প্রবন্ধঃ
নজরুল জীবনের কিছু রহস্য এবং কাব্য অদৃষ্টবাদ
গাজী গিয়াস উদ্দিন
গাজী গিয়াস উদ্দিন
বাংলা কাব্যে ভাব- ভাষা ও ছন্দের দিক থেকে রবীন্দ্র বলয় ভেঙে নতুন ধারা সৃষ্টির কারণে নজরুলকে রবীন্দ্র ভক্তদের পক্ষ থেকে নিন্দা - সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। এমনকি তিরিশের কবিরা ছিলেন নজরুল সাহিত্য বিমুখ।
১৯২০-১৯২৯ এ বিশের দশকটাই নজরুলের সাহিত্য সৃষ্টিকাল।৩০ এর দশকে নজরুল জীবনে সঙ্গীতই প্রাধান্য লাভ করে। তখন তিনি গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত - চলচ্চিত্র পরিচালক। এরপর অসুস্থ নির্বাক দিনযাপন ১৯৪২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩৪ বছর।
ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর ' নজরুল গবেষণা ঃ ধারা ও প্রকৃতি ' প্রবন্ধে নজরুল জীবনের রহস্যাবৃত চারটি মূল ঘটনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।রহস্যগুলো ছিল -
১
আপন মায়ের সাথে নজরুলের তিক্ত সম্পর্কের কারণ আবিষ্কার। এ রহস্যের উৎস নির্দেশনায় ড. আজাদ লিখেন- ' মৃত্যু শয্যা থেকে জাহেদা খাতুন পুত্রকে শেষ একনজর দেখতে চুরুলিয়ায় যাওয়ার খবর পাঠালেও নজরুল মাকে দেখতে যাননি।
২
নার্গিস নজরুল সম্পর্ক ঃ বিচ্ছেদ ঘটিত বিতর্কটি এখনো অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও অমীমাংসিত।
৩
নজরুল ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন প্রক্রিয়া। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রারম্ভিক কালে (১৯২০) নজরুল পার্টি সংগঠক মুজাফফর আহমদের সহকর্মী ছিলেন। অথচ নজরুল ক্রমশ পার্টি গঠন প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন। এর তাৎপর্য এখনো অনির্ণীত। এ প্রশ্নে ড. আজাদ লিখেন,কবির পক্ষে সবসময় পার্টির শৃঙ্খলা মেনে চলা সম্ভব হবে না বলে নজরুল পার্টির সদস্যপদ নেননি বলা হলেও বিষয়টির মীমাংসা আরো জটিল।
৪
নজরুলের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া, তদসংশ্লিষ্ট ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞ মন্ডলী প্রণীত সর্বশেষ প্রতিবেদনে রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে কোন মন্তব্য অনুপস্থিত। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন কোন রোগে তিনি গোপনে ভুগছিলেন, যার পরিণতিই ছিল ওই দুরারোগ্য মারাত্মক ব্যাধি। এ প্রসঙ্গে ড. আজাদ আরো লিখেন,চিহ্নিত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়েও বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা না করে নজরুল সত্য গোপন করেন বলে বন্ধু কমরেড মুজাফফর মন্তব্য করেছেন। (সূত্র : দৈনিক আল মুজাদ্দেদ সাময়িকী ১০ জৈষ্ঠ্য ১৪০৩ সংখ্যা)
'নজরুল স্মৃতি প্রথম দর্শন' প্রবন্ধে ( সাময়িকী দৈনিক জনকণ্ঠ ২৭ আগস্ট ১৯৯৯ সংখ্যা) ড. আশরাফ সিদ্দিকী শান্তি নিকেতনে পড়ার সময় তাঁর স্মৃতিচারণ করেন।১৯৪৬ সালে নজরুলের গ্রামের বাড়ি চুরুলিয়া ভ্রমণ সম্পর্কে ঃ স্থানীয় ( চুরুলিয়া গ্রামে) লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, নজরুল ১৯২১ এর পর বাড়ি আসেননি।ভাইরা খুব দরিদ্র। চাষবাস এবং কয়লাকুঠিতে খেটে খাওয়া মানুষ।.... কে এক মহিলা পানি খাওয়ালেন। মহিলার দেখলাম নজরুল সম্পর্কে বেশ বিরক্তি ভাব।আঞ্চলিক ভাষায় বললেন - ' মাকেও দেখতে আসে নাই, কলকাতায় তিনি ছিলেন লক্ষপতি। হিন্দু মেয়ে বিয়ে করে সেখানেই ছিলেন। এখন নাকি জবান বন্ধ - অসুস্থ। '
ড. আলী রেজার প্রবন্ধ পড়ুন এখানে ক্লিক করে
মোহাম্মদ জসিমের ভিন্ন রঙের কবিতা পড়ুন এখানে
জিল্লুর রহমান শুভ্র'র ভিন্ন স্বাদের কবিতা পড়ুন এখানে
ড. সিদ্দিকী নজরুলের ফুফাতো ভাই কাজী আনোয়ারুল ইসলামের নিকট থেকে কবির অসুস্থতার প্রাথমিক অবস্থার একটি করুণ দুঃখজনক কাহিনি শোনেন। ড. সিদ্দিকীর প্রবন্ধের ভাষায় তা হচ্ছে : একদিন হিজ মাস্টার ভয়েস কোম্পানি থেকে কাজ সেরে (১৯৪০-৪১) কবি বাসায় ফিরছেন। শ্যামবাজারের কাছে এলে একটি বাড়ির দোতলা দালান থেকে কজন মেয়ে কাজীদা কাজীদা বলে চিৎকার.... সম্ভবত তারা কবির কাছে গান শিখত।গান শিখিয়ে রাত দ্বিপ্রহরে নেমে এলেন রাস্তায়। এমন সময় পাড়ার কিছু ষন্ডা গুন্ডা ধর ধর চিৎকার, হকিস্টিক দিয়ে পেটানো শুরু করল।নজরুল খালি হাতেই যুদ্ধ করলেন। মাথার পিছনে প্রচন্ড আঘাতে রক্ত ঝরছিল। ড্রাইভার বাসায় নিয়ে এল।বাসায় কান্নাকাটি। বাড়িতেই চিকিৎসা হল, অভাব দারিদ্র্য, অসুস্থতা বাড়তে লাগল।দৈনিক ইনকিলাব ৫ এপ্রিল ২০২৪ সাহিত্য বিভাগে গবেষক ইসরাইল খান লিখিত " প্রতিভা বসুর বর্ণনায় ওস্তাদ নজরুল " প্রবন্ধে প্রতিভা বসু কর্তৃক নজরুলের উপর হামলার অনুরূপ ঘটনার কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম বয়ান পাওয়া যায়।
শোষণ-শাসন আর পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধারের যে আপসহীন সংগ্রামী চেতনা কবি তাঁর কবিতা, গান ও রাজনীতির মাধ্যমে লালন করছিলেন।সে স্বপ্নে কবি এতটা বিভোর ছিলেন যে,কবির মাঝে তখন আর কোন পিছুটান ছিল না।তাছাড়া দুঃখ দারিদ্র্যের অতীত দুঃসহ স্মৃতি তাড়িত কবির মন চাইছিল না।তাই হযতো কবি আর চুরুলিয়া ফিরে যাননি।তাই বলে মৃত্যু শয্যাশায়ী মায়ের ডাকেও কি নয়? মানবতা পূজারী যে কবির হৃদয় বিগলিত হতো সাধারণ মানুষের দুঃখ দারিদ্র্য আর রোগ শোক দেখে। যে হৃদয়বান কবির প্রাণ কেঁদে উঠতো মানবেপ্রমে,সে কবির মাঝে কি জননীর স্মৃতি বা স্পর্শকাতরতা এতটুকু কাজ করেনি? তাহলে কি মায়ের প্রতি তাঁর কোন গোপন অভিমান ছিল - ছিল কোন কঠিন তিক্ততা? এ প্রশ্ন নিতান্তই মানবিক। তবে মাকে নিয়ে কবির একটি কবিতায় পাওয়া যায় -
