প্রবন্ধঃ
ইমদাদুল হক মিলনের “নূর জাহান" উপন্যাসের চরিত্র ও সমাজ বাস্তবতা
ইলিয়াস মাহমুদ
ইমদাদুল হক মিলন ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫, তৎকালীন ঢাকার বিক্রমপুরের লৌহজঙের পয়শা গ্রামে নানীর বাড়ীতে জন্মগ্রহন করেন ।পেশায় লেখক ও সাংবাদিক। দৈন্যন্দিন জীবনে আমাদের চারপাশে ঘটতে থাকা অন্যায় অবিচারের ভেতর ভালো কিছুর স্বপ্ন বিভোর হয়ে, তিনি তার লেখনির মাধ্যমে আশাবাদ ব্যক্ত করেন । মানুষ বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ , অবহেলিত মানুষের বিপন্ন আর্তনাদ মানবতার জয়গানের জন্য তিনি শিল্পের গভীরে অবগাহন করেন । অদম্য লেখক ইমদাদুল হক মিলনের নিয়ত চিন্তাশীল মন ন্যায় বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য তার ক্ষুরধার লেখনি বার বার সোচ্চার হয়ে উঠেছে নূরজাহান উপন্যাসে ।
দবির গাছি –হামিদা দম্পতির তের বছরের বাড়ন্ত মেয়ে নুরজাহান ।হরিনীর মত চঞ্চল ,সরলমনা ,সাহসী ও প্রতিবাদী চরিত্র নূরজাহান । সারাদিন গ্রামের এই বাড়ী সেই বাড়ী ,রাস্তা, ঘাটমাঠ ঘুরে বেড়ায় , হাত পায়ে কাদা মেখে ,মাথার চুল ধুলাবালিতে ধূসর হয়ে উঠে । উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই দেশগ্রামে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে । নতুন চেহারার মানুষ জনে ভরে গেছে গ্রাম । একটি মাত্র সড়কের উন্নতি রাতারাতি বদলে দিচেছ বিক্রমপুর অঞ্চল । শহরের হাওয়া এসে লেগেছে গ্রামে।গ্রা মে র রূ প প রিব র্ত ন হ য়ে শ হ রে রূ পা ন্ত রি ত হ চে ছ । পা খি র ক ল কা ক লি শি শির ভেজা গ্রাম্য প্রকৃতিতে মানুষের শরীরে লেগেছে শহরের উন্নয়নের হাওয়া । আধুনিকতার বদেীলতে মরে যাচেছ সনাতন নদী । আউস-আমনের জায়গায় চাষ হচেছ ইরি –বোরোর চাষ । সব খানে উন্নয়নের দাপটে পাল্টে যাচেছ সব কিছু । মেয়েরা আর গৃহবন্দী নারী নয় । তারা এখন পুরুষের পাশাপাশি সংসারের হাল ধরছে । পুরুষের কাছে নারীর নিত্য প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে এসেছে । দেশে বেড়েছে শিক্ষিতের হার । অন্যায় অবিচারের বিরূদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠছে মানুষ । এই রকম প্রেক্ষাপটে জুড়ে নূরজাহান উপন্যাস প্রবাহিত ।
ইমদাদুল হক মিলন নূরজাহানের বিষয়ে বর্ণনা করেছেন এভাবে :” বিকালবেলার চমৎকার এক টুকরো আলো এসে পড়েছে নূরজাহানের মুখে। সেই আলোয় অপূর্ব লাগছে মেয়েটিকে। তার শ্যামলা মিষ্টি মুখখানি, ডাগর চোখ, নাকফুল আর স্বপ্নমাখা উদাসীনতা কীরকম অপার্থিব করে তুলেছে তাকে। কুতকুতা চোখে মুগ্ধ হয়ে নূরজাহানকে দেখছে আলী আমজাদ। দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে যে ভিতরে তার জেগে উঠতে চাইছে এক অসুর, খানিক আগেও আলী আমজাদ উদিস (টের) পায়নি। ঠিক তখনই হা হা করা উত্তরের হাওয়াটা এল। সেই হাওয়ায় আলী আমজাদের কিছু হল না, নূরজাহানের কিশোরী শরীর অন্যরকম এক রোমাঞ্চে ভরে গেল। কোনও দিকে না তাকিয়ে ছটফট করে সড়ক থেকে নামল সে। শস্যের চকমাঠ ভেঙে, ভ্রুণ থেকে মাত্র মাথা তুলেছে সবুজ ঘাসডগা, এমন ঘাসজমি ভেঙে জোয়ারে মাছের মতো ছুটতে লাগল।”
ইমদাদুল হক মিলন গল্প বলার জন্যে লেখেন না, বরং গল্প নির্মাণ করেন তিনি। লেখার কৌশল ও প্রকরণ তাঁর আয়ত্বে আছে। আর লেখালেখির প্রতি মিলনের গভীর নিবেদন আমাদের চোখে পড়ে। তিনি জীবনলগ্ন কাহিনি নির্মাণ করেন। ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাসের বিষয়, ভাষা ও পরিবেশনশৈলীর দিকে নজর দিতে গিয়ে বলতে হয় জন্মসূত্রে মার্কিনি চীনা ঔপন্যাসিক, ১৯৩৮ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী, পার্ল এস বাক (১৮৯২-১৯৭৩) নোবেল ভাষণে চীনের উপন্যাস বিষয়ে বলেছেন:” আমিও বিশ্বাস করতাম, প্রকৃত সাহিত্যের সাথে উপন্যাসের কোনো যোগ নেই। বিদ্বানরা এই রকমটিই শিখিয়েছিলেন আমাদের। আমাকে আরো শেখানো হয়েছিল, সাহিত্যে নান্দনিকতা যুক্ত করতে পারেন শুধু বিদগ্ধ মানুষেরাই। জীবনের গভীরতর উৎস থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঝরনাধারার মতো প্রতিভাগুলোকে ঠেকিয়ে রাখতেই যেন বিদ্বানদের মস্তিষ্ক এসব আইনকানুনের জন্ম দিত। প্রতিভা, তা সে যে-মাপেরই হোক না কেন, তার ভূমিকা সবসময় স্রোতস্বিনীর মতো; অন্যদিকে শিল্প, আধুনিক ধ্রুপদী যা-ই হোক-না কেন, তার ভূমিকা খোদিত অবয়বের, যার ওপর স্রোতস্বিনীর জল নেমে আসে অঝোর ধারায়। চীনের উপন্যাসও সেই স্রোতস্বিনী নদীর মতোই, যার নেমে আসাকে স্বাগত জানায় প্রকৃতির পাথর আর বৃক্ষরা, প্রাকৃত মানুষেরা তার জল পানে শীতল হয়, ছায়া আর বিশ্রাম পায় তার আশ্রয়ে। চীনে তাই উপন্যাস মাত্রই ছিল সাধারণ মানুষের মাঝ থেকে উঠে আসা এক অন্যরকম সৃষ্টি, এ ছিল তাদের একান্ত নিজস্ব সম্পদ। এ উপন্যাসের ভাষাও ছিল তাদের নিজস্ব রীতির,…।”
লেখক এরপর লেখেন, “আর কথা নাই। হালটের পাশ থেকে তুমুল ক্রোধে বৃষ্টির মতন চাকা পড়তে লাগলো মান্নান মাওলানার মুখে। হাত তুইলা, মুখ নিচা কইরা, চিৎকার চেঁচামেচি কইরা নানানভাবে পোলাপানের চাকার হাত থেকে নিজেরে রক্ষা করতে চাইলো, পারলো না।” এর অনেক আগে মান্নান মাওলানা আর তার ছেলে আতাহারের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার মাকুন্দা কাশেমের ভয়ার্ত আর্তনাদ এবং সেই আর্তনাদে তার শেষ হতে যাওয়া আয়ু কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখার নিষ্ফল চেষ্টার পর লিখেছিলেন, “মাকুন্দা কাশেমের বুকফাটা আর্তনাদে তখন স্তব্ধ হয়েছিল জেগে ওঠা মানুষ, ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছিল শীতরাত্রির নিস্তব্ধতা।” এই যে ভাষাগত পরিবর্তন ? কিশোর-তরুণদের হাতে মান্নান মাওলানার শাস্তি পাবার দৃশ্যে তিনি চলে গেলেন তাঁর শৈশব-কৈশোরের মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের ভাষায়, বর্ণনাকারীর অবস্থান থেকে, হয়ে গেলেন বাদলা নাদের হামেদদের একজন?
নূরজাহান ও মাওলানা মান্নানের প্রথম সংঘাতের চিত্রটি লেখক এঁকেছেন যথেষ্ট মর্মস্পর্শী করে। তাদের সংলাপের মূল বাক্যগুলো এমন:
দউবরার মাইয়া না তুই?
…
আমার বাপের নাম দইবরা না, দবির গাছি।
…আমার বাপরে কোনও দিন দউবরা কইবেন না।
কইলে কী হইব?
নূরজাহানের প্রায় মুখে এসে গিয়েছিল, কইলে দাড়ি টাইন্না ছিড়া ফালামু।…
এতবড় মাইয়া এত ফরফর কইরা বেড়াচ ক্যা? যেহেনে যাই ওহেনেই দেহি তরে!…
আর যাইতে পারবি না।
…ইঃ যাইতে পারব না। আপনে কি আমার বাপ লাগেন যে আপনের কথা আমার হোনন লাগব?
…আমার মুখের উপরে এতবড় কথা! তরে তো আমি জবেহ কইরা ফালামু। তরে তো কেঐ বাচাইতে পারব না। মজিদের ইমাম অইলে অহনঐ সাল্লিশ (সালিশ) ডাকাইয়া আমি, ল্যাংটা কইরা তর পিডে দোররা মারতাম।…
…আপনে আমার এইডা করবেন। পচা মলবি কিচ্ছু জানে না খালি বড় বড় কথা!… আপনেরে দেখলে মনে হয় একখানা খাডাস (খাটাস), রাজাকার।
নূরজাহান তখন আল্লাগো আল্লাহ, আল্লাহ আল্লাহ আল্লাহ বলে চিৎকার করছে। মান্নান মাওলানা একটা কইরা ইটের টুকরা ছোড়েন আর নূরজাহান আল্লাহ বইলা চিৎকার দেয়। মিনারে বসা মোতালেবের পালা একটা সাদা কবুতর স্তব্ধ হয়ে আছে। ওড়ার ক্ষমতা যেন হারায়া ফেলছে কবুতরটি। মাঘ মাসেও পদ্মার দিক থেকে আসে নরম একটু হাওয়া। সেই হাওয়া বন্ধ করেছে তার চলাচল। গাছের পাতারা নিথর হয়ে আছে, চকেমাঠে আর গৃহস্থ বাড়ির উঠানে পড়া রোদ যেন রোদ না, রোদ যেন আসলে গভীর এক অন্ধকার। দিনের বেলাই যেন নেমে গেছে অন্ধকার রাত। মাথার ওপর আছে যে নীলসাদায় আশমানখানি, ওরকম সাতখান আসমানের উপরে আছে মহান আল্লাহপাকের আরশ, মান্নান মাওলানা একটা কইরা ইটের টুকরা ছোড়ে, নূরজাহান আল্লাগো আল্লাহ বলে চিৎকার করে, তার সেই চিৎকার সাত আশমান ভেদ করে চলে যায় আল্লাহপাকের আরশের কাছে। আল্লাহর আরশ কাঁইপা কাঁইপা ওঠে।
উপন্যাসে দুইজন মাওলানার দেখা আমরা পাই । একজন ভালো মাওলানা, একজন মন্দ মাওলানা। মন্দ মাওলানা শুধু মিথ্যা বানোয়াট ফতোয়া দেয়। অসামাজিক কাজ করে। কাজের মেয়ের সাথেও ফস্টি-নস্টি করার সুযোগ খুজে। মেদেনী মন্ডল গ্রামের এক বৃদ্ধ মহিলা (ছনুবুড়ি) মারা গেলে তাকে কবর দেওয়া যাবে না। কারন ওই মহিলা চোর ছিলেন ইত্যাদি বলে ফতোয়া দেন মান্নান মাওলানা। এই মন্দ মান্নান মাওলানা একদিন তার কাজের ছেলেকে (কাশেম) খুব মারধর করেন। এবং জেলে পাঠান। মান্নান মাওলানার পুত্রের নাম আতাহার। আতাহারও তার বাবার মতো বিরাট বদ। সে তার মৃত বড় ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে বছরের পর বছর ধরে অসামাজিক সম্পর্ক করে । তিনটা সন্তানও হয়। আতাহার পাঁচ লাখ টাকা যৌতুক নিয়ে বিয়ে করে চোখ ট্যারা মেয়েকে। যাই হোক, অন্যদিকে ভালো মাওলানা (মহিউদ্দিন) দারুন সব হাদীস বলে মানুষকে সঠিক পথে দেখান। ভালো মাওলানা খান বাড়ির মসজিদের ইমাম। এই মাওলানার কথা শুনে আজিজ গাওয়াল নামের এক কৃপণ লোক ভালো হয়ে যায়। নামাজ রোজা শুরু করে । শেষে এই মওলানা গলায় ক্যান্সার হয়ে মারা যায়।এরশাদ সাহেব মাওয়া পর্যন্ত রাস্তা পাকা করবেন। এবং এই কাজ তিনি খুব দ্রুত শেষ করতে চান। এই রাস্তা মাটি ফেলে উঁচু করার দায়িত্ব পেয়েছে ঠিকাদার আলী আমজাদ। সে বিরাট বদ লোক। অযথাই সে শ্রমিকদের বকাবকি করে। মারে। তার বউ বাচ্চা আছে অথচ গল্পের নায়িকা 'নূরজাহান'কে ভোগ করতে চায়। বন্ধু বান্ধব নিয়ে প্রচুর মদ খায় সে। উপন্যাসে একজন দুষ্টলোকের সাথে আরেকজন দুষ্টলোকের মন-মানসিকতায় খুব মিলে যায়। আতাহার (দুষ্ট মাওলানার ছেলে) আর আমজাদ বিরাট দুষ্টলোক। মান্নান মাওলানার ছেলে আতাহার আবার ঠিকাদার আলী আমজাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । তারা নিয়মিত মদ খায়। সাথে মূরগীর কষানো মাংস। শেষে ঠিকাদার আলী আমজাদের খুব ভয়াবহ অবস্থা হয়। সড়কের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে পারেনি। তার নামে মামলা হয়। তাকে পালিয়ে যেতে হয়। পুলিশ তাকে সিলেট মাজার থেকে গ্রেফতার করে।
![]() |
নুরজাহান |
লেখক যে কাজটি করেছেন তা হলো মাওলানা মান্নানরে কুৎসিত চরিত্রটিতে প্রয়োজনমত ঘৃণ্য করে তুলেছেন। সামগ্রিকভাবেই মাওলানা মান্নান একটি ঘৃণ্য প্রাণীতে রূপান্তরিত হলেও কয়েকটি বিশেষ ঘটনা চরিত্রটির নির্মাণে প্রধান নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে। তার বাড়ি কাজের লোক কাশেমের সাথে মাওলানার জঘন্য ব্যবহার এবং দবির গাছির কাছ থেকে নেয়া রসের দাম না দেওয়া সে সকলের অন্যতম। দাবির গাছির সাথে বাক বিতণ্ডার এক পর্যায়ে চেতে ওঠে মাওলানা: “নিজে যেমুন মাইয়াডাও অমুন বানাইছন। ডাঙ্গর মাইয়া, দিন নাই রাইত নাই যেহেনে ইচ্ছা ওহেনে যায়, যার লগে ইচ্ছা তার লগে রঙ্গম করে। আমারে কয় রাজাকার। হেইদিনের ছেমড়ি ও রাজাকারের দেখছে কী? হ আমি রাজাকার আছিলাম, কী হইছে? আমি অহনও রাজাকার, কী হইছে? আমার এখখান পশমও তো কেউ ছিঁড়তে পারে না। কোনওদিন পারবও না। রাজাকারগ জোরের তরা দেকছস কী? জোর আছে দেইখাই প্রেসিডেন্ট জিয়া রাজাকারগ কিছু করতে পারে নাই, এরশাদ কিছু করতে পারে নাই। উল্টা রাজাকারগ মন্ত্রিমিনিস্টার বানাইছে। ”
এই মাওলানা ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের কেন্দ্রে থেকেছেন বরাবর। তিনিই হয়ে উঠেছেন সমাজের কুটিল চরিত্রের প্রধান প্রতিনিধি। আর তাকে অতিক্রম করার জন্যই কিশোরী নূরজাহানের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। কাহিনিকার মিলনও চেয়েছেন মান্নান মাওলানার প্রতিপত্তির কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিয়ে একটি সমাধানের সিঁড়ি নির্মাণ করতে । শেষমেষ মান্নান মাওলানাকে পুলিশ গ্রেফতার করে।কোমরে দড়ি বেধে মান্নান মাওলানাকে নিয়ে যাওয়ার সময়, ওসির ইশারাতে গ্রামের ছোট ছোট পিচ্চি পোলাপান মাটির চাকা উড়িয়ে মারে মাওলানার গায়ে। একসময় মান্নান মাওলানা একটা গর্তে পড়ে যায়। গ্রামের সমস্ত পিচ্চিরা এক হয়ে তাকে, ইটের টূকরা, মাটির চাকা উড়িয়ে মারে। মান্নান মাওলানার মুখ রক্তে মাখামাখি হয়। ঠিক নূরজাহানের যেরকম হয়েছিল। উপন্যাসে দুষ্টলোক শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু একজন দুষ্টলোক মান্নান মাওলানার ছেলে আতাহারের কোনো শাস্তি হয়নি। সে পালিয়ে চলে যায় শ্বশুর বাড়ি। আতাহারের শাস্তির দরকার ছিল। নূরজাহান’-এর শেষ অংশে যেভাবে লেখক দিনযাপনের ভেতর মেদিনীমণ্ডল গ্রামটির একটি চালচিত্র মেলে ধরেছেন, তাতে মান্নান মাওলানার চরিত্রটি অপ্রতিরোধ্য, দূর্বার মনে হয়েছে। মাকুন্দা কাশেমকে পিটিয়ে মৃতপ্রায় করে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার পর তার অবস্থান আরো শক্ত হয়েছে। এই উপন্যাসের খল চরিত্রগুলো প্রায় সবাই একটা অপ্রতিরোধ্য অবস্থানে চলে যায়। আতাহার, সড়কের কন্ট্রাক্টর আলী আমজাদ এবং আতাহারের সাঙ্গোপাঙ্গকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে তেমন মনে হয় না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় তাদের পরাজিত হওয়া তো দূরের কথা, তাদের কেউ বিপদে ফেলতে পারে, সে রকম ভাবার অবকাশ নেই। পরিশেষে খল চরিত্রের পরাজয় হয় । মান্নান মাওলানার মুখে যেদিন নূরজাহান থুতু ছিটিয়ে দিল, সেদিন থেকেই তার সেই পরাজয়। ধূর্ত এই মাওলানা এরপর প্রতিশোধের রাস্তায় নামল। তার পরিকল্পনা ধরে সে এগোল। দেলোয়ারার ভালোমানুষি এবং এনামুলের বদান্যতায় সে একটি মসজিদের ইমাম হলো। এর আগে সে নূরজাহানকে স্ত্রী হিসেবে অধিকারের চেষ্টা করে বিফল হলেও প্রতিশোধটা সে ঠিকই নিল। তার বিরুদ্ধে একটা ফতোয়া দিয়ে নিজেই বসল বিচারকের আসনে। এইখানে এসে লেখকের জন্য দুটি পথ খোলা ছিল—তিনি বাস্তবকে মেনে নিয়ে মান্নান মাওলানার বিজয় দেখাতে পারতেন, এবং নূরজাহানকে এক হতভাগ্য ও ট্র্যাজিক চরিত্র হিসেবে নিয়তির কাছে সমর্পণ করতে পারতেন, যা পাঠে পাঠককে একসময় বলতে বাধ্য করত, “ বাংলাদেশের নূরজাহানদের কপালে এই লেখা থাকে, আর মান্নান মাওলানাদের এমনই জয়ী হয়”; । কিন্তু তিনি মান্নান মাওলানার পরাজয়টা প্রকাশ করেছেন। এই পরাজয়ের ভেতর অপশক্তির বিরূদ্ধে এক চির সুন্দর বাংলাদেশের জেগে ওঠা হিসেবেও দেখিয়েছেন। মাকুন্দা কাশেমের মৃত্যুর সময় যে মানুষ স্তব্ধ হয়ে ছিল, মান্নান মাওলানার শাস্তি নিশ্চিত হওয়ায় মানুষ তার চিরচেনা স্তব্ধতা ভেঙে সক্রিয় হয়েছে। কিশোর—নতুন প্রজন্ম যারা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, সক্রিয় হয়েছে মানুষের বিবেক, মন । এই শাস্তি দেওয়ায় গল্পের আড়ালে জেগে থাকা ইতিহাসটা স্বস্তি পেয়েছে, সত্য জেগে উঠেছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks