ইমদাদুল হক মিলনের “নূর জাহান" উপন্যাসের চরিত্র ও সমাজ বাস্তবতা।। ইলিয়াস মাহমুদ।। article about novel nurzahan by illius mahmud.kuasha

প্রবন্ধঃ



ইমদাদুল হক মিলনের “নূর জাহান" উপন্যাসের চরিত্র  ও সমাজ বাস্তবতা


ইলিয়াস মাহমুদ


ইমদাদুল হক মিলন  ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫, তৎকালীন ঢাকার বিক্রমপুরের লৌহজঙের পয়শা গ্রামে  নানীর বাড়ীতে জন্মগ্রহন করেন ।পেশায় লেখক ও সাংবাদিক। দৈন্যন্দিন জীবনে আমাদের  চারপাশে  ঘটতে থাকা  অন্যায় অবিচারের ভেতর  ভালো কিছুর স্বপ্ন বিভোর হয়ে,  তিনি  তার লেখনির মাধ্যমে আশাবাদ ব্যক্ত করেন । মানুষ বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ ,  অবহেলিত মানুষের বিপন্ন আর্তনাদ মানবতার জয়গানের জন্য তিনি শিল্পের গভীরে অবগাহন করেন । অদম্য লেখক ইমদাদুল হক মিলনের নিয়ত চিন্তাশীল মন ন্যায় বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য তার  ক্ষুরধার লেখনি বার বার সোচ্চার  হয়ে উঠেছে নূরজাহান উপন্যাসে ।

 

দবির গাছি –হামিদা দম্পতির তের বছরের  বাড়ন্ত মেয়ে নুরজাহান ।হরিনীর মত চঞ্চল ,সরলমনা ,সাহসী ও প্রতিবাদী চরিত্র  নূরজাহান । সারাদিন গ্রামের এই বাড়ী সেই বাড়ী ,রাস্তা, ঘাটমাঠ ঘুরে বেড়ায় , হাত পায়ে কাদা মেখে ,মাথার চুল ধুলাবালিতে ধূসর হয়ে উঠে । উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই দেশগ্রামে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে । নতুন চেহারার মানুষ জনে ভরে গেছে গ্রাম । একটি মাত্র সড়কের উন্নতি রাতারাতি বদলে দিচেছ  বিক্রমপুর অঞ্চল । শহরের হাওয়া এসে লেগেছে গ্রামে।গ্রা মে র রূ প প রিব র্ত ন হ য়ে   শ হ রে   রূ পা ন্ত রি ত   হ চে ছ  ।   পা খি র   ক ল কা ক লি   শি শির ভেজা গ্রাম্য প্রকৃতিতে মানুষের শরীরে লেগেছে শহরের উন্নয়নের  হাওয়া । আধুনিকতার বদেীলতে মরে যাচেছ সনাতন নদী । আউস-আমনের জায়গায় চাষ হচেছ ইরি –বোরোর চাষ । সব খানে  উন্নয়নের দাপটে পাল্টে যাচেছ  সব কিছু । মেয়েরা আর গৃহবন্দী  নারী নয়  । তারা  এখন পুরুষের পাশাপাশি সংসারের হাল ধরছে । পুরুষের কাছে নারীর নিত্য প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে এসেছে । দেশে বেড়েছে শিক্ষিতের হার । অন্যায় অবিচারের  বিরূদ্ধে প্রতিবাদী  হয়ে উঠছে  মানুষ ।  এই  রকম প্রেক্ষাপটে জুড়ে নূরজাহান উপন্যাস প্রবাহিত 


ইমদাদুল হক মিলন নূরজাহানের বিষয়ে বর্ণনা করেছেন এভাবে :” বিকালবেলার চমৎকার এক টুকরো আলো এসে পড়েছে নূরজাহানের মুখে। সেই আলোয় অপূর্ব লাগছে মেয়েটিকে। তার শ্যামলা মিষ্টি মুখখানি, ডাগর চোখ, নাকফুল আর স্বপ্নমাখা উদাসীনতা কীরকম অপার্থিব করে তুলেছে তাকে। কুতকুতা চোখে মুগ্ধ হয়ে নূরজাহানকে দেখছে আলী আমজাদ। দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে যে ভিতরে তার জেগে উঠতে চাইছে এক অসুর, খানিক আগেও আলী আমজাদ উদিস (টের) পায়নি। ঠিক তখনই হা হা করা উত্তরের হাওয়াটা এল। সেই হাওয়ায় আলী আমজাদের কিছু হল না, নূরজাহানের কিশোরী শরীর অন্যরকম এক রোমাঞ্চে ভরে গেল। কোনও দিকে না তাকিয়ে ছটফট করে সড়ক থেকে নামল সে। শস্যের চকমাঠ ভেঙে, ভ্রুণ থেকে মাত্র মাথা তুলেছে সবুজ ঘাসডগা, এমন ঘাসজমি ভেঙে জোয়ারে মাছের মতো ছুটতে লাগল।”


ইমদাদুল হক মিলন গল্প বলার জন্যে লেখেন না, বরং গল্প নির্মাণ করেন তিনি। লেখার কৌশল ও প্রকরণ তাঁর আয়ত্বে আছে। আর লেখালেখির প্রতি মিলনের গভীর নিবেদন আমাদের চোখে পড়ে। তিনি জীবনলগ্ন কাহিনি নির্মাণ করেন। ইমদাদুল হক  মিলনের উপন্যাসের বিষয়, ভাষা ও পরিবেশনশৈলীর দিকে নজর দিতে গিয়ে  বলতে হয় জন্মসূত্রে মার্কিনি চীনা ঔপন্যাসিক, ১৯৩৮ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী, পার্ল এস বাক (১৮৯২-১৯৭৩) নোবেল  ভাষণে চীনের উপন্যাস বিষয়ে বলেছেন:” আমিও বিশ্বাস করতাম, প্রকৃত সাহিত্যের সাথে উপন্যাসের কোনো যোগ নেই। বিদ্বানরা এই রকমটিই শিখিয়েছিলেন আমাদের। আমাকে আরো শেখানো হয়েছিল, সাহিত্যে নান্দনিকতা যুক্ত করতে পারেন শুধু বিদগ্ধ মানুষেরাই। জীবনের গভীরতর উৎস থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঝরনাধারার মতো প্রতিভাগুলোকে ঠেকিয়ে রাখতেই যেন বিদ্বানদের মস্তিষ্ক এসব আইনকানুনের জন্ম দিত। প্রতিভা, তা সে যে-মাপেরই হোক না কেন, তার ভূমিকা সবসময় স্রোতস্বিনীর মতো; অন্যদিকে শিল্প, আধুনিক ধ্রুপদী যা-ই হোক-না কেন, তার ভূমিকা খোদিত অবয়বের, যার ওপর স্রোতস্বিনীর জল নেমে আসে অঝোর ধারায়। চীনের উপন্যাসও সেই স্রোতস্বিনী নদীর মতোই, যার নেমে আসাকে স্বাগত জানায় প্রকৃতির পাথর আর বৃক্ষরা, প্রাকৃত মানুষেরা তার জল পানে শীতল হয়, ছায়া আর বিশ্রাম পায় তার আশ্রয়ে। চীনে তাই উপন্যাস মাত্রই ছিল সাধারণ মানুষের মাঝ থেকে উঠে আসা এক অন্যরকম সৃষ্টি, এ ছিল তাদের একান্ত নিজস্ব সম্পদ। এ উপন্যাসের ভাষাও ছিল তাদের নিজস্ব রীতির,…।”

সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখক এই উপন্যাস লিখেন। তবে এই ঘটনা ঘটে সিলেট জেলায়। লেখক ইমদাদুল হক মিলন সিলেটের ভাষা জানেন না। লেখকের বাড়ি  বিক্রমপুর। তাই তিনি বিক্রমপুরের ভাষায় পুরো উপন্যাস লিখেছেন। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে মৌলভীবাজারের ছাতকছড়ায় দ্বিতীয় বিয়ের অপরাধে গ্রাম্য মসজিদের ইমাম মান্নান মাওলানা ফতোয়াবাজি করল, নূরজাহানকে বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে তার ওপর ১০১টি পাথর ছুড়ে মারা হলো।  পাথর তার মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত করে দিল, কিন্তু তার থেকে বেশি ক্ষতবিক্ষত করল তার আত্মসম্মানবোধকে, মানুষ হিসেবে তার পরিচিতিকে এবং সমাজ, মানুষ ও ধর্মের ওপর তার বিশ্বাসকে। এক বিশাল অবিশ্বাস এবং অপমানের ভার সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করল। নূরজাহানকে ফতোয়া দিয়ে দুজন শাগরেদ লাগিয়ে তাকে একটা গর্তে পুরে মসজিদ বানানোর খোয়া—সুরকি ছুড়ে মাওলানা মান্নান তার প্রতিহিংসা মেটাল। নূরজাহানের মুখ ও মাথা রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হলো, সে একসময় টলতে টলতে উঠে বাড়ি গিয়ে অ্যানড্রিন খেল, এবং তার মারা যাওয়ার পর মেদিনীমণ্ডলের দৃশ্যপট বদলে গেল। পুলিশ এলো এবং মাওলানা মান্নানকে ধরে নিয়ে গেল কোমরে দড়ি দিয়ে, যে রকম দড়ি দিয়ে নিষ্পাপ মাকুন্দা কাশেমকে সে চোর সাজিয়ে গ্রাম থেকে বিদেয় করে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের এক কর্তা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, এবার রাজাকার মাওলানাকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পিছু পিছু তাড়া করে আসা বাদলা নাদের হামেদ আলালদ্দি বারেকের মতো কিশোর তরুণরা পাষণ্ড মাওলানাকে যখন ঢিল ছুড়ে মারছে, সে কিছুই বলল না। মাওলানার মুখে-মাথায় ঢিল পড়তে দিল।

লেখক এরপর লেখেন, “আর কথা নাই। হালটের পাশ থেকে তুমুল ক্রোধে বৃষ্টির মতন চাকা পড়তে লাগলো মান্নান মাওলানার মুখে। হাত তুইলা, মুখ নিচা কইরা, চিৎকার চেঁচামেচি কইরা নানানভাবে পোলাপানের চাকার হাত থেকে নিজেরে রক্ষা করতে চাইলো, পারলো না।” এর অনেক আগে মান্নান মাওলানা আর তার ছেলে আতাহারের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার মাকুন্দা কাশেমের ভয়ার্ত আর্তনাদ এবং সেই আর্তনাদে তার শেষ হতে যাওয়া আয়ু কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখার নিষ্ফল চেষ্টার পর লিখেছিলেন, “মাকুন্দা কাশেমের বুকফাটা আর্তনাদে তখন স্তব্ধ হয়েছিল জেগে ওঠা মানুষ, ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছিল শীতরাত্রির নিস্তব্ধতা।” এই  যে ভাষাগত পরিবর্তন  ? কিশোর-তরুণদের হাতে মান্নান মাওলানার শাস্তি পাবার দৃশ্যে  তিনি চলে গেলেন তাঁর শৈশব-কৈশোরের মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের ভাষায়,  বর্ণনাকারীর অবস্থান থেকে, হয়ে গেলেন বাদলা নাদের হামেদদের একজন?

 

নূরজাহান ও মাওলানা মান্নানের প্রথম সংঘাতের চিত্রটি লেখক এঁকেছেন যথেষ্ট মর্মস্পর্শী করে। তাদের সংলাপের মূল বাক্যগুলো এমন:

দউবরার মাইয়া না তুই?

আমার বাপের নাম দইবরা না, দবির গাছি।

…আমার বাপরে কোনও দিন দউবরা কইবেন না।

কইলে কী হইব?

নূরজাহানের প্রায় মুখে এসে গিয়েছিল, কইলে দাড়ি টাইন্না ছিড়া ফালামু।…

এতবড় মাইয়া এত ফরফর কইরা বেড়াচ ক্যা? যেহেনে যাই ওহেনেই দেহি তরে!…

আর যাইতে পারবি না।

…ইঃ যাইতে পারব না। আপনে কি আমার বাপ লাগেন যে আপনের কথা আমার হোনন লাগব?

…আমার মুখের উপরে এতবড় কথা! তরে তো আমি জবেহ কইরা ফালামু। তরে তো কেঐ বাচাইতে পারব না। মজিদের ইমাম অইলে অহনঐ সাল্লিশ (সালিশ) ডাকাইয়া আমি, ল্যাংটা কইরা তর পিডে দোররা মারতাম।…

…আপনে আমার এইডা করবেন। পচা মলবি কিচ্ছু জানে না খালি বড় বড় কথা!… আপনেরে দেখলে মনে হয় একখানা খাডাস (খাটাস), রাজাকার।

নারীর ওপর ফতোয়ার প্রভাবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ‘নূরজাহান’-এ আছে এক বিশেষ সময়কালের কোনো রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা ও প্রার্থিত প্রতিবাদ। শেষে উপায়ন্ত না দেখে এবং মান্নান মাওলানার হাত থেকে নূরজাহানকে বাঁচানোর জন্য রব্বান নামের এক যুবকের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয় দবির গাছি ।সমস্ত খরচ দবিরগাছি'ই করে। ঘটক এখানে দবিরের সাথে প্রতারনা করে। রব্বান বাজারে চায়ের দোকানদারি করে। এই চায়ের দোকানও করে দেন নূরজাহানের বাপ। বিয়ের এক বছর পর ভোরবেলা কাউকে কিচ্ছু না বলে চলে যায় রব্বান। তবে চলে যাওয়ার আগে রব্বান টাকা পয়সা বা গহনা কিছু নেয়নি। শেষে অনেক খোজাখুজি করে জানা যায়- রব্বান মালখা নগরে অনেক আগেই বিয়ে করেছে। তার এক কন্যা সন্তান আছে। সে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে এসেছিল মেদিনী মন্ডল গ্রামে। এখানে এসে নূরজাহানকে বিয়ে করে। এক বছর পর নূরজাহানকে ছেড়ে চলে যায় তার আগের বউ বাচ্চার কাছে। এজন্য সে দবিরগাছির কাছে মাফ চায়। এবং তালাক দেয় নূরজাহানকে।  রব্বান চরিত্রটা বেশ রহস্যময়। রব্বানের সাথে সংসার হলো না নূরজাহানে।  তারপর নূরজাহানের বিয়ে হয় এক বয়স্ক লোকের সাথে। তার আবার তিন কন্যা সন্তান আছে। অসুস্থ স্ত্রী আছে। অসুস্থ স্ত্রী এবং তিন কন্যা সন্তানের দেখা শোনা করার জন্য নূরহাজানকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। অবশ্য বিয়ের আগেই এককানি জমি লিখে দেয় নূরজাহানকে। দ্বিতীয় বিয়েতে নূরজাহানের জীবন ভালোই চলছিল । কিন্তু মান্নান মাওলানা ফতোয়া জারি করেন এই বিয়ে অবৈধ। রব্বান নিখোঁজ, সে তালাক দেয়নি। তালাকের কাগজ নকল।   কিন্তু পেছনে তো লেগে আছে মান্নান মওলানা। সে যেহেতু নূরজাহানকে পায়নি, তাই কঠিন প্রতিশোধ  নিতে চায় অপমানের। নেয়ও শেষ পর্যন্ত। ‘মতলিব আর নূরজাহানি যে সংসার করতাছে, ওইডা সংসার না, ওইডা জিনা, জিনা। ব্যাভিচার’। এই মিথ্যা অভিযোগ তুলে নূরজাহানকে শাস্তি দেয় প্রবল প্রতাপশালী মান্নান মাওলানা। নিজের ফতোয়া অনুযায়ী মাটির গর্তে ফেলে নূরজাহানের ওপর নিক্ষেপ করা হয় শত শত ইটের টুকরা।  লেখক লিখছেন তখনকার পরিস্থিতির কথা:

নূরজাহান তখন আল্লাগো আল্লাহ, আল্লাহ আল্লাহ আল্লাহ বলে চিৎকার করছে। মান্নান মাওলানা একটা কইরা ইটের টুকরা ছোড়েন আর নূরজাহান আল্লাহ বইলা চিৎকার দেয়। মিনারে বসা মোতালেবের পালা একটা সাদা কবুতর স্তব্ধ হয়ে আছে। ওড়ার ক্ষমতা যেন হারায়া ফেলছে কবুতরটি। মাঘ মাসেও পদ্মার দিক থেকে আসে নরম একটু হাওয়া। সেই হাওয়া বন্ধ করেছে তার চলাচল। গাছের পাতারা নিথর হয়ে আছে, চকেমাঠে আর গৃহস্থ বাড়ির উঠানে পড়া রোদ যেন রোদ না, রোদ যেন আসলে গভীর এক অন্ধকার। দিনের বেলাই যেন নেমে গেছে অন্ধকার রাত। মাথার ওপর আছে যে নীলসাদায় আশমানখানি, ওরকম সাতখান আসমানের উপরে আছে মহান আল্লাহপাকের আরশ, মান্নান মাওলানা একটা কইরা ইটের টুকরা ছোড়ে, নূরজাহান আল্লাগো আল্লাহ বলে চিৎকার করে, তার সেই চিৎকার সাত আশমান ভেদ করে চলে যায় আল্লাহপাকের আরশের কাছে। আল্লাহর আরশ কাঁইপা কাঁইপা ওঠে।

 

উপন্যাসে দুইজন মাওলানার দেখা আমরা পাই । একজন ভালো মাওলানা, একজন মন্দ মাওলানা। মন্দ মাওলানা শুধু মিথ্যা বানোয়াট ফতোয়া দেয়। অসামাজিক কাজ করে। কাজের মেয়ের সাথেও ফস্টি-নস্টি করার সুযোগ খুজে। মেদেনী মন্ডল গ্রামের এক বৃদ্ধ মহিলা (ছনুবুড়ি) মারা গেলে তাকে কবর দেওয়া যাবে না। কারন ওই মহিলা চোর ছিলেন ইত্যাদি বলে ফতোয়া দেন মান্নান মাওলানা। এই মন্দ মান্নান মাওলানা একদিন তার কাজের ছেলেকে (কাশেম) খুব মারধর করেন। এবং জেলে পাঠান। মান্নান মাওলানার পুত্রের নাম আতাহার। আতাহারও তার বাবার মতো বিরাট বদ। সে তার মৃত বড় ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে বছরের পর বছর ধরে অসামাজিক সম্পর্ক করে । তিনটা সন্তানও হয়। আতাহার পাঁচ লাখ টাকা যৌতুক নিয়ে বিয়ে করে  চোখ ট্যারা মেয়েকে। যাই হোক, অন্যদিকে ভালো মাওলানা (মহিউদ্দিন) দারুন সব হাদীস বলে মানুষকে সঠিক পথে দেখান। ভালো মাওলানা খান বাড়ির মসজিদের ইমাম। এই মাওলানার কথা শুনে আজিজ গাওয়াল নামের এক কৃপণ লোক ভালো হয়ে যায়। নামাজ রোজা শুরু করে । শেষে এই মওলানা গলায় ক্যান্সার হয়ে মারা যায়।