মাগো আমি জানি জানি / আসবে আমার অভিমানী / খুঁজতে আমায় গভীর রাতে এই/ আমাদের কুটীর দ্বারে/ বলো তখন খুঁজতে তারেই হারিয়ে গেছি / অন্ধকারে।
তবুও প্রশ্ন রেখে যেতে হয় - মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের ডাকে কোমল কবি মন সেদিন কেন সাড়া দেয়নি? কবি জীবনের ইতিহাসের বাস্তব সত্য বিচারে তথ্য উদঘাটনের মাধ্যমে নজরুল ভক্ত ও পাঠকদের এ কৌতুহল থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া প্রাজ্ঞ - অভিজ্ঞ গবেষকদের দায়িত্ব।
আবদুল মান্নান সৈয়দ অগ্রপথিক নজরুল জন্মশতবার্ষিকী সংখ্যা ১৯৯৯ লিখিত প্রবন্ধে উল্লেখ করেন,মুজাফফর আহমদ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং তার সঙ্গে একই ঘরে সহবাসী হয়েও নজরুল কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেননি- নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছেন...'।
এবারে নজরুলের প্রথম বিয়ে প্রসঙ্গ। একুশ বছরের নজরুল কুমিল্লার দৌলতপুরে এসে নার্গিসের প্রতি আকৃষ্ট হন।১৯২১ সালের জুন মাসে নজরুল - নার্গিস বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বিবাহ বিচ্ছেদের ১৬ বছর পর ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নজরুল কলকাতা থেকে নার্গিসকে যে সুদীর্ঘ পত্র লেখেন,তাতে কবি লিখেন," আমার অন্তর্যামী জানেন,তোমার জন্যে আমার হৃদয়ে কি ক্ষত,কি অসীম বেদনা।কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি।তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি।তুমি আগুনের পরশ মাণিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না, আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।" ১৯৩৭ সালের ৪ নভেম্বর কলকাতার হোটেলে গিয়ে কবির সাথে দেখা পর্যন্ত করেছিলেন বিরহী নার্গিস।
নজরুল ও আলী আকবর খানের পরিচয় ও বন্ধুত্ব ঘটে রণাঙ্গনে।জনাব খান কমিশন্ড অফিসার হিসেবে প্রথম মহাযুদ্ধে নজরুলের মতো অংশ নিয়েছিলেন। তার সাথেই নজরুল দৌলতপুরে বেড়াতে এসে দীর্ঘ আড়াই মাস অবস্থান করেন।এ সময়টি নজরুলের শুধু প্রেমের নয়,সাহিত্য জীবনেরও এক গৌরবময় অধ্যায়। এখানে কবি ছায়ানট, পুবের হাওয়া, দোলন চাপা,ঝিঙেফুল ও চক্রবাকের বহু কবিতা লিখেন।
বাংলা ১৩২৭ সালের ২১ চৈত্র কবি দৌলতপুর পৌঁছেন কলকাতা থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত ট্রেনযোগে। ২৩ চৈত্র নজরুল খানের সাথে তার বাড়িতে আসেন।কবিতা গান আর আড্ডার মাধ্যমে কবি অল্প দিনের মধ্যে আপন করে নেন খাঁ বাড়ির লোকজন সহ পুরো গ্রামের ছোটবড় সবাইকে। আলী আকবর খানের মেঝো বোন ইখতিয়ারুন নিসাকে নজরুল মা ডাকতেন। তারই মেয়ে নার্গিসের সাথে সে বাড়িতে আগমনের এক মাস পর নজরুলের পরিচয় ঘটে নার্গিসের বড় ভাইয়ের বিয়ে অনুষ্ঠানে। পরে নজরুলের ইচ্ছে অনুযায়ী বিয়ের দিন ঠিক হলো ৩ আষাঢ় -১৩২৮ মোতাবেক ১৭ জুন ১৯২১ সালে। কমরেড মুজাফফর আহমদ এ বিয়েতে তাঁর ঘোর আপত্তি ও প্রতিবাদ জানিয়ে কবিকে চিঠি লিখলেন। বিয়েতে নার্গিসের মামা আলী আকবর খান কর্তৃক নিমন্ত্রিত হয়ে সেনগুপ্ত পরিবার কুমিল্লা থেকে আসেন।শেষপর্যন্ত বিয়ে হয় বাসরও হয়।বাসর রাত সম্পর্কে নার্গিস বলেন, বিয়ে হলো বাসর হলো। ও আমাকে বাসর রাতেই তার সঙ্গী হয়ে দৌলতপুর ত্যাগ করতে বললো।কত মিনতি করলাম।তবু ভুল বুঝলো।ছুটে গেল বিরজা সুন্দরী দেবীদের সাথে পরামর্শের জন্য। কিন্তু কবি আর দৌলতপুরে ফিরে আসেননি।পরে ২৩ জুন ১৯২১ কুমিল্লা ফিরে কবি সেন বাড়িতে উঠে মামা শ্বশুর আলী আকবর খানকে লিখেন,বাকি উৎসবের জন্যে যতো শীঘ্রই পারি বন্দোবস্ত করবো।ইতোমধ্যে ৮ জুলাই কমরেড মুজাফফর এসে কবিকে নিয়ে গেলেন কলকাতায়। ১৯২৪ এর ২৫ এপ্রিল তাঁর মধ্যস্থতায় নজরুল - প্রমীলা বিয়ে হলো।
এরপর নার্গিস নজরুলকে চারটি চিঠি দেন।লিখেছিলেন- 'আমি যে আজও পথ চেয়ে আছি'। নজরুল ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই মাত্র একটি চিঠির উত্তর দেন।কবি লিখেন- ' যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তারে'।১৯৩৮ সালের ১২ ডিসেম্বর দীর্ঘ ১৭ বছর পর নার্গিসকে তার আত্মীয় স্বজনরা কবি আজিজুল হাকিম এর সাথে বিয়ে দেন।এ বিয়েতে নজরুল শুভেচ্ছা স্বরূপ ' পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরাণ প্রিয় ' গানটি লিখে পাঠান।তার সাথে চিরকুট লিখেন,' জীবনে তোমাকে পেয়েও হারালাম।তাই মরণে পাব,সেই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব। প্রেমের ভুবনে তুমি বিজয়িনী, আমি পরাজিত। আমি আজ অসহায়। বিশ্বাস করো,আমি প্রতারণা করিনি।আমাদের মাঝে যারা এ দূরত্বের সৃষ্টি করেছে, পরলোকেও তারা মুক্তি পাবে না। তোমার নবযাত্রা শুভ (সুখের) হোক।নিত্য শুভার্থী নজরুল ১ ডিসেম্বর ১৯৩৮'। সমালোচকদের মতে,নজরুল জীবনে নার্গিস ছিলেন তেমনি,যেমনি দান্তের জীবনে বিয়াদ্রিচ,শেলীর জীবনে এমিলিয়া আর কীটসের জীবনে ফ্যানি ব্রাউন - ট্রাজেডি। কবি জীবন মাত্রই শত রহস্যের। এ সবের উর্ধ্বে উঠেও বলা যায় - কবিতায়, গানে প্রেমে ট্রাজেডিতে কাজী নজরুল ইসলাম ' মহান কবিভাগ্য' নিয়েই জন্মেছিলেন। তাঁর শুরু ও সমাপ্তি একজন বিশ্ববিশ্রুত কবি হিসেবে উজ্জ্বল ও বর্ণাঢ্য। ইতিহাসে এটাই কাব্য অদৃষ্টবাদ।
লেখকঃ
গাজী গিয়াস উদ্দিন
লক্ষ্মীপুর ৩৭০০
০১৬১২৯৪২২৯৬
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks