কবি আমিনুল ইসলাম মুল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ।। শেখ ফজলুল করিম।। article of aminul islam by sheikh fozlul karim--kuasha

প্রবন্ধঃ


আকাশের ঠিকানায় সাগরের চিঠি’ ঃ
কবিতা অথবা জীবনালেখ্য

শেখ ফজলুল করিম



ভালোবাসা-ঘৃণা, হিংসা-বিদ্বেষ পরিপূর্ণ এই ধরায় মানুষের জন্ম নিষ্কলুষ অবস্থায়। কাল পরিক্রমায় তার বয়সের পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটে, আরবিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় ক্রমাগত। ভোগ-লালসা তাড়িত রিপু আর পারিপার্শ্বিকতা মানুষকে অনেক জৈবিক চাহিদা পূরণের দিকে ধাবিত করে ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে। স্বীয় জীবনের অভিজ্ঞতা তার ব্যতিক্রম হবে এটা কীভাবে সম্ভব! বাংলা সাহিত্যে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ বা উপন্যাস পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে বেশ কয়েকটি। আত্মজীবনীমূলক কবিতা আছে কিনা তা আমার চোখে পড়েনি অক্টোবর ২০২০ নাগাদ, তবে করোনা আক্রান্তকালীন সুযোগ হয়েছে সমসাময়িক কালের আলোচিত কবি আমিনুল ইসলামের আত্মজীবনীমূলক কবিতা ‘আকাশের ঠিকানায় সাগরের চিঠি’ পড়ে দেখার। আত্মজীবনীমূলক বা স্মৃতিরোমন্থনমূলক গ্রন্থ বা উপন্যাসের মধ্যে মনে পড়ে এ সময়ের শক্তিমান লেখক হরিশংকর জলদাস এর ‘নোনাজলে ডুবসাঁতার’ উল্লেখযোগ্য অথবা প্রয়াত লিপি-কুশল লেখক আহমদ ছফার আত্মজীবনীমূলক প্রেমের উপন্যাস ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’। এ সকল গ্রন্থে বিশেষ কিছু দিক, যেমন সরল বা উন্মাদ প্রেম বা দেহ-আকৃতির জ্যামিতিক রেখাসমূহ চিত্তাকর্ষকভাবে উন্মোচন করা হয়েছে। জীবনের আরো দিক যেমন ব্যক্তিগত জীবন-যৌবন, পেশা-পদোন্নতির ছক, প্রচলিত ছকের বাইরে বা নিত্য অভিজ্ঞতার অনুভূতি ইত্যাদি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলা হয়েছে অথবা অস্বীকার করা হয়েছে অথচ সেগুলো জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে বা জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার বড় সম্পদ। ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ উপন্যাসে আহমদ ছফা একেকটি নারী চরিত্র যেমন সোহিনী, দুরদানা বা শ্যামারোখকে এমন জীবন্তভাবে উপস্থাপন করেছেন যা করুণতম অভিজ্ঞতার উৎস থেকে জন্ম নেওয়া। দুরদানা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, দুরদানা ঊনিশ বছরের তরুণী, যে সাইকেল চালিয়ে নাখালপাড়া থেকে আর্ট ইন্সটিটিউটে যাতায়াত করতো আর লোকে ছেমড়ির বুক-পাছা-নিতম্ব নিয়ে মন্তব্য ছুড়ে দিত। জাহিদ দুরদানার প্রেমে পড়েছিল এবং তার সাইকেলের পেছনে চেপে ক্যাম্পাসে চলাচল ছিল যা নিয়ে তাকে কটু কথা শুনতে হয়েছে। জাহিদের হোস্টেলে দুরদানার যাতায়াত ছিল সেই আশির দশকের প্রথম দিকে। এ পর্যন্তই দুরদানার সাথের জাহিদের রসায়ন।

লেখক-ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাসের ‘নোনাজলে ডুবসাঁতার’ গ্রন্থে রূঢ় সত্য অকপটে স্বীকার করা হয়েছে। এখানে পূর্ব-পুরুষের সংক্ষেপিত ইতিহাস, নিজের শৈশব-কৈশোর ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনাবলি, আইয়ূব সরকারের শাসনামল অত্যন্ত তথ্যনির্ভরভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে প্রচলিত জেলে সমাজের স্বাভাবিক বহমান জীবনের বাইরের ঘটনাও পরিষ্কার ও খোলাখুলিভাবে বর্ণিত হয়েছে। রাতের আঁধারে কে কার ঘরে যায় অথবা কার অর্থে কে নতুন নতুন শাড়ি বা স্নো-পাউডার ক্রয় করে তার সাবলীল বর্ণনা রয়েছে। সমাজের শোষণকারী, দখলবাজদের স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে নির্ভীকভাবে। দেশের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিন্দুধর্মাবলম্বী হওয়ায় তাঁদের নাম সংক্ষেপকরণ যেমন এম এম কলেজ, বি এম কলেজ। আবার খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের নাম অবিকৃতিকরণ যেমন ভিক্টোরিয়া কলেজ তুলে ধরা হয়েছে নিরপেক্ষভাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ কোনো কিছুই বাদ যায়নি জীবনচরিত বিষয়ক এসব গ্রন্থ থেকে।
কবি আমিনুল ইসলামের ‘আকাশের ঠিকানায় সাগরের চিঠি’ দীর্ঘ কবিতায় যথারীতি আধুনিক ও সমসাময়িক শব্দ গঠন ও প্রয়োগে সুনিপুণ কাব্যিক ভঙ্গিমায় প্রকাশ পেয়েছে জীবনের ছোট-বড়ো, অম্ল-মধুর, সুন্দর-কুৎসিত, অযৌন-যৌন জীবন আর সামাজিক নানা অসংগতি। প্রেম শাশ্বত মানবজীবনের আদিম-স্বাভাবিক ঘটনা। এটির আগমন জীবনের যেকোনো পর্যায়ে আসতে পারে। প্রেম কবির জীবনেও এসেছিল। একেবারে ব্যতিক্রমভাবে কবিতার মাধ্যমে এবং প্রেয়সীর বর্ণনায় কবির আত্মজীবনী উন্মোচন করা হয়েছে। আকাশের লম্বা ছিপছিপে দেহ বা মাথাভরতি চুলের চেয়ে বাচনভঙ্গিই সাগরকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। তখন সাগরের প্রেমে পড়া বা বিয়ের বয়স না হলেও বিধাতার কোনো পরিকল্পনায় যেন দুজন দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যান এবং পরিণতিতে বিয়ে। যেমন প্রেয়সীর বর্ণনায়:

‘তখন আমার পায়ের পাতা ছুঁয়ে-আপ্রন-উজ্জ্বল দিন;
তখন আমার বাস্তবের বারান্দায় কল্পনার হাওয়ার দোলা;
তখন আমার উঠোন জড়িয়ে-
একটি স্বপ্নমাখা ভবিষ্যতের ভূগোল;’
আকাশ গ্রামের এক কৃষক পরিবারের সন্তান সারল্য যার মজ্জাগত। রিক্সায় সাগরকে নিয়ে চড়ামাত্র রিকশাওয়ালার সাথে পরিবার পরিকল্পনা বা সন্তানের শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা আরম্ভ করতো। চাকুরীজীবনে অফিসের পিয়নকে বা ড্রাইভারকে খাবার টেবিলে বসিয়ে একসাথে খাবার গ্রহণ সামন্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা সাগরের নিকট খুব ভালো না লাগলেও আকাশ ছিল সে বিষয়ে উদার। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে মানবসমাজের শ্রেণিবিভাগ থাকতে পারে তবে নিজের পদোন্নতি বা জীবনমানের উন্নয়ন সকলেই চায়। আকাশ ও তার ব্যতিক্রম হবে কেন! বিভিন্ন আইন-কানুন সবসময় ভালো না লাগলেও পদোন্নতির লক্ষ্যে তা পড়ার প্রয়োজন ছিল। পদোন্নতির সকল শর্ত পূরণ করা হলেও পদোন্নতি বিষয়ক কমিটি আকাশ বা আকাশের মত অনেকের পদোন্নতির লক্ষ্যে সময়মতো সুপারিশ করেন না। চাকুরীজীবনে দেখা যায় পেশাদারিত্বে অসাধারণ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রাপ্য পদোন্নতিবঞ্চিত হন। আবার অনেক ক্ষেত্রেই অপেক্ষাকৃত অযোগ্য-কপট, অদক্ষ লোক পদোন্নতি ও উচ্চমানের পদপ্রাপ্য হন। কেন পদোন্নতি হয় আর কেনই বা হয় না তা সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বা তার পরিবার জানতে বা বুঝতে পারে না। এ বিষয়টি অতি নিপুণতার সাথে কবিতায় ফুঁটে উঠেছে সাগরের শ্লেষাত্মক আত্ম-জিজ্ঞাসার মাধ্যমে:
‘তোমার নাকি এসিআর ভালো; সবকিছু ক্লিয়ার; 
তাহলে বাধা কোথায়!’ কবি ব্যক্তিজীবনে এবং চাকুরীজীবনেও নারীস্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। তিনি বিভিন্ন সরকারী অনুষ্ঠানে স্থানীয় বিশিষ্ট নারীদের প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথির আসনে বসাতেন। এটি পুরুষ সহকর্মীদের বেশিরভাগই পছন্দ করতেন না। নারী স্বাধীনতা, নারী নেতৃত্ব সৃষ্টিতে কবির প্রয়াস সাগরকে মুগ্ধ করতো এবং তা তার কাছে গর্বের বিষয় অবশ্যই ছিল। আকাশ-সাগরের বৃষ্টিবিলাস বা সখ্যতায় অনেকে অবাক হত প্রথম প্রথম- কিন্তু ক্রমেই অনেকেই যোগ দিত ঐ জুটির সাথে। আকাশের প্রতি বিভিন্ন কোণের নারী সমাজের সপ্রশংস ও মুগ্ধ দৃষ্টি সাগরের মনোজগতে যে সন্দেহের উদ্রেক করেনি তা নয়। কিন্তু আকাশের প্রতি সাগরের অগাধ বিশ্বাসকে টলাতে পারেনি। মানবজীবন ধুয়া তুলসী পাতা তো নয়ই বরং ভুলের পরিমাণ যথেষ্ট। পৃথিবীতে মানবকূলের আগমনই ভুল থেকে। রামায়ণ বা ট্রয় নগরীতে সংঘর্ষের কারণ নারীকে নিয়ে পুরুষদের লোভজনিত টানাটানি আর তেমনি আকাশের জীবনেও নারীর অনুপ্রবেশ ঝড় তুলেছিল দাম্পত্য জীবনে যা অকপটে স্বীকার করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে জীবন-চরিত পড়লে দেখা যাবে এভাবে সরল স্বাীকারোক্তি শূন্যপ্রায়। বিশ্বের সৌম্য সভ্যতার বুকে মার্কিনি বোমা বা আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ, আসামে বাঙালি তাড়ানো নাগরিকপঞ্জি বা রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বিচলিত করে কবিকে। কবিক জন্ম নদীপাড়ে। তাই কবিতায় নদী এসেছে বারবার ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। আবার কবির জীবনেও নদীর মতো ভাঙন আঘাত হেনেছে বারবার। দাম্পত্য জীবন আরম্ভের পূর্বে যেমন কবির জীবনে ভালোবাসার নারীর আগমন ঘটেছে তেমনি বিবাহ-পরবর্তী ভালোবাসার আলিঙ্গন হয়েছে যা প্রকাশ পেয়েছে কবিতায় সুমনা, জোয়ানা, পপি বা অধ্যাপিকা শ্যামাঙ্গী রূপে। তাদের সাথে কবির সম্পর্ক হয়তো-বা বহুমাত্রিক কিংবা সরলরৈখিক। সাগরের কণ্ঠে:

‘সহসায় আমার নিবিড় বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে
একবার একটা বিল ক্লিনটন করে বসলে!’

অথবা
‘তোমার সাথে একটানা ছাব্বিশ বছর
আমি আজ নিশ্চিত যে-
তুমি কোনোদিনও শাহরুখ খানের মতো
একনিষ্ঠ ছিলে না;
আজও তা হয়েছ কি না, জানি না’

মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন ও মনিকা লিউনস্কির মধ্যকার সম্পর্কের সদৃশ অথবা বিপরীতক্রমে বিশ্বজনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেতা শাহরুখ খান যেমন গৌরী খানের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সেই রকম শৈল্পিক উপস্থাপন করা হয়েছে উপরি-উক্ত ছত্রগুলিতে। এত কিছুর পরও কবিতার দৃঢ় চরিত্রের অধিকারিণী সাগর মেনে নেয় আকাশকে। এ মেনে নেওয়া কোনো সংকীর্ণতা নয় ববং আকাশ ও সাগরের বৃহৎ হৃদয়েরই প্রকাশ। সাগর আকাশকে মেনে নেয় তার বৃহত্তর মানবিকতার স্বার্থে, মানুষের বৃহত্তম স্বার্থে। কারণ আকাশ কোনো দেবদূত নয় বরং রক্ত-মাংসের পার্থিব মানবকূলেরই প্রতিনিধি। ভালোবাসা কবির অভ্যাস, নদীর কলতান বা কুলকুল ধ্বনিতে কান পাতা বা পানি ছুঁয়ে দেখা কবির বাসনা কিন্তু আকাশ সাগরের দীর্ঘ ২৬ বছরের দাম্পত্য জীবনে দুজনের পারস্পরিক প্রয়োজন বা ভালোবাসা সমান্তরাল। মানবহৃদয় অতিজটিল যার সীমা-পরিসীমা নেই। মানুষ কখন কী চায়, কেনই বা চায় তার ব্যাখ্যার হদিস করা সম্ভব নয়! নিশ্চয়তা বা অনিশ্চয়তা এখানে পাশাপাশি হাত ধরে চলে। এর মাঝেও জীবনের কঠিন সময়ে পরস্পর পাশাপাশি থাকাই বড়ো জয় যা কবির অর্জনই বলতে হবে। এটি তো পরস্পর বোঝাপড়া থাকলেই সম্ভব। কবির জীবনই যে শুধু কবির জীবনকে প্রভাবিত করে তা নয়, পারিপার্শ্বিকতা বা প্রেয়সীর প্রতি অন্য পুরুষের আকর্ষণ, সখ্যতা লাভের প্রচেষ্টা কোনো কিছুই জীবনবহির্ভূত নয়। এইরূপ বলিষ্ঠ আত্মপ্রকাশ করতে হলে শুধু সাহস নয়, দুঃসাহসের প্রয়োজন। এটা এ সমকালীন আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবি আমিনুল ইসলামের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। এই কবিতায় নারী চরিত্র সাগরের স্বাতন্ত্র্য চোখে পড়ার মতো। কবিতাটির কয়েকটি ছত্র:

‘তুমি তো জানো, যাকে বলে গড়পড়তা নারী,
কোনোক্রমেই আমি তা নই;’
অথবা
‘এ জীবনে আমারও রয়েছে নিজস্ব ব্রত;
সম্মিলিত পায়ে, অথবা একলা’

আকাশ একাধারে কবি, সরকারি চাকুরীজীবী হলেও সাগর তার স্বামীর নামের অংশ নিজের নামের শেষে সংযুক্ত করেননি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যনাট্যে চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের সমীপে সর্বস্ব সমর্পণ করে। কিন্তু এ কবিতায় নারীর ভূমিকা চিত্রাঙ্গদার বিরুদ্ধাচরণ। চিত্রাঙ্গদা কাব্যনাট্যে দেখা যায় যে চিত্রাঙ্গদা নায়ক অর্জনের ব্রতের সহায় এবং তার সুখ-দুঃখের সহচরী হতে অর্জনের অনুমতি প্রার্থনা করেছে। এর অর্থ হচ্ছে চিত্রাঙ্গদার নিজস্ব ব্রত ছিল না। তিনি পুরুষের অধীন সত্তা। কিন্তু এ কবিতায় নারীর নিজস্ব স্বকীয় ব্রত বিদ্যমান। যেখানে নারীরা সমবেত বা একান্ত নিজস্ব প্রচেষ্টায় বিশ্বাসী। নারী স্বাধীনতা ও নারীবাদ নিয়ে কবি উচ্চকণ্ঠ। সাগরের ভাষ্যমতে,
‘আন্তর্জাতিক নারীদিবস আসে

আসে বেগম রোকেয়া দিবস,
নারীস্বাধীনতার লম্বা মিছিল,

উচ্চকিত স্লোগান:
নারীর প্রতি বৈষম্য, মানি না, মানবো না!
আমাকে সাথে নিয়ে তুমি মেতে ওঠো
সে-মিছিলের নেতৃত্বে’
কবি আমিনুল ইসলাম



আমাদের সমাজে নারী উন্নয়ন ও নারী স্বাধীনতার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ বিরল। এমনকি নারী সংক্রান্ত বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও দেখা যায় প্রধান আলোচকবৃন্দও পুরুষ। এ যেন নারী স্বাধীনতার প্রহসন। কবিতায় কবির ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও দৃঢ়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নারী স্বাধীনতার গান। এ যেন প্রচলিত ধারার বাইরে স্রোতের বিপরীতে চলার নামান্তর। নারী স্বাধীনতা খুবই প্রচলিত ও বহুল উচ্চারিত একটি প্রত্যয়। কিন্তু আমিনুল ইসলমের প্রকাশভঙ্গি একেবারে নতুন। শুধু নতুনই নয়, একইসঙ্গে খুব আকর্ষণীয়ও।
‘নারীস্বাধীনতার ইঞ্জিনে তুমি কতটুকু অকটেন
দিতে পেরেছিলে, সে-হিসাব আমার কাছে নেই,
হয়তো সেকথা ভুলে যেতে বসেছেন
সেদিনের সেই নারীরাও;’
কবিতাটির কোনো কোনো চিত্রকল্প সমৃদ্ধ পঙক্তি অল্প পরিসরে অনেক কথা তুলে ধরেছে। একেবারে আনকোরা উপমা যোগে নতুন ধরনের চিত্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। খুবই পরিচিতি দৃশ্য কিন্তু খুবই নতুন।

‘প্রাইমারির সুরাইয়া আপা নতুন বাঁধা ভাওয়াইয়া গানে
ভাসিয়ে দেন নারীবৈরিতার যাবতীয় জঞ্জাল!’

কবিতাটির ভাবধারা ও আঙ্গিকশৈলী বা শিল্পগুণ বিবেচনা করলে দেখা যায়, কবিতাটি খুবই আনন্দদায়ক বা উপভোগ্য ভাষায় রচিত হয়েছে। বড়ো বা দীর্ঘ কবিতার বৃহত্তম ঝুঁকি হল পাঠকের মনোনিবেশ ধরে রাখা। এই ক্ষেত্রে কবি বা লেখককে আশ্রয় নিতে হয় বাক্যে শব্দের গঠন, ব্যবহার ও প্রয়োগ; বিষয়ের ভিন্নতা, বিষয় হতে বিষয়ান্তর পরিভ্রমণ, বিষয়ের উপাদানগত বৈচিত্র্য ইত্যাদির। আলোচ্য সুদীর্ঘ কবিতাটিতেও খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রেম-বিচ্ছেদ, জৈবিক -রোমান্টিক, পরিবার-সমাজ, পেশাগত জীবন-পদোন্নতি, রাজনীতি-দুর্নীতি, নারী স্বাধীনতা-পুরুষতন্ত্র, প্রত্যাশা-নৈরাশ্য, সমাজতন্ত্র-সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদি নানারকম বিষয়সমূহের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। যেমন:
‘অবশেষে চল্লিশোর্ধ্ব নাহার খালার বিয়ের মতো

বঞ্চিত সেই তোমার পদোন্নতি হলো একদিন!’
সময়মতো পদোন্নতি চাকুরীজীবীদের বড়ো একটি প্রাপ্তি বা কাজে উৎসাহ-উদ্দীপনার উৎস। কিন্তু সঠিক সময়ে কাঙ্খিত পদোন্নতি না পাওয়ায় চাকুরী, ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। হতাশায় নিমজ্জিত হতে হয়। এর ফলে জনসাধারণও কাঙ্খিত সেবাপ্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয়। এটি চাকুরীজীবী বা রাষ্ট্র কারো জন্যই হিতকর হতে পারে না। এই কবিতাটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল সাধারণ বা অসাধারণ শব্দের মাধ্যমে অত্যন্ত জটিল ও সূক্ষ্ণ বিষয়ের সুকৌশল অবতারণা । যেমন:

‘আচ্ছা আকাশ, এসএসবি জিনিসটা কী?
সেটা কি বোদলেয়ারের বিড়াল
কিংবা টেড হিউজের কাক
অথবা জীবনানন্দ দাশের

মহীনের ঘোড়াগুলির লাহান কিছু?’
এখানে এসএসবি (SSB) হল সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড যা প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করে থাকেন। এসএসবি কোন কোন বিষয়সমূহ আমলে নিয়ে পদোন্নতির পক্ষে সুপারিশ করেন বা কোন কোন বিষয় হিসাবে নিয়ে পদোন্নতি না দেওয়ার সুপারিশ করেন তা সাধারণের পক্ষে কোনোদিনও জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না। পরবর্তীতে এসএসবি’র কোনো সদস্যও বোধহয় স্পষ্ট করে কিছু মনে করতে পারেন না কী কারণে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল! পুরো বিষয়টিই আঁধারে ঢাকা পড়ে যায়। পরাবাস্তব কবিতা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে তার পক্ষে উপরের ছত্রগুলির নিগূঢ় অর্থ উদ্ধার করা অসাধ্য ব্যাপার। তাকে ফরাসি পরাবাস্তব কবি বোদলেয়ারের ‘বিড়াল’ বা প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া’ অথবা ইংরেজ কবি টেড হিঊজের ‘কাক’ এর মতো পরাবাস্তব কবিতাসমূহ পড়ে জ্ঞান লাভ করতে হবে আগে। কবিতাগুলিতে ‘কাক’, ‘বিড়াল’ বা ‘ঘোড়া’ কোনো সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, বরং মানুষ বা সমাজের বিচিত্র রূপের চিত্রায়ন করা হয়েছে। এগুলো এখনো রহস্যের আঁধারে ঘেরা যেগুলোর উপর বর্তমানের আধুনিক কবি বা প্রাবন্ধিকগণ গবেষণা বা অনুসন্ধান করে চলেছেন।

আমিনুল ইসলাম জটিল ধরনের শব্দ ব্যবহার করেন না। তিনি সহজ শব্দে গভীর কথা বলতে অভ্যস্ত। যেমন এই কবিতার “তোমার অধর থেকে তখনো বেরিয়ে আসতো ছাত্রজীবনের বামপন্থি ঘ্রাণ”- এই সহজ বাক্যটি একজন মানুষের সংসারজীবনে তার শিক্ষাজীবনের রাজনৈতিক দর্শনের অন্তরঙ্গ প্রভাব থেকে যাওয়ার বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছে। মানুষটি শিক্ষাজীবনে বাম রাজনীতির মঞ্চে ও আড্ডায় বক্তৃতা করতেন সেকথা ফুটে উঠেছে অধর থেকে বামপন্থি ঘ্রাণ বের হয়ে আসা চিত্রকল্পটিতে।

এই কবিতায় অভিনব ধরনের সুন্দর সুন্দর শব্দসমষ্টি আছে। ‘হাওয়ায় দোলা অদ্ভুতচারিতা’, ‘ ক্র্যাচের কর্নেলের মতন’, ‘ বিড়ম্বিত বিশ্বাস’, ‘ অন্তরঙ্গ অনিশ্চয়তা’, ‘ পুরুষতন্ত্রের প্রাসাদ’, ‘ভুলের চাররঙা ঠোঁটে চুম্বন’, ‘সুকান্ত ভট্টাচার্যের হারানো কলম’, ‘এজাহারহীন চোখের জল’, ‘ঐতিহাসিক বেদনা’, ‘পুরোহিত সময়’, ‘নারীস্বাধীনতার ইঞ্জিন’, ‘জোতদার রক্তের ক্ষয়িষ্ণু ধারা’, ‘অভূতপূর্ব চাপাকান্নার অঘোষিত উদ্বোধন’, ‘ বাস্তবের বারান্দায় কল্পনার হাওয়ার দোলা’, ‘বোতামের ফাঁক দিয়ে বুকভরতি লোমের উঁকিঝুঁকি’ প্রভৃতি শব্দসমষ্টি ও বাক্যাংশের মধ্যে উপমা ও চিত্রকল্পের মতো সৌন্দর্য আছে, ভাবনার নতুন খোরাক আছে। তিনি এধরনের শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে গভীর অর্থসমৃদ্ধ পঙক্তি রচনা করেছেন। নিচে একটা উদাহরণ দিচ্ছি:

‘আমি কোনো কথা বলার আগেই
পলাশীর আম্রকানন ছোঁয়া সেই
ঐতিহাসিক বেদনা ও গালি সিডর হয়ে
তোলাপাড় জুড়ে দিলো
মেঘনার পাড় ছুঁয়ে থাকা আমার ছায়াঢাকা বুকে!
ঘৃণা শব্দটিকে তার পরিপূর্ণ ব্যঞ্জনায়
সেই প্রথমবারের মতো আবিস্কার করলাম মি!’

উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহারে কবি আমিনুল ইসলাম সিদ্ধহস্ততার পরিচয় দিয়ে চলেছেন উপরে উদ্ধৃত কবিতাংশে তা আমরা দেখেছি। সমসাময়িক শব্দের ব্যবহার ও শব্দ সৃষ্টি তার কবিতার অনন্য বৈশিষ্ট্য। একটু উদ্ধৃতি দেওয়া যাক কবিতাটি হতে:
‘কিন্তু আবারও বিধাতার বাসনার প্যারাডক্স!
সহসায় আমার নিবিড় বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে

একবার বিল ক্লিনটন করে বসলে!’
জীবন চলার পথে বিচিত্র অভিজ্ঞতার এ যেন সরল ও নাটকীয় প্রকাশভঙ্গিমা। এটি অতি সাহসী স্বীকারোক্তিও বটে। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন এবং হোয়াইট হাউসের সুন্দর কর্মচারী যুবতি মনিকা লিউনিস্কির মাঝে ঘটে যাওয়া যৌন কেলেঙ্কারির বিষয়টি এখানে বাকচাতুর্যের সঙ্গে বলা হয়েছে। এটা একধরনের উপমাও। বাংলা সাহিত্যে এধরনের সাহসী ও শুদ্ধ বহিঃপ্রকাশ একেবারেই বিরল। ভাব প্রকাশে অকৃপণ ও সিদ্ধহস্ত কবি আমিনুল ইসলাম। ক্ষেত্রমতো লাগসই, বহুমাত্রিক শব্দ ও উপমা কবিতাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। কয়েকটি ছত্রের দিকে খেয়াল করা যাক:

‘হায়, পদ্মাপাড়ের দুরন্ত মারবেল-বালক,
সোনালী ব্যাংক শাসিত শহরে এসেও

আজীবন মারবেল-বালকই রয়ে গেলে;
খেলে গেলে নিজের জীবন নিয়ে

সে-জীবনে জড়িয়ে রইলাম আমিও;
জড়িয়ে রইলো--অনাগত হাজারো রাত ও দিন

জড়িয়ে রইলো--কত অন্তরঙ্গ অনিশ্চয়তা!
জড়িয়ে রইলো--আরও কত কী!’

মারবেল-বালক একদিকে যেমন জুয়াড়ির প্রতীক অন্যদিকে সোনালী ব্যাংক তেমনি কেতাদুরস্ত হিসাবের প্রতীক। পরস্পর বিপরীত উপমার কী মেলবন্ধন উপরের ছত্রগুলিতে! দেখা যায় তার কবিতায় বিদ্রোহ, সংশয়, প্রতিবাদ, সত্যের সন্ধান, জাগরণ ও বিস্ময়ের অসাধারণ সম্মিলন।

সবশেষে একটা কথা মাথায় আসে। কবিতাটি কি সত্যিসত্যি কবি আমিনুল ইসলামের ব্যক্তিজীবনের কাব্যিক বিবরণ? নাকি তিনি একটি দীর্ঘ কবিতা লেখার পরিকল্পনায় সাগর আকাশ এসব চরিত্র সৃষ্টি করেছেন? উত্তর যে-কোনোটাই হতে পারে। কিন্তু সেটা পাঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ ভাষা ও ছন্দ ’ কবিতায় কবিদের খোলা সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন: ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি / ঘটে যা তা সব সত্য নহে।’ আমিনুল ইসলামের ‘আকাশের ঠিকানায় সাগরের চিঠি’ কবিতাটিকে সাহিত্যগত সত্য বলে মেনে নিলেও পাঠকের লাভ কম হবে না এতটুকু। নান্দনিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ কবিতাটির কাব্যমূল্য অনেক বেশি। পরিশেষে বলাই যায়- কবিতাটি সমসাময়িক কালের বিশিষ্ট কবি আমিনুল ইসলামকে ভিন্ন উচ্চতায় স্থান দিবে বাংলা ও আধুনিক বিশ্বসাহিত্যে। কেননা, আধুনিক সাহিত্য মানেই ভাবের কথা,--- কালের কথা সেখানে গৌণ।

5 মন্তব্যসমূহ

Thanks

  1. "আকাশের ঠিকানায় সাগরের চিঠি " -- একটি দীর্ঘ কবিতা। সেটি নিয়ে একটি দীর্ঘ আলোচনা। গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ। আজকাল কোনো বিশেষ একটি কবিতা এমন নানামুখী বিশ্লেষণ চোখে পড়ে না বললেই চলে। আলোচক শেখ ফজলুল করিম এবং কুয়াশা সম্পাদক কবি দ্বীপ সরকার উভয়কেই সাধুবাদ জানাই। ধন্যবাদও।

    উত্তরমুছুন
  2. কবি আমিনুল ইসলাম কবি হিসেবেই সর্বত্র প্রায় সর্বজনের কাছে পরিচিত। যদিও প্রবন্ধে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলো নজরুলপ্রেমদেরকে অনুপ্রাণিত করবে।
    কবিদের মধ্যে অনেকেই পরাবাস্তববাদী কবিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও আমিনুল ইসলাম যথেষ্ট সহজ করে কবিতা লেখেন। এটা পাঠকপ্রিয়তা লাভে যথেষ্ট সহায়ক বলে মনে করি।
    এখানে তাঁর একটি দীর্ঘ কবিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যেটি একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাসের মতো কবিতা। আমি অন্তর থেকেই তাঁর কবিতা পড়ি। দীর্ঘ একটি আলোচনা পড়ে খুব ভালো লাগল। কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা নিয়ে আলোচনা খুব সুন্দর হয়েছে। আলোচক সত্যি কথাগুলোই বলেছেন। আমি দুজনেরই রোগমুক্ত দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।
    -- হাসান ওয়াহিদ
    সম্পাদক
    কালের রাখাল

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ একজন ক‌বি‌কে নি‌য়ে দুর্দান্ত বি‌শ্লেষণ

    উত্তরমুছুন
  4. মূল্যায়নকারী তাঁর হৃদয় নিংড়ে শেখ ফজলুল করিমকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন। যথার্থ মূল্যায়ন এবং চমৎকার একটি প্রবন্ধ পেলাম।
    পাঠে দুজনের প্রতিই কৃতজ্ঞতা এবং শুভকামনা জানাচ্ছি। 🌹🌹

    উত্তরমুছুন
  5. “ শেখ ফজলুল করিমকে’’ মূল্যায়ন করা হয়নি; শেখ ফজলুল করিম মূল্যায়ন করেছেন আমিনুল ইসলামের “ আকাশের ঠিাকানায় সাগরের চিঠি “ শিরোনামের একটি দীর্ঘ কবিতার। মূল লেখার ওপরে একটা অতিরিক্ত শিরোনাম দিয়েছেন সম্পাদক মহোদয় যেখানে শব্দের ব্যবহার কিছুটা গোলমেলে ধরনের মনে হয়েছে যা ভুল বার্তা দিচ্ছে বলে মনে হলো।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks

নবীনতর পূর্বতন