বাংলা কবিতায় বর্ষা।। আলম মাহবুব।। article by alam mahbub-kuasha

বাংলা কবিতায় বর্ষা।। আলম মাহবুব।। article by alam mahbub-kuasha





বাংলা কবিতায় বর্ষা
আলম মাহবুব


প্রবন্ধ


একথা বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না যে বর্ষা আমাদের কাব্যের ঋতু। শ্রাবণের প্রথম ধারা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার প্রকৃতি যেমন শ্যামলে সবুজে জেগে ওঠে, তেমনি জেগে ওঠে কবির কলমও। এ যেন বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ভাষার নিজস্ব জলধারায় ভেসে চলা। যে কবিতায় বৃষ্টি নামে সেখানে কেবল মেঘ-বাদলের ছবি নয়, থাকে প্রেমের আকুলতা। ভেজা জানালার পাশে অপেক্ষা, কখনোবা বুকে জমে থাকা অন্বয়ের ব্যথা। বাংলা কবিতায় বর্ষা যেন এক জলে ভেজা লাস্যময়ী স্বতন্ত্র নায়িকা, তার গায়ে কোমল মাটির ভেজা গন্ধ, চুলে ঘন কুয়াশার পরশ। চোখে জল আর বিরহ কাতরতার বিষাদের দ্যুতি।

"গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা/ কুলে একা বসে আছি নাহি ভরষা।" কিংবা "নীল নভোঘনে আষাঢ় গগনে/ তিল ঠাঁই আর নাহিরে — ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।" কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন করেই বর্ষার চিত্র অঙ্কন করেছেন। শুধু কবিগুরুর কথাই বা বলি কেন আমার তো মনে হয় বাংলা ভাষার যতো কবি আছে সেই আদি কবি থেকে আজ অবধি এমন কোন কবিই নেই যে বর্ষাকে নিয়ে দু'এক পঙক্তি লিখেননি। তাই বলাই যায় বাংলা কবিতায় ঋতুচক্রের প্রভাব বিশেষ করে বর্ষা ঋতুর প্রভাব সুপ্রাচীন। বর্ষা বাংলা কবিতার এক অনিবার্য ঋতু। কখনও সে প্রেমিকা, কখনও অভিমানিনী, কখনও আবার প্রলয়-সখা। বাংলার মাটি, নদী, কৃষক, আকাশ—সবকিছুতেই এই ঋতুর এক গাঢ় ছায়া পড়ে থাকে। কবিরা সেই ছায়া ধরে রেখেছেন শব্দে, ছন্দে, চিত্রকল্পে। তাই বলা যায়, বাংলা কবিতা বর্ষায় শুধু ভেজে না, বর্ষাতেই কখনও জন্ম নেয়।

বর্ষা মানেই কেবল বৃষ্টিপাত নয়—এ এক অন্তর্গত আর্তি, বহমান বিষণ্ণতা, কিংবা এক পরম প্রতীক্ষার প্রতীক। “বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর”—এই ছেলেবেলার সরলতা থেকে “সব বৃষ্টি চোখের ভিতর”—এই আধুনিক বিষণ্ণতার পথে বর্ষা হয়ে উঠেছে সময় ও সত্ত্বার অনুবাদ। চর্যাপদের কবিরাও 'ধরতি ধূসর' কিংবা 'জল ভইলা চলন্ত নদী' ইত্যাদি চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে বর্ষার ব্যঞ্জনা ছুঁয়েছেন। মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্য, পদাবলি সাহিত্যে বর্ষার প্রসঙ্গ এসেছে কৃষিপ্রধান সমাজ জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে কিন্তু আধুনিক বাংলা কবিতায় বর্ষা এক স্বতন্ত্র রূপ ধারণ করে — সে হয়ে ওঠে অনুভূতির বাহক। বৈষ্ণব কবিরা বর্ষাকে প্রেম ও বিরহের সময় হিসেবে তুলে ধরেন। মেঘ, বিজলি, গগন—সবকিছু প্রেমিক রাধা ও কৃষ্ণের মিলন-বিরহকে ছায়া দিয়ে রচনা করে এক পৌরাণিক আবহ।

বিদ্যাপতি লিখছেন:"কাঁদে মেঘ, কাঁদে পিপীলিকা,/কাঁদে নদী সলিল-ভরা।/কাঁদে রাধা কানু বিনা,/কাঁদে মন অকারণ ধরা।"

এই বৃষ্টির মধ্যে বিরহ আছে, প্রত্যাশা আছে, আবার এক ধরণের আধ্যাত্মিক আকুতি রয়েছে। বর্ষা তাই বাংলা সাহিত্যের এক প্রাচীন কাব্যিক থিম হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষাকে দেখেছেন বহুরূপে—প্রেমের, প্রকৃতির, আধ্যাত্মিকতার, এমনকি রাজনৈতিক ইঙ্গিতের প্রতীক হিসেবে। তাঁর কবিতায় বর্ষা কখনও বিষণ্ণ, কখনও উচ্ছ্বসিত, আবার কখনও এক গোপন প্রেমের দ্যোতক।

‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় তিনি লেখেন:" দিগন্তের চারি পাশে আষাঢ় নামিয়া আসে/ বর্ষা আসে হইয়া ঘোরালো,/ সমস্ত আকাশজোড়া  গরজে ইন্দ্রের ঘোড়া/ চিকমিকে বিদ্যুতের আলো।"

এই বর্ষায় মিলন আছে, কিন্তু তা যেন হৃদয়ের গভীরতম গোপনে ঘটে। আবার ‘সোনার তরী’ বা ‘নবজাতক’-এর মতো কাব্যে বর্ষা যেন জীবনচক্রের এক অনিবার্য অধ্যায়।

রবীন্দ্রনাথের প্রাকৃতিক বর্ণনায় বর্ষা কখনও প্রেমময়ী নারী, আবার কখনও মৃত্যুর সংকেত। সেই দ্বৈততা তাঁর কবিতার গভীরতাকে বাড়িয়ে দেয়।





জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বর্ষা এক ধরণের ‘আভ্যন্তরীন ঋতু’। তিনি বর্ষাকে বাহ্যিক প্রকৃতি নয়, বরং নিজের নিঃসঙ্গতা, অস্তিত্ব, সময়চেতনা ও অতীতচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে দেখেন। তাঁর কাব্যে বর্ষা যেন নিঃশব্দ এক বিলুপ্তির অনুভব।

জীবনানন্দের বর্ষা কল্পনার ভেতরেই বেশি বয়ে চলে। তা একা, ধূলিধুসর, সময়ছাপা—এক ধরনের গভীর লোকান্তর।

শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, কিংবা নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় বর্ষা হয়ে ওঠে সময়ের ভাষ্য। পঞ্চাশ-ষাট দশকের কবিতায় বর্ষা আর প্রকৃতির উৎসব নয়, বরং এক নাগরিক দারিদ্র্য, ক্লান্তি, প্রেমহীনতা, এবং কখনও দ্রোহের প্রতীক।

শামসুর রাহমান লিখছেন: "এই বৃষ্টিভেজা দিনে, কেউ নেই পাশে/ শুধু ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছি/ আমারই মতো নীরব ছাতার নিচে।"

আধুনিক বর্ষা তাই একাকীত্বের অনুপম অনুরণন। সেখানে নদী নেই, মাঠ নেই—আছে ছাদ, কংক্রিট, ট্র্যাফিক, এবং স্মৃতি।

জসীমউদ্দীনের কবিতায় বর্ষা যেন গাঁয়ের মাটি, ধানের চাষ, কাদা, জল, আর মানুষের নিঃস্বতা নিয়ে তৈরি এক জীবন্ত ক্যানভাস। তিনি লিখেন:“চুপকে চুপকে বৃষ্টি নামে, কেঁদে উঠে বাঁশবন/ গরিবের বুকের ভিতর বেদনার বিষণ্ণ মন।”

আল মাহমুদের কবিতায় বর্ষা নারী শরীরের মতো—উগ্র, উর্বর, কামনা ও কৃষির একরাশ চিত্ররূপ:"তোমার রঙিন শাড়িতে বৃষ্টির জল/ আমার ধানের মাঠে ঝরে পড়ে প্রতিদিন।" এখানে বর্ষা একপ্রকার নারীপ্রকৃতি—যেখানে শরীর, প্রকৃতি ও ভাষা একসূত্রে বাঁধা।

বাংলা কবিতায় বর্ষা শুধু প্রকৃতি নয়, এক ধরণের প্রতীক। অনেক সময় বর্ষা হয়ে উঠেছে অপেক্ষার রূপক—প্রেমিক আসবে কিনা, ফেরাবে কিনা, সেই অনিশ্চয়তায় ভেজে মন।

কখনও বর্ষা বিচ্ছেদের প্রতীক—ভিজে উঠেছে বুক, জানালার কাচ, কিন্তু ফেরেনি কেউ।আবার কখনও বর্ষা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা—দগ্ধ সময়ের মাঝে একটু প্রশান্তির ফোঁটা।

প্রশ্ন আসে—বর্ষা কি কেবল একটি ঋতু? না, বাংলা কবিতায় বর্ষা এক অন্তর্লীন সত্ত্বা—যে কখনও প্রেম, কখনও প্রত্যাশা, কখনও আধ্যাত্মিকতা, কখনও বিপ্লব। বর্ষা কখনও শরীর, কখনও আত্মা।

বর্ষা বাংলার প্রেমিক কবির ঋতু। বৃষ্টির শব্দ যেন চিঠির মতো দরজায় কড়া নাড়ে। নারী জানালার পাশে বসে চুল শুকোয়, পুরুষ জলে পা ভিজিয়ে ফিরে আসে পুরনো রাস্তায়। এমন দৃশ্য বাংলা কবিতায় অনেকবার এসেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন:“আকাশ ভেঙে নামে জল, আর আমি জানি—/

তুমি এখন অন্য কারও পাশে দাঁড়িয়ে আছো ছাতার নিচে।” এই বর্ষায় আছে প্রণয়, অথচ আছে নিঃসঙ্গতাও। তরুণ প্রেমিকের প্রথম ভেজা চিঠি যেমন বর্ষায় লেখা হয়, তেমনি দীর্ঘ প্রেমের শেষ চোখের জলও বর্ষার ধোঁয়াটে বিকেলে ঝরে পড়ে। শঙ্খ ঘোষ তাঁর কবিতায় বলেন: " বৃষ্টি হয়েছিল পথে সেদিন/..........  বৃষ্টি নয়, বিন্দুগুলি শেফালি টগর গন্ধরাজ/। আবার রবীন্দ্রনাথ পশ্ন রাখেন : “এমন দিনে তারে বলা যায়— /এমন ঘন ঘোর বরিষায়?” এই লাইনটিতে 'বলা যায়' শব্দদুটি যেন কবির দীর্ঘকাল চেপে রাখা ভালোবাসা উচ্চারণের মুহূর্তে এসে মেঘের গর্জনের সঙ্গে মিশে যায়। বর্ষা তাই শুধু দৃশ্য নয়, একটি মনস্তত্ত্ব—একটি নিরব অভিব্যক্তি।

গ্রামের বর্ষা আর শহরের বর্ষা এখন আর এক নয়।

গ্রামে বর্ষা মানে শিশুদের ছাতা-ছাড়া দৌড়, কচুপাতায় জল গড়িয়ে পড়া, হাঁসের পাল আর রেইনকোটহীন ভিজে যাওয়া চাষী। মায়ের হাতে বোনা পান্তাভাত, বাবার হাতে ধরা কঞ্চির ছাতা, কিশোরীর মাটির ঘরে বসে গান গাওয়া—এসব গ্রামবাংলার বর্ষায় স্বাভাবিক। আর শহরে বর্ষা মানে ট্র্যাফিক জ্যাম, ভিজে ফেলা বইয়ের ব্যাগ, বৃষ্টির দিনে ছুটির স্বপ্ন। বাংলা কবিতায় এই দুই রূপই ধরা পড়ে। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা: "বর্ষা নামে—/

নালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমিক কাঁপে—/ কারণ আজ সে ছাতা আনেনি।" শক্তির এই হালকা হাস্যরসের আড়ালে বর্ষার নগরজীবন ভীষণ মানবিক হয়ে ওঠে।

বর্ষা কেবল জল ঝরায় না, সে সময়কে আলগা করে দেয়। সমস্ত সময় যেন থেমে যায় বৃষ্টির শব্দে। জানালার পাশে বসে থাকা, দিনের পর দিন ভিজে আসা পত্রমেলা, কাদামাটি ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে পুরনো কোনো প্রেমের স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া—এ সবকিছুই এক ধরনের অলৌকিক সময়চক্র তৈরি করে। এ যেন শব্দের সঙ্গে, আলো-ছায়ার সঙ্গে মিশে থাকা সময়। কবিতায় এই সময় অভিব্যক্ত হয় দীর্ঘশ্বাসে, অপেক্ষায়, কিংবা কোনো উচ্চারণহীন দৃষ্টিতে। কবি আল মাহমুদের ভাষায়— “বর্ষা আসে প্রিয়তমার মতো/ নিঃশব্দে—মনে হয় চুম্বনের মতো বৃষ্টি পড়ে।” এই চুম্বনের মতো বৃষ্টি বাংলা কবিতায় এক স্নিগ্ধ অথচ গভীর আমেজ বা চিহ্ন রেখে যায়।

বর্ষা বাংলা কবিতায় কখনো শেষ হয় না। প্রকৃতি বদলায়, কবিরা বদলায়, কিন্তু শ্রাবণের প্রথম ফোঁটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা কবিতা জেগে ওঠে। এ এক চিরকালীন পুনর্জন্ম—ভাষা, অনুভব, আর স্মৃতির।

এই বর্ষায় কেউ কারো জন্য চিঠি লেখে, কেউ ভিজে জানালায় তাকিয়ে থাকে, কেউ পুরনো প্রেমিকার নাম মনে করে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকে, কেউবা চুপচাপ কাঁদে। আর কবি? কবি শুধু লিখে যান—শব্দে, ছন্দে, জল-ছায়ায়। কারণ বাংলা কবিতা ও বর্ষা কখনোই আলাদা হয়ে থাকতে পারে না।

এই বৃষ্টির শব্দে যে রকম টিনের ছাদ কাঁপে, সেইরকম কাঁপে কবির অন্তরও। সে কারণে বাংলা কবিতা যত দিন বেঁচে থাকবে, বর্ষার শব্দ, ঘ্রাণ ও ছায়া ততদিন তার কবিতায় বেঁচে থাকবে—ফোঁটা ফোঁটা জলে ভেজা হয়ে। তাই বলাই যায় —বৃষ্টি মানেই কেবল প্রাকৃতিক রোমাঞ্চ নয়, তা এক ভাষা, এক স্মৃতি, এক অনুভব আর বৃষ্টির ফোঁটায় ভেজা কবিতার ছন্দ। 



--

with thanks & regards____

image

দ্বীপ সরকার

editor of kuasha

+88001719751792

kuasha.mag@gamil.com

https://mkuasha.blogspot.com/

facebook

twitter

linkedin



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন