জিয়াউদ্দিন লিটন
সিরিজঃ ঝলকের নিচে লুকানো ঘাম
১
অজস্র ফ্লাস, ডিসপ্লে, মুখে জ্যোতির ছলনা,
বেইলী রোডে এখন ঈশ্বরও আলনা।
হাততালি দেয় যারা, তারা কখনো দেখেনি—
মিস্ত্রির হাঁটুতে ফেটে যাওয়া রক্তের মেঘনী।
পথের ধুলোর নাম নেই বিলবোর্ডে,
ঘামের গল্প গলে শুধু চায়ের কাপে—নীরবে।
ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটি বলল,
“আমিও ছিলাম একদিন সেলফি তোলার পেছনে... চল!”
২
ডিসপ্লের মানুষ হাসে, বাস্তবতা কাঁদে,
মাটির গন্ধ ঢেকে রাখে এয়ার-ফ্রেশনারের সাজে।
ব্রেকডাউন হওয়া পুরোনো ভ্যান নিয়ে ছুটে চলে কেউ,
তার ঘামেই দোলে শহরের কারখানার ঢেউ।
তবু তাকেই বলা হয়— ‘আনকালচার্ড’, ‘রাফ’,
যার হাতে তৈরি স্যুটে বসে সিইওর প্রফিটের গ্রাফ।
‘বাজারের রঙে ভেসে যাচ্ছে জীবন,’
সে বলে—
‘আমার নীল শার্টের নিচে জমে থাকা পুরনো চিন!’
৩
একাকীত্ববাদী এক বাজারে আজ অ্যাঙ্গোলার মাছ,
তবু খিদের ছায়া গিলে ফেলে ঢের বেশি হাওয়া।
ছেলেটি দেখে—চকচকে এক রেস্তোরাঁর কাচ,
তিনটে মাছের দামে তার বাবার রোজগারও না পাওয়া।
‘আনকালচার্ড’ সে নয়, শুধু স্তব্ধ বোবা,
কেউ শেখায়নি তাকে—কনফারেন্সে কীভাবে কথা বলা।
তার চোখে আটকে থাকে এক বাক্য ভারী—
“গরিব হলে মানুষও হয়ে যায় খাঁচার অ্যাঙ্গোলা।”
৪
অচিন তেপান্তর নয়—ওই শ্রমিক কলোনি,
যেখানে সকাল মানেই নয়টার আগে গগনভেদী ঘণ্টাধ্বনি।
ধোঁয়ার ভেতর গড়ে ওঠে ভবিষ্যতের খাঁচা,
তবু শ্রমিকের মেয়ে কলেজের টাকাই পায় না বাঁচা।
একেশ্বরবাদী সিস্টেমে বসে মুনাফার ঈশ্বর,
তাদের খাতাই ছিঁড়ে যায় বারবার—নিঃশব্দ পর।
তারা বলে না কিছু, কেবল কানে বাজে গান—
“শ্রমই জীবন, কিন্তু জীবনটা কার?”
৫
তার পকেটে রাখা পাঁচ টাকার পাউরুটি হাঁপায় ভেতর থেকে—
চেপে বসা হতাশার জ্বালা।
সে ভাবে— “ঈশ্বর কি শুধু চার্চের ভেতর থাকেন?”
তার ঈশ্বর লুকায় ভাঙা বেলচা, রক্তাক্ত টায়ারের চেন।
জ্যামের ভিড়েও ঈশ্বর দাঁড়িয়ে থাকেন দেরি করে,
তাদের পায়ে পুঁজ জমে—শহর গিলে খায় কারখানার গহ্বরে।
তবু সে বলে, কষ্টের ভেতর হাসি মিশিয়ে—
“আমরা যন্ত্র না, ভাই... যন্ত্রটাই তো আমরারে খাইছে!”
৬
নটরাজ নাচে—পেছনে পড়ে শ্রমিকের নামহীন ছায়া।
একদিন তারা লিখবে পোস্টারে, দেয়ালে, ম্লান আলোয়—
“ঘাম মানে শিল্প, ঘাম মানে খিদে, ঘাম মানেই মায়া।”
সেদিন ফ্লাস নেবে পলিটেকনিকের ছেলেটা,
ডিসপ্লেতে ঝুলবে তার বানানো ব্যাটারির দামটা।
আর শহর জেগে উঠবে ধীরে ধীরে—
কবিতার মতো এক নিঃশব্দ বিপ্লবে...
যেখানে ঘামই হবে নতুন ফ্যাশন লাইন।
সিরিজঃ বনসাইয়ের বাইরে বন
সংসদের টেবিলে রাখা হলো বনসাই—
যেন সবুজতার ভদ্র সংস্করণ
যার শিকড় কাগজের নিচে বন্দি।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একপদী গণ্ডার,
চোখে সংসদের ভোট—
শীতের সকালের কুয়াশার মতো,
ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না।
ভাষণগুলো ঝরে পড়ে
আলকাতরার কালো স্রোতে,
ঢেকে দেয় শিশুর হাসি,
গানের কণ্ঠ, বাতাসের গন্ধ।
ওরা জানেনা,
বনসাইয়ের টেবিল ছিঁড়ে,
শিকড় ফুঁড়ে উঠবে আসল বন।
সিরিজ কবিতা বনসাইয়ের বাইরে বন
২
সংসদ ভবনের জানালায়
ঝুলছে লাল-সবুজ পর্দা—
যেন ভোরের কুয়াশায় ঢাকা পতাকা।
চায়ের কাপে আলোচনার ঢেউ,
কেউ বলে নদী বাঁচাতে হবে,
কেউ বলে বন্দর বেচে দাও।
তাদের চোখে নৌকার পাল
কাগজের মতো পাতলা।
যে নৌকা তীরে বাঁধা,
সে নদীর খরস্রোত বোঝে না,
কেবল পতাকার রঙ গুনে।
একটি চেয়ার বড় হতে হতে
গিলে খেলো টেবিল, ঘর, বারান্দা—
শেষে শহরও তার পায়ের নিচে।
দেয়ালের ক্যালেন্ডারে একই ছবি,
শুধু বছর বদলায়, মুখ নয়।
প্রতিদিন নতুন মেঝেতে পুরনো ধুলো
মাথা উঁচু করে হাঁটে।
মানুষের হাঁসফাঁস যেন বাতাসে মিলছে,
শব্দ হয়ে ছুঁয়ে যায় দেয়ালের কপাল।
শেকড় কেটে দিলে গাছ পড়ে,
চেয়ার দাঁড়ায়,
আর মানুষ তার ছায়ায় ঢেকে যায়।
কেউ জানে না সুর কোথা থেকে আসছে।
বাতাসে ভেসে আসে পুরনো শপথের গন্ধ,
পথের ধুলোয় লেখা অদৃশ্য গল্প।
পোস্টারে লেখা প্রতিশ্রুতিরা বৃষ্টিতে ভিজে মুছে গেছে,
তবু বক্তৃতার মঞ্চে আলো জ্বলে।
যে বাঁশি শোনে না, তার সুর চুরি হয়ে যায়,
শহরের চেতনায় আবারও ঘনিষ্ঠ হয়ে বাজে।
পঞ্চম পর্ব "আকাশের রঙ বদল"
প্রতিদিন সকালে আকাশ রঙ করে
কেউ এক অদৃশ্য চিত্রকর—
আজ নীল, কাল ধূসর, পরশু হয়তো রক্তিম।
পাখিরা দিশেহারা,
কোন দিকে যাবে জানে না।
শহরের ছাদে কাপড় শুকোয়,
তার মাঝে লুকিয়ে থাকে পতাকা।
ছায়ার খেলায় হারিয়ে যায় অচেনা সীমানা,
নতুন দিনের আলোও আড়াল গোপন করে।
রঙ বদলানো আকাশে দিকনির্দেশ মেলে না,
কেবল শহরের নিঃশ্বাসের ছন্দে পথ খুঁজে নেয় মানুষ।
তাতে উঠেছে বাজার,
পত্রিকা অফিস, ভোটের মঞ্চ।
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষরা
ভেবেছে ট্রেনটি একদিন চলবে,
কিন্তু ইঞ্জিনে জ্বালানি নেই।
ধুলোয়ের স্তর ঢেকে রেখেছে পুরনো সীমানা,
দূরে ঝুলছে শহরের অচেনা আলো।
যে ট্রেন চলে না, তার ভাড়া সবচেয়ে বেশি,
আর মানুষের আশা দাঁড়িয়ে থাকে ছাদের ওপর, চুপচাপ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks