নিজের বন্ধুর মেয়ে লতিফা, যার সাথে তার শরীরের সম্পর্ক, সেই লতিফাকে ঢাকায় নোটিশবিহীন অনুপস্থিত দেখে তার খোঁজ নিতে সে ময়মনসিংহে গিয়ে হাজির হয়। সেখানে গিয়ে লতিফার বাবার সামনে বাবরের ভাবটি এমন যে, লতিফা যেন তার মেয়েরই মতন। আবার রাতের বেলায় সেই বাড়িতেই লতিফার মধ্যে প্রবেশ করার জন্য ব্যাকুল হয় বাবর। লতিফাতে সে প্রবেশ করতে পারে না। অপমানিত হয় ফিরে আসে ।শুধু এই ফিরে আসা পর্যন্ত পড়েই অবশ্য পাঠকের ধারণা হবার কথা নয় যে বাবর “লম্পট” কিসিমের একজন মানুষ। বাবরের লাম্পট্য দর্শকের কাছে উন্মোচিত হয় বাবলীকে দিয়ে। বাবরের হাঁটুর বয়সী মেয়ে বাবলী। এই বাবলীকে পাবার জন্যই বাবর উতলা হয় কেবল বাবলীর নামের ধ্বনিতেই “ বাবর টের পায় আবার তার দুপায়ের মাঝখানে উত্তাপ বাড়ছে। বড় হচ্ছে। তার দেহকে ছাপিয়ে উঠছে আয়তনে। বাবর উপুড় হয়ে শুল। শাসন মানল না। তবু বড় হতে লাগল। উত্তাপে উত্তেজনায় যেন সেখানে ছোট ছোট ড্রাম বাজানোর কাঠিতে বাড়ি পড়তে লাগল। সৃষ্টি হতে লাগল একটা দ্রুত লয় ছন্দের। লয়টা দ্রুত থেকে আরো দ্রুত হতে লাগল। চোখের ভেতরে বাবলিকে সে দেখতে পেল স্পষ্ট। নির্বাক। নগ্ন। কাছে, আরো কাছে। সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে তাকে অনুভব করতে লাগল বাবর। আরো কাছে।বাবলি এখন তার দেহের সঙ্গে এক। আর যুগলে যেন বাজছে সেই ছোট ছোট ড্রাম। দোকানে দেখা খেলনা ড্রাম। নীল রং চারদিকে। মাঝখানে একটা উজ্জ্বল লাল রেখা। বৃত্তাকারে ঘুরছে নীল, লাল, নীল। আবার নীল, আবার লাল, আবার নীল। ঘুরতে ঘুরতে রং দুটো একাকার হয়ে গেল। বাজনার দ্রুত লয় যেন বাবরের অস্তিত্বকে অতিক্রম করে এখন হঠাৎ শেকলকাটা পাখিব মত উড়ে গেল উর্ধে আকাশে, শূন্যে। উজ্জ্বল রোদে পুড়ে যেতে লাগল বাবরের চোখ। সে দুহাতে সজোরে চেপে ধরল। তার উত্তপ্ত অধীর দ্রুত স্পন্দিত শিশ্ন। এবং তৎক্ষণাৎ এক বহু আকাঙ্গিক্ষত, মন্ত্ৰোচ্চারিত, খরচৈত্রের বৃষ্টির আবেগে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে নেবে এলো অন্ধ, অজস্র শাস্ত্রে বর্ণিত চল্লিশ দিন-রাত্রির প্রান্তর পাহাড় ডোবান মুখর জলধারা। বাবর ভেসে যেতে লাগল স্থলিত একটা সবুজপাতার মত।
ঢাকায় জাহেদাকে উত্তরবঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য তার প্রায় অসম্ভব চেষ্টা দেখে অবাক হতে হয়। সঙ্গমের জন্য তার এত তৃষ্ণা? জাহেদা যেহেতু কলেজ ছাত্রী এবং হোস্টেলে থাকে, ওখানকার কড়া নিয়মবদ্ধতা থেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য বাবর চট্টগ্রাম উড়ে গিয়ে একটি বানোয়াট টেলিগ্রাম পাঠায়। বিস্মিত হতে হয় – শুধু সঙ্গমের জন্য এতকিছু? সে তো বাবর সহজেই করতে পারে। টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করার সুবাদে সে সর্বত্রই পরিচিত মুখ, তারকাই বলা যায়। আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গী, মনোহর কথামালা, দুর্দান্ত স্মার্টনেস তাকে স্বভাবই কাম্য পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। চাইলেই সে বহু নারীকে শয্যায় নিতে পারে, মিসেস নফিস যাদের একজন। কিন্তু তার চাই কেবল সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণী, অন্য কোনো কিছুতে তার রুচি নেই। তাকে যেন ঠিক চেনা যায় না, জগৎ যে চেনে, যার নিজস্ব কিছু দার্শনিক চিন্তা মাঝে-মাঝে চমকে দিয়ে যাচ্ছে পাঠককে, তার এসব কীর্তিকলাপের বাবর জাহেদাকে নিয়ে বেরিয়েছে উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে, যেতে যেতে বলছে নানারকম কথা, আর সেইসব কথার ভেতরে রয়েছে এমনই এক রাগি মানুষের ছবি যে সমস্ত প্রচলিত নৈতিকতা, মূল্যবোধ আর সংস্কারকে ভেঙে ফেলতে চায়। একসময় উত্তরবঙ্গে পৌঁছে যায় তারা, প্রথম রাতে সঙ্গম করতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত বাধা পায় বাবর, দ্বিতীয় রাতে অবশ্য সেই বাধা আর থাকে না এবং অবশেষে জাহেদা-সুধা পান করে ফেরার পথ ধরে সে। যে বাবর জগৎ চেনে, ‘খেলারাম খেলে যা’ দর্শনটি আর কৈশোরের দুঃসহ স্মৃতি যার নিত্যসঙ্গী, সেই বাবর জীবন ও পৃথিবীকে, আমাদের দৈনন্দিন সংস্কার, বিশ্বাস আর রীতিনীতিকে কী চোখে দেখে সে বিষয়ে কয়েকটি উদ্ধতি ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি’ – জাহেদাকে এই বাক্য বলার পর –
‘বিশ্বাস না কচু। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করল বাবরের। দু’পয়সার দাম দিই না। আমি যা চাই তা এমনি তোমার পাজামা ছিঁড়ে ভেতরে যেতে। কি ক্লান্তিকর এই অভিনয়, এই সহাস্য মুখ তৈরি করা; এই কথার মালা গাঁথা।’
‘বিয়ে করবেন না নাকি?’ জাহেদার এ প্রশ্নের উত্তরে –
‘বাবর ভাবল যা সত্যি তা বললে ও বুঝতে পারবে না। বিয়ে সে করবে কেন? শরীরের জন্যে? সে প্রয়োজন বিয়ে না করেও মেটান যায়। বরং তাতে তৃপ্তি আরো অনেক। … বিয়ে করবে সন্তানের জন্যে? সন্তান সে চায় না। চায় না তার উত্তরাধিকার কারো উপরে গিয়ে বর্তাক। আমার জীবনের প্রসারণ আমি চাই না। মৃত্যুর পরেও আমি বেঁচে থাকতে চাই না। আমার এমন কিছু সম্পদ নেই, অর্জন নেই, উপলব্ধি নেই যা যক্ষের মতো আগলে রাখার স্পৃহা বোধ করি ভবিষ্যত বংশধরের জন্যে। এ জীবন আমি চাইনি, অতএব কারো জীবনের কারণও আমি হতে চাই না। বিয়ে করব ভালবেসে? ভালবাসা বলে কিছু নেই। ওটা একটি পন্থা। পন্থা কখনো লক্ষ্য হতে পারে না। নিবৃত্তি নেই তাতে। ভালবাসা একটা অভিনয়ের নাম।
বিশেষ সময়ে শরীরের বিশেষ অংশ “দপদপ” করে ওঠার বর্ণনা, বাবরের “তারাবাতি” জাহেদার হাতে ধরিয়ে দেবার বর্ণনা, “তারপর হঠাৎ সচল হয়ে দুই ঠোঁটে ব্যগ্রতার সঙ্গে সবুজ একটা অশ্বথ পাতার মতো স্তন মুখে তুলে” নেয়ার বর্ণনা, শিশ্নের মাথায় লাল লিপস্টিক মেখে দেয়ার বর্ননা পড়ে?
অবশেষে আমরা দেখি বাবর জাহেদাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসছে। তার কাজ শেষ, জাহেদাকে সে এবার ব্যবহৃত টয়লেট পেপারের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অন্যত্র মনোনিবেশ করতে চায়। কিন্তু জাহেদা নাছোড়বান্দা, হোস্টেলে সে ফিরবে না, বাবরের সঙ্গে তার বাড়িতে যাবে। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে, পথিমধ্যে বাবর গাড়ি থামিয়ে দিলে দুর্ঘটনাটি ঘটে। কয়েকজন লোক এসে তাদের ঘিরে ফেলে সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে; বর্ধমানের সেই সন্ধ্যাটি যেন ফিরে এসেছে আবার – যে সন্ধ্যায় বাবর হাসনুকে হারিয়েছিল ।
বিয়ের বন্ধন চায় না বাবর। নতুন আরেকটি জীবন তৈরি করে তার উত্তরাধিকারও রেখে যেতে চায় না। সে ভালোবাসে অবাধ যৌনাচার। কচিকচি মেয়েদের সাথে বিছানায় যাবার জন্যে সে ব্যাকুল হয়ে থাকে। কিন্তু ধর্ষণ সে করে না। বহু বুদ্ধি খরচ করে, সময় খরচ করে, অর্থ খরচ করে কচি মেয়েদের মন জয় করে সে। কেননা বাবর জানে, মন জয় হলে শরীরটা জয় করা সহজ হয়; হয় আনন্দময়।
‘কোথায় গিয়েছিল দুজন, মনে নেই। মনে রাখার কোনো প্রয়োজনও নাই। যেন জন্মের পর থেকেই সে আর হাসনু অবিরাম দ্রুত পায়ে সেই অন্ধকার ভাঙতে ভাঙতে চলেছে। কে যেন পেছনে আসছে। কই না। আবার তাকিয়ে দেখল বাবর। কাউকে দেখল না, তবু মনে হলো কেউ তাদের অনুসরণ করছে। তার হাত ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ধরবার জন্যে। চট করে হাসনুকে টেনে সে পোলের পাশে ঝোঁপের মধ্যে লুকাল। ...হাসনুর মুখ চেপে ধরে বাবর কান পেতে রাখল শব্দের ঐ উৎসের দিকে। তার মেরুদণ্ড দিয়ে হঠাৎ ঠান্ডা তরল কী যেন নামছে অতি দ্রুত। তারপর হঠাৎ উরুর ভেতরটা ভিজে গেল উষ্ণতায়। ঘড়ঘড় একটা শব্দ হলো সেই মুহূর্তে, ওপারে। ফিসফিস গলায় কে যেন জিজ্ঞেস করল, বল শালা, হিন্দু না মুসলমান? উত্তরে দ্বিতীয় লোকটা হিহি করে হেসে উঠল যেন। বল? চাপা গলায় গর্জে উঠল প্রথম। আঁ করে একটা শব্দ করল দ্বিতীয়। তারপর শোনা গেল, হি হি না, হি হি না না। চুপ শালা। ... বাবর হাসনুকে টেনে তুলে দৌড় দিতে যাবে, একবারে সামনে পড়ে গেল লোকটার। হাতে রক্তমাখা ছুরি। গলায় একটি মাদুলি চকচক করছে। আর কিছু চোখে পড়ল না তার। আর কিছু মনে নেই বাবরের। কেবল মনে আছে বাবর মাঠের ভেতর দিয়ে প্রাণপণে দৌড়ুচ্ছে। আর পেছনে হাসনুর আর্তচিৎকার আকাশে বাতাসে হা হা করছে—দা-দা।………..
সৈয়দ হক লিখেন : “এখন আরো একা লাগলো বাবরের। রক্তের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক তাদের কথা মনে পড়তেই এই বোধটা বিরাট হয়ে উঠেছে যে এখন তার চারপাশে এ দেশে কেউ নেই। আপন কাকে বলে সে ভুলে গেছে বলেই যারা আপন তারা তাকে এমন একা করে যাচ্ছে।”যখন দেখলাম, একটা অভিমানী শিশুর মত বাবর নিজেকে বলছে “আমার কেউ নেই। কেউ নেই। কোনো কিছু আমার নয়। না মাটি, না মন, না মানুষ।” বাবর যখন বর্ধমানে ফেলে আসা লেবু গাছটার কথা ভাবে, কানা ফকিরটা বেঁচে আছে না মরে গেছে বলে হাসনু নামের কারো কাছে জানতে চায় তখন বাবরের ব্যাথা স্পষ্ঠ হয়ে উঠে । । একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতাও হাহাকারের ভেতরে গোপনে কাতড়াতে থাকা বাবরকে লক্ষ করে আমরা জানতে পারি, এটি কামুক বাবরের গল্প নয়। এটি সব হারানো, অভিমানী, নিজের থেকে পলাতক কোনো এক বাবরের গল্প— যে বারবার একা হয়ে যায়, যে ভোগে বিচ্ছিন্নতায়, হাজারজনের মাঝে থেকেও যে বাস করে নিজের ভেতর। তারপর আমরা জেনেছি হাসনুর কথা। জেনেছি, সেই মেলার বিকেলের গল্প। দাঙ্গার ভয়ে মেলা ভেঙে যাবার গল্প। মেলা থেকে সন্ত্রস্ত দুই ভাই-বোন বাবর ও হাসনুর ত্রস্ত বাড়ি ফিরে আসার গল্প। বাড়ি ফেরার পথে মাঝপথে হাসনুকে দাঙ্গাকারীদের তুলে নেবার গল্প। হাসনু যখন দাদা দাদা বলে তারস্বরে ডাকছে দাদাকে, জেনেছি, প্রাণভয়ে সেই দাদার পালিয়ে আসার গল্প। জেনেছি, দেশহারা, মাটি হারা, বাবরের আর্তনাদ। জেনেছি, ট্রামাক্রান্ত বাবরের উলটপালট হয়ে যাওয়া মনোজগত ।
এখন কথা হল কার ওপর প্রতিশোধ নিতে চায় বাবর? উপন্যাসটি আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক নয়; হলে, আমরা বলতে পারতাম – সে প্রতিশোধ নিতে চায় তাদের ওপর যারা তাকে শেকড়-ছাড়া হতে বাধ্য করেছে, যারা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে একটি দেশকে ভেঙে দু-টুকরো করেছে, আর সে তার বোনকে হারিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঘটনা সেটিই। বাবরের প্রতিশোধস্পৃহা আসলে তাদের প্রতিই। আর এখানে এসেই যেন আপাত-অরাজনৈতিক উপন্যাসটিও হয়ে ওঠে ভীষণভাবে রাজনৈতিক। কিন্তু ইঙ্গিতটা এতটাই প্রচ্ছন্নভাবে দেয়া হয়েছে যে, বোঝাই কঠিন – এই জটিল ঘটনাপ্রবাহ সম্বন্ধে লেখকের রাজনৈতিক ভাষ্যটা কি!। এ-ও সত্য যে, একজন লম্পট, কামুক, বিকৃত মানুষের যৌনতাড়িত আচরণের বিপুল বর্ণনায় যে উপন্যাস এগিয়ে চলছিল, কখনো মনে হয়নি – একে রাজনৈতিকভাবে দেখবার প্রয়োজন হতে পারে। কোনোকিছুই তো আসলে রাজনীতির বাইরে নয়। একান্ত ব্যক্তিগত যে জীবন, প্রতিমুহূর্তে সেখানেও ঢুকে পড়ছে রাষ্ট্র ও রাজনীতি। ভয়াল এই রাজনীতি, যা দেশকে ভেঙে ফেলে; একটি জাতিকে বিভক্ত করে ফেলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায়।
আর এসব কিছু নিয়ে বাবর হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের এক আশ্চর্য জীবন্ত চরিত্র; সবচেয়ে আধুনিক ও প্রগতিশীল, দার্শনিক ও দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ ট্র্যাজিক এক চরিত্র ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks