আমিনুল ইসলামের ১০ কবিতা।।10 poems by aminul islam

আমিনুল ইসলামের ১০ কবিতা


ঘোড়া ও সোয়ারি

ঘোড়ার পিঠে সোয়ারি--বাচাল ও একচোখা
হাতে লাগাম ও চাবুক;
ও ঘোড়া, কই যাও?
যাই
সংবিধান ব্যাগে নিয়ে স্বৈরতন্ত্রের বাগানবাড়ি…


বিশ্বায়ন

পুঁটি মাছের ধরলাকে রেখে পেছনে
উজানে গেছিল বক
বছর তিনেক পর
ফিরে এসেছে সে ভাটির ভিটায়
সঙ্গে এনেছে-
ভাইয়ের জন্য হোমোসেক্সুয়াল দিন
বোনের জন্য লেসবিয়ান রাত
আর নিজের জন্য-
মিঠাপানি বিষয়ে বমিবমি বিতৃষ্ণা !


সখা হে ভাসলাম জলে

দূরদর্শী জলযানে উঠেছিলে বন্ধু--বোতলের জলে ধুয়ে সবটুকু!
অনর্থ-অনর্থ ডাকে আমি শুধুই গলা ভেঙেছিলাম! ততক্ষণে
মাঝজলে তুমি; চর ভাঙে পুনঃপুন আবিল ঘূর্ণির তোড়ে;
এদিকেও কেঁপে ওঠে পাড়! তোমার হাসিতে বুঝি না কী অর্থ তার!
আমি কেবল সড়কিহাতে জলের তান্ডব দেখে হতবাক হই আর
নিজের জলবিদ্যার নাভি ছুঁয়ে হেসে ফেলি নিঃসঙ্গ উলঙ্গের মতো।
এবং এতো যে আক্রোশ তবু কী আশ্চর্য নদীকূলে খালি খালি বেড়ে
যায় বিপরীত বসতি; আর স্রোতছোঁয়া বিদ্যা নিয়ে জোয়ান ছেলেরা
কেবল চলে যায় কুয়াশায়, গভীরের গোড়ায়? তাই বুঝি ঘোলা
এতো জল? আর এ জলে কাহার মুখ! হে সখা-- তোমাকেও দেখি না!
হে পিতা, হে পিতামহ,-- তোমরা দিয়ো না অমন গামছা প্রণোদনা।
মিঠাপানির জঠরে জন্ম বটে---তাই বলে কতো আর শীর্ণনদী!
কতো আর স্বচ্ছজলে স্থূলদর্শন! তার চেয়ে ঘূর্ণিঘন ঘোলাজলে
আমস্তক ডুবে যাও; সঘন তরলে আজ দেখে নাও আত্মা অবিকল
--এই ডাক হেলা করে হতভাগ্য এতটা কাল পড়েছিলাম তীরে;
অবশেষে জলে নামা আজ। পেয়ে গেছি তোমার মাড়ানো পথ,
অস্বচ্ছ এ জলরেখা আর দ্যাখো-- টাঙার অশ্বের মতো বেঁধেছি দুচোখ।
তাই বলি, বন্ধু-- চোখ রেখো চোখে; পানসে প্রবাহে যদি ভেসে যায় ফের!


খোদা তুমি করলে বাঙাল

ভাইরাসেরা হলুদ চোখে বাড়িয়ে আছে চোখ
ধুলোবালি জড়িয়ে ধরে পঙক্তিমালার ঝোলা
ডিলিট বাটন চেয়ে চেয়ে গিলছে লোভে ঢোক
মাউস বলে কী কাজে আর নতুন নথি খোলা!
পিছিয়ে যখন ছিলাম পথে আসতো কানে ডাক
এগিয়ে চলো আমরা আছি জোরসে বেঁধে মন
লক্ষ্য ছুঁবো দেখে সবাই বাড়িয়ে তোলে ফাঁক
আজব দেশের জবর মানুষ-- ঈর্ষাপরায়ণ!
আমি যেন সতেজ বানর উঠছি বেয়ে গাছ
একটু দূরে ঝুলছে ডালে ডাগর দুটি আম,
বন্ধুরা সব ধরছে চেপে লেজের ওপর হাত
খোদা তুমি করলে বাঙাল, আর পেলে না কাম?


বিকিনি রাত এবং ফুটো কনডম

প্রবাদের পাথর ফেটে উচ্চারিত হয় সজোরে,
সেটা হয় সিপাহী বিদ্রোহ,
মুখে এসে লাগে টমাহক রিপ্লাই;
প্রভাতি প্রার্থনা কাতর কবিতা হলে
সেটা উসকানির লেজে কাতুকুতু হয়,
আঁধারের প্লাস এসে খুলে নেয় নখ।
রোদের সংবিধান নিয়ে কথা বলে ট্রেন-বাস-টি স্টল-
টকশো-জেলখানা: আ রে করো কী!
মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল না!’
দশমুখে কথা বলে দিনের ডাকাত।
আরে ও চোরের মা, তুমি কেন লজ্জা পাচ্ছো জননী?
ফলে অরণ্যে রোদন-এ প্রবাদের চোখের ওপর
ঘন হয়ে আসে-
উলটো হয়ে ঝুলতে থাকা চোখবাঁধা রাত।
আছিলা বাঁশের স্কুলে জমে ওঠা প্রাকটিক্যাাল ক্লাস
থেকে ডাকছি--
ও ইতিহাস, ওগো মহাকালের প্রেস সেক্রেটারি,
প্রস্তরযুগকে সঙ্গে নিয়ে একবার এসো ভাই
দেখে যাও-- আলোকায়নের বিকিনি পরা রাত,
ফুটো কনডম--আর ধর্ষকদের ইউনাইটেড ক্লাব!


দিনের দাপট রাতের রাজত্ব

হাবা বালকের আঙুলে গিঁট দেওয়ার অভ্যাস রপ্ত করেছে দিন;
ফলে নিজের হলে তো কথাই নেই, এমনকি চান্স পেলে-
অন্যের ইজারেও হাত দিয়ে বসে: চেইনটা লাগিয়ে দিলাম মামা!
গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ায় কতক্ষণই-বা এই জ্বালাতন সহ্য করা যায়?
তাই তো রাতের জন্য জমে ওঠে হাফডজন হোয়াইটকলার অপেক্ষা।
রাত এলে মুখোশটা খুলে মুখ তুলে ধরে মুখ; ছিনালরঙের মেকআপ
সরিয়ে সামনে আসে দাগ-ছাপের চাঁদ-চাঁদ ভূগোল;
তখন কেই-বা আর চুমু দিতে যায় সত্যের মতন রঙবিযুক্ত বদনে?
রাতের শহরে রাত এলে কালো সাহসে ভর দিয়ে কোষ ছেড়ে
বেরিয়ে আসে পুলিশের মতো অনুগত ছোরা;
রাত এলে ঝুট-উগ্রতার অহং ফেলে সাদা ছলনার মতো
হাতের মুঠোয় নরম হয়ে আসে স্তন; এবং সারাদিন সূর্যের সাথে
কানামাছি খেলে আঁধারের স্বশাসিত উঠোনে শেয়ালেরা
হয়ে ওঠে শেয়াল- সাপেরা সাপ। আর নিঃসঙ্গ বিধাতা
অসহায় মুরুব্বির চোখে দেখেন প্রতিপক্ষের সাফল্যের উন্মোচিত স্মারক।


অভিচার নয়

দ্যাখো-- এমনকি লুঙ্গির নিচের গালি দিতে অভ্যস্ত ঠোঁটেও
তোমার নাম নিতেই খাড়া হয়ে যায় ঘামভেজা লোমকূপের
সবগুলো লোম; ‘না ‘না ‘না!
যদি তোমার বিউটিপার্লার ছবির সামনে মেলে ধরা হয়--
সাধারণ নয়, হরিণ-হায়েনা-খুনী ও সন্ত্রাসী দেখা চোখ,
সহসা অন্ধকার দেখা শিশুর মতো পিছিয়ে আসে যাবতীয় দৃষ্টি,
তারা দ্রুত হয়ে যায় উলটো মুখের তুলনা;
তোমার মুখে উচ্চারিত প্রেমের বাণী কানে আসামাত্র
স্বয়ংক্রিয় না-বাচকতায় আঙুল চলে যায় দু-কানের দরজায়:
না, অনেক হয়েছে, তোমাদের আর নিতে চাই না
মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধে!
অথচ তুমি গলা ফাটিয়ে বলে যাচ্ছো যে তোমাকেই চাই আমার
এবং এই আমার জন্যই তোমার ঝোলায়
ভালোবাসার যাবতীয় ফুল!
তোমার গলাবাজিতে চাপা পড়ে যাচ্ছে
ট্রাফিক সার্জনের হুইসেল,
ট্রাকের হর্ন,
এমনকি প্রয়োজনাতিরিক্তি ভলিউমের মাইকে
মুয়াজ্জিনদের আজানের আসমান ফাটানো কোরাস।
কোনো শপথ উচ্চারণ না করেই বলছি, আমি অভিচারী নই,
তাই তোমার অমঙ্গল কামনায় বিনিয়োগ করবো না
কোনো প্রভাত কিংবা সাঁঝ
শুধু তুমি জোর করে আমার প্রেম হওয়া থেকে বিরত থাকো প্লিজ!


