান্নার আওয়াজ শোনা গেছে। মনে হচ্ছিল কেউ তাদের টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েগুলোর সে কী গগণবিদাড়ি চিৎকার! ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। কমলা সন্ধ্যার পর উমেশের হাতটা ধরে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে, একদম টানটান হয়ে দাঁড়ায়, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। আহা! কী শান্তি! গর্তের ভিতর ক্ষুধা তৃষ্ণায় যতটা না কষ্ট পেয়েছে তার থেকে অধিক কষ্ট হয়েছে তার শ্বাস প্রশ্বাসে, চারিদিকে কেমন যেন একটা গুমোট ভাব আর উটকো গন্ধ।
উমেশ চেয়ে দেখে- ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলো পড়েছে কমলার শরীরে, পাঁচ মাসের পোয়াতি কমলা, আজ চারদিন নাওয়া খাওয়া নেই, চুলে তেল চিরুনি নেই, তবু যেন আজ হঠাত করে তার রুপ ঠিকরে ঠিকরে বের হচ্ছে। এভাবে অনেক দিন দেখা হয়না বৌটাকে, উমেশ যেন আজ নতুন করে মুগ্ধ হয় কমলাকে দেখে, যেমনটা হয়েছিল প্রথম দেখায়। দুধে আলতা গায়ের রং তিন তিনটে বাচ্চা হওয়ার পরও একটুও মলিন হয়নি তার। হঠাত চাঁদের আলোটা দিনের আলোর মত উজ্বল হয়ে উঠল আর কমলা ঝলমল করে উঠল। কমলা কিছু বুঝে ওঠার আগেই উমেশ তার একটা হাত ধরে হ্যাচকা টানে মাটিতে শুয়ে পড়তে বললো। ততোক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে, একজন টর্চ লাইট তাক করে কমলার দিকে ধরে রেখে বললো- ডোন্ট মুভ। আর খাকি পোশাক পড়া আট দশজন লোক বন্দুক উঁচু করে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। উমেশ হাত দুটো উপরে তুলে সামনে এগিয়ে এল, সাথে কমলাও। উদ্দেশ্য হল গর্তের মুখটা কেউ যেন দেখতে না পায়। কারন ঐ গর্তের ভিতরে রয়েছে তাদের বৃদ্ধ বাবা মা আর ছোট ছোট তিনটা বাচ্চা। গর্তের মুখটা ভিতর থেকেই বন্ধ করা যেত, আলো আর মানুষের কথার শব্দ শুনেই সমরেশ ভিতর থেকে সেটা বন্ধ করে দিয়েছেন।
আর্মি- এধার আর কন কন হ্যায়? বোলাও সবকো
একজন উমেশের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল- তু মুক্তি হ্যায়?
উমেশ কিছু না বুঝেই বললো- আমি কিছু করিনেই ছার আমারে মাপ কইরে দেন। আমার বৌ’টা পোয়াতি ওরে ছাইরে দেন।
এবার অফিসার তাকাল কমলার দিকে, কমলা তখন থরথর করে কাঁপছে। স্বামীর দেখাদেখি কমলাও হাত দুটো উপর দিকে তুলে ধরেছে। অফিসার কমলার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল, তারপর উমেশের দিকে চেয়ে বললো- মার দো সালাকো।
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বুলেট ঝাজড়া করে দিল উমেশের বুক। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হযে গেল কমলা, ভয়ে তার প্রাণটা এসে আটকে আছে গলার কাছে। দুজন তাকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গাড়ির দিকে কিন্তু কমলার কথা বলার শক্তি নেই। সে শত চেষ্টা করেও চিৎকার করতে পারছে না।

Post a Comment

Thanks

নবীনতর পূর্বতন