সাহিত্য ও রাজনীতিঃ পারস্পরিক প্রভাব।। ড. আলী রেজা।। article,literature, kuasha

প্রবন্ধঃ

সাহিত্য ও রাজনীতি।। সাহিত্য।। প্রবন্ধ


সাহিত্য ও রাজনীতিঃ পারস্পরিক প্রভাব

ড. আলী রেজা




নেকেই মনে করতে পারেন রাজনীতির সাথে সাহিত্যকে সম্পর্কিত করে ফেলা ঠিক নয়। সাহিত্য নান্দনিক, কিন্তু রাজনীতি নানা কৌশল ও জটিলতায় পূর্ণ। এ কথা মেনে নিয়ে রাজনীতি ও সাহিত্যকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় বটে, কিন্তু এ দুটোকে পরস্পর সম্পর্কহীন করে তোলা সম্ভব নয়। এর একটি প্রধান কারণ হলো সাহিত্য ও রাজনীতি দুটোই জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। রাজনীতি জাতীয় জীবনকে প্রভাবিত করে এবং সে প্রভাব ব্যক্তিজীবনকেও আলোড়িত করে। রাজনীতি কখনো ব্যক্তিজীবনকে সমৃদ্ধ করে, কখনো ব্যক্তিজীবনকে সংকটাপন্ন করে। ব্যক্তিজীবনের সুখ, সমৃদ্ধি ও সংকট পরিহার করে চলতে পারে না সাহিত্যও। তাই সাহিত্য ও রাজনীতি দুটোই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তবে রাজনীতি ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে বিধিবদ্ধভাবে। এই বিধি যখন ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তখন সাহিত্য ব্যক্তির পক্ষে দাঁড়ায়। ফলে সাহিত্য ও রাজনীতি পরস্পর প্রতিপক্ষও হয় কখনো কখনো। 

মোহাম্মদ জসিমের ভিন্ন রঙের কবিতা পড়ুন এখানে
জিল্লুর রহমান শুভ্র'র ভিন্ন স্বাদের কবিতা পড়ুন এখানে
ওপার বাংলার বিখ্যাত কবি রবীন বসুর কবিতা পড়ুন ক্লিক
ওপারের কবি তৈমুর খানের কবিতা পড়ুন এখানে


ফরাসি বিপ্লবকালে ফ্রান্সের সাহিত্য রাজশক্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল। কারণ রাজশক্তি তখন ফ্রান্সের জনগণের সকল মানবিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। রাজশক্তি ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ মিলে সাধারণ মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাকেও হরণ করেছিল। একই চিত্র ছিল বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায়। রুশবিপ্লবেও তাই সাহিত্য দাঁড়িয়েছিল গণমানুষের পক্ষে। রাজশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি তখন শুধু সাহিত্যেরই ছিল। সে সময় হতেই সাহিত্য বিপ্লবী চেতনায় সমৃদ্ধ হতে থাকে। মূলত তখন থেকেই সাহিত্যের দুটি ধারা সমৃদ্ধ হতে থাকে। একটি নান্দনিক ধারা, অন্যটি বিপ্লবী ধারা। বিপ্লবী ধারার সাহিত্য যুগে যুগে রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাজনীতির চরিত্রই হলো কারো মাধ্যমে প্রভাবিত না হওয়া। সকলের ওপর প্রভাব বিস্তার করাই রাজনীতির ধর্ম। সাহিত্যের ধর্মও তাই। ফলে বিপ্লবী সাহিত্য রাজনীতির প্রতিপক্ষ হয়েই টিকে আছে। বিপ্লবী সাহিত্য গণমানুষের পক্ষে- এ কথার সাথে এটাও বলা যায় যে সকল সাহিত্যই মানুষের পক্ষে। সাহিত্যচর্চা মানে জীবনচর্চা। জীবনের সকল দিক প্রতিফলিত হয়ে থাকে সাহিত্যে। মানুষের স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত বলে স্বাধীনতা ও অধিকারের কথা বলতে গেলে একজন সাহিত্যিককে রাজনীতির ভাষা ব্যবহার করতে হয়। তখনই সাহিত্যে রাজনীতির কথা ওঠে আসে। রাজনীতিও তখন সাহিত্যকে দমিয়ে রাখতে চায়। নিষিদ্ধ করে সাহিত্য ও দন্ডবিধান করে সাহিত্যিকের। শাসক শ্রেণি স্বাধীনতা ভোগ করলেও তারা শাসিত শ্রেণির স্বাধীনতা মানতে চান না। জনগণের স্বাধীনতাকে শাসক শ্রেণি স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। শাসক শ্রেণির জন্য দরকার জনগণের অধীনতা। জনগণ অধীন হলেই শাসকের মহিমা অক্ষুন্ন থাকে। ক্ষমতার রাজনীতি মানুষকে অধীন করতে চাইলেও সাহিত্য বলে ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়/ দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে কে পরিবে পায় [রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মিনী উপাখ্যান]।’ বাংলা সাহিত্যে এই রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন প্রমুখ সাহিত্য প্রতিভা সাহিত্যকে রাজনীতির সমান্তরালে চালিত করেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য ও রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্কের একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। সাহিত্য ও রাজনীতি- দুটোকেই রবীন্দ্রনাথ আত্মজাগরণের উপায় বলে মনে করেছেন। বঙ্গভঙ্গপর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায় দেশাত্মবোধের পাশাপাশি আত্মজাগরণের চেতনাও প্রতিফলিত হয়েছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধি বর্জন এবং ব্রিটিশরাজের বিচারে দন্ডপ্রাপ্ত কবি নজরুল ইসলামকে অনশন ভঙ্গের আহবান ও কারাবন্দী অবস্থায়ই কবি নজরুলকে ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করার বিষয়টিকে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ রাজনীতির নমুনা বলা চলে। ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতি ছিল নজরুল সাহিত্যের মৌলিক চেতনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নজরুল যখন নিয়মিতভাবে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন তখন বিশ্বের ৭০ ভাগ রাষ্ট্র ছিল উপনিবেশ এবং ৭২ ভাগ মানুষ ছিল পরাধীন। ভারতবর্ষও ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং ভারতবাসী ছিল পরাধীন। নজরুল সাহিত্য তখন পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং স্বাধীনতা ও সাম্যের কথা বলে। ব্রিটিশ রাজনীতিতে ভারতবাসী ছিল পরাধীন ও বৈষম্যের শিকার। এই রাজনীতির বিরুদ্ধে তৎকালে সাহিত্য হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার। সকল সর্বভারতীয় নেতা যখন ব্রিটিশ সরকারের নিকট থেকে সীমিত আকারে স্বায়ত্বশাসন কিংবা স্বরাজের দাবি আদায় করা নিয়ে ব্যস্ত তখন একা নজরুল ‘ধূমকেতু' পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখলেন ‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না...। ধূমকেতু সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।’ এটা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় রাজনীতি।

কবি মজিদ মাহমুদের গুচ্ছকবিতা পড়ুন এখানে
ইমদাদুল হক মিলনের নুরজাহান উপন্যাস নিয়ে প্রবন্ধঃ পড়ুন
চানক্য বাড়ৈ এর কবিতা পড়ুন এই লিংক এ
বিনয় মজুদারকে উৎসর্গিত পিয়াস মজিদের কবিতা পড়ুন এখানে

সাহিত্য রাজনীতির জ্বালানী সরবরাহ করেছে যুগে যুগে। তাই রাজনীতিকে সাহিত্যের কাছে যেতে হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ নন্দিত সাহিত্য, কিন্তু আনন্দমঠকে নন্দিত রাজনীতির গ্রন্থও বলা যাবে। বলতে হবে। একই বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’, শরৎচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘পথের দাবী’ নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘কুহেলিকা’ রাজনীতির জ্বালানী সরবরাহকারী সাহিত্য। মানবিক রাজনৈতিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করা সাহিত্যের একটি কাজ। তবে এটি খুব বেশি বড় কাজ নয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল দর্শনকে যুগে যুগে মানুষের চেতনায় বহমান রাখাই সাহিত্যের সবচেয়ে বড় কাজ। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটেছে প্রায় আট দশক আগে, পাকিস্তানি শাসন ও শোষণ থেকে বাঙালি জাতির মুক্তি ঘটেছে অর্ধশতাব্দি আগে, নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার তিন দশক পেরিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু আজও ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী সাহিত্য, ভাষা আন্দোলনের চেতনাবাহী সাহিত্য, গণঅভ্যুত্থানের সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সাহিত্য ও নব্বইয়ের গণআন্দোলনকেন্দ্রিক সাহিত্য মানুষের চেতনায় বহমান। বহমান থাকবে যুগে যুগে। সাহিত্যের সাথে রাজনীতির এই মেলবন্ধন চিরন্তন।

সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতি যখন সমাজের সর্বস্তরে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে তখন এই রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে সাহিত্য। অপরাজনীতি বা অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যখন ব্যক্তির যাপিত জীবনকেও দুর্বিষহ করে তোলে তখন সাহিত্যকে স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়াতে হয় ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে। রাজনীতি মূলত আপোসমুখি। বিশেষ স্বার্থে রাজনীতি কখনো কখনো আপোষহীন রূপ ধারণ করে। কিন্তু সাহিত্য পুরোপুরি আপোষহীন। একমাত্র সাহিত্য ও সংস্কৃতিই সঠিক সময়ে দাঁড়িয়ে যায় সকল অন্যায়-অনিয়ম আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও তা পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে সংঘটিত রাজনৈতিক আন্দোলনকেও প্রভাবিত করেছিল দারুণভাবে। আর এই প্রভাব সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন সাহিত্য। মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকে শহীদদের আত্মার একটি সংলাপ ছিল ‘আমরা কবরে যাব না’। কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী ভাষাশহীদদের প্রতি শোকতাপ না করে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন তাঁর ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতায়। ভাষা আন্দোলনে স্বেচ্ছা কারাবরণকারী ভাষা সংগ্রামীর সংখ্যা আসছে ফাল্গুনে দ্বিগুণ হবে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জহির রায়হান তাঁর ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসে। গানে, কবিতায়, নাটকে, গল্প-উপন্যাসে যেভাবে ভাষা-সংগ্রাম ও ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে শাণিত করা হয়েছে তাতে তৎকালীন রাজনীতিই প্রতিফলিত হয়েছে।

সাহিত্যের সাথে রাজনীতির এই সম্পর্ককে কেউ কেউ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চান। কখনো কখনো নেতিবাচক হয়ও বটে। সাহিত্যের সৌন্দর্য তখনই নষ্ট হয় যখন রাজনীতি সাহিত্যকে গ্রাস করে। নির্বিচারে সাহিত্য যখন রাজনীতির ক্রীড়ানক হয়ে ওঠে এবং রাজনীতির তল্পিবাহক হয়ে নিজের স্বকীয়তা নষ্ট করে তখন শুধু সাহিত্যের সৌন্দর্য নয়, সাহিত্যের মর্যাদাও ক্ষুণ্ন হয়। রাজনীতি প্রভাবিত সাহিত্য কখনো কখনো তার সঠিক গতিপথ হারাতে পারে। সাহিত্যিকের নিরপেক্ষ ব্যক্তিচিন্তার প্রতিফলন ঘটলেই সাহিত্য স্বরূপে প্রকাশ পায়। সাহিত্যে যেকোন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রকাশ ঘটতে পারে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা সাহিত্যকে বিভিন্নমুখী করতে পারে। তবে মতাদর্শিক ভিন্নতা সত্তে¡ও সাহিত্যকে সতত যে মূল উদ্দেশ্যের দিকে ধাবিত থাকতে হয় তা হলো মানব কল্যাণ। মানব কল্যাণের আবার দুটি দিক আছে। একটি হলো বস্তুগত মানবকল্যাণ অপরটি হলো মনোজাগতিক মানবকল্যাণ। বস্তুগত কল্যাণ বা উন্নয়ন রাজনীতির মূললক্ষ্য। অপরদিকে মনোজাগতিক কল্যাণ বা উন্নয়ন সাহিত্যের মূললক্ষ্য। এই দিক বিবেচনায় সাহিত্য ও রাজনীতির ক্ষেত্র ভিন্ন। 

লেখকঃ

ড. আলী রেজা
প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যচিন্তক





Post a Comment

Thanks

নবীনতর পূর্বতন