একদিন প্রতিবেশী জলে

আকাশজোড়া মেঘ ছিল কি?
ছিল বুঝি! তখন নয়কো রাত;
তুমি ছিলে! আর কে ছিল?
গুনগুনানি। কলিংবেলে হাত।
দুয়ার খোলে, বর্ডার যেমন!
এবং তুমি মাখলে গালে লাল
ঘামছো ক্যানো! তোমার গলা
মুগ্ধ বাতাস, আপনি ওড়ে পাল।
ভিজে যাবো-- সরতেছিলাম
পা কি সরে! হঠাত জোরে টান;
কোথায় মাটি! বুঝতে পারি
বৃষ্টি নয়-- বুকের নিচে বান!
বোকা মাঝি! ডরাও ক্যানো?
ডুবে যাবে! সাঁতার কেহ ভুলে?
ঘোরো ক্যানো গাঙের পাড়ে!
এ্যামনি টান---জোয়ার ওঠে ফুলে!
এই তো আমি বেঁধে এলাম
আমার নৌকা-- দুলছে গলুই তার;
নোঙর বাঁধা! জমলো তবে
এই সুযোগে সিন্ধু অভিসার।
আমি এখন পঁচিশোর্ধ; তুমি?
আমি? আমি তিরিশ পার।
ভয় কী তবে নতুন গাঙে!
বৈঠা বাঁধা সুঠাম দুটি দাঁড়!
ফুঁসছে হাওয়া-- শোনো মাঝি-
গাঙে বাজে তসলিমার ঐ ডাক!
বঙ্গনারী খুঁটায় বাঁধা--
আজ তবে এই নিন্দা ঘচে যাক্!
কথায় কথায় ঢেউ যেন সব
নিচে নদী অথই জলের বান
ডুবে গেছি! গামছা কোথায়!
চরে ঠেকা-- তখন ভাটার টান।


অন্ধকারের ছবি

আলোক ছড়ানো নক্ষত্রের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে
আড়ালের আনাচ-কানাচ
জোনাকির সাথে পাল্লা দিয়ে নেচে যায় প্রান্তরের বট ও বাবলা,
ক্লান্তি মুছে ফেলে ডেকে ওঠে গেরস্তবাড়ির কুকুরগুলো
আর তার চোখে ভেসে ওঠে নিবিড় অস্বস্তি
কি দিন কি রাত বদনাম রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে
উচ্ছিষ্টভোগী চামচারা:
চাঁদমিয়ারা ঘুমের দুশমন! চাঁদমিয়াদের মুখে থুতু!
নাইটগার্ড থেকে বাদুড় কারুরই বুঝতে বাকি থাকে না-
সূর্য নয়, চন্দ্র নয়-সংঘবদ্ধ অন্ধকারই তার সহায়ক শক্তি।


হিরোশিমা

কেয়ামতের এক ইনিংস; অতঃপর পুনরায় জেগে ওঠা;
এই ফিনিক্স পাখিটির নাম হিরোশিমা;
যদিও আজও খাড়া রয়েছে
দগ্ধদালানের মমি গেনবাকু ডোম--
সেদিনের সাক্ষী,
তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা
মোতোইয়াসুর জলে শেকড় দিয়ে
বেড়ে উঠেছে যে-শান্তিপ্রাণ সবুজেরা,
তাদের নিঃশ্বাস থেকে ছড়িয়ে পড়ছে
প্রণয়ের অক্সিজেন
শহরে,--
শহর ছাড়িয়ে পাহাড়ে সমুদ্রে নীচাকাশে সর্বত্র
আর ছাইগুলো ছবি হয়ে কথা বলে
শান্তিস্মৃতি জাদুঘরে।
যারা জানে না এ ইতিহাস,
তাদের মগজে কুলোবে না
শয়তানের শ্মশানে কিভাবে জেগে ওঠে
প্রকৃতির প্রাণ,
কিভাবে খাকি হিংস্রতা রূপান্তরিত হয় বিনয়ী নম্রতায়!
আয়না থেকে চোখ সরিয়ে যদি বন্ধ করি
হিরোশিমা দেখা চোখ,
আলো হয়ে ভেসে ওঠে ফ্লাশব্যাক;
নিজেকে আরেক হিরোশিমা বলে মনে হয়
যদিও কোনোদিনও এ-হৃদয়ে অপ্রেম ছিল না,
ছিল না হিংস্রতা; আর আজো সেখানে
পড়েনিকো কোনো শিজিও হায়াসির ক্যামেরার ফ্লাশ!
ওগো ভালোবাসা, যদি একবার দেখে আসো হিরোশিমা,
তার অতীত এবং বর্তমান,
অতঃপর চোখ তুলে দ্যাখো এই আমাকে আগাগোড়া,
আমার বিশ্বাস-- সেই তুমি
আর কোনোদিনও গড়ে তুলবে না প্রেমবৈরী মনের মজুদ।

11 মন্তব্যসমূহ

Thanks

  1. অনেকদিন পরে ১০টি কবিতা শিরোনামে কবি আমিনুল ইসলামের ১০টি কবিতা পড়লাম। সবগুলো কবিতাই সুখপাঠ্য। খুব ভালো লাগল। সমকালীন নষ্ট রাজনীতির কথা উঠে এসেছে কবিতাগুলোর মধ্যে। সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণার কথা কবির লেখার মধ্যে জ্বলজ্বল করছে। প্রিয় কবিকে আন্তরিক অভিবাদন জানাই।




    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনার পাঠোত্তর সুন্দর অভিমতের জন্য ধন্যবাদ। রাজনৈতিক ঘ্রাণের ব্যাপার আছে তবে কয়েকটি কবিতায় প্রেম-বিশ্বায়ন ইত্যাদি ব্যাপারও আছে। শুভকামনা।

      মুছুন
  2. চমৎকার সব গুলো কবিতা!
    অপূর্ব অসাধারণ ও সময়োপযোগী!
    অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় কবি 💐🌷💐

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. মন্তব্য সুন্দর। কিন্তু মন্তব্যকারীদের " নামহীন " দেখাচ্ছে কেন?

      মুছুন
  3. আপনার কবিতার সাথে বসবাস সেই এক যুগের বেশী সময় ধরে।
    সময়কে ধারালো শব্দাস্ত্রে কুলোকাতে আপনার জুড়ি মেলা ভার। প্রতিটি কবিতাই নানান প্যাটার্ন এবং ভাববস্তুতে পূর্ণ। অভিনন্দন... শাহানা সিরাজী

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনার মন্তব্য পড়ে আনন্দিত বোধ করছি। অনুপ্রাণিতও। অনেকঅনেক ধন্যবাদ কবি শাহানা সিরাজী।

      মুছুন
  4. আপনার মন্তব্য সুন্দর। অজস্র ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  5. আপনার কবিতা তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরির মতো সমাজ রাষ্ট্রের দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান অন্ধকারের অবচেতন ডকইয়ার্ডে দারুন আঘাত করে। আমাদের জন্মলগ্নের কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আপনার কবিতা চাবুকের তীব্র আঘাতে জাতিকে আলোর পথ দেখায়। অসাধারণ সব শব্দচয়নে কবিতাগুলো প্রভাতরশ্মির মতো আলো বিকিরণ করে। এই দেশ ও মাটির আপনি খাঁটি রাজকুমার।

    উত্তরমুছুন
  6. আপনার এই অভিমতে এত বেশি প্রশংসা আছে যে--উত্তর দিতে এক ধরনের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে মনে। কিন্তু অভিমত প্রদান আপনার অধিকার এবং আমি সেটার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আপনার এই অভিমতকে আমি আমার জন্য এবং আমার কবিতার জন্য গভীর ভালোবাসা ও শুভকামনা হিসাবে গ্রহণ করলাম। ধন্যবাদসহ শুভকামনা নিরন্তর।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks

নবীনতর পূর্বতন