বাস্তুহারা তারার ইশতেহার।। নিরঞ্জন রায়।। poems by niranjan roy

নিরঞ্জন। রায়।। কবি।। কবিতা


দশটি কবিতা
নিরঞ্জন রায় 

বাস্তুহারা তারার ইশতেহার

এখন কানের কাছে শব্দগুলো বেসুরো লাগে,
নদীর স্রোতধারা থেমে যাওয়া যেন এক হিমশীতল দেওয়াল
বিমূর্ত যন্ত্রণা রাতের বুক চিরে উঠে আসে লাল সিগনালের মতো।
ঠিকানা বিহীন তারাগুলো এলোমেলো, ওড়ে হাওয়ায়
নক্ষত্রের আলো বাঁধা খায়;
কোনো এক ভুল কক্ষপথে হারিয়ে ফেলা আলো যেন 
ছায়া হয়ে ধুয়ে যায় রেটিনায়।
একলা বেলায় শব্দগুলো রকেট গতিতে ছুটে আসে,
শূন্যের বুকে আঁকে লাল নীল সমীকরণ;
শব্দহীন এক বিস্ফোরণে কাঁপে চৌকাঠ,
কানে শুধু ইথারের সাইরেন।
বাস্তুহারা তারাগুলো নতুন করে আশ্রয় খোঁজে,
চিরস্থায়ী ক্যাটালগের ফাঁক গলে;
একটি তারা ঝরে পড়ে আমার কপালে
আরেক মহাবিশ্বের ইশতেহারে।

নিঃসঙ্গ এক মহাকাশচারী 

বাসের কাঁচ—যেন এক জলরঙের ক্যানভাস,
ভিড় করে ছায়া-শরীর, মায়ায় ঢাকা পৃথিবী, মনে হয় পরস্পর খুব কাছাকাছি।
শব্দেরা ঘোরে—ফোন বাজে, হাসির ঢেউ, পরিচিত সংলাপ,
তবুও নীরবতার গিরিখাত মাঝে, গভীর ব্যবধান আঁকি।
সবাইকে চিনি, এ শহরে দেখেছি শতবার আনাগোনা,
সহযাত্রীর ভিড়—যেন শত চেনা দ্বীপের সারি।
তবুও প্রতিটি চোখে দেখি এক নিঃশব্দ মহাদেশের রাত,
যেখানে আমার প্রবেশ নিষেধ, গোপন তারাভরা গহিন কুঠুরি।
চোখাচোখি হয়, এক লহমায় আলোর ফসিল জ্বলে,
কিন্তু সে চাহনি যেন গ্রহান্তরের সংকেত, ঝাপসা ও দূরগামী।
মন তখন উল্কা হয়ে ছোটে, কালপুরুষের কোলে,
এই পরিচিত বাসের সীমানা ছেড়ে, কোনো এক অজানা নক্ষত্রালোকে।
এই দেহভান্ডে জানি কতটুকু! এ জীবনের মহাসাগর?
অন্ধকারে হাঁটি, শুধু নিজের হৃদয়ের ধ্রুবতারা খুঁজি।
কার মন কাকে ছুঁয়ে যায়, এ স্পর্শের অদৃশ্য কারিগর?
সকল সংযোগের পরেও আমি—নিঃসঙ্গ এক মহাকাশচারী, বুঝি!

নদীটির একাল সেকাল

সেই চেনা নদীটির কোন দুঃখ ছিল না 
ধারা ছিল বহমান অবিরাম, মাছেদের ছিল উল্লাস
বহুধারা মিলেমিশে চঞ্চল, আনন্দে আত্মহারা 
বর্ষায় উথাল যৌবনা 
দু'তীর ভাসিয়ে সবুজ প্রান্তর-- 
বলেছিল, আমি বহমান চিরন্তন, ভালোবেসে গেয়ে চলি জীবনের গান।
হঠাৎ সেই নদীটির বুকে জলশূন্যতা, বিরানভূমি
মুদ্রার উল্টো পিঠের অমানিশা 
হায়েনা শ্বাপদের লীলাখেলা
নিয়ন্ত্রণহীন বিচরণ 
ফুলগুলো ঝরে যাচ্ছে অর্থহীন, গলা রাঙানোর পূর্বে
যোগি-ঋষিদের চোখ‌ও আজ ধৃতরাষ্ট্র।

বিবর্ণ সময়

সমুদ্র‌ও পথ ভুলে আঁধারে গৃহে চলে আসে 
ফাগুনের উথাল হাওয়ায় 
জ্যোৎস্না ভাসিয়ে দেয় রূপোলি ঢেউ
যৌবন ডানামেলে পাখি হয়ে উড়ায় বনের আকাশে
ঝাউবনে জোনাকিরা লুকোচুরি খেলে 
এখন এসব আর নাড়া দেয় না মনে
কারো কাছে এ চিত্রপট লোভনীয়, আগামীতে আসবে যে জন সেও পুলকিত 
একবার চলে গেলে সময়, ঝরে গেলে ফুল
একসময় মিলিয়ে যায় ছায়াও, বাড়ে দীর্ঘশ্বাস 
আগুনের উত্তাপেও জাগে না মন 
শুধু শুধু শিথিলতা বাড়ে বরফের আস্তরণ গলে।

সুশান্ত হালদারের কবিতা পড়ুন এখানে
মায়াপথিক এখানে
নয়ন আহমেদ এর কবিতা এখানে 
article of law and literature : click here
লতিফ জোয়ার্দারের কবিতা পড়ুন এখানে
nobel prizev:2025 on litterature here
ইসলাম তৌহীদের কবিতা পড়ুন এখানে
মহসিন খোন্দকারের কবিতা পড়ুন এখানে
গল্প বরফের ছুরি পড়ুন এখানে
প্রবন্ধ,উত্তরাধুনিক কাব্যধারার যাত্রাঃ মতিন বৈরাগী-এখানে
প্রবন্ধঃ রাজনীতি ও সাহিত্য পারস্পরিক সম্পর্ক পড়ুন এখানে
কবি মজিদ মাহমুদের গুচ্ছকবিতা পড়ুন এখানে

শ্যাওলার গন্ধ ও দীর্ঘশ্বাস

দেয়ালে লেগে থাকা শ্যাওলার গন্ধের মতো
মনে পড়ে তোমাকে—
এক অনাদি, অপ্রাকৃত সময়।
হাওয়ার ঝাপটায় ভেসে আসে উত্তাল সমুদ্রের 
উদ্ধত আভাস
ক্যাকটাসের কঠিন রেখায় ছুঁয়ে যায় 
মরুভূমির দীর্ঘশ্বাস।
হলুদ চাঁদ রক্ত শুষে নিলে পৃথিবীতে নেমে আসে আমাজনের নিস্তব্ধতা 
বৃষ্টির আগে, যেমন অজ্ঞাত গাছের পাতায় লেগে থাকে অনাদরে ধূসর, সবুজ স্তব্ধতা।

অলক্ষুণে চোখ

রেলগাড়িতে উঠে জানালার পাশেই বসি
বটগাছ দেখি
ভাটগাছ নিমিষেই হারিয়ে যায়
গাঙচিল চোখে পড়ে 
ঘাসফড়িং অচেনাই থেকে যায় 
দিগন্তবিস্তৃত গাছপালা পাহাড় বলে ভ্রম হয়
এড়িয়ে যায় ক্ষীণচোখ ধারেকাছের জলাশয় 
রেলব্রিজ পেরুনোর শব্দ শুনি
বস্তিতে বেড়ে ওঠা শিশুর আর্তনাদ পৌঁছোয় না বধির কর্ণদেশে
রেলগাড়িতে উঠে জানালার ধারেই আসন পাতি
সময়ের সাথে চলতে পারে না অলক্ষুণে চোখ।

তুমিই প্রকৃত জাদুকরী

তুমি জাদুকর দেখাও কেরামতি ফুঁ দিয়ে নাই করে দেও অর্থকড়ি 
জারিজুরি করে কথার ছলে সাজাও দাবার ঘুঁটি
ফুঁসমন্তরে হাওয়ায় জ্বালাও আস্ত লালবাতি 
চৌরাস্তার মোড়ে বেবাক জনতা তর্কযুদ্ধে লিপ্ত সব‌ই তোমার ভেলকিবাজি
কড়িবৃষ্টিতে জাদুকরের মুখে প্রশান্তির হাসি 
গোঁফে তেল মুখে সুখটান দিতে দিতে সে চলে যায় বাড়ি।
বুকপাহাড়ে ফলাও আপেল তুমি জাদুকাঠি ছাড়াই 
চোখজলে উড়াও সোহাগিপাখি
হৃদয়ঘরে শরাঘাত করো কী সে সাংকেতিক তরবারি 
নিজ অঙ্গে ঝরনা নদী তোমার, রক্তধারায় উর্বর করো জমিন 
ফলাও অবিকল এক মানব অথবা মানবী
তুমিই প্রকৃত জাদুকরী, তুমি নারী।
 
তারচেয়ে বরং

সেদিনও তো প্রেম ছিল ব‌ই কলমের গন্ধে মাতাল
স্কুল কলেজ ঠিকানা ছিল
তুমি তখন কোথায় ছিলে, ভালোবাসার সতীন ছিলে?
আজ‌ যখন তোমায় ডাকি, মিলনরথের ছবি আঁকি
নতুন ভোরের গল্প করি, মুক্তনীলের স্বপ্ন দেখি 
তুমি তখন ব্যস্ত সাজে, শাড়ি-গহনা অঙ্গে তুলে, 
দীর্ঘ চুলে বাঁধ দিয়ে, জুঁইয়ের মালা মাথায় তুলে, নদীর ধারা আটকে রেখে রাজপথে একা একা, কোন বিচ্ছেদে? 
তারচেয়ে বরং আজ চুক্তি হোক , কাগজ কলম দূরে থাক
কিউপিড আর আফ্রোদিতি স্বাক্ষী থাক 
তুমি আমাকে নাও, আমি তোমাকে
তোমার ভেতর আমি হারাই, আমার ভেতরে তুমি 
দু'জনের যৌথ প্রচেষ্টায় নিজেদের ভেতর পরস্পরকে খুঁজি, নতুন চোখে নতুন রূপে মহাবিশ্ব দেখি।

আদিখ্যেতা আর নয়

আদিখ্যেতার সেসব দিন কি আর আছে
সময়স্রোতে সবকিছু যায় ভেসে
নদী কি আর এক‌ই তালে সব‌ঋতুতে ছোটে, 
যমুনার ঘাটে শেষপ্রহরের জোছনা এসে পড়ে, তুমি বলো তুমি যাবে
ছন্দে তালে কবিতা লেখা চলে, ছন্দ বলে, 'আমার পাশেও বিরামচিহ্ন বসে' 
পানকৌড়ি কি সেসব কিছু বোঝে, দারকিনা পুঁটি জীবন নিয়ে ছোটে
তবুও আদিখ্যেতার দিন কি আর আছে, দিগন্তরেখা আবির রঙে সাজে, তুমি বলো তুমি যাবে
সুর ও ছন্দ থেমেই যদি যাবে, বলো কেন এ অবেলায় তোমার দেখা হবে
সময়কে না হয় একটু বলে নেব, ফাগুন হাওয়ায় বোনাস জুড়ে দেবে 
তবুও কি আর আদিখ্যেতা সাজে, তুমি বলো তুমি যাবে

স্বপ্নেরা হারায় না

স্বপ্নেরা চলে যেতে পারে না, ঘুরেফিরে আসে
পাখি হতে ইচ্ছে হলো, হলো না
আহত হরিণ ফিরে এলো, জলপিপাসায় কাতর 
শিল্পী হ‌ওয়ার ইচ্ছে জাগলো, হলো না
নিজেই পোস্টারে ধরা দিল, শিল্পকর্ম হয়ে 
অথবা বাংলার কৃষক, অনু্র্বর জমি ভরিয়ে তুললো সোনালি ফসলে 
স্বপ্নেরা আপাতদৃষ্টিতে নাই হয়ে যায় কখনো কখনো, নিজেকে পোড়ায়
ঘুরপথে চলে আসে আবার 
দেখা গেল ছাইভস্ম হয়ে অজান্তেই ধুলিকণায় মিশে গেল 
অথবা পাহাড়ি নদ, কলকল ধ্বনি তুলে তোমার আমার ঘুম ভাঙালো, ডিঙিনৌকা বুকজলে ভাসালো 
স্বপ্নেরা হারায় না, রূপ পরিবর্তন করে মাত্র 
হরিণিকে দেখে তীর ছুটে গেল, 
ফিরে এলো আত্মঘাতি ফলা রূপে, বুক ফুঁড়ে দিল, এমন‌ও হয়
তবে স্বপ্নেদের মৃত্যু হয় না, ঘুরেফিরে আসে মিশে থাকে ছায়ার মতো, অন্ধকারে চোখে পড়ে না, তবে হারায় না।

Post a Comment

Thanks

নবীনতর পূর্বতন