এরশাদ সাহেব মাওয়া পর্যন্ত রাস্তা পাকা করবেন। এবং এই কাজ তিনি খুব দ্রুত শেষ করতে চান। এই রাস্তা মাটি ফেলে উঁচু করার দায়িত্ব পেয়েছে ঠিকাদার আলী আমজাদ। সে বিরাট বদ লোক। অযথাই সে শ্রমিকদের বকাবকি করে। মারে। তার বউ বাচ্চা আছে অথচ গল্পের নায়িকা 'নূরজাহান'কে ভোগ করতে চায়। বন্ধু বান্ধব নিয়ে প্রচুর মদ খায় সে। উপন্যাসে একজন দুষ্টলোকের সাথে আরেকজন দুষ্টলোকের মন-মানসিকতায় খুব মিলে যায়। আতাহার (দুষ্ট মাওলানার ছেলে) আর আমজাদ বিরাট দুষ্টলোক। মান্নান মাওলানার ছেলে আতাহার আবার ঠিকাদার আলী আমজাদের  ঘনিষ্ঠ বন্ধু । তারা নিয়মিত মদ খায়। সাথে মূরগীর কষানো মাংস। শেষে ঠিকাদার আলী আমজাদের খুব ভয়াবহ অবস্থা হয়। সড়কের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে পারেনি। তার নামে মামলা হয়। তাকে পালিয়ে যেতে হয়। পুলিশ তাকে সিলেট মাজার থেকে গ্রেফতার করে।


নূরজাহান উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নূরজাহান। গ্রামের একটা হাসি খুশি প্রানবন্ত সহজ সরল মেয়ে নূরজাহান। তার বয়স ১৪/১৫ বছর। সে সারাদিন পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়াতে চায়। তার বাবার নাম দবির গাছি। দবির গাছি খেজুরের রসের ব্যবসা করেন এবং তার এক খন্ড জমি আছে। নিজেই চাষবাস করেন। নূর জাহানের মা হামিদা। দরিদ্র একটি পরিবার। দুষ্ট মৌলনার কারনে নূরজাহানের জীবনটা তছনছ হয়ে যায়। বদ মান্নান মাওলানা কিশোরী নূরজাহানকে বিয়ে করতে চায়।অথচ মান্নান মাওলানা নূরজাহানের দাদার সমান বয়স।

এনামুল নামের একজন ঢাকা শহরে থাকে। ঢাকায় ঠিকাদারী ব্যবসা করে। তিনি গ্রামে একটা মসজিদ করেন। এই মসজিদের দায়িত্ব দেওয়া হয় মান্নান মাওলানাকে। ঠিকাদার এনামুল মাত্র দুই মাসে মসজিদ নির্মান শেষ করেন। মসজিদের ইমাম মান্নান মাওলানা। তার বেতন আঠারো শ' টাকা। উপন্যাসে ছনুবুড়ি নামে একটা চরিত্র আছে।দুঃখী বৃদ্ধা মহিলা। ছেলের বউ তাকে খাবার দেয় না। সে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায় খাবারের সন্ধানে। সুযোগ পেলে ক্ষুধার জ্বালায় চুরী ও করে।  এই ছনুবুড়ির এক ছেলে আছে নাম আজিজ। আজিজ গাওয়াল খুব কৃপণ লোক। তার অনেক গুলো ছেলে মেয়ে। সে বাড়ি বাড়ি কাসার থালা বাটি, কলস ইত্যাদি বিক্রি করে। একসময় সে মায়ের  জন্য খুব আহাজারি করে। সে তার বউ এর ভয়ে মায়ের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করে নি। খান বাড়ির মাওলানার সাথে কথা বলার পর আজিজ গাওয়াল পুরোপুরি বদলে যায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শুরু করেন। ছেলে মেয়েদের লেখা পড়ায় মন দেন। এই উপন্যাসে তছি নামে একটা পাগল আছে। যুবতী মেয়ে। গায়ের কাপড় ঠিক থাকে না। একবার এক রিকশাওয়ালা তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেপ করার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রেপ করতে পারেনি। তছি তাকে জন্মের শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে। গলায় গামছা পেচিয়ে মেরেই ফেলেছে। তারপর তছি আর ঘর থেকে বের হয় না। মাথার চুল কামিয়ে ফেলে। তছির ধারনা সে যে এক রিকশাওয়ালাকে মেরে ফেলেছে এই তথ্য পুলিশ জেনে যাবে এবং তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। মরনি নামে এক নারী আছেন- যার মন আকাশের মতো বিশাল। অতি ভালো মানুষ। এই মহিলার স্বামী সন্তান নেই। বোনের ছেলেকে পেলে পুষে বড় করেছেন। বোনের ছেলের নাম মজনু। মজনু ঢাকায় টেইলার্সে কাজ করে। নূরজাহান মনে মনে মজনুকেকে পছন্দ করে। যদি মজনুর খালা মরনি নূরহাজানের সাথে মজনুর বিয়ে দিতেন তাহলে পুরো উপন্যাসের ঘটনা  অন্যরকম হত। হয়তো নূরজাহানকে বিষ খেয়ে মরতে হতো না।


এই গ্রামে আরেকজন মহিলা আছেন, নাম বানেছা। আজিজ গাওয়ালের স্ত্রী। (ছনুবুড়ির ছেলের বউ) বানেছা প্রতি বছর বছর বাচ্চা প্রসব করেন। একবার তার বাচ্চা হবে অথচ বাড়ির কারো মধ্যে কোনো টেনশন নাই। তার স্বামী আজিজ (লোকে বলে আইজ্যা)। বানেছার ব্যথা উঠেছে। অথচ তার স্বামী চুপচাপ। সে ঘুমানোর জন্য ব্যস্ত। বানেছা বলে আমার এমন সময়ে আপনি ঘুমাবেন? যান, ধাই ডেকে আনেন। আজিজ তার ছোট দুই পুত্রকে (হামেদ আর নাদের) ধাই (আলার মা) ডেকে আনতে পাঠালো ভোরে। দুই ভাই হাতে হারিকেন নিয়ে চলল গ্রামের পথ ধরে। তখনও আকাশ ফর্সা হয়নি ।

 

উপন্যাসে একটা চোর আছে। তার নাম মোকসেদ চোরা। লোকে বলে মোকসেইদ্দা চোরা। সে বিরাট চোর। চুরী করতে গিয়ে সে অনেকবার ধরা খেয়েছে। প্রচুর মাইর খেয়েছে। এই মোকসেদ চোর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সে সরাসরি তার গ্রামে চলে আসে। মাওয়া এক সেলুনে চুল দাড়ি কাটে। সে একবার নূরজাহানদের বাড়িতে চুরী করতে যায়। অবশ্য শেষমেষ চুরী করে না। কারন সে বাড়িতে কেউ নেই। খালি বাড়িতে সে চুরী করে না। এটা তার নিয়মের মধ্যে পড়ে না। উপন্যাসের শেষের দিকে এই মোকসেদ চোরা ভালো হয়ে যায়। দরিদ্র স্কুল শিক্ষক মতি স্যারের পরিবারের সাথে মিশে যায়।তার প্রতিবন্ধী দুই পুত্রের দেখভাল করে।


নুরজাহান
উপন্যাসে দেখা যায় হাসু নামের একটি মেয়ে  সতের দিনের জ্বরে পড়ে নারী থেকে পুরুষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা । জ্বর থেকে সেরে উঠে হাসু একটা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পড়ে ঘরে থেকে বেড়িয়ে যায় শহরের উদ্দ্যেশে। উপন্যাসে দুজন ঘটক আছে। লেখক দারুন ভাবে ঘটকের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। ঘটকের ভন্ডামির কারনে নূরজাহানের জীবনে অন্ধকারনেমআসে। কুট্রি এবং আলফু নামে গিরস্ত বাড়ির দু'জন কাজের লোক আছে তাদের চরিত্রও লেখক সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। মান্নান মাওলানার তিন ছেলে। এক ছেলে থাকে জাপান। অসংখ্য চরিত্র পুরো উপন্যাসে।

পুরো উপন্যাসে ছয় জন চরিত্র মারা যায়।একজন আলার মা, খান বাড়ির মসজিদের ইমাম, ছনুবুড়ি, বানেছার সাত দিনের শিশু, আদিল উদ্দিন, দেলোয়ারা আর মারা যায় মান্নান মাওলানার স্ত্রী।  আলার মা একজন ধাই। কথিত আছে উনার হাতে কখনও বাচ্চা মরে না। বানেছার কন্যা সন্তান জন্মের সাত দিন পর মরে যায়- পিতার অবহেলার কারনে। ছনু বুড়ির মৃত্যুর পর তার ছেলে আজিজ গাওয়াল মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন না করার জন্য তার আত্মগ্লানি হয়। আদিল উদ্দিন মাটি কাটে। রাস্তা তৈরির জন্য। ভোরে ফজরের নামাজ পড়া অবস্থায় তার মাটি চাপায় তার মৃত্যু হয়। খুব মর্মান্তিক মৃত্যু। ইচ্ছা করলে তাকে বাঁচানো যেত। একসময় জানা যায় এই আদিল উদ্দিন মজনুর বাপ যে মজনুকে নূরজাহান জন্য  মনে মনে পছন্দ করতো।
 অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে পাই ফুর্তিবাজ পবন,  মাকুন্দা কাশেম, কানা দলিল, নিখিল, মাওয়া বাজারের সেলুনওয়ালা দুলাল, ইব্রার বউ জহুরা, দেলোয়ারার পালিয়ে-যাওয়া ‘সুপুরুষ’ স্বামী আব্দুল মজিদ, ‘উপরে এক ভিতরে আরেক’ আলী আহম্মদ,  পারু, হাসুবালা, মতিমাস্টার, মাওলানা মান্নানের মুখে নূরজাহানকে বিয়ে করার প্রস্তাব শুনে চমকে ওঠা বারো ঘাটের পানি খাওয়া ল্যাংড়া বসির ঘটক, চা-মিস্টির দোকানদার সেন্টু, লেপ-তোশকের কারিগর কাম হাজাম আব্দুল, তামাক-বিড়ির নেশায় আচ্ছন্ন ফইজু, গণেশ নাপিত, রামদাস, ফুলমতি, রব্বান শিকদার, বিড়ি খাওয়া লোক মতলিব, মনির সর্দার সকলে মিলে যেন তৈরি করেছে এক চিলতে বাংলাদেশ। সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্র মান্নান মাওলানা। তার পরিচয় দিচ্ছেন  লেখক এভাবে : ‘চোখ দুইটা মান্নান মাওলানার ষাঁড়ের মতন, যেদিকে তাকান তাকিয়েই থাকেন, সহজে পলক পড়ে না চোখে। যেন কথা বলবার দরকার নাই, হাত পা ব্যবহার করবার দরকার নাই, দৃষ্টিতেই ভস্ম করে ফেলবেন শত্রুপক্ষ। এইজন্য মান্নান মাওলানার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না কেউ। ভুল করে অচেনা কেউ তাকালেও  দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে পলকেই সরিয়ে নেয় চোখ। “

 

লেখক যে কাজটি করেছেন তা হলো মাওলানা মান্নানরে কুৎসিত চরিত্রটিতে প্রয়োজনমত ঘৃণ্য করে তুলেছেন। সামগ্রিকভাবেই মাওলানা মান্নান একটি ঘৃণ্য প্রাণীতে রূপান্তরিত হলেও কয়েকটি বিশেষ ঘটনা চরিত্রটির নির্মাণে প্রধান নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে। তার বাড়ি কাজের লোক কাশেমের সাথে মাওলানার জঘন্য ব্যবহার এবং দবির গাছির কাছ থেকে নেয়া রসের দাম না দেওয়া সে সকলের অন্যতম। দাবির গাছির সাথে বাক বিতণ্ডার এক পর্যায়ে চেতে ওঠে মাওলানা: “নিজে যেমুন মাইয়াডাও অমুন বানাইছন। ডাঙ্গর মাইয়া, দিন নাই রাইত নাই যেহেনে ইচ্ছা ওহেনে যায়, যার লগে ইচ্ছা তার লগে রঙ্গম করে। আমারে কয় রাজাকার। হেইদিনের ছেমড়ি ও রাজাকারের দেখছে কী? হ আমি রাজাকার আছিলাম, কী হইছে? আমি অহনও রাজাকার, কী হইছে? আমার এখখান পশমও তো কেউ ছিঁড়তে পারে না। কোনওদিন পারবও না। রাজাকারগ জোরের তরা দেকছস কী? জোর আছে দেইখাই প্রেসিডেন্ট জিয়া রাজাকারগ কিছু করতে পারে নাই, এরশাদ কিছু করতে পারে নাই। উল্টা রাজাকারগ মন্ত্রিমিনিস্টার বানাইছে। ”


এই মাওলানা ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের কেন্দ্রে থেকেছেন বরাবর। তিনিই হয়ে উঠেছেন সমাজের কুটিল চরিত্রের প্রধান প্রতিনিধি। আর তাকে অতিক্রম করার জন্যই কিশোরী নূরজাহানের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। কাহিনিকার মিলনও চেয়েছেন মান্নান মাওলানার প্রতিপত্তির কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিয়ে একটি সমাধানের সিঁড়ি নির্মাণ করতে । শেষমেষ মান্নান মাওলানাকে পুলিশ গ্রেফতার করে।কোমরে দড়ি বেধে মান্নান মাওলানাকে নিয়ে যাওয়ার সময়, ওসির ইশারাতে গ্রামের ছোট ছোট পিচ্চি পোলাপান মাটির চাকা উড়িয়ে মারে মাওলানার গায়ে। একসময় মান্নান মাওলানা একটা গর্তে পড়ে যায়। গ্রামের সমস্ত পিচ্চিরা এক হয়ে তাকে, ইটের টূকরা, মাটির চাকা উড়িয়ে মারে। মান্নান মাওলানার মুখ রক্তে মাখামাখি হয়। ঠিক নূরজাহানের যেরকম হয়েছিল। উপন্যাসে দুষ্টলোক শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু একজন দুষ্টলোক মান্নান মাওলানার ছেলে আতাহারের কোনো শাস্তি হয়নি। সে পালিয়ে চলে যায় শ্বশুর বাড়ি। আতাহারের শাস্তির দরকার ছিল। নূরজাহান’-এর শেষ অংশে যেভাবে লেখক  দিনযাপনের ভেতর মেদিনীমণ্ডল গ্রামটির একটি চালচিত্র মেলে ধরেছেন, তাতে মান্নান মাওলানার চরিত্রটি অপ্রতিরোধ্য, দূর্বার  মনে হয়েছে। মাকুন্দা কাশেমকে পিটিয়ে মৃতপ্রায় করে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার পর তার অবস্থান আরো  শক্ত হয়েছে। এই উপন্যাসের খল চরিত্রগুলো প্রায় সবাই একটা অপ্রতিরোধ্য অবস্থানে চলে যায়। আতাহার, সড়কের কন্ট্রাক্টর আলী আমজাদ এবং আতাহারের সাঙ্গোপাঙ্গকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে তেমন মনে হয় না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় তাদের পরাজিত হওয়া তো দূরের কথা, তাদের কেউ বিপদে ফেলতে পারে, সে রকম ভাবার অবকাশ নেই। পরিশেষে খল চরিত্রের পরাজয় হয় । মান্নান মাওলানার মুখে যেদিন নূরজাহান থুতু ছিটিয়ে দিল, সেদিন থেকেই তার সেই পরাজয়। ধূর্ত   এই মাওলানা এরপর প্রতিশোধের  রাস্তায় নামল। তার পরিকল্পনা ধরে সে এগোল। দেলোয়ারার ভালোমানুষি এবং এনামুলের বদান্যতায় সে একটি মসজিদের ইমাম হলো। এর আগে সে নূরজাহানকে স্ত্রী হিসেবে অধিকারের চেষ্টা করে বিফল হলেও প্রতিশোধটা সে ঠিকই নিল। তার বিরুদ্ধে একটা ফতোয়া দিয়ে নিজেই বসল বিচারকের আসনে। এইখানে এসে লেখকের জন্য দুটি পথ খোলা ছিল—তিনি বাস্তবকে মেনে নিয়ে মান্নান মাওলানার  বিজয় দেখাতে পারতেন, এবং নূরজাহানকে এক হতভাগ্য ও ট্র্যাজিক চরিত্র হিসেবে  নিয়তির কাছে সমর্পণ করতে পারতেন, যা পাঠে পাঠককে একসময়  বলতে বাধ্য করত, “ বাংলাদেশের নূরজাহানদের কপালে এই  লেখা থাকে, আর  মান্নান মাওলানাদের এমনই  জয়ী হয়”; । কিন্তু তিনি মান্নান মাওলানার পরাজয়টা  প্রকাশ করেছেন।  এই পরাজয়ের ভেতর  অপশক্তির বিরূদ্ধে এক চির সুন্দর বাংলাদেশের জেগে ওঠা হিসেবেও দেখিয়েছেন। মাকুন্দা কাশেমের মৃত্যুর সময় যে মানুষ স্তব্ধ হয়ে ছিল, মান্নান মাওলানার শাস্তি নিশ্চিত  হওয়ায় মানুষ তার চিরচেনা স্তব্ধতা ভেঙে সক্রিয় হয়েছে।  কিশোর—নতুন প্রজন্ম যারা,  মুক্তিযোদ্ধার সন্তান,  সক্রিয় হয়েছে মানুষের বিবেক,  মন ।  এই শাস্তি দেওয়ায় গল্পের আড়ালে জেগে থাকা ইতিহাসটা স্বস্তি পেয়েছে, সত্য জেগে উঠেছে।

Post a Comment

Thanks

নবীনতর পূর্বতন