প্রবন্ধ।। আনওয়ার আহমেদ কবি ও কবিতা।। অনন্য রাসেল।। কুয়াশা article by anonno rasel.kuasha

প্রবন্ধ।। আনওয়ার আহমেদ কবি ও কবিতা।। অনন্য রাসেল।। কুয়াশা article by anonno rasel.kuasha


আনওয়ার আহমেদ কবি ও কবিতা
অনন্য রাসেল


বাংলা কবিতায় ষাটের দশক যেন এক জলন্ড অগ্নিকুণ্ড। প্রতিটি কবি এখানে ঢেলেছেন ঘী।দাউ দাউ করে জ্বলছে সে আগুন।সে আগুনে আলোকিত হয়েছে বাংলা সাহিত্য, বাংলাদেশের সাহিত্য। অগ্নিকুন্ডের মতোই উত্তাপ ছড়িয়ে পুংক্তি পুংক্তিতে অগ্নিবাণ ডাকিয়ে সম্মোহিত করে রেখেছে পাঠককে। শীতের রিক্ততা পেরিয়ে গেছে গীষ্মের উত্তাপে কিন্তু কবিরা তার নিজস্ব বৃত্তের বাহিরে যেতে পারেন নি।নিজেই  নিজের কাছে বরণ করেছেন পরাজয়। 

চঞ্চল আশরাফ লিখেছেন-
"ষাটের যারা বিবেচিত হয়েছেন শ্রেষ্ঠ বলে তাদের কাউকে শেষ পর্যন্ত প্রতিভাবান বলা হয় যায় না।"

রফিক আজাদ,হুমায়ুন আজাদ,আবুল হাসান, আল মাহমুদ আব্দুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুন, মহাদেব সাহা,আনওয়ার আহমদ ছিলেন এই দশকের কবি। 

আনওয়ার আহমেদ(১৯৪১-২০০৩) একজন কবি গল্পকার ও সম্পাদক। লিখেছেন ১৫ টি কবিতার বই,ও গল্পকার ছিলেন তা যেন আমরা ভুলে না-যাই । একটি-দুটি নয়, পনেরোটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে আওয়ার আহমদের। গ্রন্থগুলি এই: ১. বাহান্ন থেকে বাহাত্তর (১৯৭২), ২. শত্রু মিত্র তুমিই একক (১৯৮৩), ৩. শ্রীকান্ত শ্রীকান্ত বলে (১৯৮৪), ৪. রিলকের গোলাপ (১৯৮৭), ৫. মানবসম্মত বিরোধ (১৯৯২), ৬. নির্মাণে আছি (১৯৯৩), ৭. হঠাৎ চলে যাবো (১৯৯৬), ৮. শেষ সম্বল শেষ দান (১৯৯৭), ৯. নীল কষ্টের ডাক (১৯৯৯), ১০. অঙ্গ তোমার কাব্য করে (১৯৯৯), ১১. প্রেম পদাবলী (১৯৯৯), ১২. অটল থাকা ধীর সন্ন্যাস (২০০১), ১৩. উড়ো খই গোবিন্দ নম (২০০২), ১৪. ঊনষাটের পদাবলী (২০০১) এবং ১৫. ষাটের প্রান্ত ছুঁয়ে (২০০১)। আওয়ার আহমদের চারটি গল্পগ্রন্থও বেরিয়েছিল : ১. সতর্ক প্রহরা (১৯৮৩), ২. অন্ধকারের সীমানা (১৯৮৬), ৩. আওয়ার আহমদের গল্প (১৯৯২) এবং ৪ অন্ধ অন্ধকার (২০০২) । ৪টি গল্প গ্রন্থ, আর সম্পাদনা করেছেন লিটল ম্যাগাজিন রুপম,যা১৯৬৫:সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বহমান ছিল।

কবি শামসুর রাহমান তার কাব্য মানসে ফেলেছে দারুণ প্রভাব।কবি তাকে তুলনা করেছেন সুরার সাথে।নিত্য তা, পান করে ফিরে যান  কালির প্রণয়ে।

কবি শামসুর রাহমান শ্রদ্ধাস্পদেষু-

তুমিই আমার সুরা, তোমাকে পানের পর 
করোটির তাঁতে অক্ষর ও মাত্রাবৃত্তের তন্তু বুনন
 টের পাই চৈতন্যের যন্ত্র ও তারে নিমগ্ন মোহন শিস
 অমন শক্তি কই, ভেঙ্গে ছত্রখান হই তোমার প্রতাপে
 তুমি সারির প্রথম থেকে উঠে এসে আমার উত্থানে
 দাও বিশ্বমাত্রিক মার্জিত ডুবুরীর কাজ।

আমার গবীর করপূট ভরে যায় গীতল জ্যোৎস্নায় 
সে জ্যোৎস্নায় স্নান করে খুঁজে পাই স্বচ্ছ স্রোতস্বিনী সেখানেও তুমি 
বর্ণাঢ্য মাছের লীলা নিয়ে আমাকে শেখাও ক্রীড়া 
তবে কি সর্বত্র মননের জলে তোমার অধিষ্ঠান ?

এবার তোমার মন্ত্র ধরে নতুন অন্তরে যাই গণদেবতার কাছে শ্রমের মুক্তো ফুটে আছে জুঁই ফুলে
 তুলে নেয় ভঙ্গুর এ অভাজন গন্ধ ও ভবিষ্যতের দানা 
একে একে ছিঁড়ে যায় প্রাক্তন প্রকরণ 
ধ্বংসন্মুখ ছাদ থেকে আমাকে ধারণ করে নিরঙ্কুশ রথ।
তুমি আমার অন্যতম উচ্চগ্রামের সুরা 
তোমাকে পান করে নিত্য ফিরে যাই কালির প্রণয়ে।

শামসুর রাহমান প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র অনুষ্ঠিত শোকসভায়। সভাপতিত্ব করেন আব্দুল মান্নান সৈয়দ। 

পিতৃহৃদয়ের হাহাকার আর সন্তান প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে আত্মজার প্রতি কবিতায়-

এই শহরেই আছি
আমরা দুজন কতো কাছাকাছি অথচ ভয়াল
বিষাদের অন্ধকারে নিমজ্জিত আজ।

প্রেমিকার কোন বিকল্প হয় না
তাই কবি বলেন-
শত্রু বলো মিত্র বলো তুমিই একক।

সাইকেল হতে পারে প্রতিরোধের অস্ত্র। তাই কবি বলেন
মৃত্যুর পতাকা ছাই করে ওড়াও বাতাসে--
সময়ের করতলে হাত রেখে দাঁড়াও সটান 
এখুনি চালিয়ে দাও তীব্র সাইকেল।

শুভ্র পবিত্র সকাল যেন প্রিয়জন হারানো বিধবার মতো- তাই কবির উচ্চারণ 

আজকের সকাল যেন বিধবার বিষন্ন চেহারা 
সকালের  সুর্য থেকে নেমে আসে থান থান বিধবার শাড়ি।

কবি সম্পাদক হলেও কবিতা প্রেম তাকে নিয়ে এসেছে কবিতার অলিগলিতে 
তাই কবির উচ্চারণ -
"কবিতার নামের বিষ আকন্ঠ করেছি পান আমি
সব দরজায় এঁটে তালা 
নিজেই নিয়েছি বেছে স্বেচ্ছা নির্বাসন।"
-কবিতার জন্য পুংক্তিমালা।

জীবনানন্দ দাশ কবির কাছে 

"গোপন শুশ্রূষা রক্তফুল"

কবির মতে কবিরা হেরে যায় 
বিশ্বাসের আড়ালের গোলক ধাঁধায়"

প্রেমের নানামাত্রিক রুপ প্রকাশ পেয়েছে আনওয়ার আহমেদ এর কবিতায়। ভালবাসা কেবল দূর করতে পারে বর্ণভেদ। কালো হয়ে উঠতে পারে কাঞ্চন 

আমাকে বাসলে ভালো 
যাবে মুছে চেহারার কালো
তুমি হবে তোমার মতন 
পালিশ রঙে রঙে কাঞ্চন। 

কিশোর প্রেমের ছাপ কবিতায় ফুটেছে গোলাপ।
রক্ত আর বেদনা দিয়ে কবি তার নাম লিখেছেন। 

একটি নাম:নাজু
রক্ত আর বেদনার বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা দিয়ে 
লিখেছি একটি নাম: নাজু

উন্মুখ অভিপ্রায় নিয়ে জোড়া হাতে ঢাকা মুখ দেখতে চান তিনি।

কবি সম্পাদক ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন বিশেষ বিশেষ সংখ্যা।সম্পাদকের কাজ রাজ হংসের মতো পঙ্কিল জলের ভেতর থেকে বের করে নিতে হয় কাব্যের অমৃত। বিশেষ সংখ্যার কবিতায় সে কথা যে ধ্বনিত হয়-

তোমাকে সনাক্ত করতে তন্নতন্ন খুঁজি, কোন্ কোণে কোন্ ইঞ্চিতে আছো  নিরিখ ভোঁতা হয়ে খুলে যেতে চায় দ্বিতীয় চোখের কাচে। অবশেষে দেখা পাই-আঁটোসাটো দমচাপা নীল মুখ নিঃশ্বাস টেনে নিতে উপড়ে আসতে চাও হরফ সরিয়ে কী অপরিচ্ছন্ন তুমি, সর্বাঙ্গে মলিনতা, দারুণ কাহিল! তোমার ঘনিষ্ঠ যারা একই দশা, কাঁধে কাঁধে গা জড়াজড়ি করুণ চেহারাই বলে দেয় ব্যাতিহার বহুব্রীহি ব্যাসবাক্যের কথা। কাঁচিহাত তোমাকে সঙ্গীসহ ছোট্ট থালায় জড়ো করে একত্রে মেখেছে নিপুণ, শুনতে চায়নি নিজস্ব জবানী চরণে দিয়েছে খেয়ালবিহীন তড়িঘড়ি ভুল বানানের বেড়ি।  তাহলে তোমাকে সঠিক আত্মার আত্মীয় কি করে চিনতে পারি  তুমিই আমার ভূমিষ্ঠকালের ব্যথা, গর্ভের ধন।  ফুটফুটে শিশু গাল চেপে, কখনো নিতান্ত অবহেলা করে দিয়েছে কালিতে ফেলে বিশ্রী অচেনার রূপ। তোমাকে শুকনো দেখে, আর্ত, কর্কশ মুখে, আমার ভেতরে ব্লেডে কাটা খুনের টাটানি, বুঝে যাই মনন মরণের দুষ্কালে আছি পাঠের ইন্দ্রসভায় বিক্রমে ঢুকে গেছে অপাঠ্য অসুর।

ষাটের দশকে সময় খুব জটিল আকার ধারন করে।আন্দোলন আর মিছিলে মিছিলে মুখরিত রাজপথ।অথচ কবির কবিতা তা থেকে একটু দূরে।কবি যেন আঁকতে পারেননি সময়কে। তার সীমাবদ্ধতার কথা যেন ফুটে উঠেছে নির্মানে আছি কবিতায়।

ক্ষমা চাই মহান সময়
আমার ভাঁড়ারে জমেনি এখনো সুপক্ব শস্যদানা।
নৈবেদ্য দানে নেই যোগ্য ফলের কোয়া 
দীন আমি,পড়ে আছি সৃষ্টির কুয়াশায়।

আনওয়ার আহমেদের কবিতার বিষয় বৈচিত্র্য কম কিন্তু আছে প্রযত্নের ছাপ।কবি সহজ সরল কাব্য ভাষায় নির্মাণ করতে চেয়েছেন কাব্যজগৎ। তার কবিতায় জটিল শব্দ নেই,নেই কবিতার রহস্যময়তা,নেই আলঙ্কারিক কবিভাষা।কিন্তু ছিলো দেখার জগৎ, ছিল আত্মনিষ্ঠতা।তিনি যা যাপন করেছেন,যা দেখেছেন তা পাঠকের কাছে তুলে ধরছেন।পাঠক তার কবিতা পাঠে কাব্যের আনন্দ আস্বাদন করে কিন্তু ব্যথিত হয় কবির সত্তার অপব্যয় দেখে।তার কবি সত্তা শেষ পর্যন্ত সম্পাদকীয় সত্তার সাথে হার মানে।

আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন- "বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের আত্মচরিত্রবান একজন কবি-গল্পকার-সম্পাদক ছিলেন যিনি, তার শ্রেষ্ঠ কবিতার সংগ্রহ থেকে আমরা শুধু তারই পরিচয় পাব না পাব তাঁর কালের কন্ঠস্বর"| আলাপ শেষ করি  কবির সার্থক শেষ কবিতা দিয়ে

ভুল শব্দটি ভুল লিখি বারবার
 সংগম সুখের ফল যেমন সন্তান 
পথপাশে দাঁড়িয়ে থাকে একা একটি গাছ
 সব পাতা ঝরে সে ন্যাংটা আজ।

সূর্যোদয়ে সূর্য জানে সূর্যাস্তের সত্য
 তবু কী দাপট তার সারাবেলা তুমুল রৌদ্রবৃষ্টি
 সূর্যাস্তেও রঙিলা আভায়
 চোখ ঝলসায়
 সিগারেট পুড়ে যেমন ছাই।

মৃত্যুই তবে জীবনের শেষ সত্য! 
পাখি উড়ে যায়, চলে যায়
              পড়ে থাকে পালকের ঘ্রাণ

যাই, যাচ্ছির পরেও 
থেকে যায় কী ভীষণ পিছুটান! 
এক জীবনের গল্পে, আছে শুরু আছে শেষ!

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন