সমাজের আধার এবং আধেয় মুখ 'মায়াপথিক'
গোলাম রববানী
কবি রায়হান উল্লাহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন।তার বাবা মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং মা হাসনা হেনা গৃহিণী। এখন দুজনই জীবনের পড়ন্ত বেলায়। তাদের ছয় সন্তানের তৃতীয় তিনি। কবি রায়হান উল্লাহ সাংবাদিকতা পেশায় নিযুক্ত রয়েছেন। বর্তমানে দৈনিক আজকালের খবরের সম্পাদকীয় সহকারী ও সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। লেখালেখি তার শখের জায়গা। তার কাছে কবিতা প্রাণের চেয়ে বেশি কিছু। বলা চলে জীবনের ডায়েরি কিংবা দিনলিপি। 'মায়াপথিক' তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
'মায়াপথিক' কাব্যগ্রন্থটিতে কবি বস্তুগত-অবস্তুগত বিষয়, সমাজ,সংসার, রাষ্ট্রের তথা বৈশ্বিক মেরুকরণের ঘটে যাওয়া সমসাময়িক বিবিধ নিয়মবহির্ভূত ক্রিয়াকলাপ সমসূত্রতা বিষয়, ইতিহাস-ঐতিহ্যের চালচিত্র, জন্ম-মৃত্যু, জরা-খরা, ক্ষমতা-মোহ, লোভ-লালসা, হিংসা, প্রতিহিংসা, অর্থহীন জীবন, অপশক্তি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধাচারণ, গ্রামীণ জীবন জনপদ বা দেশপ্রেম, প্রেরণার প্রেষণায় মানুষকে নির্বোধ পৃথিবীকে আঁকড়ে থাকার অপচেষ্টার চিত্র জ্বাজ্জল্যমান, ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী, ঈশ্বরের দয়া করুণার আবহওসহ বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়াদির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ কবিতার ক্ষেত্র।যা তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় ফসল বলাবাহুল্য। সর্বপরি প্রাধান্য পেয়েছে পৃথিবী পথিকের এই পথ আমলেই নেবার নয়- প্রস্থানের এবং মৃত্যুপথযাত্রার অমোচনীয় কালোদাগের কথা।মৃত্যুই যে আসল ঠিকানা সেটা বারবার স্মরণ করিয়েছেন মায়াপথিকের কবি। মায়াপথিক ক্ষণস্থায়ী কিছু নয়, চিরকালীন পথের যাত্রাপথ। পথিকবন্ধু পথের আকার তিনি মায়াকে কেবল হাতছানি দেয়।মায়াপথিক মুক্তগদ্য এবং পদ্যের নবঢঙের ব্যতিক্রমধর্মী একটি বই। বইয়ের পাতায় পাতায় পঙক্তিতে পঙক্তিতে ধ্বনির বর্ণেরই মেলবন্ধনের অভাব ঘুচিয়েছেন। ছন্দের ঝংকার আছে।রূপকতা, কাল্পনিকতা, বাস্তবতা এবং আলঙ্কারিকতার আবেশন সৃষ্টির অনন্যসাধারণ দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন কবি। কবিতাগুলোর শব্দচয়নে কবি রায়হান উল্লাহ বেশ পারদর্শিতা তথা পাণ্ডিত্য ফলিয়েছেন। তবে মুক্ত গদ্যের আধুনিক কবিতা আর আধুনিক কবিতাগুলোর মধ্যে অভিন্নতা না রেখে বইটি হলে মোটেও অনুচিত হতো না। যাইহোক বইটির আনন্দপাঠে পাঠকমাত্রই মুগ্ধ হয়েছি। নতুন পাঠকের ক্ষেত্রে বইটি অন্যরকম সুধাময়ী হবে আশাবাদী। বইয়ের মধ্যে সমাজ সংসারের সম্মিলিত আলো অন্ধকারের ভেরিয়েবল রিকগনিশন আছে এবং আলো ছড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। ধাপে ধাপে সেগুলো দেখানোর একটা ব্যস্ততা করেছি।
মায়ায় জগৎ, মায়ায় অনিত্যতা। মায়াপথিক! পথিকই মায়া! এতো দারুণ নিদারুণ খেলা! বলা চলে মায়াপথিক মায়াময় বিশালাকৃতি পৃথিবীর সামষ্টিক অভিজ্ঞতার কর্মফলনির্ভর ফলাফল!নিরীক্ষা ও গবেষণালব্ধ চিন্তার জটিল এক সমীকরণ! সরলতার পথে বিচরণ। আর প্যাথেটিক দোলাচল! দুকূল গুপ্ত চরাচর! রহস্যময় পৃথিবী অপৃথিবীর ঘর! মায়া বাদ দিলে মায়াময় পৃথিবীর আর কি'বা থাকে! পথিকই পৃথিবী, পথিকই মানুষ, পথিকই পথিকৃৎ, পথিকই পথ- পথই পথিক; পথিকই অজানার অনুসন্ধ্যানী এক যাত্রী, পথিকই সময়- পথিকই সময়ের পাতা পৃষ্ঠায় দাগ রেখে চলা কাল! পথিকই কালজয়ী পথ- পথিকই বিলীন হওয়ার নামান্তর কিন্তু তা যেন তুড়ে মেরে হারিয়ে ফেলার ফুরসত তবুও যেন পথের যাত্রী পৃথিবীর প্রাণ! হায় পথ! হায় পথিক! হায় মায়া! পথ সাক্ষী হতে চায়, থেকে যেতে চায়- স্মৃতি হতে চায়- এ পথ তো হাজার বছর ধরে চলে আসা যেন কোনোভাবেই বন্ধ হবার নয়, চেনা-অচেনা আত্মীয়ের গমনাগমন আর চাওয়া-পাওয়ার দোলাচালের ক্ষুৎপিপাসায় কাতর প্রাণ! 'মায়াপথিক' সুন্দর এই পৃথিবীর অনন্যতার চলমান এক নাম- যা কবি রায়হান উল্লাহ'র আবহমান চিন্তাফসলের নিবিড় পরিচর্যার শ্রেষ্ঠত্বের অমূল্য একধন। মায়াপথিক যেন পৃথিবীর সূত্র; সিস্টেম বা নিয়মকানুন- টেকসই সমেত তা বাস্তবায়নের কলাকৌশল অবলম্বন করার হাতিয়ার। কেউ হাল ধরে, কেউ চলে যায়; মায়াপথিক থেকে যায়। থেকে যাওয়াটাই উচিত। থেকে গেলেইবা কী আসে যাবে এই নিষ্ঠুরতম অমানবিক পৃথিবীর! প্রকৃতির খেলাটাই মূখ্য ও উপজীব্য 'মায়াপথিকের কবি রায়হান উল্লাহ তা ভালো করেই বুঝেছেন।বোঝানোর চেষ্টাও করেছেন। আর সেই বুঝটাই সহজ সরলভাবে ভণিতা না করেই কবিতাগুলোতে ছাপ রেখেছেন। কবিতাগুলো পড়লেই তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় কবিতার বিষয়বস্তু। কবিতাগুলো নির্দিষ্টভাবে নিজস্ব কোনো ছকে বেঁধে রাখিনি। পর্যায়ক্রমে কবিতাগুলো বিচার-বিশ্লেষণ, আলোচনা, সমালোচনা, মতামত মূল্যায়ন নিরূপণ করার প্রচেষ্টা ক্ষুদ্র পরিসরে প্রসারিত হয়ে প্রতীয়মান হবে।
'মায়াপথিক' কবি রায়হান উল্লাহ'র প্রথম কাব্যগ্রন্থ- যাকে তিনি সন্তানজ্ঞান করেছেন। এই কাব্যগ্রন্থের ৫৬টি কবিতার মধ্যে প্রথম কবিতাটির শিরোনাম বা নামকবিতা 'মায়াপথিক'। এখানেই কবির বাজিমাত বলা যায় কারণ চিরাচরিতভাবে বাস্তবতার রূপায়ণ নিরূপণ করেছেন তিনি- বোঝাতে চেয়েছেন পৃথিবীর পথিক সূচনালগ্ন থেকে যে যাত্রা শুরু করেছেন তা চিরন্তন সত্য; অনন্তকালের পথে এগিয়ে চলেছে। কবি সেই পথেরই পথিক! তিনি তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে হাজার বছর বেঁচে থাকার অতৃপ্ত বাসনা রসনার কথা বলেছেন- যেন পৃথিবী ধ্বংসের সংকটময় সময়েও এ পৃথিবী মনে রাখে।বিষয়টির গভীরতা সত্যিই অন্যরকম; তিনি পৃথিবীর পথিক মানে জীবন তথা মানুষকে এমনভাবে কল্পনা করেছেন যে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ সৎকর্মের মাধ্যমে, কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে এমনকি সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে হাজার বছর মানবের মাঝেই বেঁচে থাকার সুপ্ত বাসনা জাগৃতির চিহ্ন ফেলেছেন। জীবনটা আর কয়দিনইবা থাকে!আজ মরলে কাল দুইদিন! পথিক মরলে যেন বিস্মৃতি না হয়ে মধুর স্মৃতি হয়ে থাকে পৃথিবীর স্মৃতিতে- বিষয়টি ভাবতেই আরাম লাগে। এজন্যই যে কবি বিগত অনাগত আগত পৃথিবীর একটা রসায়ন বিক্রিয়া করার প্রচেষ্টা করেছেন।এই যেমন জন্ম-মৃত্যু, হিংসা-বিদ্বেষ, শারীরিক ভোগ-বিলাসিতা, মতানৈক্য, কেউ কাউকে তোয়াক্কা না করার মানসিক মানে যে যার মতো, কেউ কাউকে ঠিক যতটা গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ঠিক ততটা না দেওয়ার মনমানসিকতার চালচিত্রও তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। মতামতের ভিন্নতা; অভিন্নতার কথা বলেছেন। এটা চমৎকার; কিন্তু ইগুয়েটিক মনোভাব চরম নিকৃষ্টতার নামান্তর। মায়াপথিক নামকবিতার শেষাংশে কবি বলেছেন, "পথকে নদী ভেবে, নদীকে পথ। জীবনের প্রয়োজনে, সময়ের আয়োজনে, মায়ার সৃজনে।আমি মায়াপথিক। "কবি এখানে দর্শন, ভাব, কল্পনা, চিন্তাভাবনার সুকোমল প্রগতিশীল চলমানতার আর বাস্তবতার একটা মিথস্ক্রিয়ার যৌক্তিক সমন্বয় করেছেন। জীবনই অর্থপূর্ণ এবং অর্থহীন সময় নদীর মতো বয়ে চলা কিছু। ভাঙাগড়ার নিয়তি। দাগ ফেলে যার চিহৃ। সৃজনশীলতার গতিবিধিতে মায়াপথিক রঙবেরঙের চমকপ্রদ উপস্থাপন। তবে মায়াকে প্রাধান্য দিতে দেখা গেছে প্রেরণার পরশ হিসেবে।
করোনাকাব্য-১ এ কবি আক্ষেপ করে বলেছেন, "মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অতিরঞ্জিতের কথা- মূল্যবোধ নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়ের কথা; অধরাকে ধরার কথা- যার ফলশ্রুতিতেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতো হৃতসর্বস্ব সময়ের স্রোতে ভেসেই চলেছে।তিনি অপরিসীম চাহিদার ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা ছাপ ফেলেছে কবিতাটিতে।" এখানে বাস্তববাদী হয়েছেন কবি। ভাববাদীও বলা চলে।
কবি রায়হান উল্লাহ তার 'কিছুই পারিনি না আমি' কবিতাটিতে চিরন্তন সত্য খাঁটি বাস্তবতার নিরূপণ করেছেন। অলৌকিকতা, অবাস্তবতা, অলীকতা বর্জন করেছেন এমনকি অকার্যকর আবেগকে নর্দমায় নিক্ষেপ করেছেন। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই প্রতিটি প্রাণীর আসা- যাওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই চলেছে। জীবনের অর্থ খুঁজতে ব্যর্থ হয়েছে।অস্তিত্ব, খ্যাতি, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি জনপ্রিয়তার মেরুদণ্ড সোজা রাখতে এবং বুদ্ধি-বিবেচনায় সৃষ্টিশীলতা দিয়ে নশ্বর পৃথিবীকে খামোখা সাজানোর বৃথা অপচেষ্টায় কতকিছুই না করেছেন। কবি তার কবিতায় এসবকে পদাঘাত করেছেন! কী দরকার এইসমস্ত তথৈব আবর্জনার। এ সব অর্থহীন! মৃত্যুই প্রধান। তবে শ্রেষ্ঠ প্রাণীর নানাবিধ কার্যকলাপ সমুন্নত রাখতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি! হয় না; পৃথিবীর এমনই। কবি প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী। নির্দ্বিধায় অনিষ্ট, অবিনাশ, মহাপ্রলয়ক, প্রাণরাক্ষসের কানাঘসাটাই বরং গাঢ়তর হয়েছে। তিনি তা অস্বীকার করেননি।কাজী নজরুল ইসলাম , জীবনানন্দ দাশ , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পুলক বাবু, হেমন্ত, চেগুয়েভারা, দস্তভয়েস্কি প্রমুখ প্রখ্যাত জনেরা জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-সাতিহ্য-সং স্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, চিন্তাভাবনা, মতামত, যুক্তিতর্ক, আধ্যাত্মিকতা, ভাববাদ, মনস্তত্ত্ব, বিপ্লব- অভ্যুত্থান, সাম্যাবস্থা- এসবে কী আর হয় এই পৃথিবীর? মায়াপথিকের কবি বোধের রাজ্যেই বিচরণ করে যেন শব্দবোমা ফাঁটিয়েছেন- কথাটি এ কারণেই বলা যে পৃথিবীর অনিয়মকে ধ্বংসপথ আগেই দেখানো হয়েছে কিন্তু কোনও কাজের কাজ হচ্ছে। এ পৃথিবী মানছেন না।নির্বোধ অবিবেচক পৃথিবীকে অবজ্ঞার ছলে প্রজ্ঞাজ্ঞান করেছেন। কবি বলেছেন-"তবুও কেন জ্যোৎস্নার বিভ্রম!" চারিদিকে এতো আলো, এতো সৌন্দর্য- তবু কেন সম্পূর্ণভাবে কদর্যতা বিশ্রী রকম অন্ধকারের চলমান পথ!কবির এ কবিতাটিকে সার্থকভাবে শব্দরাক্ষস বলা চলে। কবিতায় কবি মানুষ নিজেকে আজও সঠিকভাবে চিনতে পারার অক্ষমতার কথা বলেছেন। মায়াময় স্রষ্টাকে স্মরণ করেছেন।পৃথিবীকে আরও হেদায়েতের করা বলেছেন। পথিককে মোহ মায়া, স্বার্থের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছেন। পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী! কিছু সাথে যাবে না-সকলকেই অনিষ্টক্ষেপনশীলতা থেকে বের হবার আহবান জানিয়েছেন।
পথই জীবনের শিক্ষক; যে পথে পথের সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে,গাইডলাইন পেলে মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, আশা জাগায়, স্বপ্নের সমান বড় হতে শেখায়- সেই পথটাই বন্ধুর, রোগ-শোক, বালা-মুসিবত, মহামারি, মানবসৃষ্ট জটলার স্তূপীকৃত ভূমি যেখানে ষড়যন্ত্রের বীজ গাছ হয়ে আকাশসম ছায়া বিস্তার করে সাজানো পৃথিবীটা বড়ই ওলট-পালট করে দেয়- অনভিপ্রেত অপ্রত্যাশিত অচিন্তকনৈনিতাল যা করোনাকাব্য-২ এ কবি চমৎকারভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন।কবি বলেছেন,
"পথই দেখায় ভালোবাসার সরণি,
পথই শেখায় আলো আশার ধরণি।"
নয়ন আহমেদ এর কবিতা এখানে
article of law and literature : click here
লতিফ জোয়ার্দারের কবিতা পড়ুন এখানে
nobel prizev:2025 on litterature here
ইসলাম তৌহীদের কবিতা পড়ুন এখানে
মহসিন খোন্দকারের কবিতা পড়ুন এখানে
গল্প বরফের ছুরি পড়ুন এখানে
প্রবন্ধ,উত্তরাধুনিক কাব্যধারার যাত্রাঃ মতিন বৈরাগী-এখানে
প্রবন্ধঃ রাজনীতি ও সাহিত্য পারস্পরিক সম্পর্ক পড়ুন এখানে
কবি মজিদ মাহমুদের গুচ্ছকবিতা পড়ুন এখানে
প্রবন্ধ,নজরুলের রহস্য,পড়ুন এখানে
'বিহ্বল কথোপকথন 'কাব্যে কবি প্রেমিক-প্রেমিকা, সংসার,স্বজন- এসবকে মিলিয়েছেন বেলা অবেলা কালবেলায়। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত কিছুটা অস্পষ্ট উচ্চারণ-ইতস্ততবিক্ষিপ্ত কথোপকথন যেখানে মানুষকে ভালোবাসলেও অকপটে খোলামেলা হৃদয়ের কথা বলতে পারেননি। বিশ্বাস, আস্থা, ভরসা, প্রত্যয়, প্রত্যাশা-বিনষ্ট সংসারে ঘুনপোকার মতো- উইপোকা’র মতোই মনে হয়েছে কবির কাছে। এটাই বাস্তব। এটাই চিরকালীন ধর্ম তথা সংস্কৃতি এই দুনিয়ার।
'দ্রষ্টব্য রোমন্থন'এ এক অন্যরকম ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজবাস্তবতার ঘূর্ণি চক্র সম্বলিত কবিকে দেখি। সত্যিই একজন কবির দৃষ্টিভঙ্গি যে নির্ভর করে তার সমসাময়িক অবস্থা বা প্রেক্ষাপটের ওপর সেটা কবি রায়হান উল্লাহ কবিতায় চোখ বুলালে বোঝা যায়। কোনো সচেতন শিল্পী তার সময় ও সমাজকে কখনো অস্বীকার করতে পারেন না 'মায়াপথিক' তার জলন্ত প্রমাণ হতে পারে। তিনি দেশের গণ্ডি পেরিয়েও দেখেছেন সর্বৈব অসভ্যতা, নোংরামো আর অপরাজনীতির ছড়াছড়ি। এই দায় কোনওভাবেই নাগরিকরা এড়াতে পারেন না বিষয়টির ত্রুটিহীনতার লেশ রাখেননি। করোনাকাব্য-৭ এ তিনি এভাবেই উপস্থাপন করেছেন-
"ভালোবাসা ভেসে যায়, সহাস্য মন,
দূরীভূত মায়া গীত গায়, মনসা
চরাচর ধূলিময়, কী আয়োজন
তারপর তুমুল ভয়,বিবমিষা!"
তিনি জীবনের অস্থায়িত্ব ও ভালোবাসা-মায়ার ভাঙন শেষে যে শূন্যতা ও বিরক্তি এসে ভর করে, সেই সত্যই কাব্যিকভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ করেছেন।
"চোখে রক্ত ঝরে হে সমাজ। তবু হেসে উঠি।রক্তিম হয়েও ভেসে উঠি।ক্রমশ ডুবে যেতে যেতে পাই নির্মল প্রশ্বাস, অক্ষরের লালচে আলো। এভাবেই রক্ত কাব্য লেখা হয়।প্রতিটি পঙক্তি হয় একেকটি চোখ। দেখে সমাজ বিনির্মানের নতুন ভোর।লালাভ গোধূলি ছড়ায় সীমানা।ঘুচে যায় কলুষ।হায়রে মানুষ ফের রক্ত ঝরাও। লেখা হোক রাউর রক্তকাব্য।তোমাদের জন্যই সব পড়ি এবং গড়ি। গলগলে আগুনে ফাগুন বড়ি।"- কবি রায়হান উল্লাহ'র এই 'রক্তকাব্য'টি নিঃসন্দেহে বিপ্লবী চেতনার কবিতা।তিনি সমাজ সচেতনতার কবি।কারণ রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রামকেই সমাজ গড়ার উপাদেয় উপায় হিসেবে দেখেছেন।মানুষের রক্ত ও ত্যাগ দিয়েই সমাজ পরিবর্তন রূপান্তরের সম্ভাবনা দেখেছেন তিনি কিন্তু সমাজবাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। দেখা যায় কালের প্রেক্ষাপটে রক্ত ও ত্যাগও অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। স্বীকার না করার উপায় নেই- তার কবিতা আগামীর আলোর মুখ দেখিয়েছেন। রক্তকাব্যটিতে কবির চোখে রক্ত ঝরলেও তিনি থেমে যাননি বরং হাসিমুখে কাব্য রচনা করেছেন। একাব্যের প্রতিটি অক্ষর যেন রক্তে রঞ্জিত হয়ে সমাজকে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। রক্ত ঝরার বেদনা থেকেও জন্ম নেয় নতুন আলোর, নির্মল শ্বাসের আর সমাজ বিনির্মাণের শক্তি।বলা চলে- ত্যাগ, সংগ্রাম ও সমাজপরিবর্তনের তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ।
"গ্রাম ডাকে। শৈশবের স্মৃতি ঝাপটায়।সময়ের বাঁকে নিয়ন আলোর ছায়া মাপি।অবাক ভালোবাসা ফিরে চলে।সময়কে মুঠোয় ধরতে গিয়ে জীবন বলে- এ কী রঙ্গ! বিশ্বমঞ্চ হাহাকারের মিছিল।মায়ারা ডেকে বলে কীসের শব্দগুচ্ছ, বাহানার সন্ত্রাস।সব ছায়ার সীমারেখা, মায়াদেবীর ত্রাস। এক একটি আলেখ্য ছায়ার বেশে, মায়ার দেশে। দেশ দখল নিয়েছে কাঁটাতার।কাশ্মীরের শিশুটি দেখে- ছেঁড়া সংসার। জীবন এক মোহন ঝংকার। কাটা পড়ে নাড়ী। গ্রামেইর যমজ বন্ধু। সময়, আলো, মায়া, সভ্যতা বন্ধু হতে চায়। এভাবেই সময় বয়ে যায়।ফেরি হয় সবুজ সংসার। লাল বৃত্ত হয়ে সবুজের দখল নিয়েছে।এভাবেই বাংলাদেশ। আটষট্টি হাজার গ্রাম।অগুনতি স্মৃতির ঝাপটা।অবাক ভালোবাসা,লাল সবুজের সংসার। এক একটি মহাকাব্য। কবির সময়।"- বাংলাদেশের সময় কবিতাটিতে তিনি সময় ও সভ্যতার ভীড়ে গ্রামীণ শিকড়, দেশপ্রেম, মানবিক বেদনা ও লাল সবুজের বাংলাদেশের গৌরবময় কাব্যিক চিত্র রূপায়ণ করেছেন।তিনি তার কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে পরাধীনতার কোনও ছাপ ফেলতে চাইনি। ধ্বনি তাল, শব্দের গতি ও ভাবের তালের একটা নিজস্বতা গতিধারার প্রবাহমান পরিলক্ষিত হয়েছে। কবি তার 'বাংলাদেশের সময়' কবিতায় প্রতীক ও চিত্রকল্পের বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। গ্রাম, মায়া, কাঁটাতার, কাশ্মীরের শিশু, লাল-সবুজ ইত্যাদি অনুসঙ্গ দৃশ্যমান করেছেন।এটিকে অমিত্রাক্ষর ছন্দের আধুনিক কবিতা বলা যায়।
মাঝরাতের নিরবতা ভাঙছে
বৃষ্টি ক্ষুদ্র জলকণা
আর মেঘের গুরুগুরু ডাক।
কতটা জল ভূমিতে গড়ালে
আকাশ হেসে ওঠে
তা কেউ জানে না।
কত ভুল সময় পেরোলে
মানুষ হয়ে যায় নির্বাক
আমি তো বুঝি না।
অনেক আশার গাঁথুনি মালা
এ জীবন
ভুল পথে বৃথাই মানুষের
জীবন অন্বেষণ। ( জীবনের মানে)
জীববের মানে কবিতাটিতে কবি মানুষের জীবনযাত্রার অনিশ্চয়তা ও ব্যর্থতার কথার বয়ান দিয়েছেন। প্রকৃতি এবং প্রকৃত লেখাটির সারমর্ম দাঁড়ায়।ভুলই জীবন।ভুলই সংসার।নিশ্চয়তা ও সফলতা বলে এ পৃথিবীতে কিছু আছে বলে মনেই হয়- ভুল পথের পৃথিবীর স্বচ্ছ আয়নার নামই মায়াপথিক। মাটি থেকেই আগমন,মাটিতেই নাড়াচাড়া মাটিরই নাড়াচাড়া। মাটিতেই বেগবান মাটিময় সংসার, মাটিপুত্র ঝংকার।মাটিতেই মিশে যাবে বাঙময় মাটিগাথা বর্ণময় মাটিখাতা। মাটিতেই চুষে খাবে, মাটিসূত্র বিকিকিনি মাটিকাব্য রিনিঝিনি। (মাটিকাব্য) মাটিকাব্য কবিতাটি কবির অসামান্য চেতনারই বহিঃপ্রকাশ যেখানে মানুষের শিকড় মাটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি পরিস্কারভাবে উপস্থাপন করেছেন। মাটিতেই মানুষের জন্ম-জীবন, সৃজন ও মৃত্যুর অবিচ্ছেদ্য কেন্দ্রবিন্দু।
"চারিদিকে হুতাশন সময়ের শবাসন; কথাদের ফিউশন ব্যথাতুর অনশন।"- ঠুনকো কবিতার তৃতীয়াংশে তিনি কবিতায় সমকালীন সমাজ ও সময়ের ভয়াবহতা, দুঃখ-কষ্ট, হতাশা এবং জীবনের সংগ্রামকে প্রতীকীভাবে প্রকাশ করেছেন। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কথাগুলোও যেন সংকট ও ব্যথার কাছে পরাজিত হয়ে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে তা ফুটিয়ে তোলার উপর তিনি জোর দিয়েছেন।
এছাড়াও সময়ের হুল, জীবন পাঠ,লাল রঙের কথা, বৃষ্টি কাব্য,, মানুষ কী আর ধরবে, আমিই অমানুষ, পথিক বঙ্গবন্ধু, কৈফিয়ত, শিরোনামহীন, ওলট-পালট, মায়াজাল, আক্ষেপ, কথাচুর, ধোঁয়ার বৃত্ত এবং দৃষ্টির সীমানা কবিতাগুলো কবি রায়হান উল্লাহ সামাজিক-মানবিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধেই যেন কঠোর আঘাত করেছেন।কবিতাগুলো পড়লেই পাঠক সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন বলে প্রত্যাশা করছি।
কবি রায়হান উল্লাহ তার মায়াপথিক কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধে স্বীকার করেছেন যে এ কাব্যের কোনও কবিতা প্রচলিত নিয়ম না মেনে, ধরাবাঁধা ছক না মেনে, নিয়মকানুন বা কাঠামো না মেনেই লেখা হয়েছে।তবে কবিতার মানদণ্ড বিচারে উৎরে গেলে সেটা হবে একজন মায়াপথিকের এপিটাফ। বলা যায় অনিয়মের মধ্যেও একটা নিয়ম আছে সেটারই রূপায়ণ করার প্রচেষ্টা করেছেন মায়াপথিকে- যা তাকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে প্রত্যাশা।
মায়াপথিক' কাব্যগ্রন্থটি তিনি মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ এবং বেগম হাসনা হেনাকে উৎসর্গ করেছেন। যাদের বদলাতে তিনি আলো-আঁধারির পৃথিবী দেখেছেন আর সৃজন করেছেন মায়াপথিকের কাব্যরেখা।
রৌদ্রছায়া প্রকাশ প্রকাশনী থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৩ শে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। বইটি আসছে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৫৬৭ নম্বর স্টলে এবং অনলাইন পরিবেশক রকমারি ডটকমে পাওয়া যাবে। মায়াপথিকের প্রচ্ছদ এঁকেছেন মাহতাব শফি। ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির দাম রাখা হয়েছে ২০০ টাকা। বইটি পাঠ করে পাঠকের ভালো লাগবে নিঃসংকোচে বলা যায়। সংগ্রহে রাখার মতো একটি বই।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks